মহাভারত:বনপর্ব-০৪১-০৪৫

৪১. দময়ন্তীর স্বয়ম্বর
দময়ন্তী স্বয়ম্বর লোকমুকে শুনি।
সুরোলোকে আসেন নারদ মহামুনি।।
যথাবিধি তাঁরে পূজে দেব সুরেশ্বর।
জিজ্ঞাসিল কোথা ছিলে ওহে মুনিবর।।
ঋষি বলে গিয়াছিনু পৃথিবী মণ্ডল।
আশ্চর্য্য দেখিনু তথা, শুন আখণ্ডল।।
বিদর্ভ রাজার কন্যা দময়ন্তী নামা।
দেব যক্ষ নাগ নরে দিতে নারে সীমা।।
তার ‍রূপে সুশোভিত হল ভূমণ্ডল।
চন্দ্র ম্লান হৈল দেখি বদন কমল।।
ভীমরাজা করিল কন্যার স্বয়ম্বর।
নিমন্ত্রিয়া আনিলেন যত নৃপবর।।
দময়ন্তী রূপগুণ শুনিয়া শ্রবণে।
দেখিতে আইল কত বিনা নিমন্ত্রণ।।
নারদের এই বাক্যে শুনি দেবগণ।
দময়ন্তী রূপে মুগ্ধ হৈল সেইক্ষণ।।
দময়ন্তী প্রাপ্তি বাঞ্ছা করি দেবগণ।
স্বয়ম্বর স্থানে সবে করিল গমন।।
পৃথিবীতে বসে যত রাজরাজেশ্বর।
অহির্নিশি আসিতেছে বিদর্ভ নগর।।
সসৈন্যে চলিল নল পেয়ে নিমন্ত্রণ।
পথে নল সহ ভেট হৈল দৈবগণ।।
দেখিয়া নলের রূপ বিস্ময় অন্তর।
দময়ন্তী বাঞ্ছা ত্যাগ কিরল অমর।।
নলে দেখি অন্যে না বরিবে কদাচন।
এত চিন্তি নল প্রতি বলে দেবগণ।।
সাধু সর্ব্বগুণাশ্রয় তুমি মহারাজ।
সহায় হইয়া তুমি কর এক কাজ।।
কৃতাঞ্জলি করি বলে নিষধ নন্দন।
কে তোমরা আমা হৈতে কিবা প্রয়োজন।।
ইন্দ্র বলে, আমি ইন্দ্র, ইনি বৈশ্বানর।
শমন বরুণ এই জলের ঈশ্বর।।
সবে আসিয়াছি দময়ন্তী লভিবারে।
সবাকার দূত হয়ে যাহ তথাকারে।।
কি বলে বৈদর্ভী, জানি আইস সত্বর।
নলেরে এতেক বাক্য কহে পুরন্দর।।
রাজা বলে, দ্রুতগতি যাইতেছি আমি।
কেমনে ভেটিব কন্যা, অগম্য সে ভূমি।।
রক্ষকেরা পুররক্ষা করিছে যতনে।
এ বেশে পুরুষ আমি যাইব কেমনে।।
দেবগণ বলে, আমা সবার প্রভাবে।
না হবে বারণ, তুমি অলক্ষেতে যাবে।।
দেবগণ বাক্য নল করিয়া স্বীকার।
চলিয়া গেলেন দময়ন্তীর আগার।।
সখীগণমধ্যে দময়ন্তীরে দেখিল।
দেখিয়া তাঁহার রূপ মোহিত হইল।।
অতি সুকুমাররূপা অনঙ্গ মোহিনী।
কৃশোদরা মনোহরা বিশাল লোচনী।।
পূর্ব্বে হংসমুকে রাজা যতেক শুনিল।
সত্য সত্য বলি রাজা সকল মানিল।।
নলে দেখি দময়ন্তী হল চমকিত।
কেবা এ পুরুষবর হেথা উপনীত।।
ইন্দ্র কিম্বা কামদেব অশ্বিনীকুমার।
ধন্য ধাতা, হেন রূপ সৃজিল ইহার।।
বসিতে আসন দিতে হৃদয়ে বিচারে।
সাহস করিয়া কিছু কহিতে না পারে।।
কতক্ষণে মৃদু হাসি কহে মৃদুভাষে।
কে তুমি আসিলে হেথা বল কিবা আশে।।
কেমনে আসিলে হেথা, কেহ না দেখিল।
লক্ষ লক্ষ রক্ষকেতে যে পুরী রাখিল।।
পবনাদি দেবে মোর পিতা দণ্ড করে।
এত দূর্গ পার হয়ে এলে কি প্রকারে।।
রাজা বলে আমি নল জান বরাননে।
হেথা আইলাম দেবতার দূতপণে।।
ইন্দ্রাগ্নি বরুণ যম পাঠান আমারে।
সবাকার ইচ্ছা বড় তোমা লভিবারে।।
এ চারি জনের মধ্যে যারে হয় মন।
আজ্ঞা কর, তারে গিয়া করি নিবেদন।।
এই হেতু তব পুরে করি আগমন।
দেবের প্রভাবে না দেখিল কোন জন।।
কন্যা বলে, দেবগণ বন্দিত সবার।
সে কারণে তা সবায় মম নমস্কার।।
নিস্ফলে হেথায় আসিছেন দেবগণ।
পূর্ব্বে নল নৃপতিরে করেছি বরণ।।
হংসমুখে পূর্ব্বে আমি বরেছি তোমায়।
কেমনে আমারে ত্যাগ কর নররায়।।
কায়মনোবাক্যে রাজা তুমি মম পতি।
তোমা ভিন্ন বিষ অগ্নি জলে মোর গতি।।
নল বলে, যেই দেবে পূজে সর্ব্বজন।
তপস্যা করিয়া বাঞ্ছে যাঁর দরশন।।
মুহূর্ত্তেকে ভূমণ্ডল বিনাশিতে পারে।
হেন জন বাঞ্ছে তোমা, ত্যজ কোন তাঁরে।।
ইন্দ্র দেবরাজ দৈত্য দানব মর্দ্দন।
ত্রৈলোক্যের উপরে যাঁহার প্রভুপণ।।
শচীর সমান হবে যাঁহারে বরিলে।
হেন দেব ত্যজি কেন মনুষ্য ইচ্ছিলে।।
দিকপাল বৈশ্বানর সবাকার গতি।
যাঁর ক্রোধে মুহুর্ত্তেকে ভস্ম হয় ক্ষিতি।।
বরুণ জলেশ, যম নর অন্তকারী।
কেমনে বরিবে অন্যে তাঁকে পরিহরি।।
কন্যা বলে, অন্যে মোর ‍নাহি প্রয়োজন।
তুমি ভর্ত্তা তুমি কর্ত্তা করিনু বরণ।।
শুভকার্য্যে বিলম্ব না কর মহামতি।
গলে মাল্য দিতে রাজা দেহ অনুমতি।।
নল বলে, ইহা সম নাহিক অধর্ম্ম।
দূত হয়ে কেমনে করিব হেন কর্ম্ম।।
এত শুনি বৈদর্ভীর বিষণ্ণ বদন।
দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ, করেন রোদন।।
পুনঃ বলে দময়ন্তী চিন্তিয়া উপায়।
বরিব তোমায় দোষ না হবে তাহায়।।
দেবগণ সহ তুমি এস স্বয়ন্বরে।
তাঁ সবার মধ্যে আমি বরিব তোমারে।।
এত শুনি নল রাজা করেন গমন।
দেবগণ পাশে গিয়া করে নিবেদন।।
কেহ না দেখিল মোরে তব অনুগ্রহে।
দেখিলাম সে কন্যারে অন্তঃপুর গৃহে।।
কহিলাম সবাকারে যে সব সন্দেশ।
প্রবন্ধেতে রূপ গুণ বিভব বিশেষ।।
কারেও না চাহি কন্যা আমারে ইচ্ছিল।
আসিবার কালে পুনঃ এমত বলিল।।
দেবগণ সঙ্গে এস স্বয়ন্বর স্থানে।
তোমারে বরিব তাঁ সবার বিদ্যমানে।।
বৈদর্ভীর চিত্ত বুঝি সব দেবগণ।
নলের সমান রূপ ধরেন তখন।।
এইরূপে দেবগণ নলের সংহতি।
স্বয়ম্বর স্থানে চলি গেল শীঘ্রগতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
শ্রবণে অধর্ম্ম নাশে শাস্ত্রের বিধান।।
৪২. দময়ন্তীর নল বারণ
স্বয়ম্বর উপনীত যত রাজগণ।
যথাযোগ্য আসনেতে বসে সর্ব্বজন।।
কুশে শীলে রূপে গুণে একই প্রকার।
বিবিধ রতন অঙ্গে শোভে সবাকার।।
সিংহগ্রীব গজস্কন্ধ গমনে সিন্ধুজ।
পঞ্চমুখ ভুজঙ্গ সদৃশ ধরে ভুজ।।
তবে বিদর্ভের রাজা শুভক্ষণ দিনে।
দময়ন্তী আনাইল সভা বিদ্যমানে।।
দেখিয়া মোহিত হৈল সব রাজগণ।
দৃষ্টিমাত্র হরিলেক সবাকার মন।।
যত যত মহারাজ আছিল সভায়।
চিত্রের পুত্তলি প্রায় একদৃষ্টে চায়।।
নল বিনা বৈদর্ভীর অন্যে নাহি মন।
কোথায় আছেন নল করে নিরীক্ষণ।।
এক স্থানে দেখে ভৈমী সভার ভিতর।
নলের আকার পঞ্চ পুরুষ সুন্দর।।
আকারে নলের সম, নাহি কিছু ভেদ।
দেখি দময়ন্তী চিত্তে করে বড় খেদ।।
পঞ্চজন নল দেখি, বরিব কাহারে।
হৃদয়ে করিল চিন্তা বঞ্চিল অমরে।।
দেবতা মানব মূর্ত্তি কভু এক নয়।
তথাপি দেব মায়ায় সব এক হয়।।
উপায় না দেখি ভৈমী বিচারিল মনে।
করযোড়ে স্তুতিবাদ করে দেবগণে।।
তোমরা যে অন্তয্যামী জানহ সকল।
পূর্ব্বে হংসমুখে আমি বরিয়াছি নল।।
প্রসন্ন হইয়া সবে মোরে দেহ বর।
জ্ঞাত হয়ে পাই আমি আপন ঈশ্বর।।
সত্যেতে সংসার বর্ত্তে আমি যদি সতী।
তোমা সবা মধ্যে যেন চিনি নিজ পতি।।
বৈদভীর মনোভাব জানি দেবগণ।
আপন আপন চিহ্ন করান দর্শন।।
অনিমেষ নয়ন, স্বেদাম্বুহীন কায়া।
অম্লান কুসুম অঙ্গে, নাহি অঙ্গচ্ছায়া।।
বৈদর্ভী জানিল তবে এ চারি অমর।
নল নরপতি দেখে ভূমির উপর।।
হৃষ্টা হয়ে শীঘ্রগতি মালা দিল গলে।
দেবতা গন্ধর্ব্ব সবে সাধু সাধু বলে।।
তবে নল নরপতি প্রসন্ন হইয়া।
দময়ন্তী প্রতি বলে আশ্বাস করিয়া।।
যাবৎ শরীরে মম থাকিবেক প্রাণ।
তাবৎ ধরিব তোমা প্রাণের সমান।।
নলেরে বৈদর্ভী তবে করিল বরণ।
দেখিয়া সন্তুষ্ট হৈল যত দেবগণ।।
তুষ্ট হয়ে ইষ্টবর দিল চারিজন।
অলক্ষিত বিদ্যা দিল সহস্রলোচন।।
অমৃত দিলেন তবে জলের ঈশ্বর।
যথায় চাহিবে জল পাবে নরবর।।
অগ্নি বলে, যাহা ইচ্ছা করিবে রন্ধন।
বিনা অগ্নি রন্ধন হইবে ততক্ষণ।।
প্রাণীবধ বিদ্যা দিল সূর্য্যের নন্দন।
অস্ত্র তূণ ধনু দিয়া করিল গমন।।
নিবর্ত্তিয়া স্বয়ন্বর সবে গেল ঘর।
দময়ন্তী লয়ে গেল নল নৃপবর।।
দময়ন্তী বিনা রাজা অন্যে নাহি মতি।
কুতূহলে ক্রীড়া করে যেন কাম রতি।।
বহু যজ্ঞ সমাধিল, কৈল বহু দান।
পুণ্যবলে নাহি কেহ নলের সমান।।
মহাভারতের কথা পরম পবিত্র।
আরণ্যকে অনুপম নলের চরিত্র।।
৪৩. নল ও পুষ্করের দ্যূতক্রীড়া
স্বয়ম্বর নিবর্ত্তিয়া যায় দেবগণ।
পথেতে দ্বাপর কলি ভেটে দুই জন।।
পুছিল দুজনে ইন্দ্র যাহ কোথাকারে।
কলি বলে, যাই বৈদর্ভীর স্বয়ম্বরে।।
সে কন্যার রূপ গুণ শুনিয়া শ্রবণে।
প্রাপ্তি ইচ্ছা করি তথা যাই দুই জনে।।
হাসি ইন্দ্র বলে, সাঙ্গ হৈল স্বয়ম্বর।
নলেরে বরিল ভৈমী সভার ভিতর।।
এত শুনি বলে কলি মহাক্রোধভরে।
দেব স্বামী ত্যজি দুষ্টা বরিল নরেরে।।
এই হেতু দণ্ড আমি করিব তাহারে।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি করিব তাহারে।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি করিব তাহারে।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি তোমার গোচরে।।
দেবগণ বলে, তার দোষ নাহি তিলে।
আমা সবাকার বাক্যে বরিলেক নলে।।
নলের চরিত্র কিছু কহনে না যায়।
দেবতার যত গুণ নল নৃপে হয়।।
সমুদ্র গভীর ছিল, স্থির ছিল মেরু।
পৃথিবীতে ক্ষমা ছিল, চন্দ্র ছিল চারু।।
সবারে ছাড়িয়া নলে করিল আশ্রয়।
যজ্ঞ সভা তৃপ্ত দেব যাহার আলয়।।
সত্যব্রত দৃঢ়ব্রতী তপঃশৌচ দানী।
আমা সবাকার মাঝে নলেরে বাখানি।।
হেন নলে দুঃখদাতা হবে যেই জন।
বিপুল দুঃখেতে মজিবেক সেই জন।।
এত বলি দেবগণ করিল গমন।
দ্বাপর কলিতে দোঁহে চিন্তে মনে মন।।
নলের যতেক গুণ বলে সুরপতি।
হেন যনে দিবে দণ্ড কাহার শকতি।।
কলি বলে, তুমি মোর হইবে সহায়।
যেমনে দণ্ডিব মনে করিব উপায়।।
রাজ্যভ্রষ্ট করাব, বিচ্ছেদ দুই জনে।
পাশায় করিয়া মত্ত নৈষধ রাজনে।।
অক্ষপাটি হবে তুমি সহায় আমার।
কলি বাক্যে দ্বাপর করিল অঙ্গীকার।।
এতেক বিচারি দোঁহে করিল গমন।
নলের সহিত কলি থাকে অনুক্ষণ।।
নৃপতির পাপছিদ্র খুঁজে নিরন্তর।
হেনমতে গেল দিন দ্বাদশ বৎসর।।
একদিন নরপতি সন্ধ্যার কারণে।
অল্প শৌচ কৈল পদে, ভ্রম হৈল মনে।।
ছিদ্র পেয়ে কলি প্রবেশিল তাঁর দেহে।
নিজ বুদ্ধি হীন হৈল রাজার হৃদয়।।
পুষ্কর নামেতে ছিল রাজার সোদর।
তাহার সদনে কলি চলিল সত্বর।।
কলি বলে, অবধান করহ পুষ্কর।
বৈভব বাঞ্ছব যদি মম বাক্য ধর।।
নলের সহিত পাশা খেল গিয়া তুমি।
সহায় হইয়া তোরে জিতাইব আমি।।
কলির আশ্বাস পেয়ে পুষ্কর চলিল।
খেলিব দেবন, বলি নলে আহবানিল।।
এতেক শুনিয়া নল পুষ্করের দম্ভ।
অহঙ্খারে ক্ষণেক না করিল বিলম্ব।।
পণ করি খেলিতে লাগিল দুই জন।
হিরণ্য বিবিধ আর রজত কাঞ্চন।।
পুষ্করের বশ অক্ষ দ্বাপর প্রভাবে।
নাহি হয় অন্যথা সে, যাহা মাগে যবে।।
পুনঃ ক্রোধে পণ করিলেন রাজা নল।
মতিচ্ছন্ন হইল, না বুঝে মায়াবল।।
সুহৃদ বান্ধব মন্ত্রী যত পৌরজন।
কার শক্তি না হৈল করিতে নিবারণ।।
তবে যত বন্ধুগণ একত্র হইয়া।
দময়ন্তী স্থানে সবে জানাইল গিয়া।।
মহাদুঃখ উৎপাত আনেন নৃপতি।
কর গিয়া আপনি নিবৃত তুমি সতী।।
এত শুনি দময়ন্তী বিষণ্ণ বদন।
অতিশীঘ্র নৃপস্থানে করিল গমন।।
রাজারে বলেন ভৈমী বিনয় বচন।
মন্ত্রীসহ দ্বারে আছে অমাত্যের গণ।।
আজ্ঞা কর, সবে আসি করুক দর্শন।
ত্যজহ দেবন প্রভু, রাজ্যে দেহ মন।।
কলিতে আচ্ছন্ন রাজা, নাহি শুনে বাণী।
মাথা তুলি ভৈমীরে না চাহে নৃপমণি।।
পুনঃ পুনঃ কহি ভৈমী বারিতে নারিল।
জ্ঞানহত হৈল রাজা, নিশ্চয় জানিল।।
নিজ নিজ গৃহে তবে গেল পুরজন।
অন্তঃপুরে গেল ভৈমী করিয়া রোদন।।
হেনমতে নলরাজা খেলে বহু দিন।
ক্রমে ক্রমে বৈভবাদি সব হৈল হীন।।
অক্ষ বিনা নৃপতির নাহি অন্য মন।
সকল ত্যজিয়া রাজা খেলে অনুক্ষণ।।
দেখিয়া বৈদর্ভী মনে আতঙ্ক পাইল।
বৃহৎসেনা নামে ধাত্রী প্রতি সে বলিল।।
শীঘ্র আন বার্ষ্ণেয় সারথিকে ডাকিয়া।
আজ্ঞামাত্র গেল ধাত্রী আরতি বুঝিয়া।।
সেইক্ষণে আইল সারথি বিচক্ষণ।
সারথি দেখিয়া ভৈমী বলেন বচন।।
সর্ব্বনাশ হেতু পথ করিল রাজন।
এ মহাবিপদে তুমি করহ তারণ।।
ইন্দ্রসেন পুত্র আর কন্যা ইন্দ্রসেনা।
মম জ্ঞাতিগৃহে রাখি এস দুই জনা।।
বিলম্ব না কর রথ আন শীঘ্রগতি।
আজ্ঞামাত্র রথ সাজি আনিল সারথি।।
রথে চড়াইল দুই কুমার কুমারী।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল কুণ্ডিন নগরী।।
রথ অশ্ব সহিত থুইল রাজপুরে।
পুনঃ গেল বার্ষ্ণেয় সে নিষধ নগরে।।
পুণ্যকথা ভারতের শুনে পুণ্যবান।
কাশীদাস বিরচিল নলের আখ্যান।।
৪৪. নল-দময়ন্তীর বন গমন
ও নলের দময়ন্তী ত্যাগ
পুষ্করের সহ পাশা খেলে রাজা নল।
একে একে রাজ্য ধন হারিল সকল।।
বসন ভূষণ আর রত্ন অলঙ্কার।
সকল হারিল রাজা, কিছু নাহি আর।।
হাসিয়া পুষ্কর তবে বলিল বচন।
দেখিব কি আছে আর, শীঘ্র কর পণ।।
অবশেষে তব কিছু নাহি দেখি আর।
রাণী দময়ন্তী পণ করহ এবার।।
এত শুনি নল ক্রোধে আরক্তিম নেত্র।
পুষ্করের বাক্য যেন পৃষ্ঠে মারে বেত্র।।
তবে রাজা বস্ত্র রত্ন যা ছিল শরীরে।
বাহির করিয়া সব দিলেন পুষ্করে।।
একবস্ত্র পরিধানে বাহির হইল।
অন্তঃপুরে থাকি সব বৈদর্ভী শুনিল।।
অঙ্গের ভূষণ যত ফেলিল খুলিয়া।
চলিল রাজার সহ একবস্ত্রা হৈয়া।।
আজ্ঞা দিল পুষ্কর আপন অনুচরে।
এই কথা জ্ঞাত কর নগরে নগরে।।
নল নৃপেরে যে জন দিবেক আশ্রয়।
সবংমে সংহার আমি করিব তাহায়।।
আজ্ঞামাত্র রাজ্যে রাজ্যে জানাইল চর।
রাজাজ্ঞা শুনিয়া সবে হৃদে পায় ডর।।
তিন দিন নল নৃপ নগরে রহিল।
দণ্ড ভয়ে কেহ তাঁরে আশ্রয় না দিল।।
কেহ না জ্ঞিজ্ঞাসে, কেহ না যায় নিকটে।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় নল গেল নদীতটে।।
তিন রাত্রি দিনান্তরে করি জলপান।
তারপর বনমধ্যে করিল প্রয়াণ।।
পাছু পাছু দময়ন্তী করিল গমন।
অরণ্যের মধ্যে প্রবেশিল দুই জন।।
বহুদিন ক্ষুধা তৃষ্ণা শরীর পীড়িত।
বনমধ্যে স্বর্ণপক্ষী দেখে আচম্বিত।।
পক্ষী দেখি আনন্দেতে ভাবিল রাজন।
মাংস ভক্ষি পক্ষ বেচি পাব বহুধন।।
ধরিবার উপায় চিন্তিলেন মনে মন।
পক্ষীর উপর ফেলে পিন্ধন বসন।।
বস্ত্র লয়ে উড়িল মায়াবী বিহঙ্গম।
আকাশে উড়িয়া বলে, আর মতিভ্রম।।
সর্ব্বনাশ কৈনু অক্ষে ভ্রষ্ট করি জ্ঞান।
আমি কলি দ্বাপর বলিয়া এবে জান।।
আমা সবা এড়ি ভৈমী বরিল তোমারে।
তাহার উচিত ফল দিলাম তোমারে।।
এত শুনি নরপতি ভৈমী প্রতি বলে।
যতেক কহিল পক্ষী শ্রবণে শুনিলে।।
অক্ষে যেই হারাইল, সেই বস্ত্র নিল।
নিশ্চয় আমার প্রিয়ে জ্ঞান হত হৈল।।
এখন যে বলি শুন তাহার কারণে।
এই যে যাইতে পথ দেখহ দক্ষিণে।।
অবন্তী-নগরে লোক যায় এই পথে।
এই যে দেখহ পথ কোশল যাইতে।।
এই পথে যাই প্রিয়ে বিদর্ভ নগর।
শুনিয়া হৈল ভৈমী কম্পিত অন্তর।।
রোদন করিয়া ভৈমী কহে রাজা প্রতি।
তব বাক্য শুনি মোর স্থির নহে মতি।।
রাজ্যনাশ বনবাস বিবস্ত্র হইলে।
মহা দুঃখার্ণবেতে নিমর্জ্জিত হইলে।।
সব পাসরিবে আমি থাকিলে সংহতি।
আমারে ত্যজিতে কেন চাহ নরপতি।।
ভার্য্যার বিহনে রাজা নাহি সুখলেশ।
আমারে ত্যজিলে বনে পাবে বহু ক্লেশ।।
নল বলে, সত্য তুমি যতেক কহিলে।
ভার্য্যা সম মিত্র আর নাহি ক্ষিতিতলে।।
ত্যজিবারে পারি আমি আপন জীবন।
তোমা ত্যাগ না করিব আমি কদাচন।।
ভৈমী বলে, মোরে যদি ত্যাগ না করিবে।
বিদর্ভের পথ কেন দেখাইয়া দিবে।।
এই হেতু, শঙ্কা মম হতেছে রাজন।
তোমা ছাড়ি গেলে মোর নিশ্চয় মরণ।।
এক বাক্য বলি রাজা, যদি লয় মনে।
বিদর্ভ নগরে চল যাই দুই জনে।।
তোমারে দেখিলে পিতা হবে হরষিত।
দেবতুল্য তোমারে পূজিবে নিত্য নিত্য।।
নল বলে, নহে দেবি যাবার সময়।
এ বেশে কুটুম্বগৃহে উচিত না হয়।।
আপনি জানহ তুমি স্বয়ম্বর কালে।
তব পিতৃগৃহে গেনু চতুরঙ্গ দলে।।
এখন এ বেশে গেলে হাসিবেক লোক।
বৈরীর হইবে হর্ষ, সুহৃদের শোক।।
পরম বন্ধুর গৃহে যায় যদি দীন।
মহাগুণী হইলেও হয় মানহীন।।
অনাহারে থাকি তপ করিব কাননে।
দুঃখী হয়ে বন্ধুগৃহে, না যাব কখনে।।
তবে পুনঃ পুনঃ ভৈমী যতেক কহিল।
না শুনিল সে নল সঙ্কল্প না টালিল।।
যেই বস্ত্র ছিল ভৈমী করিয়া পিন্ধন।
সেই বস্তই পিন্ধন কৈল দুই জন।।
ছাড়িয়া যাবেন স্বামী ভয় করি মনে।
এক বস্ত্র বৈদর্ভী পরিল সে কারণে।।
বেগেতে চলিতে নারে, যায় ধীরে ধীরে।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ভ্রমে দুর্ব্বল শরীরে।।
দিব্য এক স্থান রাজা হেরিল কাননে।
শ্রান্ত হইয়া তথা শুইল দুই জনে।।
বাহু বন্ধনে ভৈমী ধরি রহে রাজারে।
পাছে স্বামী যায় ছাড়ি, সভয় অন্তরে।।
একে সুকুমারী, বহুদিন নিরাহারা।
শোবামাত্র দময়ন্তী হৈল জ্ঞানহারা।।
দুঃখে সন্তাপিত নল, নিদ্রা নাহি যায়।
মনে বিচারিল, যে বৈদর্ভী নিদ্রা যায়।।
এ ঘোর অরণ্যে ভৈমী সঙ্গে যদি থাকে।
মম দুঃখ দেখি, নিত্য মজিবেক শোকে।।
আমারে না দেখি কোন পথিক সংহতি।
ক্রমে ক্রমে যাইবেক পিতার বসতি।।
এ দুঃখ সমুদ্র হৈতে হইবে মোচন।
আমিহ একক হৈলে যাব যথা মন।।
একাকী রাখিয়া যাব, ঘোর বনস্থল।
সেই ভয় নাহি, কেহ করিবে না বল।।
তপস্বিনী পতিব্রতা, ভকতি আমাতে।
এরে কে করিবে বল নাহি ত্রিজগতে।।
কলিতে আচ্ছন্ন রাজা, হত নিজ জ্ঞান।
দময়ন্তী ত্যজিবারে করে অনুমান।।
এক বস্ত্র আচ্ছাদন দোঁহাকার গায়।
মনে চিন্তে কি করিব ইহার উপায়।।
পাছে জাগে দময়ন্তী চিন্তিত রাজন।
ভাবিত হইল বড় কি করি এখন।।
কেমনে ত্যজিব আমি এক বস্ত্র পরা।
শরীরে আছিল কলি দুষ্ট খরতরা।।
জানিয়া রাজার মন হৈল খড়্গরূপ।
সম্মূখে হেরিয়া খড়্গ হরষিত ভূপ।।
অস্ত্র লয়ে অর্দ্ধবাস ছেদন করিল।
মায়াতে মোহিত রাজা আকুল হইল।।
ধীরে ধীরে তথা হৈতে গমন করিল।
কতদূর হতে তবে বাহুড়ি আইল।।
দেখিল বৈদভী নিদ্রা যায় অচেতন।
ব্যাকুল হইয়া রাজা করয়ে ক্রন্দন।।
সিংহ ব্যাঘ্র লক্ষ লক্ষ এ ঘোর কাননে।
কি গতি হইবে প্রিয়া আমার বিহনে।।
হে সূর্য্য পবন চন্দ্র বনের দেবতা।
তোমা সবে রক্ষা কর আমার বনিতা।।
এত বলি নরপতি গমন করিল।
পুনঃ কতদূর হৈতে ফিরিয়া আইল।।
কলিতে আচ্ছন্ন রাজা দুই দিক মন।
ভার্য্যা স্নেহ ছাড়িতে না পারে কদাচন।।
দময়ন্তী দুঃখে দুঃখী কহিছে অন্তরে।
অনাথা করিয়া প্রিয়ে যাই যে তোমারে।।
পুনরপি বিধি যদি করায় ঘটন।
দেখিব তোমারে নহে শেষ দরশন।।
এত চিন্তি নরপতি আকুল হৃদয়।
পাছে দময়ন্তী জাগে পুনঃ হৈল ভয়।।
অতিবেগে চলিয়া যাইল সেইক্ষণ।
প্রবেশ করিল গিয়া নির্জ্জন কানন।।
৪৫. দময়ন্তীর সর্প গ্রাস হইতে মুক্তি
ও ব্যাধকে অভিশাপে ভস্ম করণ
কতক্ষণে দময়ন্তী নিদ্রা অবশেষে।
সজাগ হইয়া দেখে, স্বামী নাহি পাশে।।
মূর্চ্ছিত হইয়া ভৈমী ভূমিতলে পড়ি।
ধূলায় ধূসর হয়ে যায় গড়াগড়ি।।
উঠিয়া সঘনে চতুর্দ্দিকে ধায় রড়ে।
নাথ নাথ বলি উচ্চৈঃস্বরে ডাক ছাড়ে।।
অনাথা ডাকয়ে কেন না দেহ উত্তর।
কোন দিক গেলে প্রভু নিষধ ঈশ্বর।।
কোন দোষে দোষী আমি নহি তপ পায়।
তবে কেন আমারে ত্যজিলা মহাশয়।।
ধার্ম্মিক বলিয়া তোমা কহে সর্ব্বলোকে।
তবে কেন নিদ্রিতা ছাড়িয়া গেলে মোকে।।
লোকপাল মধ্যে পূর্ব্বে সত্য কৈলে প্রভু।
শরীর থাকিতে আমা না ছাড়িবে কভু।।
সত্যবাদী হয়ে সত্য ছাড় কি কারণ।
লুক্কায়িত আছ কোথা, দেহ দরশন।।
দুঃখ সিন্ধু মধ্যে প্রভু কেন দেহ দুখ।
অতি শীঘ্র এস নাথ, দেখি তব মুখ।।
ক্ষুধার্ত্ত ফলের হেতু গিয়াছ কি বনে।
তৃষ্ণার্ত্ত হইয়া কিবা গেলে জলপানে।।
এত বলি বনে বনে ভৈমী পর্য্যাটিয়া।
ক্ষণে উঠে, ক্ষণে বসে, ক্ষণে যায় ধাইয়া।।
সিংহ ব্যাঘ্র মহিষ শূকর যতি ছিল।
লক্ষ লক্ষ চতুর্দ্দিকে তাহারা বেড়িল।।
স্বামী অন্বেষিয়া ভৈমী করে বনভ্রম।
অকস্মাৎ সম্মুখেতে দেখে ভুজঙ্ঘম।।
বিকট দর্শন আর বিকট গর্জ্জন।
ভৈমীরে দেখিয়া অহি বিস্তারে বদন।।
বিপরীত মূর্ত্তি অহি দেখিয়া নিকটে।
হা নাথ বলিয়া ডাকে পড়িয়া সঙ্কটে।।
আর না দেখিব প্রভু তোমার বদন।
নিশ্চয় হইনু অজগরের ভক্ষণ।।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দে দেবী বলিয়া হা নাথ।
দূরেতে থাকিয়া তাহা শুনে এক ব্যাধ।।
শীঘ্রগতি আসি ব্যাধ দেখি অজগর।
দুইখান করিল মারিয়া তীক্ষ্ণ শর।।
সর্প মারি মৃগজীবী কহে বৈদর্ভীরে।
কে তুমি একাকী ভ্রম এ কানন ঘোরে।।
সকল বৃত্তান্ত তারে বৈদর্ভী কহিল।
বৈদর্ভীর রূপে ব্যাধ আকুল হইল।।
সম্পূর্ণ চন্দ্রমামুখ পীন পয়োধর।
বচন অমৃতে ব্যাধে বিন্ধে স্মরশর।।
কামাতুর হয়ে যায় ভৈমী ধরিবারে।
ব্যাধেরে দেখিয়া ভৈমী কহিছে অন্তরে।।
সত্যশীল নল রাজা যদি মোর পতি।
নল বিনা অন্যে যদ নাহি থাকে মতি।।
এ ‍পাপিষ্ঠ পরশিতে না পারে আমায়।
এখনি হইক অস্মরাশি দুরাশয়।।
এতেক বলিতে ব্যাধ ভস্ম হয়ে গেল।
স্বামীর উদ্দেশে সতী বৈদর্ভী চলিল।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র