২১. হিড়িম্বা ও ঘটোৎকচের আগমনঘটোৎকচ মহাবীর হিড়িম্বা-তনয়।যজ্ঞের পাইয়া বার্ত্তা সানন্দ হৃদয়।।হিড়িম্বক-বনেতে তাহার অধিকার।তিন লক্ষ রাক্ষস তাহার পরিবার।।হয় হস্তী রথেতে করিয়া আরোহণ।যজ্ঞ হেতু নানারত্ন করিয়া সাজন।।নানাবাদ্যে উপনীত যজ্ঞের সদন।অদ্ভুত রাক্ষসী মায়া করিয়া রচন।।ধবল মাতঙ্গ-পৃষ্ঠে করি আরোহণ।ঐরাবত-পৃষ্ঠে যেন সহস্র-লোচন।।মাথায় মুকুট মণিরত্নেতে মণ্ডিত।সারি সারি শ্বেত ছত্র শোভে চতুর্ভিত।।কৃষ্ণ শ্বেত চামর ঢুলায় শত শত।পার্ব্বতীর হ্স্তী অশ্ব নানাবর্ণ রথ।।উত্তর-দ্বারেতে উপনীত ভীম-সুত।চতুর্দ্দিকে হুড়াহুড়ি দেখিয়া অদ্ভুত।।কেহ বলে, ইন্দ্র চন্দ্র কিম্বা প্রেতপতি।অরুণ বরুণ কিম্বা কোন মহামতি।।কেহ বলে, দেবরাজ এ যদি হইত।সহস্র-লোচন তবে অঙ্গেতে থাকিত।।কেহ বলে, এই যদি হইতে শমন।গজ না হইয়া হৈত মহিষ বাহন।।কেহ বলে, এই যদি হৈতে হুতাশন।তবে সে হইত ছাগ ইহার বাহন।।বরুণ হইলে হৈত শুশুক বাহন।সপ্ত-অশ্ব রথ হৈত হইলে তপন।।এত বলি লোক সব করিছে বিচার।গজ হৈতে নামিলেন হিড়িম্বা-কুমার।।প্রবেশ করিতে তারে নিবারে দ্বারেতে।জিজ্ঞাসিল কেবা তুমি, এলে কোথা হতে।।পরিচয় দেহ, বার্ত্তা জানাই রাজারে।রাজাজ্ঞা পাইলে পাবে যাইতে ভিতরে।।ঘটোৎকচ বলে, আমি ভীমের অঙ্গজ।হিড়িম্বার গর্ভে জন্ম, নাম ঘটোৎকচ।।এত শুনি অনিরুদ্ধ কৈল সম্ভাষণ।রহিতে উত্তম স্থান দিল ততক্ষণ।।সহদেব কহিলেন গোচরে রাজার।জননী সহিত এলো হিড়িম্বা-কুমার।।ধর্ম্ম আজ্ঞা করিলেন, আন শীঘ্রগতি।জননী পাঠাও তাঁর যথায় পার্ষতী।।যত দ্রব্য আনিয়াছে দেহ দুর্য্যোধনে।আজ্ঞা পেয়ে সহদেব গেল সেইক্ষণে।।হিড়িম্বারে পাঠাইল স্ত্রীগণ-ভিতর।ঘটোৎকচে লৈয়া গেল রাজার গোচর।।হিড়িম্বা দেখিয়া চমকিত অন্তঃপুরী।রূপেতে নিন্দিত যত স্বর্গ-বিদ্যাধরী।।অলঙ্কারে বিভূষিত আনন্দিত অঙ্গ।বিনামেঘে স্থির যেন তরিত তরঙ্গ।।কুন্তীর চরণে গিয়া প্রণাম করিল।আশীর্ব্বাদ করি কুন্তী বসিতে বলিল।।যথায় দ্রৌপদী ভদ্রা রত্ন-সিংহাসনে।হিড়িম্বা বসিল গিয়া তার মধ্যস্থানে।।অহঙ্কারে দ্রৌপদীরে সম্ভাষ না কৈল।দেখিয়া দ্রৌপদী দেবী অন্তরে কুপিল।।২২. দুই সতীনে ঝগড়াকৃষ্ণা বলে, নহে দূর খলের প্রকৃতি।আপনি প্রকাশ পায়, যার যেই রীতি।।কি আহার, কি আচার, কোথায় শয়ন।কোথায় থাকিস, তোর না জানি কারণ।।পূবের্ব শুনিয়াছি আমি তোর বিবরণ।তোর সহোদরে ভীম করিল নিধন।।ভ্রাতৃবৈরী জনে কেহ না দেখে নয়নে।তুই ত ভজিলি সেই ভ্রাতৃহন্তা জনে।।সতত ভ্রমিস্ তুই যথা লয় মন।একে কুপ্রবৃত্তি, তায় নাহিক বারণ।।সন্ধ্যানিয়া বেড়াস্ ভ্রমরী যেন মধু।সভামধ্যে বসিলি হইয়া কুলবধূ।।মর্য্যাদা থাকিতে কেন না যাস্ উঠিয়া।আপন সদৃশ স্থানে তুমি বৈস গিয়া।।কুপিল হিড়িম্বা দ্রৌপদীর বাক্য-জালে।দুষ্ট চক্ষু রক্তবর্ণ কৃষ্ণা প্রতি বলে।।অকারণে পাঞ্চালী করিস্ অহঙ্কার।পরে নিন্দ, নাহি দেখ ছিদ্র আপনার।।কুরূপ কুৎসিত লোকে নিন্দে ততক্ষণ।যতক্ষণ দর্পণেতে না দেখে বদন।।তোমার জনকে পূর্ব্বে, জানে সর্ব্বজনা।বান্ধিয়া আনিয়া পার্থ করিল লাঞ্ছনা।।যেই জন করিলেক এত অপমান।কোন্ লাজে হেন জনে দিল কন্যাদান।।আমি যে ভজিনু ভীমে দৈবের নির্ব্বন্ধ।পশ্চাৎ আমার ভাই করিলেক দ্বন্দ্ব।।সহিতে না পারি মৈল করিয়া সংগ্রাম।বীরধর্ম্ম করিল লোকেতে অনুপাম।।শত্রুরে যে ভজে, তারে বলি ক্লীব জন্ম।সংসারে বিখ্যাত তোর জনকের কর্ম্ম।।আমার সপত্নী তুমি, আমি না তোমার।তব বিবাহের আগে বিভা হৈল মোর।।একা রাজ্যভোগ কর হয়ে পাটরাণী।দিনেক দেখিয়া মোরে হৈলে অভিমানী।।পঞ্চজন কুন্তী ঠাকুরাণীর নন্দন।পঞ্চ পুত্রে আছি মোরা বধূ নয় জন।।ঐশ্বর্য্য ভুঞ্জহ অর্দ্ধ তুমি স্বতন্তরা।অষ্ট জনেতে অর্দ্ধ নাহি দেখি মোরা।।তথাপি আমারে দেখি অঙ্গ হৈল জরা।কি হেতু নিন্দহ মোরে বলি স্বতন্তরা।।পুত্র ঘটোৎকচ মোর বনের ঈশ্বর।পুত্র-গৃহ-বাসে কভু নহি স্বতন্তর।।বাল্যকালে কন্যা রক্ষা করয়ে জনকে।নারীকে যৌবনকালে স্বামী সদা রাখে।।শেষকালে পুত্র রাখে, আছে হেন রীত।বিশেষে আমার পুত্র পৃথিবী-পূজিত।।মাতুলের রাজ্যমধ্যে হইয়া ঈশ্বর।বাহুবলে শাসিল যতেক নিশাচর।।সুমেরু অবধি বৈসে যতেক রাক্ষস।একেশ্বর মোর পুত্র সবে কৈল বশ।।রাজসূয়-যজ্ঞবার্ত্তা লোকমুখে শুনি।যতেক রাক্ষসগণ করে কাণাকাণি।।রাক্ষসের বৈরী যত পাণ্ডু-পুত্রগণচল সবে যজ্ঞ নষ্ট করিব এখন।।বকের অপত্য ভ্রাতা আছে যত জন।মোর সহোদর হিড়িম্বের বন্ধুগণ।।এইত বিচার তার অনুক্ষণ করে।এ সকল বার্ত্তা আসে পুত্রের গোচরে।।চরমুখে জানিল কুচক্রী যত জন।যুদ্ধ করি সবাকারে করিল বন্ধন।।লৌহপাশে বন্দী করি রাখে কারাগারে।যাবৎ সারিয়া যজ্ঞ না আইসে ঘরে।।আর যত পৃথিবীতে বৈসে নিশাচর।সবারে জিনিয়া বলে আনিলেক কর।।সাক্ষাতে দেখহ কৃষ্ণা মোর পুত্র-প্রভা।মোর পুত্রে শোভিতেছে পাণ্ডবের সভা।।এতেক হিড়িম্বা যদি বলে কটূত্তর।কহিতে লাগিল কৃষ্ণা কুপিত অন্তর।।পুনঃ পুনঃ যতেক কহিস্ পুত্র কথা।পুত্রের করিস্ গর্ব্ব, খাও পুত্রমাথা।।কর্ণের একাঘ্নী অস্ত্র বজ্রের সমান।তার ঘাতে তোর পুত্র ত্যজিবে পরাণ।।পুত্রের শুনিয়া শাপ হিড়িম্বা কুপিল।ক্রুদ্ধা হয়ে হিড়িম্বা কৃষ্ণারে শাপ দিল।।আমার নির্দ্দোষ পুত্রে দিলে তুমি শাপ।তুমিও পুত্রের শোকে পাবে বড় তাপ।।যুদ্ধ করি মরে ক্ষত্র, যায় স্বর্গবাস।বিনা যুদ্ধে তোর পঞ্চপুত্র হৈবে নাশ।।এত বলি ক্রোধ করি হিড়িম্বা চলিল।আপনি উঠিয়া কুন্তী দোঁহে সান্ত্বাইল।।মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধু-প্রায়।পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম দাস গায়।।২৩. দক্ষিণ ও পূর্ব্বদ্বারে বিভীষণের অপমানপার্থমুখে বার্ত্তা পেয়ে লঙ্কার ঈশ্বর।হরষেতে রোমাঞ্চিত হৈল কলেবর।।যাঁর কথা অনুক্ষণ কহে মুনিগণ।বসুদেব-গৃহে জন্মিলেন নারায়ণ।।নিরন্তর চিত্ত ব্যগ্র যাঁরে দেখিবারে।আপনি ডাকেন তিনি দয়া করি মোরে।।সর্ব্বতত্ত্ব-অন্তর্য্যামী ভকত-বৎসল।অনুগত জনে দেন মনোমত ফল।।তাঁর অনুগত আমি, বুঝিনু কারণ।করিলেন নিজ ভক্ত বলিয়া স্মরণ।।এত ভাবি বিভীষণ হৃষ্টচিত্ত হৈয়ে।যতেক সুহৃদগণে বলিল ডাকিয়ে।।শীঘ্রগতি সজ্জা কর নিজ পরিবারে।আমার সহিত চল কৃষ্ণ ভেটিবারে।।দিব্য রত্ন আছে যত আমার ভাণ্ডারে।সব ধনরত্ন লহ, দিব দামোদরে।।হেরিব নয়নে আজি কমল-লোচন।জন্মাবধি-কৃত পাপ হৈবে বিমোচন।।এত বলি রথে আরোগিল লঙ্কেশ্বর।সঙ্গেতে চলিল লক্ষ লক্ষ নিশাচর।।বাজায় বিবিধ বাদ্য রাক্ষসী-বাজনা।শত শত শ্বেতচ্ছত্র, না যায় গণনা।।দক্ষিণ-দ্বারেতে উত্তরিল বিভীষণ।মিশামিশি হইল রাক্ষস নরগণ।।বিকৃত আকার সব নিশাচরগণ।বিস্ময় মানিয়া সবে করে নিরীক্ষণ।।দুই তিন মুখ কার, অশ্বপ্রায় মুখ।বক্রদন্ত দেখি, নাসা, চক্ষু যেন কূপ।।রথ হৈতে ভূমিতে নামিল বিভীষণ।যজ্ঞ স্থান দেখি হৈল বিস্ময়-বদন।।আদি অন্ত নাহি লোক চতুর্দ্দিকে বেড়ি।উচ্চ নীড় জল স্থল আছে লোক যুড়ি।।কোথায় দেখয়ে একপদ নরগণ।দীর্ঘ-কর্ণ দেখে কোথা বিবর্ণ বদন।।কোথায় কিরাত ম্লেচ্ছ বিকৃত-আকার।কৃষ্ণ অঙ্গ তাম্র কেশ দেখে কত আর।।কোথায় অমরগণ নানা ক্রীড়া করে।রাক্ষস দানব দৈত্য অনেক বিহরে।।সিদ্ধ সাধ্য ঋষি যোগী অনেক ব্রাহ্মণ।বিবিধ বাহনে কোথা যমদূতগণ।।কোটি অশ্ব কোটি হস্তী, কোটি কোটি রথ।স্থানে স্থানে নৃত্য গীত হয় অবিরত।।অপূর্ব্ব দেখিয়া রাজা ভাবে মনে-মন।এ হেন অদ্ভুত চক্ষে না দেখি কখন।।যে দেব দানবে বৈরী আছয়ে সদায়।হেন দেব-দানবেতে একত্র খেলায়।।যে ফণী গরুড়ে কভু নাহি হয় দেখা।একত্র খেলায় যেন ছিল পূর্ব্ব সখা।।রাক্ষস পাইলে নরে করয়ে ভক্ষণ।মনুষ্যের আজ্ঞা বহে নিমাচরগণ।।অদ্ভুত মানিয়া রাজা নাকে দিল হাত।জানিল এ সব মায়া করেন শ্রীনাথ।।দুইভিতে দেখে রাজা অনিমেষ আঁখি।তিন ভুবনের লোক এক ঠাঁই দেখি।।কে কারে আনিয়া দেয়, নাহিক নির্ব্বন্ধ।আসন, ভোজন, পানে সবার আনন্দ।।পরিবার-লোক তার রহাইয়া রথ।ঠেলাঠেলি পদব্রজে গেল কত পথ।।আগুসার গম্য নহে যাইতে কাহারে।থাকুক অন্যের কাজ পিপীলিকা নারে।।কত দূর আছে দ্বার, নাহি চলে দৃষ্টি।রাজগণ দাণ্ডাইয়া আছে পৃষ্ঠাপৃষ্ঠি।।দুইভিতে দ্বারিগণ মারিতেছে বাড়ি।একদৃষ্টে আছে সব দুইকর যুড়ি।।পথ না পাইয়া দাণ্ডাইল বিভীষণ।অন্তর্য্যামী সব জানিলেন নারায়ণ।।কে আইল, কে খাইল, কেবা নাহি পায়।প্রতিজনে জিজ্ঞাসা করেন যদুরায়।।দূরে থাকি নিরখিল রক্ষ-অধিপতি।দিব্যচক্ষে জানিলেন এই লক্ষ্মীপতি।।অষ্টাঙ্গ লুটায়ে স্তুতি করে করযোড়ে।বারিধারা নয়নেতে অবিশ্রান্ত পড়ে।।দেখিয়া নিকটে তার গিয়া নারায়ণ।দুই হাতে ধরি দেন প্রীতি-আলিঙ্গন।।স্তুতি করে বিভীষণ যুড়ি দুই কর।আনন্দেতে অশ্রুধারা বহে নিরন্তর।।নানারত্ন নিবেদিয়া ফেলে ভূমিতলে।পুনঃ পুনঃ ধরি পড়ে চরণ-কমলে।।যতেক আনিল রাজা বিবিধ রতন।গোবিন্দের আগে লয়ে দিল ততক্ষণ।।করযোড় করি বলে রাক্ষসের রাজ।আজ্ঞা কর জগন্নাথ করিব কি কাজ।।গোবিন্দ বলেন, আসিয়াছ যেই কাজে।মম সঙ্গে ভেটিবারে চল ধর্ম্মরাজে।।বিভীষণ বলে, কর্ম্ম সম্পন্ন হইল।তোমার পদারবিন্দ নয়ন দেখিল।।তোমার কমল-অঙ্গ দৃঢ় আলিঙ্গন।পিতামহ-বাঞ্ছিত যে অন্য কোন জন।।লক্ষ্মীর দুর্ল্লভ মোরে করিলা প্রসাদ।চিরকাল বিচ্ছেদের খণ্ডিল বিষাদ।।সম্পূর্ণ মানস হৈল, সিদ্ধ হৈল কাজ।এখন কি করি, আজ্ঞা কর দেবরাজ।।গোবিন্দ বলেন, যে করিল আবাহন।যার দূত-সঙ্গে পূর্ব্বে পাঠাইলা ধন।।যার নিমন্ত্রণে তুমি আসিলে হেথায়।চলহ ভেটাই সেই ঠাকুরে তোমায়।।তবে বিভীষণ কহে, বিনয় বচন।পাণ্ডবের যজ্ঞে অধিষ্ঠান নারায়ণ।।তব আজ্ঞা মানি পাণ্ডবে দিয়াছি কর।অন্য কি, তোমার নামে দিব কলেবর।।চিরকাল অদর্শনে আছি অপরাধী।আপনি ডাকিলা, হেন ঘটাইল বিধি।।বিশ্বের ঠাকুর তুমি, মনে হেন জানি।তোমার ঠাকুর আছে, আমি নাহি মানি।।যে হউক মোর প্রভু তোমা বিনা নাই।প্রয়োজন নাই মোর অন্য-জন-ঠাঁই।।গোবিন্দ বলেন, ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির।যাঁর দরশনে হয়ে নিষ্পাপ শরীর।।সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় সর্ব্ব-গুণধাম।এ তিন ভুবনে আছে খ্যাত যাঁর নাম।।প্রতাপে যাঁহার ইন্দ্র-আদি কর দিল।কর দিয়া ফণীন্দ্র শরণ আসি নিল।।উত্তরে উত্তর-কুরু, পূর্ব্বে জলনিধি।পশ্চিমেতে আমি, দক্ষিণেতে তোমা আদি।।নাহি দিল, না আসিল, নাহি হেন জন।সাক্ষাতে নয়নে তুমি দেখহ এখন।।দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ কপি ফণী।মনুষ্য আসিল, যত আছয়ে অবনী।।অষ্টাশী সহস্র দ্বিজ নিত্য গৃহে ভুঞ্জে।ত্রিষ ত্রিশ দাস সেবে এক এক দ্বিজে।।ঊর্দ্ধরেতা সহস্র-দশেক সদা সেবে।আছেন যতেক দ্বিজ, কে অন্ত করিবে।।স্থানে স্থানে রন্ধনাদি হয় অবিরাম।লক্ষ লক্ষ বিপ্রবর ভুঞ্জে এক স্থান।।এক লক্ষ দ্বিজ যবে করেন ভোজন।একবার শঙ্খনাদ হয় যে তখন।।হেনমতে মুহুমুর্হুঃ হয় শঙ্খধ্বনি।চতুর্দ্দিকে শঙ্করবে কিছুই না শুনি।।তিন পদ্ম অযুত মাতঙ্গ দীর্ঘদন্ত।তিন পদ্মাযুত রথ তুরঙ্গ অনন্ত।।লক্ষ নৃপতির পত্তি কে পারে গণিতে।চারি জাতি যতেক নিবসে পৃথিবীতে।।অর্দ্ধেক রন্ধনে ভুঞ্জে অর্দ্ধেক আমান্ন।কাহার শকতি তাহা করিবে বর্ণন।।এক জন অসন্তোষ নাহিক ইহাতে।খাও খাও লও লও, ধ্বনি চারিভিতে।।মনু-আদি যত হৈল পৃথিবীতে পতি।হেন কর্ম্ম করিবারে কাহার শকতি।।যত দূর পর্য্যন্ত নিবসে যত প্রাণী।হেন জন নাহি, যুধিষ্ঠিরে নাহি জানি।।স্মরণে সুমতি হয়, নিষ্পাপ দর্শনে।প্রণামে পরম গতি আমার সমানে।।হেন জনে নাহি জান তোমা হেন জন।শীঘ্রগতি চল, লৈয়া করাব দর্শন।।বিভীষণ বলে, প্রভু কহিলা প্রমাণ।মম নিবেদন কিছু কর অবধান।।পূর্ব্বে পিতামহ-মুখে শুনিয়াছি আমি।অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে তুমি সবাকার স্বামী।।ব্রহ্মা-ইন্দ্র-পদ তব কটাক্ষেতে হয়।এ কর্ম্ম অসাধ্য নহে তোমার সহায়।।মম পূর্ব্ব-বিবরণ জান গদাধর।তপস্যা করিয়া আমি মাগিলাম বর।।স্মরিব তোমার নাম, সেবিব তোমারে।তব পদ বিনা শির না নোয়াব কারে।।যথাই লইয়া যাব সংহতি যাইব।কদাচিত অন্য জনে মান্য না করিব।।এত বলি বিভীষণ চলিল সংহতি।পশ্চাদ্ভাগে বিভীষণ আগেতে শ্রীপতি।।চট চট শব্দেতে চৌদিকে পড়ে ছাট।গোবিন্দেরে নিরখিয়া ছাড়ি দিল বাট।।দ্বারের নিকটে উত্তরিল নারায়ণে।পশিতে সাত্যকি নিবারিল বিভীষণে।।গোবিন্দ বলেন, দ্বারে না রাখ ইহারে।স্বদেশে যাবেন শীঘ্র ভেটিয়া রাজারে।।সাত্যকি বলিল, প্রভু জানহ আপনি।আজ্ঞা বিনা যাইতে না পারে বজ্রপাণি।।হের দেখ জগন্নাথ দ্বারেতে বারিত।যত রাজ-রাজ্যেশ্বর থাকে যাম্যভিত।।মৎস্যদেশ-অধিপতি বিরাট নৃপতি।শূরসেন দন্তবক্র সুমিত্র প্রভৃতি।।অগণিত সৈন্য যাঁর ধনে নাহি অন্ত।কর লৈয়ে দ্বারে আছে মাসেক পর্য্যন্ত।।শ্রেণিমন্ত সুকুমার নীলধ্বজ রাজা।একপদ কলিঙ্গ, নৈষধ মহাতেজা।।কিষ্কিন্ধ্যা-ঈশ্বর দেখ সিন্ধুকূল-বাসী।গোশৃঙ্খ ভ্রমণ আর রুক্মী ঔড্রদেশী।।ইহা সবাকার সঙ্গে শত পঞ্চ শত।কোটি কোটি গজ বাজী, কোটি কোটি রথ।।নানারত্ন ধন নিজ পরিবার লৈয়া।দ্বারেতে আছেন দেখ বারিত হইয়া।।ত্রিশ-সহস্র নৃপতি আছে এই দ্বারে।জন কত রাজা মাত্র গিয়াছে ভিতরে।।পুরজিৎ-নামে রাজা পাণ্ডব-মাতুল।রাজ-আজ্ঞা পেয়ে তবে লইল নকুল।।তার সঙ্গে গেল জন কত নৃপবর।দেখিয়া বড়ই ক্রুদ্ধ হৈল বৃকোদর।।মাতুলে রাখিয়া আর যত রাজগণে।ধাক্কা মারি তাড়াইয়া দেন ততক্ষণে।।আজ্ঞা বিনা ছাড়িবারে নারি কদাচন।আজ্ঞা আনি লৈয়া যাহ রাজা বিভীষণ।।এত শুনি ক্রুদ্ধ হৈয়া গেলেন গোবিন্দ।দুই চক্ষু দেখি যেন রক্ত-অরবিন্দ।।তথা হৈতে চলি যান সহ লঙ্কাপতি।পূর্ব্বদ্বারে উপনীত আপনি শ্রীপতি।।মহাবীর ঘটোৎকচ হিড়িম্বা-কুমার।তিন রক্ষ রাক্ষসেতে রক্ষা করে দ্বার।।কৃষ্ণেরে দেখিয়া সবে পথ ছাড়ি দিল।বেত্র দিয়া বিভীষণে দ্বারে নিবারিল।।গোবিন্দ বলেন, ইনি লঙ্কার ঈশ্বর।ব্রহ্মার প্রপৌত্র, রাবণের সহোদর।।রাজ দরশন হেতু যাবেন ত্বরিত।হেন জনে দ্বারে রাখা না হয় উচিত।।ঘটোৎকচ বলে, শুন দেব চক্রপাণি।আমি কি করিব, তুমি জানহ আপনি।।বাইশ-সহস্র রাজা আছে এই দ্বারে।জন কত রাজা মাত্র গিয়াছে ভিতরে।।ব্রহ্মার প্রপৌত্র দেব অনেক এসেছে।দুই তিন মাস দ্বারে রহিমা গিয়াছে।।ব্রহ্মার প্রপৌত্র দেব কশ্যপ-কোঙর।মহা মহা নাগ শেষ বিষধর।।সহস্র-বদনশোভে নাগ-অধিকারী।এইখানে ছিল তেঁই দিন দুই চারি।।এই দেখ রাজগণ দাণ্ডাইয়া আছে।একদৃষ্টে বুকে হস্ত, নাহি চায় পাছে।।গিরিব্রজ-পুরোহিত জরাসন্ধ-সুত।জয়সেন মহারাজ বহু সৈন্যযুত।।নাব-কোটি রথ, নব-কোটি মত্ত হাতী।ষষ্ঠি-কোটি তুরঙ্গম, অসংখ্য পদাতি।।নানারত্ন আনিলেন নানা যানে করি।হস্তিনী গর্দ্দব উট শকট উপরি।।অহর্নিশি নৌকা বাহে, সংখ্যা নাহি জানি।যার নৌকা ত্রিশ ক্রোশ ঢাকে গঙ্গাপানি।।বিংশতি সহস্র রাজা যজ্ঞেতে আসিয়া।দ্বারাতে আছেন দেখ বারিত হইয়া।।শিশুপাল রাজা দেখ চেদির ঈশ্বর।যাহার সহিত পঞ্চ-শত নৃপবর।।তিন-কোটি আসোয়ার, গতি বায়ুবৎ।।নানা যান করি নানা রত্ন সঙ্গে লৈয়া।দ্বারেতে আছেন দেখ বারিত হইয়া।।দীর্ঘযজ্ঞ রাজা দেখ অযোধ্যার পতি।তিন-কোটি রথ সঙ্গে, তিন-কোটি হাতী।।সপ্ত-শত নরপতি সংহতি করিয়া।কর লৈয়া দ্বারে আছে বারিত হইয়া।।কাশীরাজ দেখ এই কাশীর ঈশ্বর।কোশলের রাজা বৃহদ্বল নৃপবর।।বহু রাজা সুপার্শ্ব কৌশিক শ্রুত রাজা।মদ্রসেন চন্দ্রসেন পার্শ্ব মহাতেজা।।সুবর্ণ সুমিত্র রাজা সুমুখ শম্বূক।মণিদন্ত দণ্ডধর নৃপতি মটুক।।পুণ্ডরীক বাসুদেব জরদগব আদি।করিল মেদিনী ব্যাপ্ত সমুদ্র অবধি।।এ সবার সঙ্গে রাজা শত সপ্তশত।লিখনে না যায় যত গজ বাজী রথ।।যে দেশে যে রত্ন জন্মে, তাহা কর লৈয়া।দ্বারেতে আছেন সব বারিত হইয়া।।বিনয়ে অনুরাধ করেন যেইজন।রাজারে জানাই গিয়া তাঁর বিবরণ।।তবে যদি ধর্ম্মরাজ দেন অনুমতি।সেই জন পায় তথা, করিবারে গতি।।মুহূর্ত্তেক রহি মাত্র দরশন পায়।শীঘ্রগতি পুনঃ আনি রাখয়ে হেথায়।।রাজার শ্বশুর দেখ দ্রুপদ নৃপতি।দিনেক রহিল পরিজনের সংহতি।।রাজা-আজ্ঞা পেয়ে তবে ছাড়ে দ্রুপদেরে।তার সঙ্গে রাজা কত পশিল ভিতরে।।সেই হেতু পিতা মোরে করিলেন ক্রোধ।শ্বশুরের কিছু না রাখিল উপরোধ।।বাহির করিয়া যে দিলেন রাজগণে।দ্বারিগণে বহু ক্রোধ করিয়াছে মনে।।পূর্ব্বে ইন্দ্রসেন ছিল এই দ্বারে দ্বারী।এই দোষে তাহারে দিলেন দূর করি।।রাখিলেন মোরে দ্বারে অনেক কহিয়া।আজ্ঞা বিনা ইন্দ্র এলে না দিবে ছাড়িয়া।।এই হেতু জগন্নাথ ভয় লাগে মনে।আজ্ঞা বিনা কিরূপেতে ছাড়ি বিভীষণে।।আনহ অগ্রেতে রাজ-অনুমতি হরি।জানাতে রাজারে আমি নাহি শক্তি ধরি।।নকুল আইসে কিম্বা অনুজ তাঁহার।বার্ত্তা জানাইতে এ দোঁহার অধিকার।।বুঝিয়া আপনি কর যে হয় বিচার।ক্ষণেক থাকহ, নহে যাহ অন্য দ্বার।।এত শুনি কৃষ্ণ তারে নিন্দিয়া অপার।ক্রোধ করি চলিলেন উত্তর দুয়ার।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।২৪. শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক চারিজন রাজার প্রাণদানবিভীষণে সঙ্গে করি যান গদাধর।কতদূরে দেখিলেন ভীম-অনুচর।।চারিজন নৃপতিরে করিয়া বন্ধন।কেশে ধরি কোপভরে যায় চারিজন।।জিজ্ঞাসেন মাধব, তোমরা কোন্ জন।এ চারি জনেরে কেন করিলে বন্ধন।।চরগণ বলে, মোরা ভীমের কিঙ্কর।দুষ্ট কর্ম্ম কৈল এই চারি নৃপবর।।শ্বেত আর লোহিত মণ্ডল নরপতি।অবধানে জগন্নাথ কর অবগতি।।এ দোঁহার দেশ প্রভু সমুদ্রের তীরে।পার্থ জিনি কর সহ আনিল দোঁহারে।।না বলিয়া এখন যাইতেছিল দেশে।অর্দ্ধপথ হৈতে মোরা আনি ধরি কেশে।।হের দেখ জগন্নাথ এই দুই জনে।উপহাস কৈল দুই দরিদ্র ব্রাহ্মণে।।এই হেতু চারিজনে আনিনু বান্ধিয়া।আজ্ঞা করিলেন ভীম শূলে দিতে নিয়া।।এত শুনি কৃষ্ণ ফিরাইল চারিজনে।বৃকোদর কোথা জিজ্ঞাসেন দূতগণে।।আগে আগে যায় দূত, পিছে গদাধর।কতদূরে দেখিলেন আসে বৃকোদর।।এক লক্ষ রথী সহ ভ্রমে সর্ব্বস্থল।সবাকার তত্ত্ব করে ভীম মহাবল।।ভীমের নিকটে উত্তরিল নারায়ণ।কহিলেন মুক্ত করি দেহ চারিজন।।কর্ম্ম হেতু এ সবারে কৈলে অবহান।অনাদর এখন করহ কি কারণ।।কর্ম্ম যদি করিবে হইয়া মহাতেজা।ক্ষুদ্র লোকে নিমন্ত্রিলে করিবেক পূজা।।দুষ্ট শিষ্ট আসিয়াছে বহু কর্ম্মস্থলে।কর্ম্মে বহু বিঘ্ন হয় ক্ষমা না করিলে।।বৃকোদর বলে, শুন দেবকী-নন্দন।দোষমত শাস্তি যদি না পায় দুর্জ্জন।।আর সবে ক্রমে ক্রমে সেই পথ লয়।কহ ইথে কর্ম্ম পূর্ণ কেমনেতে হয়।।দুষ্টে ক্ষমা করিতে না পারি কদাচন।দুষ্টাচারী নাহি ছাড়ে নিজ দুষ্টপণ।।দুষ্ট জনে নিজ তেজ যদি না দেখাবে।অবজ্ঞা করয়ে আর কর্ম্ম ধ্বংস হবে।।ইহার সহিত পূর্ব্বে পরিচয় কোথা।বাহুবলে যত দেখ আসিয়াছে হেথা।।সুকর্ম্ম লভয়ে যদি শান্তি আচরণে।ক্রমে ক্রমে সুকর্ম্ম লভিবে কিত দিনে।।পুনশ্চ কহেন কৃষ্ণ কমল-লোচন।শুন শুন ভীমসেন আমার বচন।।তোমার শান্তির শব্দে ত্রৈলোক্য পূরিল।সেই হেতু তিন লোক একত্র মিলিল।।শান্তি না আচরি তুমি এ কর্ম্ম করিলে।কহ ভীম যজ্ঞ পূর্ণ হইবে কি ভালে।।অন্য কর্ম্ম নহে, এই রাজসূয় সত্র।এক লক্ষ রাজা আসি হয়েছে একত্র।।লক্ষ লক্ষ জন মধ্যে আছে ভালমন্দ।একত্রিত হয়ে যদি সবে করে দ্বন্দ্ব।।কহ মোরে তখন কি উপায় করিবে।প্রমাদ ঘটিবে আর যজ্ঞ নষ্ট হৈবে।।পৃথিবীর লোক সব করিলে বিরোধ।কত কত জনে তুমি করিবা প্রবোধ।।পাতালে রহিল গিয়া পার্থ ধনুর্দ্ধর।দ্বন্দ্ব করিবারে তুমি আছ একেশ্বর।।কৃষ্ণের বচন শুনি বলে বৃকোদর।তব যোগ্য কথা নহে দেব দামোদর।।এক লক্ষ রাজা যে বলিলা নারায়ণ।প্রত্যক্ষেতে দেখিলাম আমি সর্ব্বজন।।অজাযূথ লাগে যেন ব্যাঘ্রের নয়নে।সেইমত রাজগণ লাগে মম মনে।।দ্বন্দ্ব করিবারে একদিকে সবে হয়।নিবারিব এক আমি কিবা তাহে ভয়।।সসৈন্যে আগত এক লক্ষ নৃপবর।মুহূর্ত্তেক দলিবারে পারি একেশ্বর।।মনুষ্য কি গণি, যদি তিন লোক হয়।একেশ্বর সবারে করিব পরাজয়।।যার জয় ইচ্ছে দেব তোমা হেন জনে।তারে পরাজয় করে নাহি ত্রিভুবনে।।গোবিন্দ বলেন, সব সম্ভবে তোমারে।তোমা সহ বিরোধ করিতে কেবা পারে।।ইহা সবাকারে ছাড় আমার বচনে।বহু অপমান পাইয়াছে দুষ্টগণে।।এত বলি মুক্ত করি দেন চারিজনে।তথা হৈতে যান চলি লৈয়া বিভীষণে।।মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।কাশীকহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।।২৫. উত্তর ও পশ্চিম দ্বারে বিভীষণের অপমানযাইতে যাইতে কৃষ্ণ কন বিভীষণে।বহু রাজা দেখিয়াছ, শুনেছ শ্রবণে।।এমত সম্পদ কি পেয়েছে কোনজনে।আমা হেন জনে রাখে যার দ্বারিগণে।।তিন ভুবনের লোক একত্র মিলিল।ইন্দ্র-আদি করি সবে যাঁরে কর দিল।।বিভীষণ বলে, দেব এ নহে অদ্ভুত।ইহা হৈতে রাজসূয় হয়েছে বহুত।।হরিশ্চন্দ্র মহারাজ এ যজ্ঞ করিল।চৌদ্দ ভুবনের লোক একত্র হইল।।আর আর যত রাজা পৃথিবীতে ছিল।ইন্দ্র-আদি দেব জিনি নানা যজ্ঞ কৈল।।একমাত্র পাণ্ডবের বাখানি বিশেষ।আপনি এতেক স্নেহ কর হৃষীকেশ।।ব্রহ্মা আদি ধ্যায় প্রভু তোমা দেখিবারে।এ বড় আশ্চর্য্য, তুমি ভ্রম দ্বারে দ্বারে।।তোমার চরিত্র প্রভু কি বুঝিতে পারি।নিমিষে প্রলয় কর সৃষ্টি সংহারি।।ব্রহ্মপদ কীট প্রভু তোমার সমান।যারে যাহা কর, তাহা কে করিবে আন।।ইন্দ্র-আদি-পদ প্রভু না করি গণন।তব পদে ভক্তি যার সেই মহাজন।।ভক্তিতে পাণ্ডব বশ করিয়াছে তোমা।তেঁই দ্বারে দ্বারী রাখে, তারে কর ক্ষমা।।কি কারণে জগন্নাথ এত পর্য্যটন।দ্বারে দ্বারে ভ্রম প্রভু, কোন্ প্রয়োজন।।দৈবেতে এ দ্বারিগণ না ছাড়ে আমারে।মম প্রয়োজন কিছু নাহিক ভিতরে।।মানস হইল পূর্ণ, সিদ্ধ হৈল কার্য্য।তব আজ্ঞা হইল প্রভু, যাই নিজ রাজ্য।।বিভীষণ-বাক্য শুনি বলে চক্রধর।কত আর তোমারে কহিব লঙ্কেশ্বর।।সর্ব্ব ধর্ম্ম জান তুমি বিচারে পণ্ডিত।তুমি হেন কথা কহ, না হয় উচিত।।নিমন্ত্রণ করিল যে, তারে না ভেটিয়া।যদি যাহ, জিজ্ঞাসিলে কি বলিব গিয়া।।তব আগমন এবে জ্ঞাত হৈল।লোকে বলিবেক, সেই কৃষ্ণ ভেটি গেল।।হেন অপকীর্ত্তি মম চাহ কি কারণ।ক্ষণেক রহিয়া কর রাজ দরশন।।এইরূপে পথে দোঁহে কথোপকথনে।উত্তর-দুয়ারে উত্তরিলেন দুজনে।।উত্তর দুয়ারে দ্বারী কামের নন্দন।গোবিন্দে দেখিয়া আসি করিল বন্দন।।শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যাই রাজার গোচর।ধর্ম্মরাজে ভেটাইব রাক্ষস-ঈশ্বর।।অনিরুদ্ধ বলে, দেব রহ মুহূর্ত্তেকে।এখনি মাদ্রীর পুত্র হেথা আসিবেক।।তাঁর হাতে জানাইব রাজার গোচর।আজ্ঞা হৈল লয়ে যাহ রাক্ষস-ঈশ্বর।।গোবিন্দ বলেন, তুমি না জান ইহারে।ক্ষণেক উচিত নহে রাখিতে দুয়ারে।।রাবণের সহোদর লঙ্কা-অধিপতি।রাক্ষসের রাজা যে ব্রহ্মার হয় নাতি।।এত শুনি হাসি বলে কামের নন্দন।কেন হেন কহ দেব জানিয়া কারণ।।প্রত্যক্ষ দেখহ দেব যতেক নৃপতি।অনেক দিবস হৈল দ্বারে কৈল স্থিতি।।প্রাগ্ দেশ-অধিপতি রাজা ভগদত্ত।নব-কোটি রথ সঙ্গে, কোটি গজ মত্ত।।বিংশতি -সহস্র রাজা ইহার সংহতি।ঐরাবত সম যার অযুতের হাতী।।নানারত্ন কর দেখ সঙ্গেতে করিয়া।বহুদিন দ্বারে আছে বারিত হইয়া।।বাহ্লীক বৃহন্ত আর সুদেব কুন্তল।সিংহরাজ সুশর্ম্মা রোহিত বৃহদ্বল।।কামদেব কামেশ্বর রাজা কামসিন্ধু।ত্রিগর্ত্ত দ্বিরদ শিব মহারাজ সিন্ধু।।এ সবার সঙ্গে রাজা শত পঞ্চশত।ত্রিশ-কোটি মত্ত হস্তী ত্রিশ-কোটি রথ।।যেই দেশে নাহি শক্তি বিহঙ্গ যাইতে।সে সকল ভূপে দেব দেখহ সাক্ষাতে।।নানারত্ন কর লৈয়ে দ্বারে বসি আছে।বৎসর অবধি হৈল কেহ নাহি পুছে।।পুত্র-পৌত্র ব্রহ্মার এসেছে কত জন।প্রপৌত্র আইল যত, কে করে গণন।।ইন্দ্র চন্দ্র জলেশ কৃতান্ত দিনকর।ব্রহ্ম-ঋষি দেব-ঋষি আইল বিস্তর।।চিত্ররথ গন্ধর্ব্ব তুম্বুরু হাহা হুহু।বিশ্বাবসু আদি সহ বিদ্যাধর বহু।।যক্ষরাজ সহ এল, কত লব নাম।আসিয়াছে, আসিতেছে, নাহিক বিরাম।।দুই এক দিন সবে দ্বারে রহি গেছে।রাজ-আজ্ঞা-মাত্র সবে দুই এক আছে।।বিনা আজ্ঞা ছাড়ি দিলে দুঃখ পাই পাছে।রাজদ্রোহী কর্ম্মে দেব বহু বিঘ্ন আছে।।দোষ গুণ বুঝিতে ভীমের অধিকার।ভীম ক্রোধ করিলে নাহিক প্রতিকার।।বুঝিয়া করহ দেব যে হয় বিচার।কি শক্তি আমার, আজ্ঞা বিনা ছাড়ি দ্বার।।এত শুনি কৃষ্ণ তারে নিন্দিয়া অপার।ক্রোধ করি চলিলেন পশ্চিম-দুয়ার।।গোবিন্দ বলেন, রাজা দেখ বিদ্যমান।পৌত্র হৈয়ে নাহি মারে করিল সম্মান।।নাহিক উহার দোষ কর্ম্ম এইরূপে।ইন্দ্র যম ভয় করে ভীমের প্রতাপে।।অল্প দোষে দেয় দণ্ড, ক্রোধ নিরন্তর।শ্রুতিমাত্র দেয় শাস্তি, নাহি পরাপর।।চলহ পশ্চিম-দ্বারে আছে দুর্য্যোধন।আমা দেখি কদাচ না করিবে বারণ।।আর কহি বিভীষণ, না হও বিস্মৃতি।যখন করিব দৃষ্টি ধর্ম্ম-নরপতি।।ভূমিষ্ঠ হইয়া তুমি প্রণাম করিবে।নৃপতির আজ্ঞা পেলে তখনি উঠিবে।।বিভাষণ বলে, প্রভু নহে কদাচন।নিবেদন করিয়াছি মম বিবরণ।।পূর্ব্ব হৈতে তব পদে বিক্রীত শরীর।তব পদ বিনা অন্যে না নোয়াব শির।।এত শুনি গোবিন্দ ভাবেন মনে মনে।করিয়াছি কুকর্ম্ম আনিয়া বিভীষণে।।বিভীষণ যদি দণ্ডবৎ না করয়।সভাতে পাইবে লজ্জা ধর্ম্মের তনয়।।এত চিন্তি জগন্নাথ করেন বিচার।ব্রহ্মা আদি করাব নত, এবা কোন্ ছার।।যজ্ঞারম্ভ কৈল রাজা আমার বচনে।আমি যজ্ঞেশ্বর বলি জানে সর্ব্বজনে।।ব্রহ্মা আদি কৈল যজ্ঞ ব্রহ্মাণ্ড ভিতর।কোন যজ্ঞ নাহি হবে এ যজ্ঞ উপর।।এত চিন্তি জগন্নাথ সহ বিভীষণ।পশ্চিম-দ্বারেতে যান যথা দুর্য্যোধন।।দুর্য্যোধন নৃপতির দুই অধিকার।দ্রব্যের ভাণ্ডারী আর রক্ষা করে দ্বার।।অসংখ্য ভাণ্ডার যেন শোভে গিরিবর।কনক রজত মুক্তা প্রবাল পাথর।।অমূল্য কীটজ চীর লোমজ বসন।কস্তুরী দশন হস্তী শৃঙ্গী অগণন।।চতুর্দ্দিকে হইতে আসিছে ঘনে ঘন।আষাঢ় শ্রাবণে যেন হয় বরিষণ।।দরিদ্র ভিক্ষুক দ্বিজ ভ্ট্ট আদি যত।বিদুরের সম্মত দিতেছে অনুব্রত।।যত দ্রব্য আসে, তত দিতেছে সকল।পুনঃ পুনঃ আসে যেন জোয়ারেরজল।।কত জনে কত দেয়, নাহি পরিমাণ।অদরিদ্রা কৈল পৃথ্বী দিয়া বহু দান।।ঊনশত ভাই সহ নিজ পরিবার।দুর্য্যোধন দ্বারী রাখে পশ্চিম দুয়ার।।গোবিন্দেরে নিরখিয়া বলে দুর্য্যোধন।কহ কোন্ হেতু দাণ্ডাইয়া নারায়ণ।।গোবিন্দ বলেন, ইনি লঙ্কার ঈশ্বর।যাইতে নিবারে কেন তোমার কিঙ্কর।।দুর্য্যোধন বলে, কৃষ্ণ নাহি তার দোষ।আপনি জানহ প্রভু ভীমের আক্রোশ।।হেথা দেখ জগন্নাথ দ্বারেতে আছয়।পশ্চিম-দিকেতে বৈসে যত রাজচয়।।শিরসি দেশের রাজা দেখহ রোহিত।শতসংখ্য রাজা আছে ইহার সহিত।।পঞ্চকোটি হস্তী সঙ্গে দশ-কোটি রথ।যার সৈন্য যুড়িয়াছে দশ ক্রোশ পথ।।নানা যান করিয়া বিবিধ রত্ন লৈয়া।দ্বারেতে আছয়ে সব বারিত হইয়া।।মালব-ঈশ্বর শিবি পুষ্কর নৃপতি।পঞ্চশত রাজা আছে দোঁহার সংহতি।।এক কোটি রথ আর গজ কোটি সাত।কত অশ্ব আছে কেবা করে দৃষ্টিপাত।।নানাবর্ণ রত্ন লৈয়ে দুয়ারেতে আছে।মাস দুই তিন হৈল কেহ নাহি পুছে।।দ্বারপাল রাজা আর রাজা বৃন্দারক।প্রতিবিন্ধ্যা নরপতি অমর কণ্টক।।এ সবার সঙ্গে রাজা শত পঞ্চশত।লিখনে না যায় যত জগ বাজী রথ।।চারি জাতি প্রজা এল নানা কর লৈয়া।দ্বারেতে আছয়ে সবে বারিত হইয়া।।চিত্রসেন রাজা দেখ গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।ত্রিশ-কোটি রথ ত্রিশ-কোটি যে কুঞ্জর।।নানারত্ন আনিল নাহিক তার ওর।এ সবার পাছে যেন দাণ্ডাইযা চোর।।বসুদেব সহ আসে যত যদুবীর।শল্য মদ্রেশ্বের যে মাতুল নৃপতির।।আজ্ঞা পেয়ে মাদ্রীপুত্র লইল ভিতরে।তথাপিও দুই দিন রহিলেন দ্বারে।।আসিবা মাত্রেতে লয়ে চাহ যাইবার।আজ্ঞা বিনা কিরূপেতে দ্বারী ছাড় দ্বার।।এইক্ষণে আসিবেক মাদ্রীর নন্দন।ক্ষণমাত্র হেথায় বৈসহ নারায়ণ।।এত বলি দুর্য্যোধন দিল সিংহাসনে।দুই সিংহাসনে বসিলেন দুই জন।।কে বুঝিতে পারে জগন্নাথের চরিত।অখিল ব্রহ্মাণ্ড যাঁর মায়ায় মোহিত।।ধন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ন, জন্ম শুভক্ষণে।হেন প্রভু বশ কৈল আপনার গুণে।।ধন্য ধন্য অশ্বমেধ কৈল শত শত।কঠোর তপস্যা, রাজা ধন্য কৈল কত।।কেহ যজ্ঞ ব্রত করে বৈভব কারণ।ইন্দ্রপদ বাঞ্ছে কেহ কুবেরের ধন।।তিন লোক মধ্যে ইন্দ্রদ্যুন্নেরে বাখানি।কত ইন্দ্রপদ যার কর্ম্মের নিছনি।।যাহার যশের গুণে পূরিল সংসার।ক্ষিতিমধ্যে খণ্ডাইল যম-অধিকার।।যাবৎ ব্রহ্মাণ্ড আর যাবৎ ধরণী।করিল অদ্ভুত কীর্ত্তি নিস্তারিতে প্রাণী।।গোহত্যা স্ত্রীহত্যা আদি করে যে নারকী।অবহেলে স্বর্গে যায় কৃষ্ণ-মুখ দেখি।।জন্মে জন্মে কাশী আদি নানাতীর্থ সেবে।তপঃক্লেশ যজ্ঞ ব্রত সদা করে যবে।।পঞ্চ মহাপাতকী শ্রীমুখ যদি দেখে।সে কোটি কল্পের পাপ শরীরে না থাকে।।শ্রীমুখ না দেখে যেবা থাকিতে নয়ন।সংসারেতে নর-জন্ম তার অকারণ।।জগন্নাথ না দেখে যেবা থাকিতে নয়ন।সংসারেতে নর-জন্ম তার অকারণ।।জগন্নাথ-মুখপদ্ম যে করে দর্শন।জগন্নাথ নাম যেবা করয়ে স্মরণ।।পৃথিবীর মধ্যে তাঁর সফল জীবন।কাশীরাম প্রণময় তাঁহার চরণ।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon