০৬. অর্জ্জুনের সহিত দুর্য্যোধনাদির ক্রমান্বয়ে যুদ্ধপরদিন প্রভাতেতে যত বীরগণ।সসৈন্য চলিল সবে করিবারে রণ।।যোদ্ধাগণ চলিল চড়িয়া দিব্যরথে।গজবাজী পদাতিক চলে যূথে যূথে।।হস্তী হ্স্তী মল্লে মল্লে মহাযুদ্ধ করে।অশ্বে আসোয়ার যুঝে নানা অস্ত্র ধরে।।হেনকালে ধনঞ্জয় কৃষ্ণে আগে করি।রণস্থলে আইলেন হাতে ধনু ধরি।।গগন ছাইয়া বীর এড়িলেন বাণ।কোটি কোটি সেনাপতি ত্যজিলেক প্রাণ।।ক্রোধেতে অর্জ্জুন যেন দীপ্ত হুতাশন।প্রাণ লয়ে পলাইয়া যায় সেনাগণ।।সৈন্যভঙ্গ দেখি তবে রাজা দুর্য্যোধন।কোপমনে রথে চড়ি করিল গমন।।অর্জ্জুন উপরে মারে পূরিয়া সন্ধান।একেবারে প্রহারিল দশ গোটা বাণ।।অর্দ্ধপথে ধনঞ্জয় করে খান খান।ছয় বাণ মারিলেন পূরিয়া সন্ধান।।দুই বাণে কাটিলেন ধ্বজ মনোহর।চারি বাণে অশ্বগণ গেল যমঘর।।দুই বাণ এড়িলেন যেন যমদণ্ড।সারথির মাথা কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।।নিরখিয়া দুর্য্যোধন কম্পিত অন্তর।রথ এড়ি গদা লয়ে ধাইল সত্বর।।গদা ফেলি মারিলেক অর্জ্জুনের রথে।দারুণ প্রহারে রথ লাগিল কাঁপিতে।।কোপেতে অর্জ্জুন যেন অনল সমান।দুর্য্যোধনে প্রহার করিল শত বাণ।।বাণাঘাতে দুর্য্যোধন মহাকম্পবান।বেগে পলাইয়া যায় লইয়া পরাণ।।বাণাঘাতে ব্যথিত হইল দুর্য্যোধন।রথ লয়ে সারথি যোগায় সেইক্ষণ।।রথে চড়ি পলাইয়া যায় দুর্য্যোধন।দেখি ক্রোধে অগ্রসর দ্রোণের নন্দন।।ধনঞ্জয় অশ্বথামা হয় মহারণ।বিস্ময় মানিয়া চায় যত যোদ্ধাগণ।।সন্ধান পূরিয়া অশ্বথামা মারে বাণ।অর্দ্ধপথে পার্থ করিলেন খান খান।।তবে ধনঞ্জয় বীর ক্রোধে হুতাশন।দ্রৌণীর উপরে করে বাণ বরিষণ।।বৃষ্টিধারাবৎ বাণ করেন ক্ষেপণ।নিমিষেকে নিবারিল দ্রোণের নন্দন।।বাণব্যর্থ দেখি তবে বীর ধনঞ্জয়।মহাকোপে পুনশ্চ করেন অস্ত্রময়।।বাণাঘাতে অশ্বথামা ব্যথিত হইল।মূর্চ্ছিত হইয়া বীর রথেতে পড়িল।।মূর্চ্ছিত হইলে রথ ফিরায় সারথি।পলাইয়া গেল অশ্বথামা যোদ্ধাপতি।।তবে দুঃশাসন বীর দেখি বৃকোদরে।হস্তীর উপরে চড়ি চলিল সত্বরে।।দুঃশাসনে দেখি কোপে বলে ভীমবীর।গদাঘাতে আজি তোর লোটাব শরীর।।দ্রৌপদীর মানস করিব আজি পূর্ণ।এত বলি গদা লয়ে ধায় অতি তূর্ণ।।হস্তীর উপরে গদা করিল ক্ষেপণ।পৃথিবীতে দন্ত দিয়া পড়িল বারণ।।হস্তী যদি পড়িল পলায় দুঃশাসন।সৈন্যের মধ্যেতে পশি রাখিল জীবন।।তবে বৃকোদর বীর ক্রোধে হুতাশন।গদার প্রহারে মারে রথ রথিগণ।।তবে অশ্বথামা বীর ধায় শীঘ্রগতি।যুদ্ধ করিবারে বাঞ্ছা ভীমের সংহতি।।অশ্বথামা দেখি বীর চাপে নিজ রথে।ভয়ঙ্কর ধনুক তুলিয়া নিল হাতে।।বাণ বৃষ্টি করে দোঁহে দোঁহার উপর।দোঁহাকার বাণে দোঁহে হইল জর্জ্জর।।কোপে অশ্বথামা বীর পরিঘ লইয়া।মারিলেন বৃকোদরে ক্রোধিত হইয়া।।অচেতন হৈল বীর পরিঘের ঘায়।রথের উপরে বীর পড়ি গেল ঠায়।।কতক্ষণে চেতন পাইয়া বৃকোদর।মহাকোপে উঠিলেন কম্পিত অধর।।গদা ফেলি মারিলেন রথের উপর।চূর্ণ হৈল রথখান দেখি লাগে ডর।।সেইক্ষণে আর রথ যোগায় সারথি।তাহাতে চড়িয়া অশ্বথামা মহামতি।।ভীমের উপরে বীর এড়ে যত বাণ।কাটি পাড়ে ভীম তাহা করি খান খান।।অতি ক্রোধে বৃকোদর জ্বলন্ত অনল।রথ এড়ি গদা লয়ে ধায় মহাবল।।রথের উপরে মারে দোহাতিয়া বাড়ি।চূর্ণ হৈল রথখান যায় গড়াগড়ি।।লাফ দিয়া অশ্বথামা পলাইয়া যায়।দেখি বৃকোদর বীর পাছে পাছে ধায়।।হেনকালে কর্ণ বীর হৈল আগুয়ান।ভীমের উপরে মারে চোক্ চোক্ বাণ।।বাণাঘাতে বৃকোদর হইল বিবর্ণ ।কর্ণেরে এড়েন বাণ পূরিয়া আকর্ণ।।যত বাণ এড়ে ভীম কর্ণ ফেলে কাটি।রথ এড়ি ধায় বীর মহাক্রোধে ফাটি।।গদা হাতে করি ক্রোধে ধায় মহাসুর।গদা মারি অশ্ব রথ করিলেন চুর।।লাফ দিয়া কর্ণ বীর যায় পলাইয়া।শীঘ্রগতি আর রথে চড়িলেন গিয়া।।কর্ণ পলাইয়া গেল দেখি বৃকোদর।আপনার রথে গিয়া চড়িল সত্বর।।বাণ বৃষ্টি করে বীর সৈন্যের উপর।বাণেতে সকল সৈন্য করিল জর্জ্জর।।হেথায় সংগ্রাম করি পার্থ ধনুর্দ্ধর।কোটি কোটি কাটিলেন সৈন্য নিরন্তর।।অর্জ্জুনের বাণে স্থির নহে সেনাগণ।দেখিয়া ব্যাকুল তাহে রাজা দুর্য্যোদন।।দ্রোণেরে ডাকিয়া তবে বলিল বচন।দেখ গুরু সৈন্য সব হইল নিধন।।সেনাপতি তোমা করি করিলাম আশ।যুধিষ্ঠিরে ধরি দিবা করিলে আশ্বাস।।আজিকার যুদ্ধে গুরু না দেখি নিস্তার।ভীম ধনঞ্জয় করে সকল সংহার।।সেনাপতি করিতাম যদ্যপি কর্ণেরে।এত দিনে কর্ণ ধরি দিত যুধিষ্ঠিরে।।মহারথী দেখি তোমা কৈনু সেনাপতি।উপরোধে না যুঝহ বুঝি তব মতি।।তোমার শিক্ষিত অস্ত্র অর্জ্জুন পাইয়া।তব অস্ত্রে মারে সেনা দেখ দাণ্ডাইয়া।।এতেক শুনিয়া গুরু ক্রোধে হুতাশন।ডাকিয়া বলিল তবে শুন দুর্য্যোধন।।পূর্ব্বেতে তোমায় আমি কহিনু আপনে।ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ আমি কিবা কার্য্য রণে।।সেনাপতি যোগ্য আমি না হই কখন।আমার এ সব কার্য্য নহে প্রয়োজন।।এত বলি ডাকিলেন আপন নন্দন।ক্রোধ করি যায় দ্রোণ উপেক্ষিয়া রণ।।তবে দুর্য্যোধন কর্ণ শকুনি লইয়া।আগে হৈতে গুরুপদে পড়িল আসিয়া।।শকুনি বলিল গুরু কর অবধান।প্রীতিভাবে দুর্য্যোধন করে অভিযান।।তুমি যদি উপেক্ষিয়া চলিলা ভবনে।আজ্ঞা কর রাজা দুর্য্যোদন যাক বনে।।এত শুনি গুরু হাসি হইল সদয়।দুর্য্যোধন দুঃখ দেখি ব্যথিত হৃদয়।।দ্রোণ বলে কহিলাম পূর্ব্বেতে তোমারে।অর্জ্জুন না থাকিলে ধরিব যুধিষ্ঠিরে।।অর্জ্জুন সম্মূখে যুঝে নাহি হেন বীর।যার বাণে যোদ্ধাগণ কেহ নহে স্থির।।এক যুক্তি ভাবিয়াছি শুন দুর্য্যোধন।তবে সে ধরিতে পারি ধর্ম্মের নন্দন।।না থাকিবে ধনঞ্জয় সমর পাইয়া।তবে ধরে দিতে পারি রাজাকে বান্ধিয়া।।এতেক কহিতে হয় সন্ধ্যার সময়।কৌরব পাণ্ডব গেল আপন আলয়।।মহাভারতের কথা অমৃত-আখ্যান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পূণ্যবান।।০৭. দ্রোণের প্রতি দুর্য্যোধনের খেদোক্তিও নারায়ণী সেনার যুদ্ধারন্তশিবিরেতে গেল তবে রাজা দুর্য্যোধন।অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বিরস বদন।।কহিলেন গুরু অগ্রে করিয়া রোদন।কিরূপে আমার গুরু হইবে তারণ।।কি প্রকারে জিনি উপদেশ বল তুমি।কেবল ভরসা তব করিতেছি আমি।।দ্রোণ বলে গুণ আমি কহি যে বচন।তবে যুধিষ্ঠিরে ধরি শুন দুর্য্যোধন।।নারায়ণী সেনা দেখ যুদ্ধে বড় কৃতী।তাহার সহায় আছে সুশর্ম্মা নৃপতি।।অর্জ্জুনের সহ তারা করুক সমর।তবে সে ধরিতে পারি ধর্ম্মের কোঙর।।এত শুনি আনন্দিত হইল রাজন।সেইক্ষণে ডাকি আনে সংসপ্তকগণ।।ত্রিগর্ত্ত রাজাকে আনি বলিল বচন।আমার বচন শুন সুশর্ম্মা রাজন।।নারায়ণী সেনামধ্যে হও সেনাপতি।অর্জ্জুনের সহ যুদ্ধ কর মহামতি।।সসৈন্যে উত্তর দিকে তুমি চলি যাহ।অর্জ্জুনের সনে গিয়া সমর করহ।।সুশর্ম্মা বলেন শুন আমার বচন।আজি অর্জ্জুনেরে করিব নিধন।।নারায়ণী সেনা দেখ যমের সমান।পৃথিবীর মাঝে যার অব্যর্থ সন্ধাণ।।এ সব লইয়া আমি করি গিয়া রণ।জানিহ পার্থের তবে নিশ্চয় মরণ।।এতেক বলিয়া গর্জ্জে যত সেনাগণ।শুনি দুর্য্যোধন হৈল উল্লাসিত মন।।নারায়ণী সেনা মধ্যে শ্রেষ্ঠ সপ্তরথী।তার মধ্যে সুশর্ম্মা হইল সেনাপতি।।আনন্দিত মনে সবে রজনী বঞ্চিল।প্রভাতে উঠিয়া কুরুক্ষেত্রেতে চলিল।।অর্জ্জুনের রথে তবে সাজিলেন হরি।আইল পাণ্ডবগণ কৃষ্ণ অগ্রে করি।।অর্জ্জুনের প্রতি বলে সংসপ্তকগণ।আজি ধনঞ্জয় তুমি মোরে দেহ রণ।।করিব তোমারে আজি অবশ্য সংহার।এই করিলাম শুন সত্য অঙ্গীকার।।এতেক শুনিয়া হাসি ইন্দ্রের নন্দন।সংসপ্তক সহ যান করিবারে রণ।।রণেতে প্রচণ্ড বড় সংসপ্তকগণ।অদ্ভূত করয়ে রণ নাহি নিবারণ।।কর্ণ দুর্য্যোধন দেখি আনন্দিত মন।হাসিয়া বলিল তবে মিহির নন্দন।।বুঝিতে না পারি কিছু বিধাতার ইচ্ছা।করিলাম যে প্রতিজ্ঞা সে হইল মিছা।।অর্জ্জুনে বধিব আমি আছে অঙ্গীকার।পড়িয়া সংসপ্ত হাতে হইবে সংহার।।হরিষত হয়ে বড় রাজা ত্বরা করি।কহিতে লাগিল গিয়া গুরু বরাবরি।।তোমার ভারতী গুরু মস্তক ভূষণ।একান্ত আমার তুমি জানিনু এখন।।শত ভাই আমার সহায় কর্ণ রথী।দ্রোণাচার্য্য অশ্বথামা মাতুল সুমতি।।বেড়িয়া বধিব ভীমে ভয় তার কিসে।যুধিষ্ঠিরে গিয়া গুরু ধর অনায়াসে।।দ্রোণ বলে কর আজি সকলে সংগ্রাম।আজি রণে ঘুচাইব পাণ্ডবের নাম।।অপূর্ব্ব করিব ব্যূহ অদ্ভূত মানসে।ব্যূহ করি সবাকারে মারিব নিঃশেষে।।আজি সে ধরিব আমি ধর্ম্ম নৃপবর।আমার প্রতিজ্ঞা এই সবার গোচর।।চক্রব্যূহ করে তবে অদ্ভূত মানুষে।মন্ত্রেতে পূর্ণিত করি অস্ত্র চারি পাশে।।ব্যূহমুকে জয়দ্রথ রহে সাবধানে।মহারথী মধ্যে যারে করিয়া গণনে।।বহু রথ রথী হস্তী অশ্ব সেনাগণ।ব্যূহমুখে জয়দ্রথ রহে সচেতন।।তাহার পশ্চাতে রহে মহাশয় দ্রোণ।দুই পার্শ্বে অশ্বথামা সূর্য্যের নন্দন।।স্থানে স্থানে রাখে দ্রোণ মহাবীরগণ।ব্যূহমধ্যে ভ্রাতৃসহ রাজা দুর্য্যোধন।।পশ্চাতে রহিল কৃপ শল্য ভগদত্ত।সবে মহাপরাক্রম রণে মহামত্ত।।দেবের অজিত ব্যূহ সৈন্য সমাবেশ।সাহস না হয় কার করিতে প্রবেশ।।দুই দলে মহাযুদ্ধ হয় গালাগালি।সৈন্যে সৈন্যে সমর বাজিল রণস্থলী।।সৈন্যে সৈন্যে মহাযুদ্ধ হৈল আগুয়ান।গজে গজে মহাযুদ্ধ আর পাছু আন।।রথে রথে হৈল যুদ্ধ অশ্বে আসোয়ার।হুড়াহুড়ি রণস্থলে হৈল মহামার।।চক্রব্যূহ করি দ্রোণ করে মহারণ।নিমিষেকে নিপাতিল যত সৈন্যগণ।।দ্রোণের বিক্রমে সেনাগণ নহে স্থির।সম্মূখ হইয়া যুঝে নাহি হেন বীর।।সংসপ্তকে রহিলেন পার্থ মহামতি।হেথা সেনা বিনাশয়ে দ্রোণ যোদ্ধাপতি।।একেশ্বর বৃকোদর করি প্রাণপণ।নিবারণ করে আর যত যোদ্ধাগণ।।যুধিষ্ঠিরে ধরিবারে যান দ্রোণ বীর।নাহিক সম্ভ্রম কিছু নির্ভয় শরীর।।যুধিষ্ঠির উপরে করেন শরবৃষ্টি।বাণে অন্ধকার কৈল নাহি চলে দৃষ্টি।।সহিতে না পারি বড় হইলা ফাঁপর।মুহূর্ত্তেকে যুধিষ্ঠির করিয়া সমর।।দশ বাণ এড়ে দ্রোণ রথের উপর।দুই বাণে কাটি পাড়ে ধ্বজ মনোহর।।চারি বাণে কাটি পাড়ে সারথির মুণ্ড।চারি বাণে চারি অশ্ব করিলেন খণ্ড।।অচল হইল রথ দেখি দ্রোণ বীরে।ধরিবারে যায় তবে রাজা যুধিষ্ঠিরে।।দেখিয়া কৌরবগণ হরিষ অন্তর।ধন্য ধন্য করি দ্রোণে প্রশংসে বিস্তর।।আজি ধরা গেল ধর্ম্মরাজ গুরু হাতে।আজি মম মনোরথ পূরে ভালমতে।।রাজার সঙ্কট দেখি ধৃষ্টদ্যুম্ন বীর।আগুলিল দ্রোণে আসি নির্ভয় শরীর।।দ্রোণের উপরে করে বান বরিষণ।গগন ছাইল বাণে না দেখি তপন।।অস্ত্রাঘাতে যুধিষ্ঠির হইয়া কম্পিত।নকুলের রথ গিয়া চড়েন ত্বরিত।।দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুন্নে হয় অতি ঘোর রণ।দুরেতে থাকিয়া তাহা দেখয়ে রাজন।।ধৃষ্টদ্যুন্ন বাণ এড়ে তারা হেন ছুটে।দ্রোণের ধনুক বীর চারি বাণে কাটে।।আর দুই বাণ বীর এড়ে আচম্বিতে।ধনুক কাটিয়া ফেলে দ্রোণের অগ্রেতে।।আর ধনু লয়ে দ্রোণ গুণ দিয়া টানে।সেই ধনু ধৃষ্টদ্যুন্ন কাটে এক বাণে।।পুনরপি ধৃষ্টদ্যুন্ন এড়ে দশ বাণ।দ্রোণের কবচ কাটি, করে খান খান।।আর দশ বাণ বীর ছাড়িল ত্বরিত।বাণাঘাতে দ্রোণাচার্য্য হইল মূর্চ্ছিত।।দেখিয়া কৌরবগণ বিলাপ করিল।পাণ্ডবের দলে বড় আনন্দ হইল।।তবে কতক্ষণে দ্রোণ পাইল চেতন।লাজে ভরদ্বাজপুত্র মলিন বদন।।ক্রোধে এক ধনু লয়ে দিলেন টঙ্কার।শব্দেতে লাগিল তালি কর্ণে সবাকার।।সন্ধান পূরিয়া এড়ে দিব্য অস্ত্রগণ।নিবারয়ে বাণে বাণ পাঞ্চাল নন্দন।।তবে মহাক্রোধে দ্রোণ হৈল কম্পমান।একেবারে প্রহারিল তীক্ষ্ম দশ বাণ।।বাণাঘাতে ধৃষ্টদ্যুন্ন হইল মূর্চ্ছিত।কবচ ভেদিয়া অঙ্গে বহিছে শোণিত।।রথেতে পড়িল বীর হইয়া অজ্ঞান।রথ লইয়া সারথি হৈল পাছুয়ান।।মূর্চ্ছা ত্যজি উঠি বীর দেখে পলায়ন।সারথিরে নিন্দা করি বলেন বচন।।সম্মূখ সমরে মোর ফিরাইলি রথ।দ্রোণ কি বলিষ্ঠ আমি নহি কি তেমত।।এইক্ষণে দ্রোণে আমি বিনাশিব রণে।ঝাট রথ লহ শুন দ্রোণ বিদ্যমানে।।শুনিয়া সারথি রথ ফিরাইল বেগে।অবিলম্বে নিল রথ দ্রোণাচার্য্য আগে।।পুনঃ মুখামুকি দোঁহে হইল সমর।দোঁহাকার বাণ গিয়া ঠেকিল অম্বর।।মহাপরাক্রম দ্রোণ নানা অস্ত্র জানে।ধৃষ্টদ্যুন্ন দুই ধনু কাটিলেন বাণে।।ধনু যদি কাটি গেল, অন্য ধনু লয়।সেই ধনু কাটি পাড়ে দ্রোণ মহাশয়।।যত ধনু লয় বীর কাটে পুনর্ব্বার।ক্রোধে শেল হাতে নিল দ্রুপদ কুমার।।হাঁকারিয়া শেলপাট এড়ে বাহুবলে।যতদূর যায় শেল ততদূর জ্বলে।।শেলপাট দেখি দ্রোণ এড়ি দিব্য বাণ।পাঁচ বাণে শেলপাট করে খান খান।।শেল যদি কাটা গেল দ্রুপদ কুমার।চিন্তিয়া ভাবেন মনে সকলি অসার।।লাফ দিয়া ভূমে পড়ে লয়ে আসি ঢাল।সম্মূখে পড়িয়া তবে বলে ভাল ভাল।।ভাঙরি কাটিয়া বীর উঠে দ্রোণ রথে।চারি অশ্ব কাটিলেক অতিশীঘ্র হাতে।।সারথি কাটিয়া দ্রোণে কাটিবারে যায়।চমৎকার সর্ব্বলোক একদৃষ্টে চায়।।অর্দ্ধচন্দ্র বাণ গুরু করিয়া সন্ধান।অসিচর্ম্ম কাটি তার করে খান খান।।আর দশ বাণ গুরু মারে বায়ুবেগে।দশবাণ ধৃষ্টদ্যুন্ন হৃদয়েতে লাগে।।বিনাঘাতে ধৃষ্টদ্যুন্ন হইল মূর্চ্ছিত।মেতে পড়িল বীর নাহিক সম্বিত।।ধৃষ্টদ্যুন্নে বিমুখ দেখিয়া সর্ব্বজন।করিলেন দ্রোণোপরি বাণ বরিষণ।।তবে মহাক্রোধে দ্রোণ এড়ে দিব্যবাণ।হয় হস্তী রথ রথী করে খান খান।।এতেক দেখিয়া তবে রাজা যুধিষ্ঠির।।করিছেন মনে চিন্তা কুপিত শরীর।।চক্রব্যূহ করি দ্রোণ করে মহারণ।পার্থ বিনা ব্যূহ বিন্ধে নাহি হেনজন।।হেনকালে মনেতে পড়িল আচম্বিত।অভিমন্যু মহাবীরে ডাকেন ত্বরিত।।আইলেন অভিমন্যু রাজার আদেশে।ভূমিষ্ঠ হইয়া বর রাজাকে সম্ভাষে।।ধর্ম্ম বলিলেন পুত্র শুনহ বচন।ব্যূহ ভেদিবার তুমি জান প্রকরণ।।অভিমন্যু বলে রাজা করি দিবেদন।প্রবেশ জানি যে আমি, না জানি নির্গম।।যেইকালে ছিনু আমি, জননী জঠরে।তাহার বৃত্তান্ত কহি তোমার গোচরে।।পিতা মম জিজ্ঞাসিল গোবিন্দের স্থান।ব্যূহ ভেদিবারে মোরে করহ বিধান।।এত শুনি নারায়ণ ভূমিতে আঁকিয়া।প্রত্যক্ষে বৃত্তান্ত সব দিলেন কহিয়া।।হেনকালে জননী জিজ্ঞাসে সেইক্ষণ।প্রবেশে জানিলে কহ নির্গম কারণ।।এত যদি মাতা জিজ্ঞাসিলেন পিতারে।নির্গম কারণ নাহি কহিল মায়েরে।।নির্গম না জানি আমি জানাই তোমারে।তবে করি, যাহা আজ্ঞা করিবে আমারে।।শ্রীধর্ম্ম বলেন পুত্র শুনহ কারণ।তোমার পশ্চাতে যাবে যত যোদ্ধাগণ।।ব্যূহ ভেদি মার পুত্র দ্রোণ ধনুর্দ্ধর।তোমার বিক্রম যত আমাতে গোচর।।বাপের সমান পুত্র মহাধনুর্দ্ধর।তোমার সহিত যাবে যত বীরবর।।তোমার পশ্চাতে যাবে ভীম আদি করি।সত্বর আইস পুত্র দ্রোণেরে সংহারি।।অন্ধের জীবন তুই নয়নের তারা।না দেখিলে তোমা ধনে ক্ষণে হই হারা।।প্রাণ পাঠাইয়া রব সংশয়ের স্থান।তোমার পশ্চাতে যাবে যত যোদ্ধাগণ।।এত বলি শিরে রাজা করেন চুম্বন।প্রশংসিয়া ঘন ঘন দেন আলিঙ্গন।।কিশোর বয়স তব নব্য কলেবর।রমণীমোহন রূপ অতি মনোহর।।অগুরু চন্দন গায় বায়ু বহে গন্ধ।ভুবনবিজয়ী বীর নহে নিরানন্দ।।মণি মরকত আদি আভরণ গায়।হেরিলে জুয়ায় আঁখি আপদ পলায়।।পীতাম্বর পরিধান হাতে শর ধনু।সাহসে সিংহের প্রায় দোষহীন তনু।।রাজাকে কহিল বার না করিহ ভয়।করিব সমরে আজি রিপুগণ ক্ষয়।।আজি যুদ্ধে বিনাশিব দ্রাণ ধনুর্দ্ধরে।দ্রোণে না মারিয়া আমি না আসিব ঘরে।।এই সত্য কথা মম শুন নৃপবর।ইহাতে আপনি কেন এতেক কাতর।।এত বলি যুঝিতে চলিল বীরবর।সারথিরে বলে রথ সাজাও সত্বর।।সুমন্ত্র সারথি বলে করি যোড়কর।এক নিবেদন মম শুন ধনুর্দ্ধর।।অত্যল্প বয়স তব নবীন যৌবন।দ্রোণ সহ তোমার উচিত নহে রণ।।যমের সমান হেন দেখ দ্রোণ বীর।যার বাণে যোদ্ধাগণ কেহ নহে স্থির।।এতেক শুনিয়া বীর ক্রোধে হুতাশন।সারথিরে চাহি বলে করিয়া গর্জ্জন।।কৃষ্ণের ভাগিনা আমি অর্জ্জুন তনয়।ত্রিভুবন মধ্যেতে কাহারে মোর ভয়।।দ্রোণের সহিত আজি করিব সমর।এক বাণে তাহারে পাঠাব গমঘর।।আজি যদি দ্রোণে আমি মারিবারে পারি।বড় তুষ্ট হইবেন মাতুল শ্রীহরি।।যুধিষ্ঠির রাজার করিব কিছু হিত।করিব সমর আজি জানাই নিশ্চিত।।এইক্ষণে রথ তুমি সাজাও সত্বর।অবশ্য করিব যুদ্ধ কিছু নাহি ডর।।এতেক শুনিয়া তবে সুমন্ত্র সত্বর।তুলিল বহুল অস্ত্র রথের উপর।।জাঠি শেল ঝকড়া যে মুষল মুদগর।শক্তি ভিন্দিপাল তোলে অসংখ্য তোমর।।মহাদর্প করি উঠে রথের উপর।ব্যূহ ভেদিবারে যায় পার্থ বংশধর।।ভীম আদি করি তবে মহারথীগণ।তাহার পশ্চাতে যান করিবারে রণ।।ব্যূহে প্রবেশিল বীর চক্ষুর নিমিষে।নানা অস্ত্র সৈন্যগণ উপরে বরষে।।প্রলয়ের মেষ যেন সংহারিতে সৃষ্টি।ততোধিক অভিমন্যু করে শরবৃষ্টি।।ঝাঁকে ঝাঁকে বাণ মারে সৈন্যের উপর।মার মার বলি ডাকে অর্জ্জুন কোঙর।।এক গোটা বাণ বীর তূণ হৈতে আনে।দশ গোটা বাণ হয় ধনুকের গুণে।।গমনে শতেক হয়, সহস্র পতনে।এই মত পুনঃ পুনঃ এড়ে অস্ত্রগণে।।পড়িল অনেক সৈন্য রক্তে বহে নদী।কুরুসৈন্য রক্তে স্নান করে বসুমতী।।ভীম আদি করিয়া যতেক বীরগণ।ব্যূহমুখে গিয়া সবে করে মহারণ।।জয়দ্রথ ব্যূহ রক্ষা করে প্রাণপণে।না দেয় দুয়ার ছাড়ি অন্য বীরগণে।।যুধিষ্ঠির ভীম আদি নকুল দুর্জ্জয়।পার্থ বিনা সবাকারে করিলেক জয়।।জয়দ্রথ যুদ্ধ করে অতি ঘোরতর।বিমূখ করিল সর্ব্ব বীরে একেশ্বর।।এতেক শুনিয়া জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল।কহ মুনিবর আরো শুনিতে হইল।।পাণ্ডবগণেরে জয়দ্রথ করে জয়।ইহার কারণ মোরে কহ মহাশয়।।দ্রোণপর্ব্ব সুধারস অভিমন্যু বধে।কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।০৮. জয়দ্রথের নিকট পাণ্ডবদিগের পরাভবের বৃত্তান্তমুনি বলে, পূর্ব্বকথা শুনহ রাজন।যুধিষ্ঠির রাজা যবে প্রবেশেন বন।।কত দিনে জয়দ্রথ গেল সেই বনে।দ্রৌপদীরে একা তবে দেখিল ভবনে।।দেখিয়া দুর্ম্মতি হৈল সিন্ধুর নন্দন।দ্রৌপদীরে রথে তুলি করিল গমন।লইয়া আপন দেশে চলিল দুর্ম্মতি।হাহাকার শব্দ করি ডাকয়ে পার্ষতী।।তবে ভীম কোপে ধায় ভীম পরাক্রম।ক্রোধ-মূর্ত্তি দেখি যেন যুগান্তের যম।।এক লাফে ধরি বীর তাহার চিবুক।এক চড়ে দন্তপাটি করিলেক চূর।।যুধিষ্ঠির-বাক্যে ছাড়ি দিল বৃকোদর।দেশেতে না গেল বীর লজ্জায় কাতর।।আপনি প্রবেশ করি বনের ভিতরে।দ্বাদশ বৎসর সেবা করিলে শঙ্করে।।বিবিধ প্রকারে করে শিবের সেবন।দর্শন দিলেন তথা দেব পঞ্চানন।।শিব বলে, বর মাগ সিন্ধুর তনয়।ইহা শুনি জয়দ্রথ হরে প্রণময়।।অনেক করিয়া স্তুতি বলয়ে বচন।অবধান কর প্রভো মম নিবেদন।।এই বর দেহ মোরে দেব শূলপাণি।পাণ্ডবগণেরে যেন রণে আমি জিনি।।শিব বলিলেন, শুন সিন্ধুর তনয়।জিনিবে সবারে কিন্তু বিনা ধনঞ্জয়।।ইহা বলি অন্তর্ধান হৈল পঞ্চানন।জয়দ্রথ নিজ দেশে করিল গমন।।এই হেতু সবাকারে জিনিল সৈন্ধব।ভীম আদি পরাজিত যতেক পাণ্ডব।।হাতে ধনু ধরি বীর করে মহারণ।একা জয়দ্রথ সব করিল বারণ।।এক রথে জয়দ্রথ সিন্ধুর তনয়।মহাগর্ব্ব করি বুলে নির্ভয়-হৃদয়।।ভীমেরে করিল দশ বাণে পরাজয়।আর দশ বাণে বিন্ধে সাত্যকি-হৃদয়।।ধৃষ্টদ্যুম্নে নিবারিল মারি দশ বাণ।দশ বাণে বিরাটেরে করিল অজ্ঞান।।এইমত জয়দ্রথ করে ঘোর রণ।ব্যুহ প্রবেশিতে নাহি পারে যোদ্ধাগণ।।০৯. অভিমন্যুর যুদ্ধারম্ভব্যূহে প্রবেশিল যবে অভিমন্যু বীর।ভীম আদি যোদ্ধাগণ হইল অস্থির।।নাহি দিল জয়দ্রথ প্রবেশিতে পথ।চিন্তাকূল হল বড় পড়িল বিপদ।।ব্যূহ ভেদি গেল পুত্র নিজ বীরপণে।তাহাতে কহিল শুনি নির্গম না জানে।।জানিয়া সমূহ সৈন্যমাঝে গেল রণে।সঙ্কটে পড়িলে রক্ষাপাইবে কেমনে।।হেথা না দেখিয়া বীর সৈন্য নিজ পাশ।জানিল নিশ্চয় বিধি করিল নিরাশ।।উপায় কি আছে আর অপারের সিন্ধু।পড়িয়াছি পার নাহি বিধি মাত্র বন্ধু।।এত বলি সাহস করিল মহাবীর।বাণবৃষ্টি করি সৈন্য করিল অস্থির।।এক রথে অভিমন্যু করে মারমার।দেখিয়া কৌরবগণ করে হাহাকার ।।চৌদিকে বেষ্টিত যত কুরুসৈন্যগণ।পিঞ্জর মধ্যেতে যেন পোষা পক্ষী রন।।না জানে বালক সেই নির্গমের সন্ধি।মীন যেন পড়িল হইয়া জালে বন্দী।।তথাপি অভয় ধনু লইলেক হাতে।শাসিত করিয়া সৈন্য ভ্রমে এক রথে।।জলদ বরিষে যেন কালে বরিষায়।ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্র পড়ে ক্ষমা নাহি তায়।।মাহুত মাতঙ্গ পড়ে তুরঙ্গ বহুত।কোটি কোটি সৈন্য মারে সংগ্রামে অদ্ভূত।।অলস না হয় তনু সাহসী বালক।সৈন্যরণ্য দহে যেন হইয়া পাবক।।প্রকাশেন পরাক্রম নাহি তার সীমা।বাখানয়ে বালকের বিবিধ মহিমা।।একমাত্র ধনুকের গুণে পঞ্চ বাণ।না পারে সম্মূখে কেহ করিতে সন্ধান।।কুমারের প্রতাপ দেখিয়া কুরুগণ।চিন্তাকূল দুর্য্যোধন বিষণ্ণ বদন।।হেনকালে উলুক দুঃশাসনের নন্দন।অভিমন্যু সহ গেল করিবারে রণ।।আইল সমর হেতু অভিমন্যু সঙ্গ।ইচ্ছিল পড়িতে যেন পাবকে পতঙ্গ।।দেখিয়া আর্জ্জুনি কোপে অনল সমান।গাল দিয়া বলে তুই বড়ই অজ্ঞান।।কে দিল কুবুদ্ধি তোরে হৈল ব্রহ্মশাপ।এই দণ্ডে দেখাইব আমার প্রতাপ।।ত্যজ আশা, কর বাসা শমনের ঘরে।বিলম্ব না হবে এই পাঠাই তোমারে।।এত বলি ইঙ্গিত করিয়া এড়ে বাণ।তাহার বিক্রমে উলুকের উড়ে প্রাণ।।এক বাণে ধ্বজ কাটি করে খণ্ড খণ্ড।আর দুই বাণে পাড়ে সারথির মুণ্ড।।চারি বাণে কাটিলেক রথের চারি হয়।দুই বাণে উলুকেরে দিল যমালয়।।উলুক পড়িল যদি লাগে চমৎকার।কৌরবের যোদ্ধাগণ করে হাহাকার।।করি বহু বিলাপ কান্দেন দুঃশাসন।এক যোদ্ধাপতি মম উলুক নন্দন।।সর্ব্বশূন্য দেখি আমি তোমার বিহনে।গৃহে না যাইব আমি যাইব কাননে।।তবে বৃষসেন বীর কর্ণের নন্দন।আর্জ্জুনি সহিত গেল করিবারে রণ।।করিয়া অনেক দর্প বৃষসেন বীর।এক রথে যায় তবে নির্ভয় শরীর।।অভিমন্যু সহ তবে করে মহারণ।দেখি কোপে জ্বলে বীর কর্ণের নন্দন।।কাটিল রথের ধ্বজ মারি দুই বাণ।চারি বাণে চারি অশ্ব করে খান খান।।আর দুই বাণ বীর এড়ে আচম্বিতে।সারথির মাথা কাটি পাড়িল ভূমিতে।।অর্দ্ধচন্দ্র বাণ এড়ে অর্জ্জুন তনয়।এক ঘায়ে বৃষসেন হৈল মৃতপ্রায়।।পুত্র ভঙ্গ দেখি তব কর্ণ মহাবীর।ক্রোধেতে পূর্ণিত অঙ্গ হইল অস্থির।।বহু বিলাপয়ে কর্ণ সূর্য্যের নন্দন।মহাকোপে গেল তবে করিবারে রণ।।বাছিয়া বাছিয়া কর্ণ এড়ে অস্ত্রগণ।অস্ত্র ব্যর্থ করে বীর অর্জ্জুন-নন্দন।।তবে কোপে অভিমন্যু এড়ে দশ বাণ।কর্ণের কবচ কাটিকরে খান খান।।কবচ কাটিয়া বাণ অঙ্গে প্রবেশিল।মূর্চ্ছিত হইয়া কর্ণ রথেতে পড়িল।।মূর্চ্ছিত দেখিয়া রথ ফিরায় সারথি।পলাইয়া গেল তবে কর্ণ যোদ্ধাপতি।।তবেত লক্ষ্মণ দুর্য্যোধনের নন্দন।অভিমন্যু সহ গেল করিবারে রণ।।যেইক্ষণে আগু হৈল ভানুমতী-সুত।অভিমন্যু বীর তারে বলে ক্রোধযূত।।হিতবাক্য বলি তোরে ভাইরে লক্ষণ।এমত কুমতি তোরে দিল কোন্ জন।।বাপের দুলাল তুই বড় প্রিয়তর।না কর সমর ভাই মম বাক্য ধর।।অনেক যতনে লোক রক্ষা করে দেহ।আপনি মরিলে সঙ্গে না যাইবে কেহ।।এ সুখ সম্পদ আশা ছাড় কি কারণ।আমার বচন ধর না করিও রণ।।ইষ্ট বন্ধু জনক জননী খুড়া ভাই।মরিলে সম্বন্ধ আর কার সঙ্গে নাই।।ভালরূপে দেখ ভাই সবার বদন।মম সঙ্গে রণে তোর অবশ্য নিধন।।ক্ষমা চাহে আমারে যে হইয়া কাতর।হইলে পরম শত্রু ডর নাহি তার।।অভয় দিলাম ভাই বলিলাম তোরে।সম্বরিয়া সমর চলিয়া যাহ ঘরে।।তোমারে বধিলে সিদ্ধ হবে কোন কার্য।বরঞ্চ হবেন রুষ্ট শুনি ধর্ম্মরাজ।।সাক্ষাতে দেখিলে যত কর্ণের বড়াই।পড়িলে আমার ঠাঁই আজি রক্ষা নাই।।পলাইয়া গেল নারি সহিতে সমর।বাখানে কৌরবগণ যারে নিরন্তর।।আমি তোরে বলি আজি অখণ্ডিত কথা।কাটিয়া ফেলিব কর্ণ শকুনির মাথা।।বান্ধিয়া লইয়া যাব ধর্ম্মরাজ আগে।এত বলি রক্তবর্ণ চক্ষু হৈল রাগে।।লক্ষ্মণ বলিল আর না কর বড়াই।বুঝিব কেমনে এড়ইবা মোর ঠাঁই।।শুনিয়া কহিল তবে অর্জ্জুন নন্দন।ধনুকের গুণে বাণ যুড়ি সেইক্ষণ।।দুই বাণে রথধ্বজ হৈল খণ্ড খণ্ড।আর দুই বাণে কাটে সারথির মুণ্ড।।আর দুই বাণ এড়ে কি কহিব কথা।শ্রীকুণ্ডল কাটি পাড়ে লক্ষণের মাথা।।দেখি দুর্য্যোধন শোকে হৈল অচেতন।ভূমে গড়াগড়ি দিয়া করয়ে রোদন।।প্রাণের নন্দন মোর অতি প্রিয়তর।হাহাকার করে রাজা হইয়া কাতর।।ভ্রাতার মরণ দেখি পদ্মবীর বেগে।হাতে ধনু করি গেল অভিমন্যু আগে।।সেই বেগে আগু হৈল পদ্মবীরবর।দুই বাণে কাটিলেক অর্জ্জুন কোঙর।।দুর্য্যোধন দেখি পুত্র হইল সংহার।ভূমিতে পড়িয়া রাজা করে হাহাকার।।পুত্রশোকে দুর্য্যোধন হইল কাতর।বৈশনাশ কৈল মোর অর্জ্জুন কোঙর।।দুই পুত্র শোকে রাজা শোকাকুল মন।হাতে গদা করি ধায় করিবারে রণ।।অর্জ্জুনি বলিল আর কারে নাহি চাই।পাণ্ডবংশ শত্রু দুষ্ট তোরে যদি পাই।।ভূমি দুঃখ দিলে পিতা আদি পঞ্চজনে।কপট পাশায় জিনি পাঠাইলে বনে।।মোরা বনবাসী, তব সব অধিকার।এত অবিচার বিধি কত সবে আর।।আছে নাহি পলাইও প্রাণে পেয়ে ভয়।রহিয়া করহ যুদ্ধ কুরু মহাশয়।।না করিহ অবজ্ঞা বলিয়া শিশু মোরে।ফিরিয়া যাইতে সাধ না কর অন্তরে।।এত বলি বাণ এড়ে পূরিয়া সন্ধান।গদা লক্ষ্যে মারিলেক তীক্ষ্ম দশ বাণ।।দশ বাণে গদা কাটি সত্বর ফেলিল।তীক্ষ্ম ভল্ল দশ গোটা অঙ্গে প্রহারিল।।বাণাঘাতে দুর্য্যোধন ব্যথিত অন্তর।বেগে পলাইয়া যায় ত্যজিয়া সমর।।অভিমন্যু বলে রাজা না চাহি তোমায়।পলাইয়া যাও কোন শৃগালের প্রায়।।ক্ষণেক থাকিয়া যুদ্ধ কর মহাশয়।আজি তোমা পাঠাইব শমন আলয়।।এতেক বলিয়া গর্জ্জে অর্জ্জুন তনয়।পলাইল দুর্য্যোধন ব্যথিত হৃদয়।।এক রথে ভ্রমে বীর অর্জ্জুন কোঙর।নাহিক সম্ভ্রম কিছু নির্ভয় অন্তর।।গগন ছাইয়া বীর করে অস্ত্র বৃষ্টি।বাণে অন্ধকার হয় নাহি চলে দৃষ্টি।।অমর্থ সমর্থ বাণ, বাণ ব্রহ্মজাল।কোশিক কপালী বাণ আর রুদ্রকাল।অর্দ্ধচন্দ্র ক্ষুরপা তোমর ভল্ল শর।।বারুণ হুতাশ বাণ সমরে দুষ্কর।কোন স্থানে অগ্নিবাণে পুড়ে সেনাগণ।।কোন স্থানে মহাঝড় বহিছে পবন।কোন স্থানে মেঘগণে আবরিল ভানু।।মুষলধারায় বৃষ্টি শীতে কাপে তনু।ঢাকিল রবির তেজ হৈল অন্ধকার।।চারিদিকে অস্ত্র পড়ে না দেখি নিস্তার।কুঞ্জর সারথি অশ্ব ফেলে কাটি কার।ধনু সহ বামহন্ত কাটে আলোয়ার।।কাহার কাটিল মুণ্ড কুণ্ডল সহিত।নাসা শ্রুতি কাটিল দেখিতে বিপরীত।।বাণবৃষ্টি করিলেন পড়িয়া সন্ধান।কাহার কাটিল পাড়ে পদ দুইখান।।অস্ত্রাঘাত কোন বীর করে ছটফটি।কাটিয়া পাড়িল কার দন্ত দুই পাটি।।দেখিয়া কৌরবগণ করে হাহাকার।অভিমন্যু একাকী করিল মহামার।।এক শত সহোদর রাজা দুর্য্যোধন।তাহা সবাকার যত আছিল নন্দন।।একে একে অভিমন্যু করিল সংহার।দেখি দুর্য্যোধন রাজা করে হাহাকার।।মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের তনয়।ধৃতরাষ্ট্রে সব কথা শুনায় সঞ্জয়।।শুনহ নৃপতি তুমি অনর্থের কথা।হইল দৈবেতে বাম দারুণ বিধাতা।।অর্জ্জুন তনয় ষোল বৎসরের শিশু।সৈন্যমধ্যে সিংহ যেন পায় বন্যপশু।।অন্ত করে সামন্ত অর্দ্ধেক একা আসি।দ্রোণ কর্ণ রহিলেন সেই ভয় বাসি।।অধোমুখ দুর্য্যোধন মানিয়া বিস্ময়।চিন্তিয়া আকুল বড় চমকিয়া রয়।।ঊনশত ভাই তারা হারাইল বোধ।সমরে অসক্ত বড় যেমন অবোধ।।নদী হৈল শোনিতে বহিয়া স্রোত যায়।প্রলয়কালেতে সৃষ্টি নাশ হৈল প্রায়।।ধৃতরাষ্ট্র কহে শুন সঞ্জয় সুমতি।যতেক শুনি যে পড়ে মোর সেনাপতি।।একা অভিমন্যু করে মোর সেনাক্ষয়।বড় বড় সেনাপতি পায় পরাজয়।।ষোড়শ বৎসর শিশু পূর্ণ নাহি হয়।কেহ না পারিল তারে করিতে বিজয়।।অদ্ভূত শুনিয়া মম কাঁপিছে হৃদয়।ধন্য ধন্য মহাবীর অর্জ্জুন তনয়।।সঞ্জয় বলিল, রাজা শুনহ কারণ।অভিমন্যু সহ যুঝে নাহি হেন জন।।পর্ব্বত কাটিয়া পাড়ে অভিমন্যু বাণ।মহাধনুর্দ্ধর বীর বাপের সমান।।ধৃতরাষ্ট্র বলে মোর হেন লয় মন।সবারে মারিয়া যাবে অর্জ্জুন-নন্দন।।দ্রোণপর্ব্ব পুণ্যকথা অভিমন্যু বধে।কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।১০. অভিমন্যু বধমুনি বলে অপূর্ব্ব শুনহ জন্মেজয়।করিল অদ্ভূত যুদ্ধ অর্জ্জুন তনয়।।রথে পড়ে তিন কোটি রথীবৃন্দবর।ছয়বৃন্দ মদমত্ত পড়িল কুঞ্জর।।সপ্ত পদ্ম অশ্ব পড়ে রণে আসোয়ার।পদাতিক সৈন্য পড়ে সংখ্যা নাহিতার।।শোণিতে হইল নদী ভাসে কত সেনা।তরঙ্গে আতঙ্ক হয় রাশি রাশি ফেণা।।কবন্ধ উঠিয়া কেলি করে তার রসে।শোণিত সাগর মাঝে সাঁতারিয়া ভাসে।।ঝন্ঝনি রণভূমি অস্ত্র অগ্নিবাণে।প্রাণপণে যুঝে কৌরবের সেনাগণে।।এড়িল গন্ধর্ব্ব অস্ত্র অর্জ্জুন তনয়।কৌরবের ঠাট কাটি করিলেক ক্ষয়।।পড়িল অনেক সেনা লেখা জোখা নাই।তরঙ্গে ঢাকিয়া অঙ্গ ভাসিয়া বেড়াই।।শোণিত হইল নীর নৌকা করিবর।রথচয় ভাসে যেন রাজহংসবর।।অশ্ব সব ভাসি বুলে কচ্ছপের প্রায়।মানের সদৃশ নর ভাসিয়া বেড়ায়।।তৃণের সমান ভাসে ধনু অস্ত্রগণ।দেখিয়া শোণিত নদী ভীত সর্ব্বজন।।এতেক দেখিয়া তবে শকুনি নন্দন।রথেতে চড়িয়া গেল করিবারে রণ।।দেখিয়া আর্জ্জুনি ক্রোধে অনল সমান।ধনুক কাটিয়া তার করে খান খান।।চারি বাণে কাটিল রথের হয় চারি।আর দুই বাণে তার সারথি সংহারি।।সারথি পড়িল, রথ হইল অচল।বিস্ময় মানিয়া চাহে কৌরবের দল।।পুনরপি অভিমন্যু এড়ে দুই বাণ।কর্ণ নাসা কাটিয়া করেন খান খান।।শ্রবণ নাসিকা গেল দেখিতে কুৎসিত।কাটিয়া পাড়িল মুণ্ড কুণ্ডল সহিত।।শকুনি দেখিল যুদ্ধে পড়িল নন্দন।হাহাকার করি বহু করিল রোদন।।আর্জ্জুনিরে দেখি কাল শমন সমান।ভয়ে আর কোন বীর নহে আগুয়ান।।সংগ্রাম করয়ে বীর অর্জ্জুন কোঙর।কোটি কোটি রথীকে পাঠান যমঘর।।সন্ধান পূরিয়া বীর এড়ে দিব্যবাণ।শোণিতে বহিছে নদী অতি খরশান।।দেখিয়া ব্যকুল বড় রাজা দুর্য্যোধন।দ্রোণ চাহি বলিতে লাগিল সেইক্ষণ।।কুমারের তুষ্ট তুমি বুঝিনু বিধানে।তাই দুষ্ট যুদ্ধ করে তব বিদ্যমানে।।বালক হইয়া করে এত অপমান।তামা সব মহারথী আছ বিদ্যমান।।বুঝিলাম জয় নাহি আমার সমরে।একেলা মারিয়া আজি যাইবে সবারে।।এতেক শুনিয়া দুর্য্যোধনের উত্তর।ক্রোধমুখে বলিলেন দ্রোণ মহাবীর।।তব কর্ম্ম প্রাণপণে করি অনুক্ষণ।তথাপিও হেন ভাষা কহ দুর্য্যোধন।।অভিমন্যু জিনে হেন নাহি কোন জন।তার ভয়ে পলাইলে লইয়া জীবন।।বাপের সদৃশ বীর যমের সমান।বজ্রের সমান যার অব্যর্থ সন্ধান।।কর্ণ হেন যোদ্ধা, যারে নারিল সমরে।আর কে আছয়ে হেন জিনিবে তাহারে।।রাজা বলে বৃথা গুরু গঞ্জহ আমারে।না বলিয়া তোমারে বলিব আর কারে।।না জান জয়ন্তে আমি হইয়াছি মরা।শোক দুঃখ অনুতাপে বিধি কৈল জরা।।সংশয়ে আশ্রয়ী গিরি সেহনহে সার।তবে কি উপায় এতে হইবেক আর।।বিপক্ষের এক শিশু বধে নানা সেনা।নিবারিতে ইহারে নাহিক এক জনা।।এতকাল আশ্বাসে বিশ্বাস যাই যার।আজি কেন হৈল হীন ভরসা তাহার।।নামেতে বিখ্যাত যারা বড় বড় বীর।বিষাদে হইল সব দেখি নতশির।।করুণা বিষাদ বাক্য নৃপতির শুনি।কহিতে লাগিল দ্রোণ শুন কুরুমণি।।ন্যায়যুদ্ধে অভিমুন্যে জিনিতে যে পারে।কহিলাম হেন জন নাহিক সংসারে।।ভাগিনেয় শ্রীকৃষ্ণের অর্জ্জুনের সুত।দেখিলে সাক্ষাতে যার সমর অদ্ভূত।।ন্যায়যুদ্ধে তাহারে নারিবে কদাচন।কহিনু জানিও মম স্বরূপ বচন।।দুর্য্যোধন বলে, শুন আমার বচন।সপ্তরথী এককালে কর গিয়া রণ।।এতেক শুনিয়া গুরু বিরস বদন।এমত অন্যায় নাহি করে কোন জন।।কৃপাচার্য্য বলে ইহা অদ্ভূত কথন।কিমত প্রকারে ইহা হয় দুর্য্যোধন।।এমত অন্যায় যুদ্ধ কভু নাহি করি।এত বলি কৃপাচার্য্য স্মরিল শ্রীহরি।।দুর্য্যোধন বলে যদি ইহা না করিবে।সবারে মারিয়া আজি আর্জ্জুনি যাইবে।।প্রধানের সর্ব্বদোষ অন্যায়ে কি ভয়।বধিতে রিপুকে মম এই বিধি হয়।।ইহাতে করিলে হেলা বড় হবে দোষ।বধিয়া বালকে কর আমারে সন্তোষ।।মজিল সকল সৃষ্টি ব্যাজ নাহি সয়।সর্ব্বনাশ কৈল শিশু শমন উদয়।।মম বাক্যে তোমা সবা কর এই মতি।এককালে অভিমুন্যে বেড় সপ্তরথী।।দুঃশাসন শকুনি রাধেয় মম মামা।দ্রোণাচার্য্য কৃপাচার্য্য আর অশ্বথামা।।আমিও যাইব তথা তোমার পশ্চাৎ।এইরূপ করি তারে করহ নিপাত।।এত শুনি কৃপাচার্য্য নিশ্বাস ছাড়িল।দুর্নীতি রাজার হস্তে বিধ্যানয়োজিল।।আমা সবাকার ইথে কি করে বিলাপে।মরিবেক দুর্য্যোধন এই মহাপাপে।।অমঙ্গল হৈল তার নাহিক অবধি।শুকাইল সরোবর স্রোত এড়ে নদী।।আহার এড়িল সব পক্ষী যে প্রমাদে।আকুল হইয়া যত গ্রাম্যসিংহ কাঁদে।।অনাচার কর্ম্ম বড় অরণ্যে হইল।মুহুর্মূহুঃ বসুমতী কাঁপিতে লাগিল।।রাজলক্ষ্মী রাজারে ছাড়িল অনুতাপে।অচিরে হইবে নষ্ট এই মহাপাপে।।অঙ্গ হৈল বিবর্ণ বদন হৈল কালি।সামর্থ্য বিহীন অঙ্গ কর্ণে লাগে তালি।।দেবমায়া দেখে রাজা হইতে গগন।উদয় হইল যেন দ্বাদশ তপন।।আচম্বিতে মাথার মুকুট গেল খসি।অন্ধকার দেখি সদা মনে ভয় বাসি।।তথাপি বিষয় মদে না জানি মরণ।আজ্ঞা দিল বধ ঝাট পার্থের নন্দন।।সপ্তরথী রথে চড়ে ভাবিয়া বিষাদ।ভদ্র নাহি নৃপতির হইল প্রমাদ।।বেড়িল বালকে গিয়া সপ্ত মহারথী।হানাহানি মহাযুদ্ধ হয় অবিরতি।।এককালে সপ্তরথী করে অস্ত্রময়।রবি আচ্ছাদিল বাণে অন্ধকার হয়।।ভূষণ্ডী তোমর শক্তি বাণ জাঠাজাঠি।ত্রিশূল পট্টিশ মহা অস্ত্র কোটি কোটি।।সূচীমুখ শেলমুখ অর্দ্ধচন্দ্রবাণ।বিকট সঙ্কট শক্তি অনল সমান।।কপালী কৌশিকী বাণ, বাণ ব্রহ্মজাল।রুদ্রদ্যুতি রিপুচণ্ড অত্যন্ত বিশাল।।শ্রাবণের মেঘ যেন বৃষ্টি বার বার।তপন ঢাকিল যেন তিমির আকার।।একযোগে সপ্তরথী অস্ত্র বরষিল।অমর ভুজঙ্গ নর চমকিত হৈল।।যেন সৃষ্টি মজাইতে ইচ্ছা বিধাতার।বাণবৃষ্টি হয় যেন মুষলের ধার।।হইল পাবক তুল্য আর্জ্জুনি কুপিয়া।কৌরবদলের এত অন্যায় দেখিয়া।।হাহাকার আকাশে অমরগণ করে।সপ্ত মহারথী বেড়ে এক বালকেরে।।বিধি বিড়ম্বিল দুর্য্যোধন দুরাচারে।এমত অন্যায় যুদ্ধ সে কারণে করে।।কতু হেন বিপরীত না দেখি না শুনি।মরিবে নিশ্চয় পাপী গরাসিল ফণী।।মহাবীর্য্য তনুজ, তুলনা নাহি মহী।সাধু সাধু শব্দ শুনি ইহা বই নাহি।।অভিমন্যু মহাবীর অবসাদ নাই।প্রশংসা করিয়া গুণ দেবতারা গাই।।বন্ধনে সন্ধান পুরি শিশু এড়ে বাণ।নিমিষে সকাল অস্ত্র করে খান খান।।কাটিয়া সবার অস্ত্র অর্জ্জুন তনয়।দশ দশ বাণে বিন্ধে সবার হৃদয়।।বাণাঘাতে সপ্তরথী হতজ্ঞান হয়।শিশুর শমন বাণ হেন মনে লয়।।মূর্চ্ছা দেখি রথীর সারথি লয় রথ।পলাইল রথী লয়ে যোজনেক পথ।।সপ্তরথী এইরূপে যুঝে সাতবার।সবাকারে পরাজিল অর্জ্জুন কুমার।।অবসাদ নাহি, অস্ত্র এড়ে শিশু যত।কোটি কোটি সেনা হয় সমরেতে হত।।হয় পড়ে নাহি সীমা কুঞ্জরের দল।রথে পথ ঢাকিল চলিতে নাহি স্থল।।মড়ায় ধোড়ার ক্ষিতি পদাতিক গদা।রুধিরে হইল হোড় বরিষার কাদা।।কতক্ষণে সপ্তরথী পাইল চেতন।লজ্জায় সবার যেন হইল মরণ।।কার মুখ কেহ নাহি চাহে অভিরোষে।রথ এড়ি মহীতলে মাথা ধরি বসে।।কি হৈল কি হইরে কুমার নহে যম।পলাইল অবসাদে বলে হয়ে কম।।চিন্তিয়া আকুল হয়ে কূল নাহি দেখি।মজিলাম অবোধ রাজার হাতে ঠেকি।।বালকের ক্লান্তি নাহি আর বাড়ে বল।পতঙ্গের প্রায় দেখে কুরুসৈন্য দল।।নলবন দলে যেন মদমত্ত হাতী।নিপাতে নিমিষে লক্ষ লক্ষ সেনাপতি।।দুর্নীতি দেখিয়া তবে দুর্য্যোধন ভূপ।ছাড়িল জীবন আশা শুকাইল মুখ।।অধোমুখ বীরগণ বুক নাহি বান্ধে।নৃপতির চরণযুগল ধরি কান্দে।।কেশরী সমান শিশু মৃগ যেন পেয়ে।সংহারে সকল সৈন্য দেখ কিবা চেয়ে।।আকুল হইয়া রাজা রথী সপ্ত জনে।কহিতে লাগিল অতি বিনয় বচনে।।দেখ গুরু মহাশয় কর্ণ প্রাণসখা।বিনাশিল সর্ব্বসৈন্য অভিমন্যু একা।।শুন শুন সপ্তরথী আমার বচন।সুনরপি অভিমন্যু বেড় সাত জন।।সাহসে না হও হীন সতর্ক হইয়া।মোরে রক্ষা কর এই বালকে বধিয়া।।জয় করি সমরে পুরাও যদি আশ।কিনিয়া করিবে তবে মোরে নিজ দাস।।রাজার বিনয় শুনি বল করে রথী।পুনরপি যায় রণে সপ্ত সেনাপতি।।রথে বসে বিক্রমে বাসব তেজ ধরি।সারথি চালায় রথ শিশু বরাবরি।।বালকে বেড়িয়া বাণ বরিষয়ে তারা।বৃষ্টি যেন বরিষয়ে মুষলের ধারা।।প্রাণপণে করে রন প্রাণে ছাড়ি আশা।সাহসে বান্ধিয়া বুক করিল ভরসা।।নিবারণ করি অস্ত্র অভিমন্যু বীর।বাণে বিন্ধি খণ্ড খণ্ড করিল শরীর।।ধারায় রুধির বহে অবিরত গায়।তথাপি তিলেক শ্রম নাহি করে তায়।।তবে কর্ণ মহাবীর মানিয়া বিস্ময়।প্রমাদ দেখিয়া ডাকি ছয় জনে কয়।।অর্জ্জুন হইতে শিশু মহা পরাক্রম।অবসাদ নাহিক তিলেক নাহি শ্রম।।সাবধান হইয়া সবাই কর রণ।এককালে সন্ধান করহ সপ্তজন।।কেহ কাট ধনুখান কেহ কাট গুণ।কেহ কাট রথ কেহ কাট অস্ত্র তূণ।।এ উপায় বিনা কিছু নাহি দেখি আর।কাল অগ্নি সম শিশু দেখ চমৎকার।।তবে সপ্তরথী পুনঃ বেড়িল কুমারে।এককালে সন্ধান করিল সাত বীরে।।তবে কর্ণ মহাবীর কোপে কম্পে তনু।অনেক সন্ধানে কাটি ফেলাইল ধনু।।আর ধনু নিল বীর চক্ষু পালটিতে।সে ধনু কাটেন কর্ণ গুণ নাহি দিতে।।যতবার ধরিয় ধনুক হাতে লয়।খণ্ড খণ্ড করি কাটে সূর্য্যের তনয়।।পুনর্ব্বার আর ধনু লয়ে গুণ দিল।দ্রোণের নন্দন তাহা কাটিয়া পাড়িল।।কবচ কাটিল দ্রোণ আর কাটে ধনু।দুঃশাসন কাটে রথ সারথির তনু।।কৃপাচার্য্য বাণেতে কাটিল শরাসন।দুর্য্যোধন কাটে অশ্ব মারি অস্ত্রগণ।।অস্ত্র ধনু কাটা গেল রথের সারথি।শূন্যহস্ত হৈল যেন মদমত্ত হাতী।।খড়গ লয়ে চর্ম্ম এড়ি রণ করে বীর।তাহাতে কাটিল সৈন্য কেহ নহে স্থির।।বড় বড় রথী মারে পর্ব্বতের চূড়া।খান খান করে রথ হয়ে যায় গুঁড়া।।শত শত হস্তী মারে পর্ব্বতের প্রায়।পদাতি পাইক মারে ধরণী লুটায়।।যোড়া যোড়া ঘোড়া মারে পক্ষীরাজ নাম।বিষম বালক বড় শমনের সম।।আকর্ণ সন্ধানে তবে কর্ণ এড়ে শর।সেই বাণে চর্ম্ম কাটি ফেলায় সত্বর।।কাটা চর্ম্ম আচ্ছাদন নাহি তাহা উড়ে।চতুর্দ্দিক হৈতে বাণ গায়ে আসি পড়ে।।শুধু অসি লইয়া সমর করে বীর।আসে পাশে সম্মূখে সৈন্যের কাটে শির।।বড় বড় বীর মারে বড় বড় রথী।নিবারণে অসক্ত হইল সেনাপতি।।হস্তী মারে সহস্রেক অতি তড়বড়ি।অসংখ্য পদাতি পড়ে যায় গড়াগড়ি।।শিশুর সমর দেখি অগ্নি হৈল কোপে।অশ্বথামা মহাবীর বাণ যোড়ে চাপে।।তিন বাণে কাটিয়া ফেলিল খাণ্ডাখান।অস্ত্রশূণ্য হইলেক না দেখি বিধান।।চর্ম্ম কাটা গেল, অস্ত্র অবশেষ খাণ্ডা।তাহা যদি কাটা গেল, ফুরাইল ভাণ্ডা।।কাহার বিরাম নাহি বলবান অরি।অসংখ্য রাজার সেনা গণিতে না পারি।।পঙ্গপাল পাতে জাল চারিদিকে ঢাকা।পলাইতে পথ নাহি কি করিবে একা।।নৃপতি অধর্ম্মী বড় অন্যায় সমর।ধরিয়া বালক মারে পাপিষ্ঠ পামর।।তবেত অর্জ্জুন সুতে ভয় হৈল মনে।বিপক্ষের হাতে আর রক্ষা নাহি রণে।।মুকুটীতে সেনা মারে, কর পদ ঘায়।চড় চাপড়েতে সবে দেয় যমালয়।।অস্ত্র রথ দুই হীন একেলা কুমার।চারিদিক হৈতে হয় অস্ত্র অবতার।।অবসাদ পেয়ে বীর ছাড়িল নিশ্বাস।আজি রক্ষা নাহি আর অবশ্য বিনাশ।।আচরিয়া অধর্ম্ম অন্যায় কৈল রণ।কেমনে ইহাতে রক্ষা পাইবে জীবন।।পিতা রণ করে সেনা নারায়ণী যথা।তিনি মাত্র না জানেন এতেঁক বারতা।।কৃষ্ণ মম মাতুল অর্জ্জুন মম বাপ।মৃত্যুকালে না দেখিনু এই মনস্তাপ।।আমার বৃত্তান্ত তাত গোবিন্দ মাতুল।শুনিলে অবশ্য হইতেন অনুকূল।।এতেক চিন্তিয়া শিশু হইল নিরাশ।উল্কার সমান যেন পড়িল নিশ্বাস।।হাতে করি লইল রথের চক্রদণ্ড।যমচক্র সম সেই বড়ই প্রচণ্ড।।হেন চক্রদণ্ড বীর হাতে করি লৈয়া।সর্ব্ব সৈন্যগণে বীর মারিলেন গিয়া।।চূর্ণ করে হয় হস্তী হাজারে হাজার।তুরঙ্গ মারিল কত সংখ্যা নাহি তার।।সহস্র সহস্র বীর বধিল বালক।নিবারিতে নাহি শক্তি জ্বলন্ত পাবক।।তবে কর্ণ পাঁচ বাণ পূরিয়া সন্ধান।চক্রদণ্ড কাটিয়া করিল খান খান।।চক্রদণ্ড গেল যদি চক্র নিল হাতে।দানবের যুদ্ধ যেন সহ জগন্নাথে।।তাহাতে অনেক সৈন্য শোয়াইল ক্ষিতি।লেখা জোখা নাহিক মারিল ঘোড়া হাতী।।চক্রহস্ত বিষ্ণু যেন অতি জ্যোতির্ম্ময়।তাহার সমান শোভা অবিমন্যু হয়।।তবে কর্ণ মহাবীর ধরিয়া ধনুক।তিন বাণ প্রহারিল যেন হুতভুক।।অভিমন্যু করে রণ রথচক্র হাতে।কাটিলেন কর্ণ তাহা তিন বাণাঘাতে।।শূণ্যহস্ত ব্যস্ত শিশু তাহে রথহীন।ভরসায় তবু যুঝে সংগ্রামে প্রবীণ।।পদাঘাত করাঘাত প্রহারেণ যারে।সেইক্ষণে তাহারে পাঠান যমঘরে।।মদমত্ত হস্তী যেন মহাভয়ঙ্কর।মুষ্ট্যাঘাতে রথ রথী বিনাশে বিস্তর।।হয় পড়ে নাহি হয় পরিমাণ যূথে।বড় বড় রথী পড়ে অযুতে অযুতে।।চারিদিকে বীরগণ বরিষয়ে বাণ।বাণে অঙ্গ হৈল যেন সজারু সমান।।রক্তে তনু তোলবোল বিকল শরীর।পড়িয়া ধরণী ধারা কহিছে রুধির।।অস্ত্রাঘাতে অভিমন্যু হৈল অচেতন।পুনঃ সপ্তরথী করে অস্ত্র বরিষণ।।হেনকালে আসে দুঃশাসনের নন্দন।গদা হাতে করি ধায় মহাক্রুদ্ধ মন।।অরুণ জিনিয়া রক্ত ঘূর্ণিত নয়ন।দৈবে যাহা করে তাহা কে করে খণ্ডন।।আর্জ্জুনি উপরে করে গদার প্রহার।দেখিয়া অমরগণ করে হাহাকার।।এমত অন্যায় করে দুষ্ট দুর্য্যোধন।এই পাপে হইবেক সবংশে নিধন।।গদার প্রহারে বীর পায় বড় মোহ।অভিমানে নয়নযুগলে বহে লোহ।।না দেখিল জনকে মাতুল কৃষ্ণরূপে।মৃত্যুকালে সেই নাম মনে মনে জপে।।সম্মূখ সমরে বীর ছাড়িল জীবন।চন্দ্রলোকে গমন করিল সেইক্ষণ।।রোদন করয়ে পাণ্ডবের সেনাগণ।শোকাকুল হইলেন ধর্ম্মের নন্দন।।দুর্য্যোধন হইলেন আনন্দিত মন।বাজাইল রণবাদ্য শত শত জন।।দামামা দগড় বাজে শত শত বাঁশী।রঙ্গ মোহরী বাজে শত শত কাঁসি।।শত শত জয়ঢাক বাজে জয়ঢোল।পৃথিবী যুড়িয়া যেন হৈল গণ্ডগোল।।বাজে শঙ্খ দুন্দুভি যে সুমধুর বীণা।ভেউরি ঝাঁঝরি বাজে নাহিক গণনা।।কুরুসৈন্যে হৈল মহাবাদ্য কোলাহল।ক্রন্দন করয়ে যত পাণ্ডবের দল।।যুধিষ্ঠির রাজা হইলেন অচেতন।রোদন করয়ে ভীম আদি যোদ্ধাগণ।।হেনকালে অস্তগত হৈল দিবাকর।কৌরব পাণ্ডব গেল যে যাহার ঘর।।দ্রোণপর্ব্ব সুধারস অভিমন্যু বধে।কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon