২৬. ধৃতরাষ্ট্রের নিকট সনৎসুজাত মুনির আগমনসভা হৈতে উঠি যবে সকলে চলিল।বিদুর সহিত অন্ধ নৃপতি রহিল।।পাণ্ডবের ভয়ে অন্ধ চিন্তানলে জ্বলে।আসিল সনৎসুজাত মুনি হেনকালে।।সম্ভ্রমে বিদুর তবে উঠি সেইক্ষণ।দণ্ডবৎ করি দিল বসিতে আসন।।অন্ধকে বিদুর জানাইল সেইক্ষণে।আসিল সনৎসুজাত তব নিকেতনে।।শুনি অন্ধ দণ্ডবত করিল প্রণতি।পাদ্য অর্ঘ্য আনাইয়া দিল শীঘ্রগতি।।তুষ্ট হয়ে আসনেতে বসে তপোধন।কহিতে লাগিল তবে অম্বিকা নন্দন।।পাপাত্মা কুবুদ্ধি দুর্য্যোধন মোর সুত।কলহ বাঞ্ছয়ে সদা পাণ্ডব সহিত।।পাণ্ডুপুত্রগণ কভু অহিত না করে।যতেক দারুণ কষ্ট দিল বারে বারে।।সকল ক্ষমিল তারা আমার কারণ।তথাপিহ তারে নাহি দেয় রাজ্যধন।।পাণ্ডবের দূত হয়ে বুঝাইল হরি।তাঁর বাক্য না শুনিল মহাপাপকারী।।বুঝাইল মুনিগণ না শুনিল কাণে।ভীষ্ম দ্রোণ আদি আমি যত পুরজনে।।কারো বাক্য না শুনিল দুষ্ট দুর্য্যোধন।আপনি তাহারে কিছু বলে তপোধন।।তত্ত্বজ্ঞান কহি তারে করাহ সুমতি।পাণ্ডবেরে ছাড়ি যেন দেয় বসুমতী।।শুনিয়া সনৎসুজাত কহেন তখন।দিনমণি যদি উঠে পশ্চিম গগন।।তথাপি পাণ্ডব সহ নাহি হবে প্রীতি।পূর্ব্বের কাহিনী শুন, কহি শাস্ত্রনীতি।।প্রবল অসুরে যবে পৃথিবী ব্যাপিল।দান যজ্ঞ গো ব্রাহ্মণ সকল হিংসিল।।হিংসাতে পূরিল ক্ষিতি, ধর্ম্ম হৈল ক্ষয়।দেখিয়া পৃথিবী বড় মনে পেয়ে ভয়।।ব্রহ্মার সাক্ষাতে গিয়া কহিল গোহারী।হিংসকের ভার আর সহিতে না পারি।।আমাতে জন্মিয়া জীব করে অহঙ্কার।মোর রাজ্য, মোর ধন, মোর পরিবার।।মরিলে সম্বন্ধ দেখ নাহি কার সনে।আমারে হিংসয়ে লোক আপনা না জানে।।কার বাধ্য নহি আমি, কার আপ্ত নহি।কীট পক্ষী নর বৃক্ষ সবাকারে বহি।।আমাতে জন্মিয়া সুখে আমাতে বিহরে।আমাতে জন্মিয়া জীব আমাতেই মরে।।উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি আমি সবাকার।তবু অবিচারে হিংসা করে দুরাচার।।তবু অবিচারে হিংসা করে দুরাচার।অহিংসা পরম ধর্ম্ম, মনে নাহি জানে।।আমার আমার নাহি করিলে আপনে।প্রলয় অসুর ব্যাপ্ত হইল এক্ষণে।।সহিতে না পারি আর অসুরের ভার।পাতালেতে যাই আমি লভিতে নিস্তার।।পৃথিবীর স্তবে তুষ্ট হয়ে পদ্মাসন।হরির নিকটে গিয়া করেন স্তবন।।নমঃ আদি অন্তহীন, নিত্য সনাতন।তোমার আজ্ঞায় সৃষ্টি করিনু সৃজন।।হেন সৃষ্টি নাশ করে অসুর প্রবল।সহিতে না পারে ক্ষিতি, যায় রসাতল।।উপায়ে উদ্ধার কর ব্রহ্মা-সনাতন।এইরূপে নানা স্তুতি কৈল পদ্মাসন।।স্তুতিবশে সুপ্রসন্ন হয়ে জগন্নাথ।দিব্যরূপ হইলেন ব্রহ্মার সাক্ষাৎ।।সাক্ষাতে দেখিল হরি কমল-আসন।দণ্ডবৎ করি পুনঃ করিল স্তবন।।গোবিন্দ কহেন, ভয় না করিহ আর।তোমার বচনে আমি হব অবতার।।চারি যুগে চারি অংমে হয়ে অবহার।যতেক অসুরগণে করিব সংহার।।এত বলি নিজস্থানে যান নারায়ণ।শুনি ব্রহ্মা চলিলেন হয়ে হৃষ্টমন।।সান্ত্বাইয়ে পৃথিবীরে বলিল বচন।অচিরেতে তব দুঃখ হইবে মোচন।।প্রত্যক্ষ হইয়া প্রভু কহিলা আমারে।অবতার হয়ে সব মারিবে অসুরে।।অচিরেতে তব ভার করিবে মোচন।যুগে যুগে অবতার হয় নারায়ণ।।শুনিয়া পৃথিবী হৈল আনন্দিতা মনে।প্রণমি ব্রহ্মারে তবে গেল নিজ স্থানে।।অঙ্গীকার পালিবারে দেব দামোদর।প্রথমে ধরেন প্রভু মৎস্য কলেবর।।বেদ উদ্ধারিয়া হয়গ্রীব বিনাশন।অনন্তর কূর্ম্মরূপ হন নারায়ণ।।মন্দর ধরিয়া করি সমুদ্র মন্থন।নারীরূপে করিলেন অসুরে মোহন।।বরাহাবতার হইলেন অতঃপরে।ধরণী উদ্ধারি মারে হিরণ্যাক্ষ বীরে।।তৎপরে নৃসিংহমূর্ত্তি ধরি নারায়ণ।হিরণ্যকশিপু দৈত্য করেন নিধন।।ধরিয়া বামনরূপ দেব তারপর।বলির নাশেন দর্প দেব দামোদর।।নাগপাশে বান্ধি তারে রাখে রসাতলে।নিজ অধিকার দেন যত দিক্পালে।।সত্যযুগে হইলেন এই অবতার।অসুরের অহঙ্কার কৈল ছারখার।।ত্রেতাযুগে ক্ষত্রে সব পৃথিবী পূরিল।ভৃগুবংশে তাঁর অংশে অবতার হৈল।।পৃথিবীর ক্ষত্রগণে করিল সংহার।রামরূপে পুনরপি হৈল অবতার।।দারুণ রাক্ষস মারিলেন দশাননে।কৃষ্ণ অবতার প্রভু হৈলেন এক্ষণে।।বকাসুর কংস আর পূতনা রাক্ষসী।জরাসন্ধ রাজা আর শিশুপাল কেশী।।অবহেলে বধিলেন এ সব অসুরে।অবশেষ যত মারিবেন সবাকারে।।বিশ্বের কারণ সেই সৃজন পালন।সেই সৃজে, সেই পালে, করে সংহরণ।।তার বশ দেখ রাজা এ তিন ভুবন।ভেদবুদ্ধি করাবার তিনিই কারণ।।তাঁহার বিষম মায়া কে বুঝিতে পারে।একের বাড়ান ক্রোধ অন্যেরে সংহারে।।অদৃষ্টে যাহার যেই আছয়ে লিখন।বিধাতার শক্তি নাহি করিতে খণ্ডন।।পৃথিবীর ক্ষত্র নাশ হইবে অবশ্য।চিত্তে ক্ষমা দেহ রাজা, বুঝিয়া রহস্য।।পৃথিবীতে দেখ যত যত ক্ষত্রগণ।পরস্পর ভেদ করি হইবে নিধন।।দ্বাপর যুগের রাজা হৈল অবশেষ।ক্ষত্রক্ষয় হৈতে হবে জানিহ বিশেষ।।যদুকুল নিরমূল হবে অবশেষে।ভবিষ্যৎ অবতার হবে কলিশেষে।।এ সব জানিয়া রাজা ধর্ম্মে দেহ মন।পরলোক হেতু চিন্ত ঈশ্বর চরণ।।নানা যজ্ঞ ধর্ম্ম কর্ম্ম কর অবিরত।এ বিনা উপায় নাহি, কহিনু নিশ্চিত।।এত বলি সনৎসুজাত সে তপোধন।আপন আশ্রমে প্রতি করিল গমন।।চিত্তেতে প্রবোধ পেয়ে অন্ধ নরপতি।ক্ষমা দিয়া মৌনভাবে রহে মহামতি।।বিদুর চলিয়া গেল আপন ভবন।কহিলাম মহারাজ কথা পুরাতন।।মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, পরলোকে তরে।অবহেলে শুনে যেন সকল সংসারে।।২৭.পান্ডব সভায় শ্রীকৃষ্ণের আগমন ও পানন্ডগণের সসৈন্যে কুরুক্ষেত্রে গমনমুনি বলে অবধান করহ রাজন।সভা করি বসিয়াছে ভাই পঞ্চ জন।।হেনকালে উপনীত হন নারায়ণ।কৃষ্ণে দেখি সসম্ভ্রমে উঠে পঞ্চ জন।।বসিতে আসন দিয়া জিজ্ঞাসেন তাঁয়।কি কার্য্য করিলে কৃষ্ণ কুরুর সভায়।।বিবরিয়া সব কথা কহ নারায়ণ।এত শুনি হাসিমুখে কহে জনার্দ্দন।।অতি বড় নরাধম রাজা দুর্য্যোধন।কাহারো বচন না শুনিল কখন।।তোমার বিভাগ দিতে সবে বুঝাইল।কারো বাক্য দুর্য্যোধন কর্ণে না শুনিল।।অবশেষে আমি বহু কহিলাম তায়।তথাপি উচিত ভাগ নাহি দিতে চায়।।পঞ্চখানি গ্রাম কহিলাম ছাড়ি দিতে।শুনিয়া আসন ত্যাজি উঠিল ক্রোধেতে।।মহাদন্তে গর্জ্জি দর্পে কহিল সভায়।সাবধানে শুন কৃষ্ণ কহি যে তোমায়।।তীক্ষ্মসূচি অগ্রে ভূমি আচ্ছাদয়ে যত।বিনা যুদ্ধে পাণ্ডবেরে নাহি দিব তত।।নিশ্চয় হইবে যুদ্ধ না যায় খণ্ডন।ইহার বিধান তবে করহ রাজন।।এতেক শুনিয়া তবে পাণ্ডুর নন্দন।ক্রোধেতে অবশ অঙ্গ, কাঁপে ঘনে ঘন।।ক্ষণে ক্রোধ নিবারিয়া কহেন রাজন।মৃত্যুপথ দুর্য্যোধন করিল সৃজন।।শুন ভীম ধনঞ্জয় সহদেব বীর।শুনহ নকুল আর সাত্যকি সুধীর।।পাঞ্চাল নৃপতি ধৃষ্টদ্যুন্ন মহাশয়।জয়সেন আদি যত ভোজের তনয়।।যুদ্ধের সময় হৈল স্থির কর বুদ্ধি।সাবধানে কর সবে মম কার্য্যসিন্ধি।।শুনি অঙ্গীকার করিলেন বীরগণ।প্রাণপণে তব আজ্ঞা করিব পালন।।কণ্ঠেতে যাবৎ প্রাণ সবার আছয়।তাবৎ করিব যুদ্ধ, শুন মহাশয়।।বীরগণ-বাক্য তবে শুনি নরপতি।সহদেবে ডাকি আজ্ঞা দিল মহামতি।।শুভক্ষণ দেখ ভাই, যাব কুরুক্ষেত্র।সৈন্যগণে সাজিবারে বলহ একত্র।।সহদেব বলে, রাজা আজি শুভক্ষণ।পঞ্চমী দিবস আজি নক্ষত্র উত্তম।।আজি যাত্রা করিবারে হয়ত উচিত।আজ্ঞা কৈলে করি যত সৈন্য সমাহিত।।এত শুনি আজ্ঞা দেন ধর্ম্মের নন্দন।সৈন্য সেনাপতি শীঘ্র করহ সাজন।।পাইয়া রাজার আজ্ঞা চারি সহোদর।সৈন্য সেনাপতিগণ সাজিল বিস্তর।।পঞ্চ কোটি সহস্র শতেক মহারথী।লক্ষ কোটি শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ সাজে সেনাপতি।।কোটি কোটি অশ্ব আর পত্তি অগণন।সাত অক্ষৌহিণী সেনা করিল সাজন।।ঘটোৎকচ বীর আসে পেয়ে সমাচার।দুকোটি রাক্ষস হয় যার পরিবার।।চতুরঙ্গ দলে সৈন্য সাজে আগণন।এই মত পাণ্ডুসৈন্য করিল সাজন।।শূন্যে দেবগণ করে জয় জয় ধ্বনি।অতি শুভক্ষণে চলে পাণ্ডব বাহিনী।।তিন দিনে আসে পথ শতেক যোজন।কুরুক্ষেত্রে উত্তরিল পাণ্ডুপুত্রগণ।।গড় দেখি পঞ্চ ভাই হইলেন প্রীত।যুদ্ধের সামগ্রী দেখিলেন অপ্রমিত।।আত্মবর্গ যত আসে রাজ-রাজেশ্বরে।সাত্যকিরে বলে, অভ্যর্থনা করিবারে।।সাত্যকি চলিল আজ্ঞামাত্র বিচক্ষণ।সমাবেশ করি ক্রমে সব সৈন্যগণ।।যথাযোগ্য বসিতে সবারে দিল স্থিতি।নানা দ্রব্য উপহার দিল মহামতি।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাশীদাস কহে, সদা শুনে পুণ্যবান।।২৮.কুরু সৈন্যের কুরুক্ষেত্রে যাত্রামুনি বলে, শুন রাজা শ্রীজনমেজয়।কুরুক্ষেত্রে আসিলেন পাণ্ডুর তনয়।।সাত অক্ষৌহিণী সেনা করিয়া সাজন।রহেন উত্তরভাগে সিংহের গর্জ্জন।।চর আসি দুর্য্যোধনে করে নিবেদন।কুরুক্ষেত্রে সাজি এল পাণ্ডুপুত্রগণ।।শুনিয়া নৃপতি আজ্ঞা দিল দুঃশাসনে।শীঘ্রগতি ডাকি আন যত সভাজনে।।রণসজ্জা করি আসিয়াছে শত্রুগণ।শুভযাত্রা দেখি সৈন্য করহ চলন।।পাইয়া রাজার আজ্ঞা বীর দুঃশাসন।দৈবজ্ঞ আনিয়া দিন করিল গণন।।রাজারে কহিল তবে বীর দুঃশাসন।তৃতীয় প্রহরে যাত্রা অতি শুভক্ষণ।।সাজিবারে আজ্ঞা দিল যত সৈন্যগণে।জয় শব্দ করে যত সৈন্য হৃষ্টমনে।।অসংখ্য সাজিল রথী, লিখিতে না পারি।অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ কত সাজিল প্রহরী।।গজ বাজী পত্তি সাজে রথ অগণন।সমুদ্র প্রমাণ সৈন্য সাজে কুরুগণ।।ধ্বজ ছত্র পতাকায় ঢাকিল আকাশ।বাসুকী সৈন্যের ভারে পায় বড় ত্রাস।।টলমল করে পৃথ্বী যায় রসাতলে।প্রলয় কালেতে যেন সমুদ্র উথলে।।একাদশ অক্ষৌহিণী করিল সাজন।এক শত ক্রোশ যুড়ি রহে সৈন্যগণ।।তবে দুর্য্যোধন রাজা আনি সভাজনে।ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ পৃষত-নন্দনে।।জয়দ্রথ সোমদত্ত ভগদত্ত বীর।পঞ্চ ভাই ত্রিগর্ত্ত সহিত নৃপতির।।শল্য মদ্রেশ্বর আর সুশর্ম্মা নৃপতি।সবারে বিনয় করি কহে নরপতি।।ক্ষত্রমধ্যে পরাপর নাহি শাস্ত্রনীত।যুদ্ধেতে উপেক্ষা করা না হয় উচিত।।পিতা পুত্রে যুদ্ধ হৈলে না করি উপেক্ষা।সে কারণে না করিবে কাহার প্রতীক্ষা।।প্রাণ উপেক্ষিয়া সবে করিবে সমর।নিকটে সাজিয়া এল পাণ্ডুর কোঙর।।শুনি অঙ্গীকার কৈল যত বীরগণ।হইল সানন্দচিত্ত গান্ধারী নন্দন।।তবে শত ভাই সঙ্গে রাজ দুর্য্যোধন।যাত্রা করি সজ্জীভূত হৈল সেইক্ষণ।।বিদায় লইতে গেল বাপের সদন।নমস্কার করি কহে ভাই শত জন।।প্রসন্ন হইয়া তাত করহ আদেশ।শুভদিন আজি, যাব কুরুক্ষেত্র দেশ।।তোমার প্রসাদে তাত হবে রিপুক্ষয়।যুদ্ধ করিবারে আজ্ঞা দেহ মহাশয়।।শুনিয়া হইল অন্ধ ক্রোধিত অন্তর।মনে মনে অনুশোচ করিল বিস্তর।।আশীর্ব্বাদ দিল হেঁট করিয়া বদন।মায়ের নিকটে তবে গেল দুর্য্যোধন।।শত ভাই কহে কথা করিয়া প্রণতি।প্রসন্ন হইয়া মাতঃ দেহগো আরতি।।শুনিয়া সুবলসুতা সজল লোচন।আশ্বাসিয়া পুত্রগণে বলিল বচন।।ইতর তোমার রিপু নহে পাণ্ডুসুত।একৈক পাণ্ডব জিনিবেক পুরুহূত।।দেবের অজেয় রিপু বিখ্যাত ভুবনে।জীয়ন্তে পাণ্ডবে কেহ না পারিবে রণে।।সে কারণে তাহা সহ কলহ না রুচে।মোর বাক্যে প্রীতি কর যদি মনে ইচ্ছে।।শুনিয়া কহিল তবে রাজা দুর্য্যোধন।হেন বাক্য মাতা নাহি বলিও কখন।।কর্ণ মোর পক্ষ আর দ্রোণ মহাশয়।পিতামহ ভীষ্ম বীর সংগ্রামে দুর্জ্জয়।।অশ্বথামা কৃতবর্ম্মা কৃপ মহাবীর।শল্য মদ্রেশ্বর রাজা সংগ্রামে সুধীর।।লক্ষ লক্ষ বীরগণ আমার সহায়।পাণ্ডুপুত্রে সমরেতে মারিব হেলায়।।পাণ্ডবের পরাজয়, মোর হবে জয়।নাহিক সংশয় ইথে, কহিনু নিশ্চয়।।আশীর্ব্বাদ কর মাতা, বিলম্ব না সয়।ক্ষণ বহি যায় মাতা করহ বিদায়।।এত শুনি কৈল মাতা মলিন বদনে।যদি ধর্ম্মে থাক তবে জয়ী হবে রণে।।আরো এক কথা পুত্র শুন দুর্য্যোধন।যথা ধর্ম্ম তথা জয়, বেদের বচন।।এই বাক্য মুখে বলে মাতা সুবদনী।আকাশে নির্ঘাত বাণী হৈল ঘোরধ্বনি।।বিনা মেঘে রক্তবৃষ্টি হয়ত গগনে।মহাঘোর শব্দ করি ডাকে মেঘগণে।।বায়স শকুনিগণ উড়য়ে আকাশে।মন্দতেজ হৈল রবি, কর না প্রকাশে।।নগর নিকটে আসি ডাকে শিবাগণ।এইরূপে যাত্রাকালে হৈল কুলক্ষণ।।অহঙ্কারে দুর্য্যোধন কিছু না মানিল।মায়েরে বিদায় মাগি রথে আরোহিল।।ভীষ্ম দ্রোণ কৃতবর্ম্মা কৃপ মহামতি।কর্ণ আদি করি সাজে যত মহারথী।।জয় শব্দ করি চলে রাজা দুর্য্যোদন।কুরুক্ষেত্রে উত্তরিল যত কুরুগণ।।শত ক্রোশ যুড়ি রহে কৌরবের সেনা।রথ রথী গজ বাজী পত্তি অগণনা।।প্রলয়ের সিন্ধু সম সৈন্যের গর্জ্জনে।জগৎ বধির হৈল, না শুনি শ্রবণে।।তবে দুর্য্যোধন রাজা হয়ে হৃষ্টমন।উলূকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিল সেইক্ষণ।।যাহত উলূক তুমি, বিলম্ব না সহে।দেখহ আমার সৈন্য কোথা কত রহে।।যে দেখিবে বিবরিয়া কহিবে পাণ্ডবে।যুদ্ধ কর আসি সবে শক্তি অনুভবে।।কহিবে ভীমেরে মোর নিষ্ঠুর বচন।মোর সঙ্গে আসি শক্তিমত কর রণ।।দ্রৌপদীর অপমান আর দাসপণ।যত দুঃখ পেলে বনে করিয়া ভ্রমণ।।সে সব স্মরিয়া সাহসেতে করি ভর।মোর সঙ্গে আসি তুমি করহ সমর।।আমারে জিনিয়া সুখে ভুঞ্জ বসুমতী।নতুবা আমার হাতে হইবে সদগতি।।অর্জ্জুনে কহিবে দম্ভ করিয়া বিস্তর।পূর্ব্বের যতেক দুঃখ স্মরহ অন্তর।।যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, করহ পালন।আমারে জিনিয়া সুখে ভুঞ্জ ত্রিভুবন।।নতুবা কর্ণের হাতে দেখিবে শমন।অবিলম্বে কর আসি, যাহা লয় মন।।কৃষ্ণেরে কহিবে দম্ভ করিয়া অপার।পাণ্ডবের পক্ষ হয়ে হও আগুসার।।যেই মায়া দেখাইলে সভা বিদ্যমানে।সে মায়া করিয়া এস অর্জ্জুনের সনে।।সহদেব নকুলেরে কহিবে বচন।পূর্ব্ব দুঃখ ভাবি দুই জনে কর রণ।।কহিবে ধর্ম্মেরে মোর বচন বিশেষে।ব্রহ্মচারী বলি তোমা জগতেতে ঘোষে।।ধার্ম্মিকের শ্রেষ্ঠ তোমা, বলে সর্ব্বজন।তপস্বী বলিয়া তোমা করি যে গণন।।এখন সে সব কথা হইল প্রচার।বিড়াল তপস্বী প্রায় তব ব্যবহার।।পূর্ব্বেতে তাহার শুনিয়াছি যে কারণ।সেই অভিপ্রায়ে তব তপ আচরণ।।মুখে মাত্র বল ধর্ম্ম, অন্তরেতে আন।বিড়াল তপস্বী প্রায় হারাইবে প্রাণ।।এত শুনি সবিস্মরেয় উলূক তখন।নৃপতিরে জিজ্ঞাসিল বিনয় বচন।।বিড়াল তপস্বী হয়েছিল কি কারণে।আপনার দোষে সেই মরিল কেমনে।।পশু হয়ে কৈল কেন তপ আচরণ।বিবরিয়া কহ, শুনি ইহার কারণ।।উদ্যোগ পর্ব্বের কথা অমৃত-সমান।ব্যাসের রচিত দিব্য ভারত পুরাণ।।মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।কাশীদাস কহে গদাধর দাসাগ্রজ।।২৯.উলূকের নিকট দুর্যোধন কর্তৃক বিড়াল-তপস্বীর উপাখ্যান কীর্তনরাজা বলে, শুন শুন ওহে অনুচর।সত্যযুগে ছিল এক তাপস-প্রবর।।সর্ব্বগুণ সমন্বিত ছিলেন ব্রাহ্মণ।সুঘোষ তাঁহার নাম, শাস্ত্রে বিচক্ষণ।।সুশীলা নামেতে তাঁর ভার্য্যা গুণবতী।পুত্রবাঞ্ছা করি ধনী সেবে পশুবতী।।পুত্র না জন্মিল তাঁর, যুবাকাল গেল।বিপ্রের বৈরাগ্য বড় অন্তরে হইল।।ভার্য্যা সহ বনে গেল তপস্যা কারণ।হিমালয় গিরি উত্তরিল দুই জন।।দেখিয়া বিচিত্র বন প্রীতি পায় মনে।রচিয়া কুটীর তথা রহে দুই জনে।।এক দিন গেল ঋষি ফলের কারণ।ভ্রমিতে ভ্রমিতে দেখে দৈব নির্ব্বন্ধন।।অনাথ মার্জ্জার শিশু পড়ি আছে বনে।ব্রাহ্মণ দেখিয়া শিশু চাহে চারি পানে।।পলাইতে শক্তি নাহি শিশু কলেবর।চতুর্দ্দিকে বেড়িয়াছে বায়স পামর।।তার দুঃখ দেখি বিপ্র-হৃদে হৈল দয়া।জিজ্ঞাসিল মার্জ্জারের নিকটেতে গিয়া।।একাকী হেথায় তুমি কিসের কারণ।মাতা পিতা বন্ধু তব নাহি কোন জন।।বিড়াল বলয়ে, কেহ নাহিক সংসারে।প্রসবিয়া মাতা মোর গেছে কোথাকারে।।জননী ছাড়িয়া গেল দৈব নির্ব্বন্ধনে।একাকী অনাথ হয়ে রহিয়াছি বনে।।মুনি বলে, আমি তোমা করিব পালন।বঞ্চিবে পরম সুখে আমার সদন।।অপুত্রক আছি আমি, পুত্র নাহি হয়।পুত্রবৎ করি তোমা পালিব নিশ্চয়।।এত শুনি বিড়ালের হৃষ্ট হৈল মন।বিপ্রের চরণে আসি করিল বন্দন।।বিড়াল লইয়া মুনি আসিল কুটীরে।পালন করিতে তারে দিলেন ভার্য্যারে।।বিড়াল পাইয়া তুষ্টা হইল সুন্দরী।পালন করিল তারে পুত্রবৎ করি।।মায়া মোহে বন্ধ হয়ে সব পাসরিল।বিড়াল লইয়া দোঁহে নগরে আসিল।।পুনরপি গৃহধর্ম্ম করে দুই জনে।বলবন্ত হৈল সেই অধিক পালনে।।স্বভাব পশুর জাতি ছাড়িবারে নারে।বহু উপদ্রব করে গৃহস্থের ঘরে।।যজ্ঞ-হবি নষ্ট করে, পায়সান্ন খায়।মারিতে আসিলে লোক পলাইয়া যায়।।ক্রোধে নগরের লোক দুঃখী মনে মন।সবে ব্রাহ্মণেরে গালি দেয় অনুক্ষণ।।কোথায় তপস্যা তব, কোথায় ব্রহ্মণ্য।পুত্রহীন হয়ে তুমি হলে মতিচ্ছন্ন।।বিড়ালেরে এত স্নেহ পুত্রবৎ কর।সহজে পশুর জাতি মনে নাহি ডর।।এইরূপে বলে মন্দ নগরের জন।ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী ক্রোধে জ্বলিল তখন।।ধরিয়া ঈষিকাবাড়ি প্রহারে বিড়ালে।বান্ধিয়া রাখিল তারে হাতে পায়ে গলে।।দিন দুই তিন তারে রাখিল বন্ধনে।বড়ই বৈরাগ্য হৈল বিড়ালের মনে।।কোনমতে পারি যদি ছাড়াতে বন্ধন।তপস্যা করিয়া পাপ করিব মোচন।।গৃহবাসে কার্য্য নাহি, যাব বনবাস।অনাহারে পাপ আত্মা করিব বিনাশ।।এরূপে বিড়াল মনে মনে যুক্তি করি।দন্তেতে কাটিল তবে বন্ধনের দড়ি।।সেইক্ষণে গৃত হৈতে হইল বাহির।দণ্ডক কাননে গিয়া হইলেক স্থির।।বিন্দু সরোবরে তথা করি স্নানদান।একে এক সর্ব্বতীর্থে করিল প্রয়াণ।।তীর্থ প্রদক্ষিণব্রত করি একে একে।বিড়াল তপস্বী বলি খ্যাত হৈল লোকে।।সমুদ্রের কাছে দ্বীপ অতিরম্য নামে।বহু মূষাগণ তথা থাকে অনুক্রমে।।তথা গিয়া উত্তরিল বিড়াল সন্ন্যাসী।দেখিয়া সকল মূষা মনে ভয় বাসি।।হাহাকার করি সবে পলায় তরাসে।আশ্বাসি বিড়াল তবে কহে সবিশেষে।।আমারে দেখিয়া ভয় কর কেন মনে।পরম ধার্ম্মিক আমি, সর্ব্বলোকে জানে।।তপস্যা করিয়া মোর চিরকাল গেল।হিংসা হেন বস্তু মোর কখন নহিল।।পবন আহারী আমি, শুন মূষাগণ।আমারে তিলেক ভয় না কর কখন।।আনন্দ কৌতুকে সবে ভ্রমহ নির্ভয়ে।তপস্যা করিব আমি তোমার আশ্রয়ে।।এত শুনি মূষাগণ হৈল হৃষ্টমন।যার যেই স্থানে ক্রমে আসে সর্ব্বজন।।মর্য্যাদা করিয়া বহু স্থাপিল বিড়ালে।নির্ভয়েতে মূষাগণ ভ্রমে কুতূহলে।।কত দিন গেল, তবে জন্মিল বিশ্বাস।যার যেই শিশুগণ রাখে তার পাশ।।দূরবনে যায় সবে আহার কারণ।নারিল ছাড়িতে লোভ বিড়ালের মন।।সহজে পশুর জাতি, নাহি আত্ম পর।চারিদিকে চাহি তার ফুলে কলেবর।।উদর পূরিয়া খায় মূষা শিশুগণে।হাত মুখ মুছি পুনঃ বসে সে ধেয়ানে।।খাইতে খাইতে লোভ অধিক হইল।দিনে দিনে মূষা শিশু অনেক খাইল।।এ সকল তত্ত্ব নাহি জানে কোন জন।দিনে দিনে অল্প হয় মূষা শিশুগণ।।এক মূষা বুদ্ধিমন্ত তাহাতে আছিল।অল্প শিশুগণ দেখি হৃদয়ে ভাবিল।।এ বেটা তপস্বী ভণ্ড, জানিনু লক্ষণে।চুরি করি খায় যত মূষা শিশুগণে।।তদন্ত জানিতে সেই নিকটে রহিল।আর মূষাগণ সব দূরবনে গেল।।চারি পানে চাহিয়া বিড়াল ততক্ষণ।দশ পাঁচ শিশু ধরি করয়ে ভক্ষণ।।দেখিয়া প্রবীণ মূষা করে হাহাকার।সব মূষাগণে গিয়া দিল সমাচার।।শুনিয়া সকল মূষা হৈল দুঃখীমন।উপায় সৃজিল তার নিধন কারণ।।এই যুক্তি করি সবে হয়ে একমন।দ্বীপের চৌদিকে সবে করয়ে খনন।।খনিল গভীর গর্ত্ত দীর্ঘেতে বিস্তর।তাহাতে পড়িয়া মরে বিড়াল পামর।।সেইমত যুধিষ্ঠির কৈল আচরণ।মুহূর্ত্তেকে মোর হাতে হারাবে জীবন।।উলূক এতেক শুনি আনন্দিত মনে।সাধু সাধু বলি প্রশংসিল দুর্য্যোধনে।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।৩০.দূর্যোধনের দূত উলূকের প্রতি পান্ডবগণের উক্তিদুর্য্যোধন আদেশেতে সে উলূক দূত।শীঘ্রগতি গেল যথা পাণ্ডু-পঞ্চসুত।।যত কহি পাঠাইল কুরু নৃপমণি।দণ্ডবৎ করি সব কহিল কাহিনী।।শুনিয়া রুষিল পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দনে।উলূকে চাহিয়া বলে ক্রোধ করি মনে।।দুর্য্যোধন মোর হাতে মরিবে নিশ্চয়।আজি কালি মধ্যে যাবে যমের আলয়।।দুঃশাসনের মরণ হৈল সেই দিনে।দ্রৌপদীর কেশ ধরিয়াছে যেই ক্ষণে।।শুনহ উলূক বলি, কহে বৃকোদর।গদার প্রহারে ঊরু ভাঙ্গিব তাহার।।এই লৌহ মহাগদা দেখ বিদ্যমান।ইহাতে শতেক ভাই হারাইবে প্রাণ।।এত বলি গদা লয়ে বীর বৃকোদর।চক্রিচক্র ফিরে যেন মস্তক উপর।।গাণ্ডীব ধনুক তবে লইয়া অর্জ্জুন।আকর্ণ পূরিয়া টঙ্গারেন ধনুর্গুণ।।এককালে হৈল যেন শত বজ্রাঘাত।প্রমাদ গণিল সবে দেখিয়া নির্ঘাত।।ধনঞ্জয় কহিলেন উলূকে চাহিয়া।মোর দম্ভ দুর্য্যোধনে শীঘ্র কহ গিয়া।।সূতপুত্র সঙ্গে এস করিয়া সাজন।মোর হাতে তোমা সহ লইবে শমন।।ইন্দ্র যদি রক্ষা করে নাহি রক্ষা পাবে।অবশ্য আমার হাতে যমঘরে যাবে।।এইরূপে পার্থ গর্ব্ব করেন বিস্তর।মাদ্রীর তনয় তবে কহিল সত্বর।।ধৃষ্টদ্যুন্ন সাত্যকি যতেক বীরগণ।একে এক উলূকের কহে সর্ব্বজন।।উলূক পাইয়া আজ্ঞা রথে আরোহিয়া।দুর্য্যোধনে সব কথা নিবেদিল গিয়া।।যে কহিল পাণ্ডবেরা কহিতে সে ভয়।কহিল নিষ্ঠুর বাণী ভীম ধনঞ্জয়।।রাজা বলে, কিবা ভয় কহ ত কাহিনী।কি কহিল ভীমসেন ধর্ম্ম-নৃপমণি।।কি কহিল ধনঞ্জয় মাদ্রীর নন্দন।ধৃষ্টদ্যুন্ন বিরাটাদি যত বীরগণ।।উলূক বলিল, রাজা না বলিলে নয়।শুন যাহা বলিলেন ধর্ম্ম মহাশয়।।ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর চাহি আমি সুখ।সে কারণে সহিলাম, দিল যত দুখ।।কৃষ্ণেরে পাঠাই অগ্রে করিবারে প্রীতি।অহঙ্কারে না শুনিল গোবিন্দের নীতি।।ইহার উচিত শাস্তি হাতে হাতে পাবে।অচিরেতে সবংশেতে নিপাত হইবে।।ক্রোধে ভীম দর্প করি বলিল বচন।মোর সম বলিষ্ঠ না দেখি কোন জন।।রাক্ষস দানব মোর অগ্রে নহে স্থির।গদার বাড়িতে তার ভাঙ্গিব শরীর।।মাদ্রীর নন্দন আদি যত বীরগণ।একে একে প্রতিজ্ঞা যে করে জনে জন।।যে হয় উচিত রাজা করহ বিহিত।শুনি দুর্য্যোধন করে সৈন্য সমাহিত।।আশ্বাসি কহিল সব যত যোদ্ধাগণে।মোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর যোদ্ধাগণে।।মোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর সর্ব্বজনে।শুন কর্ণ মহাবীর রাধার নন্দন।পরম বান্ধব তুমি মোর দুনয়ন।।পূর্ব্বে অঙ্গীকার কৈলে সবার গোচরে।পাণ্ডবে মারিয়া রাজ্য দিবে হে আমারে।।তাহার সময় এই হৈল উপনীত।করহ বিধান সখে ইহার উচিত।।কর্ণ বলে, রাজা মোর সত্য অঙ্গীকার।প্রাণপণে কার্য্য সিদ্ধ করিব তোমার।।যাবৎ শরীরে প্রাণ আছয়ে আমার।তাবৎ সাধিব কার্য্য, শুন সারোদ্ধার।।এত শুনি দুর্য্যোধন হৈল হৃষ্টমন।বহু পুরষ্কার কর্ণে দিল সেইক্ষণ।।মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।শ্রবণে অধর্ম্ম খণ্ডে, পরলোক তরি।।৩১. কণ্যে জন্ম বিবরণজন্মেজয় জিজ্ঞাসিল কহ তপোধন।কুন্তীগর্ভে জন্মে কর্ণ বিখ্যাত ভুবন।।কৌরবের পক্ষে কেন কুন্তীর নন্দন।দেখিয়া ধরিল কুন্তী কিরূপে জীবন।।মুনি বলে, শুন কুরুবংশ চূড়ামণি।কৌরবের রণে গেল কর্ণ বীরমণি।।বিদুরের মুখে শুনি এসব বচন।চিত্তেতে চিন্তিয়া কুন্তী ভাবে মনে মন।।আমার নন্দন কর্ণ কেহ না জানিল।সূর্য্যের ঔরসে জন্ম কর্ণের হইল।।দৈবের এ সব কথা বিধির ঘটন।রাধা যে পাইয়া পুত্র করিল পালন।।রাধার নন্দন বলি ঘোষে সর্ব্বজন।কেহ জ্ঞাত নহে কর্ণ আমার নন্দন।।এ সময়ে লোকে যদি হয় সে প্রচার।উপহাস করিবেক কৌরব কুমার।।ইহার কারণে আমি করিব গমন।কর্ণেরে কহিব আমি এ সব বচন।।আমার বচন কর্ণ খণ্ডিতে নারিবে।অবশ্য সহায় পাণ্ডুপুত্রদেব হবে।।কিরূপে নিভৃতে দেখা হবে কর্ণ সনে।এতেক ভাবিয়া কুন্তী যুক্তি কৈল মনে।।প্রাতঃস্নান নিত্য কর্ণ যমুনায় করে।একেশ্বর যায় স্নানে, নাহি লয় কারে।।তত্ত্ব জানি কুন্তী তথা করিল গমন।যমুনায় নামি কর্ণ করয়ে তর্পণ।।নিত্যকর্ম্ম সমাপিয়া সূর্য্যে করে স্তব।উঠিয়া আইসে, কুন্তী মানিল উৎসব।।কর্ণের সাক্ষাতে কহে গদ গদ বাণী।অবধান কর বৎস পূর্ব্বের কাহিনী।।আমার নন্দন তুমি সূর্য্যের ঔরসে।যখন ছিলাম আমি জনকের বাসে।।অতিথি সেবায় তাত রাখিল আমারে।অনেক সেবন কৈনু দুর্ব্বাসা মুনিরে।।চারিমাস সেবিলাম বিবিধ বিধানে।আজ্ঞাবর্ত্তী হয়ে আমি রহি অনুক্ষণে।।আমার সেবায় মুনি সন্তুষ্ট হইয়া।মন্ত্রদান করিলেন আমারে ডাকিয়া।।যে মন্ত্র দিতেছি দেবি তব বিদ্যমান।মন্ত্র পড়ি যেই দেবে করিবে আহবান।।সেইক্ষণে আসিবেন তোমার সাক্ষাতে।যে বর মাগিবে, তাহা পাইবে নিশ্চিতে।।এত বলি মহামুনি গেল যথাস্থানে।তবে আমি মন্ত্র পরীক্ষিতে একদিনে।।কলসে আনিতে যাই যমুনার বারি।কৌতুকে জপিনু মন্ত্র সূর্য্যে ধ্যান করি।।তখনি আসিল সূর্য্য মোর বিদ্যমানে।সূর্য্যে দেখি ভীত আমি হইলাম মনে।।অনেক বিনয় করি কহিনু বচন।না বুঝি তোমারে আমি করি আবাহন।।অজ্ঞান স্ত্রীজন দোষ ক্ষমিবে আমার।শুনিয়া হাসিয়া সূর্য্য কহে আরবার।।কভু মিথ্যা নাহি হয় মুনির বচন।কভু মিথ্যা নহে কণ্যা মম আগমন।।আমারে ভজহ তুমি, নাহিক সংশয়।না ভজিলে মন্ত্র মিথ্যা হইবে নিশ্চয়।।বিবাহিতা নহ, চিন্তা করিছ অন্তরে।মম বরে মহারাজ বরিবে তোমারে।।এত শুনি বশ আমি হইনু তাহার।সূর্য্যের প্রসাদে হৈল জনম তোমার।।প্রসব করিয়া তোমা সচিন্তিত মন।কুমারী কালেতে জন্ম হইল নন্দন।।লোকে খ্যাত হয় পাছে এ সব কাহিনী।যমুনায় ভাসাইনু তাম্রকুণ্ড আনি।।পাইয়া তোমারে রাধা করিল পালন।কদাচিৎ নহ তুমি রাধার নন্দন।।যে হইল সে হইল, অজ্ঞাত কারণ।ভ্রাতৃগণ সহ তুমি করহ মিলন।।ছয় ভাই মিলি বৎস নাশ মোর দুঃখ।শত্রুগণে মারি ভুঞ্জ যত রাজ্য সুখ।।এত শুনি কর্ণ কহে করিয়া মিনতি।এ সকল গুপ্তকথা জানি যে ভারতী।।জানিয়া করিলে ত্যাগ আমারে পূর্ব্বেতে।রাধা যে পালিল মোরে বিখ্যাত জগতে।।রাধার নন্দন বলি ঘোষে ত্রিভুবনে।তব পুত্র আমি, এবে বলিব কেমনে।।বলিলে কি লোকে ইহা করিবে প্রত্যয়।জগতে কুযশ লজ্জা হবে অতিশয়।।বলিবেক ক্ষত্রগণ করি উপহাস।যুদ্ধকাল দেখি কর্ণ পাইল তরাস।।ভাই বলি পাণ্ডবের লইল শরণ।ব্যর্থ কর্ণ নাম বলি ঘোষে অকারণ।।এ সব হইতে মৃত্যু ভাল শতগুণে।এ কর্ম্ম করিতে নাহি পারিব কখনে।।তাহে দুর্য্যোধন মোরে শিশুকাল হতে।নানা ভোগে পুরস্কারে পালিল যত্নেতে।।দেশ ভূমি গ্রাম রত্ন দিল বহুতর।হরিহর আত্মা যেন, নহে ভিন্ন পর।।তিলেক বিভিন্ন মনে নহে কদাচনে।তাহার অপ্রীতি আমি করিব কেমনে।।বিশেষে তাহারে আমি কৈনু অঙ্গীকার।অর্জ্জুনের সঙ্গে পণ সমর আমার।।মোর হাতে পরলোকে যাবে ধনঞ্জয়।কিম্বা অর্জ্জুনের হাতে মোর মৃত্যু হয়।।এই ত প্রতিজ্ঞা কৈনু সভা বিদ্যমানে।সত্যভ্রষ্ট হৈতে নাহি পারিব কখনে।।সে কারণে ক্ষমা কর জননি আমারে।এত শুনি পুনঃ কুন্তী কহিল কর্ণেরে।।ভাইগণ সঙ্গে যদি না কর মিলন।মোর বাক্য যদি নাহি করিবে পালন।।তবে এক সত্য কর মোর বিদ্যমানে।আর চারি পুত্রে মোর না মারিবে প্রাণে।।এত শুনি কর্ণ কৈল সত্য অঙ্গীকার।আর চারি ভায়েরে না করিব সংহার।।পঞ্চ পুত্র রবে তব এই পৃথিবীতে।অর্জ্জুন সহিত কিংবা আমার সহিতে।।ব্যাসের বচন মাতা আছে পূর্ব্বাপর।পৃথিবীতে তব পঞ্চ রহিবে কোঙর।।সংসারের মধ্যে হবে রণে মহাতেজা।একচ্ছত্র পৃথিবীতে হবে মহারাজা।।ব্যাসের বচন মিথ্যা নহে কদাচন।জগতে রহিবে পঞ্চ তোমার নন্দন।।পাইবে তোমার পুত্রগণ রাজধানী।নিশ্চয় আমার মৃত্যু হইবে জননি।।না ভাবিহ দুঃখ মাতা, যাহ নিজ স্থানে।এত বলি দণ্ডবৎ করিল চরণে।।বিদায় হইয়া কর্ণ গেল নিজপুরে।যথাস্থানে গেল কুন্তী দুঃখিত অন্তরে।।বিদুরের প্রতি কুন্তী কহিল সকল।শুনি বিদুরের হৃদে হৈল কুতূহল।।কাশীরাম দাস কহে শুন জগজ্জন।উদ্যোগপর্ব্বের কথা হৈল সমাপন।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon