দেবতাদের মন্দার পর্বতে আগমন এবং মহাদেবের নিকট নারদের প্রশ্ন

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করলেন এবং ষোল হাজার রাজকন্যাকে দ্বারকায় নিয়ে আসলেন এবং বিধানমতে ষোল হাজার রাজকন্যাকে বিবাহ করলেন। মহর্ষি নারদ এ সংবাদ শ্রবণ করে নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ষোল হাজার রাজকন্যার পাণিগ্রহণ এবং এক কৃষ্ণ এক শরীরে এক সময়ে ষোল হাজার স্ত্রীর গৃহে অবস্থান করেন এ দুটি বিষয় নারদকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি আশ্চর্যও হলেন বটে। কিন্তু কৌতুহল দমন করতে পারলেন না। তিনি তা স্বচক্ষে তা দর্শন করার অভিপ্রায়ে দ্বারাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দ্বারকায় তখন কি অপূর্ব শোভা বর্ধন করছিল। পুষ্পিত উপবনসমূহে বিহগকুল কূজন করছিল। অলিকুল পুষ্পে পুষ্পে মধু আহরণ করছিল।সরোবরে ইন্দীবর, পদ্ম, কুমুদ ও উৎপলসমূহে পরিব্যাপ্ত জলাশয়ে সারস ও হংস উচ্চকন্ঠে কলধ্বনি করে ক্রীড়া করছিল। দ্বারকায় স্ফটিক ও রজতনির্মিত লক্ষ লক্ষ নূতন প্রাসাদ সকল শোভা পাচ্ছিল এবং সে সকল প্রাসাদ মহামারকতের ন্যায় চাকচিক্যশালী ও স্বর্ণ-রত্নাদির ন্যায় পরিচ্ছিন্ন ছিল। পরস্পর বিভক্ত প্রশস্ত প্রশস্ত রাজপথ, ক্ষুদ্রপথ, চত্বর, আপণ, অন্নশালা এবং দেবালয়সমূহে নগরী মনোরহ হয়েছিল। পুরীর পথ, আপণ, বীথি, ও দেহলী প্রভৃতি স্থান উত্তমরূপে জলসিক্ত ও নিত্য ধৌত হতো এবং ধ্বজ-পতাকার আড়ালে সূর্যদেব যেন ঢাকা পড়লেন। মহর্ষি নারদ দ্বারকার অপূর্ব শোভা দর্শনে বিস্মিত হলেন। দ্বারকার অভ্যন্তরস্থ শ্রীহরির অন্ত:পুর অপূর্ব শ্রীসম্পন্ন এবং লোকপালসমূহে পূজিত; শিল্পকার্য্যে বিশ্বকর্ম যেন তাঁর যাবতীয় নৈপুণ্যে উজার করে দিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র পত্নীগণের ষোড়শ সহস্র গৃহে পরিশোভিত অপূর্ব অন্ত:পুর মধ্যে দেবর্ষি নারদ উপস্থিত হয়ে শ্রীহরির সে সুবিস্তীর্ণ অন্ত:পুরের একটি ভবনে প্রবেশ করলেন। ঐ ভবনটি প্রবালস্তম্ভে সুশোভিত, বৈদুর্য্য মণিফলকে আচ্ছাদিত এবং গৃহের ভিতরের প্রাচীর সকল ইন্দ্রনীলসম বিলেপনে এতই স্বচ্ছ ছিল যে ভিত্তির বহির্ভাগের চিক্কণ ভাব ও জ্যোতি: কিছুতেই ম্লান হতো না। সে পুরী বিশ্বকর্মবিনির্মিত মুক্তাদাম বিলম্বিত বিতান দ্ধারা এবং উৎকৃষ্ট মণিমালা দ্ধারা গজ নির্মিত মহামুল্যবান আসন ও পর্য্যঙ্ক সকল গৃহের অভ্যন্তরে শোভা পাচ্ছিল। শুভ্রবসনা নিষ্ককন্ঠী দাসীগণ এবং কঞ্চুক উষ্ণীব বস্ত্র এবং মণিময় কুন্ডল ধারণে সুসজ্জিত দাসগণের পরিসেবিত কাজ দর্শনে দেবর্ষি নারদ অত্যন্ত আনন্দিত হলো। বহুসংখ্যক রত্নপ্রদীপের আলোকে গৃহের অন্ধকার দূরিভূত হয়েছিল, গৃহের ভিতর হতে অগুরুধূমপূঞ্জ নির্গত হচ্ছিল।ময়ুরেরা তা দর্শন করে মেঘ মনে করে উচ্চ কেকারবে নৃত্য করছিল। দেবর্ষি নারদ গৃহে প্রবেশ করে যদুপতিকে দর্শন করলেন। তিনি দেখলেন- সমান বয়স, সমান গুণ, সমান রূপ, সমান বেশ এরূপ সহস্র সহস্র দাসীতে পরিবৃতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মহিষী রুক্মিণী কাঞ্চনদন্ডশালী চামর দ্ধারা সর্বদা সাত্ত্বত পতিকে ব্যঞ্জন করছেন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নারদকে সহসা দেখে পর্য্যঙ্ক হতে উত্থানপূর্বক কিরীটি শোভিত মস্তক অবনত করে পদযুগলে প্রণাম করে অঞ্জলিপুটে দন্ডায়মান হয়ে তাকে স্বীয় আসনে উপবেসন করালেন। যার চরণ ধৌত জলে গঙ্গা তীর্থ হয়েছেন, তিনি গুণযুক্ত স্বীয় ব্রহ্মণ্যদেব নামের মাহাত্ম্য রক্ষার্থে স্বয়ং জগদগুরু হয়েও নারদের পদযুগল প্রক্ষালন করে, সে জল নিজ মস্তকে ধারণ করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগৎ সংসারের একমাত্র আরাধ্যতম ও সাধুগণের একমাত্র তিনিই গতি। ‘ব্রহ্মণ্যদেব’ নাম একমাত্র তারই উপযুক্ত। তারপর পুরাণ ঋষি নরসখা নারায়ণ শাস্রোক্ত বিধানমতে দেবর্ষিকে পূজা করে পরিমিত অথচ অমৃতবর্ষী বাক্য দ্বারা তার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বললেন,“ প্রভু! আপনার কি কার্য সম্পন্ন করতে হবে, আমাকে আদেশ করুন” নারদ বলিলেন,“ হে প্রভু! আপনি অখিল লোকের অধিশ্বর। সাধুজনের সহিত মৈত্রী এবং খলপ্রকৃতি দুষ্টগণের দমন করা; এ উভয়ই আপনার কার্য, এতে আশ্চর্যে্যর কিছুই নেই। আপনি জগতের স্থিতি ও রক্ষা এবং মুক্তির জন্য স্বীয় ইচ্ছায় ধরাতলে অবতীর্ণ হন। আমরা ইহা সম্যকরূপে জানি। অপূর্ব সৌভাগ্যবলেই চরণযুগল দর্শন করে আমার জন্ম সার্থক হলো। আপনার ঐ সুদর্শন চরণযুগল দর্শন করা কারো ভাগ্যেই প্রায়ই ঘটে না। ভক্তজনের মুক্তির একমাত্র কারণ আপনার চরণযুগল দর্শন; সর্বজ্ঞ ব্রহ্মাদি লোকপালগণ আপনাকে হৃদয়ে ধারণপূর্বক ধ্যান করেন; আমার প্রতি আপনি এ অনুগ্রহ করুন যেন দুরতিক্রমণীয়া সংসার কূপে পতিত ব্যক্তির উদ্ধারের জন্য একমাত্র অবলম্বন স্বরূপ সেই চরণকমল চিন্তা করেই যেন আমি বিচরণ করতে পারি। চিরকাল যেন ঐ চরণযুগলে আমার স্মৃতি থাকে। তারপর দেবর্ষি নারদ যোগেশ্বরের অনির্বচনীয় যোগমায়া জানিবার ইচ্ছায় অন্য এক পত্নীর গৃহে প্রবেশ করলেন। সেগৃহেও তিনি দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ প্রিয় ভার্য্যাকে লয়ে উদ্ধবের সহিত অক্ষক্রীড়া করছে। দেবর্ষি নারদকে দর্শন করামাত্রই শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যুত্থান ও আসনাদি দ্ধারা পূজা করলেন। যেন প্রথম তার সহিত সাক্ষাত হলো এমন ভাব নিয়ে বললেন,“ দেবর্ষি নারদ, আপনি কখন আগমন করেছেন? আপনার অভিপ্রায় আমাকে বলুন। আপনারা পূর্ণ আর আমরা অপূর্ণ। অতএব আমরা আপনার কি অভিষ্ট পূরণ করিব? আপনি বসুন। আপনার আদেশ দ্ধারা আমার জন্ম সফল করুন।” শ্রীকৃষ্ণের এরূপ বাক্য শ্রবণ করে দেবর্ষি নারদ বিস্মিত হলেন এবং তথা হতে উঠে কিছু না বলে অন্য গৃহে প্রবেশ করলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শিশু সন্তানগণকে লালন পালন করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে অন্য গৃহে প্রবেশ করে দেখলেন গোবিন্দ স্নান করার জন্য তৈরী হচ্ছেন। এরূপভাবে কোন গৃহে বা পঞ্চ মহাযজ্ঞ দ্ধারা আহ্বনীয়াদি অগ্নিতে হোম করছেন; কোন গৃহে দ্বিজগণকে ভোজন করিয়ে নিজে ভোজন করছেন; অন্য গৃহে বাগযত হয়ে পরব্রহ্মকে ধ্যান করত: সন্ধ্যাপোসনা করছেন; একস্থানে অসি চর্ম লয়ে অসিপথে বিচরণ করছেন; আর এক স্থানে অশ্বপৃষ্ঠে ও গজে চড়ে ভ্রমণ করছেন; কোথায় বা পর্য্যঙ্কে শায়িত- বন্ধীগণ স্তব করছেন; কোন স্থানে গিয়ে দেখলেন উদ্ধবাদি মন্ত্রিগণসহ কোন গভীর বিষেয়ে মন্ত্রণা করছেন; কোন গৃহেনারদ দেখলেন- শ্রীকৃষ্ণ দ্বিজগণকে অলঙ্কৃত গোদান করছেন; কোথাও বা ইতিহাস ও পুরাণাদি মঙ্গলকথা শ্রবন করছেন; কোন গৃহে প্রিয়ার সহিত হাস্যালাপ করছেন; কোন গৃহে ধর্ম, অর্থ ও কাম-সেবায় রত আছেন; একস্থানে দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতি পর পুরুষ পরমাত্মার ধ্যান করছেন; কোথায় বা কামনা-পূরণ, ভোগপ্রদান ও পূজা দ্ধারা গুরুগণের সেবা করছেন; কোন গৃহে শ্রীকৃষ্ণ কারো সাথে কলহ করছে বা কারো সাথে সন্ধি করছে; আর এক গৃহে দেখলেন বলদেবের সহিত একসাথে বসে সাদুগণের মঙ্গল চিন্তা করছেন; কোন গৃহে দেখলেন পুত্র-কন্যাগণের বিবাহ দিবার জন্য এবং যৌতুকাদি প্রদানের জন্য যত্নশীল রয়েছেন; যোগেশ্বর বাসুদেবের পুত্রবধুর আনয়ন বা দুহিতাকে শ্বশুরালয়ে প্রেরণ উৎসব অবলোকন করে বিস্ময়াপন্ন হয়, সে বিষয়ে কল্পনা করছেন; বহুদক্ষিণাবিশিষ্ট যজ্ঞের অনুষ্ঠানে কোন গৃহে শ্রীকৃষ্ণ স্বগণবিশিষ্ট দেবতাগণের অর্চনা করছেন, কোথাও বা কূপ, আরাম ও দেবমন্দিরাদির প্রতিষ্ঠা দ্বারা প্রচুর পূর্ত্তকর্মের অনুষ্ঠান করছেন; নারদ আরও দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ যদুশ্রেষ্ঠগণে বেষ্টিত হয়ে কোথাও বা সিন্ধুদেশীয় অশ্বে আরোহণ করে মৃগয়া করতে করতে যজ্ঞের পশুসকল বধ করছেন; ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বজ্ঞ হলেও নিজের অন্ত;পুরের গূঢ় রহস্য জানার অভিপ্রায়ে স্ত্রীবেশ ধারণ করে সে যোগেশ্বরকে ইতস্তত বিচরণ করছেন; তারপর মানব লীলা করার জন্য অবতীর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এরূপ অচিন্ত্য শক্তির অনির্বচনীয় বিকাশ দর্শনে বিস্মিত দেবর্ষি নারদ ঈষৎ হাসলেন এবং সর্বান্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণকে বললেন,“ হে যোগেশ্বর! যোগেন্দ্রগণ এবং মায়াশক্তিসম্পন্ন লোকপালগণও আপনার দর্শন লাভ করতে পারে না, কেবল আপনার ভবদীয় চরণকমল সেবা দ্ধারাই অবগত হয়ে আপনার অনন্ত যোগমায়ার প্রভাব অদ্য জানতে পারলাম। হে দেব! আমাকে আজ্ঞা দিন। আপনার ভূবনপাবনী লীলাকথা গান করতে করতে ভবদীয় যশোরাশি পরিব্যাপ্ত নানা লোকে আমি বিরচণ করি।” ভগবান বললেন,“ হে ব্রাহ্মণ! আমি ধর্মের বক্তা, অনুষ্ঠাতা ও অনুমোদিতা, জগতে সেই সকল ধর্মের অনুষ্ঠান প্রণালী যাতে লোককে শিক্ষা দিতে পারি, সেই অভিপ্রায়ে আমি আপনার সহিত এরূপ সম্মান প্রদর্শন করেছি। হে পুত্র! এ জন্য আপনি মোহপ্রাপ্ত হবেন না।” এভাবেই দেবর্ষি নারদ একমাত্র শ্রীকৃষ্ণকেই সকল গৃহে গৃহস্থগণের পরম পবিত্র উৎকৃষ্ট ধর্মসমূহের সকল আচরণ করতে দর্শন করলেন। দেবর্ষি নারদ অনন্তবীর্ষ শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য যোগমায়ার প্রভাব বার বার দর্শন করে কৌতুহলান্বিত ও বিস্মিত হলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে দেবর্ষি নারদকে এরূপে ধর্ম, অর্থ ও কাম বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে পূজা করলেন এবং তিনি মনে মনে একান্ত প্রসন্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে করতে প্রস্থান করলেন। বিশ্বব্রহ্মান্ডের মঙ্গল কামনায় প্রয়োজন অনুসারে যিনি নানা মূর্তি ধারণ করে আবির্ভূত হয়ে থাকেন, সেই ভগবান নারায়ণ মনুষ্যবিগ্রহ রূপে অবর্তীণ হযে, এই প্রকারে রূপলাবণ্যবতী ষোড়শ সহস্র পত্নীর সলজ্জ প্রেমপূর্ণ হাস্য ও অবলোকনে অনুরাগে নিরন্তর সেবিত হয়ে যযোপযুক্ত বিহার করছেন। বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের একমাত্র হেতু ভগবান শ্রীহরি যে সমস্ত অসাধারণ লীলা কর্ম করেছেন, মানব যদি কেবল সেই সকল লীলা শ্রবণ, কীর্তন এবং অনুমোদন মাত্র করেন, তা হলেই তার আর সৌভাগ্যের সীমা থাকে না। মোক্ষদাতা ভগবান শ্রীহরিতে তার ভক্তি জন্মে, সন্দেহ নেই।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র