২১.হস্তিনায় শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতি মুনি বলে, শুন কুরুবংশ-চূড়ামণি। বৃকদেশে রাত্রি বঞ্চি দেব চক্রপাণি।। প্রাতঃকৃত্য সমাপিয়া আরোহেন রথে। মেলানি মাগিয়া চলিলেন হস্তিনাতে।। বিচিত্র মন্দির, পথে পথে নানা বাস। দেখিয়া বিস্মিত হৈল দেব শ্রীনিবাস।। কোনখানে মুনিগণ বেদ উচ্চারয়। কোনখানে বাদ্যকার সুবাদ্য বাজায়।। নানা রত্ন অলঙ্কার পরি পুষ্পমালা। কোনখানে শিশুগণ করে নানা খেলা।। নগরের প্রজাগণ দিব্য বেশ ধরে। চতুরঙ্গদলে বসিয়াছে পথধারে।। দেখিয়া কহেন কৃষ্ণ ডাকি সাত্যকিরে। পূর্ব্বমত নাহি দেখি হস্তিনা নগরে।। দ্বিতীয় ইন্দ্রের পুরী সম সুশোভন। বড়ই ধর্ম্মাত্মা দেখি হেথা প্রজাগণ।। বুঝি এবে ধৃতরাষ্ট্র ধর্ম্মে মতি দিল। সে কারণে মহোৎসব গীত আরম্ভিল।। সাত্যকি বলিল, নহে ধর্ম্মের কারণ। তোমারে পরীক্ষা করিতেছে দুর্য্যোধন।। লোকমুখে শুনি ভক্তাধীন জনার্দ্দন। পাণ্ডবের বশ তেঁই ভক্তির কারণ।। ভক্তিতে পাণ্ডব বশ করিয়াছে তাঁরে। আমি ভক্তি করি দেখি এবে কিবা করে।। এমত মন্ত্রণা করি যত কুরুগণ। যজ্ঞ মহোৎসব করিয়াছে আরম্ভণ।। ইহা শুনি হাসি হাসি কহে দামোদর। আমার কপট ভক্তি নহে প্রীতিকর।। বিড়ম্বিলে মোরে সেই নিজে বিড়ম্বিবে। এই দোষে যমঘরে অবিলম্বে যাবে।। এত বলি জগন্নাথ করিলা প্রস্থান। নগর মধ্যেতে উত্তরিলেন শ্রীমান।। কৃষ্ণ আগমন শুনি কৌরবের পতি। আগু বাড়াইয়া গিয়া আনে শীঘ্রগতি।। নর্ত্তক চারণ আদি গায়কের গণ। দুঃশাসন সঙ্গে করি আসিল তখন।। চতুরঙ্গ দলে গিয়া বীর দুঃশাসন। আগু বাড়াইয়া শীঘ্র আনে নারায়ণ।। সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ আনিল সভাতে। যথাযোগ্য স্থানে সবে দিলেন বসিতে।। ভক্তি করি দুর্য্যোধন রত্ন সিংহাসনে। সভামধ্যে বসাইল দেব নারায়ণে।। যত দ্রব্য আহরণ করে দুর্য্যোধন। গোবিন্দের অগ্রে লয়ে দিল সেইক্ষণ।। অশ্রদ্ধায় যত দ্রব্য করে সমর্পণ। কোন দ্রব্য না নিলেন তার নারায়ণ।। প্রসঙ্গ করিয়া কহিলেন জনার্দ্দন। আজি কোন দ্রব্যে মোর নাহি প্রয়োজন।। আজি আমি রহি গিয়া বিদুরের বাসে। কালি রাজা মম পূজা করিহ বিশেষে।। ইহা বলি সভা হৈতে উঠি নারায়ণ। সাত্যকির হাত ধরি করেন গমন।। তবে দুর্য্যোধন রাজা উঠি সভা হৈতে। কর্ণ দুঃশাসন মাতুলেরে নিল সাথে।। আনন্দে অমাত্য সহ বসি দুর্য্যোধন। যুক্তি করে কি উপায় করিব এখন।। পাণ্ডবের পক্ষ দেখি দেব নারায়ণ। পাণ্ডবের গতি কৃষ্ণ পাণ্ডব জীবন।। কৃত্যা করি বান্ধি এবে রাখহ নিবাস। দন্ত উপাড়িলে যেন ভুজঙ্গ নিরাশ।। কৃষ্ণ বিনা মরিবেক পাণ্ডু-অঙ্গজনু। জলহীন মৎস্য যেন নাহি ধরে তনু।। দুঃশাসন বলে, যুক্তি নিল মোর মন। গোবিন্দেরে রাখ রাজা করিয়া বন্ধন।। বলিকে বান্ধিয়া যথা ইন্দ্র রাজ্য করে। এই কর্ম্মে তব হিত দেখি যে অন্তরে।। শকুনি বলিল, যুক্তি নিল মোর মন। এই কর্ম্মে সব সুখ দেখি যে রাজন।। পূর্ব্বাপর শাস্ত্রমত আছে হেন নীত। ছলে বলে শত্রুকে না ক্ষমিতে উচিত।। তোমার পরম শত্রু পাণ্ডুর নন্দন। তার অনুগত হয় দেব নারায়ণ।। তারে কৃত্যা করি দোষ নাহিক ইহাতে। বন্ধন করিয়া কৃষ্ণে রাখহ ত্বরিতে।। কর্ণ বলে, ভাল বলে গান্ধার-নন্দন। এই কর্ম্মে তব সুখ হইবে রাজন।। কিন্তু বলভদ্র আদি যত যদুগণ। পাছে আসি যুদ্ধ করে জানিয়া কারণ।। পাণ্ডবের পক্ষ হবে যত যদুগণ। গোবিন্দ বিচ্ছেদে সবে করিবেক রণ।। যাহা হৌক, তারা তব কি করিতে পারে। নিভৃতে বান্ধিয়া তুমি রাখ দামোদরে।। এতেক বলিল যদি রাধার নন্দন। এমত মন্ত্রণা করি প্রীত দুর্য্যোধন।। যত দৃঢ়ঘাতিগণ দ্বারেতে আছিল। নিভৃতে ডাকিয়া আনি সবারে কহিল।। কল্য কৃষ্ণ আসিবেন মোর অন্তঃপুরে। দ্বারকা যাবেন তিনি কহিয়া আমারে।। মহাপাশে শীঘ্র তাঁরে করিয়া বন্ধন। যতনে রাখিবে তাঁরে করিয়া গোপন।। শুনি অঙ্গীকার কৈল দুষ্টমতিগণ। হইল সানন্দ চিত্ত রাজা দুর্য্যোধন।। মহাভারতের কথা অমৃত লহরী। কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।। ২২.বিদুরের গৃহে কুন্তীসহ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার কহেন জনমেজয়, শুন তপোধন। অতঃপর কিবা করিলেন নারায়ণ।। দুর্য্যোধন সভা হৈতে উঠি হৃষিকেশ। কিবা কর্ম্ম করিলেন, কহ সবিশেষ।। মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন। কহিব পুরাণ কথা, করহ শ্রবণ।। সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ চলিয়া সত্বরে। দেখেন বিদুর নাহি আপনার ঘরে।। বিদুর বিদুর বলি ডাকেন শ্রীহরি। বাহির হলেন কুন্তী শব্দ অনুসারি।। গোবিন্দে দেখিয়া কুন্তী আনন্দে পূরিল। পূর্ণিমার চন্দ্র যেন হাতেতে পাইল।। আলিঙ্গিয়া শিরে চুম্বি কান্দে অবিশ্রাম। দুই পায়ে ধরি কৃষ্ণ করেন প্রণাম।। পাদ্য অর্ঘ্য আনি কুন্তী দিল সেইক্ষণে। বসাইল গোবিন্দেরে কুশের আসনে।। গোবিন্দের আগে কুন্তী কান্দে উচ্চৈঃস্বরে। মোর সম ভাগ্যহীন নাহিক সংসারে।। আজন্ম দুঃখেতে মম দহিল শরীর। এত কষ্টে পাপ আত্মা না হয় বাহির।। শিশু পুত্রে রাখি স্বামী স্বর্গবাসে গেল। পুত্রগণ এত কষ্ট চক্ষে না দেখিল।। সঙ্গে গেল ভাগ্যবতী মদ্রের নন্দিনী। আমি সঙ্গে না গেলাম, অধম পাপিনী।। দারুণ পাপিষ্ঠ খল রাজা দুর্য্যোধন। বারে বারে যত দুঃখ দিলেক দুর্জ্জন।। বিষ খাওয়াইল ভীমে নাশিবার তরে। ধর্ম্ম হতে রক্ষা পাইলেক বৃকোদরে।। অনন্তর কপটতা করি পাপমতি। অগ্নিগৃহ করি দিল করিবারে স্থিতি।। তাহাতে পাইল রক্ষা বিদুর কৃপাতে। দ্বাদশ বৎসর দুঃখে ভ্রমিনু বনেতে।। যাঞাতে যে করিলাম বিপ্র আচরণ। বহু কষ্ট পেয়ে তবে গেনু পাঞ্চালেরে। পাঁচটি কুমার গেল ভিক্ষা অনুসারে।। আমার পুণ্যের ফল উদয় হইল। সভামধ্যে লক্ষ্য বিন্ধি দ্রৌপদী পাইল।। পুত্রগণ পক্ষ রাজা দ্রুপদ হইল। দিনকত তথা মাত্র সুখেতে বঞ্চিল।। অনন্তর দেশে এলে খল কুরুপতি। রহিবারে ইন্দ্রপ্রস্থে দিলেক বসতি।। আপন ইচ্ছায় ভাগ দিল যেবা কিছু। তাহাতে সন্তুষ্ট হৈল মোর পঞ্চ শিশু।। ধর্ম্মবলে বাহুবলে সঞ্চিল রতন। পিতৃ-আজ্ঞা ধরি যজ্ঞ করিল সাধন।। দেখিয়া বিভব মোর দুষ্ট দুর্য্যোধন। শকুনির সহ যুক্তি করিয়া দারুণ।। কপট পাশায় জিনি সর্ব্বস্ব লইল। নিয়ম করিয়া বনবাসে পাঠাইল।। যে নিয়ম করে পুত্র সবার অগ্রেতে। তাহাতে হইল মুক্ত ধর্ম্মবল হৈতে।। তপস্বীর বেশ ধরি মম পুত্রগণ। দ্বাদশ বৎসর বনে করিল ভ্রমণ।। এক সম্বৎসর অজ্ঞাতেতে কাটাইল। এত কষ্ট দিয়া তবু দয়া না জন্মিল।। সম্প্রীতে ছাড়িয়া রাজ্য পাপিষ্ঠ না দিল। যুদ্ধ করি মরিবেক এই সে হইল।। যুদ্ধ করিবারে চাহে মোর পুত্র সনে। না জানি কপালে কিবা আছয়ে লিখনে।। এতেক বলিতে শোক বাড়িল অপার। উচ্চৈঃস্বরে কান্দে কুন্তী করি হাহাকার।। মহাভারতের কথা অমৃত সমান। ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত পুরাণ।। ২৩.শ্রীকৃষ্ণের নিকটে কুন্তীর রোদন হা হা ভীম যুধিষ্ঠির, হা হা পুত্র পার্থবীর, সহদেব নকুল তনয়। রূপ গুণ শীলযুতা, হা হা বধূ পতিব্রতা, তোমার বিচ্ছেদে প্রাণ রয়।। বিষম দুর্গম বনে, সঙ্গে নিজ স্বামিগণে, বহুকষ্টে বঞ্চিলে কেমনে। দারুণ দুরন্ত পশু, ব্যাঘ্র সর্প যত কিছু, যক্ষ রক্ষ ভয়ানক স্থানে।। তপস্বীর বেশধারী, যত সব হিংসাকারী, ভাগ্যে পুণ্যে না মারিল প্রাণে। পূর্ব্ব পুণ্যফল হৈতে, রক্ষা হৈল রিপুহাতে, ধর্ম্মবলে আঁচিল জীবনে।। প্রাণের দোসর তুমি, নির্ভয় করিলে ভূমি, সংহারিয়া রাক্ষস দুর্জ্জন। হা হা পুত্র বৃকোদর, মম গোত্রে গোত্রধর, হা হা পার্থ আমার জীবন।। করিয়া খাণ্ডব দাহ, তুষ্ট কৈলে হব্যবাহ, ইন্দ্রের ভাঙ্গিলে মহাভয়। মহা উগ্র তপ করি, তুষ্ট কৈলে ত্রিপুরারি, বাহুযুদ্ধে কৈলে পরাজয়।। এইরূপে পুত্রগণ, মনে করি চতুর্গুণ, কান্দে দেবী ভোজের নন্দিনী। শোকাকুল অতি দীন, শরীর অত্যন্ত ক্ষীণ, মূর্চ্ছা হয়ে পড়িল ধরণী।। দেখি ব্যস্ত হয়ে হরি, তুলিলেন হাতে ধরি, প্রবোধিয়া কহিছেন তাঁরে। শোক ত্যজ পিতৃষ্বসা, গেল তব দুঃখদশা, পুত্রগণ-দুঃখ গেল দূরে।। প্রসন্ন হইল কাল, ধর্ম্ম হবে মহীপাল, আজি কালি হস্তিনা নগরে। আমারে করিয়া দূত, পাঠাইল ধর্ম্মসূত, বুঝাইতে কৌরব-কুমারে।। যদি নাহি শুনে বাণী, ক্রুরমতি কুরুমণি, যদি নাহি দেয় রাজ্য তাঁর। তবে তব পুত্র জয়, ক্রূরবুদ্ধি কুরুচয়, সবংশেতে হইবে সংহার।। বলিলেন যুধিষ্ঠির, শীঘ্র যাহ যদুবীর, জননীরে কহিবে এমতি। হবে দুঃখ অবসান, ধর্ম্ম রাখিবেন মান, অচিরেতে ঘুচিবে দুর্গতি।। এত বলি জগৎপিতা, প্রবোধেন ভোজসুতা, শুনি কুন্তী হৈল হৃষ্টমন। উদ্যোগপর্ব্বের কথা, ব্যাস বিরচিত গাথা, কাশীরাম দাস বিরচন।। ২৪.শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বিদুরের স্তব ও তাঁহার গৃহে শ্রীকৃষ্ণের ভোজন কুন্তী কাছে বসিয়াছিলেন নারায়ণ। নানা কথা আলাপনে অতি হৃষ্টমন।। হেনকালে আইল বিদুর নিজালয়। স্কন্ধ হৈতে ভিক্ষাঝুলি ভূমিতে নামায়।। গৃহে প্রবেশিতে দেখে দেবকী-নন্দন। কহে গদ গদ হয়ে সজল লোচন।। আমার ভাগ্যের কথা কহিতে না পারি। কৃপা করি মম গৃহে আসিলে মুরারি।। কোন দ্রব্য দিয়া আমি পূজিব তোমারে। আছুক অন্যের কাজ, অন্ন নাহি ঘরে।। বড় ভাগ্যহীন আমি, অধম বঞ্চিত। ক্ষমিবে আমারে প্রভু দেখিয়া দুঃখিত।। এত বলি দণ্ডবৎ হয়ে করে স্তুতি। নমো নমো পূর্ণব্রহ্মা জগতের প্রতি।। তুমি আদি তুমি অন্ত তুমি মধ্যরূপ। সকল সংসার প্রভু তোমর স্বরূপ।। নমো নমো আদি ব্রহ্মা মৎস্য-রূপধর। নমো নমো হয়গ্রীব, নমস্তে ভূধর।। নমস্তে বরাহ হিরণ্যাক্ষ-বিদারক। নমো ভৃগুপতিরূপ ক্ষত্রকুলান্তক।। নমো কূর্ম্ম অবতার মন্দার ধারণ। নমস্তে মোহিনীরূপ অসুর মোহন।। নমস্তে নৃসিংহরূপ দৈত্য বিনাশক। নমো রাম অবতার রাবণ নাশক।। নমস্তে বামনরূপ বলিদ্বারে দ্বারী। বাসুদেব নমো জয় নমস্তে মুরারি।। ভবিষ্যতি অবতার, নমো বুদ্ধকায়। নমো কল্কি অবতার, ম্লেচ্ছবিনাশায়।। কি জানি তোমার স্তুতি আমি হীনজ্ঞান। ব্রহ্মা শিব আদি যাঁরে সদা করে ধ্যান।। তুমি সে প্রকৃতিপর দেব নিরঞ্জন। আত্মরূপে সর্ব্বভূতে তোমার গমন।। শিষ্টের পালন কর, দুষ্টের সংহার। এই হেতু জগৎপতি নাম যে তোমার।। কে বলিতে পারে তব গুণ অগোচর। তোমার মহিমা বেদ শাস্ত্রের উপর।। এরূপে বিদুর করে নানাবিধ স্তুতি। প্রসন্ন হইয়া তারে কহেন শ্রীপতি।। পরম মহৎ তুমি সংসার ভিতরে। তব তুল্য ধর্ম্মশীল নাহি চরাচরে।। ভক্তবশ আমি থাকি ভক্তের অধীনে। অধিক নাহিক প্রীতি ভক্তজন বিনে।। মেরুতুল্য রত্ন যে অভক্ত জয় দেয়। তাহাতে আমার তুষ্টি কিঞ্চিৎ না হয়।। অল্প বস্তু দেয় যদি ভক্তি সহকারে। তাহাতে যতেক তুষ্টি, কে কহিতে পারে।। শ্রীহরির স্নেহবাক্য বিদুর শুনিল। প্রতি অঙ্গ পুলকিত কহিতে লাগিল।। কি দিয়া করিব তুষ্ট আমি অভাজন। আপনার গুণে কৃপা কর নারায়ণ।। ভক্তের অধীন তুমি দয়ার সাগর। কৃপা করি পদছায়া দেহ গদাধর।। কৃপা করি মোরে স্নেহ কর হৃষীকেশ। তোমার মহিমা আমি না জানি বিশেষ।। বিদুরের স্তবে তুষ্ট হয়ে নারায়ণ। কৌতুকে কহেন পুনঃ কপট বচন।। বিদুর সে সব কথা হইবে পশ্চাতে। সম্প্রতি কাতর আমি অত্যন্ত ক্ষুধাতে।। স্তবেতে কাহার কবে পূরিল উদর। খাদ্যবস্তু আন কিছু জুড়াক অন্তর।। স্নান করি বসিয়াছি বিনা জলপানে। যে কিছু আছয়ে শীঘ্র আন এইখানে।। শুনিয়া বিদুর গৃহে করিল প্রবেশ। তণ্ডুলের খুদমাত্র আছে অবশেষ।। তাহা আনি দিল পদ্মাপতি পদ্মকর। পদ্মা সহ পদ্মাপতি বান্ধিল অন্তরে।। সন্তুষ্ট হইয়া কৃষ্ণ করেন ভক্ষণ। বিদুর লজ্জিত হয়ে না মেলে নয়ন।। পুনশ্চ বিদুর কহে দেব দামোদরে। আজ্ঞা কর যাই আমি ভিক্ষা-অনুসারে।। নগরে যে পাই ভিক্ষা অতিরিক্ত নয়। এত শুনি হাসি কন দেবকী তনয়।। ভিক্ষার কারণ বহু কৈলে পর্য্যটন। পুনঃ যাবে ভিক্ষাতে, না রুচে মম মন।। যে কিছু পাইলে তাহা করহ রন্ধন। সবে মেলি বাঁটিয়া তা করিব ভক্ষণ।। শুনিয়া বিদুর আজ্ঞা করিল কুন্তীরে। রন্ধন করিয়া কুন্তী দিলেন সত্বরে।। সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ বিদুরের বাসে। ভোজনান্তে আচমন করিলেন শেষে।। তাম্বূল না ছিল ঘরে, দিল হরীতকী। ভক্ষণ করিলা কৃষ্ণ পরম কৌতুকী।। বিদুর সাত্যকি আর দেব নারায়ণ। ইষ্ট আলাপনে করিলেন জাগরণ।। বিদুর বলেন, দেব কর অবধান। কি হেতু হস্তিনাপুরে তোমার প্রয়াণ।। পাণ্ডবের দূত হয়ে এলে অভিপ্রায়ে। ধর্ম্মনীতি বুঝাইতে গান্ধারী-তনয়ে।। তব বাক্য না রাখিবে কভু দুর্য্যোধন। সম্প্রীতে ছাড়িয়া রাজ্য না দিবে দুর্জ্জন।। ভীষ্ম দ্রোণ বুঝাইল ব্যাস মুনিবর। কার বাক্য না শুনিল কৌরব পামর।। গোবিন্দ বলেন, যাহা কহিলে প্রমাণ। না করিবে সম্প্রীতে সে পাণ্ডবে সম্মান।। তথাপিহ লোকধর্ম্মে তরিবার তরে। ধর্ম্ম-আত্মা যুধিষ্ঠির পাঠাইলা মোরে।। পঞ্চ ভাই জন্যে মাগি লব পঞ্চ গ্রাম। এই হেতু আসিলাম দুর্য্যোধন-ধাম।। বিদুর বলেন, দেব এ কথা না কহ। ভালে ভালে শীঘ্রগতি হেতা হতে যাহ।। যে মন্ত্রণা করিয়াছে বলিবারে ভয়। দুষ্ট দুর্য্যোধন আরা রাধার তনয়।। দুঃশাসন সহ দুষ্ট বসিয়া নিভৃতে। যুক্তি করিয়াছে তোমা বান্ধিয়া রাখিতে।। এত শুনি গোবিন্দের ক্রোধে কাঁপে বক্ষ। কুম্ভকার চক্র যেন ফিরে দুই অক্ষ।। অরুণ লোচন ক্রোধে রক্ত বিম্ব জিনি। বলেন বিদুর প্রতি দেব চক্রপাণি।। এত অহঙ্কার করে কুরু পাপকারী। ইহার উচিত শাস্তি দিতে আমি পারি।। মুহূর্ত্তেকে পারি সবা করিতে সংহার। বাতি দিতে কুরুকুলে না রাখিব আর।। গোবিন্দের বাক্যে বিদুরের ভীত মন। করযোড় করি পুনঃ বলেন বচন।। তোমারে বান্ধিতে পারে, কাহার শকতি। ত্রিভুবনে হর্ত্তা কর্ত্তা তুমি জগৎপতি।। ভকতে বান্ধিতে পারে মাত্র ভক্তিপাশে। আপন বন্ধন তুমি লহ অনায়াসে।। যে কালে গোকুলে বাল্যলীলা করেছিলে। একদিন যশোদার ক্রোধ বাড়াইলে।। ক্রোধেতে যশোদা তোমা করিল বন্ধন। মায়াতে মোহিত হয়ে করিলা এমন।। যত দড়ি যশোমতী আনে ক্রোধমনে। বান্ধিতে না আঁটে দুই অঙ্গুলি প্রমাণে।। দেখিয়া মায়ের দুঃখ হৈল তব দয়া। লইলে বন্ধন তুমি ত্যজি নিজ মায়া।। মায়ার পুত্তলী তুমি নানা মায়া জান। আদি নিরঞ্জন তুমি, পূর্ণ ভগবান।। তোমার এতেক ক্রোধ কি হেতু না জানি। আমারে দেখিয়া ক্রোধ ক্ষম চক্রপাণি।। তোমারে বান্ধিতে পারে, আছে কোন্ জন। কিবা অল্পমতি ছার রাজা দুর্য্যোধন।। কি করিতে পারে তোমা, কাহার শকতি। সর্ব্ব অপরাধ ক্ষম দেব জগৎপতি।। বিদুরের বাক্যে শান্ত হৈল নারায়ণ। জল দিলে যথা নিবর্ত্তয়ে হুতাশন।। পুনরপি হাসি হাসি বলে জনার্দ্দন। লঙ্ঘিতে না পারি আমি তোমার বচন।। ক্ষমিলাম কৌরবের দোষ যে সকল। অচিরাতে পাবে দুষ্ট সমুচিত ফল।। খণ্ডিতে না পারি আমি ধর্ম্মের উত্তর। সে কারণে আসিলাম হস্তিনা নগর।। এত বলি ক্রোধহীন হন নারায়ণ। বিদুর প্রবোধ পেয়ে আনন্দিত মন।। নানা কথা আলাপেতে ছিলা তিন জন। কথা শেষে করিলেন সকলে শয়ন।। উদ্যোগপর্ব্বের কথা অমৃত-সমান। ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত-পুরাণ।। কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার। যাহার শ্রবণে হয় ভবসিন্ধু পার।। ২৫.কৌরব সভায় শ্রীকৃষ্ণের পুনরাগমন রজনী বঞ্চিয়া সুখে বিদুরের ঘরে। প্রভাতে উঠিয়া দেব হরিষ অন্তরে।। প্রাতঃক্রিয়া সমাপিয়া শুভযাত্রা করি। বিদুরের সঙ্গে করি চলেন শ্রীহরি।। সাত্যকি চলিল সঙ্গে আর চেকিতান। চারি জন চলি যান কুরু বিদ্যমান।। সভা করি বসি আছে অন্ধ নরপতি। হেনকালে উপনীত দেব জগৎপতি।। কৃষ্ণ-আগমন রাজা জানি সেইক্ষণ। বহু মান্য করি দিল বসিতে আসন।। হেনকালে উপনীত যত সভাজন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ পৃষত-নন্দন।। পঞ্চ ভাই ত্রিগর্ত্ত দেশের নরপতি। আসিল যতেক রাজা সবে মহামতি।। শত ভাই সহ বসি রাজা দুর্য্যোধন। যার যেই আসনেতে বসে সর্ব্বজন।। আসিল যতেক মুনি জানিয়া কারণ। নারদ পুলস্ত্য আর দেবল তপন।। মার্কণ্ড অগস্ত্য বিভাণ্ডক তপোধন। আসিল যতেক মুনি অন্ধের ভবন।। যথাযোগ্য আসনেতে বৈসে মুনিগণ। শুন দুর্য্যোধন রাজা হয়ে একমন।। ধর্ম্ম আত্মা যুধিষ্ঠির ধর্ম্মেতে তৎপর। ধম্ম চিন্তি পাঠাইল তোমার গোচর।। কুলক্ষয় জানি মনে সবে ক্ষমা দিল। বিনয়ে আমাকে সেই এখানে পাঠাল।। যা বলিল ধর্ম্মরাজ, শুন বলি তাই। ভাই ভাই বিরোধেতে প্রয়োজন নাই।। নিয়ম হইল পূর্ব্বে তোমার সাক্ষাতে। নানা কষ্ট ভুঞ্জি মুক্ত হইলাম তাতে।। আমার বিভাগ রাজ্য যে হয় উচিত। তাহা ছাড়ি দিয়া মম সঙ্গে কর প্রীতি।। সভামধ্যে যত কিছু কৈলে অপমান। সে সকল অপরাধে আছি ক্ষমাবান।। সে সকল দুঃখ আমি নাহি করি মনে। অদৃষ্ট যেমন মম, ঘটিল তেমনে।। এইরূপ কহিলন ধর্ম্মের কুমার। ভীম ধনঞ্জয় মাদ্রীপুত্র দুই আর।। যাহা চিত্তে লয়, তাহা কর নরবর। এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র করিল উত্তর।। শুনিলে কি দুর্য্যোধন কৃষ্ণের বচন। যাহা বলি পাঠাইল পাণ্ডুপুত্রগণ।। পাণ্ডবেরা তব কিছু না কর অকার্য্য। উচিত ছাড়িয়া দিতে তাহাদের রাজ্য।। যে নিয়ম করেছিল, হইল মোচন। তবে তার সহ দ্বন্দ্ব কর কি কারণ।। এমত করিলে তোমা না সহিবে ধর্ম্ম। সংসার যুড়িয়া হবে তব অপকর্ম্ম।। পূর্ব্ব অধিকার তার ছিল যত দূর। যত রাজ্য ধন রত্ন ছিল গ্রাম পুর।। তাহা দিয়া প্রীতি কর পাণ্ডবের সনে। নাহি দিলে পরিণামে পাবে দুঃখ মনে।। দুর্য্যোধন বলে, তাত না বুঝিয়া কহ। জীয়ন্তে কি প্রীতি হবে পাণ্ডবের সহ।। নাহি দিব রাজ্য আমি, যুদ্ধ করি পণ। ইহার বিধান এই, শুনহ রাজন।। শক্তি থাকে পাণ্ডবের, করিবেক রণ। যুদ্ধে জিনি আমা সবে লবে রাজ্য ধন।। এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র হইল বিরত। কহিতে লাগিল তবে সভাসদ্ যত।। ভীষ্মবীর বলে আর দ্রোণ মহাশয়। কৃপ অশ্বথামা আর পৃষত তনয়।। কহিল নারদ মুনি ধর্ম্মশাস্ত্রমত। এ কর্ম্ম তোমার রাজা না হয় উচিত।। সংসারে অজেয় পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়। তাহা সহ যুদ্ধ তব উচিত না হয়।। স্বধর্ম্মে থাকিলে হয় জয়ী ত্রিভুবনে। অর্জ্জুনের গুণকর্ম্ম না যায় বর্ণনে।। দেবের অবধ্য কালকেয়াদি মারিল। গন্ধর্ব্বের ভয় হতে তোমারে রাখিল।। নিবাতকবচগণে করিল নিধন। খাণ্ডব দহিয়া করে অগ্নির তর্পণ।। মহাবল যদুগণে সমরে জিনিল। সুভদ্রা জিনিয়া আনি বিবাহ করিল।। দ্রৌপদীর স্বংন্বরে বীর ধনঞ্জয়। এক লক্ষ রাজগণে করে পরাজয়।। বাহুযুদ্ধে পরাজয় করে পশুপতি। একেশ্বর বিজয় করিল সব ক্ষিতি।। ভীমের বিক্রম সবে জান ভালমতে। লক্ষ লক্ষ নিশাচরে মারে মুষ্ট্যাঘাতে।। হিড়িম্ব কির্ম্মীর বক আদি নিশাচর। হেলায় সংহার করিলেক বৃকোদর।। শত ভাই কীচকেরে মারিল নিমিষে। ত্রিভুবন নাহি আঁটে ভীম যদি রোষে।। হেন জন সহ তোমা বিরোধে কি কাজ। অদ্ধরাজ্যে পাণ্ডবেরে দেহ কুরুরাজ।। না দিলে প্রমাদ বড় হইবে তোমার। পাণ্ডবের হাতে হবে সবংশে সংহার।। আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে, পৃথ্বী যদি ভাসে। দিনকর তেজোহীন, সপ্তসিন্ধু শোষে।। ইন্দ্র আদি দেব যদি তব পক্ষ হয়। জিনিতে নারিবে তবু পাণ্ডব সদনে।। বিনয় করিয়া দোষ খণ্ডাহ এক্ষণে।। গলায় কুঠার বান্ধি দন্তে তৃণ করি। শীঘ্রগতি যাহ, যথা ধর্ম্ম অধিকারী।। যত ধন রাজ্য নিলে জিনিয়া পাশাতে। তাহার দ্বিগুণ করি দেহত সাক্ষাতে।। ইন্দ্র প্রস্থে আনি অভিষেক কর। এই কর্ম্মে তব হিত দেখি কুরুবর।। এতেক নারদ মুনি বলিল বচন। বলিল পরশুরাম জানিয়া কারণ।। ব্যাস বুঝাইল কত, না শুনিল কানে। পৌলস্ত্য যে বুঝাইল বেদের বিধানে।। অনন্তর বুঝাইল যত সভাজন। কারো বাক্য না শুনিল গান্ধারী নন্দন।। অদৃষ্ট মানিয়া তবে ধৃতরাষ্ট্র বলে। কালেতে কুবুদ্ধি ফল দুর্য্যোধনে ফলে।। সে কারণে কারো বাক্য না শুনে শ্রবণে। এত শুনি মৌনী হয়ে রহে সভাজনে।। অদৃষ্ট মানিয়া তবে অম্বিকা নন্দন। নিশ্বাস ছাড়িয়া হেঁট করিল বদন।। পুনরপি হাস্যমুখে বলে নারায়ণ। জানিলাম দুর্য্যোধন তোমার যে মন।। অবশেষে বলিলেন যদুবংশপতি। কহি, অবধান কর কুরুকুল-পতি।। অর্দ্ধ রাজ্য ছাড়ি যদি না দিবে রাজন। তোমার অধীন হৈল পাণ্ডুপুত্রগণ।। পঞ্চ পাণ্ডবেরে ছাড়ি দেহ পঞ্চ গ্রাম। সুখে তুমি ভোগ কর এই ধরাগ্রাম।। পাণ্ডব নগর কুশস্থল সিদ্ধিগ্রাশ। ইন্দ্রপ্রস্থ আর যে বারণাবত নাম।। এই পঞ্চ গ্রাম ছাড়ি দেহ পাণ্ডবেরে। দ্বন্দ্বে কার্য্য নাহি রাজা কহিনু তোমারে।। পঞ্চ গ্রাম দিয়া শান্ত কর পঞ্চ জন। পৌরুষ বৈভব যদি বাঞ্ছাহ রাজন।। উভয় কুলের আমি সদা চিন্তি হিত। মম বাক্যে পাণ্ডুপুত্রে করহ সম্প্রীতি।। বনে বনে ভ্রমে পাণ্ডবেরা পঞ্চ জন। বলহীন, কোন মতে ধরয়ে জীবন।। যুদ্ধে অসমর্থ তারা, নারিবে জিনিতে। না হয় উচিত, জ্ঞাতি হহন করিতে।। জ্ঞাতিবধ মহাপাপ, সর্ব্বশাস্ত্রে গণি। সে কারণে উপেক্ষা না কর নৃপমণি।। এতেক বলিল যদি দেব জগৎপতি। পুত্রে দোষী বলি কহে অন্ধ নরপতি।। দুর্য্যোধন ক্রোধে ওঠে আসন হইতে। গোবিন্দে চাহিয়া তবে লাগিল কহিতে।। তীক্ষ্ম সূচী অগ্রদেশে ধরে যত ভূমি। বিনা যুদ্ধে পাণ্ডবেরে নাহি দিব আমি।। প্রতিজ্ঞা করিনু আমি, না হবে খণ্ডন। পশ্চিমে উদয় যদি হয় ত তপন।। আকাশ পড়য়ে ভূমে, পৃথ্বী জলে ভাসে। দিনকর তেজে যদি হয় দ্বিজগণ।। তথাপি প্রতিজ্ঞা মকম না হবে খণ্ডন। পাণ্ডবেরে ছাড়িয়া না দিব রাজ্যধন।। এত শুনি মৌন হয়ে রহে লক্ষ্মীপতি। বলেন ক্ষণেক পরে ধৃতরাষ্ট্র প্রতি।। দূত হয়ে আসিলাম দুই কুল হিতে। শুনিনু অদ্ভুত কথা বিদুর-মুখেতে।। কোন্ দোষে করিলাম শুনহ রাজন। আমারে বান্ধিতে চাহে তোমার নন্দন।। কে কারে বান্ধিতে পারে দেখ বিদ্যামনে। ক্ষমা করি শুধু মাত্র চাহি তোমা পানে।। ক্ষুদ্র মৃগে মারে যথা কেশরী প্রচণ্ড। নাগেরে গরুড় যথা করে খণ্ড খণ্ড।। সেইরূপ দেখি আমি যত কুরুগণে। মুহূর্ত্তে মারিতে পারি যদি করি মনে।। তোমার অপেক্ষা হেতু ক্ষমিয়াছি আমি। নহে কেন পাণ্ডবেরা ভ্রমে বনভূমি।। এত বল উচ্চৈঃস্বরে হাসে নারায়ণ। হাসিতে হাসিতে হৈল আরক্ত লোচন।। কম্পান্বিত কলেবর দেখি লাগে ভয়। দেবমায়া সৃজিলেন দেব দয়াময়।। নিজ অঙ্গে দেখালেন এ তিন ভুবন। দিব্য চক্ষু সব জনে দেন নারায়ণ।। দিব্য চক্ষু পেয়ে সবে একদৃষ্টে চায়। যতেক দেখিল, তাহা কহনে না যায়।। দেবতা তেত্রিশ কোটি দেখে পৃষ্ঠদেশে। নাভিপদ্মে দেখে ব্রহ্মা আছে সবিশেষে।। নারদ বক্ষেতে শোভে দেব তপোধন। নয়নে দেখয়ে একাদশ রুদ্রগণ।। ঊনপঞ্চাশৎ বায়ু অশ্বিনী কুমার। অনন্ত বাসুকি আদি যত নাগ আর।। গোবিন্দের পুরোভাগে করে নানা স্তুতি। তবে আর নানাবিধ দেখয়ে বিভূতি।। স্থাবর জঙ্গম দেখে যত দেহিগণ। গোবিন্দের অঙ্গে দেখে এ তিন ভুবন।। বিশ্বরূপ নিরখিয়া সবে মূর্চ্ছা গেল। গোবিন্দের অগ্রে সবে কহিতে লাগিল।। জগতের কর্ত্তা তুমি, জগতের পতি। সৃজন পালন তুমি, সংহার মূরতি।। অপার মহিমা তব, বেদে অগোচর। নিজ রূপ সম্বরহ দেব গদাধর।। এইরূপে স্তুতি কৈল যত মুনিগণ। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আদি যতেক সুজন।। স্তুতি বশে সুপ্রসন্ন হয়ে জগৎপতি। বিশ্বরূপা মায়া ছাড়িলেন সে বিভূতি।। দুর্য্যোধনে পুনরপি বুঝাইল সবে। কারো বাক্য দুর্য্যোধন না শুনিল তবে।। সভা হৈতে উঠি তবে চলে সর্ব্বজন। নিজস্থানে গেল তবে যত মন্ত্রিগণ।। সাত্যকির হাতে ধরি চলেন শ্রীহরি। যত দ্রব্য দিয়াছিল কুরু-অধিকারী।। কোন দ্রব্য না নিলেন হয়ে ক্রোধমন। শীঘ্রগতি করিলেন রথে আরোহন।। বিস্ময় মানিল ধৃতরাষ্ট্র নরপতি। অনর্থ হইল, বলে ভীষ্ম মহামতি।। মৌনভাবে রহিলেন অম্বিকা-নন্দন। কুন্তীর নিকটে কৃষ্ণ করেন গমন।। সম্ভাষি সবারে, পরে কুন্তীরে নমিয়া। বহু কথা কহিলেন নিকটে বসিয়া।। তাবৎ বৃত্তান্ত সব কহিলেন তাঁরে। চলিলেন চক্রপাণি সম্ভাসি সবারে।। পথে কর্ণ সহ মিলিলেন জনার্দ্দন। কর্ণের সহিত হৈল রহস্য কথন।। কন্যাকালে কুন্তীগর্ভে তোমার উৎপত্তি। তুমি কর্ণ মহাবীর, কুন্তীর সন্ততি।। যুধিষ্ঠির নৃপতির তুমি সহোদর। আপনা না চিন কর্ণ তুমি কি বর্ব্বর।। ধর্ম্মশাস্ত্র পড়িয়াছ, করিয়াছ দান। ব্রাহ্মণ সভাতে করে তোমার বাখান।। তোমার কনিষ্ঠ পাণ্ডবেরা পঞ্চ ভাই। এ হেন সম্বন্ধ কর্ণ বড় ভাগ্যে পাই।। দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র অভিমন্যু আদি। পূজিবে ভৃত্যের সম তোমা নিরবধি।। নকুল অর্জ্জুন সহদেব ভীম বীর। তব পদ ধোয়াইবে রাজা যুধিষ্ঠির।। সুবর্ণ রজত কুম্ভে তব অভিষেকে। রাজকন্যা সেবিবে যে দেখিবে প্রত্যেকে।। পঞ্চজনে দ্রৌপদী যে করিবে সেবন। অগ্নিহোত্র করিবেক ধৌম্য তপোধন।। তোমারে সিঞ্চিবে আজি বিপ্র চারিবেদী। পাণ্ডবের পুরোহিত কুশল-সংবাদী।। যুবরাজ হবে তব রাজা যুধিষ্ঠির। ধবল চামর লয়ে বিচিত্র শরীর।। মস্তকে ধরিবে ছত্র বীর বৃকোদর। রথের সারথি হবে পার্থ ধনুর্দ্ধর।। সুধীর শিখণ্ডী তব হবে আগুসার। এ সব বচন কর্ণ ধরিবে আমার।। বৃষ্ণিবংশ লয়ে তব পিছে যাব আমি। এ সব সম্পদ কর্ণ ভোগ কর তুমি।। বলিলেন এইমত নিজে দামোদর। ভক্তি করি কর্ণ তবে দিলেন উত্তর।। সূর্য্যের ঔরসে জন্ম কুন্তীর উদরে। সূর্য্যের বচনে মাতা বিসর্জ্জিলা মোরে।। সূত মোরে পেয়ে পালে আপনার ঘরে। আমারে পুষিল রাধা যত্ন পুরঃসরে।। স্তন দিয়া পুষিলেন, জানে সর্ব্বজন। সর্ব্বলোকে বলে মোরে রাধার নন্দন।। ধর্ম্মেতে পাণ্ডুর সুত, কুন্তীগর্ভে জাত। যুধিষ্ঠিরে না কহিবে এ সব বৃত্তান্ত।। অনুরোধ করিবেন ধর্ম্ম নৃপবর। আমি পুনঃ সর্ব্বথা না যাব দামোদর।। আমি যদি পাই রাজ্য দিব দুর্য্যোধনে। সত্যভঙ্গ তথাপি না করি, লয় মনে।। দুর্য্যোধন কৈল মোরে বিস্তর পোষণ। রাজ্য ধন দিল দিব্য রতন ভূষণ।। তের বর্ষ ভুঞ্জিলাম রাজ্য আদি সুখ। দুর্য্যোধন প্রসাদেতে নাহি কোন দুঃখ।। করিব নিতান্ত রণ অর্জ্জুন সহিত। প্রতিজ্ঞা করিনু, সর্ব্ব কৌরব বিদিত।। যদ্যপি জানি যে আমি পাণ্ডবের জয়। সবান্ধবে দুর্য্যোধন হইবেক ক্ষয়।। অর্জ্জুনের হাতে হৈবে আমার নিধন। দ্রোণাচার্য্যে মারিবেক দ্রুপদ নন্দন।। ধৃতরাষ্ট্র পুত্র এই শত সহোদর। পাঠাবে শমন ঘরে বীর বৃকোদর।। তথাপিহ না ত্যজিব রাজা দুর্য্যোধনে। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম জান প্রতিজ্ঞা পালনে।। আপনি জানহ কৃষ্ণ সকল রহস্য। সকল কৌরব নাশ হইবে অবশ্য।। যেখানে তোমার নাম, সেইখানে জয়। ইথে অন্যমত নাহি, শুন মহাশয়।। যথা কৃষ্ণ তথা জয়, জানি যে সর্ব্বথা। আমার প্রতিজ্ঞা নষ্ট না হইবে তথা।। কেবল নিমিত্তভাগী এই তিন জন। দুঃশাসন দুর্য্যোধন সুবল-নন্দন।। কৌরব পাণ্ডব-যদ্ধে রুধিবে কর্দ্দম। মরিবে পাণ্ডব হাতে কৌরব অধম।। পাণ্ডব হইবে জয়ী, কুরু পরাজিত। অবিলম্বে জনার্দ্দন হইবে নিশ্চিত।। মঙ্গল না দেখি আমি কৌরবের কাজে। উৎপাত অদ্ভুত দেখি গ্রহগণ মাঝে।। গগণেতে উল্কাপাত নির্ঘাত সহিত। পৃথিবী কম্পিতা হয়, দেখি বিপরীত।। ভয়ানক শব্দ করি কান্দে অশ্ব গজ। অকস্মাৎ খসি পড়ে যত রথধ্বজ।। গৃধ্র পক্ষী কাক বক মূষিক সঞ্চান। কৌরবের পাছে পাছে দেখি বিদ্যমান।। মাংস আর রক্তবৃষ্টি ঊর্দ্ধে বহে বাত। কৌরবগণের মৃত্যু দেখি জগন্নাথ।। দুঃষ্বপ্ন দেখিনু আমি, শুন নায়ায়ণ। অমৃত পায়স ভুঞ্জে পাণ্ডুপুত্রগণ।। পৃথিবী প্রসবে ধর্ম্ম, দেখিয়া এমন। পর্ব্বতে উঠিয়া ভীম করে মহা রণ।। রতন কবচ গায়ে দেখি সুশোভন। পুষ্পমালা গলে শোভে ধবল বসন।। হাতেতে ধবল ছত্র নামে সরোবর। স্বপ্ন আমি দেখিলাম শুন দামোদর।। পাণ্ডব হইবে জয়ী, কুরু পরাজয়। অচিরে হইবে কৃষ্ণ, নাহিক সংশয়।। এত বলি কর্ণ বীর করিল গমন। প্রেমরূপে গোবিন্দেরে দিয়া আলিঙ্গন।। কর্ণবীর গেল যদি আপন ভবন। সৈন্যগণ সহ চলিলেন জনার্দ্দন।। নানাবাদ্য কোলাহলে চলেন ত্বরিত। বিরাট নগরে হইলেন উপনীত।। হরিহরপুরগ্রাম সর্ব্বগুণধাম। পুরুষোত্তম নন্দন মুখটি অভিরাম।। কাশীরাম বিরচিত তাঁর আশীর্ব্বাদে। সদা চিত্তে রহে যেন দ্বিজ পাদপদ্মে।।রি বঞ্চি দেব চক্রপাণি।। প্রাতঃকৃত্য সমাপিয়া আরোহেন রথে। মেলানি মাগিয়া চলিলেন হস্তিনাতে।। বিচিত্র মন্দির, পথে পথে নানা বাস। দেখিয়া বিস্মিত হৈল দেব শ্রীনিবাস।। কোনখানে মুনিগণ বেদ উচ্চারয়। কোনখানে বাদ্যকার সুবাদ্য বাজায়।। নানা রত্ন অলঙ্কার পরি পুষ্পমালা। কোনখানে শিশুগণ করে নানা খেলা।। নগরের প্রজাগণ দিব্য বেশ ধরে। চতুরঙ্গদলে বসিয়াছে পথধারে।। দেখিয়া কহেন কৃষ্ণ ডাকি সাত্যকিরে। পূর্ব্বমত নাহি দেখি হস্তিনা নগরে।। দ্বিতীয় ইন্দ্রের পুরী সম সুশোভন। বড়ই ধর্ম্মাত্মা দেখি হেথা প্রজাগণ।। বুঝি এবে ধৃতরাষ্ট্র ধর্ম্মে মতি দিল। সে কারণে মহোৎসব গীত আরম্ভিল।। সাত্যকি বলিল, নহে ধর্ম্মের কারণ। তোমারে পরীক্ষা করিতেছে দুর্য্যোধন।। লোকমুখে শুনি ভক্তাধীন জনার্দ্দন। পাণ্ডবের বশ তেঁই ভক্তির কারণ।। ভক্তিতে পাণ্ডব বশ করিয়াছে তাঁরে। আমি ভক্তি করি দেখি এবে কিবা করে।। এমত মন্ত্রণা করি যত কুরুগণ। যজ্ঞ মহোৎসব করিয়াছে আরম্ভণ।। ইহা শুনি হাসি হাসি কহে দামোদর। আমার কপট ভক্তি নহে প্রীতিকর।। বিড়ম্বিলে মোরে সেই নিজে বিড়ম্বিবে। এই দোষে যমঘরে অবিলম্বে যাবে।। এত বলি জগন্নাথ করিলা প্রস্থান। নগর মধ্যেতে উত্তরিলেন শ্রীমান।। কৃষ্ণ আগমন শুনি কৌরবের পতি। আগু বাড়াইয়া গিয়া আনে শীঘ্রগতি।। নর্ত্তক চারণ আদি গায়কের গণ। দুঃশাসন সঙ্গে করি আসিল তখন।। চতুরঙ্গ দলে গিয়া বীর দুঃশাসন। আগু বাড়াইয়া শীঘ্র আনে নারায়ণ।। সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ আনিল সভাতে। যথাযোগ্য স্থানে সবে দিলেন বসিতে।। ভক্তি করি দুর্য্যোধন রত্ন সিংহাসনে। সভামধ্যে বসাইল দেব নারায়ণে।। যত দ্রব্য আহরণ করে দুর্য্যোধন। গোবিন্দের অগ্রে লয়ে দিল সেইক্ষণ।। অশ্রদ্ধায় যত দ্রব্য করে সমর্পণ। কোন দ্রব্য না নিলেন তার নারায়ণ।। প্রসঙ্গ করিয়া কহিলেন জনার্দ্দন। আজি কোন দ্রব্যে মোর নাহি প্রয়োজন।। আজি আমি রহি গিয়া বিদুরের বাসে। কালি রাজা মম পূজা করিহ বিশেষে।। ইহা বলি সভা হৈতে উঠি নারায়ণ। সাত্যকির হাত ধরি করেন গমন।। তবে দুর্য্যোধন রাজা উঠি সভা হৈতে। কর্ণ দুঃশাসন মাতুলেরে নিল সাথে।। আনন্দে অমাত্য সহ বসি দুর্য্যোধন। যুক্তি করে কি উপায় করিব এখন।। পাণ্ডবের পক্ষ দেখি দেব নারায়ণ। পাণ্ডবের গতি কৃষ্ণ পাণ্ডব জীবন।। কৃত্যা করি বান্ধি এবে রাখহ নিবাস। দন্ত উপাড়িলে যেন ভুজঙ্গ নিরাশ।। কৃষ্ণ বিনা মরিবেক পাণ্ডু-অঙ্গজনু। জলহীন মৎস্য যেন নাহি ধরে তনু।। দুঃশাসন বলে, যুক্তি নিল মোর মন। গোবিন্দেরে রাখ রাজা করিয়া বন্ধন।। বলিকে বান্ধিয়া যথা ইন্দ্র রাজ্য করে। এই কর্ম্মে তব হিত দেখি যে অন্তরে।। শকুনি বলিল, যুক্তি নিল মোর মন। এই কর্ম্মে সব সুখ দেখি যে রাজন।। পূর্ব্বাপর শাস্ত্রমত আছে হেন নীত। ছলে বলে শত্রুকে না ক্ষমিতে উচিত।। তোমার পরম শত্রু পাণ্ডুর নন্দন। তার অনুগত হয় দেব নারায়ণ।। তারে কৃত্যা করি দোষ নাহিক ইহাতে। বন্ধন করিয়া কৃষ্ণে রাখহ ত্বরিতে।। কর্ণ বলে, ভাল বলে গান্ধার-নন্দন। এই কর্ম্মে তব সুখ হইবে রাজন।। কিন্তু বলভদ্র আদি যত যদুগণ। পাছে আসি যুদ্ধ করে জানিয়া কারণ।। পাণ্ডবের পক্ষ হবে যত যদুগণ। গোবিন্দ বিচ্ছেদে সবে করিবেক রণ।। যাহা হৌক, তারা তব কি করিতে পারে। নিভৃতে বান্ধিয়া তুমি রাখ দামোদরে।। এতেক বলিল যদি রাধার নন্দন। এমত মন্ত্রণা করি প্রীত দুর্য্যোধন।। যত দৃঢ়ঘাতিগণ দ্বারেতে আছিল। নিভৃতে ডাকিয়া আনি সবারে কহিল।। কল্য কৃষ্ণ আসিবেন মোর অন্তঃপুরে। দ্বারকা যাবেন তিনি কহিয়া আমারে।। মহাপাশে শীঘ্র তাঁরে করিয়া বন্ধন। যতনে রাখিবে তাঁরে করিয়া গোপন।। শুনি অঙ্গীকার কৈল দুষ্টমতিগণ। হইল সানন্দ চিত্ত রাজা দুর্য্যোধন।। মহাভারতের কথা অমৃত লহরী। কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।। ২২.বিদুরের গৃহে কুন্তীসহ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার কহেন জনমেজয়, শুন তপোধন। অতঃপর কিবা করিলেন নারায়ণ।। দুর্য্যোধন সভা হৈতে উঠি হৃষিকেশ। কিবা কর্ম্ম করিলেন, কহ সবিশেষ।। মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন। কহিব পুরাণ কথা, করহ শ্রবণ।। সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ চলিয়া সত্বরে। দেখেন বিদুর নাহি আপনার ঘরে।। বিদুর বিদুর বলি ডাকেন শ্রীহরি। বাহির হলেন কুন্তী শব্দ অনুসারি।। গোবিন্দে দেখিয়া কুন্তী আনন্দে পূরিল। পূর্ণিমার চন্দ্র যেন হাতেতে পাইল।। আলিঙ্গিয়া শিরে চুম্বি কান্দে অবিশ্রাম। দুই পায়ে ধরি কৃষ্ণ করেন প্রণাম।। পাদ্য অর্ঘ্য আনি কুন্তী দিল সেইক্ষণে। বসাইল গোবিন্দেরে কুশের আসনে।। গোবিন্দের আগে কুন্তী কান্দে উচ্চৈঃস্বরে। মোর সম ভাগ্যহীন নাহিক সংসারে।। আজন্ম দুঃখেতে মম দহিল শরীর। এত কষ্টে পাপ আত্মা না হয় বাহির।। শিশু পুত্রে রাখি স্বামী স্বর্গবাসে গেল। পুত্রগণ এত কষ্ট চক্ষে না দেখিল।। সঙ্গে গেল ভাগ্যবতী মদ্রের নন্দিনী। আমি সঙ্গে না গেলাম, অধম পাপিনী।। দারুণ পাপিষ্ঠ খল রাজা দুর্য্যোধন। বারে বারে যত দুঃখ দিলেক দুর্জ্জন।। বিষ খাওয়াইল ভীমে নাশিবার তরে। ধর্ম্ম হতে রক্ষা পাইলেক বৃকোদরে।। অনন্তর কপটতা করি পাপমতি। অগ্নিগৃহ করি দিল করিবারে স্থিতি।। তাহাতে পাইল রক্ষা বিদুর কৃপাতে। দ্বাদশ বৎসর দুঃখে ভ্রমিনু বনেতে।। যাঞাতে যে করিলাম বিপ্র আচরণ। বহু কষ্ট পেয়ে তবে গেনু পাঞ্চালেরে। পাঁচটি কুমার গেল ভিক্ষা অনুসারে।। আমার পুণ্যের ফল উদয় হইল। সভামধ্যে লক্ষ্য বিন্ধি দ্রৌপদী পাইল।। পুত্রগণ পক্ষ রাজা দ্রুপদ হইল। দিনকত তথা মাত্র সুখেতে বঞ্চিল।। অনন্তর দেশে এলে খল কুরুপতি। রহিবারে ইন্দ্রপ্রস্থে দিলেক বসতি।। আপন ইচ্ছায় ভাগ দিল যেবা কিছু। তাহাতে সন্তুষ্ট হৈল মোর পঞ্চ শিশু।। ধর্ম্মবলে বাহুবলে সঞ্চিল রতন। পিতৃ-আজ্ঞা ধরি যজ্ঞ করিল সাধন।। দেখিয়া বিভব মোর দুষ্ট দুর্য্যোধন। শকুনির সহ যুক্তি করিয়া দারুণ।। কপট পাশায় জিনি সর্ব্বস্ব লইল। নিয়ম করিয়া বনবাসে পাঠাইল।। যে নিয়ম করে পুত্র সবার অগ্রেতে। তাহাতে হইল মুক্ত ধর্ম্মবল হৈতে।। তপস্বীর বেশ ধরি মম পুত্রগণ। দ্বাদশ বৎসর বনে করিল ভ্রমণ।। এক সম্বৎসর অজ্ঞাতেতে কাটাইল। এত কষ্ট দিয়া তবু দয়া না জন্মিল।। সম্প্রীতে ছাড়িয়া রাজ্য পাপিষ্ঠ না দিল। যুদ্ধ করি মরিবেক এই সে হইল।। যুদ্ধ করিবারে চাহে মোর পুত্র সনে। না জানি কপালে কিবা আছয়ে লিখনে।। এতেক বলিতে শোক বাড়িল অপার। উচ্চৈঃস্বরে কান্দে কুন্তী করি হাহাকার।। মহাভারতের কথা অমৃত সমান। ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত পুরাণ।। ২৩.শ্রীকৃষ্ণের নিকটে কুন্তীর রোদন হা হা ভীম যুধিষ্ঠির, হা হা পুত্র পার্থবীর, সহদেব নকুল তনয়। রূপ গুণ শীলযুতা, হা হা বধূ পতিব্রতা, তোমার বিচ্ছেদে প্রাণ রয়।। বিষম দুর্গম বনে, সঙ্গে নিজ স্বামিগণে, বহুকষ্টে বঞ্চিলে কেমনে। দারুণ দুরন্ত পশু, ব্যাঘ্র সর্প যত কিছু, যক্ষ রক্ষ ভয়ানক স্থানে।। তপস্বীর বেশধারী, যত সব হিংসাকারী, ভাগ্যে পুণ্যে না মারিল প্রাণে। পূর্ব্ব পুণ্যফল হৈতে, রক্ষা হৈল রিপুহাতে, ধর্ম্মবলে আঁচিল জীবনে।। প্রাণের দোসর তুমি, নির্ভয় করিলে ভূমি, সংহারিয়া রাক্ষস দুর্জ্জন। হা হা পুত্র বৃকোদর, মম গোত্রে গোত্রধর, হা হা পার্থ আমার জীবন।। করিয়া খাণ্ডব দাহ, তুষ্ট কৈলে হব্যবাহ, ইন্দ্রের ভাঙ্গিলে মহাভয়। মহা উগ্র তপ করি, তুষ্ট কৈলে ত্রিপুরারি, বাহুযুদ্ধে কৈলে পরাজয়।। এইরূপে পুত্রগণ, মনে করি চতুর্গুণ, কান্দে দেবী ভোজের নন্দিনী। শোকাকুল অতি দীন, শরীর অত্যন্ত ক্ষীণ, মূর্চ্ছা হয়ে পড়িল ধরণী।। দেখি ব্যস্ত হয়ে হরি, তুলিলেন হাতে ধরি, প্রবোধিয়া কহিছেন তাঁরে। শোক ত্যজ পিতৃষ্বসা, গেল তব দুঃখদশা, পুত্রগণ-দুঃখ গেল দূরে।। প্রসন্ন হইল কাল, ধর্ম্ম হবে মহীপাল, আজি কালি হস্তিনা নগরে। আমারে করিয়া দূত, পাঠাইল ধর্ম্মসূত, বুঝাইতে কৌরব-কুমারে।। যদি নাহি শুনে বাণী, ক্রুরমতি কুরুমণি, যদি নাহি দেয় রাজ্য তাঁর। তবে তব পুত্র জয়, ক্রূরবুদ্ধি কুরুচয়, সবংশেতে হইবে সংহার।। বলিলেন যুধিষ্ঠির, শীঘ্র যাহ যদুবীর, জননীরে কহিবে এমতি। হবে দুঃখ অবসান, ধর্ম্ম রাখিবেন মান, অচিরেতে ঘুচিবে দুর্গতি।। এত বলি জগৎপিতা, প্রবোধেন ভোজসুতা, শুনি কুন্তী হৈল হৃষ্টমন। উদ্যোগপর্ব্বের কথা, ব্যাস বিরচিত গাথা, কাশীরাম দাস বিরচন।। ২৪.শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বিদুরের স্তব ও তাঁহার গৃহে শ্রীকৃষ্ণের ভোজন কুন্তী কাছে বসিয়াছিলেন নারায়ণ। নানা কথা আলাপনে অতি হৃষ্টমন।। হেনকালে আইল বিদুর নিজালয়। স্কন্ধ হৈতে ভিক্ষাঝুলি ভূমিতে নামায়।। গৃহে প্রবেশিতে দেখে দেবকী-নন্দন। কহে গদ গদ হয়ে সজল লোচন।। আমার ভাগ্যের কথা কহিতে না পারি। কৃপা করি মম গৃহে আসিলে মুরারি।। কোন দ্রব্য দিয়া আমি পূজিব তোমারে। আছুক অন্যের কাজ, অন্ন নাহি ঘরে।। বড় ভাগ্যহীন আমি, অধম বঞ্চিত। ক্ষমিবে আমারে প্রভু দেখিয়া দুঃখিত।। এত বলি দণ্ডবৎ হয়ে করে স্তুতি। নমো নমো পূর্ণব্রহ্মা জগতের প্রতি।। তুমি আদি তুমি অন্ত তুমি মধ্যরূপ। সকল সংসার প্রভু তোমর স্বরূপ।। নমো নমো আদি ব্রহ্মা মৎস্য-রূপধর। নমো নমো হয়গ্রীব, নমস্তে ভূধর।। নমস্তে বরাহ হিরণ্যাক্ষ-বিদারক। নমো ভৃগুপতিরূপ ক্ষত্রকুলান্তক।। নমো কূর্ম্ম অবতার মন্দার ধারণ। নমস্তে মোহিনীরূপ অসুর মোহন।। নমস্তে নৃসিংহরূপ দৈত্য বিনাশক। নমো রাম অবতার রাবণ নাশক।। নমস্তে বামনরূপ বলিদ্বারে দ্বারী। বাসুদেব নমো জয় নমস্তে মুরারি।। ভবিষ্যতি অবতার, নমো বুদ্ধকায়। নমো কল্কি অবতার, ম্লেচ্ছবিনাশায়।। কি জানি তোমার স্তুতি আমি হীনজ্ঞান। ব্রহ্মা শিব আদি যাঁরে সদা করে ধ্যান।। তুমি সে প্রকৃতিপর দেব নিরঞ্জন। আত্মরূপে সর্ব্বভূতে তোমার গমন।। শিষ্টের পালন কর, দুষ্টের সংহার। এই হেতু জগৎপতি নাম যে তোমার।। কে বলিতে পারে তব গুণ অগোচর। তোমার মহিমা বেদ শাস্ত্রের উপর।। এরূপে বিদুর করে নানাবিধ স্তুতি। প্রসন্ন হইয়া তারে কহেন শ্রীপতি।। পরম মহৎ তুমি সংসার ভিতরে। তব তুল্য ধর্ম্মশীল নাহি চরাচরে।। ভক্তবশ আমি থাকি ভক্তের অধীনে। অধিক নাহিক প্রীতি ভক্তজন বিনে।। মেরুতুল্য রত্ন যে অভক্ত জয় দেয়। তাহাতে আমার তুষ্টি কিঞ্চিৎ না হয়।। অল্প বস্তু দেয় যদি ভক্তি সহকারে। তাহাতে যতেক তুষ্টি, কে কহিতে পারে।। শ্রীহরির স্নেহবাক্য বিদুর শুনিল। প্রতি অঙ্গ পুলকিত কহিতে লাগিল।। কি দিয়া করিব তুষ্ট আমি অভাজন। আপনার গুণে কৃপা কর নারায়ণ।। ভক্তের অধীন তুমি দয়ার সাগর। কৃপা করি পদছায়া দেহ গদাধর।। কৃপা করি মোরে স্নেহ কর হৃষীকেশ। তোমার মহিমা আমি না জানি বিশেষ।। বিদুরের স্তবে তুষ্ট হয়ে নারায়ণ। কৌতুকে কহেন পুনঃ কপট বচন।। বিদুর সে সব কথা হইবে পশ্চাতে। সম্প্রতি কাতর আমি অত্যন্ত ক্ষুধাতে।। স্তবেতে কাহার কবে পূরিল উদর। খাদ্যবস্তু আন কিছু জুড়াক অন্তর।। স্নান করি বসিয়াছি বিনা জলপানে। যে কিছু আছয়ে শীঘ্র আন এইখানে।। শুনিয়া বিদুর গৃহে করিল প্রবেশ। তণ্ডুলের খুদমাত্র আছে অবশেষ।। তাহা আনি দিল পদ্মাপতি পদ্মকর। পদ্মা সহ পদ্মাপতি বান্ধিল অন্তরে।। সন্তুষ্ট হইয়া কৃষ্ণ করেন ভক্ষণ। বিদুর লজ্জিত হয়ে না মেলে নয়ন।। পুনশ্চ বিদুর কহে দেব দামোদরে। আজ্ঞা কর যাই আমি ভিক্ষা-অনুসারে।। নগরে যে পাই ভিক্ষা অতিরিক্ত নয়। এত শুনি হাসি কন দেবকী তনয়।। ভিক্ষার কারণ বহু কৈলে পর্য্যটন। পুনঃ যাবে ভিক্ষাতে, না রুচে মম মন।। যে কিছু পাইলে তাহা করহ রন্ধন। সবে মেলি বাঁটিয়া তা করিব ভক্ষণ।। শুনিয়া বিদুর আজ্ঞা করিল কুন্তীরে। রন্ধন করিয়া কুন্তী দিলেন সত্বরে।। সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ বিদুরের বাসে। ভোজনান্তে আচমন করিলেন শেষে।। তাম্বূল না ছিল ঘরে, দিল হরীতকী। ভক্ষণ করিলা কৃষ্ণ পরম কৌতুকী।। বিদুর সাত্যকি আর দেব নারায়ণ। ইষ্ট আলাপনে করিলেন জাগরণ।। বিদুর বলেন, দেব কর অবধান। কি হেতু হস্তিনাপুরে তোমার প্রয়াণ।। পাণ্ডবের দূত হয়ে এলে অভিপ্রায়ে। ধর্ম্মনীতি বুঝাইতে গান্ধারী-তনয়ে।। তব বাক্য না রাখিবে কভু দুর্য্যোধন। সম্প্রীতে ছাড়িয়া রাজ্য না দিবে দুর্জ্জন।। ভীষ্ম দ্রোণ বুঝাইল ব্যাস মুনিবর। কার বাক্য না শুনিল কৌরব পামর।। গোবিন্দ বলেন, যাহা কহিলে প্রমাণ। না করিবে সম্প্রীতে সে পাণ্ডবে সম্মান।। তথাপিহ লোকধর্ম্মে তরিবার তরে। ধর্ম্ম-আত্মা যুধিষ্ঠির পাঠাইলা মোরে।। পঞ্চ ভাই জন্যে মাগি লব পঞ্চ গ্রাম। এই হেতু আসিলাম দুর্য্যোধন-ধাম।। বিদুর বলেন, দেব এ কথা না কহ। ভালে ভালে শীঘ্রগতি হেতা হতে যাহ।। যে মন্ত্রণা করিয়াছে বলিবারে ভয়। দুষ্ট দুর্য্যোধন আরা রাধার তনয়।। দুঃশাসন সহ দুষ্ট বসিয়া নিভৃতে। যুক্তি করিয়াছে তোমা বান্ধিয়া রাখিতে।। এত শুনি গোবিন্দের ক্রোধে কাঁপে বক্ষ। কুম্ভকার চক্র যেন ফিরে দুই অক্ষ।। অরুণ লোচন ক্রোধে রক্ত বিম্ব জিনি। বলেন বিদুর প্রতি দেব চক্রপাণি।। এত অহঙ্কার করে কুরু পাপকারী। ইহার উচিত শাস্তি দিতে আমি পারি।। মুহূর্ত্তেকে পারি সবা করিতে সংহার। বাতি দিতে কুরুকুলে না রাখিব আর।। গোবিন্দের বাক্যে বিদুরের ভীত মন। করযোড় করি পুনঃ বলেন বচন।। তোমারে বান্ধিতে পারে, কাহার শকতি। ত্রিভুবনে হর্ত্তা কর্ত্তা তুমি জগৎপতি।। ভকতে বান্ধিতে পারে মাত্র ভক্তিপাশে। আপন বন্ধন তুমি লহ অনায়াসে।। যে কালে গোকুলে বাল্যলীলা করেছিলে। একদিন যশোদার ক্রোধ বাড়াইলে।। ক্রোধেতে যশোদা তোমা করিল বন্ধন। মায়াতে মোহিত হয়ে করিলা এমন।। যত দড়ি যশোমতী আনে ক্রোধমনে। বান্ধিতে না আঁটে দুই অঙ্গুলি প্রমাণে।। দেখিয়া মায়ের দুঃখ হৈল তব দয়া। লইলে বন্ধন তুমি ত্যজি নিজ মায়া।। মায়ার পুত্তলী তুমি নানা মায়া জান। আদি নিরঞ্জন তুমি, পূর্ণ ভগবান।। তোমার এতেক ক্রোধ কি হেতু না জানি। আমারে দেখিয়া ক্রোধ ক্ষম চক্রপাণি।। তোমারে বান্ধিতে পারে, আছে কোন্ জন। কিবা অল্পমতি ছার রাজা দুর্য্যোধন।। কি করিতে পারে তোমা, কাহার শকতি। সর্ব্ব অপরাধ ক্ষম দেব জগৎপতি।। বিদুরের বাক্যে শান্ত হৈল নারায়ণ। জল দিলে যথা নিবর্ত্তয়ে হুতাশন।। পুনরপি হাসি হাসি বলে জনার্দ্দন। লঙ্ঘিতে না পারি আমি তোমার বচন।। ক্ষমিলাম কৌরবের দোষ যে সকল। অচিরাতে পাবে দুষ্ট সমুচিত ফল।। খণ্ডিতে না পারি আমি ধর্ম্মের উত্তর। সে কারণে আসিলাম হস্তিনা নগর।। এত বলি ক্রোধহীন হন নারায়ণ। বিদুর প্রবোধ পেয়ে আনন্দিত মন।। নানা কথা আলাপেতে ছিলা তিন জন। কথা শেষে করিলেন সকলে শয়ন।। উদ্যোগপর্ব্বের কথা অমৃত-সমান। ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত-পুরাণ।। কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার। যাহার শ্রবণে হয় ভবসিন্ধু পার।। ২৫.কৌরব সভায় শ্রীকৃষ্ণের পুনরাগমন রজনী বঞ্চিয়া সুখে বিদুরের ঘরে। প্রভাতে উঠিয়া দেব হরিষ অন্তরে।। প্রাতঃক্রিয়া সমাপিয়া শুভযাত্রা করি। বিদুরের সঙ্গে করি চলেন শ্রীহরি।। সাত্যকি চলিল সঙ্গে আর চেকিতান। চারি জন চলি যান কুরু বিদ্যমান।। সভা করি বসি আছে অন্ধ নরপতি। হেনকালে উপনীত দেব জগৎপতি।। কৃষ্ণ-আগমন রাজা জানি সেইক্ষণ। বহু মান্য করি দিল বসিতে আসন।। হেনকালে উপনীত যত সভাজন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ পৃষত-নন্দন।। পঞ্চ ভাই ত্রিগর্ত্ত দেশের নরপতি। আসিল যতেক রাজা সবে মহামতি।। শত ভাই সহ বসি রাজা দুর্য্যোধন। যার যেই আসনেতে বসে সর্ব্বজন।। আসিল যতেক মুনি জানিয়া কারণ। নারদ পুলস্ত্য আর দেবল তপন।। মার্কণ্ড অগস্ত্য বিভাণ্ডক তপোধন। আসিল যতেক মুনি অন্ধের ভবন।। যথাযোগ্য আসনেতে বৈসে মুনিগণ। শুন দুর্য্যোধন রাজা হয়ে একমন।। ধর্ম্ম আত্মা যুধিষ্ঠির ধর্ম্মেতে তৎপর। ধম্ম চিন্তি পাঠাইল তোমার গোচর।। কুলক্ষয় জানি মনে সবে ক্ষমা দিল। বিনয়ে আমাকে সেই এখানে পাঠাল।। যা বলিল ধর্ম্মরাজ, শুন বলি তাই। ভাই ভাই বিরোধেতে প্রয়োজন নাই।। নিয়ম হইল পূর্ব্বে তোমার সাক্ষাতে। নানা কষ্ট ভুঞ্জি মুক্ত হইলাম তাতে।। আমার বিভাগ রাজ্য যে হয় উচিত। তাহা ছাড়ি দিয়া মম সঙ্গে কর প্রীতি।। সভামধ্যে যত কিছু কৈলে অপমান। সে সকল অপরাধে আছি ক্ষমাবান।। সে সকল দুঃখ আমি নাহি করি মনে। অদৃষ্ট যেমন মম, ঘটিল তেমনে।। এইরূপ কহিলন ধর্ম্মের কুমার। ভীম ধনঞ্জয় মাদ্রীপুত্র দুই আর।। যাহা চিত্তে লয়, তাহা কর নরবর। এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র করিল উত্তর।। শুনিলে কি দুর্য্যোধন কৃষ্ণের বচন। যাহা বলি পাঠাইল পাণ্ডুপুত্রগণ।। পাণ্ডবেরা তব কিছু না কর অকার্য্য। উচিত ছাড়িয়া দিতে তাহাদের রাজ্য।। যে নিয়ম করেছিল, হইল মোচন। তবে তার সহ দ্বন্দ্ব কর কি কারণ।। এমত করিলে তোমা না সহিবে ধর্ম্ম। সংসার যুড়িয়া হবে তব অপকর্ম্ম।। পূর্ব্ব অধিকার তার ছিল যত দূর। যত রাজ্য ধন রত্ন ছিল গ্রাম পুর।। তাহা দিয়া প্রীতি কর পাণ্ডবের সনে। নাহি দিলে পরিণামে পাবে দুঃখ মনে।। দুর্য্যোধন বলে, তাত না বুঝিয়া কহ। জীয়ন্তে কি প্রীতি হবে পাণ্ডবের সহ।। নাহি দিব রাজ্য আমি, যুদ্ধ করি পণ। ইহার বিধান এই, শুনহ রাজন।। শক্তি থাকে পাণ্ডবের, করিবেক রণ। যুদ্ধে জিনি আমা সবে লবে রাজ্য ধন।। এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র হইল বিরত। কহিতে লাগিল তবে সভাসদ্ যত।। ভীষ্মবীর বলে আর দ্রোণ মহাশয়। কৃপ অশ্বথামা আর পৃষত তনয়।। কহিল নারদ মুনি ধর্ম্মশাস্ত্রমত। এ কর্ম্ম তোমার রাজা না হয় উচিত।। সংসারে অজেয় পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়। তাহা সহ যুদ্ধ তব উচিত না হয়।। স্বধর্ম্মে থাকিলে হয় জয়ী ত্রিভুবনে। অর্জ্জুনের গুণকর্ম্ম না যায় বর্ণনে।। দেবের অবধ্য কালকেয়াদি মারিল। গন্ধর্ব্বের ভয় হতে তোমারে রাখিল।। নিবাতকবচগণে করিল নিধন। খাণ্ডব দহিয়া করে অগ্নির তর্পণ।। মহাবল যদুগণে সমরে জিনিল। সুভদ্রা জিনিয়া আনি বিবাহ করিল।। দ্রৌপদীর স্বংন্বরে বীর ধনঞ্জয়। এক লক্ষ রাজগণে করে পরাজয়।। বাহুযুদ্ধে পরাজয় করে পশুপতি। একেশ্বর বিজয় করিল সব ক্ষিতি।। ভীমের বিক্রম সবে জান ভালমতে। লক্ষ লক্ষ নিশাচরে মারে মুষ্ট্যাঘাতে।। হিড়িম্ব কির্ম্মীর বক আদি নিশাচর। হেলায় সংহার করিলেক বৃকোদর।। শত ভাই কীচকেরে মারিল নিমিষে। ত্রিভুবন নাহি আঁটে ভীম যদি রোষে।। হেন জন সহ তোমা বিরোধে কি কাজ। অদ্ধরাজ্যে পাণ্ডবেরে দেহ কুরুরাজ।। না দিলে প্রমাদ বড় হইবে তোমার। পাণ্ডবের হাতে হবে সবংশে সংহার।। আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে, পৃথ্বী যদি ভাসে। দিনকর তেজোহীন, সপ্তসিন্ধু শোষে।। ইন্দ্র আদি দেব যদি তব পক্ষ হয়। জিনিতে নারিবে তবু পাণ্ডব সদনে।। বিনয় করিয়া দোষ খণ্ডাহ এক্ষণে।। গলায় কুঠার বান্ধি দন্তে তৃণ করি। শীঘ্রগতি যাহ, যথা ধর্ম্ম অধিকারী।। যত ধন রাজ্য নিলে জিনিয়া পাশাতে। তাহার দ্বিগুণ করি দেহত সাক্ষাতে।। ইন্দ্র প্রস্থে আনি অভিষেক কর। এই কর্ম্মে তব হিত দেখি কুরুবর।। এতেক নারদ মুনি বলিল বচন। বলিল পরশুরাম জানিয়া কারণ।। ব্যাস বুঝাইল কত, না শুনিল কানে। পৌলস্ত্য যে বুঝাইল বেদের বিধানে।। অনন্তর বুঝাইল যত সভাজন। কারো বাক্য না শুনিল গান্ধারী নন্দন।। অদৃষ্ট মানিয়া তবে ধৃতরাষ্ট্র বলে। কালেতে কুবুদ্ধি ফল দুর্য্যোধনে ফলে।। সে কারণে কারো বাক্য না শুনে শ্রবণে। এত শুনি মৌনী হয়ে রহে সভাজনে।। অদৃষ্ট মানিয়া তবে অম্বিকা নন্দন। নিশ্বাস ছাড়িয়া হেঁট করিল বদন।। পুনরপি হাস্যমুখে বলে নারায়ণ। জানিলাম দুর্য্যোধন তোমার যে মন।। অবশেষে বলিলেন যদুবংশপতি। কহি, অবধান কর কুরুকুল-পতি।। অর্দ্ধ রাজ্য ছাড়ি যদি না দিবে রাজন। তোমার অধীন হৈল পাণ্ডুপুত্রগণ।। পঞ্চ পাণ্ডবেরে ছাড়ি দেহ পঞ্চ গ্রাম। সুখে তুমি ভোগ কর এই ধরাগ্রাম।। পাণ্ডব নগর কুশস্থল সিদ্ধিগ্রাশ। ইন্দ্রপ্রস্থ আর যে বারণাবত নাম।। এই পঞ্চ গ্রাম ছাড়ি দেহ পাণ্ডবেরে। দ্বন্দ্বে কার্য্য নাহি রাজা কহিনু তোমারে।। পঞ্চ গ্রাম দিয়া শান্ত কর পঞ্চ জন। পৌরুষ বৈভব যদি বাঞ্ছাহ রাজন।। উভয় কুলের আমি সদা চিন্তি হিত। মম বাক্যে পাণ্ডুপুত্রে করহ সম্প্রীতি।। বনে বনে ভ্রমে পাণ্ডবেরা পঞ্চ জন। বলহীন, কোন মতে ধরয়ে জীবন।। যুদ্ধে অসমর্থ তারা, নারিবে জিনিতে। না হয় উচিত, জ্ঞাতি হহন করিতে।। জ্ঞাতিবধ মহাপাপ, সর্ব্বশাস্ত্রে গণি। সে কারণে উপেক্ষা না কর নৃপমণি।। এতেক বলিল যদি দেব জগৎপতি। পুত্রে দোষী বলি কহে অন্ধ নরপতি।। দুর্য্যোধন ক্রোধে ওঠে আসন হইতে। গোবিন্দে চাহিয়া তবে লাগিল কহিতে।। তীক্ষ্ম সূচী অগ্রদেশে ধরে যত ভূমি। বিনা যুদ্ধে পাণ্ডবেরে নাহি দিব আমি।। প্রতিজ্ঞা করিনু আমি, না হবে খণ্ডন। পশ্চিমে উদয় যদি হয় ত তপন।। আকাশ পড়য়ে ভূমে, পৃথ্বী জলে ভাসে। দিনকর তেজে যদি হয় দ্বিজগণ।। তথাপি প্রতিজ্ঞা মকম না হবে খণ্ডন। পাণ্ডবেরে ছাড়িয়া না দিব রাজ্যধন।। এত শুনি মৌন হয়ে রহে লক্ষ্মীপতি। বলেন ক্ষণেক পরে ধৃতরাষ্ট্র প্রতি।। দূত হয়ে আসিলাম দুই কুল হিতে। শুনিনু অদ্ভুত কথা বিদুর-মুখেতে।। কোন্ দোষে করিলাম শুনহ রাজন। আমারে বান্ধিতে চাহে তোমার নন্দন।। কে কারে বান্ধিতে পারে দেখ বিদ্যামনে। ক্ষমা করি শুধু মাত্র চাহি তোমা পানে।। ক্ষুদ্র মৃগে মারে যথা কেশরী প্রচণ্ড। নাগেরে গরুড় যথা করে খণ্ড খণ্ড।। সেইরূপ দেখি আমি যত কুরুগণে। মুহূর্ত্তে মারিতে পারি যদি করি মনে।। তোমার অপেক্ষা হেতু ক্ষমিয়াছি আমি। নহে কেন পাণ্ডবেরা ভ্রমে বনভূমি।। এত বল উচ্চৈঃস্বরে হাসে নারায়ণ। হাসিতে হাসিতে হৈল আরক্ত লোচন।। কম্পান্বিত কলেবর দেখি লাগে ভয়। দেবমায়া সৃজিলেন দেব দয়াময়।। নিজ অঙ্গে দেখালেন এ তিন ভুবন। দিব্য চক্ষু সব জনে দেন নারায়ণ।। দিব্য চক্ষু পেয়ে সবে একদৃষ্টে চায়। যতেক দেখিল, তাহা কহনে না যায়।। দেবতা তেত্রিশ কোটি দেখে পৃষ্ঠদেশে। নাভিপদ্মে দেখে ব্রহ্মা আছে সবিশেষে।। নারদ বক্ষেতে শোভে দেব তপোধন। নয়নে দেখয়ে একাদশ রুদ্রগণ।। ঊনপঞ্চাশৎ বায়ু অশ্বিনী কুমার। অনন্ত বাসুকি আদি যত নাগ আর।। গোবিন্দের পুরোভাগে করে নানা স্তুতি। তবে আর নানাবিধ দেখয়ে বিভূতি।। স্থাবর জঙ্গম দেখে যত দেহিগণ। গোবিন্দের অঙ্গে দেখে এ তিন ভুবন।। বিশ্বরূপ নিরখিয়া সবে মূর্চ্ছা গেল। গোবিন্দের অগ্রে সবে কহিতে লাগিল।। জগতের কর্ত্তা তুমি, জগতের পতি। সৃজন পালন তুমি, সংহার মূরতি।। অপার মহিমা তব, বেদে অগোচর। নিজ রূপ সম্বরহ দেব গদাধর।। এইরূপে স্তুতি কৈল যত মুনিগণ। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আদি যতেক সুজন।। স্তুতি বশে সুপ্রসন্ন হয়ে জগৎপতি। বিশ্বরূপা মায়া ছাড়িলেন সে বিভূতি।। দুর্য্যোধনে পুনরপি বুঝাইল সবে। কারো বাক্য দুর্য্যোধন না শুনিল তবে।। সভা হৈতে উঠি তবে চলে সর্ব্বজন। নিজস্থানে গেল তবে যত মন্ত্রিগণ।। সাত্যকির হাতে ধরি চলেন শ্রীহরি। যত দ্রব্য দিয়াছিল কুরু-অধিকারী।। কোন দ্রব্য না নিলেন হয়ে ক্রোধমন। শীঘ্রগতি করিলেন রথে আরোহন।। বিস্ময় মানিল ধৃতরাষ্ট্র নরপতি। অনর্থ হইল, বলে ভীষ্ম মহামতি।। মৌনভাবে রহিলেন অম্বিকা-নন্দন। কুন্তীর নিকটে কৃষ্ণ করেন গমন।। সম্ভাষি সবারে, পরে কুন্তীরে নমিয়া। বহু কথা কহিলেন নিকটে বসিয়া।। তাবৎ বৃত্তান্ত সব কহিলেন তাঁরে। চলিলেন চক্রপাণি সম্ভাসি সবারে।। পথে কর্ণ সহ মিলিলেন জনার্দ্দন। কর্ণের সহিত হৈল রহস্য কথন।। কন্যাকালে কুন্তীগর্ভে তোমার উৎপত্তি। তুমি কর্ণ মহাবীর, কুন্তীর সন্ততি।। যুধিষ্ঠির নৃপতির তুমি সহোদর। আপনা না চিন কর্ণ তুমি কি বর্ব্বর।। ধর্ম্মশাস্ত্র পড়িয়াছ, করিয়াছ দান। ব্রাহ্মণ সভাতে করে তোমার বাখান।। তোমার কনিষ্ঠ পাণ্ডবেরা পঞ্চ ভাই। এ হেন সম্বন্ধ কর্ণ বড় ভাগ্যে পাই।। দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র অভিমন্যু আদি। পূজিবে ভৃত্যের সম তোমা নিরবধি।। নকুল অর্জ্জুন সহদেব ভীম বীর। তব পদ ধোয়াইবে রাজা যুধিষ্ঠির।। সুবর্ণ রজত কুম্ভে তব অভিষেকে। রাজকন্যা সেবিবে যে দেখিবে প্রত্যেকে।। পঞ্চজনে দ্রৌপদী যে করিবে সেবন। অগ্নিহোত্র করিবেক ধৌম্য তপোধন।। তোমারে সিঞ্চিবে আজি বিপ্র চারিবেদী। পাণ্ডবের পুরোহিত কুশল-সংবাদী।। যুবরাজ হবে তব রাজা যুধিষ্ঠির। ধবল চামর লয়ে বিচিত্র শরীর।। মস্তকে ধরিবে ছত্র বীর বৃকোদর। রথের সারথি হবে পার্থ ধনুর্দ্ধর।। সুধীর শিখণ্ডী তব হবে আগুসার। এ সব বচন কর্ণ ধরিবে আমার।। বৃষ্ণিবংশ লয়ে তব পিছে যাব আমি। এ সব সম্পদ কর্ণ ভোগ কর তুমি।। বলিলেন এইমত নিজে দামোদর। ভক্তি করি কর্ণ তবে দিলেন উত্তর।। সূর্য্যের ঔরসে জন্ম কুন্তীর উদরে। সূর্য্যের বচনে মাতা বিসর্জ্জিলা মোরে।। সূত মোরে পেয়ে পালে আপনার ঘরে। আমারে পুষিল রাধা যত্ন পুরঃসরে।। স্তন দিয়া পুষিলেন, জানে সর্ব্বজন। সর্ব্বলোকে বলে মোরে রাধার নন্দন।। ধর্ম্মেতে পাণ্ডুর সুত, কুন্তীগর্ভে জাত। যুধিষ্ঠিরে না কহিবে এ সব বৃত্তান্ত।। অনুরোধ করিবেন ধর্ম্ম নৃপবর। আমি পুনঃ সর্ব্বথা না যাব দামোদর।। আমি যদি পাই রাজ্য দিব দুর্য্যোধনে। সত্যভঙ্গ তথাপি না করি, লয় মনে।। দুর্য্যোধন কৈল মোরে বিস্তর পোষণ। রাজ্য ধন দিল দিব্য রতন ভূষণ।। তের বর্ষ ভুঞ্জিলাম রাজ্য আদি সুখ। দুর্য্যোধন প্রসাদেতে নাহি কোন দুঃখ।। করিব নিতান্ত রণ অর্জ্জুন সহিত। প্রতিজ্ঞা করিনু, সর্ব্ব কৌরব বিদিত।। যদ্যপি জানি যে আমি পাণ্ডবের জয়। সবান্ধবে দুর্য্যোধন হইবেক ক্ষয়।। অর্জ্জুনের হাতে হৈবে আমার নিধন। দ্রোণাচার্য্যে মারিবেক দ্রুপদ নন্দন।। ধৃতরাষ্ট্র পুত্র এই শত সহোদর। পাঠাবে শমন ঘরে বীর বৃকোদর।। তথাপিহ না ত্যজিব রাজা দুর্য্যোধনে। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম জান প্রতিজ্ঞা পালনে।। আপনি জানহ কৃষ্ণ সকল রহস্য। সকল কৌরব নাশ হইবে অবশ্য।। যেখানে তোমার নাম, সেইখানে জয়। ইথে অন্যমত নাহি, শুন মহাশয়।। যথা কৃষ্ণ তথা জয়, জানি যে সর্ব্বথা। আমার প্রতিজ্ঞা নষ্ট না হইবে তথা।। কেবল নিমিত্তভাগী এই তিন জন। দুঃশাসন দুর্য্যোধন সুবল-নন্দন।। কৌরব পাণ্ডব-যদ্ধে রুধিবে কর্দ্দম। মরিবে পাণ্ডব হাতে কৌরব অধম।। পাণ্ডব হইবে জয়ী, কুরু পরাজিত। অবিলম্বে জনার্দ্দন হইবে নিশ্চিত।। মঙ্গল না দেখি আমি কৌরবের কাজে। উৎপাত অদ্ভুত দেখি গ্রহগণ মাঝে।। গগণেতে উল্কাপাত নির্ঘাত সহিত। পৃথিবী কম্পিতা হয়, দেখি বিপরীত।। ভয়ানক শব্দ করি কান্দে অশ্ব গজ। অকস্মাৎ খসি পড়ে যত রথধ্বজ।। গৃধ্র পক্ষী কাক বক মূষিক সঞ্চান। কৌরবের পাছে পাছে দেখি বিদ্যমান।। মাংস আর রক্তবৃষ্টি ঊর্দ্ধে বহে বাত। কৌরবগণের মৃত্যু দেখি জগন্নাথ।। দুঃষ্বপ্ন দেখিনু আমি, শুন নায়ায়ণ। অমৃত পায়স ভুঞ্জে পাণ্ডুপুত্রগণ।। পৃথিবী প্রসবে ধর্ম্ম, দেখিয়া এমন। পর্ব্বতে উঠিয়া ভীম করে মহা রণ।। রতন কবচ গায়ে দেখি সুশোভন। পুষ্পমালা গলে শোভে ধবল বসন।। হাতেতে ধবল ছত্র নামে সরোবর। স্বপ্ন আমি দেখিলাম শুন দামোদর।। পাণ্ডব হইবে জয়ী, কুরু পরাজয়। অচিরে হইবে কৃষ্ণ, নাহিক সংশয়।। এত বলি কর্ণ বীর করিল গমন। প্রেমরূপে গোবিন্দেরে দিয়া আলিঙ্গন।। কর্ণবীর গেল যদি আপন ভবন। সৈন্যগণ সহ চলিলেন জনার্দ্দন।। নানাবাদ্য কোলাহলে চলেন ত্বরিত। বিরাট নগরে হইলেন উপনীত।। হরিহরপুরগ্রাম সর্ব্বগুণধাম। পুরুষোত্তম নন্দন মুখটি অভিরাম।। কাশীরাম বিরচিত তাঁর আশীর্ব্বাদে। সদা চিত্তে রহে যেন দ্বিজ পাদপদ্মে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon