শ্রীমদ্ভগবত গীতা অষ্টম অধ্যায়

অষ্টম অধ্যায় - অক্ষর-ব্রহ্ম যোগ

|অর্জুন উবাচ|
কিং তদ্ ব্রহ্ম কিমধ্যাত্মং কিং কর্ম পুরুষোত্তম |
অধিভূতং চ কিং প্রোক্তমধিদৈবং কিমুচ্যতে || ১ ||
অর্থ : অর্জুন জিজ্ঞাসা কররেন- হে পুরুষোত্তম! ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি? অধিভূত ও অধিদৈবই বা কাকে বলে ? অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্পষ্ট করে বল।
অধিয়জ্ঞঃ কথং কোহত্র দেহেহস্মিন্মধুসূদন |
প্রয়াণকালে চ কথং জ্ঞেয়োহসি নিয়তাত্মভিঃ || ২ ||
অর্থ : হে মধুসূদন! এই দেহে অধিযজ্ঞ কে এবং এই দেহের মধ্যে তিনি কিরুপে অবস্থিত? মৃত্যুকালে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কিভাবে তোমাকে জানাতে পারেন?
|শ্রীভগবানুবাচ|
অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবোহধ্যাত্মমুচ্যতে |
ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ || ৩ ||
অর্থ : পরমেশ্বর ভগবান বললেন- নিত্য বিনাশ-রহিত জীবকে বলা হয় ব্রহ্ম এবং তার নিত্য স্বভাবকে অধ্যাত্ম বলে। ভুতগণের উৎপত্তি ও বৃদ্ধিকর সংসারই কর্ম।
অধিভূতং ক্ষরো ভাবঃ পুরুষশ্চাধিদৈবতম্ |
অধিযজ্ঞোহহমেবাত্র দেহে দেহভৃতাং বর || ৪ ||
অর্থ : হে দেহধারীশ্রেষ্ঠ! নশ্বর জড়া প্রকৃতি অধিভূত। সূর্য, চন্দ্র আদি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিরুপ বিরাট পুরুষকে অধিদৈব বলা হয়। আর দেহীদের দেহান্তর্গত অন্তযামী রুপে আমিই অধিযজ্ঞ।
অন্তকালে চ মামেব স্মরন্মুক্ত্বা কলেবরম্ |
য: প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ || ৫ ||
অর্থ :মুত্যুর সময়ে যিনি আমাকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ আমার ভাবই প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
যং যং বাপি স্মরণ্ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্ |
তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ ||৬ ||
অর্থ : অন্তিকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি সেই ভাবে ভাবিত কলেবর লাভ করেন।
তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্য চ |
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্মামেবৈষ্যস্যসংশয়: || ৭ ||
অর্থ : অতএব হে অর্জুন! সর্বদা আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাব বিহিত যুদ্ধ কর, তা হলে আমাতে তোমার মন ও বুদ্ধি অর্পিত হবে এবং নি:সন্দেহে তুমি আমাকেই লাভ করবে।
অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা নান্যগামিনা |
পরমং পুরুষং দিবং যাতি পার্থানুচিন্তয়ন্ || ৮ ||
অর্থ : হে পার্থ ! অভ্যাস যোগে যুক্ত হয়ে অনন্যগামী চিত্তে যিনি অনুক্ষণ পরম পুরুষের চিন্তা করেন, তিনি অবশ্যই তাঁকেই প্রাপ্ত হবেন।
কবিং পুরাণমনুশাসিতারম্ অণোরণীয়াংসমনুস্মরেদ্ য: |
সর্বস্য ধাতারমচিন্ত্যরূপম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ || ৯ ||
অর্থ :সর্বজ্ঞ,সনাতন, নিয়ন্তা, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, সকলের বিধাতা, জড় বুদ্ধির অতীত, অচিন্ত্য ও পুরুষরুপে পরমেশ্বর ভগবানের ধ্যান করা উচত। তিনি যূর্যের মতো জ্যোতির্ময় এবং এই জড়া প্রকৃতির অতীত।
প্রয়াণকালে মনসাচলেন ভক্ত্যা যুক্তো যোগবলেন চৈব |
ভ্রুবোর্মধ্যে প্রাণমাবেশ্য সম্যক্ স তং পরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্ || ১০ ||
অর্থ :যিনি মৃত্যুর সময় অচঞ্চল চিত্তে, ভক্তি সহকারে পূর্ণ যোগশক্তির বলে ভ্রুযুগলের মধ্যে প্রাণবায়ুকে স্থাপন করে পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করেন, তিনি অবশ্যই সেই দিব্য পরম পুরুষকে প্রাপ্ত হন।
যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি বিশন্তি যদ্ যতয়ো বীতরাগাঃ |
যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে || ১১ ||
অর্থ : বেদবিৎ পন্ডিতেরা যাঁকে 'অক্ষর' বলে অভিহিত করেন, বিষয়ে আসক্তিশূন্য সন্ন্যাসীরা যাতে প্রবেশ করেন, ব্রহ্মচারীরা যাঁকে লাভ করার ইচ্ছায় ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁর কথা আমি সেংক্ষেপে তোমাকে বলব।
সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ |
মূর্ধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগধারণাম্ || ১২ ||
অর্থ : ইন্দ্রিয়ের সব কয়টি দ্বার সংযত করে , মনকে নিরোধ করে এবং ভ্রুদ্বয়ের মধ্যে প্রাণ স্থাপন করে যোগে স্থিত হতে হয়।
ওঁ ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্মামনুস্মরন |
য: প্রয়াতি ত্যজন্ দেুহং স যাতি পরমাং গতিম্ || ১৩ ||
অর্থ : যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হয়ে ওঙ্কার উচ্চারন করতে করতে কেই যদি পরমেশ্বর ভগাবানকে স্মারণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই পরমা গতি লাভ করবেন।
অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ |
তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যয়ুক্তস্য যোগিনঃ || ১৪ ||
অর্থ :হে পার্থ ! যিনি একাগ্রচিত্তে কেবল আমাকেই নিরন্তর স্মরণ করেন, আমি সেই নিত্যযুক্ত ভক্তযোগীর কাছে সুলভ হই।
মামুপেত্য পুনর্জন্ম দুঃখালয়মশাশ্বতম্ |
নাপ্নুবন্তি মহাত্মানঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ || ১৫ ||
অর্থ : মহাত্ম, ভক্তিপরায়ণ যোগীগণ আমাকে লাভ করে আর এই দু:খপূর্ণ নশ্বর সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না, কেন না তাঁরা পরম সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন।
আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন |
মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে || ১৬ ||
অর্থ :হে অর্জুন! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু তে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না।
সহস্রযুগপর্যন্তমহর্যদ্ ব্রহ্মণো বিদুঃ |
রাত্রিং যুগসহস্রান্তাং তেহহোরাত্রবিদো জনাঃ || ১৭ ||
অর্থ : মনুষ্য মানের সহস্র চর্তুযুগে ব্রহ্মার একদিন হয় এবং সহস্র চতুর্যুগে তাঁর এক রাত্রি হয়। এভাবেই যাঁরা জানেন, তাঁরা দিবা-রাত্রির তত্ত্ববেত্তা।
অব্যক্তাদ্ ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্রভবন্ত্যহরাগমে |
রাত্র্যাগমে প্রলীয়ন্তে তত্রৈবাব্যক্তসংজ্ঞকে || ১৮ ||
অর্থ :ব্রহ্মার দিনের সমাগমে সমস্ত জীব অব্যক্ত থেকে অভিব্যক্ত হয় এবং ব্রহ্মার রাত্রির আগমে তা পুনরায় অব্যক্তে লয় প্রাপ্ত হয়।
ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে |
রাত্র্যাগমেহবশঃ পার্থ প্রভবত্যহরাগমে || ১৯ ||
অর্থ : হে পার্থ! সেই ভূতসমূহ পুন; পুন: উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মার রাত্রি সমাগমে লয় প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় দিনের আগমনে তারা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়।
পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ |
য: স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যত্সু ন বিনশ্যতি || ২০ ||
অর্থ :কিন্তু আর একটি অব্যক্ত প্রকৃতি রয়েছে যা নিত্য এবং ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তুর অতীত। সমস্ত ভূত বিনষ্ট হলেও তা বিনষ্ট হয় না।
অব্যক্তোহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম্ |
যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম || ২১ ||
অর্থ :সেই অব্যক্তকে অক্ষর বলে, তাই সমস্ত জীবের পরমা গতি। কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাঁকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।
পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা লভ্য়স্ত্বনন্যয়া |
যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং তত্ || ২২ ||
অর্থ : হে পার্থ ! সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর ভগবানকে অনন্যা ভক্তির মাধ্যমেই কেবল লাভ করা যায়। তিনি যদিও তাঁর ধামে নিত্য বিরাজমান, তবুও সর্বব্যাপ্ত এবং সব কিছু তাঁর মধ্যেই অবস্থিত।
যত্র কালে ত্বনাবৃত্তিমাবৃত্তিং চৈব যোগিনঃ |
প্রয়াতা যান্তি তং কালং বক্ষ্যামি ভরতর্ষভ || ২৩ ||
অর্থ : হে ভারতশ্রেষ্ঠ! যে কালে মৃত্যু হলে যোগীরা এই জগতে ফিরে আসেন অথবা ফিরে আসেন না, সেই কালের কথা আমি তোমাকে বলব।
অগ্নির্জোতিরহঃ শুক্লঃ ষণ্মাসা উত্তরায়ণম্ |
তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ || ২৪ ||
অর্থ :ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ অগ্নি, জ্যোতি, শুভদিন, শুক্লপক্ষে ও ছয় মাস উত্তরায়ণ কালে দেহত্যাগ করলে ব্রহ্ম লাভ করেন।
ধূমো রাত্রিস্তথা কৃষ্ণঃ ষণ্মাসা দক্ষিণায়নম্ |
তত্র চান্দ্রমসং জ্যোতির্যোগী প্রাপ্য নিবর্ততে || ২৫ ||
অর্থ :ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ অথবা দক্ষিণায়নের ছয় মাস কালে দেহত্যাগ করে যোগী চন্দ্রলোকে গমনপূর্বক সুখভোগ করার পর পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন করেন।
শুক্লকৃষ্ণে গতী হ্যেতে জগতঃ শাশ্বতে মতে |
একয়া যাত্যনাবৃত্তিমন্যয়াবর্ততে পুনঃ || ২৬ ||
অর্থ : বৈদিক মতে এই জগৎ থেকে দেহত্যাগের দুটি মার্গ রয়েছে- একটি শূক্ল এবং অপরটি কৃষ্ণ। শুক্লমার্গে দেহত্যাগ করলে তাকে আর ফিরে আসতে হয় না, কিন্তু কৃষ্ণমার্গে দেহত্যাগ করলে ফিরে আসতে হয়।
নৈতে সৃতী পার্থ জানন্ যোগী মুহ্যতি কশ্চন |
তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু য়োগযুক্তো ভবার্জুন || ২৭ ||
অর্থ :হে পার্থ ! ভক্তেরা এই দুটি মার্গ সম্বন্ধে অবগত হয়ে কখনও মোহগ্রস্ত হন না । অতএব হে অর্জুন! তুমি ভক্তিযোগ অবলম্বন কর।
বেদেষু যজ্ঞেষু তপঃসু চৈব দানেষু যৎ পূণ্যফলং প্রদিষ্টম্ |
অত্যেতি তৎ সর্বমিদং বিদিত্বা যোগী পরং স্থানমুপৈতি চাদ্যম্ || ২৮ ||
অর্থ : ভক্তিযোগ অবলম্বন করলে তুমি কোন ফলেই বঞ্চিত হবে না। বেদপাঠ, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, তপস্যা, দান আদি যত প্রকার জ্ঞান ও কর্ম আছে, সেই সমুদয়ের যে ফল, তা তুমি ভক্তিযোগ দ্বারা লাভ করে আদি ও পরম ধাম প্রাপ্ত হও।
ইতি-শ্রীমদ্ভগবতগীতার অষ্টম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র