০১. পঞ্চ-পাণ্ডবের অজ্ঞাত বাসের মন্ত্রণাবন্দ মহামুনি ব্যাস তপস্বী তিলক।মহামুনি পরাশর যাহার জনক।।বেদ শাস্ত্রোপর নিষ্ঠ শুদ্ধবুদ্ধি ধীর।নীলপদ্ম আভা জিনি কোমল শরীর।।কনকাভা জটাভার শিরে শোভা করে।প্রচন্ড শরীর পরিধান রাঘাম্বরে।।নয়নযুগল কত মণি শোভে নখশির।।ভাগবত ভারত ও যতেক পুরাণ।যাহার কমল মুখে সবার নির্মাণ।।শ্রীকৃষ্ণের লীলা আর বেদ চারিখান।ঋক যজু সাম আর অথর্ব্ব বিধান।।মৎস্যগন্ধা গর্ভে যার দ্বীপেতে উৎপত্তি।বাল্যকালাবধি যার তপস্যা সম্পত্তি।।প্রণতি করিয়া মুনি চরণ-পঙ্কজে।পরম আনন্দে কাশীদাস সদা ভজে।।বেদ রামায়ণে আর পুরাণ ভারতে।লিখিত যতেক তীর্থ আছে ত্রিজগতে।।সর্বশাস্ত্র বিচারিয়া বুঝ পুন: পুন:।আদি অন্ত অভ্যন্তরে গাঁথা হরিগুণ।।জন্মেজয় বলে, কহ শুনি তপোধন।দুর্য্যোধন ভয়েপূর্ব্ব পিতামহগণ।।বিরাট নগর মধ্যে রহিল অজ্ঞাতে।বৎসরেক যাপন করিল কোন্ মতে।।কহেন বৈশম্পায়ন, শুন মহারাজ।দ্বাদশ বৎসর অন্তে অরণ্যের মাঝ।।পঞ্চ ভাই পাণ্ডবেরা পাঞ্চালী সহিত।বহু দ্বিজগণ সঙ্গে ধৌম্য পুরোহিত।।বলেন সবার প্রতি ধর্ম্মের তনয়।সবে জান, পূর্ব্বে যাহা হইল নির্ণয়।।দ্বাদশ বৎসর অন্তে অজ্ঞাত বৎসর।অজ্ঞাতে রহিব কৃষ্ণা পঞ্চ সহোদর।।বরষ মধ্যেতে যদি প্রকাশিত হব।পুনশ্চ দ্বাদশ বর্ষ বনবাসে যাব।।বিচারিয়া কহ ভাই ইহার বিধান।অজ্ঞাত থাকিব এক বর্ষ কোন স্থান।।সেই দিন হবে কালি রজনী প্রভাতে।বিচারিয়া যুক্তি কহ আমার সাক্ষাতে।।এত শুনি কহে ভীম রাজারে চাহিয়া।তোমার পার্থবীর উপেক্ষা করিয়া।।মোর আগে কে যুঝিবে পৃথিবীর মাঝ।হেন জন চক্ষে নাহি দেখি ধর্ম্মরাজ।।মৃত্যু সম বনে দুঃখ দ্বাদশ বৎসর।তোমার নিয়মে বঞ্চিলাম নৃপবর।।পাণ্ডবের পতি তুমি, পাণ্ডবের গতি।তুমি যেই পথে যাবে, সবে সেই পথি।।কহিলেন ধর্ম্মরাজ দ্বিজগণ প্রতি।সবে জান আমাকে যা কৈল কুরুপতি।।অজ্ঞাত থাকিব এক বরষ লুকায়ে।ততদিন যথাস্থানে সবে রহ গিয়ে।।বিধাতা করিল মোর এমত কুদিন।মৃত্যু সম নির্ব্বাহিব ব্রাহ্মণ বিহীন।।মেলানি করিয়া দ্বিজগণে নৃপবর।দু-নয়নে বহে অশ্রুধারা ঝর ঝর।।ভ্রাতৃগণ ধৌম্য আদি যত দ্বিজ আর।রাজারে বুঝান সবে বিবিধ প্রকার।।বিপদকালেতে রাজা অধৈর্য্য না হবে।ধীর হৈলে শত্রুগণে বিজয় করিবে।।বড় বড় রাজগণ বিপদে পড়িয়া।পুনরপি রাজ্য লভে মন্ত্রণা করিয়া।।অসুরের ভয়ে ইন্দ্র রহেন লুকায়ে।বলিরে ছলিলা হরি বামন হইয়ে।।উপায় করিয়া ইন্দ্র অসুরে মারিল।কাষ্ঠমধ্যে থাকি অগ্নি খাণ্ডব দহিল।।তুমিহ এখন রাজা বুঝ কালগতি।ধৈর্য্য ধরি পুনরপি শাস বসুমতী।।এত বলি শান্ত করি তুষিল রাজায়।আশীর্ব্বাদ করি তবে দ্বিজগণ যায়।।তবে ধর্ম্মরাজ সব ভ্রাতৃগণে লয়ে।এক ক্রোশ দূরে যান সে বন ছাড়িয়ে।।জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মরাজ ভ্রাতৃগণ প্রতি।কোথায় অজ্ঞাতরূপে করিবে বসতি।।রম্যদেশ দেখি সবে রব গুপ্তবেশে।একস্থানে ছয় জনে থাকিব বিশেষে।।এতশুনি সবিনয়ে কহ ধনঞ্জয়।ধর্ম্মের বরেতে রাজা নাহি কোন ভয়।।অজ্ঞাত রহিব সবে, কে পাবে নির্ণয়।দেশ নাম কহি রাজা, যথা মনে লয়।।পাঞ্চাল বিদর্ভ মৎস্য বীহ্লীক ও শাল্ব।মগধ কলিঙ্গ শূরসেন কাশী মল্ল।।এই সব দেশ, তব যথা লয় মনে।অজ্ঞাতে রহিব তথা ভাই পঞ্চ জনে।।রাজা বলে, মৎস্যদেশে বিরাট নৃপতি।সত্যশীল শান্ত ধর্ম্মশীল মহামতি।।তথায় বঞ্চিতে মন হতেছে আমার।তোমা সবাকার চিত্তে কি হয় বিচার।।সবারে দেখিব, সবে থাকিব গুপ্তেতে।অন্য জন কেহ যেন না পারে লক্ষিতে।।বৃকোদর কহে তবে চাহিয়া রাজায়।কহ কোন্ বেশে রাজা বঞ্চিবে তথায়।।নিন্দিত নহিবে কর্ম্ম, নহে কোন ক্লেশ।বিচারিয়া নরপতি কহ উপদেশ।।ইহা সম দুঃখ আর নাহিক রাজন।রাজা হয়ে পরবশ, পরের সেবন।।মহাপাপে দুঃখ যথা পায় পাপিগণ।কোন্ কর্ম্ম নির্ব্বাহিবে, বল রাজন।।রাজা বলে, কহি আমি বঞ্চিব যেমতে।ন্যায়কর্ত্তা হব আমি বিরাট সভাতে।।বলাইব কঙ্ক নাম, পাশায় পণ্ডিত।ব্রহ্মচর্য্য ধর্ম্মশাস্ত্র জানি সর্ব্বনীত।।মণিরত্ন যত আছে, জানি তার মূল্য।যুধিষ্ঠিরের সৃহৃদ ছিনু প্রাণ তুল্য।।কহিয়া শাস্ত্রের কথা তুষিব রাজারে।এরূপে বঞ্চিব ভাই বিরাট-নগরে।।ভীমে চাহি বলিলেন ধর্ম্ম-নরনাথ।কহ ভাই কোন্ বেশে বঞ্চিবে অজ্ঞাত।।পদ্মপুষ্প হেতু গন্ধমাদন পর্ব্বতে।রক্ষোহীন হৈল ক্ষিতি তোমার ক্রোধেতে।।হিড়িম্বক বক জটাসুর কির্ম্মীরাদি।নিষ্কণ্টক কৈলে মারি সাগর অবধি।।কিরূপে বঞ্চিবে ভাই বিরাট নগরে।এত শুনি কহে ভীম ধর্ম্মের গোচরে।।বল্লব নামেতে আমি হব সূপকার।রন্ধন করিতে নাহি সমান আমার।।পরিচয় দিয়া তেজ দেখাব রাজনে।মল্লযুদ্ধে হারাইব যত মল্লগণে।।বৃষ ব্যাঘ্র হিংস মেষ মহিষ কুঞ্জর।ধরিয়া আনিয়া দিব রাজার গোচর।।যুধিষ্ঠির গৃহে পূর্ব্বে ছিনু সূপকার।কৌতুকে রাখেন মোরে রাজা দয়াধার।।এত বলি পরিচয় দিব বিরাটেরে।শুনিয়া সন্তুষ্ট চিত্ত নৃপ যুধিষ্ঠিরে।।পার্থ প্রতি চাহিয়া বলেন নরবর।কই ভাই কিবা মতে বঞ্চিবে বৎসর।।অগ্নিরে নিরোগ কৈলে জিনি পুরন্দর।জিনিলে বাহুর বলে ধরা একেশ্বর।।দেব মধ্যে ইন্দ্র যথা, দানবেতে বলি।ত্রিভুবনে পূজ্য যথা রুদ্রেতে কপালী।।আদিত্যেতে বিষ্ণু যথা স্থিরে মেরুবৎ।গ্রহমধ্যে চন্দ্র যথা গজে ঐরাবত।।ঋষিমধ্যে শুদ্ধ যথা শুকদেব মুনি।আয়ুধেতে বজ্র যথা শব্দে কাদম্বিনী।।তাদৃশ পাণ্ডব মধ্যে অর্জ্জুন প্রধান।পরাক্রমে তুমি বাসুদেবের সমান।।ত্রিভুবনে বিস্তারিত যার রূপ গুণ।কি মতে লুকাবে ভাই কহত অর্জ্জুন।।দুই হস্তে ধনুর্গুণ ঘর্ষণের চিহ্ন।কিমতে লুকাবে ভাই সব্যসাচী চিহ্ন।।অর্জ্জুন বলেন, দেব আছয়ে উপায়।নপুংসক-বেশে আমি আচ্ছাদিব কায়।।দুই হস্ত আচ্ছাদিব শঙ্খ আচ্ছাদনে।মস্তকে ধরিব বেণী, কুণ্ডল শ্রবণে।।রাজা জিজ্ঞাসিলে দেব এই পরিচয়।পূর্ব্বেতে ছিলাম আমি পাণ্ডব-আলয়।।রাজপত্নী দ্রৌপদীর ছিলাম নর্ত্তক।নৃত্যগীতে বিজ্ঞ আমি, জাতি নপুংসক।।শিখাইতে পারি আমি অন্তঃপুর বালা।এই বৃত্তিজীবি জানি, নাম বৃহন্নলা।।নকুলে ডাকিয়া জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মরায়।কত ভাই লুকাইবে কিমত উপায়।।দুঃখ ক্লেশ নাহি জান, অতি সুকুমার।বালকের প্রায় তুমি পালিত আমার।।ত্রৈলোক্য জিনিয়া রূপ পরম সুন্দর।ভ্রাতৃগণ প্রাণ-তুল্য গুণের সাগর।।নকুল বলিল, দেব কর অবধান।এই পরিচয় দিব বিরাটের স্থান।।অশ্ববৈদ্য নাহি কেহ আমার সমান।অশ্বের চিকিৎসা জানি, গ্রন্থিক আখ্যান।।কড়িয়ালি দিব আমি যে ঘোড়ার মুখে।কোনকালে তার দুষ্টভাব নাহি থাকে।।এইরূপে গুপ্ত করি আপনার কায়।বৎসরেক মহারাজ বঞ্চিব তথায়।।তবে জিজ্ঞাসেন রাজা সহদেব প্রতি।বিবিধ বিচারে বিজ্ঞ, বুদ্ধে বৃহস্পতি।।জননী কুন্তীর সদা অতি প্রিয়তর।কি মতে বঞ্চিবে ভাই অজ্ঞাত বৎসর।।সহদেব কহে, তবে শুন নৃপবর।বিরাট রাজার গবী আছে বহুতর।।গোধন রক্ষক হই, জাতি যে গোয়াল।মৎস্যদেশে বলাইব নাম তন্তিপাল।।দ্রৌপদীরে কহে তবে নৃপতি কাতর।কিমতে বঞ্চিবে কৃষ্ণা অজ্ঞাত বৎসর।।রাজকন্যা রাজত্নী দুঃখিনী আজন্ম।নাহি জান সাধারণ স্ত্রীলোকের কর্ম্ম।।পুষ্পমাল্য আভরণ ভার নাহি সয়।কিরূপে অধীনা হয়ে রবে পরালয়।।প্রাণাধিক প্রিয় তোমা দেখি অনুক্ষণে।পর আজ্ঞা বহনেতে বঞ্চিবে কেমনে।।কৃষ্ণা বলে, চিন্তা রাজা না করিহ মনে।যেমতে বঞ্চিব আমি বিরাট ভবনে।।তোমা সবাকার মনে নাহি হবে দুঃখ।সদাই দেখিব রাজা সবাকার মুখ।।বিরাট রাজার রাণী সুদেষ্ণা নামেতে।তার স্থানে বৎসরেক বঞ্চিব অজ্ঞাতে।।তারে কব সৈরন্ধ্রীর বেশ কর্ম্ম জানি।শুনিয়া অবশ্য মোরে রাখিবেন রাণী।।এত শুনি হৃষ্ট চিত্তে ধর্ম্মের নন্দন।অগ্নিহোত্র ধৌম্য-হস্তে করেন অর্পণ।।আছিল যতেক দাস দাসী দ্রৌপদীর।পাঞ্চালে যাইতে আজ্ঞা দেন যুধিষ্ঠির।।ইন্দ্রসেন আদি করি যতেক সারথী।রথ লয়ে সবে চলি যাহ দ্বারাবতী।।পথে জিজ্ঞাসিলে লোক কহিবে সবারে।না জানি কোথায় গেল পঞ্চ সহোদরে।।কালি সবে এক স্থানে ছিলাম কাননে।আমা সবা ছাড়ি কোথা পশিলা নির্জ্জনে।।তবে ধৌম্য কহিলেন বহু উপদেশ।অজ্ঞাত সময়ে হতে পারে নানা ক্লেশ।।বহু অপমান হৈলে তাহা সম্বরিবে।যখন যেমন হয় বুঝিয়া করিবে।।ক্ষত্রমধ্যে অগ্নিসম তোমা পঞ্চ জনে।সকলে তোমার শত্রু জানহ আপনে।।গুপ্তভাবে গুপ্তবেশে থাক ভালমতে।রাজসেবা করি সদা রবে রাজপ্রীতে।।ক্ষুধা-তৃষ্ণা তেয়াগিবে আলস্য শয়ন।বিশ্বাস করিবে নাহি নৃপে কদাচন।।রাজার সম্মুখে আর পশ্চাতে না রবে।তাঁর বামপার্শ্বে কিম্বা দক্ষিণে থাকিবে।।কোন কার্য্য হেতু যদি রাজা আজ্ঞা করে।আপনার প্রাণপণে করিবে সত্বরে।।অন্তঃপুর নারীসহ না কহিবে কথা।মিথ্যা বাক্য রাজারে না কহিবে সর্ব্বথা।।হরষেতে মত্ত নাহি হয়ে কদাচন।রাজা সনে না কহিবে রহস্য বচন।।সন্নিকটে না থাকিয়া অন্তরে থাকিবে।লাবালাভ না বিচারিয়া আদেশ পালিবে।।ভ্রাতা বন্ধু পুত্রে নাহি নৃপতির প্রীত।সেই সে আপন, কর্ম্ম করে মনোনীত।।আমি কি কহিব তুমি জানহ সকলে।কাল কাটি পুনরপি আসিও কুশলে।।এত শুনি উঠি তবে ভাই পঞ্চ জন।প্রদক্ষিণ করি ধৌম্যে চলেন তখন।।কাম্যবন ছাড়ি যান যমুনার পার।বামেতে শাল্বের দেশ, দক্ষিণে পাঞ্চাল।।শূরসেন রাজ্যমধ্যে করিয়া প্রবেশ।পদব্রজে বলি যান বিরাটের দেশ।।মৎস্যদেশ ছাড়ি গেলা ধৌম্য তপোধন।শ্রমযুক্তা হয়ে কৃষ্ণা বলেন বচন।।চলিবার শক্তি আর নাহিক নৃপতি।আজি নিশি এক ঠাঁই করহ বসতি।।নিকটে না দেখি, দূরে বিরাট নগর।কালি প্রাতে গুপ্তভাবে যাব নৃপবর।।নৃপতি বলেন, কালি হইব অজ্ঞাত।অনর্থ ঘটিবে, হৈলে লোকেতে বিদিত।।পার্থে ডাকি আজ্ঞা দেন ধর্ম্মের তনয়।দ্রৌপদীর স্কন্ধে করি লহ ধনঞ্জয়।।আজ্ঞামাত্র ধনঞ্জয় করিলেন স্কন্ধে।ঐরাবত-স্কন্ধে যে ইন্দ্রাণী আনন্দে।।নগর বিরাট আছে অতি অল্প দূর।হেনকালে বলিলেন ধর্ম্ম নৃপবর।।সশস্ত্র নগরে যদি করিবে প্রবেশ।দৃষ্টিমাত্রে সর্ব্বলোক চিনিবে বিশেষ।।বাল বৃদ্ধ যুবা জানে গাণ্ডীব বিখ্যাত।হেন স্থানে রাখ, যেন লোকে নহে জ্ঞাত।।অর্জ্জুন বলেন, দেখ এই শমীদ্রুম।ভয়ঙ্কর শাখা সব পরশিছে ব্যোম।।আরোহিতে না পারিবে অন্য কোন জন।ইহাতে রাখি যে অস্ত্র যদি লয় মন।।অর্জ্জুনের বাক্যে রাজা করিয়া স্বীকার।কহিলেন রাখ যেন না হয় প্রচার।।তবেত গাণ্ডীব ধনু খসাইয়া গুণ।গদা শঙ্খ আদি যত অস্ত্রপূর্ণ তূণ।।বসনে আচ্ছাদি সব একত্র ছান্দিয়া।রাখিলেন উচ্চতর শাখাতে বান্ধিয়া।।শ্মশান নিকটে ছিল যত গোপগণ।সবাকারে পুনঃ পুনঃ বলেন বচন।।পথেতে আসিতে বৃদ্ধা জননী মরিল।অগ্নির অভাবে বৃক্ষে স্থাপিত হইল।।কুল ক্রমাগত মম আছে এই পথ।কিবা অগ্নি দহি, কিবা করি এই মত।।তবে জয় বিজয় জয়ন্ত জয়ৎসেন।জয়দ্বল পঞ্চ নাম গুপ্তে রাখিলেন।।পঞ্চ পাণ্ডবের এই নাম সমুদয়।যথাক্রমে রাখিলেন ধর্ম্ম মহাশয়।।সাধ্বী দ্রৌপদীর নাম মালিনী হইল।ছয় জনে ছয় নাম যুধিষ্ঠির দিল।।২. পঞ্চ পাণ্ডবের বিরাট রাজসভায় প্রবেশকাঁখেতে দেবন মণি মাণিক্যের সাজ।সভামাঝে প্রথমতঃ যান ধর্ম্মরাজ।।যুধিষ্ঠির রূপ দেখি মুগ্ধ মৎস্যপতি।সভাজন প্রতি চাহি কহে শীঘ্রগতি।।এই যে পুরুষ আসে কন্দর্প আকার।ইহাকে কখন কেহ দেখেছ কি আর।।ইন্দ্র চন্দ্র সূর্য্য সম প্রভা কলেবর।ঐরাবত সম গতি পরম সুন্দর।।কাঞ্চন পর্ব্বত যেন ভূমে শোভা পায়।আমার সভায় আসে, বুঝি অভিপ্রায়।।ক্ষত্রিয় লক্ষণ সর্ব্ব, ব্রাহ্মণের নয়।রাজচক্রবর্ত্তী প্রায় সর্ব্ব তেজোময়।।যে কাম্য করিয়া এই আসিতেছে হেথা।ক্ষত্র দ্বিজ যেবা হৌক পূরাব সর্ব্বথা।।হেন বিচারিতে উপনীত ধর্ম্মরাজ।কল্যান করিয়া দাণ্ডাইল সভামাঝ।।নমস্কার করি মৎস্যপতি মৃদুভাষে।বিনয় পূর্ব্বক ধর্ম্মরাজকে জিজ্ঞাসে।।কে তুমি, কোথায় বাস, এলে কোথা হৈতে।কোন্ কুল গোত্রে জন্ম, কেমন বংশেতে।।যে কাম্য তোমার, মাগি লহ মম স্থান।রাষ্ট্রপুর গৃহ দণ্ড ছত্র আর যান।।তোমারে দেখিয়া মম হেন মনে লয়।যাহ মাগ তাহা দিব করেছি নিশ্চয়।।এত শুনি কহিছেন ধর্ম্ম-অধিকারী।বৈয়াঘ্র আমার গোত্র, কঙ্ক নাম ধরি।।যুধিষ্ঠির নৃপতির ছিনু আমি সখা।কিছু ভেদ নাহি ছিল যেন আত্মা একা।।শত্রু নিল রাজ্য, বনে গেল পঞ্চ ভাই।তাঁর সম লোক আমি বিশেষ নিপুণ।।হেথা আসিলাম আমি শুনি তব গুণ।।এত শুনি মৎস্যরাজ বলেন হরিষে।সদাই আমার বাঞ্ছা এমত পুরুষে।।দৈবযোগে মম ভাগ্যে তোমারে পাইনু।রাজ্য ধন তব করে সকলি অর্পিনু।।আমার সদৃশ হয়ে থাকহ সভায়।যত মন্ত্রী পাত্র মোর সেবিবে তোমায়।।এত শুনি বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।কোন দ্রব্যে কভু মম নাহি প্রয়োজন।।হবিষ্য আহারী আমি, শয়ন ভূমিতে।কিছু যদি লাগে, তবে লৈব তোমা হৈতে।।হেনমতে সেই স্থানে রহে যুধিষ্ঠির।কতক্ষণে উপনীত বৃকোদর বীর।।হাতেতে করিয়া চাটু মৃগপতি গতি।হেমন্ত পর্ব্বত প্রায় কিবা যূথপতি।।সভাতে প্রবেশে যেন বাল-সূর্য্যোদয়।দেখি রিবাটের মনে হইল বিস্ময়।।রাজার সভায় উপনীত বৃকোদর।জয় হৌক, বলি বীর তুলে দুই কর।।চতুর্ব্বর্ণ শ্রেষ্ঠ আমি হই যে ব্রাহ্মণ।গুরু-উপদেশে পারি করিতে রন্ধন।।মোর সম রন্ধনেতে নাহি সূপকার।মল্লযুদ্ধাভ্যাস কিছু আছয়ে আমার।।এত শুনি মৎস্যপতি বলেন বচন।সূপকার তোমারে না লাগে মম মন।।কুবের ভাস্কর যেন শোভিয়াছে ভূমি।সর্ব্বক্ষিতি পালনের যোগ্য হও তুমি।।সূপকার যোগ্য তুমি নহ কদাচন।এত শুনি বৃকোদর বলেন বচন।।যুধিষ্ঠির নৃপতির ছিনু সূপকার।আমাতে বড়ই প্রীতি আছিল রাজার।।সিংহ ব্যাঘ্র বৃষ আর মহিষ বারণ।যাহা সহ যুঝাইবে, দিব আমি রণ।।মল্লযুদ্ধে আমা সম নাহিক মানুষে।আমার পালিল রাজা কৌতুক বিশেষে।।বল্লব আমার নাম রাখে ধর্ম্মরাজ।তাঁহার অভাবে ভ্রমি পৃথিবীর মাঝ।।বিরাট কহিল, ইথে নাহিক সংশয়।তোমার সব কথা বিচিত্র কিছু নয়।।বসুন্ধরা শাসিবারে যোগ্য হও তুমি।যে কামনা কর তুমি দিব তাহা আমি।।আমার আল যত আছে সূপকার।সবার উপরে তব হবে অধিকার।।এত বলি পাকগৃহে ভীমে পাঠাইল।এমতে রহিল ভীম কেহ না জানিল।।তবে কতক্ষণে আসিলেন ধনঞ্জয়।স্ত্রীবেশ কুণ্ডল শঙ্খ করেতে শোভয়।।দীর্ঘকেশ বেণী নামিয়াছে পৃষ্ঠোপরে।ভূমিকম্প যেন মত্তগজ-পদভরে।।দূরে দেখি সভাসদে কহে মৎস্যপতি।এই যে আসিছে যুবা ছদ্ম নারীজাতি।।ইহারে কখন কেহ দেখেছ কি আর।মনুষ্য না হয় এই দেবের কুমার।।ইহাকে দেখি আশ্চর্য্য হয়েছে সবাই।কেবা এ বুঝহ শীঘ্র আসিছে হেথায়।।এই মত মৎস্যপতি চিত্তে বিচারিতে।উপনীত হইলেন অর্জ্জুন সভাতে।।পার্থে হেরি সভাজন মানিল বিস্ময়।সবিস্ময়ে ধনঞ্জয়ে সবে নিরখয়।।বিস্ময়েতে জিজ্ঞাসেন বিরাট রাজন।কহ কেবা হও তুমি কাহার নন্দন।।কোন প্রয়োজনে হেথা তব আগমন।ক্ষম হৈলে করি তব প্রার্থনা পূরণ।।অর্জ্জুন বলেন, আমি হই যে নর্ত্তক।যেই হেতু বহুকাল আসি নপুংসক।।নৃত্যগীতে মম সম নাহিক ভুবনে।শিখাইতে পারি আমি দেবকন্যাগণে।।বিরাট বলিল, ইহা নাহি লয় মন।এ কর্ম্মের যোগ্য তুমি নহ কদাচন।।এই যে স্ত্রীবেশ তুমি ভূষিয়াছ গায়।তোমার অঙ্গেতে ইহা শোভা নাহি পায়।।ভূতনাথ-অঙ্গে যথা ভস্ম আচ্ছাদিল।দিনকর তেজ যেন মেঘেতে ঢাকিল।।তোমার এ ভুজতেজ যে ধনু সহিল।সে ধনুর তেজে সব পৃথিবী কাঁপিল।।পার্থ কহিলেন, রাজা ধর্ম্মের নন্দন।তাঁর ভার্য্যা দ্রৌপদীর ছিলাম গায়ন।।শত্রু রাজ্য নিল, তাঁরা প্রবেশিল বন।এই হেতু তব রাজ্যে আসিনু রাজন।।আমি নপুংসক রাজা নাম বৃহন্নলা।নৃত্য গীত বাদ্য শিক্ষা দেই রাজবালা।।রাজা বলে, বৃহন্নলা রহ মম ঘরে।সব সমর্পণ আমি করিনু তোমারে।।ধন জন পুত্র দারা রাখ এই পুর।পুত্র তুল্য তুমি এই রাজ্যের ঠাকুর।।উত্তরাদি কন্যা যত আছে মম পুরে।নৃত্য গীতে বিশারদা করহ সবারে।।এত বল অন্তঃপুর মধ্যে পাঠাইল।এমতে রহেন পার্থ কেহ না জানিল।।নকুল ক্ষণেক পরে করে আগমন।দূর হৈতে নৃপ তাঁরে করে নিরীক্ষণ।।মেঘ হৈতে মুক্ত যেন হৈল শশধরে।সূতবেশ তুরঙ্গ প্রবোধ বাড়ি করে।।দুইবিতে অশ্বগণ করে নিরীক্ষণ।মদমত্ত গতি যেন প্রমত্ত বারণ।।প্রণমিয়া দাঁড়াইল রাজ সভাতলে।কোমল মধুর ভাষে নৃপতিরে বলে।।অশ্ব চিকিৎসক, নাম গ্রন্থিক আমার।জীবিকার্থে আসিলাম তোমার আগার।।রাজা বলে, এলে তুমি কোন্ দেশ হৈতে।দেবপুত্র প্রায় তোমা, লয় মম চিতে।।নকুল বলিল, কুরু ধর্ম্মের নন্দন।লক্ষ লক্ষ অশ্ব তাঁর না যায় গণন।।সব অশ্ব পালিবারে মোরে নিয়োজিল।আমার পালনে অশ্বগণ বৃদ্ধি হৈল।।কড়িয়ালি দেই আমি যে ঘোড়ার মুখে।কোনকালে তার দুষ্টভাব নাহি থাকে।।রাজা বলে, যত মম আছে অশ্বগণ।সকলি রক্ষার্থ তোমা করিনু অর্পণ।।নকুল করিল অশ্বগৃহেতে গমন।কতক্ষণে সহদেব দিল দরশন।।তরুণ অরুণ যথা উঠে পূর্ব্বভিতে।অগ্নিশিখা যেন যজ্ঞে দেখি আচম্বিতে।।গোপজাতি যেন ধরিয়াছে নট বশে।গোপুচ্ছ ছান্দ দড়ি আছয়ে বিশেষ।।রাজা সহ সবিস্ময় যত সভাজন।প্রণাম করিয়া বলে, মাদ্রীর নন্দন।।জীবিকার্থে আসিলাম তোমার নগর।গবী রক্ষা হেতু মোরে রাখ নৃপবর।।আমার রক্ষণে গবী ব্যাধি নাহি জানে।ব্যাঘ্রভয় চৌরভয় নাহি কদাচনে।।বিরাট বলিল, ইথে তুমি যোগ্য নহ।কে তুমি, কি নাম ধর, সত্য করি কহ।।ইন্দ্র চন্দ্র কামদেব জিনি তব মূর্ত্তি।বুদ্ধি পরাক্রমে বুঝি রাজচক্রবর্ত্তী।।বৃহস্পতি শুক্র সম নীতি তব ভাষ।খড়গধারী হস্ত তব, পদ্মধারী পাশ।।সহদেব বলে, জান পাণ্ডুর নন্দন।তাঁহার যতেক গবী লোকে অগণন।।করিতাম সেই সব গোধন পালন।মম গুণে প্রীত ছিল পাণ্ডুর নন্দন।।আর এক মহৎ কর্ম্ম জানি নরনাথ।ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান মম জ্ঞাত।।পৃথিবী ভিতরে নৃপ যত কর্ম্ম হয়।গৃহেতে বসিয়া তাহা জানি মহাশয়।।ধর্ম্মরাজ সভাতলে ছিনু দীর্ঘকাল।যুধিষ্ঠির মোরে নাম দিল তন্তিপাল।।রাজা বলে, যত বল, সম্ভবে তোমারে।যে কাম্য তোমার থাকে, লহ মোর পুরে।।যত গবী আছে মম আর রক্ষিগণ।তোমারে দিলাম সব, করহ পালন।।এমত কহিয়া সহদেবে মহামতি।পঞ্চ জনে বাঞ্ছামত দেন নরপতি।।মৎস্যদেশে পাণ্ডবেরা রহেন গোপনে।অস্তগিরি মধ্যে যেন সহস্রকিরণে।।রহিল অনল যেন ভস্মমধ্যে লুকি।কেহ না জানিল, সবে অনুক্ষণ দেখি।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।৩. বিরাট-গৃহে দ্রৌপদীর প্রবেশ ও বিরাট-রাণীসুদেষ্ণার সহিত কথোপকথনতবে কতক্ষণে কৃষ্ণা প্রবেশে নগরে।চতুর্দ্দিকে নরনারী ধায় দেখিবারে।।ক্লেশেতে মলিন মুখ, দীর্ঘ মুক্তকেশ।পিন্ধন মলিন জীর্ণ, সৈরন্ধ্রীর বেশ।।পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসয়ে যত নারীগণ।কে তুমি, একাকী ভ্রম কিসের কারণ।।তোমার রূপের সীমা বর্ণনে না যায়।কিন্নর অপ্সরা তুমি দেবকন্যা প্রায়।।সবারে প্রবোধি কৃষ্ণা বলে এই বাণী।সৈরন্ধ্রীর কর্ম্ম করি, নরজাতি আমি।।এমতে বেষ্টিত লোকে ভ্রমে দেবী কৃষ্ণা।প্রাসাদে থাকিয়া তাহা দেখিল সুদেষ্ণা।।কৈকেয়-রাজের কন্যা, বিরাট মহিষী।কৃষ্ণারে আনিতে শীঘ্র পাঠালেন দাসী।।আদর করিয়া তাঁরে যতেক কামিনী।অন্তঃপুরে লয়ে গেল যথা রাজরাণী।।শত শত রাজকন্যা সুদেষ্ণা বেষ্টিতা।দ্রৌপদীরে হেরি সবে হইল লজ্জিতা।।সাশ্চর্য্যে কৃষ্ণার রূপ সবে নিরীক্ষণে।নীরবে যতেক নারী চিন্তে মনে মনে।।বুঝি শাপভ্রষ্ট হৈয়া কোন দেবকন্যা।আসিয়াছে মৎস্যদেশ করিবারে ধন্যা।।কতক্ষণে জিজ্ঞাসিল বিরাটের রাণী।দেবকন্যা হয়ে কেন ভ্রমহ অবনী।।মহাভারতের কথা সুধা হৈতে সুধা।সাধুজন করে পান নাশিবারে ক্ষুধা।।কাশীরাম দাস করে নতি সাধুজনে।পাইবে পরম প্রীতি যাহার শ্রবণে।।৪. দ্রৌপদীর রূপ বর্ণনকিবা লক্ষ্মী সরস্বতী, হরপ্রিয়া হৈমবতী,সাবিত্রী কি ব্রহ্মার গৃহিণী।রোহিণী চন্দ্রের রামা, রতি সতী তিলোত্তমা,কিবা হবে ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী।।তোমার অঙ্গের আভা, ম্লান করিলেক সভা,তারা যেন চন্দ্রের উদয়ে।তোমার শরীর দেখি, নিমেষ না করে আঁখি,ঘন ঘন কম্পিত হৃদয়ে।।শশী নিন্দি মুখপদ্ম, কেন করিয়াছ ছদ্ম,এ বেশ তোমার নাহি শোভে।পেয়ে তব অঙ্গঘ্র্রাণ, ত্যজিয়া কুসুমোদ্যান,অলিবৃন্দ ধায় মধুলোভে।।মৃগনেত্র জিনি আঁখি, কামশর তুল্য দেখি,বাজিলে মরিবে কামরিপু।কণ্ঠ তব কম্বু জিনি, ওষ্ঠ পক্ক-বিম্ব গণি,পঞ্চশর লিপ্ত তব বপুল।।রক্ত কর কোকনদ, কক্ত কোকনদ-পদ,রক্তযুক্ত অরুণ অধর।শুকচঞ্চু জিনি নাসা, সুধার সদৃশ ভাষা,ভুজযুগ জিনি বিষধর।।তোমার নিতম্ব কুচে, গগন নিবাসী ইচ্ছে,মৃগপতি জিনি মধ্যদেশ।কিবা পুঞ্জ কাদম্বিনী, জিত চারু চামরিণী,মুক্ত দেখি কেন হেন কেশ।।হের দেখ বরাননে, তোমা দেখি তরুগণে,লম্বিত হইল শাখা সহ।কি দেবী নাগিণী তুমি, কি হেতু ভ্রমহ ভূমি,না ভাণ্ডিহ সত্য মোরে কহ।।তব অঙ্গযোগ্য পতি, মানুষে না দেখি সতি,বিনা দেব দিকপালগণ।তব অঙ্গ-দরশনে, মোহ গেল নারীগণে,পুরুষ না জীয়ে কদাচন।।সুদেষ্ণার বাক্য শুনি, মধুর কোমল বাণী,সবিনয়ে বলেন পার্ষতী।না দেবী গন্ধর্ব্বী আমি, মানুষী নিবসি ভূমি,ফলাহারী সৈরন্ধ্রীর জাতি।।দয়া করি রাণী মোরে, রাখহ আপন ঘরে,সেবা করি রহিব তোমার।না ছোঁব উচ্ছিষ্ট জাত, চরণে না দিব হাত,এইমাত্র নিয়ম আমার।।প্রবালকুমুতা পাঁতি, ভাল জানি নিত্য গাঁথি,পুষ্পমালা জানি যে বিশেষ।।সিন্দূর কঙ্গল আদি, রত্ন-আভরণ নিধি,বিচিত্র জানি যে কেশ-বেশ।।গোবিন্দের প্রিয়তমা, মহাদেবী সত্যভামা,বহুকাল সেবিলাম তাঁকে।আমার নৈপুণ্য দেখি, পাণ্ডবের প্রিয়সখী,কৃষ্ণা মাগি নিলেন আমাকে।।কৃষ্ণা আমি এক প্রাণ, ইথে না জাহি আন,বহুকাল বঞ্ছিলাম তথা।রাজ্য নিল শত্রুগণ, পাণ্ডবেরা গেল বন,তেঁই আমি আসিলাম হেথা।।বিরাটপর্ব্বের কথা, বিচিত্র ভারত গাথা,সর্ব্বদুঃখ শ্রবণে বিনাশ।কমলাকান্তের সুত, সুজনের মনঃপূত,বিরচিল কাশীরাম দাস।।৫. সুদেষ্ণার নিকট দ্রৌপদীর নিয়ম কথনও সুদেষ্ণার দ্রৌপদীকে আশ্রয় প্রদানরাণী বলে, শুন সতি তব রূপ দেখি।স্ত্রীজাতি হইয়া পালটিতে নারি আঁখি।।নৃপতি দেখিয়া লোভ করিবে তোমারে।না হইবে মম শক্তি নিবারিতে তাঁরে।।তোমা দেখি আদর না করিবেন মোরে।আমি উদাসীনা হব তোমা রাখি ঘরে।।আপনার দ্বারে কাঁটা রোপিব আপনে।কর্কটীর গর্ভ যথা মৃত্যুর লক্ষণে।।রাজ-বাসে রহে কত আত্ম-পরিজন।সৎ অসৎ আছে তার মধ্যে কত জন।।তোমায় প্রদানি আমি হেথায় আশ্রয়।কেমনে রক্ষিব তোমা এই জাগে ভয়।।এত শুনি কৃষ্ণা তবে বলে সুদেষ্ণায়।দুষ্টা নারী সম রাজ্ঞী না ভাব আমায়।।যেবা হৌক, মোর প্রতি যদি কোন জন।পাপচক্ষে চাহিলে না জীবে কদাচন।।পঞ্চ গন্ধর্ব্বের আমি করি যে সেবন।অনুক্ষণ রাখে মোরে সেই পঞ্চ জন।।থাকুক স্পর্শন, যদি দেখে পাপচক্ষে।দেবতা হলেও মৃত্যু যেন তার পক্ষে।।দুঃখানলে দগ্ধ সদা মম স্বামিগণ।না বাঁচিবে আমারে যে করিবে চালন।।দয়া করি মোরে যদি রাখ গুণবতী।পশ্চাতে জানিবে তুমি আমার প্রকৃতি।।না লব উচ্ছিষ্ট আর না ছোঁব চরণ।পুরুষের কাছে নাহি পাঠাবে কখন।।সুদেষ্ণা বাক্য শুনি কৃষ্ণা হৃষ্টমনে।এমতে রহিলা দেবী বিরাট ভবনে।।সেবায় হইল বশ বিরাটের রাণী।সুশীলে করিলা বশ যতেক রমণী।।বিরাটের সভাপতি ধর্ম্মের নন্দন।ধর্ম্ম ন্যায়ে বশ করিলেন সভাজন।।সপুত্রেতে আনন্দিত মৎস্য-অধিকারী।অনুক্ষণ ধর্ম্ম সহ খেলে পাশাসারি।।পাশায় জিনিয়া ধর্ম্ম অনেক রতন।দীন দরিদ্রেরে সব করে বিতরণ।।ভীমের রন্ধনে তুষ্ট হলেন রাজন।বশ হৈল, যত জন করিল ভোজন।।মল্লযুদ্ধে বড় তুষ্ট হইয়া রাজন।অর্পণ করেন ভীমে কনক রতন।।অর্জ্জুনের দেখি নৃত্য গীত বাদ্যরস।অন্তঃপুরে নারীগণ সবে হৈল বশ।।বহুকাল অশ্বগণ দুষ্টমন ছিল।নকুলের করস্পর্শে সবে শান্ত হৈল।।গবীগণ বৃদ্ধি পায়, যথা ক্ষীরবতী।সহদেব গুণে বশ হন মৎস্যপতি।।পাণ্ডবের গুণে মৎস্যদেশ বশ হৈল।এইরূপে চারিমাস ক্রমেতে কাটিল।।সুধার সমান মহাভারতের কথা।ভক্তিতে শুনিলে ঘুচে যায় ভবক্ষুধা।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon