কংস-নারদ সংবাদ

একদা মুনিসত্তম নারদ, ত্রিতন্ত্রী বীণাতে তান সংযোগে হরি গুণানুকীর্তণ করতে করতে বিমানপথে কংস মহারাজের সভাস্থলে উপস্থিত হলেন, সে সর্ব সুহৃদ সাধুতম মহর্ষিকে দর্শন করে কংস রাজা রাজসিংহাসন হতে সত্বর অবতরণ করে অভ্যর্থণা করলেন। রত্নরঞ্জিত আসন রাজা নিজ হস্তে লয়ে মুনিবরকে বসালেন। অত:পর অষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। কংসরাজের স্বাগত জিজ্ঞাসায় নারদ উত্তরদান করে বললেন নরনাথ! তোমার সহিত আমার গূঢ় কথা বলতে হবে। সে বাক্য শুনে কংসরাজ চমকে গেলেন। না জানি মুনিবর কি কথা বলেন। তাই মুনিবরসহ কংসরাজ মন্ত্রনা ভবনে প্রবেশ করলেন। মন্ত্রনাগৃহের মধ্যে উভয়েই যথাযোগ্য আসনে আসীন হয়ে মহর্ষি নারদ গুপ্ত বৃত্তান্ত সকল দুষ্টমতি কংসকে বলতে লাগলেন। নারদ বললেন,” মহারাজ! তোমার হিতার্থে গুহ্যতম কথা সকল বলছি মন দিয়ে শ্রবণ কর। যাঁকে নন্দ নন্দন কৃষ্ণ বলে শুনেছ, যিনি সম্প্রতি গোকুলে বাস করছেন, যিনি কমল নয়ন, যিনি নবনীরদ শ্যামসুন্দর এবং যাঁকে সখাগণ অভিলাষবশত: পুষ্পের মালা গেথে বিভূষিত করে স্থিরনয়নে অবলোকন করেন, তিনিই দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ইহাতে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। আর যিনি ভীমপরাক্রম রাম তিনি রোহিণীর গর্ভ সম্ভব সন্তান, তিনিই দেবকীর সপ্তম গর্ভজাত সন্তান, কেহ যাতে জানিতে না পারে এ প্রকারে অত্যন্ত গোপনে এ দুটো সন্তানকে বসুদেব নন্দের গৃহে রেখে এসেছে। সে সুকুমার মহাবাহুদ্বয়ই তোমার তৃণাবর্ত্ত প্রভৃতি মহাসুর সকলকে পরাভূত করেছে। পূর্বে যে কন্যা তোমার হতে হতে অন্তরীক্ষে প্রস্থান করেন, তিনিই নন্দরাজের তনয়া, কেবল তোমাকে প্রতারিত করবার জন্যই বসুদেব কর্তৃক এ কাজটি করা হয়েছিল। নারদ মু্খে নিগূঢ় বাক্য শ্রবণ করে দুরাচার কংস ক্রোধে অধীর হয়ে উঠে এবং তৎক্ষণাৎ চর্মকোষ হতে শানিত তলোয়ার বের করে বসুদেবের সহিত বেদকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। তখন দেবর্ষি নারদ বহুবিধ প্রবোধ দিয়ে তাকে শান্ত করে নিজ আশ্রমে গমন করলেন। তারপর কংস নিজ মনে কিছু মন্ত্রণা করলেন এবং মন্ত্রীগণের সহিত মন্ত্রণা করে অক্রুরকে ডেকে পাঠালেন। অক্রুর আসামাত্রই কংস কহে,“হে ধীমন! তুমি একবার গোকুলে গমন কর। বসুদেব নন্দন রামকৃষ্ণ, গোপবালকের ছলে গোপরাজ নন্দের গৃহে বাস করছে। সে বালকবীরদ্বয়কে সত্বরই মথুরাপুর আনয়ন করবে। আমার আজ্ঞা শিরোধার্য। এ অন্যথা যেন না হয়। অবশ্যই মল্ল যুদ্ধে চানুর, মুষ্টিক প্রভৃতি মল্ল সে কুমারদ্বয়কে পরাজিত করতে পারবে।” মহামতী অক্রুর দূরাচার কংসের এরকম আদেশ প্রাপ্ত হয়ে রথ নিয়ে বিচিত্রপুরী গোকুল অভিমুখে যাত্রা করলেন। গোকুলে পৌছার আগেই সারথীকে মথুরাভিমুখে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। অক্রুর রামকৃষ্ণ দর্শন লালসায় পদব্রজে হেটে ব্রজরাজ পথে গমন করতে লাগলেন। গমনকালে অক্রুর মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন “আমি পাপিষ্ঠ কংসের দূত। হরি কি আমাকে দর্শন দিয়ে কৃতার্থ করবেন? মনে হয় করবেন না। আবার পরক্ষণেই মনে হয় কেনই বা করবেন না? তিনি তো অন্তর্যামী সকল ব্যক্তিরই অন্তর্গত ভাব তাঁর অজানা নয়। অতএব আমার অভিলাষ কৃষ্ণের অজানা নয়।” এ সকল ভাবিতে ভাবিতে অক্রুর গোকুলের দিকে গমন করতে লাগল। এদিকে ভক্ত বৎসল্য কৃষ্ণ ভক্তের অভিলাষ পূর্ণ করতে বলদেবকে বললেন,“দাদা! চল আজ আমরা জননীর নিকট হতে গোষ্ঠ বিহারের সজ্জা করে আসি।” বলে উভয়েই জননীর নিকট উপস্থিত হলেন। মৃদু স্বরে হাস্য করতে করতে কৃষ্ণ বললেন,“জননী! আমরা আজ গোচারণে গমন করব না কিন্তু গৃহাঙ্গনেই সেই মত ক্রীড়া করব। আমাদিগকে গোষ্ঠবিহারের সজ্জা করে দাও।” কৃষ্ণের সুমধুর বাক্যবলি শ্রবণ করে যশোদা ও রোহিণী উভয়ে খুবই সন্তষ্ট হলেন। অন্যদিনের চেয়ে রামকৃষ্ণকে অধিক বেশি করে সুসজ্জিত করতে লাগলেন। রাম-কৃষ্ণের সহজেই ত্রিলোক রঞ্জন, তদুপরি আবার বিবিধ রত্নাভরণ অলকাবলীতে বিভূষিত দনমণ্ডল, মস্তকে মণিরঞ্জিত, বিচিত্রচূড়া, রামের নীল বসন ও কৃষ্ণের পীত বসন, কটিতটে বিচিত্র ধড়া ও তদুপরি কিঙ্কিণীজাল, চরণে রতনময় নূপুর হায়! কি অপূর্ব শোভা, অন্তরীক্ষে উপস্থিত অমরাগণ সেই শোভা দর্শন করে স্বীয় স্বীয় জন্মের সফলতা এবং কতই কৃতার্থতা স্বীকার করতে লাগলেন। যশোদা রোহিণীকে সাধুবাদ প্রদান করে তাঁদের মস্তকোপরি পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। রাম-কৃষ্ণকে যদিও সর্বদা তারা দেখতেন তথাপি আজকের সুসজ্জা দেখে যশোদা রোহিণী আনন্দে আত্মহারা ও মুগ্ধ হলেন। এ সময়ে রামকৃষ্ণ রহিরাঙ্গনে এসে ‍যে স্থানে নব নব গোবৎস সকল ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করছে, স্বীয় স্বীয় বৎসকে নিরীক্ষণ করত: ধেনু সকল চর্বিত চর্বণ করছে তার মধ্যে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ বললেন,“ভ্রাতা! ঐ দেখ জননীদ্বয় আমাদের সংগে সংগেই প্রায় এসে মধ্যম দ্বারপার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে। পুত্র বাৎসল্যে বাধিত হয়ে আমাদের রূপ হতে অক্ষিযুযগকে প্রতিনিবৃত্ত করে অন্তপুরেও যেতে পারছে না; আবার কোন অপরিচিত লোকের শংকাতে বহিরঙ্গনেও আসতে পারছে না। অতএব আসুন, বিপিন বিহারের ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিরূপ দেখায়ে জননীদ্বয়ের জন্ম সফল করা যাক।” এ বলিয়া উভয়ে পরিমিলিত হয়ে ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে দণ্ডায়ামান হলেন। এ সময় অক্রুর এসে নন্দের বহির্দ্বারে উপস্থিত হলেন। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হয়ে রাম-কৃষ্ণের ঐরুপ দর্শন করে প্রথমত বিস্ময়াপন্ন হলেন, মনে মনে ভাবতে লাগলেন হায়! একি আশ্চর্য মূর্তি? জন্মাবধি এমন রূপ কখনো দর্শন করিনি। একি মনুষ্যই নাকি? বিবিধ রাগরঞ্জিত বিচিত্র পুত্তলিকা, ঈষৎ ঈষৎ দোলায়িতভার দর্শন করে মনে করলেন যে, এ রামকৃষ্ণ ইহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। নতুবা প্রাকৃত দেহের এমন রূপ কখনো হয় না ভাবিতে ভাবিতে দণ্ডবৎ রামকৃষ্ণকে প্রণাম করল। এরুপ দর্শনে রামকৃষ্ণ ঈষৎ লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,” আপনি কে? কেনই বা এ প্রকারে প্রণতি জানাচ্ছেন।” গাত্রোত্থান করুন বলে ভক্তবৎসল শ্রীকৃষ্ণ অক্রুরকে প্রেমসম্ভাষণে ভুমি হতে উঠালেন। অক্রুর আগমনের কারণ এবং কংসের মন্ত্রণার কথা শ্রীকৃষ্ণকে বললেন। অক্রুর বললেন,“দয়াময়! তোমাদের দুজনকে মধুপুর নিয়ে যেতে দুরাত্মা কংস আমাকে প্রেরণ করেছেন। মন্ত্রীদের সাথে সে দুষ্টমতি পরামর্শ করেছে যে, তোমাদের দুজনকে মল্লযুদ্ধে বধ করবে। কিন্তু আমি জানি তোমরা বিশ্বাধার, তোমাদেরকে জয় করে এমন কেহ নেই। কেবল নিজ লীলাক্রমে পুংদেহ ধারণ করে মায়াময় মনুষ্য রূপে জন্মগ্রহণ করে নন্দের এবং যশোদার পূর্ব জন্মের ফল প্রদান করার জন্য পুত্রছল অবলম্বন করে কংস দূরাচারের এতদিন অজ্ঞাত ছিলেন এবং কংসও জেনে গেছেন যে তুমিই কংস দূরাচারের হন্তা। কালবিলম্ব না করে মধুপুর গমন করে অত্যাচারী কংসকে বিনাশ করুন। আমিও তোমাদের অনুগ্রহে প্রভুকার্য সমাধা করে সেই দূর্বত্তের নিগ্রহ হতে নিষ্কৃতি লাভ করি।” রামকৃষ্ণের মথুরা গমনঃ পিতা-মাতার যন্ত্রণা হবে মনে করে রামকৃষ্ণ ক্ষণকাল যেন বিহ্বল হলেন। প্রেমাশ্রুজলে তাদের নয়ন অভিষিক্ত হল। আবার গোপবৃন্দকে গোপন করবার জন্য তৎক্ষণাৎ তা সম্বরণ করলেন। পিতা নন্দরাজকে বললেন,” পিত! কংস মহারাজ আমাদের দু ভাইকে তার সভাতে নিয়ে যেতে রথ প্রেরণ করেছেন। স্বজনদেরকে বলুন আমাদের সাথে দুধ ঘৃত ননী দেয়ার জন্য। এ কথা শুনে গোপরাজের হৃদয় বিদীর্ণ হল। কিন্ত কেন বিদীর্ণ হল তিনি তা বুঝতে পারলেন না। তিনি এভেবে আনন্দিত হলেন যে রাজসভায় তাদের সন্তানদ্বয়কে কত সম্মান প্রদান করা হবে। রামকৃষ্ণ এর সাথে উপটৌকন দেয়ার জন্য উপানন্দকে বললেন। রামকৃষ্ণ অদর্শনে নন্দরাজ ও যশোদা যখন অসহিষ্ণু হলেন তখন রামকৃষ্ণের নূপুরধ্বনী শ্রবণে করে দ্রুত তাদেরকে নন্দরাজের নিকট নিয়ে গেলেন। নন্দরাজ তাদেরকে দেখে আনন্দে আশ্বস্ত হলেন। পিতৃদর্শনে প্রফূল্লমনা কৃষ্ণ দুই হস্তে পিতার গলদেশ বেষ্টনে করে বক্ষঃস্থলে পড়িলেন। গম্ভীস্বভাব বলদেব ধীরে ধীরে পিতৃপার্শ্বে আগমন করে তাঁর গায়ে গায়ে সংলগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন নন্দরাজ বাৎসল্যরসে আর্দ্র হয়ে দুই হস্ত বিস্তার করে বলদেবের কটি ধরে সস্নেহে চুম্বন করলেন। পরে যশোদা ও রোহিনীকে লক্ষ করে নন্দরাজ বললেন,” তোমরা শুন। মথুরাধিপতি কংসরাজের নিকট হতে রথ লয়ে রামকৃষ্ণকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য তার প্রধান পাত্র অক্রুর এখানে এসেছেন। অতএব আগামীকাল প্রভাতে আমি রামকৃষ্ণকে নিয়ে মথুরা গমন করব। মহারাজ কংসের রাজসম্মান রক্ষার্থে উপটৌকন প্রদানের জন্য ভৃত্যগণকে প্রচুর পরিমান দধি, দুগ্ধ ও ঘৃতাদি আহরণ ও গ্রহণের জন্য আদেশ দিয়েছি।নন্দরাজের এরুপ কথা শুনে যশোদা প্রায় মূর্ছা গেলেন। সাহসে ভর করে সজলনয়নে বলতে লাগরেন,” গোপনাথ! আমি আপনার আজ্ঞাকারিনী ও সহধর্মীনি। হে স্বামী! আমি আপনাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। আপনি আর এ কথা পুনরায় উচ্চারণ করবেন না। তাহলে আজ্ঞা প্রতিপালন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আরও জানবেন যে, আমার প্রাণাধিক রামকৃষ্ণ, শ্রীদামাদি রাখাল-শিশুগণেরও প্রিয়তম সখা; গোষ্ঠে গমনকালে তারা যখন আমার নিকটে এসে বলে- হে মাতা! তোমার রামকৃষ্ণ আমাদের সাথে গোচারণে দিতে হবে, আমার আজ বেশি দূরে যাব না। তখন আমি তাদের কথানুসারে এক এক দিন তাহাদের প্রেরণ করে থাকি। কিন্তু তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাগলিনীর ন্যায় পথ চেয়ে থাকি। কোন কাজে মনঃসংযোগ করতে পারি না। এত কাছে প্রেরণ করেও যখন আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। আর আপনি বহু যোজন দূরে সেই মধুপুরে কিভাবে নিয়ে যাবেন। বলতে বলতে রানীর দুনয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। নন্দরাজ কৃষ্ণকে যশোদার কোলে দিলে তিনি কিছুটা সুস্থবোধ করলে নন্দ পুনরায় বললেন,”যশোদা! গোপাল যে তোমার প্রাণ-পুত্তলিকা, নয়নের মণি, কণ্ঠের ভূষণ ও অঞ্চলের নিধি, তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্ত কেন আমি তোমাকে এ কথা বললাম তা তুমি শ্রবণ কর। মহাত্মা অক্রুর এখানে এসে রামকৃষ্ণের সাথে কি কথা হয়েছে আমি তা জানিনা। তবে কিছুক্ষণ পর রামকৃষ্ণ আমার নিকট গদগদ স্বরে বিনীতভাবে বলল,”হে পিতা! মধুপুর হতে মহাত্মা অক্রুর মহারাজ কংসের আদেশক্রমে আমাদেরকে নিয়ে যাবার জন্য রথ ও নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে আগমন করেছেন। অতএব আপনি শ্রীঘ্রই মথুরানগরে আমাদেরকে উপটৌকনসহ প্রেরণের ব্যবস্থা করুণ। হে যশোদা কুমারের বায়নাবশত: এ কথা বললে আমি স্নেহবশত: সম্মত হয়েছি। বিশেষ করে আমিও সঙ্গে যাব কুমারের রাজসভায় পরিচিতি ও সম্মানিত হবে এ বিবেচনায় মনের আনন্দে তখন বিহ্বল হয়েছিলাম। ভাল-মন্দ কিছুই চিন্তা করতে পরিনি। কিশোর রামকৃষ্ণের ক্ষণকাল অদর্শনে তোমার যে কি অসহ্য অন্তর্বেদনা হবে তা মনে করে আমারও মর্মান্তিক পীড়া হচ্ছে। অতএব আমি উহা হতে নিবৃত্ত হলাম। এখন তুমি তোমার গোপালকে প্রবোধ দিয়া সান্তনা করা। তারপর যশোদা কৃষ্ণের চিবুকে হাত রেখে সস্নেহে বললেন,” পুত্র কৃষ্ণ! তুমি আমাদের পরিত্যাগ করে কোথায় গমন করবে? আমরা তোমাকে ছাড়া কিভাবে জীবন ধারণ করব? হে পুত্র! তুমি আমার অন্ধের নয়ন, বৃদ্ধের অবলম্বন, রোগীর ঔষধ, নির্ধনের ধন ও মৃত ব্যক্তির জীবন স্বরূপ। তোমাকে ছাড়া সংসার অসার ও অন্ধকার বোধ করি এবং বিন্দুমাত্রও সুস্থ্যহৃদয়ে থাকতে পারি না। অতএব তুমি এখন অন্য কোথাও যেতে পারবে না। তখন কৃষ্ণ বললেন,” জননি! আপনি আমাকে আর ঐ রূপ নিষ্ঠুর আদেশ করবেন না। আমার একান্ত অভিলাষ যে, আমি পিতৃদেবের সহিত স্বগণে পরিবেষ্টিত হয়ে মহারাজ কংশের সহিত পরিচিত হই। তাতে আপনার কোন আশংকার সম্ভাবনা নেই। আপনি আমাকে অবাধে তথায় যেতে অনুমতি দিন। নতুবা আমি আর আপনাকে জননি বলে ডাকব না এবং আপনার ক্ষীর সর ও নবনীতাদি কিছুই গ্রহণ করব না। এ কথা বলে কৃষ্ণ বালক সুলভ ব্যবহার প্রকাশ করত: যশোদার কোল হতে দ্রুত নেমে তার অঞ্ছল ধরে নানা প্রকার বাল্যচপলতা প্রকাশ করতে লাগল। তখন নন্দরাণী কৃষ্ণের বিষন্নবদন দেখে নিজেকে বড় অসহায় বোধ করলেন। তাকে পুনরায় সান্তন দেবার চেষ্টা এবং নিবৃত্তি করার জন্য মাথায় ও মুখে ঘন ঘন চুম্বন করতে লাগলেন। কিন্তু কিছূতেই কিছু হল না। বরং জননীর কোলে থেকে কৃষ্ণ স্মিতবদনে বললেন,” মাতা! তুমি যদি আমাকে মধুপুর যেতে অনুমতি না দাও তা হলে আাম আর তোমার স্তনপান করব না। এ বলে নয়নজলে তার বুক আর্দ্র করত লাগলেন। তখন স্নেহপ্রবণ যশোদা কুমারের ঐকান্তিক বাসনা দর্শনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অগত্যা তাকে যেতে অনুমতি দিলেন। তখন অন্তরীক্ষস্থ দেবতরা সকলে ঈষৎ হেসে বলতে লাগলেন,” হায়! এ অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যাঁর মায়ায় বিমোহিত হয়ে আছে তিনি যে এ সামান্য গোপরমণী যশোদাকে মুগ্ধ করবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? অত:পর যশোদা মাতা বলরামকে ডেকে বললেন,” বৎস বলরাম! বিদেশ গমনে তোমার কি অভিমত? বলরাম যথারীতি কৃষ্ণের মতই উত্তর দিলেন এবং বললেন,” মাতা! কিছুদিনের জন্য আমরা মথুরানগরী যাচ্ছি। আপনাদের ভীত বা উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোন কারণ নেই। আমাদের জীবন নাশের কোন আশংকা করবেন না। আপনাদের আশীর্বাদে আমরা অজেয়। এ বলে তাদেরকে সান্তনা দিলেন। রামকৃষ্ণের কথায় যশোদা মাতা আশ্বস্থ হলেও পুত্রের অদর্শন শোক তিনি দূর করতে পারছিলেন না। দুঃখের আশংকায় স্বভাবত:ই নানা বিভীষিকাময় নানা জিনিস দৃশ্যপট হয়। যশোদার ক্ষেত্রেও তাই হল। তখন সন্দিগ্ধচিত্তে যশোদা মাতা রামকে জিজ্ঞাসা করল,” তোমরা তো অদ্যই মধুপুর হতে ফিরবে। প্রত্যুত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন,” তা কি করে সম্ভব। আমাদের আসতে তিন দিন সময় লাগবে। তিন দিন পর আমরা ফিরে আসব। সে জন্য আপনি আর উদ্বিগ্ন হবেন না। দেখুন মাতা এ জগতে গমনাগমনের দ্বারা আপন সন্তান সন্ততিরা সাহসী, পরাক্রমী ও বিখ্যাত হয়, ইহা সকল পিতা মাতারই অভিলাষ। তাতেই তারা নিজেদেরকে সুখী মনে করেন। মাতা আপনি এ সকল জেনেও কেন আকুল হচ্ছেন। যশোদা কৃষ্ণের কথা শ্রবণ করেও হৃদয়ের শোক নিবারণ করতে পারছে না। তাই কৃষ্ণকে ঈষৎ অবজ্ঞা সুরে বললেন,” বৎস! তুমি যা বললে সে সবই সত্য বটে, কিন্ত বাছা! যদি তুমি আমার ন্যায় কারো জননী হতে তাহলে পুত্রের অদর্শনজনিত দুঃখও অনুভব করতে পারতে। আমি বহু আরাধনা করে পুত্ররূপে তোমাকে পেয়েছি। তুমি আমার কণ্ঠাহারের নীলকান্ত মণি ও গৃহের সর্ববধন। তোমাকে ছাড়া আমি পৃথিবীর সকল ধনসম্পদ অতি তুচ্ছ মনে করি। সংসার যতই সুখময় হোক না, তোমাকে ছাড়া আমি তা অসার ও ক্লেশকর মনে করি। আমি তোমাকে বক্ষে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে অবলীলাক্রমে দিন যাপন দ্বারা পরম সুখ ও আনন্দ অনুভব করতে পারি। কিন্তু তোমার তিলমাত্রও অদর্শন আমার কাছে অসহ্য হয়ে থাকে। পালকমাত্র তোমাকে না দেখতে পেযে যখন জগৎ শূন্য ও অন্ধকারময় মনে হয়, তখন এ তিন দিবস কি আমি তোমাকে ব্যতিত সচেতন থাকতে পারি? মধুপুরে গমনে তোমার ঐকান্তিক বাসনা জেনে আর কোন কথা বলল না বটে, কিন্ত পুত্র আমার! সেখানকার বিচিত্র নগরীর সৌন্দর্য দর্শনে ও নানা প্রকার প্রলোভনে পড়ে যেন এ দুঃখিনী জননীকে ভুলে না থাকো। এ নন্দরাণী সজলনয়নে ক্ষান্ত হলেন। রাম আসলে কৃষ্ণ মায়ের কোলে বসে বলল,” আমাকে ক্ষীর সর ও নবনীত দাও। মা যশোদা অতি যত্নসহকারে পুত্রকে ক্ষীর সর ও নবনীত দিলেন। নন্দপুত্র ইতস্তত: গমন করত: কিছু ভক্ষণ করল আর কিছু ভূমিতে নিক্ষিপ্ত করে অপচয় করল। তা দর্শন কের যশোদা ভগিনী রোহিনী বলল,” ভগিনী! আমার জীবন সর্বস্ব রামকে তো উদর পূর্ণ করে ক্ষীর সন নবনীত খাওয়ালে। রোহিনী শুধু প্রত্যুত্তরে হা বলল। যশোদা রোহিনী মনের অবস্থা অনুধাবন করে সস্নেহে রামকে কাছে টেনে কোলে বসিয়ে অতি যত্ন করে ক্ষীর সর নবনীত খাওয়ালেন। রামকৃষ্ণ ভোজন শেষে কৃষ্ণ রামকে বলল,” দাদ! আমাদের সাথে যে সকল রাখাল বালক যাবে তাদের সন্ধান করি।রাম বলল,” কৃষ্ণ! আমরা দুই ভাই দুই পথে গমন করি তাহলে অল্পসময়ের মধ্যে সকল রাখাল বালকগণকে পাব।” এদিকে রামকৃষ্ণ গোষ্ঠে না যাওয়ায় কোন রাখাল বালকও গোচারণে যায়নি। সকলেই নিজ নিজ মায়ে কাছে রইল। ঠিক সে সময় কৃষ্ণ বংশীধ্বনী করল। কৃষ্ণের বংশীধ্বনী শ্রবণ করামাত্রই রাখাল বালকগণ নিজ নিজ মাতাকে বলল,”রাখালরাজ বংশীধ্বনী করে আমাদের আহ্বান করছে। আমরা আর ঘরে বসে থাকতে পারি না।” উর্ধ্বশ্বাসে সকলই কৃষ্ণের নিকট উপনীত হল। অন্যদিকে বলরামও তার শৃঙ্গবেনুর রব শ্রবণ করে তথায় অন্য রাখালবালকগণ উপনীত হল। সেখানে সকল রাখালবালকগণ উপস্থিত হয়ে কিছুক্ষণ ক্রীয়া ও কৌতুক করে ক্লান্ত হয়ে পড়লে রাখালবালকগণ রামকৃষ্ণকে চক্রাকারে বেষ্টন করে সেখানে বসে পড়ল। তারপর কৃষ্ণ বলল,” হে সহচরবৃন্দ! অদ্য রজনী প্রভাত হলে আমরা দুভাই মধুপুরী গমন করব; আমাদের সাথে পিতা নন্দরাজ ও পিতৃব্য উপানন্দসহ অনেকেই আমাদের সাথে গমন করবেন। তোমাদের মধ্যে যারা আমাদের সাথে যেতে চাও তারা রাত্রিশেষে ব্রজরাজপ্রসাদে উপস্থিত থাকবে।” কৃষ্ণের এ কথা শ্রবণ করে সকলই বালকই সেখানে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। অদূরেই কয়েকজন শিশু কৃষ্ণের আজ্ঞাপেক্ষী হয়ে দাঁড়ায়ে রইল। কৃষ্ণ তাদের প্রেমভরে আলিঙ্গণ করে সহাস্যবদনে ও সুমধূর বচনে বলল,” তোমরা নিতান্তই শিশু ও দুগ্ধপোষ্য, জননীর দুগ্ধ পান করা ছাড়া তোমারদের বড় ক্লেশ হবে। তোমরা সেখানে যাওয়া থেকে নিবৃত্তি হও। শিশুগণ কৃষ্ণের বাক্যে নিবৃত্ত হল বটে, কিন্তু কৃষ্ণের অদর্শনে ব্রজপুরে তারা কিভাবে বিচরণ করতে তাভেবে তাদের অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু অন্তর্যামী কৃষ্ণ তাদের মনোবাসনা বুঝতে পেরে ভক্তের বাসনা পূর্ণ করবার জন্য তাদেরকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করলেন। এ জ্ঞানচক্ষুর প্রভাবে ব্রহ্মাণ্ডেরই সর্বএই কৃষ্ণদর্শন করতে লাগল। শিশুগণ অপার আনন্দে মনের সুখে ক্রীড়া ও কৌতুক করতে লাগল। তাদের আর দু:খ রইল না। শ্রীদামাদি গোপবালকগণ মনে মনে চিন্তা করথে লাগল কৃষ্ণ যেমন আমাদের কাছে জীবনসর্ব্বস্ব ও প্রিয়তম সখা, শ্রীরাধিকা প্রভৃতি গোপিনীগণও ততধিক প্রিয়তম; অতএব তিনি তাদের সাথে অদ্য অবশ্যই সাক্ষাৎ করবেন। এ চিন্তা করতে করতে সকলই নিজ নিজ সদনে প্রস্থান করল। এদিকে সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়ছে। চিন্তামনি কৃষ্ণ মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন যে, “অদ্য রাধিকার সাথে একবার দেখা করা দরকার। কিন্ত এরুপ ঘটনাকালে তিনি কি ভাবে রাধার সাথে দেখা করবেন? আমার মথুরাগমন বোধ হয় ইতোমধ্যে সে অবগত হয়েছে। এ সংবাদ শুনে তার মনে যে কি পরিমান মনোবেদনা উপস্থিত হবে তা অনির্বচনীয়। আমি জগৎকে মোহিত করি বলে লোকে আমাকেই জগন্মোহন বলে থাকে। সে আবার আমারই মনোমোহিনী। অতএব বৃষ-ভানু রাজদুহিতার চিত্তকে আর দগ্ধ না করে বরং তার উদ্দেশ্যেই আলিঙ্গন ও তাঁর সহবাসসুখ অনুভব করি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এরুপ চিন্তা করতে করতে প্রজ্বলিত দীপশিখার মত নিষ্প্রভ হয়ে পড়লেন। গৃহে প্রবেশ করে একবার মাত্র জননীকে দর্শন দিয়ে বিশ্রাশ ভবনে প্রবেশ করলেন। যশোদা ভাবলেন গোপাল বুঝি ক্রীড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাই তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না।অতঃপর কৃষ্ণ শ্রীরাধিকার চিন্তায় এতই ব্যাকুল হয়ে পড়লেন যে, ভূমিতে শয্যা গ্রহণ করলেন। মস্তক হতে চূড়া এবং হাত হতে বংশী খসে পড়ল। প্রস্রবনের ন্যায় তাঁর নয়ন হতে জল গণ্ডস্থল বহে পতিত হতে লাগল। কিছূকার পর ভূতল হতে ধূলী-ধূষরিত শরীরে চিন্তা করতে লাগলেন এ কি! সে শ্রীরাধিকার জন্য কেন এমন আকুল হচ্ছেন? এখানে গুরুজন যে কোন সময় আগমন করতে পারেন। তারা যদি তাকে এ অবস্থায় দেখে তবে কি মনে করবে? কত কৌশল উদ্ভাবন করে তিনি শ্রীরাধিকাকে কলঙ্কমোচন করেছেন। তবে কি তার দোষে সে কি চিরকলঙ্কিনী হয়ে থাকবে? এরুপ চিন্তা করতে করতে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকা চিন্তায় মগ্ন হলেও লোকলজ্জার ভয়ে তৎক্ষণাৎ ভূমীতল হতে উঠলেন এবং পুনরায় বেশভূষা ধারণ করলেন। বিশাখার শ্রীমতির নিকট গমন গতযামিনীর কুঞ্জবিহারের কথা স্মরণ করে শ্রীমতি রাধা চিন্তা করতে লাগলেন যদিও ফুলশয্যা প্রীতিকর হয়েছিল তবুও যেন তার মনে হয়েছে প্রাণবল্লভ কৃষ্ণের সেই পরমসুন্দর দেহ কোনমতেই যেন উপযুক্ত হয়নি। তাই সে অদ্য শ্যামসুন্দরের জন্য উপযুক্ত এক পূষ্পাহার গ্রন্থন করবে। শ্রীমতি রাধারানি যখন ঠিক এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন তখন তার সখি চিত্রা আসল। সখিকে দেখে রাধিকা বলল,’’ চিত্রে! আমি মনে মনে তোমার কথাই ভাবছিলাম।” চিত্রা বলল,” হে রাজনন্দিনি! তুমি শ্রীকৃষ্ণের প্রাণ, যোগীন্দ্র মুনীন্দ্রগণ অজ্ঞান অন্ধকার দূর করে যোগদৃষ্টি দ্বারা যাঁকে দর্শন করে; ধ্যান, ধারণা ও সমাধিরও যিনি দূর্লভ, সেই ভগবান কৃষ্ণও তোমার নিরন্তর তোমার চিন্তা করেন- তোমার রুপ ও প্রেম ধ্যান করেন। আমি তো তোমার দাসীমাত্র। পূর্ব পূণ্যকর্মের ফলে তোমার চরণচ্ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছি।” তখন শ্রীমতি রাধিকা বললেন,” হে চিত্রে! আমি অদ্য বিশেষরুপে শ্রীকৃষ্ণের পূজা ও সেবা করার ইচ্ছা পোষণ করছি, এ সময়ে তার আয়োজন করা একান্ত আবশ্যক; এ জন্য তোমাকে আহ্বান করার চিন্তা করছিলাম। এমন সময় তুমি সহসা এখানে উপস্থিত হলে। এখন তুমি সত্ত্বর ললিতা ও চম্পকলতা সমেত অন্যান্য সখিগণকে নিয়ে আমার তমালকুঞ্জে গমন কর। পরে আমি অন্যান্য সহচরীকে নিয়ে সেখানে গমন করব।” পথিমধ্যে শ্রীরাধিকা সখীগণকে সম্বোধনে করে বলতে লাগল ননন্দৃকুটিলা তার বিষয় নিয়ে কোপন স্বভাবের আয়ানের নিকট আর কিছূ অভিযোগ করতে পারবে না। আর করলেও তিতানি আর শুনবেন না। কারণ ঐ দুষ্টার কথানুসারে আয়ন যখন সন্দিগ্দমনা হয়ে তার দোষানুসন্ধান করতে লাগল তখন প্রাণপতি কৃষ্ণের কৌশলে অবশেষে তার প্রতি আর আয়ানের কোন সন্দেহ থাকল না। সুতরা কৃষ্ণ সহবাসে তার আর কোন বাধা নেই। সে এখন অবলীলাক্রমে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম দর্শন ও পূজা করতে পারবে। এরুপ বলতে বলতে তারা তমালকুঞ্জে উপস্থিত হল। চিত্র, চম্পকলতা ও ললিতা প্রভৃতি সখীগণ পুষ্প অবচয়ন করছে। শ্রীরাধিকা সখীগণকে বললেন গতযামিনীর কুসুম কান্ড মনে করে দেখ সকলই উৎকৃষ্ট হয়েছিল কিন্তু পুষ্পমালা তেমন পারিপাটি হয়নি। তাই স্বয়ং শ্রীরাধিকা শ্যামসুন্দরের জন্য কন্ঠোচিত এক মালা গ্রন্থন করবে। সখীগণ সকলে কুঞ্জ কুটীরের ফুলশয্যাদি প্রস্তুত করতে লাগল। আর শ্রীরাধিকা কৃষ্ণগুণ গান করতে করতে পুষ্পমালা চয়ন করতে লাগল। সন্ধ্যাকালে কুলায়স্থ কোকিলাদি বিহঙ্গগণ মাঝে মাঝে কূজনধ্বনি করে বনভূমিকে যেন অমৃতরসে অভিষিক্ত করে, নিাশগমন জেনে মধুপানোন্মত্ত অলিদল ঝংকার করতে করতে যে যার স্থানে প্রস্থান করল। তদ্রুপ নাথসমাগমে প্রফুল্লমনা কুমুদিনী মন্দ মন্দ বায়ুভরে দোদুল্যমান হয়ে সরোবরাসনে বসে চঞ্চলহাস্যে হাসিতে লাগলেন। শ্রীরাধিকা কুঞ্জকানন হতে প্রকৃতির এরুপ অবলোকন করতে করতে মনে মনে বলতে লাগল “ অহো! অধুনা আমার কি সুখঅনুভব করছি। কান্তসহবাসে আসার জন্য আর আমার লোকলাঞ্ছনা ও গুরুগঞ্জনার কোনই আশঙ্খা নেই- এখন অকুতোভয়ে স্বেচ্ছাসুখে তাঁর চরণারবিন্দ দর্শন করতে পারব। যা হোক সে চিরসখাকে দর্শন করলে কলঙ্ক বা লোকলাঞ্চনার আর কিছুই ভয় থাকে না। অহো! সে কৃষ্ণপ্রেমসুধা যে ব্যক্তি একবার পান করে, সে কি বিমলানন্দই না অনুভব করে, জগৎসংসার তার অতি সামান্য বলে জ্ঞান মনে হয়; তাই কৃষ্ণসহবাসে আর কুলভয়ের সম্ভাবনা কি? এভাবে শ্রীরাধিকা নানা চিন্তা করছে এমন সময় ললিতা ও চম্পকলতা তথায় উপস্থিত হলে শ্রীরাধিকা জানতে চান কুঞ্জকুটির কেমন সাজানো হয়েছে? তারা জানান কুঞ্জকুটির এমনভাবে সুসজ্জীভূত ও পুষ্পশয্যা করা হয়েছে যা ইতোপূর্বে হয়নি। শ্রীরাধিকা সখীগণকে বলল“ দেখতো বনমালাখানা কেমন গ্রথিত হয়েছে। তারা বলল“ অতি উৎকৃষ্ট হয়েছে। কৃষ্ণের অতি উপযুক্ত রুপে তৈরী হয়েছে। এখন চলেন আমার কুঞ্জের নিকটে যাই। এদিকে নাথের তথায় আসার সময়ও প্রায় আগত। এ সময় আপনাকে না দেখতে পেলে তিনি কাতর হবেন। সমস্ত সৌন্দের্য্যের মধ্যে আপনিই এখানকার পরম সৌন্দর্য- আপনি ব্যতীত এখানকার সকল সকলই অন্ধকার ও অপ্রীতিকর। অতএব আর বিলম্ব না করে ত্বরায় সে স্থানে চলুন।কিছুদুর গমন করার পর পথিমধ্যে অপরাপর সখী বেষ্ঠিত বিষন্নবদনা প্রাধান সখী বৃন্দাকে দেখতে পেয়ে সেখানে ঠায় দাড়িয়ে রইল। বৃন্দা তাহাদিগকে দেখতে পেয়ে কুঞ্জের ও শ্রীমতী বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইল এবং শোকান্তরে সকলকে বলতে লাগল সখী! এতদিনের পর আর বুঝ আমাদের সকল সুখই বিনষ্ট হল। হতবিধি আমাদের প্রতি বাম হলেন। শুনছি গোবিন্দ আগামীকাল মধুপূরী গমন করবেন। হায় ভগবান আমাদের প্রতি বিমুখ হলেন। অন্যান্য সখীগণ এ কথা শুনে চমকিত ও ক্ষণকাল নিস্তব্ধ হয়ে রইল। কিছূক্ষণ নিরবতার পর চম্পকলতা বললেন“ দূতি! এ কথা সত্য নাও হতে পারে। এ শুধু শ্রুত কথা। শ্রুত কথা সকল সময় সত্য হয় না। তখন বৃন্দা বলল“ আমাদের এমন কি পূণ্যফল যে এরুপ জনরব মিথ্যা হবে? বিশেষত: ইহা জেনে রাখ যে অশুভ কথা প্রায় মিথ্যা হয় না। যাহোক আমি বিশাখা সখীকে গোপনে সংবাদ আনার জন্য প্রেরণ করেছি। তার আসা না পর্যন্ত আমাদিগকে অপেক্ষা করতে হবে। বৃন্দা মনে মনে চিন্তা করতে লাগল কৃষ্ণ সমস্ত ব্রজবাসীগণের জীবনসর্বস্ব ইহা সত্য বটে, তথাপি আমরা যে তাঁর নিমিত্ত কুল, শীল ও মানে জলাঞ্জলি দিয়েছি- লোকলাঞ্ছনা ও গুরুগঞ্ছনার ভয় একেবারেই পরিত্যাগ করে তাঁরই শরণাপন্ন দাসী হয়েছি, সেই চরণেই সমস্ত বিক্রয় করেছি। অতএব আমাদের সর্ব বিনিময়কর্তা সেই ভবসাগরকাণ্ডারী হবি কি আমাদিগকে অকুলপাথাকে নিক্ষেপ করবেন? ইহাও কি কখনও সম্ভব হতে পারে? তিনি কি আমাদিগকে তাঁর প্রেম-নিগড়ে দৃঢ়তর রুপে চিরবদ্ধ জেনেও তাঁর কঠিন বিচ্ছেদবাণে তা কর্তন করবেন? বৃন্দার এ সকল কথাবার্তা শ্রবণ করে প্রায় সকল সখীই শোকাতুর হয়ে রোদন করতে লাগল। কেহ কেহ বলতে লাগল“ বৃন্দে! তুমি আর এরুপ অলক্ষণের কথা বলিও না। আর যদিও বা আমাদের প্রাণভল্লভ কৃষ্ণ মধুপুরী গমন করেন সেতো স্বল্প সময়ের জন্য। আমাদের প্রাণনাথ নিশ্চয় অবগত আছেন যে, তাঁকে ছাড়া আমরা আর কাকেও জানিনা, তবে আমাদিগকে নির্দয় ও নিষ্ঠুরের ন্যায় কেনইবা চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করে যাবেন? কখনই যাবেন না। তখন বৃন্দা বলল“, সখী! তোমরা যে যা কিছুই বলা না কেন কিন্তু যে বিষম অনর্থকর কৃষ্ণবিচ্ছেদযন্ত্রনা সম্মুখে আগত প্রায় জেনে আমাকে অত্যন্ত কাতরও বিহ্বল করেছে।” অত:পর কোন কোন সখী বিশ্বাস না করে অবজ্ঞাসূচক বাক্য প্রয়োগ করতে লাগল। কেহ বা বিশ্বাস না করে উপহাস করতে লাগল। কেহ বা মৌন হয়ে দাড়িয়ে রইল। এরুপে কিছু সময় অতিবাহিত হলো। বৃন্দা সখীগণকে লক্ষ করে বলতে লাগল”, সখী এখন ওকথা থাক। চল আমার বরং কুঞ্জে গিয়ে দেখি কিশোরী কি করছে। আর তাঁর রাত্রবাসের কুসুমশয্যা সম্পন্ন হয়েছে কিনা? এদিকে বিশাখা কৃষ্ণের মথুরাগমন সংবাদ যথার্থ জেনে কৃষ্ণবিচ্ছেদবানে অধৈর্য হয়ে পড়ল এবং বাণবিদ্ধ হরিহীর ন্যায় ছুটাছুটি করতে লাগল। কুঞ্জবনে প্রবেশ করে দূর হতে রাধিকা দেখতে পেল। নিকটে এসে দেখলতে পেল শ্রীরাধিকা সহাস্যবদনে কুসুম হার গ্রন্থন করছেন। এ সময় বিশাখা মনে মনে চিন্তা করতে লাগল শ্রীরাধিকা আপন সুখেই সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু সামনে যে কি বিচ্ছেদ বেদনা অপেক্ষা করছে তার কিছুই সে অনুধাবন করতে পারছে না। সে কেমন করে এ বিচ্ছেদ সংবাদ শ্রীরাধিকা দিবে? পরক্ষণিই আবার চিন্তা করল এ সংবাদ রাধিকাকে অবশ্যেই দিতে হবে। কারণ সে হচ্ছে সকলের প্রধান, সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমতী ও কৃষ্ণের মনমোহিনী। সে নিশ্চয় এ সংবাদ শ্রবণ করা মাত্রই কৃষ্ণের মথুরাগমণে বাধার সৃষ্টি করবে। কিন্তু সে কি করে এমন বেদনাবিধুর সংবাদ রাধিকাকে দিবে? এ জন্য কি তার নাম বিশাখা হয়েছে? এরুপ চিন্তা করতে করতে রাধিকার সামনে গিয়ে প্রণাম করল। রাধিকা বিশাখাকে সহাস্যবদনে জিজ্ঞাসা করল”, বিশাখা তুমি কি এ মাত্র কুঞ্জবন হতে এসেছ? তুমি বল আমার প্রাণবল্লভ কৃষ্ণ কোথায়? তার আসতে বিলম্ব কত? কিন্ত বিশাখা শ্রীরাধিকার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিল না। মৌন হয়ে দাড়িয়ে রইল। শ্রীরাধিকা বিশাখার নিরবতা দর্শন করে চঞ্চল চমকিত চিত্তে বললেন”, বিশষে তুমি আমার সাথে পরিহাস করছ? এ কি তোমার পরিহাসের সময়? শ্রীরাধিকা যখন এমন কথা বলছে ঠিক তখন সখীগণ পরিবেষ্ঠিত হয়ে প্রধান, বৃন্দা ম্লানবদনে সেখানে প্রবেশ করল। সখীগণের বিষন্নভাব প্রদর্শন করে রাধিকা আর স্থির থাকতে পারলেন না। সে পুষ্পাহার পরিত্যাগ করে বৃন্দাকে জিজ্ঞাসা করল”, বৃন্দে! তোমাদেরকে বিষন্ন দেখছি? ইহার কারণ কি? তোমরা পুনরায়ন গুরুজন কর্তৃক আবার তিরষ্কৃত হয়েছে? নাকি প্রাণবল্লভ কৃষ্ণের আগমনবিলম্বে তোমরা বিমর্ষ হয়েছে? তোমাদের বিষন্নভাব আমার মনে নানা সংশয়ের সৃষ্টি করছে। আমার সংশয় দূর করে আমার চিত্তকে স্থির কর। সমস্ত ঘটনা আমাকে বল।”সখীরা শ্রীরাধিকা পরিবেষ্ঠিত হয়ে উপবেশন করল। বৃন্দা বলতে লাগল”, শ্রীমতি! তুমি রমণীকুলে মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কুলরমণীগণের মধ্যে যে সকল গুণ থাকা দরকার তা সবই তোমার আছে। স্বয়ং কৃষ্ণ কেবল তোমাকে অবগত আছেন। আর আমিও তোমাদের পদসেবীকা। তোমার প্রসাদে আমিও তোমায় কিঞ্চিৎ অবগত হয়েছি। তুমি পরমাসুন্দরী ও ধৈয্য ও গাম্ভীর্য্যের আধার। তুমি অতিশয় বুদ্ধিমতী। এখন আমি তোমাকে যে দু:সংবাদ দিব যদি তুমি সাধারণ রমণীগণের মত অসহিষ্ণু না হয়ে বরং কোন উপায় অবলম্ব দ্বারা তা হতে নিষ্কৃতি পাবার চেষ্টা কর, তবেই সকল প্রকার মঙ্গল হবে। নতুবা অনিষ্টের সম্ভাবনা। বৃন্দের এরুপ বাক্য শ্রবণ করে শ্রীরাধিকা নিশ্চিত হতে চেষ্টা করছে যে, কান্ত সর্ম্পকে কোন অমঙ্গলসূচক কথাই হবে। কিন্তু অনুমানে প্রতীয়মান হয় এ অমঙ্গল তার দৈহিক নয়। কারণ যিনি সমস্ত মঙ্গলেরই মঙ্গল তার আবার শারীরিক অমঙ্গল কি? তিনি হয়ত অদ্য বিলাসকাননে আগমন করবেন না। তা শুনেই হয়ত সকলে এত শোকানুল হয়েছে। যাহোক বৃন্দে তুমি আমাকে সবিস্তারে বল। আমার মনের উদ্বেগ দূর কর। আমার ধৈর্য্যচুত্যির কোন সম্ভাবনা নেই। তখন বৃন্দা কিছূ অভয় হয়ে বলতে লাগল”, আজ আমি শ্যামা প্রভৃতি সখীগণকে নিয়ে এখানে আসছিলাম। পথিমধ্যে দুইজন অপরিচিত কামিনীর নিকট শুনলাম আগামী কাল নন্দ-নন্দন মুধুপূরী গমন করবেন। কিন্তু তারা এর বেশী কিছু বলতে পারল না। আমি তখন উদ্বিগ্নমনা হয়ে বিশাখাকে নন্দালয়ে পাঠালাম গোপন সংবাদ আনার জন্য।” বিশাখা নন্দালয় হতে এ সংবাদ আনায়ন করল যে, মথুরাধিপতি কংসের আমন্ত্রণে আগামী কাল শ্রীকৃষ্ণ মথুরা গমন করবেন। বিশাখার নিকট হতে এসকল কথা শ্রবণ করে কিছুক্ষণ সখীগণ মৌন থেকে জনৈক সখী বৃন্দে কে বলল”, বৃন্দে! সত্যি যদি গোপীনাথ ব্রজবালাগণকে অনাথিনী করে মধুপুরে গমন করে তবে এ ফুলশয্যার আর কি প্রয়োজন? এসকল দূরে নিপেক্ষ করাই শ্রেয়। কারণ এগুল দর্শন করলে আরও বিরহনল দ্বিগুণ হবে। তখন শ্রীমতি রাধিকার সকলকে নিবৃত্ত করে বললেন”, তোমরা আর কিছুকাল অপেক্ষা কর। আমার নাথ এখনও বৃন্দাবন ত্যাগ করেনি। তিনি এখনও এখানে আছেন। তাই অনেক আশাও আছে-এ আশা দ্বারাই লোকে জীবিত থাকে। তার বিরহবাণে কুলরমণীগন যে একেবারে মৃতপ্রায় থাকবেন-তিনি তা অবশ্যই অবগত আছেন। অতএব তা বিবেচনা করে তিনি এখানে আসলে আসতেও পারেন। সুরাং ঐ হার ও শয্যা এখন দূরে নিক্ষেপ করা ঠিক হবে না। সখি, আজ যদি বিপিনবিহারী কৃষ্ণ আমাদিগকে অনাথিনী করে চলে যান তবে না জানি আমাদের কি দুর্শদশাই ঘটবে। তাতে তার কি ক্ষতি হবে? তাঁকে তো আর বিরহের অনলে সহ্য করতে হবে না? তখন এক বলল”, হে রাধে! আপনি অমন কথা বলবেন না। কৃষ্ণ যে আপনার বিরহে কাতর হবেন না এ কথা আমাদের বিশ্বাস হয় না। কারণ আপনি যখন অভিমানিনী হয়ে কৃষ্ণকে উপেক্ষা করেছিলেন তখন তিনি আপান শ্রীচরণ পর্যন্ত ধারণ করে সে মানভঞ্জন করেছে। তাই এরুপ চিন্তাকে মনে স্থান দিবেন না।অত:পর শ্রমতি রাধিকা বললেন”, বৃন্দে! আমি অনেক আশা করে এ বিনোদমালা গ্রথিত করেছি। হায়! আমি সে মালা শ্যামের গলায় অর্পণ করতে পারলাম না। অতএব সকলে এ মালা ও কুসুমশয্যা যমুনার জলে নিক্ষেপ কর এবং আমার সকলে উহার গর্ভে প্রবেশ করি। এ বলতে বলতে শ্রীমতি রাধিকা জ্ঞান হারালেন। সখিগণ হাহাকার স্বরে রোদন করতে লাগল। সখিগণ তার চোখে মুখে শীতল জল সেচন করে মূর্চ্ছা ভঙ্গের চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু এ হার ও ফুলশয্যা দেখে কৃষ্ণ বিচ্ছেদ উদ্রেক হয় সেহেতু তা কোন উপকুঞ্জে আড়াল করে রাখা হলো। এ সময় শ্রীমতী রাধিকার সূর্চ্ছা ভঙ্গ হল। শ্রীরাধিকার উক্তি ও শ্রীকৃষ্ণের পথ অবরোধ করতে যাত্রা শ্রীমতী রাধিকা বলল,” সখিগণ! তোমরা সে কুসুমহার এখান হতে আড়াল করেছ। তা কর। কিন্তু সে যে কৃষ্ণ-গুণ-হার যা অবিনশ্বর রুপে আমার হৃদয় কন্ঠে শোভা পাচ্ছে তা তো আর উন্মোচন করতে পারবে না। সে হার এখন অধিকতর কষ্টদায়ক হলেও তার কি প্রতীকার করবে? দেখ সামান্য বনপূষ্প হার যে পর্যন্ত শুষ্ক না ততক্ষণ পর্যন্ত লোকে আদর যত্ন করে তা ধারণ করে; কিন্তু এ তো আর সেরুপ নয়। পাছে কোন দুর্বৃত্ত দেখতে পেয়ে ঐ পরম উৎকৃষ্ট রমণীয় কৃষ্ণ-গুণ-হার বলপূর্বক আমাদের কন্ঠ হহতে কাড়িয়া নেয়, এ ভয়ে আমরা পূর্বেই তাকে হৃদয়মধ্যে অতি যত্নপূর্বক গোপন করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু এখন তাহাই এ সমান্য কুসুম-হার অপেক্ষা শত গুণে ক্লেশকর হয়ে উঠেছে। হায় ব্রজাঙ্গনাগণ! আমাদের কি দুরদৃষ্ট? আমরা ঈদৃশ পরমধনে বঞ্চিত হচ্ছি। হায় বিধাতা! তুমি কেন আমাদিগকে চির পরাধীনী-কুল-কামিনী করে সৃজন করে এরুপে নিগঢ়াবদ্ধ করলে? তা না হলে এমন সময়ে তো অনায়সেই প্রাণনাথের সাথে মধুপুরী গমন করতাম। হায় সখিগণ! যখন আমরা কৃষ্ণ-কলঙ্কিনী বলে আখ্যায়িত হয়েছিলাম, তখন আমরা কুল-বন্ধন হতে এক প্রকার মুক্তি লাভ করেছিলাম। কিন্তু সখা কৃষ্ণ আবার কত যত্নে কত কৌশলে আমাদের সে কলঙ্ক মোচন করে আমাদের তৎকালোচিত কামনা পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হয় সেরুপ না করলে বড়ই ভাল হতো। কারণ সে সুচক্রী কৃষ্ণ, কলঙ্ক মোচনের ছলে আমাদিগকে কুল শীলে পুনরাবদ্ধ করে চলে যাবেন। মূলত: একমাত্র প্রবোধ, যদিও আমাদের আবদ্ধ রাখবার জন্য বর্তমান উপায় বটে, কিন্তু কৃষ্ণ-বিচ্ছেদ কালে আমাদের সে প্রবোধ জ্ঞান, কিছুই থাকবে না। আর ইহাও আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে যে, কৃষ্ণ একবার মথুরায় গমন করলে আর কদাচিৎ এস্থানে আসবেন না। সুতরাং আমরা তাঁর চিরবিরহে জীবিত থাকলেও অনাথিনী হয়ে-পাগলিনী হয়ে বিচরণ করব।" এ বলে শ্রীরাধিকা তৎক্ষণাৎ ভূপতিত ও মূর্চ্ছিত হলেন। আর সখিরাও রোদন করতে করতে তাঁর শুশ্রুষা করতে লাগল।
এদিকে নিশা প্রায় শেষ হয়ে আসল। কমলিনী চৈতন্য পেয়ে বলতে লাগল,” বৃন্দে! নিশা প্রায় অবসান হয়ে এলো। আর এখানে বসে থেকে বৃথা রোদন করার কি প্রয়োজন? ইহা কেবল অরণ্য রোদন মাত্র। অতএব চল আমরা কৃষ্ণের পথ অবরোধ করি। আমরা রাজপথে প্রবেশ করতে করতেই নিশা অবসান হবে, সে সময় তিনিও গমনের জন্য উদ্যোগ করলে আমরা তাঁর পথ অবরোধ করব। এ বলে তিনি ধীরে ধীরে গমন করতে লাগলেন। সখিরাও তাকে অনুসরণ করল। বৃন্দের নির্দেশে সখিগণ শ্রীমতীর দুই পার্শ্বে দন্ডায়মন হল এবং শ্রীমতী দুই সখির স্কন্দে হাত রেখে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। গমনকালে বৃন্দা শ্রীরাধিকাকে সম্বোধন কলে বলতে লাগল,” শ্রীমতি রাধে! রাম-কৃষ্ণ যখন গমন করবেন, আমরা তাদের পথ অবরোধ করব বট; কিন্তু সে অবরোধ গোকুলের প্রাপ্তভাগে গিয়ে করব, জনাকীর্ণ পথে তা করব না। তাঁর গমনকালে ব্রজবাসগণ তাঁর নিকটে থাকিবে। সুতরাং তখন নির্জন পাওয় কঠিন হবে। কিন্তু ইহাও আপনি নিশ্চয় জানবেন যে, গমনকালে ভ্রাতৃদ্বয় প্রথমে এক রথে যাবেন, সে রথে বোধ হয় আর কেহ থাকিবে না। পশ্চাদে নন্দাদি সকলে দধি দুগ্ধাদি উপটৌকন সামগ্রী নিয়ে অপর রথে বা শকটে গমন করবেন। অতএব, আমরা সে সুযোগে রাম-কৃষ্ণকে সম্ভাষণ করব। সকলে একবাক্যে তা অনুমোদন করল।
এ দিকে রাত্রি প্রভাত হলে অক্রুর ঘুমে হতে উঠে রাম-কৃষ্ণকে জাগরিত করল। তাঁরা প্রাত:কৃত্য সমাপন করল। অক্রুর সারথীকে রথ প্রস্তুত করতে বলল। অক্রুর নন্দাদি গোপগণকে সম্বোধন করে বলল,"হে মহাশয়গণ! আমি এ সুজ্জিত রথে রাম-কৃষ্ণকে নিয়ে অগ্রসর হলাম। আপনার পশ্চাতে শকটে গমন করুন। পরে মথুরা গিয়ে আমরা একসাথে রাজসভায় গমন করব।" দেখতে দেখতে রথ ব্রজপুরী প্রায় পরিত্যাগ করল। প্রান্তভাগে উপস্থিত হলে অক্রুর দেখতে পেলেন যে, কিছু বিষন্নবদনা কুলকামিনী রথের দিকে আসছে। তাদের নীরিক্ষণ করে অক্রুর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, কুলকামিনীগণ সুখস্বচ্ছন্দে দিনাতিপাত করতেন কিন্তু তারা কিছুর অভাব বোধ করছে। তখন অক্রুর প্রভুকে লক্ষ্য করে বললেন,“প্রভু দেখুন কুলকামিনীগণ এদিকেই আসছে।” অন্তর্যামী ভগবান সমস্ত কিছু জেনেও যেন কিছুই জানেন না এরুপ ভাব প্রদর্শণ করলেন। বলরাম সমস্ত অবগত হয়ে নিদ্রাদেবীকে স্মরণ করে রথের উপর শয়ন করলেন।এদিকে শ্রীরধিকা গোপীনিগণ সমেত রথের সামনে এসে অক্রুরকে সম্বোধন করে বললেন,“হে মহাত্মন! আপনি কে? আপনাকে দেখে তো ধার্মিক পুরুষ বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এমন দুর্বত্তের ন্যায় আমারদের প্রাণনাথকে নিয়ে আপনি পালায়ন করছেন কেন? আমার জীবন থাকতে আপনি কৃষ্ণকে নিয়ে যেতে পারবেন না। হে অক্রুর! আমরা অবলা নারী, আমারা ঐ কৃষ্ণপদে প্রাণ, মান, জীবন যৌবন সবকিছূ সমর্পণ করেছি। কৃষ্ণ ব্যতীত আমাদের আর কিছু্ই নেই। তোমার সহিত বিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তথাপিও আমাদের প্রাণ সংহার না করে তুমি কৃষ্ণকে নিয়ে যেতে পারবেনা। আমরা আপনার গতিরোধ করলাম। আমাদের হত্যা করে রাম-কৃষ্ণকে নিয়ে যান।” এ কথা বলে সকলে ছিন্ন তরুর ন্যায় মাটিতে বসে পড়লেন। অক্রুর আর রথ চালাত পারলেন না। বলরামকে ঘুমন্ত দেখে শ্রীকৃষ্ণ রথ হতে নামলেন এবং শ্রীরাধিকার হাত ধরে মধুর স্বরে বললেন,“একি! উঠে দাড়াও। এ তোমার উপযুক্ত স্থান নয়। তুমি কুল কন্যা। সুতরাং তোমার প্রকাশ্যে আসা উচিৎ নয়।” ব্রজবালাগণ কৃষ্ণের বাক্যে ও হস্ত দ্বারা স্পর্শ হওয়াতে তাদের মনোবল অনেক পরিমানে বেড়ে গেল এবং সেখানে সকলে বসে পড়লেন।কিছুক্ষণ সকলেই মৌন হয়ে রইল। নয়ন থেকে অবিরত জল ঝরছিল। আর অশ্রুসিক্ত নয়নে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে লাগল। অন্তর্যামী গোপীবল্লভ, গোপাঙ্গনাদের অন্তর্গত প্রেম সমস্তই অবগত আছেন কিন্তু সে সময়ে তিনিও গোপ ললনাদের অপার প্রেমসাগরে নিমগ্ন হলেন। ভক্তবৎসল হরির নয়নযুগল তখন ছল ছল করতে লাগল। তিনি মনে করলেন যে, এ গোপীকাদের মত আমার ভক্ত জগতে নিতান্তই দুর্লভ; অতএব এদের তো কোন কথাই নেই। কিন্তু এদের পাদসংলগ্ন ধূলারাসীর দ্বারা স্পৃষ্ট যে বৃক্ষ গুল্মাদি ইহাদিগকে দেবসদৃশ বা তদতীত মহত্ত্ব দান করা আবশ্যক। গোপীকাদের হৃদয়মন্দির আমি ক্ষণকালের জন্যও পরিত্যাগ করতে পারব না। তবে নশ্বর দেহে আমার অসহ্য বিরহতাপ কিছুকালের জন্য ইহাদিগকে সহ্য করতে হবে। এ বিবেচনা করে শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবালাদিগকে পুনরায় বললেন,“সখিগণ! তোমরা কুলবধূ, তোমাদের কুলমান রক্ষা করবার জন্য আমি ইত:পূর্বে অনেক ক্লেশ স্বীকার করেছি তা তোমার অবশ্যই জান। অতএব এখন তোমরা এভাব পরিত্যাগ করে স্ব স্ব আবাসনে প্রস্থান কর। তোমাদের গুরুজনরা অতিশ্রীঘ্রই এখানে গমন করবেন। তখন তোমার ভীষন লজ্জায় পতিত হবে। আর আমি প্রানেশ্বরী শ্রীমতীর শরীর স্পর্শ করে বলছি কিছুদিন পরেই তোমাদের সহিত শ্রীমতীকে দর্শন করব। আমার বিরহ তোমাদের জন্য অত্যন্ত দু:সহ বটে কিন্তু তা থেকে উত্তরনের উপায় বলছি- তোমরা অতি নির্জন স্থানে মুদ্রিত নয়নে আমাকে চিন্তা করলেই আমি তোমাদের হৃদয়মধ্যে উদয় হয়ে তোমাদের বিয়োগভীত হৃদয়কে সুশীতল করব এতে বিন্দুমাত্রও সংশয় নেই।” এরুপ বলত বলতে হরি শ্রীমতীর গাত্রস্থ কিছূ ধূলীরাশী অঞ্চলে বন্ধন করলেন। পরে সকলেরই শরীর স্পর্শ করে মুধুর বাক্যে বলতে লাগলেন,“প্রিয়তমাগণ! আর দেরী না করে সকলেই স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান কর।” প্রাণসখা কৃষ্ণের কোমল স্পর্শে সকলেই যেন কৃতার্থ হলেন। প্রাণসখার মুধুর বাক্যে সকলেই আশ্বস্তমনে গোকুলাভিমুখে গমন করতে লাগলেন। ব্রজবালাদের বিদায় দিয়ে শ্রীকৃষ্ণও বিরহকাতর হয়ে অক্রুরকে রথ চালানোর ইঙ্গিত দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অক্রুর রথসহ মধুপুরী তোরণে উপনীত হলেন। তখন মথুরাবাসীগণ রামকৃষ্ণের অপূর্ব রুপলাবণ্য দর্শন করে আহ্লাদ-সাগরে নিপতিত হলো।
এদিকে লোক পরম্পরায় অতি অল্প সময়েরই মধ্যে মধুপুরীর প্রায় সকলেই জানতে পারলেন যে, বৃন্দাবন হতে রামকৃষ্ণ নামে অপূর্ব রুপবান দুটি বালক এখানে এসেছে। প্রথমত: তাদের এ সুমধুর নাম শ্রবণ করা মাত্রই তাদের কর্ণকুহর পবিত্র হলো। রামকৃষ্ণের রুপ-লাবণ্য দর্শন করার জন্য গোপ-গোপিনীগণের নয়ন যেন লালায়ীত হতে লাগল। রাজপথের উভয় পাশে অট্টালিকার উপরভাগে বাতায়ন হতে শত শত গৃহলক্ষ্ণীরা একদৃষ্টে পথ চেয়ে রইল।এদিকে রাম কৃষ্ণ পরস্পর পরস্পরের বেশ ভূষা দেখে বলতে লাগল “ভাই! এমন বেশ ভূষায় কি রাজসভায় যাওয়া যায়?” এমন সময় দূরে এক ব্যক্তিকে দেখে কৃষ্ণ বলল,“অগ্রজ! দেখুন, দেখি কেমন একজন অর্পূব বেশে এদিকে আসছে। তার আপাদমস্তক সুভ্র বস্ত্রদ্বারা কি চমৎকার আবৃত ও সজ্জিত। তার উভয় পার্শ্বে উত্তরীয় বসন উড্ডীয়নমান হওয়ায় মনে হচ্ছে যেন উহার দুই দিকে ময়ুরদ্বয় পূচ্ছ বিস্তার করে আছে। মস্তকে কি মনোহর মুকুট।” শ্রীকৃষ্ণের বাক্য শুনের রাম বললেন,” ভ্রাত:! তোমার শ্রীঅঙ্গের উপযুক্ত কোন সবনই নেই; অথচ এ ব্রজবেশ পরিত্যাগ করলে গোপরাজের তা প্রীতিকর হবে না। অতএব ইহা পরিবর্তনের আর কোন প্রয়োজন নেই। এ বলে উভয়ই গোকূল পরিচ্ছদই পরিপাটি করে পরিধান করে জনৈক মালাকারের গৃহে উপস্থিত হলে অত্যন্ত বিষ্ণু পরায়ণ, সেই সত্বগুণধারী মালাকার রামকৃষ্ণের রুপ দর্শন করা মাত্রই ভক্তি গদগদ হয়ে দন্ডায়মান হয়ে রইল। তাকে দন্ডায়মান দেখে কৃষ্ণ বলল,“আমরা বৃন্দাবন হতে কংসরাজের আমন্ত্রণে এখানে এসেছি। আমারদের নাম রাম ও কৃষ্ণ। তুমি আমাদিগকে রাজোচিত মালা প্রদান কর।” তখন মালাকার বলা,“প্রভূ! কিছু পূর্বে আমি রামকৃষ্ণের নাম শ্রবণ করেছি। আপনারা কি সে ব্রজবাসী নিবাসী রামকৃষ্ণ?” তখন রাম উত্তরে বললেন,“ আমারই রামকৃষ্ণ। কৃষ্ণ আমার অনুজ।” তখন শশব্যস্ত হয়ে মালাকার তাদের বসিবার জন্য আসন দিলেন। স্ত্রীকে উচ্চস্বরে ডাকাতে লাগলেন। স্ত্রীকে বললেন,“আমি যে রামকৃষ্ণের আগমনের কথা শুনেছি উনারাই রামকৃষ্ণ। যে রামকৃষ্ণকে দর্শন করার জন্য তোমার হৃদয় ব্যাকুল হয়েছিল ভাগ্যক্রমে দেখ তাদের পদরেণু দ্বারা আমাদের এ কুটিরকে পবিত্র ও আমাদিগকে চরিতার্থ করেছেন।” পরে মালিনী পুলকে পূর্ণিত হলো এবং তাঁহাদিগকে দরিদ্রের রত্নলাভের ন্যায় যত্ন করতে লাগল। পরে মালাকার পুষ্পমালা দিয়ে রামকৃষ্ণকে সুসজ্জিত করে দিল।
এদিকে নন্দাদি গোপবৃন্দ মধুপুরী প্রবেশ করে রামকৃষ্ণকে না দেখতে পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। এমন সময় রামকৃষ্ণ সেখানে আগমন করল। মা যশোদা প্রদত্ত ক্ষীর, স্বর ও নবনীতাদি ভোজনপূর্বক রামকৃষ্ণ রথে উপবেশন করল। অক্রুর ধীরে ধীরে রথ চালনা করতে লাগল। এদিকে কুলকামিনীগণ রামকৃষ্ণের অসাম্যরুপের কথা শ্রবণ করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল যে- হে সহিচরিগণ! গৃহ কর্ম চিরদিনই আছে। কিন্তু আজ সহস্র কর্ম থাকলেও রামকৃষ্ণকে অবশ্যই দর্শন করতে হবে; তাতে গুরুজনদের তিরস্কার ও লাঞ্চলা সহ্য করতে হলে তারা সহ্য করবে তবুও তারা রামকৃষ্ণকে দর্শন করবে। ইতোমধ্যে যারা রামকৃষ্ণের রূপ দর্শন করেছে তারাও তাদের সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করতে করতে এমন বিমোহিত ও অধীর হয়ে পড়ল যে স্পষ্ট করে আর কিছু বলতে পারল না। রামকৃষ্ণকে নিয়ে অক্রুরের রথ যখন লোকালয়ের কাছে আসল তখন কেহ কেহ বলতে লাগল “সখি! আমার শুনেছি ব্রজপুর এক বালক আছে, তার বাঁশীর সুলে ব্রজনারীরা কুলমান বিসর্জন দিয়ে লোকলাঞ্চনা এবং গুরুগঞ্জনাদিতে কর্ণপাত না করে ঐ শব্দের অনুগামী হতেন। আমরা যে সময়ে ঘর হতে বাহির হতে ভীত ও সংকোচ বোধ করি; সে সময়ে ব্রজনারীরা অন্ধকার রজনীতে সকল প্রকার বিভীষিকা অতিক্রম করে অবলীলাক্রমে নিবীড় ও নির্জন কাননে প্রবেশ করে বিহার করত। কন্টক, কীলকাদি কিছুই মানত না। হে সহচরিগণ! সে সময় আমরা ব্রজসুন্দরীগণের এরকম কর্দয কাজ শ্রবণ করে তাদের প্রতি কত ধিক্কার দিয়েছি। কিন্তু এখন দেখছি ত্রিভুবনের মধ্যে তারাই ধন্যা, তারাই শ্যামসুন্দরের অপরূপ রূপ দর্শনে কৃতার্থ হয়েছে। যার রূপ দেখে সহজেই আত্মজ্ঞান শূন্য হয়, তাহাতে আবার ঐ বাঁশীর সুর শোনে কোন কামিনীর অধৈর্য হয়ে কুলত্যাগ করে প্রেমসাগরে অবগাহন না করবে?” অন্য একজন বলল,“আমি শুনেছি যে, সে বাঁশী কোন সাধারণ বাঁশী নয়। এ বাঁশীর সুর শুনলে পশু-পাখীরাও বিমোহিত হয়। যমুনাও নাকি স্ফীত হয়ে উজানে প্রবাহিত হয়। কৃষ্ণকে পলকমাত্র দর্শন করেই আমাদের যখন এমন ব্যাকুলতা, তবে না জানি ব্রজগোপিনীগণ কৃষ্ণ বিরহে কিভাবে জীবন ধারণ করবে।” এ কথা বলে তারা শোকাবেগ সহ্য করে স্ব স্ব গৃহে গমন করল। রামকৃষ্ণের কংসপুরী প্রবেশ অক্রুর রথ নিয়ে কংসালয়ের সমীপে উপনিত হলেন। সিংহদ্বার হস্তিদ্বারা সুসজ্জিত করে রাখা হয়েছিল। অক্রুর রামকৃষ্ণকে নিয়ে সিংহদ্বার প্রবেশ করা মাত্রই হস্তী তার ভীষণ শুন্ডদ্বারা কৃষ্ণকে বেষ্ঠন করল। কিন্তু তিনি অচলের ন্যায় অটলভাবে ও নির্ভীকভাবে দন্ডায়ামান রইলেন। হায়! যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনন্তরূপী, যিনি কনিষ্ঠাঙ্গুলে গোবর্ধনগিরি অনায়াসে ধারণ করেছিলেন, যার দ্বারা অসাধ্য সাধিত হয়। সামান্য এক হস্তী তার কি অনিষ্ট করতে পারে! হস্তীর শুন্ড হতে নিজেকে মুক্ত করে বীর বিক্রমে মুষ্টি ও চপেটাঘাত করে হস্তীকে নিপতিত করলেন। নন্দাদি এ সকল দৃশ্য অবলোকন করে ভীত হলেন এবং কংসরাজার সামনে উপনীত হয়ে বেশী পরিমানে দুগ্ধাদি উপহার সামগ্রী দিতে লাগলেন। কিন্তু দূরাত্মা কংস রামকৃষ্ণের বিনাশ বাসনায় উন্মুক্ত। আর অন্য কোনদিকে তার দৃষ্টি নেই। মল্লগণকে আদেশ দিলেন রামকৃষ্ণকে নাশ করার জন্য। রাজআজ্ঞা পেয়ে চানুর, মুষ্টিক প্রভৃতি মল্লগণ তর্জন গর্জন করে রামকৃষ্ণের সহিত মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। রামের সহিত মুষ্টিকের এবং কৃষ্ণের সহিত চানুরের মল্লযুদ্ধ শুরু হল। বীরচতুষ্টয় বাহুমুলে রঙ্গধূলি মর্দন করে সিংহনাদ করে পৃথিবী কম্পিত করতে লাগল। ক্রোধে রামের চক্ষু রক্তবর্ণ ধারণ করা মাত্রই প্রচন্ড মুষ্টিতে মুষ্টিকে যমালয়ে পাঠালেন। অপরদিকে রাম কর্তৃক মুষ্টিক নিহত হওয়ার দৃশ্য দেখে কৃষ্ণ অধিকতর উৎসাহ পেয়ে দূর্বৃত্ত চানুরের পদদ্বয় ধারণপূর্বক উৎক্ষিপ্ত করে বিনাশ করলেন। অন্যান্য মল্লযোদ্ধাগণ তা অবলোকন করে ক্রোধান্বিত হয়ে রামকৃষ্ণকে আক্রমন করল। রামকৃষ্ণ একে একে সকলকেই বিনাশ করলেন। রামকৃষ্ণ কর্তৃক মল্লগণের মৃত্যুর সংবাদ শ্রবণ করা মাত্রই দুরাত্মা কংসধিপতি ভীত ও চমকিত হলেন। দূতগণকে ডেকে নির্দেশ দিলেন,“এখনই এখানে হতে রামকৃষ্ণকে দূর করে দাও। নন্দাদি পোপবৃন্দকে সমুচিত দন্ড প্রদান কর। কারণ তারা আমার প্রবল শত্রুদ্বয়কে সুখসেব্য উপভোগ দ্বারা পরিবর্দ্ধিত ও অদ্ভুদ বীর্যশালী করে আমার সহিত বৈরীআচরণ করেছে। তাই তাদেরকে সস্ত্রীক বিনাশ করে আমার সমস্ত ক্ষোভ নিবারণ কর।” দুরাত্মা কংসের এমন নিষ্ঠুর বাক্য শ্রবণ করে ক্রোধে কম্পিত হয়ে নিজ মূর্তিধারণ করলেন। দেখতে দেখতে তিনি ব্রহ্মান্ড ক্ষোভকাররিনী ভয়ঙ্করা খড়গহন্তা নরমালা বিভূষণা ভীষণ কলিকা মূর্তি ধারণ করে বামকরে সভামধ্যস্থ দৈত্যপতির কেশাকর্ষণ পূর্বক ভূমে পতিত করে স্বকীয় তীক্ষ্ণ কৃপান দ্বারা শিরচ্ছেদন করলেন। দূরাত্মা কংস বিনাশ হওয়া মাত্রই তিনি আবার বনমারা সুশোভিত শান্ত কৃষ্ণ মুর্ত্তি ধারণ করে অগ্রজের সাহিত পরম আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র