১১২. পাণ্ডবদিগের বিবাহ-বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া দুর্য্যোধনাদির মন্ত্রণা বার্ত্তা উপরন্তে তার তৃতীয় দিবসে। ভগ্নদত্ত দুর্য্যোধন উত্তরিল দেশে।। যাবার সময় গেল দশ অক্ষৌহিণী। পঞ্চ অক্ষৌহিণীতে আইল নৃপমণি।। কারে রথে নাহি ধ্বজা, দন্তী দন্ত কাটা। কারো ক্ষত দেহ, কেহ কুব্জা বোঁচা ঠুঁটা।। কারো মুখে নাহি কথা, নাহিক বাজন। নাহিক চামর ছত্র, নাহি চিহ্ন বাণ।। বাপের চরণে গিয়া নমস্কার কৈল। আশীর্ব্বাদ করি অন্ধ বার্ত্তা জিজ্ঞাসিল।। কহ তাত যুধিষ্ঠির সহিত মিলিলা। হুলাহুলি করিয়া সম্প্রীতে বিভা দিলা।। কিরূপে পাণ্ডব সহ হইল মিলন। আইল কি তব সঙ্গে পাণ্ডু-পুত্রগণ।। শুনি দুর্য্যোধন কর্ণে লাগে চমৎকার। জানিল ব্রাহ্মণ নহে পাণ্ডুর কুমার।। কর্ণ বলে, কি কথা কহিলে মহাশয়। হেন বাক্য কি মতে স্ফুরিত মুখে হয়।। আমার পরম শত্রু পাণ্ডুর নন্দন। আমা দেখা পাইলে কি জীয়ে পঞ্চজন।। ছদ্ম-দ্বিজ বেশ ধরি ভাণ্ডিল আমারে। দ্বিজ-বধ-ভয় করি ক্ষমিলাম তারে।। তখন জানিতাম যদি, মারিতাম প্রাণে। পাণ্ডু-পুত্র বলি শুনি তোমার বদনে।। দুর্য্যোধন বলে, ইহা জানিব কেমনে। এতকাল জীয়ে আছে পাণ্ডু-পুত্রগণে।। ধিক্ ধিক্ পুরোচন মৈল ভালে পুড়ি। কি করিল কার্য্য, লজ্জা কৈল ক্ষিতি যুড়ি।। এক্ষণে কি হইবেক ইহার উপায়। শিয়রে হইল শত্রু শমনের প্রায়।। এই সন্নিকটে যদি উপায় নহিবে। পশ্চাতে ইহার জন্য অনর্থ হইবে।। লোক পাঠাইয়া দেহ দ্রুপদের স্থানে। নিভৃতে কহুক গিয়া পাঞ্চাল রাজনে।। সহস্রেক রথ দিব, সহস্রেক হাতী। অর্দ্ধরাজ্য ভোগ কর আমার সংহতি।। সখ্য হৈয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন তব পুত্র সহ। আমার পরম শত্রু পাণ্ডবে মারহ।। নতুবা পাঠাই যে সুরূপা নারীগণ। পাণ্ডবের সহ রহুক করুক কথন।। দ্রৌপদীরে তাহার হউক অনাদর। তবে ক্রোধ করিবে দ্রুপদ নরবর।। নতুবা সুহৃদ দ্বিজে তথায় পাঠাই। প্রকারেতে ভেদ করাউক পঞ্চ ভাই।। পঞ্চ ভাই তারা যদি বিচ্ছেদ করিব। কোন্ ছার পাণ্ডু-পুত্র নিমিষে মারিব।। নতুবা যাউক এক অন্তঃপুরে-লোক। সবার অগ্রেতে কাঁদি কহে পূর্ব্ব-শোক।। তবে তারে পাণ্ডু-পুত্র করিবে বিশ্বাস। বিষ দিয়া বৃকোদরে করুক বিনাশ।। ভীম বিনা পাণ্ডবেরা হইবে অনাথ। কর্ণ-যুদ্ধে কে যাইবে অর্জ্জনের সাথ।। দুর্য্যোধন বচন শুনিয়া কর্ণ বলে। কিছু নাহি চিত্তে লাগে যতেক কহিলে।। দ্রুপদ রাজারে রত্নে লোভ করাইবে। ত্রৈলোক্য পাইলে সেও না ত্যজে পাণ্ডবে।। একেত জামাতা, আর দ্বিতীয়ে বলিষ্ঠ। এক্ষণে কি দ্রুপদের আছে পূর্ব্বাদৃষ্ট।। দ্বিজ দ্বারা ভ্রাতৃভেদ কি করিতে পারি। ভেদ না হইল পঞ্চ স্বামী এক নারী।। ভীমেরে মারিতে পারে আছে কোন্ জন। কত না করিলা গৃহে আছিল যখন।। বিষ দিলা, নানা অস্ত্র গর্ত্ত খুঁড়েছিলে। অবশেষে জতুগৃহে দাহন করিলে।। করিলা যতেক কিবা হইল তাহায়। এক্ষণে হইল তার অনেক সহায়।। নারীগণ কি করিবে পাণ্ডবের ঠাঁই। কটাক্ষেও পরস্ত্রী না দেখে পঞ্চ ভাই।। যতেক উপায় বল, নাহি লয় মনে। বিনা দ্বন্দ্বে সাধ্য নহে পাণ্ডুর নন্দনে।। যাবৎ না আইসেন কৃষ্ণ যদু-বলে। যাবৎ না পায় বার্ত্তা নৃপতি সকলে।। রজনীর মধ্যে গিয়া নগর বেডিব। সপুত্র দ্রুপদ সহ পাণ্ডবে মারিব।। কর্ণের বচন শুনি অন্ধ নৃপবর। সাধু সাধু বলিয়া প্রশংসে বহুতর।। এ বিচার করিতে তোমারে যোগ্য দেখি। তবে ভীষ্ম বিদুর দ্রোণেরে আন ডাকি।। সে সবার মত দেখি কি করে যুকতি। এত বলি সবারে ডাকিল শীঘ্রগতি।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে, সদা কর পান।। ১১৩. ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুরের যুক্তি রাজার আদেশে সব এল মন্ত্রিগণ। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য দ্রোনের নন্দন।। ভূরিশ্রবা সোমদত্ত বাহ্লীক বিদুর। কুলে শীলে বুদ্ধিবলে খ্যাত তিনপুর।। ধৃতরাষ্ট্র বলে, অবধান জ্যেষ্ঠতাত। শুনি যে পাণ্ডব জীয়ে আছে কুন্তী সাথ।। এতকাল কোথা ছিল, লুকাইয়া কেন। কিছুত ইহার আমি না বুঝি কারণ।। হেন বুঝি চিত্তে প্রায় আমারে আক্রোশ। আমি সে সবার স্থানে নাহি করি দোষ।। তবে কেন গুপ্তবেশে পাঞ্চালে থাকিয়া। বিভা কৈল পঞ্চ ভাই মোরে না বলিয়া।। কহ কি করিব এবে বিধান ইহার। শুনিয়া কহেন তারে গঙ্গার কুমার।। তব পুত্রাধিক তোমা সেবিত পাণ্ডব। তুমি তায় পুত্রাধিক করিতে গৌরব।। কি বুদ্ধি হইল তোমা না জানি কারণ। বারণাবতেতে পাঠাইলা পুত্রগণ।। না জানি তথায় কিবা কৈল পুরোচন। জতুগৃহে দগ্ধ কৈল, বলে সর্ব্বজন।। ত্রিভুবন যুড়ি মম অকীর্ত্তি হইল। আপনি থাকিতে ভীষ্মে এতেক করিল।। যদবধি জতুগৃহ হইল দাহন। তোমাদিগে নাহি চাহি মেলিয়া নয়ন।। জননী সহিত জীয়ে পাণ্ডুর কুমার। ইহার অধিক রাজা কি ভাগ্য তোমার।। অপযশ অধর্ম্ম সকল তব গেল। তোমার পূর্ব্বের ধর্ম্ম উদয় হইল।। এক্ষণেতে এই কর্ম্ম করহ রাজন। কর পাণ্ডু-পুত্রগণ সঙ্গেতে মিলন।। আমি একা নাহি বলি, সবার বিচার। যেন তুমি, তেন পাণ্ডু নৃপতি আমার।। যেন কুন্তী তেন বধূ গান্ধার-নন্দিনী। যেন যুধিষ্ঠির তেন দুর্য্যোধনে মানি।। ইথে ভেদাভেদ ভদ্র নাহিক রাজন্। পাণ্ডুপুত্র সহ তব দ্বন্দ্ব কি কারণ।। তার পিতা পাণ্ডু ছিল, পৃথিবীর রাজা। তাঁহার সকল সৈন্য রাজ্য ধন প্রজা।। সে জীয়ন্তে তাহারে ত্যজিবে কোন্ জন। তব হিত হেতু তাই বলি হে রাজন।। অর্দ্ধরাজ্য দিয়া কর পাণ্ডবেরে বশ। পৃথিবী যুড়িয়া রাজা হৈবে তব যশ।। কীর্ত্তি রাখ নৃপতি, কীর্ত্তি সে বড় ধন। হতকীর্ত্তি অভাজন জীয়ন্তে মরণ।। কীর্ত্তি রহে নরপতি যাবৎ ধরণী। যত পূর্ব্বদোষ খণ্ডিবেক নৃপমণি।। ভীষ্মের বচন অন্তে কহিলেন গুরু। সর্ব্বগুণবাণ তুমি যেন কল্পতরু।। আপনার হিতাহিত বিচার কারণ। ধৃতরাষ্ট্র আনিয়াছে সব মন্ত্রিগণ।। সে কারণে হিতকথা চাহি কহিবার। শুনহ ক্ষত্রিয়গণ মম যে বিচার।। ধর্ম্ম অর্থ যশ শ্রেয় সবার কল্যাণ। সব কহিলেন গঙ্গাপুত্র মতিমান।। এক্ষণেতে এই কর্ম্ম করহ ভূপাল। প্রিয়ম্বদ একজন পাঠাও পাঞ্চাল।। বিবাহ-সামগ্রী লৈয়া মঙ্গল-বাজন। নানা অলঙ্কার দ্রব্য করিয়া সাজন।। দ্রৌপদীরে তুষিবে অনেক অলঙ্কারে। নানারত্নে তুষিবেক পঞ্চ সহোদরে।। পুনঃপুনঃ সন্তোষিয়া কুন্তীরে কহিবে। যেন পূর্ব্ব দুঃখ স্মরি রুষ্ট না হইবে।। দ্রুপদ রাজার মান্য দেহ বহু ধন। প্রত্যক্ষ করিবে তাহা সব পুত্রগণ।। হেন জন পাঠাহ সুশীল সত্যবাদী। পাণ্ডব তোমাতে যেন না হয় বিবাদী।। এত বাক্য যদি বলিলেন ভীষ্ম দ্রোণ। ক্রোধমুখে উত্তর করির বৈকর্ত্তন।। ভাল মন্ত্রী আনিলা মন্ত্রণা করিবারে। সবাই শত্রুর অংশ, খ্যাত এ সংসারে।। মুখেতে সুহৃদ তব, অন্তরেতে আন। যে কহিল, বুঝহ করিয়া অনুমান।। ধন জন সম্পদ এ সবার ভিতরে। সবাকারে দিয়াছ না দিয়াছ কাহারে।। তাপি পাণ্ডব-অংশ, তোমার অহিত। জিহ্বায় অন্তর-বার্ত্তা হতেছে বিদিত।। রাজা হৈয়া যেই জন আপনা না বুঝে। দুষ্ট-মন্ত্রী-মন্ত্রণাতে স্বংশেতে মজে।। শুনি ক্রোধে বলে ভলদ্বাজের কুমার। ওরে দুষ্ট, শুনি কহ তোর কি বিচার।। কলহ হরিতে প্রায় চাহ তার সহ। নিকট বাঞ্ছহ প্রায় যেতে যমগৃহ।। ভালমতে জানি আমি তোর বীরপণা।। দেখিল পাঞ্চালরাজ্যে তাহা সর্ব্বজনা। লক্ষ রাজা সবে একা বেড়িল অর্জ্জুনে।। পলাইয়া গেলা, তাই রহিলা জীবনে। হেন জন সহ দ্বন্দ্ব চাহ কহিবারে।। তোর মত নির্লজ্জ না দেখি এ সংসারে। কিমতে কহিব আমি এমত বিচার।। কুরু-কুল ক্ষয় হৈবে সবার সংহার। এত শুনি বলিলা বিদুর মহামতি।। কি হেতু নিঃশব্দ হৈয়া আছহ নৃপতি।। আপনি না বুঝ কেন করিয়া বিচার। ভীষ্ম দ্রোণ সম হিতকারী কে তোমার।। এ দোঁহার গুণে কেবা আছে ভূমণ্ডলে। বিচারে অমরগুরু, তেজে আখণ্ডলে।। ধর্ম্মেতে সাক্ষাৎ ধর্ম্ম ত্রিভুবনে খ্যাত। শীলতায় পূর্ব্বে যেন ছিল রঘুনাথ।। কভু নাহি তব মন্দ ভীষ্ম মুখে ভাষে। সর্ব্বদা তোমার হিত সর্ব্বলোকে ঘোষে।। এ দোঁহার বাক্য ঠেলে দুষ্ট অধোগামী। কি কারণে উত্তর না দেহ রাজা তুমি।। ভীষ্ম দ্রোণ যে বলেন সবার স্বীকার। ইহা না করিয়া চাহ কি করিতে আর।। কলহ করিতে বুঝি চাহ নরপতি। কে তোমার যুঝিবেক অর্জ্জুন-সংহতি।। এই কর্ণ দুর্য্যোধন সসৈন্য সংহতি। পাঞ্চালেতে ছিল এক লক্ষ্য নরপতি।। সবারে করিল জয় পার্থ একেশ্বর। শুনিয়া থাকিবা যে করিল বৃকোদর।। অস্ত্রহীন, বৃক্ষ লয়ে প্রবেশিয়া রণে। এক লক্ষ নৃপসৈন্য করিল মথনে।। এক্ষণে সহায় হৈবে সেই রাজগণ। স্ব-অস্ত্রে করিবে যুদ্ধ ভাই পঞ্চজন।। সহায় সর্ব্বস্ব যার মন্ত্রী বিশ্বপতি। আর যত যদুগণ বৈসে দ্বারাবতী।। মাতুল-নন্দন বলভদ্র সখা যার। শ্বশুর দ্রুপদ সহ যতেক কুমার।। বিশেষ তোমার দেখ যত মন্ত্রীগণ। ভালমতে জানহ কি সবাকার মন।। আমি জানি সবে হৈবে পাণ্ডব-সহায়। দ্বন্দ্ব ইচ্ছা কর তুমি কার ভরসায়।। আর বার্ত্তা তুমি নাহি জান নরপতি। রাজ্যের যতেক লোক করয়ে যুকতি।। পাণ্ডুপুত্র জীয়ে আছে, শুনিয়া শ্রবণে। দেখিতে তাঁদের বাঞ্ছা করে সর্ব্বজনে।। সবে ইচ্ছা করে রাজা যুধিষ্ঠির -পতি। তার সহ দ্বন্দ্বে ভদ্র নাহি নরপতি।। সহজে এ শিশুগণ কি জানে বিচার। মোর বাক্য শুন রাজা যে হিত তোমার।। জতুগৃহে পোড়াইলা লজ্জিত অন্তরে। সব দোষ গেল পুরোচনের উপরে।। প্রিয়বাক্যে হেথায় আনহ পাণ্ডুসুতে। ঘুচিবেক লজ্জা, যশ ঘুষিবে জগতে।। বিদুরের বচনেতে ধৃতরাষ্ট্র কয়। যা বলিলা বিদুর, আমার মনে লয়।। পাণ্ডবে প্রবোধে হেন নাহি অন্য জন। আপনি বিদুর তুমি করহ গমন।। এতেক বলিল যদি অন্ধ নরপতি। শুনিয়া যে সভাজন হৈল হৃষ্টমতি।। মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী। কাশীরাম কহিছে শ্রবণে ভবে তরি।। ১১৪. হস্তিনায় পাণ্ডবগণকে আনিতে বিদুরের পাঞ্চালে গমন মুহূর্ত্তেক বিদুর বিলম্ব না করিল। বহু রত্ন-ধন লৈয়া পাঞ্চালে চলিল।। একে একে সবাকারে সম্ভাষি বিদুর। কুন্তী কৃষ্ণা দর্শনে যাইল অন্তঃপুর।। দ্রৌপদীরে তুষিল অনেক অলঙ্কারে। নানা রত্নে বিভূষিল পঞ্চ সহোদরে।। বিদুরে দেখিয়া বড় হরিষ দ্রুপদ। সূর্য্যের উদয়ে যেন ফুটে কোকনদ।। পঞ্চ ভায়ে দেখিয়া বিদুর মহাশয়। আনন্দে নয়ন-জলে ভাসিল হৃদয়।। বিদুর-চরণে প্রণমিল পঞ্চজন। কুশল জিজ্ঞাসা কৈল যত বন্ধুগণ।। বিদুর কহিল যত কুশল সংবাদ। একে একে করিল সবারে আশীর্ব্বাদ।। বিদুরে লইয়া গেল দ্রুপদ রাজন। মিষ্টান্ন পলান্নে তাঁরে করান ভোজন।। ভোজনান্তে সর্ব্বলোক বসিল সভাতে। দ্রুপদে বিদুর তবে লাগিল কহিতে।। পাণ্ডবে বরিল রাজা তোমার নন্দিনী। বড় আনন্দিত হৈল ধৃতরাষ্ট্র শুনি।। তোমা হেন বন্ধু রাজা বড় ভাগ্যে পায়। সে কারণে সম্ভাষিতে পাঠায় আমায়।। বহু কহিলেন ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন। তোমা সহ সম্বন্ধেতে প্রীত হৈল মন।। প্রিয়সখা তোমারে জানায় আলিঙ্গন। পুনঃপুনঃ বলিলেন নিজে গুরু দ্রোণ।। বহুদিন নাহি দেখি পাণ্ড-পুত্রগণে। সবাই উদ্বিগ্ন বড় এই সে কারণে।। গান্ধারী প্রভৃতি যত কুরু-কুল-নারী। দেখিবারে উতরোল তোমার কুমারী।। পাণ্ডবেরা বহুদিন ত্যাজিল আবাস। বহুদিন নাহি বন্ধগণের সম্ভাষ।। আমারে ত এইমত কহে নরপতি। লইতে পাণ্ডবগণে আপন বসতি।। দ্রুপদ বলিল, ভাগ্য আমার আছিল। কুরু মহাবংশ সহ কুটুম্বিতা হৈল।। যা বল বিদুর সেই মোর মনোনীত। পাণ্ডবের নিজগৃহে যাইতে উচিত।। জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র জনক-সমান। তাঁর সেবা পাণ্ডবের হয় ত বিধান।। ভয় আছে তথা, যদি হেন কর মনে। তোমা সবা বিরোধিবে বল কোন্ জনে।। তথাপিহ নহে আর হস্তিনায় স্থিতি। খাণ্ডবপ্রস্থেতে গিয়া করহ বসতি।। দ্রুপদের বচন শুনিয়া পঞ্চজন। মাতৃসহ বিদায় হলেন ততক্ষণ।। রথে চড়ি চলিলেন দ্রৌপদী সংহতি। হস্তিনানগরে যান বিদুর সহিত।। পাণ্ডব বরিল রাজা তোমার নন্দিনী। বড় আনন্দিত হৈল ধৃতরাষ্ট্র শুনি।। তোমা হেন বন্ধু রাজা বড় ভাগ্যে পায়। সে কারণে সম্ভাষিতে পাঠায় আমায়।। বহু কহিলেন ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন। তোমা সহ সন্বন্ধেতে প্রীত হৈল মন।। প্রিয়সখা তোমারে জানায় আলিঙ্গন। পুনঃপুনঃ বলিলেন নিজে গুরু দ্রোণ।। বহুদিন নাহি দেখি পাণ্ডু-পুত্রগণে। সবাই উদ্বিগ্ন বড় এই সে কারণে।। গান্ধারী প্রভৃতি যত কুরু-কুল-নারী। দেখিবারে উতরোল তোমার কুমারী।। পাণ্ডবেরা বহুদিন ত্যজিল আবাস। বহুদিন নাহি বন্ধুগণের সম্ভাষ।। আমারে ত এইমত কহে নরপতি। লইতে পাণ্ডবগণে আপন বসতি।। দ্রুপদ বলিল, ভাগ্য আমার আছিল। কুরু মহাবংশ সহ কুটুম্বিতা হৈল।। যা বল বিদুর সেই মোর মনোনীত। পাণ্ডবের নিজগৃহে যাইতে উচিত।। জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র জনক-সমান। তাঁর সেবা পাণ্ডবের হয় ত বিধান।। ভয় আছে তথা, যদি হেন কর মনে। তোমা সবা বিরোধিবে বল কোন্ জনে।। তথাপিহ নহে আর হস্তিনায় স্থিতি। খাণ্ডবপ্রস্থেতে গিয়া করহ বসতি।। দ্রুপদরে বচন শুনিয়া পঞ্চজন। মাতৃসহ বিদায় হলেন ততক্ষণ।। রথে চড়ি চলিলেন দ্রৌপদী সংহতি। হস্তিনানগরে যান বিদুর সহিত।। পাণ্ডব হস্তিনা আসে শুনি প্রজাগণ। বাল বৃদ্ধ যুবা ধায় দর্শন কারণ।। লজ্জা ভয় ত্যজি ধায়কুলের যুবতী। ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটে যায় নারী গর্ভবতী।। পাণ্ডবেরে দেখিতে করয়ে হুড়াহুড়ি। যষ্টি ভর করিয়া চলিল যত বুড়ী।। পঞ্চ ভাই গেলেন যেখানে জ্যেষ্ঠতাত। একে একে তাঁহারে করেন প্রণিপাত।। কুন্তীসহ অন্তঃপুরে গিয়া যাজ্ঞসেনী। একে এক সম্ভাষেন কৌরব-রমনী।। তবে ধৃতরাস্ট বলে ভাই পঞ্চজনে। হস্তিনা বসতি তব নহে সুশোভন।। খাণ্ডবপ্রস্থেতে যাহ পঞ্চ সহোদর। অর্দ্ধ রাজ্য ভোগ কর ইন্দ্রের সোসর।। শুনিয়া যুধিষ্ঠির করিলেন স্বীকার। খাণ্ডবপ্রস্থেতে সবে কৈল আগুসার।। পাণ্ডবের আগমন জানি যদুবর। বলভদ্র সনে যান হস্তিনা-নগর।। ধৃতরাষ্ট্র যে বলিল পাণ্ডবের প্রতি। খাণ্ডবে রহিতে কৃষ্ণ দেন অনুমতি।। বলভদ্র জনার্দ্দন পঞ্চ সহোদর। শুভক্ষণে করিলেন আরম্ভ নগর।। প্রাচীর হইল উচ্চ আকাশ সমান। চতুর্দ্দিকে গড়খাই সমুদ্র প্রমাণ।। উচ্চ উচ্চ মন্দির করিল মনোরম। কিবা সে অমরাবতী ভোগবতী সম।। প্রাচীর উপরে সব অস্ত্র পূর্ণ কৈল। ভক্ষ্য ভোজ্য পদাতিক প্রজাগণ থুল।। কুবের ভাণ্ডার জিনি পূরাইল ধন। শুক্লবর্ণ সব গৃহ বিচিত্র শোভন।। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ ক্ষত্র বৈশ্যজাতি। নগরের মধ্যস্থলে করিল বসতি।। পাঠক লেখক বৈদ্য চিকিৎসক জন। সূত্রধর বণিক জাতি আর শূদ্রগণ।। বসিল সকল লোক নগর-ভিতরে। পাণ্ডব-নগরবাসী ইন্দ্রে নাহি ডরে।। স্থানে স্থানে নগরে রোপিল বৃক্ষগণ। পিপ্পলী কদম্ব আম্র পনস কানন।। জম্বীর পলাশ তাল তমাল বকুল। নাগেশ্বর কেতকী চম্পক রাজফুল।। পাটলি বদরী বেল করবী খদির। পারিজাত আমলকী পর্কটী মিহির।। কদলী গুবাক নারিকেল সুখর্জ্জুর। নানাবর্ণে বৃক্ষ শোভে যেন সুরপুর।। স্থানে স্থানে খোদাইল দীঘি পুষ্করিণী। জলচর পক্ষিগণ সদা করে ধ্বনি।। দ্বিতীয় ইন্দ্রের পুর দেখি সুশোভন। ইন্দ্রপ্রস্থ নাম রাখিলেন নারায়ণ।। পাণ্ডবেরে স্থাপি তথা হলধর হরি। বিদায় হইয়া যান দ্বারকা নগরী।। পাণ্ডবের রাজ্য প্রাপ্তি দারিদ্র্য খণ্ডন। আদিপর্ব্ব ভারত ব্যাসের বিরচিত। পাঁচালি প্রবন্ধে কাশীরাম গায় গীত।। ১১৫. সুন্দ উপসুন্দের বিবরণ ও দ্রৌপদী সম্বন্ধে পাণ্ডবগণের নিয়ম নির্দ্ধারণ জন্মেজয় বলে, মুনি কর অবধান। শুনিবারে ইচ্ছা বড় ইহার বিধান।। পঞ্চ ভাই এক স্ত্রী কিমতে আচরিল। বিভেদ নহিল, দিন কহিতে বঞ্চিল।। মুনি বলে, নরপতি শুন সাবধানে। ইন্দ্র প্রস্থে গেল যবে ভাই পঞ্চজনে।। কতদিনে হৈল নারদের আগমন। কৃষ্ণা সহ পাণ্ডব পূজিল শ্রীচরণ।। করযোড়ে করি দাঁড়াইল ছয় জন। বসিবারে আজ্ঞা মুনি দিলেন তখন।। নারদ বলেন, শুন পাণ্ডুর নন্দন। একপত্নী পতি যে তোমরা পঞ্চজন।। ভাই ভাই বিভেদ করিয়া থাক পাছে। স্ত্রী হেতু বিরোধ হয় পূর্ব্বে হেন আছে।। সুন্দ উপসুন্দ বলি দুই ভাই ছিল। নারী হেতু দুই ভাই যুদ্ধ করি মৈল।। যুধিষ্ঠির বলিলেন, কহ মুনিবর। কি হেতু করিল যুদ্ধ দুই সহোদর।। নারদ বলেন, পূর্ব্বে কশ্যপ-নন্দন। হিরণ্যকশিপু হিরণ্যাক্ষ দুই জন।। নিকুম্ভ অসুর হিরণ্যাক্ষ দৈত্যবংশে। সুন্দ উপসুন্দ দুই তাহার ঔরসে।। মহাবল দুই ভাই মহাকলেবর। অসুরকুলেতে শ্রেষ্ঠ মহা ভয়ঙ্কর।। দুই ভাই এক বাক্য একই জীবন। তিলেক বিচ্ছেদ নাহি হয়ত কখন।। দুই জন মিলি তবে যুক্তি কৈল সার। তপোবলে ত্রৈলোক্য করিব অধিকার।। বিন্ধ্য-মহীধরে গিয়া তপ আরম্ভিল। অনেক বৎসর বায়ু-আহারে রহিল।। অনাহারে বহু তপ কৈল দুই জনা। যতেক কঠোর কৈল না যায় গণনা।। দোঁহার কঠোর তপ দেখি পিতামহ। ডাকিয়া বলেন, মনোমত বর লহ।। দুই ভাই বলে, বিধি করহ অমর। বিরিঞ্চি বলেন, দোঁহে মাগ অন্যবর।। দুই ভাই বলে, মোরে অন্য নাহি চাই। তবে পত ত্যজি যবে এই বর পাই।। বিধাতা বলেন, জন্ম হইলে মরণ। মরণ-বিধান কিছু কর দুই জন।। দৈত্য বলে, পরহস্তে নহিবে মরণ। পরস্পর ভেদ হৈলে হইবে নিধন।। স্বস্তি বলি বর দিয়া গেলেন বিধাতা। সুন্দ উপসুন্দ গেল নিজ গৃহ যথা।। ত্রৈলোক্য জিনিতে সৈন্য সাজাল অসুর। নানাবর্ণে অস্ত্র লৈয়া গেল সুরপুর।। অমর জানিল, ব্রহ্মা দিয়াছেন বর। ছাড়িয়া অমরাবতী হইল অন্তর।। বিনা যুদ্ধে পলাইয়া গেল দেবগণ। ইন্দ্রপুরে ইন্দ্রত্ব করিল দুই জন।। যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব জিনিল নাগালয়। সবে পলাইয়া গেল দুই দৈত্যভয়।। যজ্ঞ হোম ব্রত যথা দ্বিজ মুনিগণ। একে একে উচ্ছিন্ন করিল দুইজন।। দেবকন্যা নাগকন্যা অপ্সরী কিন্নরী। ত্রৈলোক্যেপাইল যত অপূর্ব্ব সুন্দরী।। সে সবারে হরিয়া আনিল নিজ ঘরে। যখন যাহারে ইচ্ছা তখনি বিহরে।। যে দেবের যে বাহন ভূষা অলঙ্কার। সর্ব্বরন্তে পূর্ণ কৈল আপন ভাণ্ডার।। স্থানভ্রষ্ট হৈয়া যত দেব ঋষিগণ। ব্রহ্মারে সকলে গিয়া কৈল নিবেদন।। শুনিয়া ক্ষণেক ব্রহ্মা হৃদয়ে চিন্তিয়া। বিশ্বকর্ম্মা প্রতি কহিলেন বিবরিয়া।। মনোহরা নারী এক করহ রচন। তুলনা না হয় যেন এ তিন ভুবন।। সেইক্ষণে বিশ্বকর্ম্মা মহা-বিচক্ষণ। বিধাতার আজ্ঞা পেয়ে করিল সৃজন।। ত্রৈলোক্য ভিতরে যত রূপবন্ত ছিল। সর্ব্বরূপ হৈতে তিল তিল নিল।। অপূর্ব্ব সুন্দরী নারী করিয়া রচন। ব্রহ্মার অগ্রেতে লৈয়া দিল ততক্ষণ।। যে সব দেবতা সেই কন্যা পানে চাহে। যেই অঙ্গে পড়ে দৃষ্টি সেই অঙ্গে রহে।। ব্রহ্মা বলিলেন, নাহি এ রূপের সীমা। তিল তিল আনি কৈল নাম তিলোত্তমা।। তবে করযোড়ে কন্যা ধাতা অগ্রে কয়। কি করিব, আজ্ঞা মোরে কহ মহাশয়।। বিরিঞ্চি বলেন, সুন্দ উপসুন্দ শূর। তপোবলে দুই দৈত্য নিল তিনপুর।। ভেদ হৈলে দুই ভাই হইবে সংহার। উপায় করিয়া ভেদ করাহ দোঁহার।। পাইয়া ব্রহ্মার আজ্ঞা চলিল সুন্দরী। দেবতা-মণ্ডলী কন্যা প্রদক্ষিণ করি।। কন্যা দেখি মোহিত হইল ত্রিলোচন। চারি ভিতে চারি গোটা হইল বদন।। যেই দিকে চায়, মুখ সেই দিকে রয়। পূর্ব্ব সহ পঞ্চমুখ হৈল মৃত্যুঞ্জয়।। মদনে পীড়িত হৈয়ে চাহে পুরন্দর। দশ-শত চক্ষু তাঁর হৈল কলেবর।। আর যত দেবগণ এক দৃষ্টে চায়। অধৈর্য্য হইল সবে দেখিয়া কন্যায়।। দেবগণ বলে, প্রভু কার্য্য সিদ্ধ হৈবে। ইহারে দেখিয়া কোন জন না ভুলিবে।। তবে তিলোত্তমা গেল যথা দুই জন। ক্রীড়া করে দুই ভাই লইয়া স্ত্রীগণ।। কোটি কোটি দৈত্যগণ সহ পরিবার। অশ্ব গজ রথ সৈন্য পূর্ণিত ভাণ্ডার।। লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরী লয়ে দুইজনে। বিন্ধ্যাগিরি মধ্যে ক্রীড়া করে হৃষ্টমনে।। রক্তবস্ত্র পরি তিলোত্তমা বিদ্যাধরী। নানাপুষ্প তোলে সেই পর্ব্বত-উপরি।। ধীরে ধীরে তথা দৈত্য করিল গমন। দূরে থাকি কন্যারে দেখিল দুইজন।। দেববরে, মত্ত, সদা মত্ত মধুপানে। শীঘ্রগতি কন্যা দেখি উঠে দুইজনে।। জ্যেষ্ঠ সুন্দ ধরিল কন্যার সব্যকর। বামহস্তে ধরিল কনিষ্ঠ সহোদর।। পরম আনন্দ সুন্দ কন্যারে দেখিয়া। হাত ছাড়, ভাই প্রতি বলিল ডাকিয়া।। মোর ভার্য্যা তোমার গুরুর মধ্যে গণি। উহারে ধরহ তুমি কেমন কাহিনী।। উপসুন্দ বলে, এরে বরিয়াছি আমি। ভ্রাতৃবধূ হয় তব, ছাড়ি দেহ পাণি।। সুন্দ বলে, আমি দেখিলাম এ কন্যারে। উপসুন্দ বলে, কন্যা বরেছে আমারে।। ছাড় ছাড় বলি দোঁহে করে গালাগালি। ক্রুদ্ধ হয়ে দুই ভাই দোঁহারে নেহালি।। মধুপানে কামবাণে হইল অজ্ঞান। ক্রোধে দুই জনে হৈল অগ্নির সমান।। ভয়ঙ্কর দুই গদা ধরি ততক্ষণ। দোঁহাকারে প্রহার করিল দুইজন।। যুগল পর্ব্বত প্রায় পড়ে দুই বীর। খসিয়া পড়িল যেন যুগল মিহির।। আর যত দৈত্যগণ এ সব দেখিয়া। কালরূপা কন্যা জানি গেল পলাইয়া।। দেবগণ সহ ব্রহ্মা আসিয়া তখন। কন্যারে দিলেন বর করিয়া বর্ণন।। সূর্য্যের কিরণে তুমি থাক নিরন্তর। কারো দৃষ্ট নহে যেন তব কলেবর।। তপ যজ্ঞ ভঙ্গ হৈবে তোমার কারণে। ধর্ম্ম নষ্ট হৈবে লোক তোমা দরশনে।। সেই হেতু সূর্য্য-অংশু মধ্যে তুমি রহ। এত বলি অন্তর্দ্ধান কৈলা পিতামহ।। নারদ বলেন, শুন ধর্ম্ম নৃপবর। তুমি জান, অতি প্রীত পঞ্চ সহোদর।। এইমত প্রীত তারা ছিল দুইজন। হেন গতি হৈল দোঁহে নারীর কারণ।। মহাবংশে জন্মিলা তোমরা পঞ্চজন। বিভেদ না হয় যেন ভার্য্যার কারণ।। এত শুনি পঞ্চ ভাই নারদ গোচরে। সমান নির্ব্বন্ধ হয়ে বলে যোড়করে।। বৎসরেক কৃষ্ণা থাকিবেক এক গৃহে। অন্যজন সেইকালে অধিকারী নহে।। কৃষ্ণা সহ দেখে যদি ভাই অন্য জনে। দ্বাদশ বৎসর সেই যাইবে কাননে।। এ নির্ব্বন্ধ করিলেন ব্রহ্মার নন্দন। হেনমতে কৃষ্ণা সহ বঞ্চে পঞ্চজন।। ১১৬.অর্জ্জুনের নিয়মভঙ্গ, বনগমন, নাগকন্যা উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার সহিত মিলন তবে কতদিনে সেই রাজ্যের ভিতরে। ব্রাহ্মণের গবী হরি লৈয়া যায় চোরে।। কাতরে ব্রাহ্মণ কহে অর্জ্জুনের পাশ। থাকিয়া তোমার রাজ্যে হৈল সর্ব্বনাশ।। গালি দেয় ব্রাহ্মণ যতেক আসে মনে। জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুন সঙ্কোচে সে ব্রাহ্মণে।। কি হেতু কান্দহ দ্বিজ, কহ বিবরণ। দ্বিজ বলে অস্ত্র লৈয়া চল এইক্ষণ।। হরিয়া আমার গবী যায় দুষ্টগণ। শীঘ্রগতি চল, তারা গেল এতক্ষণ।। দ্বিজের বচন শুনি ধনঞ্জয় বীর। আস্তে ব্যস্তে চলিলেন আয়ুধ-মন্দির।। দৈবযোগে অস্ত্র-গৃহে কৃষ্ণা যুধিষ্ঠির। দূরে থাকি জানি পার্থ হলেন বাহির।। দ্বিজ বলে, অস্ত্র লয়ে শীঘ্রগতি চল। উচ্চৈঃস্বরে কান্দে দ্বিজ, চক্ষে পড়ে জল।। দ্বিজের রোদন দেখি পার্থে হৈল ভয়। কি করিব, চিত্তেতে চিন্তেন ধনঞ্জয়।। গৃহে প্রবেশিলে দুঃখ হৈবে বহুতর। দ্বাদশ বৎসর যাব অরণ্য-ভিতর।। ব্রাহ্মণের চক্ষুজল যত ভূমে পড়ে। ততবার মহাপাপ মম শিরে চড়ে।। দ্বিজ-দুঃখ নাশিলে হইবে বড় কর্ম্ম। বিনাক্লেশে উপার্জ্জন কভু নহে ধর্ম্ম।। এত ভাবি অর্জ্জুন গেলেন অস্ত্রঘরে। হস্তে ধনু লৈয়া বীর চলেন সত্বরে।। দ্বিজ সহ গেলেন যথায় চোরগণ। চোর মারি আনি দেন বিপ্রের গোধন।। দ্বিজে প্রবোধিয়া আসি কহেন ফাল্গুনি। শুন নিবেদন মম ধর্ম্ম নৃপমণি।। অতিক্রম করিলাম লঙ্ঘিয়া সময়। বনবাসে যাব, আজ্ঞা কর মহাশয়।। রাজা কন, কেন হেন কহ ধনঞ্জয়। পূর্ব্বেতে নারদ ঋষি কৈলা যে সময়।। কনিষ্ঠ ভায়ের সঙ্গে কৃষ্ণা যদি থাকে। জ্যেষ্ঠ ভাই বনে যাবে, তাহা যদি দেখে।। তুমি মম কনিষ্ঠ ইহাতে দোষ নাই। কেন হেন অপ্রিয় বচন বল ভাই।। পার্থ বলিলেন, স্নেহে বল মহাশয়। এ কপট কর্ম্মে প্রভু মম মত নয়।। সত্যে বিচলিত হই, নাহি চাহে মন। আজ্ঞা কর মহারাজ, যাব আমি বন।। এই বলি পার্থ করিলেন নমস্কার। মাতৃ ভ্রাতৃ সখা ছিল যত যত আর।। সবারে বিদায় মাগি গেলেন কানন। সব বন্ধুগণ হৈল বিরস বদন।। অর্জ্জুনের সহিত চলিল দ্বিজগণ। পৌরাণিক কথকাটি গায়ক চারণ।। মহাবনে প্রবেশ করিয়া মতিমান। বহুপুণ্যতীর্থে করিলেন স্নান দান।। কত দিনে হরিদ্বারে করিয়া গমন। দেখিয়া হলেন হৃষ্ট পাণ্ডুর নন্দন।। স্নান করি অগ্নিহোত্র করে দ্বিজগণ। গঙ্গায় প্রবেশি পার্থ করেন তর্পণ।। তর্পণ করিতে দেখি অগ্নিহোত্র-স্থানে। জল হৈতে নাগকন্যা ধরিল অর্জ্জুনে।। বলে ধরি লয়ে গেল আপন মন্দির। উত্তম আলয় তথা দেখে পার্থবীর।। অগ্নিহোত্র জ্বলে তথা দেখি ধনঞ্জয়। সেই অগ্নি পূজিলেন কুন্তীর তনয়।। নিঃশঙ্ক হৃদয় পার্থ, নাহি ভ্রম ভয়। কন্যারে বলেন এই কাহার আলয়।। কি নাম ধরহ তুমি, কাহার কুমারী। কি কারণে আমারে আনিলা এই পুরী।। কন্যা বলে, ঐরাবত-নাগরাজ বংশে। কৌরব্য নামেতে নাগ এই পুরে বৈসে।। তার কন্যা আমি যে উলুপী মোর নাম। তোমারে দেখিয়া মোরে, পীড়িলেক কাম।। আনিলাম তোমারে যে এই সে কারণ। তোমারে ভজিব, মোর তৃপ্ত কর মন।। পার্থ বলিলেন, কন্যা না জান কারণ। ব্রহ্মচারী আমি, ভ্রমি সতত কানন।। দ্বাদশ বৎসর করিয়াছি এ নিয়ম। কিমতে লঙ্ঘিব তাহা নহে কোন ক্রম।। কন্যা বলে, সব তত্ত্ব আমি ভাল জানি। কৃষ্ণা হেতু নিয়ম যে করিলা আপনি।। অন্য স্ত্রীতে নাহি দোষ শুন মহাশয়। তাহে আর্ত্ত জনে রক্ষা উচিত নিশ্চয়।। আর্ত্ত হয়ে আমি বাঞ্ছা করি যে তোমারে। ধর্ম্ম আছে, পাপ ইথে নাহিক সংসারে।। অনুগত জন আমি কহিনু নিশ্চয়। এক পুত্র দান মোরে দেহ মহাশয়।। তোমার ঔরসে এক পুত্র আমি চাই। তাহার অধিক কাম্য কিছু মোর নাই।। হৃদয়ে বিচারি পার্থ কন্যার বচন। ধর্ম্ম-সাক্ষী করি করেন পত্নীত্বে গ্রহণ।। এক নিশি বঞ্ছি তথা পার্থ মহাবীর। প্রাতঃকালে গঙ্গা হৈতে হলেন বাহির।। বিস্ময় হইয়া দ্বিজগণ জিজ্ঞাসিল। প্রত্যক্ষ বৃত্তান্ত পার্থ কহেন সকল।। তবে দ্বিজগণ সহ কুন্তীর নন্দন। হিমালয় পর্ব্বতে করেন আরোহণ।। অগস্ত্য নামেতে বট বশিষ্ঠ-আশ্রমে। বহুতীর্থে পার্থ স্নান করিলেন ক্রমে।। পৃথিবী দক্ষিণাবর্ত্তা করি হেন গণি। পূর্ব্ব-সিন্ধু-তীরে বীরে গেলেন আপনি।। গয়া গঙ্গা প্রয়াগ, নৈমিষারণ্য আদি। পৃথিবীতে যত তীর্থ, যত নদ নদী।। অঙ্গ বঙ্গ মধ্যেতে যতেক তীর্থ বৈসে। স্নান করি চলিলেন কলিঙ্গ-প্রদেশে।। কলিঙ্গে না পশি বাহুড়িল দ্বিজগণ। কলিঙ্গে পশিলে ভ্রষ্ট হয়ত ব্রাহ্মণ।। কলিঙ্গ নগরে পশিলেন ধনঞ্জয়। ক্রমে ক্রমে দেখিলেন যত তীর্থচয়।। সমুদ্রের তীরেতে মহেন্দ্র গিরিবর। মণিপুর নামে এক আছয়ে নগর।। চিত্রভানু নামে রাজা রাজ্য অধিকারী। চিত্রাঙ্গদা নাম ধরে তাহার কুমারী।। দেবের বাঞ্ছিত কন্যা, পূর্ণা রূপে গুণে। নগরে বিহরে কন্যা, দেখিল অর্জ্জুনে।। কন্যা দেখি মোহিত হইয়া ধনঞ্জয়। শীঘ্রগতি গেলেন সে রাজার আলয়।। পার্থ বলিলেন, রাজা কর অবধান। তোমার কুমারী এই মোরে দেহ দান।। রাজা বলে, কে তুমি, কোথায় তব ঘর। কোন বংশে জন্ম তব, কাহার কোঙর।। তীর্থবাসী জন হৈয়া বাঞ্ছ রাজসুতা। কেমনে সাহসে তুমি কহ এই কথা।। অর্জ্জুন বলেন, আমি পাণ্ডুর তনয়। কুন্তী-গর্ভে জন্ম মম, নাম ধনঞ্জয়।। এত শুনি শীঘ্রগতি উঠিয়া রাজন। আলিঙ্গন করি দিল বসিতে আসন।। রাজা বলে, এতদূরে আসা কি কারণ। বিশেষিয়া কহিলেন পৃথার নন্দন।। রাজা বলে, মোর ভাগ্যে আইলা হেথায়। মম বিবরণ শুন, কহিব তোমায়।। প্রভঞ্জন নামে রাজা মম পূর্ব্ববংশে। পুত্র-বাঞ্ছা করি রাজা সেবিল মহেশে।। প্রসন্ন হইয়া বর দিলেন ঈশ্বর। তব বংশে হৈবে রাজা একই কোঙর।। কুলক্রমে এক ভিন্ন দ্বিতীয় নহিবে। যে পুত্র হইবে, সেই রাজে রাজা হবে।। পূর্ব্বেতে এমত বর দিলেন ধূর্জ্জটী। পুত্র না হইল মম, হইল কন্যাটী।। পুত্রবৎ করি কন্যা করি যে পালন। মম বংশে রাজা হৈতে নাহি আর জন।। সেই হেতু করিলাম মনে এ বিচার। এই কন্যা দিয়া তারে দিব রাজ্যভার।। কুরুবংশে শ্রেষ্ঠ তুমি না শোভে এ কথা। এক সত্য কর, তবে দিব আমি সুতা।। ইহার গর্ভেতে যেই জ্যেষ্ঠপুত্র হবে। সেই সে আমার রাজ্যে রাজত্ব করিবে।। সত্য করিলেন পার্থ, রাজা কন্যা দিল। এক বর্ষ তথা তাঁরে রহিতে হইল।। পরে পার্থ চলিলেন দক্ষিণ সাগর। স্নান দান সর্ব্বত্র করেন বীরবর।। একস্থানে তথায় দেখেন ধনঞ্জয়। পঞ্চতীর্থ বলি তারে মুনিগণে কয়।। অশ্বমেধ-ফল স্নানে হয়ত বিশেষে। কিন্তু সে তীর্থসলিল কেহ না পরশে।। বিস্মিত হইয়া পার্থ জিজ্ঞাসেন লোকে। হেন তীর্থ লোকে না পরশে কোন্ পাকে।। মুনিগণ বলেষ এই পুণ্যতীর্থ গণি। কুম্ভীরের ভয়ে কেহ না পরশে পানি।। শুনিয়া গেলেন স্নানে কুন্তীর নন্দন। নিষেধিল তাঁহারে যাইতে সব জন।। সৌভদ্র নামক তীর্থে পশি ধনঞ্জয়। স্নান করিলেন বীর নিঃশঙ্ক হৃদয়।। শব্দ শুনি কম্ভীরিণী আইল নিকটে। অর্জ্জুনের পায়ে ধরে দশন বিকটে।। বলে ধরি কূলে তারে তুলেন অর্জ্জুন। গ্রাহরূপ ত্যজি কন্যা হইল তখন।। অদ্ভুত মানিয়া জিজ্ঞাসেন পার্থবীর। কে তুমি, কি হেতু হৈলা কুম্ভীর শরীর।। কন্যা বলে, আমি বর্গা-নামেতে অপ্সরী। কুবেরের ইষ্টা পঞ্চ আমরা কুমারী।। সুবেশা হইয়া যাই যথা ধনেশ্বর। পথে দেখি তপ করে এক দ্বিজবর।। চন্দ্র-সূর্য্য সম তেজ মহাতপোধন। অহঙ্কারে তাহারে করিলাম বিড়ম্বন।। তপোভঙ্গ করিবারে গেনু তাঁর পাশ। নৃত্য গীত বাদ্য, বহু হাস্য পরিহাস।। কদাচিত বিচলিত নহিল ব্রাহ্মণ। ক্রোধে মো সবারে শাপ দিল ততক্ষণ।। অনেক বৎসর থাক গ্রাহরূপ ধরি। করিলাম বহু স্তুতি করযোড় করি।। অবধ্য অবলা জাতি, জানিয়া অন্তরে। বধাধিক শাস্তি দিলা আমা সবাকারে।। ব্রাহ্মণেরা শান্ত শীল সর্ব্বশাস্ত্রে জানি। দয়ায় শাপান্ত আজ্ঞা কর মহামুনি।। মুনি বলে, গ্রাহ হৈবে তীর্থের ভিতরে। তবে মুক্ত হৈবে যদি তোলে কোন নরে।। ব্রাহ্মণের বচন শুনিয়া পঞ্চজন। বাহুড়িয়া যাই ঘরে হইয়া বিমন।। আচম্বিতে দেখিনু নারদ তপোধন। জানাইনু তাঁহাকে আপন বিবরণ।। নারদ বলেন, নাহি হইও বিমনা। পঞ্চ-তীর্থে গ্রাহরূপে থাক পঞ্চজনা।। তীর্থযাত্রা হেতু যে আসিবে ধনঞ্জয়। তাহার পরশে মুক্ত হইবে নিশ্চয়।। সত্য হৈল যে বলিল ব্রাহ্মণ কুমার। তোমার পরশে মুক্তি হইল আমার।। চারি তীর্থে চারি সখী আছে যে আমার। কৃপা করি তাহাদের করহ উদ্ধার।। বিনয় শুনিয়া পার্থ হয়ে দয়াবান। চারি তীর্থে চারি জনে করিলেন ত্রাণ।। মুক্ত হৈয়া নিজ স্থানে গেল পঞ্চজন। নিষ্কণ্টক তীর্থ করি গেলেন অর্জ্জুন।। পুনঃ বীর মণিপুরে করেন গমন। চিত্রাঙ্গদা সহ পুনঃ হইল মিলন।। চিত্রাঙ্গদা-গর্ভে জনমিল যে নন্দন। নাম রাখিলেন তার শ্রীবভ্রূবাহন।। কত দিন বঞ্চি পুত্রে স্থাপিয়া রাজ্যেতে। পুনঃ তীর্থ ভ্রমিবারে গেল তথা হৈতে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon