গোপালের নামকরণ

গোপালের নামকরণঃ
একদিন যদুকুল-পুরোহিত গর্গ মুনি বসুদের সদনে উপস্থিত হলেন। মুনিবরকে দেখামাত্র বসুদেব দন্ডবৎ হয়ে প্রণাম করলেন। মুনিকে পাদ্য অর্ঘ্য আসন দিলেন বসার জন্য। বসুদেব হাত জোর করে বললেন,” আপনি মহামতি। আপনি যদুকুল-পুরোহিত। যখন অনুগ্রহ করে এসেছেন। আপনাকে গোপনে নন্দের সদনে যেতে হবে। সেখানে আছে রোহিণী আর দেবকী-জাত দুই নন্দন। এখনও পর্যন্ত তাদের নামকরণ ও অন্নপ্রাশনাদি হয়নি। আপনি অনুগ্রহ করে ব্রজপুরে যান। গিয়ে তাদের নামকরণ করুন। কংসের ভয়ে আপনার সংবাদ নিতে পারিনা। এসেছেন যখন তখন আপনি ব্রজপুরে যান মহামতি। শুনে গর্গমুনি কন,” কেমনে আমি ব্রজেতে গমন করি। তুমি কংসের ভয়ে লুকিয়ে আছ। আর পুত্রকে লুকিয়ে রেখেছ নন্দালয়ে। সকলই জানে আমি যদুকুল-পুরোহিত। ব্রজেতে গেলে বিপরীত অবস্থা হতে পারে।”
বসুদেব বলেন,” নিবেদন করি আপনার কাছে। আপনি অতি গোপনে ব্রজধামে যাবেন। আপনি না গেলে যে নামকরণ হবে না। বসুদেবের বাক্য শুনে মহামতি গর্গমুনি নন্দের সদনে গেলেন। গর্গমুনিকে দেখে নন্দরাজ প্রণাম করলেন। বসবার জন্য পাদ্য অর্ঘ্য আসন দিলেন। করজোর করে নন্দরাজ গর্গমুনির পাশে বসলেন। বসুদেব নানা বাক্যে স্তব করে বললেন,” আজ আমার জন্ম সফল হয়েছে। আমার সকল কাজ সফল হয়েছে। আপনার দর্শনে চিত্ত থেকে পাপ দূরীভূত হয়। আপনাদের এ উপকার কিন্তু সামান্য নয়। সাধু সাক্ষাতে গৃহীর পূণ্য সঞ্চয় হয়।” নন্দরাজ আনন্দ সাগরে ভাসে। তখন নন্দ গর্গমুনিকে কহে,” কি জন্য মহামতির শুভাগমন হলো এখানে।” গর্গ কহে,” প্রয়োজন আছে এখানে। বসুদেব-পুত্র তোমার গৃহেতে আছে। আমি এসেছি তার নামকরণ করতে।” বসুদেব তখন বলেন, তাহলে আয়োজন করি। আর একদিন মাত্র আছে। সকলই জানে আপনি যদুকুল-পুরোহিত। আপনি মহাপন্ডিত। আমারও এক সন্তান আছে। জাতালয়ে তার নামকরণ করবেন।” গর্গমুনি কন,” ইহা কিভাবে হবে।” সকলই জানে আমি যদুকুল-পুরোহিত। তোমার পুত্রের নামে অন্নপ্রাশন দিলে সকলই তাকে বলবে যদুর নন্দন।” শুনে বসুদেব বলেন,” প্রভু নিবেদন করি। আমি গোপন স্থান করে দিব। সেখানে আপনি দুজনের নামকরণ করবেন।” শুনে গর্গ কন,” তা হলে পারি।” অতি গোপনে এক ধেনুশালায় গর্গমুনিকে নিয়ে গেল। নন্দরাজ যশোদা ও রোহিণীকে বলে, শোন তোমরা, গর্গমুনি এসেছেন তোমার পুত্রের নাম রাখার জন্য। সে সাথে আমার পুত্রের নামও রাখা হবে। আয়োজন কর অতি গোপনে। ষোল উপচার সহ বসন পরায়ে দুজনকে ধেনুশালে পীঠোপরি বসিয়ে রাখবে। পরে গর্গমুনি এসে নামকরণ করবেন।” গর্গমুনি স্নান সমাপন করে সে গৃহেতে প্রবেশ করে দুটি বালককে দেখে মহানন্দে ভাসে। চন্দন তূলসী দিয়ে পূজা করেন। নানা বাক্যে স্তব করেন। দু নয়নে তার বারি।
“কি নাম রাখিব তব ওহে গদাধর।
চতুর্ব্বেদে সংখ্যা নাহি হয় দামোদর।।
নারায়ণ দুরিতদমন দীনবন্ধু।
কেশব কমলাকান্ত করুণার সিন্ধু।।
গোপাল গোবিন্দ গোপীনাথ গিরিধারী।
রাধিকাররমণ রাসরসিক-বিহারী।।
দু’জনে সম্মুখে একবার দাঁড়াইবে।
দেখিয়া দোঁহার রূপ নয়ন জুড়াবে।।”
গর্গমুনির বাসনা পূর্ণ করবার জন্য দুটি বালক ত্রি-ভঙ্গিমায় দাঁড়ান। দুটি বালকের শোভাকে তুলনা করা যায় নীলগিরি( নীলাচল, জগন্নাথক্ষেত্র, পুরী) ও রজত-পর্বতের( কৈলাস পর্বত) সাথে। পূজা স্তুতি করে গর্গমুনি রোহিণী ও যশোদাকে আসার জন্য বলে। তখন গর্গমুনি রোহিণীকে কন, ” তুমি কত পূণ্য করেছিলে, সে পূণ্যের ফলে এমন পুত্র পেলে। এ সন্তানেরে যে নিরখিবে( নিরীক্ষণ করা বা দেখা) তার তাপিত প্রাণ জুড়াবে। মানুষে সন্তোষ বিধান করবেন বলে তার নাম হলো “রাম”। আর এ পুত্র হবে অত্যন্ত বলবান। “বল” বলে অন্য নাম পৃথিবীর মানুষ জানবে। তার আর এক নাম হবে সংকর্ষণ।” তোমার পুত্রের তিন নাম হলো।” তারপর যশোদাকে ডেকে গর্গমুনি বলেন,” মাগো তোমার পুত্রের নাম কে রাখতে পারে। বহু পূণ্য ফলে পেয়েছে কোলে তাঁকে। শুন নন্দ, তোমার এ কুমার যুগে যুগে হয়েছেন অবতার। আবার হবেন অবতীর্ণ। শ্বেত রক্ত পীত এখন দেখি কৃষ্ণবর্ণ। শুভ্ররূপে পূর্বে হয়েছেন অবতার। রক্তিম আবরণ নিয়ে পূনরায় অবতার হলেন। পীতবর্ণ ধারণ করে ভবিষ্যে অবতার গ্রহণ করবেন। এখন দেখছি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে জন্ম নিয়েছেন। তাই তাঁর নাম দিলাম “কৃষ্ণ”। জগতের মানুষ তার আর এক নাম বাসুদেব বলে জানবে। বসুদেবের পুত্র হয় বাসুদেব ( ত্রিলোকের মধ্যে যার বাস বা যাঁহাতে বসেন ত্রিভূবন জন, সে জন্যে তার নাম বাসুদেব)। নারায়ণ সমতুল্য হবে সে।” এ সব কথা বলে নন্দঘোষকে সান্তনা দিল। মুনি কন,” নামকরণ হলো। এখন দক্ষিণা প্রদান কর।” মুনির কাছে রইলেন রাম-কৃষ্ণ দু’ইজন। দক্ষিণা আনতে নন্দ গেলেন অন্য গৃহে। এ সুযোগ বুঝে মুনিবর দুহাত জোর করে কৃষ্ণকে কন,” নিবেদন করি গদাধর। নন্দঘোঘ আমাকে দক্ষিণা দিবে। সে দক্ষিণায় আমার কোন প্রয়োজন নেই। তোমাদের দু’জনার আমি নামকরণ করলাম। এবার দক্ষিণার ছলেতে পূর্ণ কর মনস্কাম। তুমি ভুলায়েছ নন্দকে মায়ার জালে। কিন্তু এ দাসকে তুমি ভুলাতে পারবে না প্রভু। আমি চিনেছি তোমাকে। অবশ্য আজ মনোবাঞ্জা পূরণ করতে হবে।” শুনে কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করেন,”আপনার কোন ধনের প্রয়োজন।” গর্গ কন,” আমার কোন ধনের প্রয়োজন নেই প্রভু। আমার ধন শুধু আপনার এ “রাঙ্গাচরণ”। আমার মস্তকে দু’জনার চরণ ঠেকাও। এ ভিক্ষা দাও যেন ভব-ভয় থেকে উদ্ধার পাই। কতবার এ ভবে আসতে হবে। জঠরের যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছিনা। কৃপা করে আমাকে ভব-ভয় থেকে নিস্তার কর। পুনরায় যেন আমার আর গর্ভে বাস করতে না হয়।” তা শুনে হরি কন,” তোমার ভয় নেই। তোমাকে আর জঠরে বাস করতে হবে না।” এ বলে দু’ভাই গর্গমুনির মস্তকে চরণ ঠেকালো।” ঠিক তখনই দক্ষিণা নিয়ে নন্দ ধেনু গৃহে প্রবেশ করল। পরে গর্গমুনি দু’জনার মুখে অন্ন তুলে দেন। নন্দরাজ গর্গমুনিকে প্রণাম করল। তারপর মুনিবর আপনার স্থানে চলে যান।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র