শ্রীমদ্ভগবতগীতার প্রথম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

ধৃতরাষ্ট্র বললেন,“হে সঞ্জয়! আমার পুত্রেরা ও পান্ডব পুত্রেরা ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেত হয়ে তারপর কি করলেন? সঞ্জয় বললেন,“মহারাজ! দুর্যোধন তখন পান্ডব সৈন্যকে ব্যুহিত দেখে আচার্য্য সমীপে গমন-পূর্বক বললেন, হে আচার্য্য! ঐ দেখুন, আপনার শিষ্য ধীমান দ্রুপদ পুত্র পান্ডবদিগের মহতী সেনা ব্যুহিত করেছেন। দুর্যোধন বললেন- পান্ডব পক্ষের সকল মহাধনুর্দ্ধর ও যুদ্ধে ভীমার্জুন সদৃশ- যুযুধান, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্যবান কাশিরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ, নরশ্রেষ্ট শৈব্য, বিক্রান্ত যুধামন্যু, বীর্যবান উত্তমৌজা, সুভদ্র-নন্দন এবং দ্রোপদী-পুত্রগণ রয়েছেন। এরা সকলেই মহারথ। পরন্তু হে দ্বিজোত্তম! আমাদের পক্ষে যে সকল প্রধান প্রধান যোদ্ধা রয়েছেন তা শ্রবণ করুন। যারা আমাদের সৈন্যের নায়ক হয়েছেন, আপনাকে তা অবগত করছি। আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, যুদ্ধ বিজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সৌমদত্ত-পুত্র ভূরিশ্রবা:, জয়দ্রথ ও অন্যান্য বহু শূর আমার নিমিত্তে জীবন পরিত্যগী হয়ে যুদ্ধার্থে কৃতসঙ্কল্প হয়েছেন; সকলেই নানা প্রকার শস্ত্র প্রহরণ-সমর্থ ও যুদ্ধ বিশারদ। আমাদের সৈন্য বহু সংখ্যক ও ভীষ্ম কর্তৃক রক্ষিত এবং ঐ পান্ডদিগের অল্প সৈন্যও ভীম রক্ষিত হওয়াতে সমর্থ বোধ হচ্ছে, অতএব আপনারা সকলেই রণ ভূমির পূর্বাপরাদি যধা যোগ্য স্ব স্ব দিক বিভাগ স্থলে অবস্থিত হয়ে ভীষ্মকে রক্ষা করুন।

প্রতাপবান কুরু পিতামহ বৃদ্ধ ভীষ্ম, রাজা দুর্যোধনের হর্ষো উৎপাদনের জন্য উচ্চৈ: শব্দে শঙ্খ ধ্বনি করলেন। তারপর রণস্থলে সর্বত্র সহসা শঙ্খ, ভেরী, পণব, ঢাক ও গোমুখবাদি হয়ে তুমুল শব্দ সৃষ্টি হলো। পরে শ্বেতাশ্ব-যোজিত মহান রথে অবস্থিত মাধব ও অর্জুন উভেয়েই দিব্য শঙ্খ ধ্বনি করলেন। হৃষিকেশ পঞ্চজন্য এবং ধনঞ্জয় দেবদত্ত শঙ্খ বাদিত করলেন। ভীমকর্মা বৃকোদর পৌন্ড্র নামক মহা শঙ্খ ধ্বনি করলেন। যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামে শঙ্খ, নকুল সুঘোষ শঙ্খ ও সহদেব মণিপুষ্কক শঙ্খ বাজালেন। হে ধরণীপতে! মহাধনুর্দ্ধর কাশিরাজ, মহারথ শিখন্ডী, ধৃষ্টদ্যুন্ম, বিরাট, অপারাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রেরা সকলে ও মহাবাহু সুভদ্রা নন্দন অভিমন্যু, এরা প্রত্যেকেই পৃথক পৃথকর শঙ্খ ধ্বনি করলেন। সেই তুমুল শঙ্খ ধ্বনি ভূমন্ডল ও নভোমন্ডল অনুনাদিত করে কৌরপক্ষীয়গণের হৃদয় বিদারণ করতে লাগল।

হে মহীপাল! কপিধ্বজ রথারূঢ় অর্জুন ধৃতরাষ্ট্র পক্ষীয় যোদ্ধাগণকে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত দেখে শরাসন উদ্যত করত হৃষিকেশকে বললেন,“হে অচ্যুত! যারা যুদ্ধেচ্ছু হয়ে উপস্থত হয়েছেন, তাদেরকে আমি যাতে অবলোকন করতে পারি, তুমি উপভয় পক্ষীয় সেনার মধ্যস্থলে রথ স্থাপন করুন। এই রন সমুদ্যমে আমারে কাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে, কারা যুদ্ধে দুর্বুদ্ধির দুর্যোধনের প্রিয়চিকীর্ষু হয়ে এখানে সমাগত হয়েছেন, সেই সকল যুদ্ধোদ্যতদিগকে আমি নিরীক্ষণ করব। গুড়াকেশ ধনঞ্জয় এরুপ বললে হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যস্থলে রথ স্থাপন করে বললেন, হে পার্থ! ঐ ভীষ্ম দ্রোণপ্রমুখ কৌরবগণ সমবেত হয়েছেন, তা অবলোকন করুন। তখন ধনঞ্জয় উভয় সৈন্যমধ্যে তাঁর পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, শ্বশুর ও মিত্রগণ অবস্থিতি করছে, অবলোকন করত: করুণাপরতন্ত্র ও বিষন্ন হয়ে বাসুদেবকে বললেন, হে বাসুদেব! এ সমস্ত স্বজনগণ যুদ্ধার্থী হয়ে সমাগত হয়েছেন দেখে আমার শরীর অবসন্ন, কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হচ্ছে, মুখ শুষ্ক হচ্ছে, হস্ত হতে গান্ডীব খসে পড়ছে, ত্বক যেন জ্বলে যাচ্ছে। আমি আর কোনভাবে স্থির থাকতে পারছিনা। আমার মন অতিশয় উদভ্রান্ত হয়ে উঠছে। হে কেশব! আমি কেবল অমঙ্গলসূচক বস্তু দর্শন করছি। সমরে এ সমস্ত স্বজনগণকে হত্যা করা শ্রেয়স্কর বোধ হচ্ছে না। হে কৃষ্ণ! আমি আর জয়, রাজ্য এবং সুখের আকাঙ্খা করি না। হে গোবিন্দ! আমার রাজ্য ভোগ বা জীবনের প্রয়োজন কি? যাদের জন্য রাজ্য ভোগ বা সুখাভিলাষ করতে হয়, সেই আচার্য, পিতা, পুত্র, পিতামহ, মাতুল ও পৌত্র প্রভৃতি সকলেই এই যুদ্ধে প্রাণধন পরিত্যাগ করে আমার সম্মুখে উপস্থত হয়েছেন। হে মধুসুদন! ইহারা আমাকে হত্যা করলেও আমি ইহাদিগকে হত্যা করতে ইচ্ছা করি না। হে জনার্দ্দন! ধার্ত্তারাষ্ট্রগণকে নিহত করলে, আমাদের কি প্রীতি লাভ হবে? এই আততায়ীগণকে বধ করলে নি:সন্দেহ আমাদিগকে পাপ স্পর্শ করবে। অতএব, আমাদের স্বজন ধার্তারাষ্ট্রগণকে বধ করা কোন মতেই কর্তব্য নয়। আত্নীয়-স্বজনগণকে বিনাশ করে আমাদের কি সুখ লাভ হবে। এদের চিত্ত নিতান্ত লোভাতুর হয়েছে বলে যেন এরা কুলক্ষয়জনিত দোষ ও মিত্রদ্রোহজনিত পাতক দর্শন করছে না; কিন্ত আমরা কুলক্ষয়ের দোষ দর্শন করেও কি জন্য পাপাচরণ হতে নিবৃত্ত হবো না? কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হয়; কুলধর্ম বিনষ্ট হলে সমস্ত কুল অধর্ম দ্বারা অভিভূত হয়, অধর্ম কর্তৃক কুল অভিভূত হলে কুলস্ত্রীগণ দূষিত হয় এবং কুলস্ত্রী দূষিত হলে বর্ণ সঙ্কর উৎপন্ন হয় এবং এ বর্ণ সঙ্করই কুল ও কুল নাশকদিগের নরকের কারণ। কুলনাশকারীদের পিতৃগণের পিন্ড, উদকক্রিয়া বিনষ্ট হয়; সুতরাং তারা নরকে পতিত হয়ে থাকে। কুলনাশকারীদের বর্ণসঙ্করের কারণ এই সমস্ত দোষ দ্বারা জাতি ও কুলধর্ম উৎসন্ন হয়। শ্রবণ করেছি যে, কুলধর্ম বিনষ্ট হলে মনুষ্যগণের চিরকাল নরকে বাস করতে হয়, হায়! কি দু:খের বিষয়, আমরা এই মহাপাপাচারের অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন হত্যার করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি; আমি প্রতিকারে পরাঙ্মৃখ ও শস্ত্রবিহীন হলে, যদি রাজ্যসুখ লোভে আত্মীয় বিনাশে সমুদ্যত শস্ত্রপাণি ধার্ত্তারাষ্ট্রগণ আমারে বিনাশ করে তা হলেও আমার পক্ষে মঙ্গলই হবে। হে ভূপতে! ধনঞ্জয় এই কথা বলে ধনুর্বাণ পরিত্যাগপূর্বক শোকসন্তপ্তচিত্তে রথে উপবেশন করলেন।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র