মহাভারত:সৌপ্তিকপর্ব-০০১-০০৫

০১. অশ্বখামার পান্ডবনাশার্থ প্রতিজ্ঞা
জন্মেজয় বলিলেন কহ মুনিবর।
কোন্ জন কি কর্ম্ম করিল অতঃপর।।
মুনি বলে দ্রোণপুত্র রাজার সাক্ষাতে।
মহাঅহঙ্কার করি লাগিল বলিতে।
অবধান মহারাজ কৌরব ঈশ্বর
এক কথা কহি আমি তোমার গোচর।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আর শল্য আদি বীরে।
সেনাপতি করিয়া পূজিলা সমাদরে।
কোন কর্ম্ম তোমার করিল কোন্ জন।
সবে পান্ডবের পক্ষ জানিহ রাজন।
সে কারণে তোমার না হৈল কিছু হিত।
মম ইচ্ছা হয়, কিছু করিব বিহিত।
সেনাপতি কর মোরে কুরু অধিকারী।।
আমর বীরত্ব তুমি জান ভালমতে।
কোন্ জন যুঝিবেক আমার অগ্রেতে।।
ইন্দ্র যম বরুণ কুবের হুতাশন।
মম সনে বিবাদে তরিবে কোন জন।।
একদিন যুক্তি না করিলে মম সনে।
আপন বৈভব তুমি নাশিলা আপনে।।
জনম অবধি আমি তোমার পালিত।
সে কারণে করিবারে চাহি তব হিত।।
আমার প্রতিজ্ঞা এই গুন নরনাথ।
পাঞ্চাল পান্ডবে আজি করিব নিপাত।।
দ্রৌণির বচন গুনি রাজা দুর্য্যোধন।
সাধু সাধু বলিয়া করে নিবেদন।।
যে সব কহিলা মোরে গুরুর নন্দন।
পান্ডবের প্রিয় সবে বুঝিনু এখন।।
আর কেহ নাহি মম গুন মহাশয়।
আপনি যদ্যপি মম ঘুচাও সংশয়।।
সেনাপতি তোমারে করিব আজি ‍আমি।
যদবধি আছি, কিছু হিত করতুমি।।
রাজার বিনয় শুনি দ্রোণের নন্দন।
গর্ব্ব করি বলিল নাশিব সর্ববজন।।
কৌরবের পতি শুনি এতেক বচন।
কৃপেরে চাহিয়া তবে বলিছে তখন।।
শীঘ্রগতি জল আনি দেহ মহামতি।
আজি গুরুপুত্রেরে করিব সেনাপতি।।
এতেক বলিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
দুই বীর চলিলেক জলের কারণ।।
কৃপাচার্য্য কৃতবর্ম্মা চলিল তখনি।
জল অন্বেষণ করে আঁধার রজনী।।
স্থানে স্থানে ভ্রমে, জল খুঁজিয়া না পায়।
একএ হইয়া দোঁহে ভাবেন উপায়।।
রাজার বচনে আসি জল অন্বেষণে।
জল নাহি পাই কি করিব দুই জনে।।
বলিলেন কৃপ, গুন আমার বচন।
যুদ্ধকালে এনেছিল জল সৈন্যগণ।।
সেই জল বিনা আর না দেখি উপায়।
এত বলি দুইজন চলিল তথায়।।
মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত।
কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর মত।।
০২. অশ্বথামাকে সেনাপতির অভিষেক
হেম কলসেতে বারি লয়ে দুইজন।
রাজার নিকটে যায় আনন্দিত মন।।
যথায় আছয়ে রাজা তথায় চলিল।
দুর্য্যোধন নিকটেতে জল আনি দিল।
দেখি আনন্দিত অতি কৌরবের পতি।
অভিষেক করিতে উঠেন শীগ্রগতি।।
উরু ভাঙ্গি পড়িয়াছে উঠিতে না পারে।
স্পর্শ করি দিল বারি অশ্বন্থামা করে।।
আপনি লইয়া বারি ঢালিলেক শিরে।
এইরূপে সেনাপতি করিল দ্রৌনীরে।।
বিদায় হইয়া তবে বীর তিনজন।
পান্ডব শিবিরে যান সত্বর গমন।।
ঘোর অন্ধকার নিশি পথ নাহি চিনি।
ধীরে ধীরে চলি যায়, শব্দ নাহি শুনি।।
হেনমতে কতদূর যায় তিনজন।
বৃক্ষতলে বসি করে কথোপকথন।।
হেনকালে রাজা সেই বৃক্ষের উপরে।
দারুণ সঞ্চান পক্ষী ‍পান দেখিবারে।।
জাগি রহিয়াছে সেই ভক্ষণের তরে।
নিদ্রিত সকল পক্ষী সকল সংসারে।।
দেখিয়া উপায় পেয়ে বলে অশ্বথামা।
এক বুদ্ধি পাইলাম কৃপাচার্য্য মামা।।
কহিতে লাগিল পরে দ্রোণের কুমার।
পাঞ্চাল পান্ডবে আজি করিব সংহার।।
এইমত অম্বথামা কহি দুই বীরে।
হরষিত হয়ে যায় পান্ডব শিবিরে।।
রণজয় করিয়া হরিষ বড় মনে।
সুখে নিদ্রা যায় সব পান্ডব নন্দনে।।
এইকালে তিনজন উত্তরিল তথা।
বীরদর্প করি দ্রোণি কহিলেন কথা।
সবংশে পান্ডবে আজি মারিব সমূলে।
একজন না রাখি ব পান্ডবের কুলে।।
বলিলেন কৃপ ইহা না হয় উচিত।
নিদ্রিত জনেরে নাহি মারি কদাচিত।।
ভয়ার্ত্ত শরণাগত নিদ্রিত যে জন।
কখন না হেন জনে করি প্রহরণ।।
নিষেধ না মানি ইহা যেই জন করে।
পঞ্চম পাতকী মধ্যে গণি যে তাহারে।।
আমার বচন তুমি শুন সাবধানে।
হেন কর্ম্ম বাসনা না কর কদাচনে।।
আপন কুকর্ম্মে মজিলেক দুর্য্যোধন।
ধার্ম্মিক পান্ডবে হিংসা করে অনুক্ষণ।।
পান্ডবের সহায় সম্পদ নারায়ণ।
তাহার অহিত করি জীবে কো জন।।
দুর্য্যোধন হিতাহিত বিচারিয়া মনে।
যত শক্তি আছিল যুঝিল প্রাণপণে।।
তখন নারিলে যুদ্ধ করিবে এখন।
দুর্ব্বদ্ধি ছাড়িয়া তাত স্থির কর মন।।
পিতৃবৈরী যদি চাহ করিতে নিধন।
রণমধ্যে ধরি বাপু কর নিপাতন।।
সংকর্ম্ম করিবে তাত মনে বিচারিলে।
অসৎপথে পদার্পন কিহেতু করিলে।।
সৎকর্ম্ম সাধন তাত করহ যতনে।
অসৎকর্ম্ম করিবারে ইচ্ছা কেন মনে।।
এখন যে কহি আমি গুন সাবধানে।
তিনজন চল যাই ধৃতরাষ্ট্র স্থানে।।
সবাকার অধিকারী হন অন্ধরাজ।
সে যেমত কহিবে করিব সেই কাজ।।
সৌপ্তিকপর্ব্বের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে শুনিলে এ ভব হবে পার।।
কৃপের বচন গুনি দ্রোণের নন্দন।
ইচক্ষু রক্তবর্ণ কহিছে বচন।।
করিয়াছি প্রতিজ্ঞা রাজার বিদ্যমানে।
সকল করিব নষ্ট তোমার বচনে।।
শুভ্রধর্ম্ম আছে হেন কহে জ্ঞানিজন।
শুভ্রধর্ম্ম হয়ে করিবেক প্রতিজ্ঞা পালন।।
দ্রৌণি বলে যাব আমি শিবির ভিতর।
তার ছাড়ি দেহ যদি প্রাণে থাকে ডর।
দুনিয়া কহেন শিব ছদ্মবেশধারী।।
বিকেশ্বর আছি আমি দ্বারের রক্ষণে।
কামা না জিনিয়া পুরে যাইবে কেমনে।।
দুনিয়া কুপিত দ্রৌণি মারে নানা বাণ।
বধ মেলি সে সব গিলেন ভগবান।।
বাণ এড়ে দ্রৌণি খান ত্রিলোচন।
পাখিয়া বিস্ময় মানে দ্রোণের নন্দন।।
বিদ্য ভুণ হৈল আর অস্ত্র নাহি তাতে।
বিস্ময় মানিয়া দ্রোণি লাগিল ভাবিতে।।
অমান্য মনুষ্য নাহি হবে এইজন।
প্রাণ গিলে নর হয়ে, না দেখি এমন।।
জিজ্ঞাসা করিল তবে দ্রোণের নন্দন।
এক নিবেদন মম গুন মহাজন।।
অরুণ আমার অস্ত্র আপনি গিলিলা।
অত্র বাণ খেয়ে কিছু ব্যথিত নহিলা।।
বিদ্য হৈল তুণ মম, বাণ নাহি আর।
তোমার চরিত্র দেখি লাগে চমৎকার।।
কোন দেব তুমি হও কহ মহাশয়।
অনুগ্রহ করি নাশ করহ সংশয়।।
বাতেক বলিল যদি দ্রোণের নন্দন।
বোধিয়া তাহারে কহেন ত্রিলোচন।।
নাহি জান দ্রোণপুত্র আমি কোনজন।
অম্বনাথ নাম মম জানে বিশ্বজন।।
তবশুনি কহে দ্রৌণি ষোড় করি হাত।
পা করি মোরে দ্বার ‍ছাড় বিশ্বনাথ।।
ধূর্জ্জটি বলেন ইহা কেমনে পারিব।
পান্ডবের আজ্ঞা বিনা ছাড়িতে নারিব।।
চিন্তিত হইল দ্রৌণি শুনিয়া বচন।
ভাবে মনে উপায় কি করিব এখন।।
কি করিব কি হইবে ভাবে দ্রৌণি বীর।
শিব পূজা করিব অন্তরে করে স্থির।।
এত বলি গড়ে লিঙ্গ মৃত্তিকা লইআ।
বিশ্বনাথে অর্চ্চিলেন বিল্বপত্র দিআ।।
শত্রুরে করিয়ে ক্ষয় অশেষ প্রকারে।
বলে ছলে কৌশলে নাশিব অকাতরে।।
ক্ষভ্রধর্ম্ম লইয়াছি ব্রাক্ষ্মণ হইয়া।
রাখিব ক্ষভ্রিয়ধর্ম্ম রিপু সংহারিয়া।।
আমারে মন্ত্রণা দিলা নিজশক্তিমত।
কেবা এত অজ্ঞান করিবে সেইমত।।
দুরাচার রিপু মম দ্রুপদ নন্দন।
অন্যায় সমরে তাতে করিল নিধন।।
সেই কোপে আজিও আমার তনু জ্বলে।
নিতান্ত বধিব আজি নিজ বাহুবলে।।
তাহে যেইজন তার হইবে সহায়।
তার সহ মারিয়া পাঠাব যমালয়।।
যেই দিন ধৃস্টদ্যুন্ন নাশিলেক তাতে।
অঙ্গীকার করিয়াছি সবার সাক্ষাতে।।
ব্রক্ষ্মবধী পাতকী অধম দুরাচার।
তাহাকে মারিতে হেন উদ্যম আমার।।
পাঞ্চাল পান্ডবে আমি করিব নিধন।
পরিতুষ্ট হইবে ভুপতি দুর্য্যোধন।।
হর্ত্তা কর্ত্তা অন্নদাতা জনম অবধি।
প্রাণপণ করিয়া তাহার কার্য্য সাধি।।
গৃহমধ্যে শ্রেষ্ঠ যেইজন অন্নদাতা।
তাহারে তুষিতে পাপ নাহিক সর্ব্বথা।।
দুর্য্যোধন তুষিব মারিব পিতৃবৈরি।
সন্তুষ্ট হইবে মোরে কুরু অধিকারী।।
এত বলি গর্জ্জে বীর দ্রোণের নন্দন।
নিঃশব্দে রহেন কৃপ না কহে বচন।।
মহাবেগে যান দ্রৌণি অতি ক্রোধমনে।
পাছু পাছু দুইজনে চলে তাঁর সনে।।
শিবির নিকটে উত্তরিল তিন জন।
পশিতে বিরোধী হৈল নর এক জন।।
বিভূতি ভূষণ তার অঙ্গে ফণিহার।
চতুর্ভূজ ত্রিলোচন শিরে জটাভার।।
ব্যাঘ্রচর্ম্ম পরিধান করতে ডম্বুর।
দিব্যরূপ দ্বার রক্ষা করেন শঙ্কর।
নিষেধ করেন তারে যাইতে ভিতর।।
গঙ্গালজলে পুষ্প দিয়া করিল, অর্চ্চন।
পূজা সারি স্তব করে দ্রোণের নন্দন।।
কাশীরাজ দাস কহে গুন সর্ববজন।
যেইরূপ স্তব করে দ্রোণের নন্দন।।
০৩. অম্বথামা কর্ত্তৃক শিবের স্তব
গুন প্রভু দিগন্বর, বাঞ্চা পূর্ণ কর হয়,
আমি দীন হীন অভাজন।
ক্ষমা কর দোষ যত, আমি তব অনুগত।
নাহি জানি ভজন পূজন।।
আকাশ পাতল ভূমি, স্থাবর জঙ্গম তুমি,
দশ দিক অষ্ট কুলাচল।
ক্ষিতি অপ তেজঃ ব্যোম, পবন ভাস্কর সোম,
তব মুত্তি বিশেষ সকল।।
কি কব তোমার তত্ত্ব, তুমি রজঃ তুমি সত্ত্ব,
তমোগুণে করহ সংহার।
পড়িয়াছি এই দায়, উদ্ধার করহ তায়,
তোমা বিনা কেবা আছে আর।।
ভজনবিহীন জন, হের প্রভু ত্রিলোচন,
লজ্জা রক্ষা কর এইবার।
কাতর এ দীন জানি, কৃপা কর শূলপাণি,
তোমা বিনা গতি কি আমার।।
সুমতি কুমতি দাতা, তুমি সবাকার ধাতা,
পাষন্ড কি জানিবে মহিমা।
ভক্তজনে জানে তত্ত্ব, ও চরণে সদা মত্ত,
গুণাতীত গুণে নাই সীমা।।
তব ভক্ত যেই জন, তার নহে দুঃখী মন,
সদা সুখে বঞ্চে চিরকাল।
অভক্ত তোমার যেই, সদা দুঃখে মরে সেই,
বদ্ধ থাকে নাহি কাটে কাল।।
জ্ঞানোদয় নাহি হয়, সদা অন্ধকারময়,
বৃথা সেই ভ্রমে অবিরত।
না বুঝে ধর্ম্মের মর্ম্ম, যেমতে আপন কর্ম্ম,
ফল পায় সেই সেইমত।।
যদি জ্ঞান হয় তার, তবে ঘুচে অন্ধকার,
তব পদ আশ্রয় করিলে।
দিনে দিনে বাড়ে মান, প ুনঃ হয় পুন্যবান,
ভক্তিতে কেবল ইহা মিলে।।
এমন নামের গুণ নিগুর্ণের জন্মে গুন,
গুণিগণে অধিক বাহুল্য।
অনায়াসে মুক্ত হয়, যেই জন নাম লয়,
পৃথিবীতে নাহি তার তুল্য।
এত বলি দ্রোণপুত্র, স্তব করি শুদ্ধচিত,
মহেশের ভুলাইল মন।
সদয় হইয়া হর, তারে কন নিতে বর,
কি বাসনা বলহ এখন।।
দ্রৌণি বলে এই বর, দেহ দেব দিগন্বর,
বাঞ্ছা পূর্ণ যেন মম হয়।
করি গিয়া শত্রুনাশ, দ্বার ছাড়ি কৃত্তিবাস,
এই বর দেহ মহাশয়।।
০৪. অশ্বথামার শিবিরে প্রবেশ ও বৃষ্টদ্যুরাদি বধ
গিরিশ বলিল ইহা করিতে না পারি।
পুরী রক্ষা করি আমি হইয়া যে দ্বারী।
এ বর ছাড়িয়া মাগ যাহা লয় মন।
দ্রৌণী বলে অন্য বরে নাহি প্রয়োজন।
যদি কদাচিৎ এই বর নাহি দিবে।
বলিদান গ্রহণ করহ দেব তবে।
দিব্য অস্ত্র যুড়ি অগ্রে জ্বালিল অনল।
পুড়িয়া মরিতে যায় দ্রৌণি মহাবল।
বহুস্তব করিতে সে না করিল ত্রুটি।
নিবারিয়া বর মাগ বলিলা ধূর্জ্জটি।
দ্রৌণি বলে যদি বর দিবে ত্রিলোচন।
রুপায় করহ মম প্রতিজ্ঞা পূরণ।
স্তবে বশ শঙ্কর দিলেন সেই বর।
পুনরপি বলে দ্রোণি যুড়ি দুই কর।।
আর এক অনুগ্রহ কর শূলপাণি।
কৃপা করি দেহ মোরে তব খড়গখানি।।
খড়গ দিয় অন্তরে গেলেন পশুপতি।
কৃপেরে চাহিয়া বলে দ্রৌণি মহামতি।
দ্বার আশুলিয়া দোঁহে রহ এইখানে।
কাটিও তাহার ‍মাথা আসিবে যে জনে।।
খড়গ হস্তে শিবিরে পশিল বীরবর।
নিদ্রাগত ধৃষ্টদ্যৃন্ন খট্টার উপর।
পিতৃবৈরী পেয়ে বীর মহাকোপমনে।
হাসিয়া ধরিল তবে পাঞ্চাল নন্দন।
খড়েগ মুন্ড কাটি মোরে না কর নিধন।
যুদ্ধ করি কর বীর স্বকার্য্য সাধন।
দ্রৌণি বলে ব্রক্ষ্মবধী দুষ্ট দুরাচার।
পশুবৎ করি তোরে করিব সংহার।
এত শুনি ধৃস্টদ্যুন্ন কহে আরবার।
বিনা যুদ্ধে না মারিহ দ্রোণের কুমার।।
যুদ্ধেতে হইলে মৃত্যু স্বর্গেতে গমন।
এই কার্য্য কর বীর দ্রোণের নন্দন।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বচন গুণিয়া নাহি শুনে।
বজ্রমুষ্টি কীল তায় মারে ক্রোধমনে।
হস্তপদ উদরেতে করিল প্রবেশ।
পশুবৎ করিয়া ভাঙ্গিল মধ্যদেশ।
ভীম যেন কীচকেরে করিলে সংহার।
সেইমত করিলেন কুষ্মান্ড আকার।
একেশ্বর দ্রোণপুত্র মারে সবাকারে।
নিশাযোগে ঘোর রণ শিবির ভিতরে।
হাহাকার মহাশব্দ হয় ‍‌আচন্বিতে।
প্রাণভয়ে পলাইতে চাহে দ্বারপথে।
অসি হস্তে দুইজন রক্ষা করে দ্বার।
বাহির হইতে তারা করয়ে সংহার।।
বিপাকে পড়িয়া তারা না দেখে নিষ্কৃতি।
ঘোর রণ করে সবে দ্রৌণির সংহতি।।
দ্রোণপুত্র অম্বথামা রণেতে প্রচন্ড
কাটিল সকল সেনা করি খন্ড খন্ড।
দাবানল বন যেন করয়ে দাহন।
সেইমত কাটে সেনা দ্রোণের নন্দন।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ছিল এক ঘরে।
এক ঠাঁই শুয়েছিল পঞ্চ সহোদরে।
হাত বুলাইয়া দেখে দ্রোণের নন্দন।
ভাবিল বুলাইয়া দেখে দ্রোণের নন্দন।
ভাবিল পান্ডব এই ভাই পঞ্চজন।
মুখে বস্ত্র বান্ধিয়া কাটিয়া পাড়ে শির।
একে একে পঞ্চমুন্ড কাটে দ্রৌণি বীর।
পঞ্চমুন্ড বসনে বান্ধিয়া দ্রোণসুত।
পান্ডবে শিখন্ডী ধনুর্ব্বাণ ণিল হাতে।
করয়ে দারুণ যুদ্ধ দ্রৌণির সহিতে।
বাণে বাণ নিবারয়ে দ্রোণের কুমার।
এইরূপে মহাযুদ্ধ করে মহামার।
তীক্ষ্ম অসি লয়ে বীর দ্রোণের কুমার।
মন্ডলী করিয়া যুঝে বীর অবতার।
ধরাধরি করি দোঁহে করে মহারণ।
মুন্ডে মুন্ডে বুকে বুকে চরণে চরণ।।
মল্লযুদ্ধ করি দোঁহে ক্ষিতিতলে পড়ি।
করিয়া অতুল যুদ্ধ যায় গড়াগড়ি।
কখন উপরে দ্রৌণি শিকন্ডী কখন।
দোঁহার প্রহারে দোঁহে অতি ক্রোধমন।
প্রাণপণে শিখন্ডী মারয়ে দ্রোণসুতে।
নাহি ফুটে অঙ্গে তার দৈববল হৈতে।।
বজ্রমুষ্ট্যাঘাত মারে শিখন্ডীর মাথে।
ভাঙ্গিল মস্তকখান বজ্রমুষ্ট্যাঘাতে।
এইমত শিকন্ডীকে করিয়া সংহার।
একজন অবশেষে না রাখিল আর।
পঞ্চমুন্ড লয়ে দ্রোণি চলে হরষিতে।
দোহাকার সঙ্গে আসি মিলিল দ্বারেতে।
দ্রোণি বলিলেন মম প্রতিজ্ঞা পূরণ।
পান্ডব প্রভৃতি আর নাহি একজন।
পঞ্চ পান্ডবের মুন্ড দেখহ সাক্ষাতে।
দুর্য্যোধন দিব, লয়ে চলহ ত্বরিতে।
রাজার নিকটে আসি বীর তিনজন।
দপূ করি কহে কথা দ্রোণের নন্দন।।
অবধানে কথা শুন রাজা দুর্য্যোধন।
মারিলাম তব শ্ত্রু পান্ডুর নন্দন।।
পাঞ্চাল বিরাট আদি যত বীর ছিল।
সকলে আমার হাতে আজি মারা গেল।
যে প্রতিজ্ঞা করিলাম সাক্ষাতে তোমার।
আজি আমি করিলাম পালন তাহার।
পঞ্চ পান্ডবের মুন্ড দেখহ সাক্ষাতে।
এক জন না রাখিনু পান্ডব সৈন্যেতে।।
এত শুনি হরষিত হৈল দুর্য্যোধন।
সাধু সাধু বলি রাজা বলিল বচন।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।
০৫. হর্ষ-বিষাদে দুর্য্যোধনের মৃত্যু
পড়িয়া আছিল রাজা ভুমির উপর।
বাহুযুগে ভর দিয়া উঠিল সত্বর।।
রিপু নাশ গুনি রাজা তুস্ট হৈল চিত্তে।
পান্ডবের মুন্ড রাজা চাহিলে দেখিতে।।
ধন্য মহাবীর তুমি গুরুর নন্দন।
আমার পরম কার্য্য করিলে সাধন।।
পঞ্চমুন্ড দেহ আমি দেখিব নয়নে।
ভীমের মস্তক আমি ভাঙ্গিব চরণে।।
শুনি পঞ্চমুন্ড দ্রৌণি দিল সেইক্ষণে।
হাত বুলাইয়া দেখে রাজা দুর্য্যোধনে।।
কৃষ্ণার দ্বিতীয় পুত্র ভীমের আকৃতি।
ভীম বলি সেই মুন্ড ভাঙ্গিয়া ফেলিল।।
তিলবৎ মুন্ড গোটা গুড়া হয়ে গেল।
দেখিয়া কৌরবপতি মানিল বিষ্ময়।।
পান্ডবের মুন্ড নহে জানিল নিশ্চয়।
একে একে পঞ্চমুন্ড ভাঙ্গে দুর্য্যোধন।
জানিল পান্ডব নহে এই পঞ্চজন।।
পর্ব্বত সদৃশ মম গদা গুরুতর।
কত প্রহারিনু তার মস্তক উপর।।
পর্ব্বত ভাঙ্গিতে পারে করিয়া আঘাত।
দুরন্ত রাক্ষসগলেণ করিল নিপাত।
মারে বক হিড়িন্ব কির্ম্মীর নিশাচর।।
জটাসুর কীচক শতেক সহোদর।
হেন ভীমে কাটিতে কি দ্রৌণির শকতি।
এত বলি নিম্বাস ছাড়িল কুরুপতি।।
বিষাদ ভাবিয়া কহে দ্রোনের নন্দনে।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ভাই পঞ্চজনে।।
শিশুগণে সংহারিয়া কি কার্য্য সাধিলা।
কুরুকুলে জলপিন্ড দিতে না রাখিলা।।
পান্ডবে মারিতে পার কাহার শকতি।
যাহার সহায় হরি কমলার পতি।।
নির্ব্বংশ করিলে তুমি ভাই পঞ্চজনে।
করুকুল বংশহীন হৈল এত দিনে।।
এত বলি বিষাদ করিল বহুতর।
হরিষ বিষাদে রাজা ত্যজে কলেবর।
কাহার শরণ লবচ কে করিবে ত্রাণ।
তব কর্ম্মদোষে আজি হারাইব প্রাণ।।
এইরূপে খেদ করি করয়ে বিচার।
দম্ভ করি বলে তবে দ্রোণের কুমার।।
রণ করি পান্ডবে পাঠায় যমালয়।
মারিব পান্ডবে আমি কহিনু নিশ্চয়।।
ব্রক্ষ্ম অস্ত্র আছে যেই আমার সদনে।
কার শক্তি হইবেক তাহার বারণে।।
এইমত তিনজনে করিয়া বিচার।
ভাবে রণসিন্ধু মধ্যে কিসে হব পার।।
এইরূপে তিনজন ভাবিতে লাগিল।
ইতিমধ্যে বিভাবরী প্রভাত হইল।
প্রাণভয়ে তিনজন তথা নাহি রয়।
চলিল নগর মুখে সশঙ্ক হৃদয়।।
ভারত সৌপ্তিকপর্ব্ব অপূর্ব্ব কথন।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচন।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র