৩৬. ভ্রাতৃবর্গ ও দ্রৌপদীকে পণ করণও যুধিষ্ঠিরের পরাজয়শকুনি বলিল চাহি ধর্ম্মের নন্দন।সর্ব্বস্ব হারিলে আর কি করিবে পণ।।যুধিষ্ঠির বলে, মম অসংখ্য রতন।চারি সিন্ধু মধ্যে আছে মোর যত ধন।।অযুত নিযুত কোটি খর্ব্ব মহাখর্ব্ব।পদ্ম শঙ্খ করি অন্ত আছে যত সর্ব্ব।।সকল করিনু পণ এবার সারিতে।জিনি লইলাম, বলে গান্ধারের সুতে।।যুধিষ্ঠির বলেন, যে আছে পশুগণ।গাভী উষ্ট্র খর আর মেষ অগণন।।সব করিলাম পণ এবার দ্যূতেতে।জিনিলাম, বলি বলে সুবলের সুতে।।যুধিষ্ঠির বলিলেন, পণ করি আমি।আমার শাসিত আছে যত রাজ্যভূমি।।ব্রাহ্মণের ভূমি গৃহ ছাড়িয়া রতন।এবার দেবনে আমি করিলাম পণ।।শকুনি বলিল, আমি জিনিনু সকল।আর কি আছয়ে পণ কর মহাবল।।ধর্ম্ম দেখিলেন, ধন কিছু নাহি আর।কুমারগণের অঙ্গে যত অলঙ্কার।।সকল করিলা পণ, জিনিল শকুনি।দেখিয়া চিন্তিত বড় ধর্ম্ম-নৃপমণি।।শকুনি বলিল, কহ কি আর বিচার।বিচারি করেন পণ ধর্ম্মের কুমার।।ক্ষিতি মধ্যে সুবিখ্যাত নকুল সুধীর।কামদেব জিনি রূপ সুন্দর শরীর।।সিংহগ্রীব পদ্মপত্র যুগল নয়ন।এবার সারিতে নকুলেরে করি পণ।।কপটে শকুনি বলে, বলি সারোদ্ধার।তব প্রিয় ভাই এই পাণ্ডুর কুমার।।কেমনে ইহারে পণ করিবা দেবনে।এত বলি ফেলি পাশা লইলেক জিনে।।ধর্ম্ম বলে, সহদেব ধর্ম্মজ্ঞ পণ্ডিত।আমার পরম প্রিয় জগতে বিদিত।।এবার সারিতে সহদেবে করি পণ।জিনিলাম বলি বলে গান্ধার-নন্দন।।কপট চাতুরী বাক্যে বলিল শকুনি।আর কি আছয়ে পণ কর নৃপমণি।।বৈমাত্রেয় দুই ভাই হারিলা সারিতে।ভীমার্জ্জুন হারিবে না, লয় মম চিতে।।ধর্ম্মরাজ বলে, তব দেখি দুষ্প্রকৃতি।ভ্রাতৃভেদ ভাষা কেন কেহ মন্দমতি।।আমি আর পঞ্চ ভাই একই পরাণ।কি বুঝিয়া হেন বাক্য কহিলা অজ্ঞান।।ভীত হৈয়ে শকুনি বলিছে সবিনয়।সহজে পাশায় মত্ত সুজনেও হয়।।মত্ত হৈলে অবক্তব্য বাক্য আসে মুখে।তুমি শ্রেষ্ঠ গরিষ্ঠ, ক্ষমহ দোষ মোকে।।পুনঃ যুধিষ্ঠির করিলেন এ উত্তর।তিন লোকে খ্যাত যে আমার সহোদর।।হেলে তরি পরসৈন্য সাগরের প্রায়।যেই দুই বীর কর্ণধারের কৃপায়।।হেলায় জিনিল দেবরাজে ভুজবলে।অগণিত গুণ যার খ্যাত ক্ষিতিতলে।।এ কর্ম্মেতে পণযোগ্য নহে হেন নিধি।তথাপিহ করি পণ অক্ষক্রীড়া বিধি।।শকুনি ফেলিয়া পাশা জিনিলাম বলে।ধনঞ্জয়ে জিনি হৃষ্ট হয় কুরুদলে।।ধর্ম্ম বলিলেন, পণ করি এইবার।বলেতে মনুষ্য-লোকে সম নাহি যার।।ইন্দ্র যেন দৈত্য দলি পালে সুরগণে।সেই মত পালে ভীম পাণ্ডুর নন্দনে।।পাশায় এ পণযোগ্য নহে হেন ধন।তথাপিহ করি পণ দৈব নির্ব্বন্ধন।।জিনিলাম বলি, তবে বলিল শকুনি।আর কি আছয়ে পণ কর নৃপমণি।।এত শুনি বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।এত আছি মাত্র এবে, মোরে করি পণ।।জিনিয়া শকুনি বলে কপট আচার।পাপকর্ম্ম করিলা হে কুন্তীর কুমার।।দ্রুপদ-কুমারী পণ করহ এবার।জিনিয়া করহ রাজা আপন উদ্ধার।।এ সকল থাকিতে আপনা নাহি হারি।আপনি থাকিলে হয় বহু ধন নারী।।রাজা বলে, মামা না সম্ভবে এই কথা।কি মতে করিব পণ দ্রুপদ-দুহিতা।।রূপেতে লক্ষ্মীর সম যাহার বর্ণনা।অসংখ্য যাহার গুণ না হয় গণনা।।মম সৈন্যসিন্ধু সম না হয় বর্ণন।প্রত্যক্ষ সবার শুভচেষ্টা অনুক্ষণ।।দ্বিজ ক্ষত্র দাস দাসী যত পশুগণ।সবারে জননী-রূপে করয়ে পালন।।হেন স্ত্রী করিব পণ, নাহি লয় মতি।কপট করিয়া বলে শকুনি দুর্ম্মতি।।লক্ষ্মী-অবতার রাজা তোমার গৃহিণী।তাঁর ভাগ্যে কদাচিৎ পড়ে পাশা জানি।।হারিলা আপনা রাজা করহ উদ্ধার।আপনা হইতে বড় নাহি কেহ আর।।বিপদে পড়িলে বুদ্ধি হারায় পণ্ডিত।শকুনির বচন যে মানিলাম হিত।।এতেক শুনিয়া কহিলেন যুধিষ্ঠির।পাশা ফেল আরবার সেই পণ স্থির।।এতেক শুনিয়া দুষ্ট পাশা ফেলাইল।হাসিয়া শকুনি বলে জিনিল জিনিল।।শুনি কর্ণ দুর্য্যোধর হাসে খল খল।মহা আনন্দিত কুরু-সোদর সকল।।বিপরীত কর্ম্ম দেখি ভাবে সভাজন।ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ হৈল সজল নয়ন।।শির ধরি বিদুর বসিলা অধোমুখে।জ্ঞানহত লোক যেন হয় মহাশোকে।।হৃষ্ট হয়ে ধৃতরাষ্ট্র ডাকিয়া বলিল।কে জিনিল, কে জিনিল বলি জিজ্ঞাসিল।।বহুকালে প্রকাশিল কুটিল আচার।না পারিল লুকাইতে ধৃতরাষ্ট্র আর।।এইমতে সর্ব্বস্ব হারেন ধর্ম্মরায়।সভাপর্ব্বে সুধারস কাশীদাস গায়।।৩৭. পঞ্চ পাণ্ডবকে সভাস্থ করণহাসিয়া বলিল তবে সূর্য্যের নন্দন।দেখহ ইহারে হৈল দৈবের ঘটন।।আমা সবা মধ্যেতে তোমারে দিল লাজ।উপহাস কৈল পেয়ে আপন সমাজ।।এই ভীমার্জ্জুন দেখ মাদ্রীর নন্দন।পুনঃ পুনঃ তোমা দেখি হাসে সর্ব্বজন।।বাতুল দেখিয়া যথা হাসে সভাজনে।সেই মত কৈল তোমা আপন ভবনে।।সেই অধর্ম্মের ফলে দেখ নৃপমণি।দাস করি বান্ধিয়া দিলেক দৈবে আনি।।দাস হৈল যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃ সমুদায়।সমযোগ্য নহে দাস বসিতে সভায়।।দুর্য্যোধন বলে, সখা উত্তম কহিলে।আজ্ঞা দিল, যুধিষ্ঠিরে লহ সভাতলে।।দাস হৈল, দাস-স্থানে থাক্ পঞ্চ জন।সবাকার কাড়ি লহ বস্ত্র আভরণ।।বুঝিয়া আপনি সখা করহ বিধান।পঞ্চ জনে নিযুক্ত করহ স্থানে স্থান।।যে কর্ম্মে যে যোগ্য, তারে কর সমর্পণ।এতেক শুনিয়া বলে দুষ্ট বৈকর্ত্তন।।দৈব হৈতে বহুজন ভৃত্য-কর্ম্ম করে।বিনা কর্ম্মে কেবা আছে সংসার ভিতরে।।নিজবৃত্তি মত কর্ম্ম করয়ে আজন্ম।রাজা রাজকর্ম্ম করে, ভৃত্য ভৃত্যকর্ম্ম।।ভৃত্য হৈল পঞ্চ জন করুক স্বকাজ।যে কর্ম্মে যে যোগ্য তারে দেহ মহারাজ।।অনুভব আমার যে কর অবধান।পঞ্জ জনে নিয়োজিত কর স্থানে স্থান।।সুকোমল অঙ্গ রাজা ধর্ম্মের তনয়।অন্য কর্ম্মে ইহার ক্ষমতা নাহি হয়।।তাম্বূলের সেবাতে করহ নিয়োজন।পান লৈয়ে সন্নিধানে রবে অনুক্ষণ।।হৃষ্টপুষ্ট বৃকোদর হয় বলবান।সে কারণে মম মনে লয় এই জ্ঞান।।বৃকোদরে সমর্পণ কর চতুর্দ্দোল।অনায়াসে ভার সবে, নহেক দুর্ব্বল।।স্কন্ধে করি তোমা লৈবে সহ ভ্রাতৃগণ।স্বচ্ছন্দে যাইবে, যথা করিবা গমন।।অর্জ্জুনেরে এই সেবা দেহ মহাশয়।আমি অনুমানি যদি তব মনে লয়।।বস্ত্র-অলঙ্কার যদি সমর্প অর্জ্জুনে।লয়ে তব পুরোভাগে রবে অনুক্ষণে।।তব হিত-প্রিয় দুই মাদ্রীর তনয়।এ দোঁহারে দুই সেবা দেহ মহাশয়।।দুইভিতে তোমার থাকিবে দুই জন।চামর লইয়া সদা করিবে ব্যজন।।এ পঞ্চ সেবায় পাঁচে কর নিয়োজন।আসিয়া করুক কৃষ্ণা গৃহে দাসীপণ।।এতেক বলিল যদি কর্ণ দুরাচার।হাসিয়া বলয়ে তবে গান্ধারী-কুমার।।দুর্য্যোধন বলে, সখা বলিলা উত্তম।যে বিধান করিলা সে মম মনোরম।।ইঙ্গিত করিয়া জানাইল ভ্রাতৃগণে।ভৃত্যস্থলে লইয়া বসাও সর্ব্বজনে।।আজ্ঞামাত্র ততক্ষণে যত ভ্রাতৃগণ।উঠ উঠ বলি কহে কর্কশ বচন।।কোন্ লাজে রাজা সনে আছহ বসিয়া।আপনার যোগ্য স্থানে সবে বৈস গিয়া।।দুঃশাসন উঠাইল ধর্ম্ম-করে ধরি।চল চল বলি ডাকে পৃষ্ঠে ঢেকা মারি।।ক্রোধেতে ধর্ম্মের পুত্র কাঁপে কলেবর।চক্ষু রক্তবর্ণ, লোহ বহে ঝরঝর।।বিপরীত মানহীন দেখি যুধিষ্ঠির।ক্রোধে থর থর কম্পমান ভীমবীর।।ভৈরব-গর্জ্জনে গর্জ্জে দন্ত কড়মড়ি।যেমন প্রলয়-কালে হয় মড়মড়ি।।যুগান্তের যম যেন সংহারিতে সৃষ্টি।অরুণ আকার চক্ষু, চাহে এক দৃষ্টি।।নাকে ঝড় বহে যেন প্রলয় সমান।মহাবীর ভীমসেন কর্ণ পানে চান।।দেখিয়া কৌরবগণ পায় বড় শঙ্কা।হাতে গদা করি ভীম উঠে রণরঙ্কা।।মাথায় ফিরায় গদা চক্রের আকার।চরণের ভরে ক্ষিতি হয় ত বিদার।।ক্রোধমুখ করি দুঃশাসন পানে ধায়।অনুমতি লইবারে ধর্ম্ম পানে চায়।।হেঁটমাথা যুধিষ্ঠির দেখিয়া ভীমেরে।বুঝিয়া অর্জ্জুন গিয়া ধরিলেন তাঁরে।।অর্জ্জুন বলেন, ভাই না কর অনীতি।কি হেতু হেলন কর ধর্ম্ম-নরপতি।।দিকপাল সহ যদি আইসে দেবরাজ।আর যত বীর বৈসে ত্রৈলোক্যের মাঝ।।ধর্ম্মেরে করিবে হেয় আমরা থাকিতে।মুহূর্ত্তেকে পাঠাইব যমের ঘরেতে।।কোন্ ছার এরা সব, তৃণ হেন গণি।এখনি দহিতে পারি, কারে নাহি মানি।।বিনা ধর্ম্ম-আজ্ঞায় নাহিক ভাই শক্তি।কোন্ কাজ ভদ্র যাহে ধর্ম্মেতে অভক্তি।।অস্বীকার ধর্ম্মের এ কর্ম্মে অভিপ্রায়।সে কারণে এ কর্ম্ম করিতে না যুরায়।।অর্জ্জুনের বচনে, হইল শান্তক্রোধ।ফেলিলেন গদা ভীম মানি উপরোধ।।আভরণ পরিধান যতেক আছিল।পঞ্চ ভাই আপনা আপনি সব দিল।।সভাত্যাগ করিয়া নিকৃষ্ট ধূল্যাসনে।অধোমুখে বসিলেন ভাই পঞ্চজনে।।হেনকালে দুষ্ট কর্ণ কহিল বচন।দ্রৌপদী আনিতে দূত করহ প্রেরণ।।শুনি দুর্য্যোধন তবে বিদুরে ডাকিল।হাস্য উপহাসে তবে কহিতে লাগিল।।তবে ধৃতরাষ্ট্র রাজা বুঝিয়া বিচার।সভা হৈতে গৃহে তবে গেল আপনার।।৩৮. দ্রৌপদীকে আনিতে প্রতিকামীর গমনতবে রাজা দুর্য্যোধন আনন্দিত মতি।দম্ভ করিয়া কহিল বিদুরের প্রতি।।বিষাদিত কেন বসিয়াছ অধোমুখে।হেন বুঝি দুঃখী বড় পাণ্ডবের দুঃখে।।উঠ উঠ যাহ শীঘ্র ইন্দ্রপ্রস্থে চলি।আপনি আইস হেথা লইয়া পাঞ্চালী।।অন্তঃপুরে আছয়ে যতেক দাসীগণ।তা সবার সহিত করুক দাসীপণ।।এত শুনি বিদুর কম্পিত কলেবর।ক্রোধমুখে দুর্য্যোধনে করিল উত্তর।।মন্দমতি ছন্নমতি না বুঝিস্ কিছু।করালি ব্যাঘ্রেরে ক্রোধ হৈয়ে মৃগশিশু।।বিষ সম্বরিয়া বসিয়াছে বিষধর।অঙ্গুলি না পূর তার মুখের ভিতর।।কেমনে এ দুষ্ট ভাষা মুখেতে আনিলি।কৃষ্ণা তব দাসী হৈবে, কুলে দিলি কালি।।দ্রৌপদীতে তোমার কিসের অধিকার।সবাই না বুঝ কেন করিয়া বিচার।।আপনা হারিল পূর্ব্বে ধর্ম্মের কুমার।আপনার উপরে কিসের অধিকার।।অন্যের উপরে তার প্রভুপণ কিসে।।আর তার চারি স্বামী আছয়ে বিশেষে।মোর কথা যদি তোর নাহি লয় মনে।জিজ্ঞাসিয়া দেখ যত বৃদ্ধ মন্ত্রিগণে।।এই বৃদ্ধ অন্ধরাজ হৃষ্ট হইয়াছে।লোভেতে হইল ছন্ন, নাহি দেখে পাছে।।নিকটে আইল মৃত্যু, কে করে বারণ।ফুল ধরি যেন বাঁশগাছের মরণ।।দ্যূতেতে পরম ধর্ম্ম, আপন কল্যাণ।কদাচিৎ তথাপি না করে মতিমান।।শুখাইলে খণ্ডে অস্ত্রাঘাতের বেদন।বাক্যাঘাত নাহি খণ্ডে যাবত জীবন।।পাশাতে জিনিয়া বড় আনন্দ-হৃদয়।চিত্তে ভাব পাণ্ডবের হৈল অসময়।।শ্রীমন্ত জনের হয় অসময় কিসে।কি তার সহায় নাই এই মহাদেশে।।কোথা হয় শ্রীরহিত শ্রীমন্ত সুজন।জলেতে পাষাণ নাহি ভাসে কদাচন।।লাউ নাহি ডুবে কভু জলের ভিতর।কখন দুর্গতি নহে বিষ্ণুভক্ত নর।।পুনঃ পুনঃ আমি কহিলাম হিতবাণী।না শুনিয়া মৃত্যুকাল ডাকিলে আপনি।।নিশ্চয় হইল দেখি তিনকুল ধ্বংস।শান্তনু বাহলীক অন্ধ নৃপতির বংশ।।মাত্র মিত্র ইষ্ট পুত্র সহিত মজিবে।আমার এ সব কথা পশ্চাৎ ফলিবে।।এইরূপ বিদুর কহিল বহুতর।শুনি দুর্য্যোধন তারে নিন্দিল বিস্তর।।প্রতিকামী ছিল তাঁর সম্মুখে দাণ্ডাইয়া।তারে আজ্ঞা দিল রাজা নিকটে ডাকিয়া।।যাহ তুমি, দ্রৌপদীকে আন এইক্ষণে।পাণ্ডবের ভয় তুমি না করিহ মনে।।বিদুরের বোলে কিছু না করিহ ভয়।সর্ব্বকাল বিদুরের ভয়ার্ত্ত হৃদয়।।আর কুস্বভাব আছে বিদুর-চরিত।ধৃতরাষ্ট্র-কুৎসা কহে পাণ্ডবের হিত।।আদেশ পাইয়া তবে চলে প্রতিকামী।ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশে করিল শীঘ্রগামী।।যথায় পুরীর মধ্যে দ্রৌপদী সুন্দরী।দ্রৌপদীর আগে কহে করযোড় করি।।অবধান মহাদেবী শুনহ বিধান।রাজা যুধিষ্ঠির হৈল দ্যূত হতজ্ঞান।।সর্ব্বস্ব হারিল দ্যূতে, তোমা আদি করি।তোমা নিতে আজ্ঞা দিল কুরু-অধিকারী।।ধৃতরাষ্ট্র-গৃহে চল, কর যথাকর্ম্ম।শুনিয়া দ্রৌপদীর ভাঙ্গিল নিজ মর্ম্ম।।৩৯. দ্রৌপদীর প্রশ্নদ্রৌপদী বলেন, হেন কভু নাহি শুনি।রাজপুত্র হারিয়াছে আপন গৃহিণী।।যুধিষ্ঠির ধীর বুদ্ধি, কভু মত্ত নয়।এ কর্ম্ম দ্যূতেতে, হেন মনে নাহি লয়।।প্রতিকামী বলে, দেবী মিথ্যা কভু নয়।গ্রহবশে খেলিলেন ধর্ম্মের তনয়।।একে একে সর্ব্বস্ব হারিয়া নরবর।আপনারে হারিলেন সহ সহোদর।।পশ্চাতে তোমারে হারিলেন নৃপমণি।এত শুনি বলিলেন দ্রুপদ-নন্দিনী।।যাহ প্রতিকামী গিয়া জিজ্ঞাস রাজারে।প্রথমে আপনা কিবা হারিলা আমারে।।হারিয়া থাকেন যদি প্রথমে আপনা।তবে গিয়া জিজ্ঞাসহ সভাসদ্ জনা।।তবে যদি সভাতলে সবে যেতে কয়।আপন ইচ্ছায় তবে যাইব তথায়।।এত শুনি প্রতিকামী চলিল সত্বরে।সভায় জিজ্ঞাসে গিয়া ধর্ম্ম-নৃপবরে।।পাঠাইল দ্রৌপদী আমারে জিজ্ঞাসিতে।কোন্ পণ প্রথমে করিলা রাজা দ্যূতে।।প্রথমে আপনা কি হারিলা যাজ্ঞসেনী।শুনি মুগ্ধ হইলেন ধর্ম্ম-নৃপমণি।।রহিল নীরবে বসে, নাহি সবে বাণী।মনে বুঝি কিছু না বলিল প্রতিকামী।।প্রতিকামী প্রতি ক্রোধে বলে কুরুবরে।যাহ প্রতিকামী কিবা জিজ্ঞাস উহারে।।সভামধ্যে লইয়া আইস দ্রৌপদীরে।আসিয়া করুক ন্যায় সভার ভিতরে।।আসি জিজ্ঞাসুক সেই, যেই লয় মনে।করুক আসিয়া ন্যায় লয়ে সভাজনে।।এত শুনি প্রতিকামী হইল দুঃখিত।পুনঃ দ্রৌপদীর স্থানে চলিল ত্বরিত।।করযোড়ে প্রতিকামী বলে সবিষাদ।অবধান মহাদেবি হইল প্রমাদ।।অস্ত হৈল কুরুকুল, বুঝিলাম মনে।সভাতে তোমারে লৈতে বলিলা যখনে।।দ্রৌপদী বলিল, শুন সঞ্জয়-নন্দন।ধর্ম্মরাজ কি বলেন, কিবা দুর্য্যোধন।।প্রতিকামী বলে, রাজা কিছু না বলিল।সভাতে লইতে দুর্য্যোধন আজ্ঞা দিল।।দ্রৌপদী কহিল, তুমি বলিলা প্রমাণ।বংশ-নাশ-হেতু বিধি করিল বিধান।।যাহ প্রতিকামী গিয়া জিজ্ঞাস রাজায়।নিশ্চয় কি তার মন লইতে সভায়।।এত শুনি প্রতিকামী চলিল সত্বর।রাজারে কহিল যত কৃষ্ণার উত্তর।।তবে যুধিষ্ঠির রাজা ভাবিয়া অন্তরে।দুর্য্যোধন-যত্ন দেখি কৃষ্ণা অনিবারে।।বিচারিয়া কহিলেন, কহ দ্রৌপদীরে।দৈবের নির্ব্বন্ধ কর্ম্ম কে খণ্ডিতে পারে।।সত্য বিনা মম চিত্তে অন্য নাহি ভয়।ধর্ম্ম রক্ষা করুক সে আসি এ সভায়।।প্রতিকামী প্রতি তবে দুর্য্যোধন বলে।ক্রোধে দুই চক্ষু যেন অগ্নি হেন জ্বলে।।ভাল তোরে পাঠানু আনিতে দ্রৌপদীরে।পুনঃ পুনঃ আইসহ দ্রৌপদী-বচনে।।যাহ শীঘ্র দ্রৌপদীরে আনহ এস্থানে।এত শুনি প্রতিকামী ভীত হৈল মনে।।পুনরপি ইন্দ্রপ্রস্থে চলিল সত্বরে।কতেক দূরেতে গিয়া ভাবিল অন্তরে।।কি ক্ষণে আইনু আজি রাজার নিকটে।সে কারণে পড়িলাম এমন সঙ্কটে।।পাছে ক্রোধ করে কৃষ্ণা দেখিলে এবার।পাণ্ডব করিলে ক্রোধ নাহিক নিস্তার।।কদাচিৎ কৃষ্ণা যদি এবার না আইসে।দুর্য্যোধন মহাক্রোধ করিবে বিশেষে।।বিচারিয়া বাহুড়িল সঞ্জয়-নন্দন।করযোড়ে বলে দুর্য্যোধনের সদন।।তব আজ্ঞাবশে যাই কৃষ্ণ আনিবারে।না আইলে কি করিব, আজ্ঞা কর মোরে।।৪০. দুঃশাসনের দ্রৌপদী-সমীপে গমনও তাঁহার কেশাকর্ষণ পূর্ব্বক সভায় আনয়নশুনি দুঃশাসনে ডাকি বলে দুর্য্যোধন।পাণ্ডবেরে ভয় করে সঞ্জয়-নন্দন।।এ কর্ম্মের যোগ্য নহে এই অল্পমতি।তুমি গিয়া দ্রৌপদীরে আন শীঘ্রগতি।।সভামধ্যে কেশে ধরি আনহ তাহারে।নিস্তেজ হয়েছে শত্রু, কি আর বিচারে।।আজ্ঞামাত্র দুঃশাসন চলিল ত্বরিত।দ্রৌপদীর অন্তঃপুরে হৈল উপনীত।।দ্রৌপদী চাহিয়া ডাকি বলে দুঃশাসন।চলহ দ্রৌপদী, আজ্ঞা করিল রাজন।।পাশায় তোমার স্বামী হারিল তোমারে।দুর্য্যোধনে ভজ এবে ত্যজি যুধিষ্ঠিরে।।দুঃশাসন দুষ্টবুদ্ধি দেখি গুণবতী।সক্রোধ-বদন আর বিকৃত-আকৃতি।।ভয়েতে দেবীর অঙ্গ কাঁপে থরথর।শীঘ্রগতি উঠি গেল ঘরের ভিতর।।স্ত্রীগণের মধ্যে দেবী ভয়ে লুকাইল।দেখি দুঃশাসন ক্রোধে পাছু গোড়াইল।।গৃহদ্বারে কুন্তীদেবী ভুজ প্রসারিয়া।সবিনয়ে বলে দুঃশাসনেরে চাহিয়া।।কহ দুঃশাসন এই কেমন বিহিত।দ্রৌপদী ধরিতে চাহ, না বুঝি চরিত।।কুলবধূ লৈয়া যাবে সভার মধ্যেতে।কুলের কলঙ্ক-ভয় নাহিক তোমাতে।।শুনি দুঃশাসনে ক্রোধে উঠিল গর্জ্জিয়া।দুই হাতে কুন্তীরে সে ফেলিল ঠেলিয়া।।অচেতন হয়ে দেবী পড়িল ভূতলে।দুঃশাসন ধরিলেক দ্রৌপদীর চুলে।।যেই কেশ রাজসূয়-যজ্ঞের সময়।মন্ত্রজলে সিঞ্চিলেন ব্যাস মহাশয়।।বাহিরিল কৃষ্ণার সেই কেশেতে ধরি।দেখিয়া কান্দয়ে যত অন্তঃপুর-নারী।।কেশে ধরি লয়ে যায় পবনের বেগে।চলিতে চরণ ভূমে লাগে কি না লাগে।।নাগিনী বিকলা যথা গরুড়ের মুখে।ছ্ট্ফট্ করে দেবী, ছাড় ছাড় ডাকে।।আরে মন্দমতি কেন না দেখ নয়নে।রজঃস্বলা আছি আর একই বসনে।।দুঃশাসন বলে, তুমি ছাড় হেন আশ।রজঃস্বলা হও কিম্বা হও একবাস।।পূর্ব্ব-অহঙ্কার এবে না করিহ মনে।সভাতে লইতে আজ্ঞা করিল রাজনে।।কৃষ্ণা বলে, গুরুজন আছেন সভাতে।কি মতে দাণ্ডাব আমি তাঁদের অগ্রেতে।।না লহ সভাতে মোরে কর পরিহার।আরে মন্দমতি কেশ ছাড়হ আমার।।কেন হেন জ্ঞানহারা হৈলি রে অবোধ।সর্ব্বনাশ হবে, হৈলে পাণ্ডবের ক্রোধ।।ইন্দ্র সভা হৈলে তবু রক্ষা না পাইবি।ক্ষণমাত্রে যম-গৃহে সবংশেতে যাবি।।ধর্ম্মে বদ্ধ হয়েছেন ধর্ম্ম-নরপতি।ভ্রাতৃ-উপরোধ বশ চারি মহামতি।।এই হেতু এতক্ষণ তোমার জীবন।এখন যে রক্ষা পাও হৈলে নিবারণ।।কৃষ্ণার বচন শুনি দুঃশাসন হাসে।পুনঃ আকর্ষিয়া দুষ্ট টান দিল কেশে।।ঝাঁকারি সবলে তাঁরে নিল সভাস্থল।উচ্চৈঃস্বরে কান্দে কৃষ্ণা হইয়া বিকল।।অধীর হইয়া চাহে ভূমি ধরিবারে।না লও সভাতে মোরে, বলয়ে কাতরে।।বড় বড় জন দেখি আছেন সভায়।হেন এক জন নাহি, এক কথা কয়।।কেহ তার দুর্বুদ্ধি না করে নিবারণ।চিত্র-পুত্তলিকা মত আছেন সভাজন।।এই ভীস্ম দ্রোণ দেখ আছেন সভাতে।ধার্ম্মিক এই দুই বড় খ্যাত পৃথিবীতে।।স্বধর্ম্ম ছাড়িল এরা, হেন লয় মনে।মম এত দুঃখ কেন না দেখে নয়নে।।বাহ্লীক বিদুর ভূরিশ্রবা সোমদ্ত্ত।ধর্ম্মশীল জানি সবে অতুল মহত্ত্ব।।কুরুকুল সত্যভ্রষ্ট হইল নিশ্চয়।এক জন কেহ এক ভাষা নাহি কয়।।এত বলি কান্দে দেবী সজল নয়নে।কাতর হইয়া চাহে স্বামীগণ পানে।।দ্রৌপদী-কাতর-দৃষ্টি দেখিয়া পাণ্ডব।ঘৃত পেলে যেই মত জ্বলে জলোদ্ভব।।রাজ্য দেশ ধন জন সকল হারিল।তিলমাত্র তাহাতে তাপিত না হইল।।দ্রৌপদী-কাতর-,মুখ দেখিয়া নয়নে।কুম্ভকার-শাল যেন পোড়য়ে আগুণে।।দুঃশাসনে টানে ঘন কেশেতে আকর্ষি।পরিহাস করি কেহ বেল, আন দাসী।।সাধু দুঃশাসন, বলে রাধেয় শকুনি।সজল নয়নে কান্দে দ্রুপদ-নন্দিনী।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon