মহাভারত:ভীষ্মপর্ব-০০১-০০৫

০১. ধৃতরাষ্ট্রকে কুরু-পাণ্ডবের রণবার্ত্তা শুবণার্থে
সঞ্জয়কে ব্যাসদেবের দিব্যচক্ষু প্রাপ্তি বরদান
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ তপোধন।
উলুকের মুখে বার্ত্তা করিয়া শ্রবণ।।
কোন্ কর্ম্ম করিলেক দুর্য্যোধন বীর।
কিবা কর্ম্ম করিলেক রাজা যুধিষ্ঠির।।
বলিলা বৈশম্পায়ন শুন মহাশয়।
দূতমুখে বার্ত্তা শুনি ধর্ম্মের তনয়।।
কৃষ্ণেরে কহেন হৈল সমর সময়।
বিহিত ইহার যাহা কর মহাশয়।।
শ্রীহরি বলেন রাজা করি নিবেদন।
যাত্রা কর মহাশয় দিন শুভক্ষণ।।
তখনি দিলেন আজ্ঞা রাজা যুধিষ্ঠির।
চল্লিশ সহস্র রাজা সাজে মহাবীর।।
পাঁচকোটি রথ সাজে ত্রিজ কোটি হাতী।
ষষ্টি কোটি আসোয়ার অসংখ্য পদাতি।।
সপ্ত অক্ষৌহিণী সেনা পাণ্ডবের দলে।
সবে বিষ্ণুপরায়ণ মহাবল বলে।।
সিংহনাদ শঙ্খধ্বনি বিবিধ বাজন।
নানা অস্ত্রে বীরগণ করিল সাজন।।
শ্রীহরি করিয়া অগ্রে পাণ্ডুর তনয়।
কুরুক্ষেত্র চলিলেন করি জয় জয়।।
তর্জ্জন গর্জ্জন করে যত যোদ্ধাগণ।
পাঞ্চজন্য আপনি বাজান নারায়ণ।।
দেবদত্ত শঙ্খ বাজাইয়া ধনঞ্জয়।
যুদ্ধ করিবারে যান সমরে দুর্জ্জয়।।
গদা হস্তে বৃকোদর আনন্দিত মন।
সহদেব নকুল সাজিল সেইক্ষণ।।
দ্রুপদ শিখণ্ডা আর বিরাট নৃপতি।
জরাসন্ধসুত সহদেব মহামতি।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন চেকিতান সাত্যকি দুর্জ্জয়।
শ্বেতশঙ্খ ও উত্তর বিরাট তনয়।।
শূরসেন নৃপ আর কেশী মহাবল।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সমরে কুশল।।
অভিমন্যু ঘটোৎকচ সমরে বিশাল।
ইত্যাদি সাজিল রণে যত মহীপাল।।
জয় জয় শব্দে বাদ্য বাজে কোলাহল।
কুরুক্ষেত্র উত্তরিল পাণ্ডবের দল।।
দাঁড়াইল পূর্ব্বমুখে সব সেনাগণ।
যুধিষ্ঠির মহারাজা হরষিত মন।।
দুঃশাসনে ডাকিয়া বলিল দুর্য্যোধন।
যুদ্ধ করিবারে, কর বাহিনী সাজন।।
সাজ সাজ বলে রাজা বিলম্ব না সহে।
মারিব পাণ্ডবগণ আনন্দেতে কহে।।
দুঃশাসন বীর দিল কটকে ঘোষণা।
সাজ সাজ বলি ধ্বনি করে সর্ব্বজনা।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য অশ্বথামা বীর।
ভূরিশ্রবা সোমদত্ত প্রফুল্ল শরীর।।
বাহলীক শকুনি কৃতবর্ম্মা নরপতি।
ভগদত্ত শল্যরাজ মদ্র অধিপতি।।
বিন্দ আর অনুবিন্দ কর্ণ মহাবল।
শত ভাই কলিঙ্গ বিখ্যাত ভূমণ্ডল।।
শ্বেতছত্র পতাকা শোভিত সারি সারি।
সাজিলেন শত ভাই কুরু অধিকারী।।
ছত্র ধরে চলে ষাটি সহস্র ভূপতি।
একৈক রাজার সঙ্গে সহস্রেক হাতী।।
একৈক ধানুকী সাথে দশ দশ ঢালী।
চরণে নুপুর শব্দে কর্ণে লাগে তালি।।
গজ বাজী রথধ্বজ পতাকা প্রচুর।
কুরুসৈন্য সজ্জা দেখি কম্পে তিনপুর।।
কৌরবের সৈন্যগণ মহা পরাক্রম।
অস্ত্রে শস্ত্রে বিশারদ বিপক্ষেতে যম।।
মহা আনন্দিত মন যত কুরুগণ।
যুদ্ধ হেতু সর্ব্বজন করিল সাজন।।
আচম্বিতে বায়ু বহে মহাশব্দ শুনি।
গিরিতে চাপিয়া যেন আইসে মেদিনী।।
অকস্মাৎ মেঘ যেন বরিষে রুধির।
বিনা ঝড়ে খসি পড়ে দেউল প্রাচীর।।
গর্দ্দভ প্রসবে গাভী, কুকুরে শৃগাল।
ময়ুর প্রসবে কাকা, ইঁদুরে বিড়াল।।
নিরুৎসাহ অশ্বগণ কাঁপে ঘনে ঘন।
অমঙ্গল কত হয় না যায় বর্ণনা।।
দেখি যে ত্রিপদ পশু, নাহি চারি পাদ।
দিবসেতে পেচকেরা করে ঘোরনাদ।।
দণ্ডহস্তেব শিশু সব যুঝে পরস্পর।
মহাঘোর রণশব্দ গগন উপর।।
এক বৃক্ষে অন্য ফল অদ্ভূত কথন।
ক্ষণেক্ষণে পৃথিবী কম্পয়ে ঘনে ঘন।।
বিদুর দেখিয়া ইহা বিস্ময় মানিল।
ধৃতরাষ্ট্র স্থানে গিয়া সব নিবেদিল।।
শুনিয়া আকুল হৈল অন্ধ নরপতি।
নিরুৎসাহ হয়ে রাজা বসিলেন ক্ষিতি।।
কুরুকুল ধ্বংস হেতু জানিয়া তখন।
আইলেন তথা সত্যবতীর নন্দন।।
দেখি সভাজন সবে পাদ্য অর্ঘ্য দিল।
চরণ বন্দিয়া অন্ধ স্তবন করিল।।
ধৃতরাষ্ট্র কহে শুন মুনি মহাশয়।
কারো বাক্য না শুনিল আমার তনয়।।
যুদ্ধ আয়োজন করে দুষ্ট মন্ত্রণায়।
অমঙ্গল দেখি ভয় জন্মিল তাহায়।।
ব্যাসদেব বলেন শুনহ মহাশয়।
কুরুকুল হবে ক্ষয় জানিহ নিশ্চয়।।
কর্ম্ম অনুসারে জীব ভ্রময়ে সংসারে।
দৈবে যাহা হয় তাহা কে খণ্ডিতে পারে।।
পৃথিবীতে যত ক্ষন্ত্র একত্র হইল।
এই যুদ্ধে সর্ব্বজন নিশ্চয় মজিল।।
পুত্র তব শত আর যত নৃপচয়।
পরস্পর যুদ্ধ করি সবে হবে ক্ষয়।।
যুদ্ধ দেখিবারে যদি বাঞ্ছা থাকে মনে।
দিব্যচক্ষু দিয়া যাই দেখহ নয়নে।।
প্রণমিয়া ধৃতরাষ্ট্র সকরুণে কহে।
পুত্রবধূ জ্ঞাতিবধ প্রাণে নাহি সহে।।
তোমার প্রসাদে আমি শুনিব শ্রবণে।
এত বলি ধৃতরাষ্ট্র পড়িল চরণে।।
ক্ষণেক চিন্তিয়া তবে ব্যাস তপোধন।
রাজারে বলেন শুন আমার বচন।।
দিব্যচক্ষে সঞ্জয় দেখিবে ত্রিভুবন।
রাত্রিদিন তোমারে কহিবে বিবরণ।।
ইহাতে শুনিবে যত যুদ্ধ বিবরণ।
গৃহে বসি সব বার্ত্তা পাইবা রাজন।।
যত অলক্ষণ এই দেখ মহাশয়।
হইতেছে দিবসেতে নক্ষত্র উদয়।।
উদয়াস্ত প্রায় সূর্য্য গগনে বেষ্টিত।
বিনা মেঘে বরিষয়ে সঘনে শোণিত।।
অগ্নিবর্ণ প্রায় দেখি সমস্ত আকাশ।
হইতেছে ধুমকেতু দিবসে প্রকাশ।।
পর্ব্বত শিখর খসে সাগর উথলে।
মহাবৃক্ষ ভাঙ্গিয়া পড়িছে স্থলে স্থলে।।
এই সব অলক্ষণ শুনহ রাজন।
বংশনাশ হইবার এই সে কারণ।।
এ সকল বাক্য মুনি অন্ধেরে কহিয়া।
চলিলেন স্বস্থানে সঞ্জয়ে আজ্ঞা দিয়া।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
একমনে শুনিলে তরয়ে ভববারি।।
ব্রাহ্মণের পদরজঃ মস্তকে বন্দিয়া।
কাশীরাম দাস কহে পয়ার রচিয়া।।
০২. ভীষ্মের যুদ্ধসজ্জা ও প্রতিজ্ঞা
মুনি বলে অবধান করহ রাজন।
বহুবিধ বিলাপিয়া অম্বিকা নন্দন।।
অনেক কান্দিয়া শোক ত্যজি নরপতি।
সঞ্জয়েরে জিজ্ঞাসিল করিয়া মিনতি।।
কহত সঞ্জয় তুমি বড় বিচক্ষণ।
কোন্ কর্ম্ম কৈল কুরু-পাণ্ডুর নন্দন।।
কিরূপে ভারতযুদ্ধ হৈল আরম্ভণ।
কার সনে কার যুদ্ধ কহ বিবরণ।।
সঞ্জয় বলিল, রাজা কর অবধান।
কৌরব পাণ্ডব দুই বীরের প্রধান।।
ভীষ্ম সম মহাবীর নাহি দুই দলে।
ভীষ্মে সেনাপতি কৈল কুরু-মহীপালে।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল গগন।
মনেতে করিয়া তবে গঙ্গার নন্দন।।
ধর্ম্মের সভায় দূত পাঠায় তখন।
ধর্ম্মেরে কহিবে এই আমার বচন।।
বিপক্ষ জানিয়া তুমি কর মহারণ।
উপরোধ জ্ঞান না করিবে কদাচন।।
ন্যায়যুদ্ধ করিবে অন্যায় না করিবে।
ভীতজনে কদাচিত অস্ত্র না মারিবে।।
বাক্যযুদ্ধে কদাচন অস্ত্র না ধরিবে।
ন্যায়যুদ্ধে অন্য জনে নাহিক ঘাতিবে।।
রথী রথী যুঝিবেক পদাতি পদাতি।
মল্লে মল্লে যুঝিবেক করি ধর্ম্মনীতি।।
আসোয়ারে আসোয়ারে করিবেক রণ।
গজে গজে যুঝিবেক পত্তি পত্তি জন।।
গদা গদা যুঝিবেক রাউতে রাউতে।
খড়্গে খড়্গে যুঝিবেক মাহুতে মাহুতে।।
পলায়িত জনে না করিবে অস্ত্রাঘাত।
যে জন বর্জ্জিত অস্ত্র না মারিবে তাত।।
শ্রমযুক্তে না মারিবে দূতে কদাচন।
অস্ত্রহীন জন সঙ্গে বর্জ্জিবেক রণ।।
না মারিবে যে জন বিমুখ-পলায়ন।
এক সঙ্গে যুঝি অন্যে না মারিবে বাণ।।
শক্তিহীন জনে অস্ত্র করিবে বর্জ্জিত।
শরণাগতে অস্ত্র না মারিবে কদাচিত।।
যে জন যোগায় অস্ত্র না মারিবে তারে।
কদাচিৎ অস্ত্র না মারিবে বাদ্যকর।।
এইরূপ কহি ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
চর পাঠাইয়া দিল ধর্ম্মের সদন।।
চর গিয়া যুধিষ্ঠির রাজারে কহিল।
শুনি ধর্ম্মপুত্র তবে স্বীকার করিল।।
এই মত স্বীকার করিয়া দুইদলে।
হরিষ-বিষাদ-মতি হইল সকলে।।
ধর্ম্ম-ন্যায়যুদ্ধ শুনি সাধু রাজগণ।
আনন্দে বিভোলচিত্ত হৈল সর্ব্বজন।।
এই মত সম্মত হইয়া দুই দলে।
সংগ্রামে প্রবৃত্ত হৈল বাদ্য-কোলাহলে।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পৃথিবী পূরিল।
দুই দলে কোলাহল অনেক হইল।।
একাদশ অক্ষৌহিণী-পতি দুর্য্যোধন।
সাত অক্ষৌহিণী-পতি ধর্ম্মের নন্দন।।
সবে মহাবীর্য্যবন্ত সবে মহাশূর।
দুইদলে সিংহনাদ কাঁপে তিনপুর।।
পূর্ব্ব ও পশ্চিম ভাগে রহে সৈন্যগণ।
রচিল বিচিত্র ব্যূহ গঙ্গার নন্দন।।
ভেরী শঙ্খ দুন্দুভি অনেক বাদ্য বাজে।
বাদ্যের শবদে কম্প হৈল সর্ব্বরাজে।।
রথী মহারথীপতি করে সিংহনাদ।
দুইদলে বাদ্য বাজে জয় জয় বাদ।।
দুঃশাসনে আজ্ঞা তবে কৈল দুর্য্যোধন।
শীঘ্রগতি আন রথ করিয়া সাজন।।
বিচিত্র রথেতে শোভা পাইল কুরুনাথে।
সারি সারি শ্বেতছত্র আশ্চর্য্য দেখিতে।।
কনক সদৃশ দিব্য শোভা কলেবর।
কনক কিরীট মাথে দেখিতে সুন্দর।।
যুদ্ধস্থানে উপনীত হৈল কুরুনাথ।
একাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের সহিত।।
নানাবাদ্য কোলাহল সাজে সৈন্যগণ।
বাদ্যের শবদে কম্প হৈল ত্রিভুবন।।
বিবিধ প্রকারে সাজে সব সৈন্যগণ।
নানাবিধ অলঙ্কার অঙ্গেতে শোভন।।
গজ বাজি রথ ধ্বজ পতাকা সুন্দর।
কাঞ্চন রচিত সব রথ মনোহর।।
বিবিধ পতাকা শোভে বিদ্যুৎ ঝলমল।
কনক-মণ্ডল কর্ণে কনক-কুণ্ডল।।
অঙ্গে অলঙ্কার সব সুন্দর সুবেশ।
সংগ্রামের স্থানে সবে করিল প্রবেশ।।
একাদশ অকৌহিণী সিংহের গর্জ্জন।
ভীষ্ম তাহে সেনাপতি বিক্রমে ভীষণ।।
দুর্য্যোধন নরপতি সাজাইল দলে।
চন্দ্রের উদয় যেন সমুদ্রের জলে।।
রচিল বিচিত্র ব্যূহ গঙ্গার কুমার।
চক্রাকার শবব্যূহ পরম সুন্দর।।
ব্যূহে নিয়োজিল মহা মহাযোদ্ধাগণ।
বাম শৃঙ্গেতে ব্রহ্মা কৈল নিয়োজন।।
অশ্বত্থামা ভূরিশ্রবা প্রতীপ-নন্দন।
দক্ষিণ শৃঙ্গের দিকে কৈল নিয়োজন।।
ব্যূহের অগ্রেতে হৈলা দ্রোণ মহাশয়।
মধ্যেতে রহিল ভীষ্ম সংগ্রামে দুর্জ্জয়।।
ব্যূহ-অভ্যন্তরেতে রহিল দুর্য্যোধন।
চতুর্দ্দিকে বেষ্টিত সকল রাজগণ।।
ডাক দিয়া বলে ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
সাবধানে শুনহ যতেক বীরগণ।।
হিত উপদেশ কহি না হও বিমুখ।
সংগ্রামের মুখ্য ধর্ম্ম ক্ষত্রিয়ের সুখ।।
প্রাণ উপেক্ষিয়া সবে করিবে সংগ্রাম।
সংগ্রামে বিমুখ হৈলে নাহি যশ নাম।।
সম্মুখ সংগ্রামে যেই না হয় বিমুখ।
চিরকাল স্বর্গে রহে ব্রহ্মার সম্মুখ।।
অনিত্য সংসার নিত্য নহে কদাচন।
ক্ষত্রকুলে জন্মি ক্ষিতি করিবে শাসন।।
পরাণে কাতর নাহি হবে কদাচন।
ক্ষত্র হৈয়া সংগ্রামে পলায় যেই জন।।
শুনহ তাহার কথা যত বিবরণ।
অন্তকালে নরকেতে হয়ত গমন।।
ইহা জানি বিমুখ না হৈবে কদাচন।
প্রাণ আশা ছাড়ি সবে কর মহারণ।।
ভীষ্মের বচন শুনি যত রাজগণ।
সাধু সাধু বলি প্রশংসিল সর্ব্বজন।।
ক্ষত্রশিরোমণি ভীষ্ম সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞাতা।
যে কহিলা মহাশয় না হয় অন্যথা।।
এতেক বলিয়া সবে কৈল সিংহনাদ।
নানাবিধ বাদ্য বাজে জয় জয় বাদ।।
শঙ্খ দুন্দুভি বাজে পটহ মাদল।
অনেক মৃদঙ্গ বাজে বহুত কল্লোল।।
দুর্য্যোধনে কহে তবে গঙ্গার নন্দন।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর শুনহ রাজন।।
যাবৎ থাকিব আমি রণে যোদ্ধাপতি।
কর্ণ অস্ত্র না লবে না হবে সেনাপতি।।
শুনি দুর্য্যোধন রাজা দিল অনুমতি।
সংগ্রামে সাজিল তবে ভীষ্ম যোদ্ধাপতি।।
আরবার কহে ভীষ্ম কৌরব-ঈশ্বরে।
দশদিন ভার মম হইল সমরে।।
নিজ সৈন্য রক্ষা করি অন্যেরে নাশিব।
রথী দশ সহস্রেক প্রত্যহ মারিব।।
অর্জ্জুন সহিত যুদ্ধে শ্রীহরি সাক্ষাৎ।
রথী দশ সহস্রেক করিব নিপাত।।
ব্যূহের অগ্রেতে গেলা করিয়া সাজন।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল গগন।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।।
০৩. অর্জ্জুন-যুধিষ্ঠির সংবাদ
সঞ্জয় কহিল রাজা কর অবধান।
ব্যূহ-কথা শুনিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
অর্জ্জুনে ডাকিয়া রাজা বলেন বচন।
সাবধানে কর ভাই উপস্থিত রণ।।
অল্প সৈন্য আমার অনেক কুরুকুল।
প্রকার করিয়া কর আপনে বহুল।।
ধৃষ্টকেতু ভীমসেন বিরাট প্রভৃতি।
জয়সেন সাত্যকি দ্রুপদ মহামতি।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন জয়ৎসেন সত্যজিত বীর।
অভিমন্যু চেকিতান আদি মহাধীর।।
সহদেব সুদেব নকুল নরপতি।
কারস্কর ভোজবংশ আদি মহামতি।।
এই সব বীর আছে বীরের প্রধান।
আপনি বুঝহ ভাই করিয়া বিধান।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন ধনঞ্জয়।
বহু সৈন্য বহু গুণ নহে মহাশয়।।
এই কৃষ্ণ দেবরাজ কর অবধান।
অনেক সঙ্কট হৈতে হৈবে পরিত্রাণ।।
হেন নর-নারায়ণ তোমার সহায়।
ইহাতে সংহার কুরু হইবে নিশ্চয়।।
অনাদি-নিদান এই প্রভু নারায়ণ।
আমার সারথি হৈল বিজয় কারণ।।
যথা ধর্ম্ম তথা কৃষ্ণ তথায় বিজয়।
বেদের বচন ইথে নাহিক সংশয়।।
অর্জ্জুন বচন শুনি ধর্ম্ম নরপতি।
চিত্তেতে প্রবোধ পেয়ে কহেন ভারতী।।
যে কহিলে ধনঞ্জয় নাহিক সংশয়।
সংসার ঈশ্বর এই প্রভু দয়াময়।।
যাহাতে জনম স্থিতি যাহাতে প্রলয়।
তাহার প্রসাদে মোরা হইব বিজয়।।
তথাপিহ ভ্রম ভাই হয় মোর মনে।
সেনাপতি কুরুকুলে গঙ্গার নন্দনে।।
ভুবনে দুর্জ্জয় বীর ভুবনে বিজয়।
কিরূপে তাহার রণে হবে পরাজয়।।
ভুবনে বিজয়ী দ্রোণ কর্ণ মহামতি।
অশ্বত্থামা কৃপাচার্য্য বাহ্লিক প্রভৃতি।।
এসব থাকিতে নাহি দুর্য্যোধন-ক্ষয়।
এই হেতু চিত্তে মোর বড়ই বিস্ময়।।
এত শুনি হাসি পুনঃ বলে ধনঞ্জয়।
এই হেতু চিন্তা কেন কর মহাশয়।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত কথা পাসরিলে কেনে।
ধৃষ্টদ্যুন্ন জন্মিয়াছে দ্রোণ-বিনাশনে।।
শিখণ্ডীর পূর্ব্বকথা জানহ আপনে।
ভীষ্মের নিধনহেতু জানে জগজ্জনে।।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর শুনহ রাজন।
সূতপুত্র মোর হাতে ত্যজিবে জীবন।।
বৃকোদর মারিবেক গান্ধারী-তনয়।
সাত্যকির হাতেতে মরিবে রাজচয়।।
কুরুকুলে অমঙ্গল দেখি অতিশয়।
নিশ্চয় জানিহ কৌরবের পরাজয়।।
বিনা মেঘে বিদ্যুৎ আকাশে প্রকাশয়।
উল্কাপাত নির্ঘাত যে দেখি শব্দময়।।
মেদিনী কম্পিত ঘন প্রভাতের ভানু।
বিনা মেঘে শব্দ শুনি কাঁপে অঙ্গ তনু।।
বহু অলক্ষণ দেখি দুর্য্যোধন-দলে।
চিত্ত স্থির নরপতি কর মোর বোলে।।
০৪. পাণ্ডবগণের যুদ্ধসজ্জা
সঞ্জয় বলেন, শুন অম্বিকা নন্দন।
অর্জ্জুনের এত বাক্য শুনিয়া তখন।।
চিত্তেতে প্রবোধ পেয়ে বসিলা রাজন।
যুদ্ধ হেতু আজ্ঞা দিল করিতে সাজন।।
রাজার আদেশ পেয়ে ইন্দ্রের কুমার।
অনুচরে ডাকি আজ্ঞা দিলেন সত্বর।।
বাদ্য বাজাইয়া সব সাজিতে সেনারে।
যুদ্ধহেতু সাজন করিতে সবাকারে।।
আজ্ঞামাত্র অনুচর সৈন্য সাজাইল।
রথী মহারথীগণ সাজিতে লাগিল।।
বিবিধ বাজনা বাজে নাচে বীরগণ।
বাদ্যের শবদে কম্প হৈল ত্রিভুবন।।
কৃষ্ণেরে করিয়া স্তুতি ইন্দ্রের নন্দন।
শুভক্ষণে রথোপরে কৈল আরোহণ।।
সারথি হইয়া ‍কৃষ্ণ বসিলা রথেতে।
একে একে বীরগণ লাগিলা সাজিতে।।
বিবিধ প্রকারে সব করিল সাজন।
নানাবিধ অলঙ্কার অঙ্গেতে ভূষণ।।
শঙ্খ ভেরী মৃদঙ্গাদি নানা বাদ্য বাজে।
বাদ্যের শবদে কম্প হৈল সর্ব্বরাজে।।
নানাবিধ অস্ত্র সব করিয়া সাজন।
নানাবিধ অরঙ্কার অঙ্গেতে ভূষণ।।
শঙ্খ ভেরী মৃদঙ্গাদি নানা বাদ্য বাজে।
বাদ্যের শবদে কম্প হৈল সর্ব্বরাজে।।
নানাবিধ অস্ত্র সব করিয়া সাজন।
যুদ্ধস্থান উপনীত পাণ্ডবের গণ।।
মহাবিচক্ষণ পার্থ ইন্দ্রের নন্দন।
সূচীমুখ দিব্য ব্যূহ করিল রচন।।
ব্যূহমুখে নিয়োজিল মহারথিগণ।
সহদেব ভীম আদি শিনির নন্দন।।
বামশৃঙ্গে রাখিল সাত্যকি মহাবীরে।
দক্ষিণ শৃঙ্গেতে নিয়োজিলে নুকলেরে।।
মধ্যেতে রাখিল যুধিষ্ঠির নরপতি।
ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি বীর তাহার সংহতি।।
বিবিধ বাজনা বাজে শব্দ জয় জয়।
ব্যূহের অগ্রেতে হৈল পার্থ মহাশয়।।
তবে ভীষ্ম মহাবীর গঙ্গার নন্দন।
সিংহনাদ করি শঙ্খ করিলা নিঃস্বন।।
শঙ্খের নিঃস্বনে পূর্ণ হইল গয়ন।
বিপুল শব্দেতে ভীত হৈল পাণ্ডুগণ।।
দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা আদি বীরগণ।
এককালে সবে শঙ্খ করিল নিঃস্বন।।
কোটি কোটি শঙ্খনাদ হৈল এককালে।
প্রলয়কালেতে যেন সমুদ্র উথলে।।
ডগর ডিণ্ডিম ভেরী কাংস্য করতাল।
সহস্র সহস্র কোটি বাজয়ে বিশাল।।
তবে পার্থ মহাবীর সংগ্রামে দুর্জ্জয়।
দেবদত্ত শঙ্খ বীর সত্বরে বাজায়।।
পাঞ্চজন্য বাজান সে নিজে নারায়ণ।
বাজান সুধীর শঙ্খ মাদ্রীর নন্দন।।
পুণ্ডরীক শঙ্খ শব্দে বৃকোদর বীর।
অনন্তবিজয় শঙ্খে পূরে যুধিষ্ঠির।।
মণিপুষ্প শঙ্খ তবে সহদেব বীর।
বাজায় সুনাদ শঙ্খ সাত্যকি সুধীর।।
যার সেই শঙ্খনাদ করে বীরগণ।
সহস্র সহস্র হয় শঙ্খের নিঃস্বন।।
এককালে সবাকার হয় শঙ্খবর।
শঙ্খের শবদে ভয় পাইল কৌরব।।
এককালে হৈল যেন শত বজ্রাঘাত।
মহাশব্দে ভয়াকুল হৈল কুরুনাথ।।
দুইদলে বাদ্য বাজে গণনা না হয়।
মহাভয়ঙ্কর শব্দে হইল প্রলয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হেলে তব তরি।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদদ্বন্দ্ব।
কাশীরাম দাস কহে পয়ার প্রবন্ধ।।
০৫. অর্জ্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের যোগকথন
সঞ্জয় বলেন, রাজা শুন সাবধানে।
ধনু ঊর্দ্ধে নিয়া পার্থ কহে নারায়ণে।।
দুই দল মধ্যে রথ রাখ নারায়ণ।
যতেক বিপক্ষগণে করি নিরীক্ষণ।।
কার সনে যুঝিব, মারিব কারে বাণ।
ক্ষণেক রাখহ রথ পুরুষ-প্রধান।।
এত শুনি রথ স্থির কৈলা নারায়ণ।
যতেক বিপক্ষ পার্থ করে নিরীক্ষণ।।
পিতৃতুল্য পিতামহ ভীষ্ম মহাবীর।
মন্মথ জিনিয়া মূর্ত্তি সুন্দর শরীর।।
বদন পঙ্কজ পূর্ণচন্দ্র অখন্ডিত।
করি-কর ভুজ নাসা গৃধিনী-নিন্দিত।।
শিরীষ জিনিয়া তাঁর সুকোমল তনু।
কাঞ্চন পর্ব্বতশৃঙ্গ-গর্জ্জিত সুজানু।।
দেখিয়া করুণা হৈল পার্থের হৃদয়ে।
তবে পুনঃ নিরীখয়ে দ্রোণ মহাশয়ে।।
শ্যাম তনু নাসা হনু ভুজ করি-কর।
কোটি শশি-মুখরুচি বদন সুন্দর।।
রম্ভাতরু জিনি ঊরু আঁখি মনোহর।
হরিকাটি জিনি কটি নাভি সরোবর।।
শিরীষ কুসুম-তনু বিশাল বদন।
দেখিয়া বিস্মিত-তনু হইল অর্জ্জুন।।
তবে অশ্বত্থামা কৃপ প্রতীপ নন্দন।
একে একে কুরুগণে কৈল নিরীক্ষণ।।
জ্ঞাতি বন্ধু বান্ধব মাতুল গুরুজন।
একে আরোধিক রূপ সবেতে সমান।।
যুঝিবারে আইল গুরু জ্ঞাতি বন্ধুগণ।
কোন্ শক্তি এ সবারে করিব নিধন।।
যদি কদাচিৎ আমি মারব সবারে।
মোর সম নিদারুণ নাহিক সংসারে।।
মোর সম পাপী তবে নাহি অতিশয়।
এতেক ভাবিয়া কৃষ্ণে কহে ধনঞ্জয়।।
অবধানে জগন্নাথ শুন নিবেদন।
যুঝিবারে আইল আমার বন্ধুগণ।।
কারে অস্ত্র মারিব যুঝিবে কোন্ বীর।
শোকেতে আকুল হৈল আমার শরীর।।
অঙ্গ মোর হৈল শ্লথ বল নাই তনু।
শরীর লোমাঞ্চ হৈল কাঁপে বক্ষ জানু।।
জ্ঞাতি বন্ধু বধিব রাজ্যের অভিলাষে।
যুদ্ধে কার্য্য নাহি, পুনঃ যাব বনবাসে।।
এত বলি অধোমুখে বসিলা অর্জ্জুন।
হাত হৈতে খসিল গাণ্ডীব শর তূণ।।
অর্জ্জুনের মুখ দেখি দেব নারায়ণ।
পার্থ প্রতি কহে প্রভু প্রবোধ-বচন।।
জ্ঞাতি-বন্ধু বধ হেতু ভয় হয় মন।
অহঙ্কারে আপনারে না জান অর্জ্জুন।।
উপস্থিত যুদ্ধকালে করহ এমন।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি হয়ে বিচক্ষণ।।
যোগতত্ত্ব কহি কিছু শুনহ অর্জ্জুন।
শুনিলে মনের ভ্রান্তি হইবে খণ্ডণ।।
কাহার শকতি কারে মারিবারে পারে।
কর্ম্ম অনুসারে ভোগ ভুঞ্জয়ে সংসারে।।
আমার মায়েতে বন্দী এ সব সংসার।
আমাতে উৎপত্তি স্থিতি, আমাতে সংহার।।
সত্ত্বগুণে রক্ষা আমি করি যে পালন।
রজোগুণে সৃষ্টি তমোগুণেতে নিধন।।
কাল নামে পুরুষ আমার মূর্ত্তি ধরে।
কালেতে ভুঞ্জয়ে ভোগ, কালেতে সংহারে।।
আমার বিভূতি হয় এ তিন ভুবন।
সর্ব্বঘটে আত্মরূপে থাকি অনুক্ষণ।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম দুই মূর্ত্তি আমার স্বরূপে।
সর্ব্বত্র সমান আমি হই বিশ্বরূপে।।
এত শুনি অর্জ্জুন বিস্ময় হৈল মনে।
জিজ্ঞাসিল গোবিন্দেরে করুণ বচনে।।
বিভূতি বিস্তার দেব কিরূপ তোমার।
শুনিবারে ইচ্ছা মোর ইহার বিচার।।
এত শুনি হাসি বলে দেবকী-কুমার।
একচিত্ত হয়ে শুন বিভূতি আমার।।
সর্ব্বঘটে স্থিতি মোর সর্ব্বত্র সমান।
শুন পার্থ যেইরূপে আমি বিদ্যমান।।
রুদ্রগণ মধ্যে আমি দেব পশুপতি।
নক্ষত্রগণের মধ্যে নাম অভিজিতি।।
ঐরাবত নাম মোর হস্তিগণ মাঝে।
যক্ষগণ মধ্যেতে কুবের মহারাজে।।
পশুগণে মধ্যে হই স্বরূপে কেশরী।
আদিত্যের মধ্যে নাম ধরি যে প্রহরী।।
বসুগণে বিশ্বাবসু ধরি আমি তনু।
কপিগণ মধ্যে আমি নাম ধরি হনু।।
দেবগণ মধ্যে আমি ইন্দ্র দেবরাজ।
বরুণ-স্বরূপ আমি জলচর মাঝ।।
ঋষিতে নারদ আমি, মুনিগণে প্রকাশ।
সেনাপতিগণের মধ্যে মরুত স্বরূপ।।
অগ্নিমধ্যে নাম আমি ধরি বৈশ্বানর।
অসুরেতে হিরণ্যক্ষ অসুর প্রবর।।
রাক্ষসগণের মধ্যে নাম বিভীষণ।
ভক্তগণ মধ্যে নাম প্রহ্লাদ ধারণ।।
মাস মধ্যে নাম আমি ধরি যে অঘ্রাণ।
পুষ্প মধ্যে পারিজাত নাম নিরূপণ।।
যজ্ঞ মধ্যে রাজসূয় যজ্ঞ অনুপাম।
ক্ষত্রগণ মধ্যেতে ভরত মোর নাম।।
শিল্পিগণ মধ্যে নাম বিশ্বকর্ম্মা ধরি।
মায়া মধ্যে নাম মোর বন্ধুগণে মারি।।
ছয় ঋতু মধ্যেতে বসন্ত নাম মোর।
দৈত্যগণ মধ্যে বিরোচনের কোঙর।।
অহিংসা স্বরূপ নাম ধর্ম্ম মধ্যে ধরি।
স্থান মধ্যে নাম মোর বৈকুণ্ঠ-নগরী।।
পর্ব্বতগণে মধ্যে সুমেরু স্বরূপ।
এই সব কথা কহি যোগ অনুরূপ।।
মণিরত্ন মধ্যেতে কৌস্তুভ নাম মোর।
ধাতুদ্রব্য মধ্যেতে সুবর্ণ নাম ধর।।
এইরূপ বহুবিধ আমার বিভূতি।
গণনা করিতে পারে কাহার শকতি।।
এত শুনি সন্তুষ্ট হলেন ধনঞ্জয়।
পুনরপি জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।।
কিরূপে তোমার ধ্যান করে যোগিগণ।
কহ শুনি জনার্দ্দন যোগের লক্ষণ।।
গোবিন্দ বলিল, সখা শুন একমনে।
বড়ই দুষ্কর লভে যোগিগণ ধ্যানে।।
দ্বিজকুলে জন্মি গুরু উপদেশ লবে।
গৃহাশ্রমে ধন্ধ ছাড়ি অরণ্যে পশিবে।।
আপন উদ্যান ব্যানে শোধিবে শরীর।
আমাতে আরোপি মন চিত্ত করি স্থির।।
গোকর্ণ প্রমাণ স্থান করি পরিষ্কার।
মনোময় কল্পিত বিবিধ উপহার।।
হস্তপদ প্রক্ষালন করি আচমন।
পূর্ব্বমুখে আসন করিবে নিরূপণ।।
যথা যোগশাস্ত্র মতে করিয়া আসন।
যেরূপে করিবে ধ্যান শুনহ অর্জ্জুন।।
পূর্ব্বভিতে দক্ষিণে বা উত্তর মুখেতে।
করিবে আসন দিব্য নির্ণয় যেমতে।।
পাবক স্তম্ভবায়ু করিবে সেচন।
পূর্ব্বেতে পূরক বায়ু করিবে রেচন।।
দক্ষিণে রেচক বায়ু করিবে রোধন।
উত্তরে কুম্ভক বায়ু করি নিঃসারণ।।
এইরূপে প্রাণ বায়ু করিবে শাসন।
এই সব যোগতত্ত্ব করিলে শ্রবণ।।
এইরূপ আমার চিন্তিবে তদন্তর।
দ্বিভুজ পদ্মাক্ষ বক্ষঃস্থলে রত্নহার।।
শ্রীবৎস লাঞ্ছন আমি পীতাম্বরধারী।
কিরীট কুণ্ডল কর্ণে বিচিত্র কবরী।।
বনমালা বিকশিত কণ্ঠে মণিহার।
ত্রিভঙ্গ ললিত অঙ্গ মুক্তি-অবতার।।
এই দিব্যরূপ ধ্যানে আমারে চিন্তিবে।
অবহেলে যোগী তবে ভবপার হবে।।
সূক্ষ্মরূপ আমার চিন্তিবে অনুপাম।
গবাক্ষ মার্ত্তণ্ডগত রজোগুণ ধাম।।
এসরেণু প্রমাণ সুন্দর কলেবর।
সুচারু যে সূক্ষ্মমূর্ত্তি শঙ্খচক্রধর।।
কিরীট কুণ্ডল দিব্য বনমালাধারী।
নূপুর কঙ্কণ করে শোভিত মুরারি।।
এই দিব্য সূক্ষ্মরূপ চিন্তিবে আমার।
সূক্ষ্মরূপ চিন্তিলেই হেলে হবে পার।।
এত শুনি পুনরপি কহেন অর্জ্জুন।
কহিলে গোবিন্দ তুমি অপূর্ব্ব কথন।।
কর্ম্মযোগ ক্রিয়াযোগ কিরূপ তোমার।
কর্ম্মযোগ করি যোগী কিরূপে হয় পার।।
কি কর্ম্ম করিয়া নর ভজিবে তোমারে।
কর্ম্মযোগ কহ প্রভু করিয়া বিস্তারে।।
গোবিন্দ বলেন সখা কর অবধান।
অনন্ত কর্ম্মের যোগ নাহি পরিমাণ।।
কিছু অল্প কহি শুন হৈয়া সাবহিত।
সংসারী জনের এই কর্ম্মের বিহিত।।
দ্বিজকুলে জন্মি বেদ করিবে পঠন।
আত্মধর্ম্ম রাখিয়া ভজিবে নারায়ণ।।
পূর্ব্বভিতে সমভাবে করিবে চিন্তন।
কারো সনে বিরোধ না করিবে কখন।।
শত্রু-মিত্র ভাব না করিবে কদাচন।
পুত্র মিত্র বন্ধুগণে করিবে পালন।।
যে যে ইচ্ছা করে বন্ধু মিত্র ভ্রাতৃগণ।
তাহা দিয়া তার মন করিবে তোষণ।।
যজন যাজন আদি করিবে বন্দন।
নিত্য ভিক্ষা করিবে বুঝিয়া মহাজন।।
ত্রিসন্ধ্যা করিয়া স্নান গায়ত্রী জপিবে।
এইরূপে বিপ্রগণ আমারে ভজিবে।।
ক্ষত্রকুলে জন্মিয়া শাসিবে ভূমণ্ডল।
বন্ধু বান্ধব আদি পালিবে সকল।।
সমুচিত বিধানে পালিবে প্রজাগণ।
কারো সনে দ্বন্দ্ব না করিবে কদাচন।।
দেবযজ্ঞ পিতৃযজ্ঞ সতত করিবে।
একান্ত ভকতি করি আমারে ভজিবে।।
এইরূপে কতকাল রাজত্ব করিবে।
তিন ভাগ আয়ুক্ষয় যাবত নহিবে।।
অবশেষে পুত্রে রাজা দিয়া রাজ্যভার।
ভার্য্যাসহ প্রবেশিবে অরণ্য ভিতর।।
বাণপ্রস্থ ধর্ম্ম তবে করি আচরণ।
ফলমূলাহরী হবে তপস্বী-লক্ষণ।।
যোগাসন করিয়া ত্যজিবে কলেবর।
দিব্যরথে চড়ি যাবে ইন্দ্রের নগর।।
সহমৃতা হবে তার ভার্য্যা গুণবতী।
পতি সহ ইন্দ্রপুর করিবে বসতি।।
কতকাল পত্নীসহ স্বর্গভোগ করি।
পুনরপি আসি জন্ম আসি লবে মর্ত্ত্যপুরী।।
রাজকুলে জন্ম আসি লবে দুইজন।
সেইরূপে ভোগ পুনঃ করিবে বর্জ্জন।।
এইরূপে ক্রমে ক্রমে ভজিবে আমারে।
বহুকাল পরে সেই যাবে স্বর্গপুরে।।
বৈশ্যকুলে জন্মি মাত্র অতিথি-সেবন।
শূদ্রকুলে মহাধর্ম্ম দ্বিজ-পরায়ণ।।
দাস ভাব করিয়া সেবিবে দ্বিজগণে।
সর্ব্বকর্ম্ম সমর্পিবে ব্রাহ্মণ চরণে।।
অবিদ্য সবিদ্য বেদহীন দ্বিজগণ।
তথাপি আমার তনু জানিহ অর্জ্জুন।।
এই গৃহাশ্রমে ধর্ম্মাধর্ম্ম-নিরূপণ।
চতুর্ব্বিধ পরকাল করিলে লক্ষণ।।
এত শুনি অর্জ্জুন বিস্ময় হৈয়া মনে।
করযোড়ে পুনঃ জিজ্ঞাসিলা নারায়ণে।।
যোগধর্ম্ম তুমি নাথ কহিলে আপনে।
অচিরে তোমারে যোগী পায় যোগধ্যানে।।
বহুকাল সেবি পায় গৃহাশ্রমা জনে।
তোমাতে ভকত যেই সে পায় কেমনে।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন জনার্দ্দন।
আমাতে করিলে যোগী তনু মন ধন।।
আমা বিনে যোগীগণ না জানয়ে আন।
আমি গতি আমি পতি আমি ধন প্রাণ।।
তেকারণে অল্পকালে লভে ত আমায়।
জন্ম জন্মান্তরে গৃহাশ্রম ধর্ম্ম পায়।।
এত শুনি পুনরপি বলিল অর্জ্জুন।
কিরূপ তোমার ভক্তি, ভকতি লক্ষণ।।
গোবিন্দ বলেন সখা শুন একমনে।
অনন্ত আমার ভক্তি ভকতি লক্ষণে।।
সর্ব্বজন হিত আমি করি অনুক্ষণ।
সর্ব্বজীবে সমভাব আমার করণ।।
সাত্ত্বিক ভকতি যেই জানিহ নিশ্চয়।
আমাতে বিভিন্ন তার কদাচিত নয়।।
গো-ব্রহ্ম-ভয়ার্ত্তে যেই করয়ে রক্ষণ।
সর্ব্বকর্ম্ম আমারে যে করে সমর্পণ।।
আমাতে অর্পিত চিত্ত সেবয়ে শরীর।
ভকত উত্তম সেই সর্ব্বগুণ ধরি।।
পুণ্যতীর্থে সদা যেই করয়ে ভ্রমণ।
আমার মন্দির সদা করয়ে মার্জ্জন।।
সর্ব্বজীবে তোষে ধন-বাক্য-ব্যবহারে।
উত্তম ভকত সেই বলিনু তোমারে।।
বৃত্তি দিয়া ব্রাহ্মণে স্থাপয়ে যেই জন।
অন্নজল দান দিয়া তোষে দুঃখিগণ।।
ভকত উত্তম সেই জানহ অর্জ্জুন।
এইরূপ বহুবিধ ভক্তের লক্ষণ।।
যতেক ভকতি আর ভক্তের লক্ষণ।
একে একে যোগধর্ম্ম কৈল নারায়ণ।।
ক্রমে ক্রমে তাঁরে পার্থ যত জিজ্ঞাসিল।
বিবরিয়া জগন্নাথ সকলি কহিল।।
অষ্টাদশ অধ্যায় ভারত যোগসার।
বহুবিধ ভক্তিযোগ-মার্গ ব্যবহার।।
কহিয়া তুষিল কৃষ্ণ অর্জ্জুনের মন।
তাহা কি লিখনে যায় অসংখ্য কথন।।
ভীষ্মপর্ব্বের কথা অমৃত-লহরী।
কাহার শকতি তাহা বর্ণিবারে পারি।।
শ্রুতমাত্র কহি আমি পাঁচালির ছন্দ।
রসিক সজ্জন হেতু সুধা মকরন্দ।।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র