মহাভারত:বিরাটপর্ব-০০৬-০১০

৬. শঙ্করযাত্রা ও ভীমের মল্লযুদ্ধ
পূর্ব্বাপার কুলরীতি আছে মৎস্যদেশে।
শঙ্কর নামেতে যাত্রা আরাধে মহেশে।।
কলির শঙ্করযাত্রা বিরাট রাজন।
নানা দেশ হৈতে আসে বহুসংখ্য জন।।
দ্বিজ আদি চারি জাতি নরনারীগণ।
নৃত্যগীত মহোৎসব করে জনে জন।।
পণ্ডিতে পণ্ডিতে কথা শাস্ত্রের বিবাদ।
হস্তী হস্তী যুদ্ধ হয় ছাড়ে ঘোর নাদ।।
কৌতুক দেখেন তথা বিরাট-রাজন।
পর্ব্বত আকার লক্ষ লক্ষ মল্লগণ।।
মল্লগণমধ্যে এক মল্ল বলবান।
সর্ব্ব মল্লগণ করে যাহা বাখান।।
সর্ব্ব মল্লগণ মধ্যে ছাড়ে সিংহনাদ।
কে আছ, আমার সঙ্গে করহ বিবাদ।।
লাখে লাখে বড় বড় যত মল্ল ছিল।
অধোমুখে হয়ে কেহ উত্তর না দিল।।
ডাকিয়া বলয়ে মল্ল নৃপতির প্রতি।
মোর সঙ্গে যুঝে হেন দেহ নরপতি।।
যদি মল্ল দেহ রাজা,গুণ গেয়ে যাব।
নাহি দিলে দেশে দেশে অখ্যাতি করিব।।
চিন্তিয়া বিরাট তবে করিয়া স্মরণ।
সূপকার বল্লবেরে ডাকেন তখন।।
বিরাট বলেন, তুমি কহিয়াছ পূর্ব্বে।
এ মল্ল সহিত রণ কর তুমি এবে।।
এ মল্ল সহিত যদি পার যুঝিবারে।
তোমারে তুষিব আমি রাজ-ব্যবহারে।।
ভীম বরে নরপতি জানহ আপনে।
যতেক কহিনু পূর্ব্বে উদয়-ভরণে।।
সে সব স্মরিয়া যদি ‍চাহ বধিবারে।
এ মল্ল সহিত তবে যুঝাহ আমারে।।
মহাবলবান মল্ল পর্ব্বতআকার।
পেটার্থী ব্রাহ্মণ জাতি হই সূপকার।।
এ মল্ল সহিত যদি করাও সংগ্রাম।
দ্বিজবধ ভয় নাহি, কর পরিণাম।।
শুনিয়া নিঃশব্দ হন মৎস্যের ঈশ্বর।
কতক্ষণে কঙ্ক তবে করেন উত্তর।।
যার যে আশ্রয়ে থাকে পণ্ডিত সুজন।
যথাশক্তি তার আজ্ঞা না করে হেলন।।
পুনঃ পুনঃ মল্ল বলিতেছে নৃপবরে।
রাজার হয়েছে ইচ্ছা যুদ্ধ দেখিবারে।।
রাজারে সন্তোষ কর, দেখুক সকলে।
একবার মল্ল সহ যুঝ কুতূহলে।।
যুধিষ্ঠির বাক্য শুনি বীর বৃকোদর।
পুনরপি নৃপতিরে করেন উত্তর।।
তোমার প্রসাদে আর কঙ্কের প্রসাদে।
না জীবেক মল্ল আজি, পড়িল প্রমাদে।।
এত বলি রঙ্গসভা মধ্যে দাণ্ডাইল।
ডাক দিয়া বৃকোদর মল্লেরে কহিল।।
যদি মৃত্যু ইচ্ছা থাকে, যুদ্ধ কর আসি।
প্রাণ ইচ্ছা থাকে যদি, পলাহ প্রবাসী।।
ভীমের বচন শুনি সে মল্ল কুপিল।
মহাপরাক্রম করি ভীমেরে ধরিল।।
পর্ব্বত নাড়িতে কোথা বায়ুর শকতি।
না পারিল চালিবারে ভীম মহামতি।।
ঈষৎ হাসিয়া ভীম ধরে দুই পায়।
অন্তরীক্ষে তুলিলেক ভ্রমাইয়া তায়।।
ক্ষুদ্র মীনে ধরি যথা গ্রাস করে নক্র।
আকাশে ঘুরায় যেন কুম্ভকার-চক্র।।
ঘুরাতে ঘুরাতে ত্যজে মল্ল নিজ প্রাণ।
ফেলাইয়া দিল ভীম যেন লতাখান।।
দেখিয়া অদ্ভূত সবে, মনে চমৎকার।
বিরাট-নৃপতি পান আনন্দ অপার।।
অনেক রতন ভীমে দিল নরপতি।
যাত্রা নিবর্ত্তিয়া গেল যে যার বসতি।।
বার্ত্তা পেয়ে রাজ্যে যত ছিল মল্লগণ।
বৃকোদর সহ আনি সবে করে রণ।।
অনেক মরিল শুনি কেহ না আসিল।
বল্লবের পরাক্রমে রাজা বশ হৈল।।
বড় বড় সিংহ ব্যাঘ্র মত্ত হস্তিগণ।
কৌতুকে ভীমের সহ করাইল রণ।।
নিমেষেতে অনায়াসে মারে বৃকোদর।
কৌতুকে দেখেন রাজা স্ত্রীবৃন্দ ভিতর।।
এইরূপে তথা একাদশ মাস গেল।
সানন্দে পাণ্ডব পঞ্চ অজ্ঞাতে রহিল।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাহার শকতি তাহা বর্ণিবারে পারি।।
শ্রুতমাত্র কহি আমি রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে তাহা সকল সংসার।।
ভারত শ্রবণে সর্ব্ব পাপের বিনাশ।
কাশীরাম দাস কহে, কহিলেন ব্যাস।।
৭. দ্রৌপদীর সহিত কীচকের
সাক্ষাৎ ও মিলন বাঞ্ছা
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ মুনিবর।
অতঃপর কি করিলা পঞ্চ সহোদর।।
মুনি বলে, অবধান কর কুরুনাথ।
একাদশ মাস গত হইল অজ্ঞাত।।
সুদেষ্ণার সেবা কৃষ্ণা করে অনুক্ষণ।
হেনমতে দেখ তথা দৈবের ঘটন।।
কীচক নামেতে বিরাটের সেনাপতি।
এক দিন দ্রৌপদীরে দেখিল দুর্ম্মতি।।
দৃষ্টিমাত্র রূপে তার হৈল বিমোহিত।
দ্রৌপদীর সন্নিকটে হৈল উপনীত।।
বলিতে লাগিল তবে মধুর বচনে।
হের, অবধান কর পূর্ণচন্দ্রাননে।।
মনোহর অঙ্গ তব অনঙ্গ মোহিনী।
নিরুপম অঙ্গ তব প্রথম যৌবনী।।
হেথায় আছহ, কভু নাহ আমি জানি।
এ রূপ যৌবন কেন নষ্ট কর ধনি।।
তোমার অঙ্গের শোভা সুর-মন লোভে।
এ সব ভূষণ নাহি তব অঙ্গে শোভে।।
দেখিয়া তোমারে মন মজিল আমার।
কামবাণে দহে প্রাণ করহ উদ্ধার।।
গৃহ দারা পুত্র মম যত ধন জন।
সব ত্যজি লইলাম তোমার শরণ।।
সহস্র সহস্র মোর আছে নারীগণ।
দাসী হয়ে সেবিবেক তোমার চরণ।।
রত্ন-অলঙ্কার যত লোক মনোহর।
যথা ইচ্ছা বিভূষণ কর কলেবর।।
রত্ন-মন্দির শয্যা, রত্ন-সিংহাসন।
রত্ন-আভরণ পর, শুনহ বচন।।
সবার উপরে তুমি হবে ঠাকুরাণী।
যদি না রাখহ ধনী অধীনের বাণী।।
এখনি ত্যজিব প্রাণ তোমা বিদ্যমান।
এই দেখ হইয়াছে কণ্ঠাগত প্রাণ।।
কীচকের বাক্যে কৃষ্ণা কম্পে কলেবর।
ধর্ম্মেরে স্মরিয়া দেবী করিলা উত্তর।।
সৈরন্ধ্রী আমার জাতি, বীভৎসরূপিণী।
আমারে এমত কভু না শোভে কাহিনী।।
এ সকল কহ নিজ কুল-ভার্য্যাগণে।
বংশবৃদ্ধি হবে যাতে, থাকিবে কল্যাণে।।
পরদারে লোভে কৈলে নাহিক মঙ্গল।
জীয়ন্তে অখ্যাতি ঘোষে পৃথিবী মণ্ডল।।
যতেক সুকৃতি তার সব নষ্ট হয়।
পরশ করিলে মাত্র হয় আয়ুক্ষয়।।
পুত্র দারা শোক কষ্ট দরিদ্র লক্ষণ।
অল্পকালে দণ্ড তারে করয়ে শমন।।
সকল বিনাশ হয় পরদারা প্রীতে।
কভু ত্রাণ নাহি তার নরক হইতে।।
পরদারা আমি, তাহা জানহ আপনে।
পাপদৃষ্টি মোর প্রতি কর কি কারণে।।
গন্ধর্বব আমার পতি যদ্যপি দেখিবে।
কুটুম্ব সহিত তোমা সবংশে মারিবে।।
পঞ্চ গন্ধর্ব্বের আমি করি যে সেবন।
অনুক্ষণ রাখে মোরে সেই পঞ্চ জন।।
কালরাত্রি পোহাইল আজি যে তোমারে।
তেঁই হেন দুষ্ট ভাষা কহিছ আমারে।।
তুমি যে এমত ভাষা আমারে কহিলে।
ধরিল যমের দূত আজি তব চুলে।।
সুবুদ্ধি পণ্ডিত যেই জ্ঞানবন্ত জন।
পরস্ত্রী দেখিলে হেঁট করয়ে বদন।।
দৌপদীর বাক্য শুনি কীচক দুঃখিত।
নৈরাশ্য আঘাতে হয় অত্যন্ত পীড়িত।।
তাহার ভগিনী বিরাটের রাজরাণী।
তার স্থানে কহে গিয়া সবিনয় বাণী।।
অচেতন অঙ্গ কম্পে সঘনে নিশ্বাস।
কহিতে না পারে, কহে অর্দ্ধ অর্দ্ধ ভাষ।।
ভগিনী নিকটে যাহা বলা নাহি যায়।
কহিতে লাগিল তাহা লজ্জা নাহি পায়।।
দেখহ ভগিনী মোর বাহিরায় প্রাণ।
যদি মোরে চাহ শীঘ্র কর পরিত্রাণ।।
সৈরন্ধ্রী আছয়ে যেই তোমার সদনে।
তারে মোর পত্নী করি দেহ এইক্ষণে।।
না দিলে সোদর হত্যা হইবে তোমার।
এখনি জানিবে প্রাণ যাইবে আমার।।
মধুর বচনে কন বিরাটের রাণী।
কেন হেন কহ ভাই অনুচিত বাণী।।
ছার দাসী লাগি কেন ত্যজিবে জীবন।
দিবার হইলে আমি দিতাম এখন।।
অভয় দিয়াছি আমি, লয়েছে শরণ।
দুষ্টমতি নহে সেই, বুঝিয়াছি মন।।
চক্ষু মেলি নাহি চাহে পুরুষের পানে।
তব ভার্য্যা হৈতে তারে কহিব কেমনে।।
করিছে গন্ধর্ব্ব পঞ্চ তাহার রক্ষণ।
শান্ত হও, ত্যজ ভাই সৈরন্ধ্রীতে মন।।
কীচক বলিল, শুন গন্ধর্ব্ব কি ছার।
কাহার শকতি হয় অগ্রেতে আমার।।
পঞ্চ গন্ধর্ব্বেতে রক্ষা করে বলি কয়।
সহস্র গন্ধর্ব্ব হৈলে নাহি করি ভয়।।
নষ্টা স্ত্রী প্রকৃতি কভু নাহি জান তুমি।
নষ্টা স্ত্রীলোকেরে ভালমতে জানি আমি।।
মুখেতে সতীত্ব কহে, অন্তরেতে আন।
সেইমত সৈরন্ধ্রীতে কর অনুমান।।
যদি মোরে চাহ, তবে বল শীঘ্রগতি।
সেবিকারে কর ভয়, সোদরে অপ্রীতি।।
রাণী বলে, যত কহ, মোহেব বশেতে।
সতী প্রতি হে বাণী কহিব কিমতে।।
সৈরন্ধ্রী ইচ্ছিয়া, নিজ মরণ ইচ্ছিলে।
সেই হেতু ভগিনীরে এ কথা কহিলে।।
নিশ্চয় নিকট মৃত্যু দেখি যে তোমার।
যাহ তুমি দ্রুতগতি আপন আগার।।
আহারাদি কর গিয়া আপনার ঘরে।
সৈরন্ধ্রী পাঠাব সুধা আনিবার তরে।।
শান্তি কথা সব তারে কহিবে প্রথম।
শান্তিতে ভজিলে হয় সকল উত্তম।।
এত শুনি শীঘ্র গৃহে করিল গমন।
যা বলিল ভগ্নী, তাহা করিল তখন।।
তবে কতক্ষণে বিরাটের পাটরাণী।
সৈরন্ধ্রীরে ডাকি কহে সুমধুর বাণী।।
ক্রীড়ায় ছিলাম আমি, তৃষ্ণায় পীড়িত।
ভ্রাতৃগৃহ হৈতে সুধা আনহ ত্বরিত।।
সুদেষ্ণার বাক্য শুনি যেন বজ্রাঘাত।
ভয়েতে কাঁপেন কৃষ্ণা যেন রম্ভাপাত।।
কৃষ্ণা বলে , সূতপুত্র নির্লজ্জ দুর্ম্মতি।
তার পাশে যেতে মোরে না বলহ সতি।।
প্রথমে তোমার স্থানে করেছি নির্ণয়।
রাখিলে আপন গৃহে করিয়া অভয়।।
আপন বচন দেবী করহ পালন।
সুধা আনিবারে তথা যাক অন্য জন।।
আর কোন কর্ম্মে আজ্ঞা কর রাজরাণী।
শ্রমসাধ্য হলেও তা পালিব এখনি।।
শুনিয়া সুদেষ্ণা কহে ক্রোধে আরবার।
প্রেষিণী নারীর কেন এত অহঙ্কার।।
যথায় পাঠাব, তথা করিবে গমন।
বিশেষে বিশ্বস্ত তুমি, বলি সে কারণ।।
যাহ শীঘ্রগতি, সুধা আনহ ত্বরিতে।
এত লি সুধাপাত্র তুলি দিল হাতে।।
এত শুনি দ্রৌপদীর চক্ষে বহে নীর।
করযোড়ে প্রণমিল দেবতা মিহির।।
সূর্য্যপানে চাহি দেবী করেন স্তবন।
দুঃসহ সঙ্কটে দেব করহ তারণ।।
পাণ্ডুপুত্র বিনা মম অন্যে নাহি মতি।
কীচকের স্থানে মোরে কর অব্যাহতি।।
মুহূর্ত্তেক সূর্য্যস্তব দ্রৌপদী করিল।
কৃষ্ণা রাখিবারে দেব রক্ষগণ দিল।।
কৃষ্ণাতে সমর্থ যেন না হয় কীচক।
অলক্ষিতে যাহ সঙ্গে রাক্ষস রক্ষক।।
দুঃখেতে কাতরা অতি দ্রূপদ-নন্দিনী।
ব্যাঘ্র স্থানে যেতে যথা ডরায় হরিণী।।
দূর হৈতে মূঢ়মতি দেখি দ্রৌপদীরে।
প্রাসাদ হইতে ভূমে নামিল সত্বরে।।
সমুদ্র তরিতে যেন পাইল তরণী।
কৃষ্ণারে চাহিয়া বলে সুমধুর বাণী।।
আজি সুপ্রভাত মোর হইল রজনী।
তেঁই মোরে কৃপা করি আসিলে আপনি।।
এই গৃহ ধন জন সকলি তোমার।
দিব্য বস্ত্র পর তুমি,দিব্য অলঙ্কার।।
কৃষ্ণা বলে, তব ভগ্নী হৈল পিপাসিত।
সুধা দেহ লয়ে আমি যাইব ত্বরিত।।
কীচক বলিল, কেন বলহ এমন।
তোমার আজ্ঞায় সুধা লবে অন্য জন।।
কষ্ট গেল, শুভ তব হইল এখন।
সহস্র সহস্র দাসী সেবিবে চরণ।।
আসি বৈস তুমি এই রত্ন সিংহাসনে।
এত বলি ধরিতে চলিল সেইক্ষণে।।
কীচকের দুষ্টাচার দেখিয়া পার্ষতী।
ভূমিতে ফেলিয়া পাত্র ধায় শীঘ্রগতি।।
অন্তঃপুরে গেলে দুষ্ট করিবেক বল।
ভাবিয়া চলিলা দেবী রাজ সভাস্থল।।
পাছু পাছু ধেয়ে যায় কীচক দুর্ম্মতি।
সভামধ্যে চুলে ধরি ক্রোধে মারে লাথি।।
সূর্য্য অনুচর সেই অলক্ষিতে ছিল।
কীচকে ধরিয়া বলে ভূমিতে পাড়িল।।
মূল কাটা গেলে যথা বৃক্ষ পড়ে তলে।
অচেতন হয়ে দুষ্ট পড়িল ভূতলে।।
রাজা সহ পাত্র মিত্র বসেছে সভায়।
সবে দেখে, দ্রৌপদীরে প্রহারিল পায়।।
সভায় বসিয়াছিল বীর বৃকোদর।
দুই চক্ষু রক্তবর্ণ, কম্পিত অধর।।
জ্বলন্ত অনলে যেন ঘৃত দিল ঢালি।
দেখিল যে অপমান পাইল পাঞ্চালী।।
নয়ন যুগলে অগ্নিকণা বাহিরায়।
দুপাটী দশন চাপি উঠিল সভায়।।
সম্মূখে আছিল বৃক্ষ লইবারে যায়।
অনুমতি লইবারে ধর্ম্মপানে চায়।।
অঙ্গুলি নাড়িয়া ধর্ম্ম চক্ষুতে চাপিল।
অধোমুখে হয়ে ভীম সভাতে বসিল।।
স্বামীগণ সব বসি দেখে চারি পাশে।
ঊর্দ্ধশ্বাসে কান্দে কৃষ্ণ, কহ অর্দ্ধভাষে।।
ধর্ম্মাসনে বসি আছ মৎসের ঈশ্বর।
বিনা অপরাধে মোরে মারিল বর্ব্বর।।
দাসীরে মারিতে নারে রাজার সভায়।
তোমা বিধ্যমানে মোরে প্রহারিল পায়।।
দুষ্ট লোকে রাজা দণ্ড নাহি করে যদি।
তবে অল্পকালে তারে দণ্ড দেন বিধি।।
অনাথা দেখিয়া মোরে দুষ্ট দুরাশয়।
চুলে ধরি মারিলেক, নাহি ধর্ম্মভয়।।
ন্যায়মত রাজা যদি পালে প্রজাগণ।
বহুকাল থাকে সেই ইন্দ্রের ভুবন।।
ন্যায় না করিয়া যদি উপরোধ করে।
অধোমুখ হয়ে পড়ে নরক দুস্তরে।।
দান যজ্ঞ আদি কর্ম্ম সব ব্যর্থ যায়।
এমন বিধির বিধি, শাস্ত্রে হেন কয়।।
কীচক পড়িয়াছিল হয়ে অচেতন।
সচেতন কর, আজ্ঞা করিল রাজন।।
পিতা প্রতি কহে তবে বিরাট নন্দন।
রাজধর্ম্ম রাজা নাহি করিলা পালন।।
বিনা অপরাধে আসি মারিল সভায়।
রাজদণ্ড নাহি দিলে চোর-সভা প্রায়।।
সবাই অধর্ম্মী বসিয়াছ যত জন।
ধর্ম্ম ভয় নাহি, তেঁই না কহ বচন।।
এত শুনি সদুত্তর করে মৎস্যভূপ।
পরোক্ষে দোঁহার দ্বন্দ্ব না জানি কিরূপ।।
না জানিয়া না শুনিয়া কহিব কেমনে।
কি হেতু তোমরা দ্বন্দ্ব কর দুই জনে।।
বিরাটের হেন বাক্য শুনি যাজ্ঞসেনী।
রোদন করিয়া কহে শিরে কর হানি।।
পদাঘাতে মৃতবৎ করে শত্রুগণ।
দেব দ্বিজগণ প্রিয়, বড় প্রিয় রণে।।
সে সব জনের আমি মানসী মহিষী।
সূতপুত্র মোরে পদে প্রহারিল আসি।।
যাঁর ধনুর্ঘোষে তিন লোকে কম্প হয়।
এক রথে যে করিল তিন লোক জয়।।
তাঁর ভার্য্যা হই আমি, দেখিয়া অনাথ।
সূতপুত্র দুষ্ট মোরে করে পদাঘাত।।
বল বুদ্ধি তা সবার কোথাকারে গেল।
মোর এত অপমান নয়নে দেখিল।।
বলিতে লাগিল তবে যত সভাজন।
ভাল কর্ম্ম না করিল সূতের নন্দন।।
সাক্ষাতে সৈরন্ধ্রী দেবকন্যা-স্বরূপিণী।
হেন অঙ্গে পদাঘাত অনুচিত বাণী।।
তবে ধর্ম্ম কহিছেন কঙ্ক নামধারী।
সৈরন্ধ্রী না কর খেদ, যাও অন্তঃপুরী।।
ধর্ম্মশীল মৎস্যরাজ ডরে পললোকে।
উপরোধ করি ক্ষমা করিল কীচকে।।
দেখিতেছে গন্ধর্ব্বেরা তব পতিগণ।
সময় বুঝিয়া ক্ষমা করিল এখন।।
কালেতে কীচকে তারা দণ্ডিবে উচিত।
কীচক হইতে কিছু নাহি হও ভীত।।
দুঃখিনী সমান কেহ কান্দহ সভায়।
আত্মপাপে দুঃখ পাও, কি দোষ রাজায়।।
কৃষ্ণা কহে, সভাসদ কহিলে প্রমাণ।
আত্মপাপে দুঃখ মোর কে করিবে আন।।
এত বলি দুই চক্ষু কেশেতে মুছিল।
কেশ বিঘর্ষণে কত শোণিত স্রাবিল।।
ভর্ত্তৃ-আজ্ঞা পেয়ে কৃষ্ণা যান অন্তঃপুরী।
যথায় আছয়ে নারী কেকয়-কুমারী।।
সুদেষ্ণার আগে দেবী কান্দিতে লাগিল।
শাঠ্যেতে সুদেষ্ণা তারে সম্ভ্রমে পুছিল।।
কে তোমার করিলেক এতেক দুর্গতি।
সমূলে বিনাশ পাবে সেই দুষ্টমতি।।
নিঃশ্বাস ছাড়িয়া কহে সৈরন্ধ্রী-রূপিণী।
জানিয়া কপট কেন কর রাজরাণী।।
সুধা আনিবারে ভ্রাতৃগৃহেতে পাঠালে।
কত বা কহিব তাহা, যত দুঃখ দিলে।।
রাজাসহ পাত্র মিত্র দেখেছে সভায়।
কেশে ধরি তব ভ্রাতা মারিল আমায়।।
যথোচিত তার শাস্তি পাবে দুষ্টমতি।
আজি কিম্বা কালি যাবে যমের বসতি।।
আজি হৈতে ত্যজ আমা ভ্রাতার জীবন।
কর আয়োজন তার শ্রাদ্ধের কারণ।।
এত বলি নিজ স্থানে গেলেন পাঞ্চালী।
জলে প্রবেশিয়া সব ধুইল রক্ত ধূলী।।
পরপুরুষের স্পর্শে যেই আচরণ।
বিধানে দ্রৌপদী তাহা করিল তখন।।
পুনঃ পুনঃ কান্দে কৃষ্ণা নিজ দুঃখ স্মরি।
হেনমতে গেল তবে অর্দ্ধেক শর্ব্বরী।।
ক্ষুধা নিদ্রা নাহি, দেবী করে অনুমান।
এ দুঃখ সাগর হৈতে কে করিবে ত্রাণ।।
না পারিবে বৃকোদর বিনা অন্য জন।
চিন্তিয়া ভীমের পাশে করেন গমন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৮. ভীমের সহিত দ্রৌপদীর কীচক বধের মন্ত্রণা
বিরাট রন্ধনগৃহে ভীমের শয়ন।
নিদ্রা যায় বৃকোদর হয়ে অচেতন।।
সঙ্কেতে বলেন দেবী চাপি দুই পায়।
উঠ উঠ, কত নিদ্রা যাও মৃতপ্রায়।।
হীনজন সাধ্যমত আপন ভার্য্যারে।
প্রাণপণে করি রক্ষা সঙ্কটেতে তারে।।
সভামধ্যে যত মম অপমান কৈল।
সিংহের রমণী লৈতে শৃগাল ইচ্ছিল।।
চরণ চাপিতে ভীম হন জাগরিত।
দ্রৌপদী কাতর দেখি উঠেন ত্বরিত।।
কহ ভদ্রে, এত রাত্রে কেন আগমন।
দুঃখিতের প্রায় দেখি মলিন বদন।।
যে কথা কহিতে আছে, শীঘ্র কহ মোরে।
কেহ পাছে দেখে ‍শুনে, যাহ নিজ ঘরে।।
ভীমবাক্য শুনি আরো বৃদ্ধি পায় দুঃখ।
নয়নে সলিল পড়ে, কৃষ্ণা অধোমুখ।।
ভীম বলে, কহ প্রিয়ে কি হেতু শোচন।
কি দুঃখ তোমার কহ করিব মোচন।।
এত শুনি সকরুণে বলেন পার্ষতী।
কি দুঃখ শোচন, যার যুধিষ্ঠির পতি।।
জানিয়া শুনিয়া কেন জিজ্ঞাসিছ মোরে।
আপনার দুঃখ কিবা বলিব তোমারে।।
হস্তিনায় দুঃশাসন যতেক করিল।
কুরুসভা মধ্যে সবে বসিয়া দেখিল।।
একবস্ত্রা পরিধানা আমি রজঃস্বলা।
কেশে ধরি আনিবেক করিয়া বিহুলা।।
তদন্তরে ‍অরণ্যেতে দুষ্ট জয়দ্রথ।
বলে ধরি লয়ে গেল পাপিষ্ঠ উন্মত্ত।।
দ্বাদশ বৎসর বনে দুঃখে বঞ্চি শেষে।
মৎস্যদেশে সুদেষ্ণার দাসী হৈনু এসে।।
গোরোচনা চন্দনাদি ঘষি নিরন্তর।
দেখ দেখ কলঙ্কিত হৈল দুই কর।।
সে সব দুঃখের কথা নাহি করি মনে।
তোমা সবা দুঃখ দেখি ভুলি ক্ষণে ক্ষণে।।
বিনা অপরাধে মোরে কীচক দুর্ম্মতি।
সবার সাক্ষাতে মোরে মারিলেক লাথি।।
এ ছার জীবনে মোর নাহি প্রয়োজন।
এত লঘু হয়ে জীব কিসের কারণ।।
রাজকন্যা হয়ে মোর সমান দুঃখিনী।
স্বামীর জীয়ন্তে কেহ, না দেখি, না শুনি।।
আজি যদি কীচকেরে তুমি না মারিবে।
নিশ্চয় আমার বধ তোমারে লাগিবে।।
গরল খাইব কিংবা প্রবেশিয়া জলে।
প্রভাতে মরিব আমি কীচকে দেখিলে।।
নিত্য আসে দুরাচার আমার নিলয়।
মোর ভার্য্যা হও বলি অনুক্ষণ কয়।।
সৈরন্ধ্রী বলিয়া মোরে করে উপহাস।
ধিক্ মোর ছার প্রাণে, আর কিবা আশ।।
হস্ত-সুখে নরপতি দেবন খেলিল।
যাঁহার কর্ম্মেতে এত দুঃখ উপজিল।।
এমন করেছে কোন্ রাজা কোন্ দেশে।
সবান্ধবে রাজ্য ত্যজি অরণ্যে প্রবেশে।।
কোটি কোটি গজ বাজী গবী গৃহবাস।
সব ত্যজি এবে হৈল বিরাটের দাস।।
মূঢ় লোক থাকে যথা কর্ম্ম ধ্যান করি।
সেইমত বসি আছ, নিল সব অরি।।
নিরবধি সেবে দশ সহস্র সুন্দরী।
অতিথি সেবনে দশ সহস্রক নারী।।
যত অন্ধ, যত খঞ্জ আশ্রমেতে থাকে।
লক্ষ রাজা দাণ্ডাইয়া থাকয়ে সম্মুখে।।
দুষ্ট দ্যূতে হরিলেক এতেক সম্পদ।
আজ বিরাটের দাস পেয়ে কঙ্কপদ।।
অতুল গাণ্ডীবধারী বীর ধনঞ্জয়।
এক রথে করিলেক ত্রৈলোক্য বিজয়।।
ইন্দ্র জিনি করিলেক ঐলোক্য বিজয়।
দৈত্যে মারি নিষ্কন্টক কৈল দেবগণ।।
বজ্রঘাত ডাকে যার ধনুর নির্ঘোষে।
কন্যাগণ মধ্যে থাকে নপুংসক বেশে।।
মাথায় কিরীট যার সূর্য্যপ্রভা ‍জিনি।
সে মস্তকে হের আজি লম্ববান বেণী।।
দ্রুপদের কন্যা, ধৃষ্টদুন্নের ভগিনী।
পঞ্চ স্বামী ভজি তবে হৈনু অনাথিনী।।
বজ্রের অধিক মোর কঠিন শরীর।
তেঁই এত কষ্টে প্রাণ না হয় বাহির।।
এত বলি কান্দে দেবী মুখে দিয়া কর।
নেত্রনীরে তিতিল কৃষ্ণার কলেবর।।
কৃষ্ণার ক্রন্দন দেখি কান্দে বৃকোদর।
করপদ কাঁপে ঘন, কাঁপে ওষ্ঠাধর।।
ধিক্ মোর বাহুবল, ধিক্ ধনঞ্জয়।
তোমার এতেক কষ্ট দেখি প্রাণ রয়।।
আমারে কি বল কৃষ্ণা, আমি কি করিব।
আত্মবশ হৈলে কেন এত দুঃখ পাব।।
যেখানে তোমারে দুষ্ট মারিলেক লাথি।
সেইখানে পাঠাতাম যমের বসতি।।
সভাসহ মারিতাম নৃপতি সহিতে।
কাহারে না রাখিতাম অন্যেরে কহিতে।।
বিদিত হইলে পুনঃ যাইতাম বন।
এত অপমান অঙ্গে হয় কি সহন।।
কটাক্ষে চাহিয়া মোরে রাজা মানা কৈল।
সে কারণে দুরাচার কীচক বাঁচিল।।
যুধিষ্ঠির বাখ্য আমি লঙ্ঘিতে না পারি।
নহিলে এ গতি কেন হইবে সুন্দরী।।
ইন্দ্রের অধিক সুখ শত্রুগণে দিয়ে।
এত দুঃখ হৈল শুধু তাঁর বাক্যে রয়ে।।
সভামধ্যে করিলেক যত দুঃশাসন।
মৃত্যু ইচ্ছা হয় তাহা করিলে স্মরণ।।
সে সকল অপমান বসি দেখিলাম।
যুধিষ্ঠির আজ্ঞা লাগি সব সহিলাম।।
ক্রন্দন সম্বর দেবি, দুঃখ হৈল ক্লেশ।
কহিলে যে, মোর সম দেখি ধরণী।।
তোমা হৈতে দুঃখ পাইয়াছে বহুতর।
কহিব সে সব কথা, অবধান কর।।
ছিলেন বৈদেহী সীতা জনক দুহিতা।
লক্ষ্মী অবতার হন রামের বনিতা।।
চৌদ্দ বর্ষ হেতু বনে গমন করিল।
ফল মূলাহার করি কষ্টেতে বঞ্চিল।।
অরণ্যে হরিয়া লয় দুষ্ট দশানন।
বহু কষ্ট দিল তথা রাক্ষস দুর্জ্জন।।
অনাহারে ক্ষীণ তনু অস্থি-চর্ম্ম-সার।
নিত্য নিশাচরীগণ করিত প্রহার।।
এত কষ্ট সহিলেন জনক কুমারী।
সীতা উদ্ধারিলা রাম রাবণেরে মারি।।
অগস্ত্যের ভার্য্যা, রূপে গুণে অনুপাম।
রাজার কুমারী হয়, লোপামুদ্রা নাম।।
তাঁহার যতেক কষ্ট, কহনে না যায়।
বল্মীক-মৃত্তিকা সব বেড়িলেক গায়।।
বহুকাল সেইরূপে কষ্টেতে রহিল।
এত কষ্ট সহি পুনঃ অগস্ত্যে পাইল।।
ভীমপুত্রী দময়ন্তী নলের গৃহিনী।
তাঁহার ঘতেক কষ্ট অদ্ভুত কাহিনী।।
মহাঘোর বনমাঝে ছাড়ি গেল পতি।
ক্রমে ক্রমে গেল পুনঃ বাপের বসতি।।
বহু কষ্ট সহি পুনঃ স্বামীরে পাইল।
কতেক কহিব দুঃখ, যতেক সহিল।।
তুমিও সেমত দুঃখ পাইলে অপার।
ক্ষমা কর অল্প দিন দুঃখ আছে আর।।
তের বর্ষ পূর্ণ হৈতে বিংশতি রজনী।
পুনরপি নিজদেশে হবে ঠাকুরাণী।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশীরাম দাস কহে, শুন কর্ণ ভরি।।
৯. কীচক বধ
কৃষ্ণা বলে, যা বলিলে সব আমি জানি।
আজি রক্ষা পেলে, পিছে হব ঠাকুরাণী।।
যদি তুমি কীচকে না দিবে আজি দণ্ড।
লোকে কবে, সৈরন্ধ্রী যে কহিয়াছে ভণ্ড।।
আমি কহিয়াছি সর্ব্বলোকের গোচর।
আমার আছয়ে পঞ্চ গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।।
গন্ধর্ব্বের নাম শুনি করে উপহাস।
বলে, লক্ষ গন্ধর্ব্বেরে করিব বিনাশ।।
সকল শোভিল তার যতেক কহিল।
এত অপমান করি দণ্ড না পাইল।।
প্রভাত হইলে পুনঃ দ্বারেতে আসিবে।
পরিহাস করি মোরে বচন কহিবে।।
সে বাক্য শুনিতে মোরে যেতে বল ঘরে।
এখনি ত্যজিব প্রাণ তোমার গোচরে।।
জয়দ্রথ ভয় হৈতে করিলে উদ্ধার।
জটাসুর বিনাশিয়া কৈলে প্রতিকার।।
এখন কীচক-ভয়ে কর পরিত্রাণ।
তোমা বিনা রাখে ইথে, নাহি দেখি আন।।
যুধিষ্ঠির আজ্ঞা হেতু বিচারিছ চিতে।
আজ্ঞা করেছেন তিনি কীচকে দণ্ডিতে।।
তখনি বিদিত হৈত পূর্ণ সভামাঝ।
ধর্ম্মভয় করি ক্ষমা করে মহারাজ।।
এত শুনি চিন্তি ভীম বলিল বচন।
না কর ক্রন্দন দেবি স্থির কর মন।।
এত বলি ক্রোধে ভীম কহেন তখন।
কীচকে অবশ্য আমি করিব নিধন।।
সময় করহ এক কিন্তু তার সনে।
উপায়ে মারিব, যেন কেহ নাহি জানে।।
আজিকার মত তুমি যাহ নিজালয়ে।
কালি প্রাতে তার সঙ্গে করিহ সময়।।
নৃত্যশালে যথা কন্যাগণ নৃত্য শিখে।
রজনীতে শূন্য তথা, কেহ নাহি থাকে।।
তথায় নির্ব্বন্ধ কর শয্যা করিবারে।
সে ঘরে পাঠাব দুষ্টে শমন-আগারে।।
ভীমের আশ্বাস পেয়ে সম্বরি ক্রন্দন।
নয়ন মুছিয়া কৃষ্ণা করিল গমন।।
রজনী প্রভাত হৈল, কীচক উঠিল।
যথা রাজগৃহে কৃষ্ণা শীঘ্রগতি গেল।।
দ্রৌপদীর প্রতি তবে দম্ভ করি বলে।
ধাইয়া যে গেলে তুমি রাজ সভাস্থলে।।
রাজ-বিদ্যমানে তোরে প্রহারিনু লাথি।
কি করিল মোরে বল বিরাট নৃপতি।।
মোর বাহুবলে রাজ্য ভুঞ্জে নরপতি।
কি করিতে পারে মোর, কাহার শকতি।।
ভজহ সৈরন্ধ্রী মোরে, ক্ষম দোষ মোর।
এই দেখ দন্তে তৃণ, দাস হৈনু তোর।।
কৃষ্ণা বলে, তব বশ হইলাম আমি।
আছয়ে গন্ধর্ব্ব কিন্তু মোর পঞ্চস্বামী।।
তাহা সবাকারে বড় ভয় হয় মনে।
এমন করহ, যেন কেহ নাহি জানে।।
নৃত্যশালা রজনীতে থাকে শূন্যাগার।
তথা নিশা তব সঙ্গে করিব বিহার।।
এত শুনি দৃষ্টমতি হৈল হৃষ্টমন।
শীঘ্রগতি নিজগৃহে করিল গমন।।
নানা গন্ধ চন্দনাদি অঙ্গেতে লেপিল।
দিব্য রত্ন অলংকার অঙ্গেতে ভূষিল।।
সৈরন্ধ্রী চিন্তা করি বিরহ-হুতাশে।
ক্ষণে ক্ষণে দিনকর নিরখে আকাশে।।
কতক্ষণে হবে অস্ত দেব দিবাকর।
পুনঃ বাহিরায়, পুনঃ প্রবেশয়ে ঘর।।
হেথা কৃষ্ণা বৃকোদরে কহে সমাচার।
রাত্রিতে আসিবে নৃত্যালযে দুষ্টাচার।।
যথোচিত ফল আজি দিবে তার প্রতি।
প্রভাত না হয় যেন আজিকার রাতি।।
এমতে আসিয়া হৈল সন্ধ্যার সময়।
বৃকোদর আগে চলি গেল নৃত্যালয়।।
অন্ধকার করি বৈসে পালঙ্কের মাঝ।
মৃগ মারিবারে যথা সাজে মৃগরাজ।।
আনন্দিত চিত্ত হয়ে কীচক চলিল।
একক হইয়া, সঙ্গে
১০. কীচকের ঊনশত ভ্রাতা কর্ত্তৃক দ্রৌপদীর
লাঞ্ছন ও ভীমহস্তে তাহাদের নিধন
কীচক মরণে কৃষ্ণা আনন্দিত হয়ে।
সভাপাল প্রতি তবে বলিল ডাকিয়ে।।
মোরে যত দুঃখ দিল কীচক দুর্ম্মতি।
দণ্ড দিল গন্ধর্ব্বেরা, যারা মোর পতি।।
অহঙ্কার করি দুষ্ট গন্ধর্ব্বেরা না মানে।
গন্ধর্ব্বে পারিবে কোথা মানুষ পরাণে।।
এত শুনি ধেয়ে আসে যতেক রক্ষক।
মাংসপিণ্ড প্রায় তথা দেখিল কীচক।।
অপূর্ব্ব দেখিয়া লোক মানিল বিস্ময়।
কেহ বলে কীচক এ, কেহ বলে নয়।।
কোথা গেল হস্ত পদ, কোথা গেল শির।
কুষ্মাণ্ডের প্রায় দেখি কাহার শরীর।।
কেহ বলে, গন্ধর্ব্বেরা মারে এইমত।
বার্ত্তা পেয়ে ধেয়ে আসে ভ্রাতা ঊনশত।।
কীচকে বেড়িয়া সবে করয়ে ক্রন্দন।
ভ্রাতা মিত্র বন্ধু যত স্ত্রী পুরুষগণ।।
এইমতে বন্ধুগণ কান্দিয়া অপার।
অগ্নিসংস্কার হেতু করিল বিচার।।
হেনকালে দ্রৌপদীরে দেখি সেইখানে।
দম্ভ করি দাণ্ডাইয়া আছে বিদ্যমানে।।
ক্রোধে সূতপুত্রগণ বলিল বচন।
এই দুষ্টা হৈতে হৈল কীচক নিধন।।
কেহ বলে, না চাহিও এ দুষ্টার পানে।
কেহ বলে, অসতীরে মারহ পরাণে।।
অগ্নিতে পোড়াও এরে কীচক সংহতি।
পরলোকে কীচকের হইবেক প্রীতি।।
বান্ধিয়া ইহারে শীঘ্র শব সহ লহ।
একবারে গিয়া নৃপতিরে জিজ্ঞাসহ।।
বিরাট নৃপতি শুনি কীচক নিধন।
শোকে দুঃখে ক্ষোভে উচ্চে বিলাপে রাজন।।
কোথায় কীচক বীর মোর সেনাপতি।
তোমার বিহনে মোর হবে কোন্ গতি।।
সৈরন্ধ্রী দুষ্টার হেতু কীচক নিধন।
ক্রোধে নরপতি আজ্ঞা দিল সেইক্ষণ।।
তার মুখ আর নাহি দেখিব কখন।
শীঘ্র করি লহ তারে করিয়া বন্ধন।।
পোড়াহ কীচক সহ জ্বালিয়া অনল।
তবে সে আমার অঙ্গ হইবে শীতল।।
আজ্ঞা পেয়ে দ্রৌপদীর বান্ধিল তখন।
শব সহ লইলেক করিয়া বন্ধন।।
তবে ত দ্রৌপদী দেবী না দেখি উপায়।
আকুল হইয়া অতি কান্দে উভরায়।।
জয় বিজয় জয়ন্ত আর জয়ৎসেন।
জয়দ্বল নাম লয়ে উচ্চেতে ডাকেন।।
দুন্দুভির শব্দ যাঁর ধনুক টঙ্কার।
তিনলোকে শক্তিমান, নাহি শত্রু যার।।
তাঁর প্রিয়া বড় আমি, করিল বন্ধন।
শীঘ্রগতি আসি মোরে করহ মোচন।।
এইমত পুনঃ পুনঃ ডাকে যাজ্ঞসেনী।
রন্ধন গৃহেতে থাকি ভীমসেন শুনি।।
ক্রন্দনের শব্দ শুনি উঠিয়া বসিল।
দ্রৌপদীর রব বুঝি হৃদয় কাঁপিল।।
কেশ বেশ মুক্ত বীর বায়ুবেগে ধায়।
পথাপথ নাহি শব্দ অনুসোরে যায়।।
একলাফে ডিঙ্গাইয়া গড়ের প্রাচীর।
আম্বাসিয়া দ্রৌপদীরে কহে মহাবীর।।
না কান্দে সৈরন্ধ্রী দেবী, আসিল গন্ধর্ব্ব।
এখনি মারিবে দুষ্ট সূতপুত্র সর্ব্ব।।
এত বলি উপাড়িল দীর্ঘ তরুবর।
দণ্ডহস্তে যম যেন ইন্দ্র বজ্রকর।।
সবে বলে, হের ভাই গন্ধর্ব্ব আসিল।
পলাহ পলাহ বলি, সবে রড় দিল।।
নগরের মুখ ধরি ধায় বায়ুবেগে।
পাছে ধায় বৃকোদর সিংহ যেন মৃগে।।
আরে আরে দুষ্টাচার সূতপুত্রগণ।
মনুষ্য হইয়া কর গন্ধর্ব্বে হেলন।।
এত বলি মারে বীর দীর্ঘ তরুবর।
এক ঘায়ে ‍মারে ঊনশত সহোদর।।
অশ্রুপূর্ণমুখী কৃষ্ণা আছিল বন্ধনে।
মুক্ত করি বৃকোদর দিল সেইক্ষণে।।
ভীম বলে, দুঃখ নাহি ভাব গুণবতী।
তোমায় হিংসিয়া দুষ্ট লভিল দুর্গতি।।
আজ্ঞা কর, যাব আমি কেহ পাছে জানে।
করহ গমন তুমি আপনার স্থানে।।
এত বলি চলি গেল বীর বৃকোদর।
অন্তঃপুরে গেল কৃষ্ণা সুদেষ্ণার ঘর।।
রজনী প্রভাতে হৈল, আসে সর্ব্বজন।
রাজারে করিল জ্ঞাত রাজমন্ত্রিগণ।।
কীচকে দহিতে গেল যত ভ্রাতৃগণ।
গন্ধর্ব্বে হাতে সব হইল নিধন।।
সবে মারি সৈরন্ধ্রীরে মুক্ত করি দিল।
সৈরন্ধ্রী পুনশ্চ আসি পুরে প্রবেশিল।।
মৎস্যদেশের আর নাহিক প্রতিকার।
গন্ধর্ব্বের হাতে সবে হইবে সংহার।।
মনোরমা নারী হয় পরমা সুন্দরী।
হেরিলে গন্ধর্ব্ব তারে চলে যাবে মারি।।
শীঘ্র করব নরপতি ইথে প্রতিকার।
হেথা হৈতে দুষ্টা গেলে সবার নিস্তার।।
শুনিয়া বিরাট রাজা ভয়ে ত্রস্ত হৈল।
কীচকেরে দহিবারে লোকে আজ্ঞা দিল।।
অন্তঃপুরে গিয়া রাজা রাণীকে বলিল।
সৈরন্ধ্রী রাখিয়া গৃহে বিপত্তি ঘটিল।।
এখন যেথায় হৈতে যায় যেই মতে।
মোরে নাম নাহি লবে, কহিবে সম্প্রীতে।।
এতদিন ছিলে তুমি আমার সদন।
এখন যথায় ইচ্ছায় করহ গমন।।
তোমা হৈতে বড় ভয় হইল সবার।
বিলম্ব না কর, শীঘ্র হও আগুসার।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
যাহার শ্রবণে ত্রাণ পায় যত নর।।

ConversionConversion EmoticonEmoticon

:)
:(
=(
^_^
:D
=D
=)D
|o|
@@,
;)
:-bd
:-d
:p
:ng

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র