শ্রীমদ্ভগবতগীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

অর্জুন বললেন,“হে মহাবাহো! হে কেশিনিসূধন! হে ঋষিকেশ! আমি সন্ন্যাস ও ত্যাগের প্রকৃত তথ্য পৃথকভাবে জানতে ইচ্ছা করি। ভগবান বললেন,“হে অর্জুন! পন্ডিতগণ কাম্যকর্ম ত্যাগকেই “সন্ন্যাস” বলে থাকেন এবং সূক্ষ্মদর্শিগণ সমস্ত প্রকার কর্মফল ত্যাগকেই “ত্যাগ” বলে থাকেন। কোন কোন পন্ডিতগণ কর্ম দোষযুক্ত বলে কর্ম ত্যাগ করা কর্তব্য বলে মনে করেন। অপর কেহ কেহ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা রুপ কর্ম ত্যাগ করা অবশ্যই উচিৎ নয়। তারা একে অত্যাজ্য বলে ঘোষণা করেছেন। হে ভরতসত্তম! কর্মত্যাগ বিষয়ে নিশ্চয় আমার সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! ত্যাগ ত্রিবিধ বলে শাস্ত্রে কথিত হয়েছে। যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম কোন মতেই ত্যাজ্য নয় অবশ্যই তা করা কর্তব্য। কারণ এ ধরণের কর্ম মনীষিগণকে পবিত্র করে থাকে। হে অর্র্জুন! পূর্বোক্ত যজ্ঞদানাদি কর্মের অনুষ্ঠানকালে কর্তৃত্বাভিমান ও স্বর্গাদিফল কামনা ত্যাগ করাই আমার মতে শ্রেষ্ঠ ত্যাগ।ইহাই আমার নিশ্চিত অভিমত। কিন্তু নিত্যকর্ম ত্যাগ করা কোন মতেই উচিৎ নয়। মোহবশত: নিত্যকর্ম ত্যাগ হলে তা তামসিক ত্যাগ বলে কথিত হয়। কিন্তু যারা কায়িক ক্লেশের ভয়ে নিত্যকর্ম ত্যাগ করেন, তা রাজসিক ত্যাগ বলে কথিত হয়। এ প্রকার কর্মফল ত্যাগে কোন প্রকার ফল লাভ হয় না। হে অর্জুন! আসক্তি ও কর্মফল ত্যাগ করে যে কার্যানুষ্ঠান করা হয়, তা সাত্ত্বিক ত্যাগ বলে কথিত হয়। সত্ত্বগুণসম্পন্ন, সংশয়রহিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি দুঃখ কর্মে দ্বেষ করেন না এবং শুভকর্মে আসক্ত হন না। দেহাভিমানী ব্যক্তি নি:শেষে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করতে সমর্থ হয় না; কিন্তু যিনি কর্মফল ত্যাগী তিনিই ত্যাগী বলে কথিত হন। অত্যাগীগণ মরণোত্তর অনিষ্ট(অসুখকর), ইষ্ট(সুখকর) ও মিশ্র(সুখ ও দু:খ মিশ্রিত) এ তিন প্রকার কর্মফল ভোগ করতে হয় কিন্তু সন্ন্যাসীদের কোন কর্মফল ভোগ করতে হয় না। হে মহাবাহো! সকল কর্ম সিদ্ধির নিমিত্ত সাংখ্য ও বেদান্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে যে পঞ্চবিধ কারণ নিরুপিত আছে, তা তুমি আমার নিকট হতে অবগত হও। শরীর, অহংকার, চক্ষুরাদি বিবিধ ইন্দ্রিয়, নানাবিধ চেষ্টা এবং এতৎকারণ সমূহের মধ্যে দৈব- এ পাঁচটি হচ্ছে নির্দিষ্ট আছে। ধর্মই হোক বা অধর্মই হোক মানুষ শরীর, বাক্য ও মনের দ্বারা যে কোন কার্যানুষ্ঠান করুক না কেন পূর্বোক্ত পঞ্চবিধই তার কারণ। এ রূপ কারণ অবধারিত হলে যে মূঢ় ব্যক্তি অসঙ্গ ও উদাসীন আত্মাকে কর্তৃরূপে অবলোকন করে সে দূর্মতি কখনও সাধুদর্শী হয় না। “আমি কর্তা” এরূপ অভিমান যিনি করেন না, যার বুদ্ধি কার্যে লিপ্ত হয় না, তিনি এ সমস্ত লোকসমূহকে হত্যা করেও হত্যা করেন না ও হত্যার জন্য তাকে কোনরূপ ফলভোগও করতে হয় না।
জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা- এ তিনটি কর্মের প্রবর্ত্তক। আর করণ, কর্ম ও কর্তা এ তিনটি হচ্ছে কর্মের আশ্রয়। সাংখ্যশাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা সত্ত্বাদি গুণভেদে তিন প্রকার কথিত হয়েছে। তা আমার নিকট হতে যথাযথরূপে শ্রবণ কর। যে জ্ঞানের দ্বারা পরস্পর বিভক্ত ভুতগণের(আত্মা) মধ্যে অভিন্নরূপে অবস্থিত ও অব্যয় পরমাত্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ হয় তাই সাত্ত্বিক জ্ঞান। পৃথক পৃথক দেহাদি ভূতসমূহে যে জ্ঞানের দ্বারা পৃথক পৃথক পদার্থের অনুভব হয় তা রাজসিক জ্ঞান বলে কথিত হয়। আর যে জ্ঞানের দ্বারা কোনও একটি কার্যে “ইহাই সব” এ রকমভাবে আসক্তির উদয় হয় এরুপ অযৌক্তিক ও অযথার্থ জ্ঞানই তামসিক জ্ঞান বলে অভিহিত হয়। ফলকামনারহিত পুরূষ সঙ্গশূন্য ও রাগদ্বেষাদি বর্জিত হয়ে যে নিত্য কর্মের অনুষ্ঠান করে তাই সাত্ত্বিক কর্ম। সকাম বা অহংকারযুক্ত ব্যক্তি যে কৃচ্ছ্রসাধ্য কাম্য কর্মসমূহের অনুষ্ঠান করেন সে কাম্য কর্মসমূহ রাজসিক কর্ম। ভাবী শুভাশুভ, ক্ষয়, হিংসা পৌরুষ আদি বিচার না করে মোহবশত: যে কর্ম করা হয় তাই তামসিক। ফল কামনাবর্জিত, অহংকারশূন্য, ধৃতি ও উৎসাহযুক্ত এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নির্বিকার চিত্ত কর্তাকেই সাত্ত্বিক কর্তা বলে। বিষয়ানুরাগী, কর্মফলাকাঙ্খী, লুদ্ধচিত্ত, হিংসা-পরায়ণ, অশুচি, হর্ষ ও শোকযুক্ত যে কর্তা তাকে রাজসিক কর্তা বলে কথিত হয়। আর যে ব্যক্তি অসাবধান, বিবেকশূন্য, উদ্ধত,শঠ, পরের অপমানকারী, অলস, বিষাদযুক্ত ও দীর্ঘসূত্রী শাস্ত্রে সে ব্যক্তিকে তামসিক কর্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে। হে ধনঞ্জয়! গুণানুসারে বুদ্ধির ও ধৃতির ত্রিভিদ ভেদ নির্দিষ্ট হয়ে থাকে, আমি ইহা সম্যকরুপে পৃথক পৃথক করে বলছি। হে পার্থ! যে বু্দ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি, কার্য ও অকার্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মুক্তি পরিজ্ঞাত হওয়া যায় তাই সাত্ত্বিকী জ্ঞান। হে পার্থ! যে বুদ্ধির দ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য অযথাবৎ অর্থাৎ সন্দিগ্ধরূপে জানতে পারা যায় সে বুদ্ধি রাজসিকী। হে পার্থ! যে বু্দ্ধি অন্ধকারাবৃত হয়ে অধর্মকে ধর্ম এবং সকল প্রকার বিষয়কেই বিপরীতরূপে প্রতিপন্ন করে, সে বুদ্ধিই তামসী। হে পার্থ! যে অব্যভিচারণিী ধৃতি যোগের দ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া শক্তিকে নিরোধ করে তাই সাত্ত্বিকী ধৃতি। হে পার্থ! হে অর্জুন! যে ধৃতি প্রসঙ্গত: ফললাভের অভিসন্ধি করে ধর্ম, অর্থ ও কাম ধারণ করে থাকে তা রাজসিক ধৃতি। হে পার্থ! যে ধৃতির সাহায্যে স্বপ্ন, ভয়, শোক, বিষাদ ও মদ আদি ত্যাগ করে না তাই তাসসী ধৃতি। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! অভ্যাসবশত: যে সুখে আসক্তি বৃদ্ধি পায় ও যে সুখ প্রাপ্ত হলে দু:খের অবসান হয়, আমি সে সুখের ত্রিবিধ প্রকার ভেদ তোমার নিকট বলছি তুমি তা শ্রবণ কর। যে সুখ প্রথমে বিষের মত ও পরিণামে অমৃততুল্য মনে হয় এবং যে সুখ দ্বারা আত্ম বিষয়িণী বৃদ্ধির প্রসন্নতা জন্মে যোগী পুরুষগণ তাকেই সাত্ত্বিক সুখ বলেছেন। বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে প্রথমে যে সুখ অমৃততুল্য ও পরিণামে বিষের মত বোধ হয় তা রাজসিক সুখ। যে সুখ প্রথমে ও পরিণামে বুদ্ধিকে মোহমুগ্ধ করে এবং নিদ্রা,আলস্য ও প্রমাদ থেকে উৎপন্ন হয় তা তামসিক সুখ বলে কথিত হয়।
পৃথিবীতে বা স্বর্গে দেবতাদের মধ্যে এমন কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই যে প্রকৃতিজাত এ ত্রিগুণ থেকে মুক্ত। হে পরন্তপ! ত্রিগুণজাত অনুসারেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্মসমূহ বিভক্ত হয়েছে। শম, দম, তপ:, শৌচ,ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এ কয়টি ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম। শৌর্য, তেজ:, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে অপলায়ন, দান ও ঈশ্বরভাব এ কয়টি ক্ষত্রিদের স্বভাজত কর্ম। কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বভাজাত কর্ম এবং একমাত্র পরিচর্যাত্মক কর্মই শূদ্রের স্বভাবজাত। মানুষ নিজ নিজ কর্মে নিষ্ঠাবান হলে সিদ্ধি লাভ করে থাকে। স্ব স্ব কর্মে নিষ্ঠাযুক্ত থাকলে করুপে সিদ্ধি লাভ হয় তা তুমি শ্রবণ কর।হে অর্জুন! যে ঈশ্বর আকাশাদি ভূতসমূহকে সৃষ্টি করেছেন, যে ঈশ্বর সচরাচর বিশ্বের সর্বত্র বিদ্যমান রয়েছেন মানুষ নিজ কর্ম দ্বারা তাঁকে অর্চনা করে সিদ্ধি লাভ করে থাকে।
সম্যকরুপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা স্বধর্ম অঙ্গহীন হয়ে অনুষ্ঠিত হলেও শ্রেষ্ঠ; কেন না স্বভাববিহিত কর্ম করলে মানুষকে পাপ ভাগী হতে হয় না। (অসমাপ্ত)
ইতি: "মোক্ষযোগ" নামক শ্রীমদ্ভগবত গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্তের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র