শ্রীমদ্ভগবত গীতা সপ্তম অধ্যায়

সপ্তম অধ্যায় - বিজ্ঞানযোগ

|শ্রীভগবানুবাচ|
ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং য়ুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ |
অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু || ১ ||
অর্থ: শ্রীভগবান বললেন- হে পার্থ! আমাতে আসক্তচিত্ত হয়ে, আমাতে মনোনিবেশ করে যোগাভ্যাস করলে, কিভাবে সমস্ত সংশয় থেকে মুক্ত হয়ে আমাকে জানতে পারবে, তা শ্রবণ কর।
জ্ঞানং তেহহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ |
যজ্জ্ঞাত্বা নেহ ভূয়োহন্যজ্জ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে| ২ ||
অর্থ: আমি এখন তোমাকে বিজ্ঞান সমন্বিত এই জ্ঞানের কথা সম্পূর্নরুপে বলব, যা জানা হলে এই জগতে আর কিছু্ই জানবার বাকি থাকে না।
মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে |
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ || ৩ ||
অর্থ:হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কদাচিৎ কোন একজন সিদ্ধি লাভ করে। আবার সেই সকল সিদ্ধ পুরুষের মধ্যে কদাচিৎ কোন একজন আমাকে অর্থাৎ আমার ভগবদ-স্বরুপকে উপলদ্ধি করতে পারে।
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ |
অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||
অর্থ: ভূমি, জল ,বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার- এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ |
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ || ৫ ||
অর্থ:হে মাহবাহো! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃত রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরুপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নি:সৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে।
এতদ্ যোনিনী ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয় |
অহং কৃতস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা || ৬ ||
অর্থ: আমার এই উভয় প্রকৃতি থেকে জড় ও চেতন সবকিছু উৎপন্ন হয়েছে। অতএব নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের মূল কারণ।
মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধঞ্জজয় |
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব || ৭ ||
অর্থ: হে ধঞ্জজয়! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সূত্রে যেমন মণিসমুহ গাঁথা থাকে, তেমনই সমস্ত বিশ্বই আমাতে ওত:প্রোতভাবে অবস্থান করে।
রসোহহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্য়য়োঃ |
প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু || ৮ ||
অর্থ:হে কৌন্তেয়! আমিই জলের রস, চন্দ্র ও সূর্যের প্রভা, সর্ব বেদের প্রণব, আকাশের শব্দ এবং মানুষের পৌরুষ।
পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাং চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ |
জীবনং সর্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু || ৯ ||
অর্থ: আমিই পৃথিবীর পবিত্র গন্ধ, অগ্নির তেজ, সর্বভূতের জীবন এবং তপস্বীদের তপ।
বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্ |
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম‌ || ১০ ||
অর্থ: হে পার্থ! আমাকে সর্বভূতের সনাতন বলে জানবে। আমি বুদ্ধিমানের বুদ্ধি এবং তেজস্বীদের তেজ।
বলং বলবতাং চাহং কামরাগবিবর্জিতম্ |
ধর্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভ || ১১ ||
অর্থ: হে ভরতর্ষভ! আমি বলবানের কাম ও রাগ বিবর্জিত বল এবং ধর্মের অবিরোধী কামরুপে আমি প্রাণীগণের মধ্যে বিরাজমান।
যৈ চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে |
মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি || ১২ ||
অর্থ:সমস্ত সাত্ত্বিক , রাজসিক ও তামসিক ভাবসমুহ আমার থেকেই উৎপন্ন বলে জানবে। আমি সেই সকলের অধীন নই, কিন্তু তারা আমার শক্তির অধীন।
ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ |
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্য পরমব্যয়ম্ || ১৩ ||
অর্থ:তিননি গুণের দ্বারা মোহত হওয়ার ফলে সমগ্র জগৎ এই সমস্ত গুণের অতীত ও অব্যয় আমাকে জানতে পারে না।
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া |
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে || ১৪ ||
অর্থ:আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উর্ত্তীণ হতে পারেন।
ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢাঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ |
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ || ১৫ ||
অর্থ:মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কখনও আমার শরণাগত হয় না।
চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোহর্জুন |
আর্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ || ১৬ ||
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ:হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন! আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী- এই চার প্রকার পুণ্যকর্মা ব্যক্তিগণ আমার ভজনা করেন। ভক্ত দুই প্রকার। সকাম ভক্ত ও নিষ্কাম ভক্ত। সকাম ভক্ত হচ্ছে তারাই যারা ফলের আশায় কর্ম করেন। আর নিষ্কাম ভক্ত হচ্ছে তারাই যারা ফলের কামনা ব্যতীত কর্ম করেন। আর্ত, জিজ্ঞাসু, অর্থার্থী এ তিন ধরণের ভক্ত হচ্ছে সকাম ভক্ত। আর জ্ঞানীই হচ্ছে নিষ্কাম ভক্ত। আর্ত ভক্ত হচ্ছে তারাই যারা কাতর হয়ে, ভয়ে বিহ্বল হয়ে, বিপদে পতিত হয়ে নিজেকে ভয় ও বিপদ হতে রক্ষা করার জন্য ভগবানের আরাধনা করেন। কৌরবসভায় বিপদাপন্ন দ্রৌপদীর কাতর প্রার্থনা আর্ত ভক্তের অন্তর্গত। আত্মজ্ঞান লাভ, তত্ত্বজ্ঞান লাভ, পারমার্থিক জ্ঞান লাভের জন্য অর্থাৎ যাদের জানার আগ্রহ তীব্র তারাই জিজ্ঞাসু ভক্ত। উদ্ধব, জনকাদি রাজা জিজ্ঞাসু ভক্তের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর যারা এ জড় জগতে ধনাদির জন্য বা সিদ্ধি লাভের জন্য ভগবানের আরাধনা করেন তারাই হচ্ছে অর্থার্থী ভক্ত। ইহলোকে ও পরলোকে সুখপ্রাপ্তি সুগ্রীব ও সুরথ রাজা প্রভৃতি রজ:প্রধান অর্থাথী ভক্ত। আর ভোগবিলাস ত্যাগী, ফলাকাঙ্খারহিত, আত্মাতে পরিতৃপ্ত সেই আত্মানন্দ পুরুষই হচ্ছে জ্ঞানী ভক্ত। সনক, শুক, প্রহ্লাদ ও নারদাদি তারাই হচ্ছেন জ্ঞানী ভক্ত। আবার অবস্থা ভেদে জিজ্ঞাসু ভক্ত আর্ত ও অর্থাথী হতে পারেন। ভগবৎ বিরহ বশত: তিনি আর্ত এবং ভগবৎকৃপা লাভের অভিলাষী বলে অর্থার্থী। প্রকৃত সুকৃতিমান পুরুষ ব্যতীত কেহই এ চতুর্বিধ ভক্ত শ্রেণিভূক্ত হতে পারে না।
তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে |
প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ || ১৭ ||
অর্থ: এই চার প্রকার ভক্তের মধ্যে নিত্যযুক্ত, আমাতে একনিষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। কেন না আমি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয়।
উদারাঃ সর্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্ |
আস্থিতঃ স হি য়ুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম‌|| ১৮ ||
অর্থ: এই সকল ভক্তেরা সকলেই নি:সন্দেহে মহাত্ম, কিন্তু যে জ্ঞানী আমার তত্ত্বজ্ঞানে অধিষ্ঠিত, আমার মতে তিনি আমার আত্মস্বরুপ। আমার অপ্রাকৃত সেবায় যুক্ত হয়ে তিনি সর্বোত্তম গতিস্বরুপ আমাকে লাভ করেন।
বহূনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে |
বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ || ১৯ ||
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ: জ্ঞানী সর্বদাই আমার সেবায় যুক্ত থেকে পরম গতি লাভ করেন। জ্ঞানবান ব্যক্তি বহু জন্মের পর বাসুদেবই এ চরাচর জগৎ এরুপ অভেদ চিন্তাপূর্বক আমাকে প্রাপ্ত হন; সেরুপ মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ। জন্মে জন্মে পূণ্য সঞ্চয় করে অবশেষে জ্ঞানবান ব্যক্তি ভগবৎ প্রেমে বিহ্বল হয়ে সকল কিছুতেই ভগবত দর্শন করেন। জ্ঞানবান যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, সে দিকেই ভগবান ব্যতীত আর কিছুই দর্শন পান না। এজন্যে জ্ঞানপূর্বক যিনি তাঁকে ভক্তি করেন তিনি অতি মহাত্মা। এরুপ ব্যক্তি সচরাচর দেখকে পাওয়া যায় না।বহুজন্মার্জিত নিষ্কাম কর্মের ফলে পূণ্যপুঞ্জ সঞ্চিত হলেই জীবের ঈশ্বরসাক্ষাৎকার হয়ে থাকে। তখনই মনুষ্যকে প্রকৃত জ্ঞানবান বলা যেতে পারে। অভেদভাবে আত্মবোধ না হলে কারও প্রকৃত জ্ঞান লাভ হয় না। এরুপ জ্ঞানীই প্রকৃত ভক্তিমান, তাঁর জ্ঞানদৃষ্টিতে অন্ত:করণ ভগবদ্ভাবে সমাহিত হলে ভগবৎসত্তা ব্যতীত নিজের বা অপর কিছুরই পৃথক অস্তিত্ব থাকে না। জ্ঞান বিনা প্রকৃত প্রেমের বিকাশ হয় না এবং প্রেমিক না হলেও জ্ঞানের উদয় হতে পারে না। এ জন্যে জ্ঞানী ভক্ত সুদুর্লভ।
কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদন্তেহন্যদেবতাঃ |
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া || ২০ ||
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ: যে যে সকাম ব্যক্তি বা ভক্ত ভক্তিযুক্ত হয়ে যে যে দেবমূর্তির প্রতি শ্রদ্ধাপূর্বক পূজা অর্চনা করতে ইচ্ছা করে, আমিই অন্তর্য্যমিরূপে সেই সেই ব্যক্তির বা ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করে।স্বয়ং ভগবান পরমাত্মরুপে আমাদের সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন। তাই যে যে ভাবেই ও যে যে মূর্তিতেই কোন পূজা করুন নাম কেন, অন্তর্য্যামী ভগবান সেই ভাবেই ও সেই মূর্তিতেই তার ভক্তিপ্রবাহের পথ মুক্ত করে দেন। আমরা স্থূলবুদ্ধি বশত: ভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখি বটে, কিন্তু ভগবানের চোখে এ ভিন্ন দৃষ্টি নেই। সমস্ত পূজারই ফলদাতা একমাত্র পরমেশ্বর ভগবানই । যে ভাবেই মানুষ দেবদেবীদের পূজা করুক না কেন প্রকারান্তে সর্বদা তাঁরই পূজা হয়ে থাকে। তিনি সেভাবেই তার অর্চনার পথ উন্মুক্ত করে দেন।
যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি |
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্ || ২১ ||
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ: যে যে সকাম ব্যক্তি বা ভক্ত ভক্তিযুক্ত হয়ে যে যে দেবমূর্তির প্রতি শ্রদ্ধাপূর্বক পূজা অর্চনা করতে ইচ্ছা করে, আমিই অন্তর্য্যমিরূপে সেই সেই ব্যক্তির বা ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করে।যে যে ভাবেই ও যে যে মূর্তিতেই কোন পূজা করুন নাম কেন, অন্তর্য্যামী ভগবান সেই ভাবেই ও সেই মূর্তিতেই তার ভক্তিপ্রবাহের পথ মুক্ত করে দেন। আমরা স্থূলবুদ্ধি বশত: ভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখি বটে, কিন্তু ভগবানের চোখে এ ভিন্ন দৃষ্টি নেই। সমস্ত পূজারই ফলদাতা একমাত্র পরমেশ্বর ভগবানই । যে ভাবেই মানুষ দেবদেবীদের পূজা করুক না কেন প্রকারান্তে সর্বদা তাঁরই পূজা হয়ে থাকে। তিনি সেভাবেই তার অর্চনার পথ উন্মুক্ত করে দেন।
স তয়া শ্রদ্ধয়া য়ুক্তস্তস্যারাধনমীহতে |
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্ ||২২||
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ: যে যে সকাম ব্যক্তি বা ভক্ত ভক্তিযুক্ত হয়ে যে যে দেবমূর্তির প্রতি শ্রদ্ধাপূর্বক পূজা অর্চনা করতে ইচ্ছা করে, আমিই অন্তর্য্যমিরূপে সেই সেই ব্যক্তির বা ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করে।যে যে ভাবেই ও যে যে মূর্তিতেই কোন পূজা করুন নাম কেন, অন্তর্য্যামী ভগবান সেই ভাবেই ও সেই মূর্তিতেই তার ভক্তিপ্রবাহের পথ মুক্ত করে দেন। আমরা স্থূলবুদ্ধি বশত: ভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখি বটে, কিন্তু ভগবানের চোখে এ ভিন্ন দৃষ্টি নেই। সমস্ত পূজারই ফলদাতা একমাত্র পরমেশ্বর ভগবানই । যে ভাবেই মানুষ দেবদেবীদের পূজা করুক না কেন প্রকারান্তে সর্বদা তাঁরই পূজা হয়ে থাকে। তিনি সেভাবেই তার অর্চনার পথ উন্মুক্ত করে দেন।
অন্তবত্তু ফলং তেষাং ভবত্যল্পমেধসাম্ |
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি || ২৩ ||
অন্বয়: তু- কিনতু; অল্পমেধসাং-অল্পবুদ্ধি; তেষাং- সেই ব্যক্তিগণের; তৎ ফলম- সেই ফল; অন্তবৎ- বিনাশি; ভবতি- হয়; হি- যেহেতু; দেবযজ-দেবোপাসকগণ; দেবান- দেবতাগণ; যান্তি- প্রাপ্ত হয়; মদ্ভক্তা- আমার ভক্তগণ; মাং- আমাকে; যান্তি- পেয়ে থাকে।
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ: অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিগণের আরাধনালদ্ধ ফল বিনাশ হয়ে থাকে, কেননা তারা দেবার্চ্চনা দ্ধারা দেবলোকই প্রাপ্তহ হয় কিন্ত আমার ভক্তগণ পরিনামে আমাকেই লাভ করে থাকে। যাদের জ্ঞান অল্প তারা সকাম পূজা করিলেও ভগবান তাদের ফল প্রদান করেন থাকেন। কিন্ত তারপরও ভগবানের স্বরূপের পূজা করলে মানুষ যে ফল প্রাপ্ত হয়, তারা তা প্রাপ্ত হয় না। তমোগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিগণ ভূতপ্রেতের, রজোগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিগণ যক্ষ-রক্ষকদের ও স্বাত্তিক ব্যক্তিগণ ইন্দ্রাদি দেবতার অর্চনা করে থাকেন। আরাধ্য দেবতাতে যতটুকু শক্তির সঞ্চার থাকা সম্ভবনা, তৎপেক্ষা অতিরিক্ত ফল প্রাপ্তিতে তৎদেবার্চ্চনাকারীদের আশা নেই। যে মুমুক্ষুগণ কেবল ভগবানের স্বরূপের পূজা করে থাকে সেই নিষ্কাম ভক্তগণ অন্তে মুক্তিপদ-ব্রহ্মপদ লাভ করে থাকে। ভবগৎ স্বরূপের আরাধনকারী আর্তাদি ভক্তগণও প্রথমত: বাঞ্ছিত ফল লাভ করে পরিণামে কামনার পরিপাক হলে মুক্তিপদ লাভ করে থাকে।
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ |
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ || ২৪ ||
অন্বয়: অবুদ্ধয়:- অবিবেকিগণ; মম-আমার; অব্যয়ম- অক্ষয়; অনুত্তমং- সর্বোৎকৃষ্ট; পরং ভাবম- পরমাত্মা-স্বরূপ; অব্যক্তং- প্রপঞ্চাতীত; মাম- আমাকে; অজান্ত-না জেনে; ব্যক্তিম- সাকারভাব; আপন্নং- প্রাপ্ত; মন্যন্তে-বিবেচনা করে;
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ: অবিবেকি (মূঢ়, বুদ্ধিহীন) মানুষেরা আমার অব্যয় ও সর্বোৎকৃষ্ট স্বরূপ না জেনে অব্যক্তস্বরূপ আমাকে ব্যক্ত (যা ব্যক্ত করা যায় না) বলে মনে করে অর্থাৎ আমি পূর্বে নির্বিশেষ ছিলাম এখন রূপ পরিগ্রহ করেছি এরূপ মনে করে। অর্জুনের প্রশ্ন হচ্ছে- যদি কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান হন এবং মুক্তিদাতা হন, তাহলে মানুষেরা কেন তাঁকে ছেড়ে দেবদেবীর আরাধনা করে? অর্জুনের এরূপ সংশয় দূর করার জন্যেই এ শ্লোকের অবতারণা। যারা বিবেকবুদ্ধিবর্জিত, যারা মূঢ়, যারা অজ্ঞান, তারা তাঁকে সর্বকারণের পরম কারণ, সচ্চিদানন্দময়, অনাদিরাধির গোবিন্দ না জেনে মীন, কূর্ম, মানবাদি জীব বলে জ্ঞান করে। তারাই তাঁর স্বরূপে বিমুখ হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেবতার আরাধনা করে থাকে এবং এজন্যেই তারা মোক্ষফল লাভ করতে পারে না। ভগবানের সচ্চিদানন্দময় রূপ সাক্ষাৎ করতে হলে ভক্তি ও বৈরাগ্যসহ যথাযথ জ্ঞানের চ্চা করা করা একান্ত আবশ্যক। এজন্যেই মোক্ষশস্ত্র শ্রীমদ্ভগবত গীতা বার বার পঠন করতে হবে, আলোচনা করতে হবে। গীতাতে নিহিত আছে আমাদের মুক্তির পথ।
নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ |
মূঢোহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্ || ২৫ ||
অন্বয়:অহং- আমি; যোগমায়াসমাবৃত:- যোগমায়ায় আচ্ছাদিত থাকা;সর্বস্য- সকলের নিকট; প্রকাশ:- প্রকাশিত;ন- হই না/ এ জন্য; অয়ং- এই; মূঢ়: লোক:-মূঢ় লোক;মাম- আমাকে;অজম- জন্মরহিত;অব্যয়ং- ক্ষয়শূন্য বলে;ন অভিজানাতি- জানিতে পারে না;
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ:আমি সকলের নিকট প্রকাশিত হই না। কেননা যোগমায়ায় আবৃত থাকি এজন্যে মূঢ় লোক আমার অজ ও অব্যয় স্বরুপকে জানতে পারে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপ পরিগ্রহকালে অলোক সামান্য লক্ষণ সত্ত্বেও কেন লোকে তাঁকে সাধারণ মানুষ বলে মনে করে, অর্জুনকে ইহাই বুঝানোর জন্য ভগবান বলছেন যে, একান্ত অনুরাগ ব্যতীত তাঁকে কেহ দেখতে পায় না। তাঁর এ স্বত:সিদ্ধ সঙ্কল্পশক্তিই যোগমাযারূপে তাঁরই স্বরূপকে লোকবুদ্ধির বহির্ভূত গুপ্ত করে রেখেছে। তাই ভক্তিহীন মূঢ়গণ তাঁকে দেখতে ইচ্ছা করলেও তাকে দেখতে পায় না। মায়াবরণ ভেদ করে তাঁকে দেখতে হলে সরল বিশ্বাস ও অকপট ভক্তির একান্ত প্রয়োজন। ভক্তিহীন ব্যক্তির নিকট তিনি মেঘাচ্ছাদিত রবির ন্যায় চিরদিনই অপ্রকাশিত থাকেন।
বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন |
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন || ২৬ ||
অন্বয়:অহং- আমি; সমতীতানি- অতীত; বর্তমানানি- বর্তমান; ভবিষ্যাণি- ও ভবিষ্যৎ; ভূতানি- সমস্ত বিষয়; বেদ- জানি; তু-কিন্তু; কশ্চন- কেহই; মাং- আমাকে; ন বেদ- অবগত নহে;
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ:হে অর্জুন! আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ত্রিকালের সমস্ত বিষয় সম্পর্কেই সম্যক অবগতি আছি। কিন্তু আমাকে কেউ জানে না। ভগবান স্বয়ং সর্বজ্ঞ, তিনি সর্ব বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। তাই যোগমায়াবরণের জন্য তাঁর ত্রিকালদর্শিতার বিন্দুমাত্র বিঘ্ন হচ্ছে না। কিন্তু মায়া জীবকে চতুর্দিক থেকে এমনভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, জীবগণ সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন অতিক্রম করে ভগবানের স্বরূপ উপলদ্ধি করতে সমর্থ হচ্ছে না। যেমন সূর্যের প্রখর তাপে কূজ্ঝটিকা (কূয়াশা) দূর হয়ে যায় তেমনি তীব্র বৈরাগ্য ও ভক্তি সাধুদের হৃদয়ে সঞ্চারিত হলে আপনি হতেই যোগমায়ার আবরণও দূরীভূত হয়ে যায়।
ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত |
সর্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ || ২৭ ||
অন্বয়:ভারত- হে ভারত; পরন্তপ- হে পরন্তপ; সর্গে- স্খূলদেহ উৎপন্ন হলে; ইচ্ছাদ্বেষসমুথ্থেন- ইচ্ছাদ্বেষজনিত; দ্বন্দ্বহোহেন- দ্বন্দ্বজনিত মোহ দ্বারা; সর্বভূতানি-প্রাণিগণ; সম্মোহ যান্তি- অভিভূত হয়ে;
ব্যাখ্যামূলক বঙ্গানুবাদ: হে ভারত! হে পরন্তপ! প্রাণিগণের স্থূলদেহ উৎপন্ন হলে তাঁরা ইচ্ছাদ্বেষজনিত শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্বের দ্বারা মোহ প্রাপ্ত হয়ে থাকে।জীব স্থূলদেহ (মনুষ্য শরীর) লাভ করলেই অনুকূল বিষয় লাভে ইচ্ছা ও প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ করে থাকে। শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা-তৃষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে নিজে ব্যাকুল করে রাখে এবং আমি সুখী, আমি দু:খী এরূপ অভিমান করে। যোগমায়ার ন্যায় এ বিষম দ্বন্দ্বদৃষ্টিও ভগবদর্শনের বিষম প্রতিবন্ধক। ভগবান “ভারত” পদে অর্জুনের পবিত্র কুলমর্যাদা ও “পরন্তপ” পদ দ্বারা তাঁর ব্যক্তিগত সাধন সামর্থ্যের মর্যাদে দেখালেন। যারা রাগদ্বেষাদি দ্বন্দ্বের বশীভূত ভগবানকে তারা দর্শন করতে পারে না।
যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্ |
তে দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢব্রতাঃ || ২৮ ||
অর্থ: যে সমস্ত পূণ্যবান ব্যক্তির পাপ সম্পূর্ণরুপে দূরীভূত হয়েছে এবং যাঁরা দ্বন্দ্বমোহ থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে আমার ভজনা করেন।
জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে|
তে ব্রহ্ম তদ্ বিদুঃ কৃত্স্নমধ্যাত্মং কর্ম চাখিলম্ || ২৯ ||
অর্থ:যে সমস্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি জরা ও মৃত্যু থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমাকে আশ্রয় করে যত্ন করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মভূত, কেন না তাঁরা অধ্যাত্মতত্ত্ব ও কর্মতত্ত্ব সব কিছূ সম্পূর্ণরুপে অবগত।
সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞং চ যে বিদুঃ |
প্রয়াণকালেহপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ || ৩০ ||
অর্থ: যাঁরা অধিভূত-তত্ত্ব, অধিদৈব-তত্ত্ব ও অধিযজ্ঞ-তত্ত্ব সহ আমাকে পরমেশ্বর ভগবান বলে অবগত হন, তাঁরা আমাতে আসক্তচিত্তে , এমন কি মরণকালেও আমাকে জানতে পারেন।
ইতি-পারমার্থিক জ্ঞান বিষয়ক শ্রীমদ্ভগবগীতার সপ্তম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র