মহাভারত:বিরাটপর্ব-০৪৬-০৪৯

৪৬. বিরাট রাজার নিকট
উত্তরের যুদ্ধ-বৃত্তান্ত বর্ণন
তবে মৎস্য-নরপতি চাহিয়া কুমার।
জিজ্ঞাসিল কহ তাত যুদ্ধ-সমাচার।।
যে কর্ম্ম করিলে তুমি অদ্ভুত সংসারে।
দুর্দ্ধর্ষ যে কুরুসৈন্য জিনিলে সমরে।।
তোমার সমান পুত্র নহিল নহিবে।
তোমার মহিমা যশ সংসারে ঘোষিবে।।
কহ তাত কিরূপে জিনিলে কুরুগণে।
কর্ণ মহাবীর বলি বিখ্যাত ভুবনে।।
দেব দৈত্য অগ্রে যার যুদ্ধে নহে স্থির।
কিরূপে জিনিলে হেন কুরু মহাবীর।।
দ্রোণ গুরু বলি যিনি প্রতাপে অপার।
ক্রোধ কৈলে জিনিবারে পারয়ে সংসার।।
কালাগ্নি সমান শিক্ষা ভীষ্ম মহাবীর।
অশ্বত্থামা কৃপাচার্য্য দুর্জ্জয় শরীর।।
কিরূপে করিলে যুদ্ধ তা সবার সহ।
প্রত্যক্ষে সে সব কথা শুনি, মোরে কহ।।
অদ্ভুত লাগিছে মোর এই সব কথা।
যেই কুরুসৈন্যে আছে মহা মহা-রথা।।
ব্যাঘ্রমুখ হৈতে যেন আমিষ আনিলে।
সেইমত কুরু হৈতে গোধন ছাড়ালে।।
ধন্য ধন্য পুত্র তুমি কুলের দীপক।
বড় ভাগ্যবান আমি, তোমার জনক।।
উত্তর বলিল, তাত কর অবধান।
যখন সমরে আমি করিনু প্রয়াণ।।
বহু সৈন্য দেখি চিত্তে লাগে মোর ভয়।
হেনকালে আসে এক দেবের তনয়।।
আপনি হইয়া রথী করিলেক রণ।
কুরুবল রণে সেই জিনিল তখন।।
অদ্ভুত তাঁহার কর্ম্ম, নাহি দেখি শুনি।
এক মুখে কি কহিব তাঁহার কাহিনী।।
লণ্ড ভণ্ড করিলেক অপ্রমিত সেনা।
যতেক পড়িল তাত কে করে গণনা।।
দয়া করি তোমা আমা সঙ্কটেতে তারি।
কুরুসৈন্য হৈতে গবী দিলেন উদ্ধারি।।
নাহি জিনিয়াছি আমি কুরুসৈন্যগণ।
নাহি মুক্ত করিয়াছি একটি গোধন।।
শুনিয়া বিরাট কহে, কহ পুত্র মোরে।
কি হেতু সে দেবপুত্র রাখিল তোমারে।।
কোথায় নিবাস তাঁর, গেল কোথাকারে।
দেখিতে কি কভু নাহি পাব আমি তাঁরে।।
উত্তর বলিল, তাত আছে এই দেশে।
আজি কিম্বা কালি কিম্বা তৃতীয় দিবসে।।
হেথায় আসিবে সেই দেবের নন্দন।
শুনিয়া বিরাট হন আনন্দিত মন।।
অন্তঃপুরে যান পার্থ যথা কন্যাগণ।
উত্তরাকে দিল যত আনিল বসন।।
যার যে নিবাস-স্থানে নিবসিল গিয়া।
কাশীদাস কহে কৃষ্ণপদ ধেয়াইয়া।।
যতনে ধেয়ায় সাধু যাঁরে নিরবধি।
যাদব-কুলেতে যেই দয়াময় নিধি।।
জলধর-কান্তি মুখ-চন্দ্র অখণ্ডিত।
অমল কমল চক্ষু অরুণ-নিন্দিত।।
মকর কুণ্ডল কর্ণে মস্তকে মুকুট।
বান্ধুলি বরণ ওষ্ঠাধর করপুট।।
যে মুখ দর্শনে জন্ম জন্ম পাপ খণ্ডে।
জরা-শোক ভয় খণ্ডে আর যমদণ্ডে।।
৪৭. বিরাট-সিংহাসন পার্ষতী
সহ যুধিষ্ঠিরের উপবেশন
রজনীতে পাণ্ডবেরা মিলিল ছজন।
জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুনেরে ধর্ম্মের নন্দন।।
শুনিলাম, বহু সৈন্য যুদ্ধেতে মারিলে।
পরকার্য্যে কেন এত জ্ঞাতিবধ কৈলে।।
অর্জ্জুন বলেন, অবধান নরনাথ।
দুর্য্যোধন-দোষে সৈন্য হইল নিপাত।।
এতেক দুর্গতি পেয়ে শান্ত নাহি হয়।
নাহি দিবে রাজ্য, রণ করিবে নিশ্চয়।।
যুধিষ্ঠির কহেন, কি প্রকারে জানিলে।
না দিবে সে রাজ্য তোমা, কোন্ জন বলে।।
পার্থ বলে, অস্ত্রমুখে জিজ্ঞাসিনু দ্রোণে।
না করিবে সন্ধি, জানি দ্রোণের বচনে।।
শুনিয়া ধর্ম্মের পুত্র বিষণ্ন বদন।
এ কর্ম্ম করিলে ভাই কিসের কারণ।।
না জানি অজ্ঞাত শেষ কত দিনে হয়।
ইতিমধ্যে কি প্রকারে দিলে পরিচয়।।
কহ সহদেব শীঘ্র গণিয়া পঞ্জিকা।
দ্বাদশ বৎসর শেষ অজ্ঞাতের লেখা।।
অজ্ঞাত বৎসর শেষ পদি কিছু থাকে।
তবে মোরা পুনরায় যাব অরণ্যেতে।।
সহদেব বলে, প্রভু হইয়াছে শেষ।
চতুর্দ্দশ বৎসরের বিংশতি প্রবেশ।।
নিয়ম হইল পূর্ণ পূর্ব্বের নির্ণিত।
তব আজ্ঞা লৈতে আছে হইতে উদিত।।
যুধিষ্ঠির মহানন্দে কহে সহদেবে।
শুভ দিনে সমুদিত হবে ভাই কবে।।
সহদেব কহিলেন করিয়া গণন।
আষাঢ় পূর্ণিমা তিথি দিন শুভক্ষণ।।
নক্ষত্র উত্তরাষাঢ়া, ইন্দ্র নামে যোগ।
বৃহস্পতি বাসরেতে, মাস অর্দ্ধ ভোগ।।
সহদেব বাক্যে ধর্ম্ম হলেন সর্ম্মত।
যথাস্থানে যান সবে, নিশা অর্দ্ধগত।।
তদন্তরে তাহার তৃতীয় দিনান্তরে।
পূণ্য তীর্থে স্নান করি পঞ্চ সহোদরে।।
দিব্য বস্ত্র অলঙ্কার করেন ভূষণ।
মুকুট কুণ্ডল হার অঙ্গদ কঙ্কণ।।
বিরাট রাজার রাজ-সিংহাসনোপরি।
শুভ লগ্ন বুঝি তবে বসে ধর্ম্মকারী।।
ভস্ম হৈতে মুক্ত যেন হৈল হুতাশন।
মেঘ হতে মুক্ত যেন হইল তপন।।
বামভাগে বসিলেন দ্রুপদ-দুহিতা।
দক্ষিণেতে বৃকোদর ধরে দণ্ডছাতা।।
করযোড়ে পুরোভাগে রহে ধনঞ্জয়।
চামর ঢুলায় দুই মাদ্রীর তনয়।।
ইন্দ্রকে বেড়িয়া যেন শোভে দেবগণ।
ভ্রাতৃসহ যুধিষ্ঠির শোভেন তেমন।।
সভাতে রাজার যত সভাপাল ছিল।
দেখি শীঘ্র গিয়া মৎস্যরাজারে কহিল।।
শুনিয়া বিরাট রাজা ধায় ক্রোধভরে।
সুপার্শক মদিরাক্ষ সঙ্গে সহোদরে।।
শ্বেত শঙ্খ আসে দোঁহে রাজার নন্দন।
কুমার উত্তর শুনি ধায় সেইক্ষণ।।
যত মন্ত্রী সেনাপতি পাত্র ভৃত্যগণ।
বার্ত্তা শুনি ধেয়ে সবে আসিল তখন।।
পাণ্ডবেরে দেখি সবে বিস্ময়ে মগন।
পঞ্চ গোটা ইন্দ্র যেন হয়েছে শোভন।।
জলদগ্নি সম তেজ পাণ্ডবে দেখিয়া।
মুহূর্ত্তেক রহে রাজা স্তম্ভিত হইয়া।।
উত্তর পড়িল কত দূরে ভূমিতলে।
কৃতাঞ্জলি প্রণমিয়া স্তুতিবাক্য বলে।।
দেখিয়া বিরাট রাজা কুপিত অন্তর।
কঙ্কেরে চাহিয়া বলে কর্কশ উত্তর।।
হে কঙ্ক, কি হেতু তব হেন ব্যবহার।
কিমতে বসিলে তুমি আসনে আমার।।
ধর্ম্মজ্ঞ সুবুদ্ধি বলি বসাই নিকটে।
কোন্ বুদ্ধে বৈস আসি মোর রাজপাটে।।
প্রথমে বলিলে তুমি, আমি ব্রহ্মচারী।
ভূমিতে শয়ন করি, ফলমূলাহারী।।
কোন দ্রব্যে নাহি মম কিছু অভিলাষ।
এখন আপন ধর্ম্ম করিলে প্রকাশ।।
অনুগ্রহ করি তোমা করি সভাসদ।
এবে ইচ্ছা হৈল মোর নিতে রাজপদ।।
না বুঝিয়া বসিলে অবিদ্যমানে মোর।
বিদ্যমানে আমার সম্ভ্রম নাহি তোর।।
আর দেখ মহাশ্চর্য্য সব সভাজনে।
সৈরিন্ধ্রীরে বসাইলে আপনার বামে।।
মোর ভয় নাহি কিছু, নাহি লোকলাজ।
পরস্ত্রী লইয়া বসে রাজসভা মাঝ।।
কহ বৃহন্নলা, কেন অন্তঃপুর ছাড়ি।
কঙ্কের সম্মুখে দাণ্ডাইলে কর যুড়ি।।
হে বল্লব সূপকার তোমার কি কথা।
কার বাক্যে কঙ্কোপরে ধর তুমি ছাতা।।
অশ্বপাল গোপালের কিবা অভিপ্রায়।
এ দোঁহে কঙ্কেরে কেন ‍চামর ঢুলায়।।
হে সৈরিন্ধ্রী, জানিলাম তোমার চরিত্র।
গন্ধর্ব্বের ভার্য্যা তুমি পরম পবিত্র।।
এখন কঙ্কের সহ হেন ব্যবহার।
নাহি লজ্জা ভয় কিছু অগ্রেতে আমার।।
বাপের বচনে উত্তর ভীত মন।
আঁখি চাপি জনকেরে করে নিবারণ।।
কুমারের ইঙ্গিত না বুঝিল রাজন।
উত্তরে চাহিয়া বলে সক্রোধ বচন।।
কহ পুত্র তোমার এ কেমন চরিত।
মোর পুত্র হয়ে কেন এমত অনীত।।
কঙ্কের অগ্রেতে করিয়াছ যোড়হাত।
মুখে স্তুতিবাক্য, ঘন ঘন প্রণিপাত।।
সেই দিন হৈতে তোর বুদ্ধি হৈল আন।
কুরু হৈতে যেই দিন গোধনের ত্রাণ।।
আমা হৈতে শত গুণে কঙ্কেতে ভকতি।
নহিলে এ কর্ম্ম করে কাহার শকতি।।
পুনঃ পুনঃ নরপতি কহে কটূত্তর।
কোপেতে কম্পিত কায় বীর বৃকোদর।।
নিষেধ করেন ধর্ম্ম ইঙ্গিতে ভীমেরে।
হাসিয়া অর্জ্জুন বীর কহিছেন ধীরে।।
যা বলিলে নরপতি, মিথ্যা কিছু নয়।
তোমার আসন নাহি এর যোগ্য হয়।।
যে আসনে ত্রিভুবনে সবে নমস্কারে।
ইন্দ্র যম বরুণ শরণাগত ডরে।।
অখিল ঈশ্বর যেই দেব জগন্নাথ।
ভূমি লুঠি যে চরণে করে প্রণিপাত।।
সে আসনে নিরন্তর বসে যেই জন।
কিমতে তাঁহার যোগ্য হয় এ আসন।।
অন্ধক কৌরব বৃষ্ণি ভোজ আদি করি।
সপ্তবিংশ সহ সুখে খাটেন শ্রীহরি।।
পৃথিবীতে যত বৈসে রাজরাজেশ্বর।
ভয়েতে শরণ লয় দিয়া রাজকর।।
দশ কোটি হস্তী যাঁর প্রতি দ্বার রাখে।
অশ্ব রথ পদাতিক কার শক্তি লেখে।।
দানেতে দরিদ্র নাহি রহে পৃথিবীতে।
নির্ভয় অদুঃখী প্রজা যাঁর পালনেতে।।
অথর্ব্ব অকৃতী অন্ধ খঞ্জ অগণন।
অনুক্ষণ গৃহে ভুঞ্জে যেন পুত্রগণ।।
অষ্টাদশ সহস্র দ্বিজ নিত্য ভুঞ্জে ঘরে।
যে দ্রব্য যাহার ইচ্ছা, পায় সর্ব্ব নরে।।
ভীমার্জ্জুন পৃষ্ঠভাগ রক্ষিত যাঁহার।
দুইভিতে রাম-কৃষ্ণ মাতুল কুমার।।
পাশাতে যে রাজ্য দিয়া ভাই দুর্য্যোধনে।
দ্বাদশ বৎসর ভ্রমিলেন তীর্থ বনে।।
হেন রাজা যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।
তোমার আসন যোগ্য হয় কি ইহার।।
শুনিয়া বিরাট রাজা মানে চমৎকার।
সম্ভ্রমে অর্জ্জুনে জিজ্ঞাসিল আরবার।।
‌ইনি যদি যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অধিকারী।
কোথায় ইহার আর সহোদর চারি।।
কোথায় দ্রুপদ-কন্যা কৃষ্ণা গুণবতী।
সত্য কহ বৃহন্নলা এই ধর্ম্ম যদি।।
অর্জ্জুন বলেন, এই দেখ পরপতি।
তব সূপকার যেই বল্লব খেয়াতি।।
যাঁহার প্রহারে যক্ষ রাক্ষস কম্পিত।
সিংহ ব্যাঘ্র মল্ল আদি তোমার বিদিত।।
মারিল কীচকে যেই তোমার শ্যালক।
এই দেখ বৃকোদর জ্বলন্ত পাবক।।
অশ্বপাল গোপালক যেই দুই জন।
সেই দুই ভাই এই মাদ্রীর নন্দন।।
এই পদ্মপলাশাক্ষী সুচারু হাসিনী।
পাঞ্চাল রাজার কন্যা নাম যাজ্ঞসেনী।।
যার ক্রোধে শত ভাই কীচক মরিল।
সৈরিন্ধ্রীর বেশে তব গৃহেতে বঞ্চিল।।
আমি ধনঞ্জয়, ইহা জানহ রাজন।
শুনিয়া বিরাট রাজা বিচলিত মন।।
উত্তর বলয়ে, তবে করিয়া বিনয়।
তব ভাগ্য দেখ তাত কহনে না যায়।।
পঞ্চ ভাই আর কৃষ্ণা আজ্ঞাবর্ত্তী তাত।
বৎসরেক তব গৃহে বঞ্চিল অজ্ঞাত।।
দেখিয়া না দেখ পিতা, হইলে অজ্ঞান।
যাঁর দরশনে ইন্দ্র চন্দ্র হয় ম্লান।।
মহাবল কীচকেরে হেলায় মারিল।
সুশর্ম্মারে ধরি আনি তোমা মুক্ত কৈল।।
অপ্রমিত কুরুসৈন্য সাগরের প্রায়।
তরিলাম যেই কর্ণধারের সহায়।।
ভুজবলে জিনিলেক যত যোদ্ধাগণ।
রাজ্যরক্ষা কৈল তব, রাখিল গোধন।।
যাঁর শঙ্খনাদে তিন লোক কম্পমান।
বধির রয়েছে অদ্যাবধি মম কাণ।।
সেই ইন্দ্রদেব পুত্র এই ধনঞ্জয়।
এই রথে যে করিল কুরুসৈন্য জয়।।
পূর্ব্বে এই ধর্ম্মরাজ রাজসূয়-কালে।
বহুদিন কর লয়ে দ্বারে বদ্ধ ছিলে।।
সহস্র সহস্র রাজা সঙ্গে লয়ে কর।
দ্বারিগণ প্রহারেতে জীর্ণ কলেবর।।
পূর্ব্বে তব পিতৃগণ বহু পূণ্য কৈল।
তেঁই হেন নিধি তাত গৃহেতে আসিল।।
চরণে শরণ লহ, শীগ্রগতি তাত।
এত বলি রাজপুত্র করে প্রণিপাত।।
শুনিয়া বিরাট রাজা সজললোচন।
সর্ব্বাঙ্গ লোমাঞ্চ হৈল গদগদ বচন।।
ঊর্দ্ধবাহু করি তবে পড়ে কত দূর।
পুনঃ পুনঃ উঠে পড়ে ধুলায় ধূসর।।
সবিনয়ে বলে রাজা যোড় করি পাণি।
বহু অপরাধী আমি ক্ষম নৃপমণি।।
রাজ্য দারা ধন মম যত পুত্র ভাগে।
করিলাম সমর্পণ তব পদযুগে।।
শুনিয়া সদয় হয়ে ধর্ম্মের তনয়।
আজ্ঞা করিলেন পার্থে, তুলহ রাজায়।।
অর্জ্জুন ধরিয়া নৃপে তোলে সেইক্ষণে।
সান্ত্বাইলা নরপতি মধুর বচনে।।
সর্ব্বকাল ধর্ম্মরাজ তোমারে সদয়।
তোমার পুরেতে আসি লইনু আশ্রয়।।
বিরাট কহিল, যদি করিলে প্রসাদ।
ক্ষমা কর আমাদের যত অপরাধ।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, কেন হেন কহ।
বহু উপকারী তুমি, অপকারী নহ।।
বৎসরেক তব গৃহে ছিলাম অজ্ঞাত।
গর্ভবাসে যথা সবাকার বাস খ্যাত।।
নিজগৃহ হৈতে সুখ তব গৃহে পাই।
তোমার সমান বন্ধু নাহি কোন ঠাঁই।।
বিরাট বলিল, যদি হৈলে কৃপাবান।
এক নিবেদন মম আছে তব স্থান।।
উত্তরা নামেতে কন্যা আমার আছয়।
বিবাহ করুন তারে বীর ধনঞ্জয়।।
শুনি যুধিষ্ঠির, চাহিলেন ধনঞ্জয়।
অর্জ্জুন কহেন, কন্যা মম যোগ্য নয়।।
শুনিয়া বিরাট রাজা হলেন ব্যথিত।
সবিনয়ে অর্জ্জুনেরে জিজ্ঞাসে ত্বরিত।।
কহ মহাবীর কিবা আছে মম বাদ।
দারা পুত্র দোষী কিবা কন্যা অপরাধ।।
অর্জ্জুন বলেন, রাজা না কহ বুঝিয়া।
বৎসরেক পড়াইনু আচার্য্য হইয়া।।
শিক্ষা দীক্ষা জন্মদাতা একই সমানে।
না করিল লজ্জা মোরে আচার্য্যের জ্ঞানে।।
কন্যাবত আমি তারে বিদ্যা শিখাইল।
এই হেতু তব কন্যা ‍অযোগ্য হইল।।
কিন্তু দুষ্ট লোকে আমি বড় ভয় করি।
বলিবেক পার্থ ছিল নারীবেশ ধরি।।
বৎসরেক নারী সহ ছিল নারীবেশে।
শয়ন গমন কিছু না জানি বিশেষে।।
এই হেতু মোর বড় ভয় হয় মনে।
বিবাহ করিলে নিন্দা দুষ্টের বচনে।।
অতীব পবিত্র তব কন্যা গুণবতী।
তব কন্যাযোগ্য অভিমন্যু মহামতি।।
অস্ত্রে শস্ত্রে সুপণ্ডিত, বিক্রমে কেশরী।
তব কন্যা তার যোগ্যা উত্তরা সুন্দরী।।
অভিমন্যু যোগ্য পাত্র, ইথে নাহি আন।
মম পুত্রে নরপতি কর কন্যাদান।।
বধূ করি তব কন্যা করিব গ্রহণ।
শুনিয়া বিরাট রাজা আনন্দিত মন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন বিরাটের তরে।
দ্বারকা নগরে দূত পাঠাও সত্বরে।।
৪৮. উত্তরার সহিত অভিমন্যুর বিবাহ
তবে ধর্ম্ম আজ্ঞা পেয়ে যায় দূতগণ।
রাজ্যে রাজ্যে যথা যথা বৈসে বন্ধুজন।।
পাণ্ডবের কথা শুনি যত বন্ধুগণ।
শ্রুতমাত্র মৎস্যদেশে করিল গমন।।
দ্বারকা হইতে যদু সপ্তবংশ লয়ে।
রাম কৃষ্ণ দুই ভাই গরুড়ে চড়িয়ে।।
প্রদ্যুন্ন সাত্যকি শাম্ব গদ আদি করি।
সত্যভামা রুক্মিণী প্রভৃতি যত নারী।।
সুভদ্রা সৌভদ্র আর যতেক সারথি।
সহ পরিবার আসিলেন শীঘ্রগতি।।
আসিল পাঞ্চাল হৈতে দ্রুপদ রাজন।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সহ পঞ্চ কৃষ্ণার নন্দন।।
কাশীরাজ আদি আর কেকয় নৃপতি।
দুই অক্ষৌহিণী সেনা দোঁহার সংহতি।।
উগ্রসেন বসুদেব উদ্ধব অক্রূর।
সব রাজা উত্তরিল বিরাটের পুর।।
নানাধৃতি সুকৃতি কৌতুক নরপতি।
ঝিল্ল উপঝিল্ল তথা এল শীঘ্রগতি।।
মাতা সহ অভিমন্যু অর্জ্জুন-নন্দন।
চিত্রসেন সারথি যে আসে সেইক্ষণ।।
বৃষ্ণি ভোজ উলূকান্দি যত সেনাপতি।
পুরীসহ শ্রীগোবিন্দ আসিলেন তথি।।
মাতঙ্গ সহস্র দশ, অশ্ব তিন লক্ষ।
এক লক্ষ রথে চড়ি আসে সর্ব্ব পক্ষ।।
দশ লক্ষ চর আসে পদাতিকগণ।
স্বয়ং কৃষ্ণ আসিলেন বিরাট-ভবন।।
গোবিন্দেরে দেখি পঞ্চ পাণ্ডব সানন্দ।
চকোর পাইল যেন পূর্ণিমার চন্দ্র।।
আলিঙ্গন দিয়া রাজা কৃষ্ণে না ছাড়েন।
দুই ধারা নয়নেতে অশ্রু বরিষেন।।
অশ্রুজলে গোবিন্দের ভাসে পীতবাস।
মুখেতে না স্ফুরে বাক্য, গদগদ ভাষ।।
প্রণমিয়া শ্রীগোবিন্দ বলে মৃদুভাষা।
একে একে পঞ্চ ভাই করেন সম্ভাষা।।
সবারে করেন পূজা রাজা মহাশয়।
থাকিতে সবারে দেন উত্তম আলয়।।
উৎসব করিল তবে বিবিধ কারণ।
নট নটী নৃত্য করে বিবিধ বাজন।।
নানা বৃক্ষ রোপে আর নানা পুষ্পমালা।
প্রতি দ্বারে হেমকুম্ভ প্রতি দ্বারে কলা।।
নানা বস্ত্র বিভূষণ কন্যারে পরাল।
রোহিণী চন্দ্রমা যেন একত্র মিলিল।।
সর্ব্বগুণে সুলক্ষণা উত্তরা যে নাম।
অভিমন্যু সঙ্গে মিলে যেন রতি কাম।।
অর্জ্জুন-তনয় অভিমন্যু মহামতি।
কৃষ্ণ-ভাগিনেয়, বসুদেবের যে নাতি।।
ভক্তিভাবে মৎস্যরাজ করে কন্যাদান।
রথ গজ অশ্ব দিল প্রধান প্রধান।।
এক লক্ষ দিল গজ রত্ন-সিংহাসন।
প্রবাল মুকুট রত্ন দিল নানা ধন।।
হেনমতে সবান্ধবে কুতূহলী মনে।
ধর্ম্ম নিবসেন সুখে বিরাট ভবনে।।
বিদায় করেন ধর্ম্ম যত রাজগণ।
যে যাহার দেশে সবে করিল গমন।।
শ্রীকৃষ্ণ রহেন তথা আর অভিমন্যু।
বিদায় করেন কৃষ্ণ আর যত সৈন্য।।
যত যদুনারী গেল দ্বারকা নগর।
বলভদ্র আদি আর যতেক কুমার।।
পাণ্ডবের অভ্যুদয় শুনে যেই জন।
সর্ব্ব দুঃখ খণ্ডে তার ব্যাসের বচন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে পরলোকে তরি।।
৪৯. ব্যাস-বর্ণন ও ফলশ্রুতি কথন
বন্দি মহামুনি ব্যাস তপস্বী তিলক।
তপোধন পরাশর যাঁহার জনক।।
বেদশাস্ত্র পরায়ণ শুদ্ধ বুদ্ধি ধীর।
নীরপদ্ম আভা যেন কোমল শরীর।।
যুগল নয়ন দীপ্ত উজ্জ্বল মিহির।
পদযুগে কত মণি শোভে নখশির।।
ভাগবত পুরাণাদি যতেক গ্রন্থন।
যাঁহার তপো প্রভাবে হয়েছে নির্ম্মাণ।।
শ্রীকৃষ্ণের লীলা আর বেদ চারিখান।
ঋক্ যজু সাম আর অথর্ব্ব বিধান।।
মৎস্যগন্ধা গর্ভে যাঁর দ্বীপেতে উৎপত্তি।
বাল্যকালাবধি যাঁর তপস্যা সম্পত্তি।।
দ্বীপেতে জনম তাই নাম দ্বৈপায়ন।
কৃষ্ণ তাঁর কায় কৃষ্ণ নাম সঞ্চায়ণ।।
চারিবেদ বিভাগেতে নাম বেদব্যাস।
প্রণতি করি ভারত রচে কাশীদাস।।
সংক্ষেপে বর্ণিনু বিরাটপর্ব্ব কথা।
সাধুর সমান মহাভারতের কথা।।
অশ্বমেধ ফল পায় যে শুনে এ কথা।
ব্যাসের বচন ইথে নাহিক অন্যথা।।
সুবর্ণ মণ্ডিত শৃঙ্গে ধেনু শত শত।
সুপণ্ডিত দ্বিজে দান দেয় ‍অবিরত।।
নিত্য নিত্য শুনে পুণ্য ভারতের কথা।
নিশ্চয় জানহ তুল্য ফল লভে দাতা।।
যেবা কহে যেবা শুনে করে অধ্যয়ন।
তুল্য ফল হয় তার সেই সাধুজন।।
সুবৃষ্টি করয়ে কালে মেঘ সর্ব্ব দেশে।
পরিপূর্ণ হয় পৃথ্বী শস্য সমাবেশে।।
অক্ষয় হউক লোক ব্রাহ্মণ নির্ভয়।
ভক্তজনে কৃতার্থ করুণ কৃপাময়।।
ধন্য হৈল কায়স্থ-কুলেতে কাশীদাস।
চারি পর্ব্ব ভারত করিল সুপ্রকাশ।।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দাস।
কৃষ্ণ-পদাম্বুজে অলি হৈব অভিলাষ।।
হরিধ্বনি কর সবে গোবিন্দের প্রীতে।
অন্তকালে স্বর্গপুরে যাবে আনন্দেতে।।
সর্ব্বশাস্ত্র বীজ হরি নাম দ্বি-অক্ষর।
আদি অন্ত নাহি যার বেদে অগোচর।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলিতে মজিবে কৃষ্ণে দেহ।
কৃষ্ণের মুখের আজ্ঞা না হয় সন্দেহ।।
পাঁচালী বলিয়া কেহনা করিবে হেলা।
অনায়াসে পাপা নাশে গোবিন্দের লীলা।।
থাকিলে ভারত নীচগৃহে নহে দুষ্ট।
শুনিলে পাতক হয় সমূলে বিনষ্ট।।
পাণ্ডবের অভ্যুদয় শুনে যেই জন।
সর্ব্বদুঃখ তরে সেই ব্যাসের বচন।।
হরিকথা শ্রবণেতে সর্ব্ব পাপ যায়।
আদ্য মধ্য অন্তে যেবা হরিগুণ গায়।।
কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর মত।
বিরাট পর্ব্বের কথা হৈল সমাপিত।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র