১৬. শ্রীবৎস রাজার কাঠুরিয়া আলয়ে স্থিতিশুন শুন ধর্ম্মরাজ অপূর্ব্ব কথন।কাননে বঞ্চেন চিন্তা শ্রীবৎস রাজন।।পূর্ব্বমত ফলমূল না মিলে তথায়।কানন ত্যজিয়া রাজা নগরেতে যায়।।নগর উত্তরভাগে ধনীর বসতি।তথায় বসতি মোর না হয় সঙ্গতি।।দুঃখী হয়ে ধনাঢ্যের নিকটে না যাবে।দরিদ্র দেখিয়া মোরে অবজ্ঞা করিবে।।দুঃখীর সমাজে আকি কাটাইব কাল।পাছে লোকে ঘৃণা করে, এ বড় জঞ্জাল।।এত বলি দক্ষিণেতে প্রবেশিল রায়।শত শত ঘর তথা কাঠুরিয়া রয়।।রাজা রাণী তথাকারে হয় উপনীত।দেকিয়া সম্ভ্রমে তারা জিজ্ঞাসে ত্বরিত।।কহ তুমি, কেবা হও, কোথায় বসতি।কি হেতু আসিলে দোঁহে, কহ শীঘ্রগতি।।শুনিয়া সবার বাক্য কহে নৃপবর।মোর সম দুঃখী নাহি পৃথিবী ভিতর।।বহুদুঃখ পেয়ে আমি আইনু হেথায়।তোমরা করিলে কৃপা তবে দুঃখ যায়।।আশ্বাস করিয়া তারা কৈল অঙ্গীকার।করিব তোমার হিত, প্রতিজ্ঞা সবার।।মোরা কাঠুরিয়া জাতি, কাষ্ঠ বেচি কিনি।নিত্য আনি নিত্য খাই, দুঃখ নাহি জানি।।সঙ্গে থাকি কাষ্ঠ বেচি প্রত্যহ আনিবে।এ কর্ম্মে নিযুক্ত হলে দুঃখ না রহিবে।।শুনি আনন্দিত হন শ্রীবৎস রাজন।ভাল ভাল এই কর্ম্ম করিব এখন।।হেনমতে কাঠুরিয়া ঘরে দুই জন।রহিল গোপনে রাজা নিরানন্দ মন।।কাঠুরিয়াগণ ভার্য্যা যতেক আছিল।চিন্তার সৌজন্য হেরি সবে বশ হল।।নানা ধর্ম্ম নানা কর্ম্ম করান শ্রবণ।শুনিয়া সন্তুষ্ট হল সবাকার মন।।সবা সঙ্গে সখীভাবে আছে রাজরাণী।শিষ্টালাপে থাকে সদা দিবস রজনী।।প্রভাতে কাঠুরেগণ চলিল কাননে।রাজাকে ডাকিল সবে, এস যাই বনে।।শুনিয়া চলেন রাজা সবার সংহতি।ঘোর বনে প্রবেশে করিল শীঘ্রগতি।।কাঠুরিয়াগণ কাষ্ঠ ভাঙ্গিল অনেক।বড় বড় বোঝা সবে বান্ধিল যতেক।।ফলমূল পত্রপুষ্প নিল সর্ব্বজন।আমি কি লইব চিত্তে চিন্তিল রাজন।।নিন্দিত না হয় কর্ম্ম, ক্লেশ না সহিব।অথচ আপন কর্ম্ম প্রকারে সাধিব।।চিনিয়া লইল রাজা চন্দনের সার।কাঠুরিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল বাজার।।বাজারে ফেলিলা বোঝা কাঠুরিয়া কুল।গৃহীলোক আসি সবে করি নিল মূল।।কেহ পায় চারি পণ কেহ আটপণ।কেহ বা বেচিয়া কেনে খাদ্য প্রয়োজন।।চন্দনের কাষ্ঠ লয়ে শ্রীবৎস রাজন।বেচিবারে যায় তবে বণিক সদন।।দিব্য চন্দনের সার পেয়ে সদাগর।করিয়া উচিত মূল্য দিলেক সত্বর।।তঙ্কা দুই চারি রাজা বেচিয়া পাইল।অপূর্ব্ব বিচিত্র দ্রব্য কিনিয়া লইল।।ঘৃত তৈল চালি ডালি লবণ সৈন্ধব।মশলা মিষ্টান্ন দধি কিনিলেন সব।।শাক সূপ তরকারী যতেক পাইল।ভাল মৎস্য মাংস রায় যত্ন করি নিল।।কিনিয়া অশেষ দ্রব্য লয়ে নরপতি।গৃহেতে আনিয়া দিল যথা চিন্তাসতী।।রাণী প্রতি কহে রাজা বিনয়-বচন।কাঠুরিয়াগণ বন্ধু, কর নিমন্ত্রণ।।শুনিয়া সন্তুষ্ট হৈল চিন্তা মহারাণী।বিচিত্র করিয়া পাক করিল তখনি।।লক্ষ্মী অংশে জন্ম তাঁর, লক্ষ্মী স্বরূপিণী।চক্ষুর নিমিষে পাক কৈল চিন্তারাণী।।স্নান দান করি রাজা আসিয়া সত্বর।দেখিল সকল পাক হয়েছে সুন্দর।।রাণী বলে, সবাকারে ডাকহ রাজন।সকল রন্ধন হৈর করাহ ভোজন।।এত শুনি নরপতি ডাকে সবাকারে।আনন্দিত হয়ে সবে এল ভুঞ্জিবারে।।একত্র হইয়া সব কাঠুরিয়াগণ।ভোজনে বসিল সবে অতি হৃষ্ট মন।।রাণী আসেন অন্ন নৃপ করেন বন্টন।তৃপ্তিতে লাগিল সবে করিতে ভোজন।।সুধা সম অন্নপাক খায় সর্ব্বজন।ধন্য ধন্য ধ্বনি হল কাঠুরে ভবন।।শ্রদ্ধা পুরস্কারে সবে বিদায় করিয়া।পশ্চাতে ভুঞ্জিল রাজা হৃষ্টমন হৈয়া।।এইরূপে কত দিন বঞ্চিল তথায়।এক দিন শুন যুধিষ্ঠির মহাশয়।।বাণিজ্য করিতে এক সদাগর যায়।চাপাইয়া তরী সাধু সেইখানে রয়।।অকস্মাৎ তার ডিঙ্গি চড়াতে লাগিল।হায় হায় করি কান্দে, কি হল কি হল।।হেনকালে শুন রাজা দৈবের ঘটন।গণক হইয়া শনি আইল তখন।।হস্তে লাঠি, কাঁখে পুঁথি গ্রহাচার্য্য হৈয়া।সাধুর মঙ্গল কথা কহিল আসিয়া।।শুন মহাজন তুমি, স্থির কর মন।তোমার তরণী বদ্ধ হৈল যে কারণ।।তব নারী নবগ্রহ করেন অর্চ্চন।অবজ্ঞা করিয়া তুমি আইলে পাটন।।সেই হেতু তব তরী হৈল হেনরূপ।কহিনু যতেক কথা, জানিবে স্বরূপ।।মহাজন কহে কথা করিয়া প্রণতি।অমৃত অধিক শুনি আমার ভারতী।।ব্রাহ্মণ বলেন, শুনি আমার বচন।যেমতে তোমার তরী চলিবে এখন।।এই গ্রামবাসী কাঠুরিয়া যত জন।নিমন্ত্রণ করি আন তার ভার্য্যাগণ।।সকলে আসিয়া তারা ধরিবেক তরী।তার মধ্যে পতিব্রতা আছে এক নারী।।সেই আসি যেইক্ষণে ছুঁইবে তরণী।কহিনু স্বরূপ কথা, ভাসিবে তখনি।।শুনি আনন্দিত হৈল সেই মহাজন।এ কথা কহিয়া শনি করিল গমন।।শুনিয়া উপায় সাধু চিন্তা করে মনে।পাইনু পরম তত্ত্ব দৈবের ঘটনে।।কিঙ্করের তবে সাধু কহিল সত্বরে।কাঠুরিয়া জাতি সতী আনহ সাদরে।।শুনিয়া সাধুর আজ্ঞা কিঙ্কর চলিল।স্তবস্তুতি করি সবাকারে আমন্ত্রিল।।সহজেতে হীনজাতি, অতি অল্পজ্ঞান।পাইয়া সাধুর নাম আনন্দ বিধান।।যতেক কাঠুরে ভার্য্যা নিমন্ত্রণ শুনি।হরিষ বিধানে সবে চলিল তখনি।।যেখানে নদীর ঘাটে আটক তরণী।সেইখানে উত্তরিল যতেক রমণী।।কমলা বিমলা গেল আর কলাবতী।কৌশল্যা রোহিনী চলে আর সরস্বতী।।রেবতী কৈকেয়ী উমা রম্ভা তিলোত্তমা।হরিপ্রিয়া চিত্রাবতী রাধা সতী শ্যামা।।যশোদা যমুনা জয়া বিমলা বিজয়া।আর ষষ্ঠী গয়া গঙ্গা কালিন্দী অভয়া।।চপলা চঞ্চলা ধায় চাণ্ডালী কেশরী।পদ্মাবতী অরুন্ধতী সাবিত্রী মঞ্জরী।।একে একে তরী সবে পরশ করিল।জনে জনে মান নিয়া বিদায় হইল।।কারো হাতে নাহি হল সাধু প্রয়োজন।বুঝিল হইল মিথ্যা গণক বচন।।কত নারী আইল, না এল কত জন।কিঙ্করে জিজ্ঞাসে সাধু সে সব কারণ।।নাবিক কহিল, সবে আসিয়াছে রায়।এক নারী না আইল স্বামীর মানায়।।শুনি সাধু মনে কৈল, সেই সাধ্বী তবে।তিনি এলে মোর তরী অবশ্য চলিবে।।মহাভারতের আখ্যান সুধার সার।তরিবারে ইহা বিনা কিছু নাহি আর।।১৭. বণিক কর্ত্তৃক চিন্তা হরণতবে সাধু হর্ষযুত গলে বন্ত্র দিয়া।যথা চিন্তা সতী তথা উত্তরিল গিয়া।।চিন্তাদেবীরে সাধু কহে বিনয় বাণী।আমারে করহ রক্ষা, ওগো ঠাকুরাণি।।সাধুরে দেখিয়া চিন্তা কহে দুঃখ মনে।আমাকে যাইতে মানা করিল রাজনে।।কি কহিবে মহারাজ আসিয়া ভবনে।ভাবিয়া চিন্তিয়া রাণী স্থির কৈল মনে।।কাতর শরণাগত যেই জন হয়।তাহারে করিলে রক্ষা ধর্ম্মের সঞ্চয়।।বেদে শাস্ত্রে মুনিমুখে শুনিয়াছি আমি।প্রাণ দিয়া রাখয়ে শরণাগত প্রাণী।।যাহা কন মহারাজ এ কথা শুনিয়া।সহবি সকল কথা শরণ মাগিয়া।।এত ভাবি চিন্তাদেবী হৃষ্টচিত্তা হৈয়া।চলিলেন তবে রাণী ঈশ্বর ভাবিয়া।।উপনীত হন যথা সদাগর তরী।করযোড়ে কহে দেবী প্রদক্ষিণ করি।।যদি আমি সতী হই পতি অনুগতা।তবে সে ভাসিবে তরী কহিনু সর্ব্বথা।।এত বলি সেই তরী পরশ করিতে।ভাসিয়া উঠিল তরণী সেইক্ষণেতে।।দেখি সদাগর হল হরিষত মন।জানিল মনুষ্য নহে এই নারীজন।যদি মার নৌকা কভু আটক হইবে।।ইহাকে লইলে সঙ্গে তখনি চলিবে।এত ভাবি নৌকা পরে লইল চিন্তারে।।দেখ যুধিষ্ঠির রাজা দৈবে কি না করে।শুনি ধর্ম্ম-নৃপমণি কহে প্রভু প্রতি।।অমৃত অধিক শুনি তোমার ভারতী।চিন্তার বলহ শেষে হৈল কোন গতি।কিরূপে রহিল কোথা শ্রীবৎস নৃপতি।।এত শুনি কহেন শ্রীগশোদা কুমার।শুন মহারাজ কহি বিশেষ ইহার।।অতি দুঃখে শোকাকুল কাতর অন্তরে।ঈশ্বর স্মরিয়া দেবী কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।।কেন আমি আইলাম আপনা খাইয়া।কান্দিয়া আকুল চিন্তা এ কথা ভাবিয়া।।সূর্য্যপানে চাহি দেবী যোড় করি হাত।বহু স্তব করে চিন্তা বহু প্রণিপাত।।দয়া কর দিননাথ অখিলের পতি।মোর রূপ লহ দেব! দেহ কু আকৃতি।।জরাযুত অঙ্গ প্রভু দেহ শীঘ্রগতি।এত বলি কান্দে দেবী লোটাইয়া ক্ষিতি।।দেখি দেব ভাঙ্করের দয়া উপিজিল।ভয় নাই ভয় নাই বাণী নিঃসরিল।।না কান্দহ না চিন্তিহ ওগো চিন্তাসতী।স্বামী প্রতি সদা হয়ে থেকো ভক্তিমতী।।তব সুন্দর রূপরাশি এবে হরিব।স্মরিলে আমায় পুনঃ পূর্ব্বরূপ দিব।।তবে সতী রূপ সূর্য্য করেন হরণ।গলিত ধবল মূর্ত্তি দিল ততক্ষণ।।এইরূপে চিন্তাদেবী নৌকায় রহিল।দক্ষিণেতে নৌকা বাহি সাধু যে চলিল।।এথায় কানন হতে আসি নিজালয়।শূন্য ঘর দেখি রাজা মানিল বিস্ময়।।কান্দিয়া অস্থির রাজা না দেখি চিন্তায়।সকাতরে পড়সীরে জিজ্ঞাসেন রায়।।পঠনে শ্রবণে নারী লভে ধর্ম্মজ্ঞান।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান্ ।।১৮. শ্রীবৎস রাজার রোদন এবং চিন্তার অন্বেষণকাতর হৃদয় অতি, শ্রীবৎস ধরণীপতি,পড়সীরে জিজ্ঞাসে বারতা।কহ সবে সমাচার, কোথা চিন্তা সে আমার,না হেরিয়া পাই মনে ব্যথা।।রাজার বচন শুনি, পড়সী কহিছে বাণী,ওহে ধীর পণ্ডিত সুজন।কহি শুন বিবরণ, এই ঘাটে এক জন,আইল ধনাঢ্য মহাজন।।তাহার কর্ম্মেতে ঘটে, তরণী আটক ঘাটে,বিধাতা তাহারে বিড়ম্বিল।সতী যে জন হইবে, পরশে তরী ভাসিবে,তেঁই নারী সবারে ডাকিল।।গৌরব করিয়া সাধু, লইয়া কাঠুরে বধূ,ক্রমে ক্রমে তরী ছোঁয়াইল।না ভাসিল সেই তরী, পুনঃ পুনঃ যত্ন করি,তোমার চিন্তায় লয়ে গেল।।চিন্তা সতী পরশিতে, ভাসে তরী হরষেতে,চিন্তায় ধরি লৈল তরিতে।ছাড়িয়া সে দিল তরী, করি অতি তাড়াতাড়ি,চিন্তাদেবী লাগিল কান্দিতে।।বজ্র সম বাণী শুনি, মূর্চ্ছাগত নৃপমণি,লোটায়ে পড়িল ধরাতলে।ক্ষণেকে চেতন পায়, বলে রাজা হায় হায়,কেন হেন ঈশ্বর করিলে।।আমার কর্ম্মের পাশ, রাজ্য ত্যজি বনবাস,নারী সঙ্গে আইনু কাননে।ধন রত্ন যত আনি, সকলি হরিল শনি,অবেশেষে ছিনু দুই প্রাণে।।তাহাতে করিল আন, দুই জন দুই স্নান,শনি দুঃখ দিল বুহ মোরে।বিষাদে তাপিত মন, এই চিন্তা অনুক্ষণ,ভয়ে রক্ষা কে করিবে তারে।।এত চিন্তি নরপতি, শোকেতে কাতর অতি,চলিল নদীর তটে তটে।জিজ্ঞাসিল জনে জনে, স্থাবর জঙ্গমগণে,মনুষ্য যতেক দেখে বাটে।।বিবিধ কানন মাঝ, খুঁজিলেন মহারাজ,চিন্তার না পাইল উদ্দেশ।বহু দেশ নানা স্থানে, নদ নদী উপবনে,ভ্রমে রাজা পেয়ে বহু ক্লেশ।।ক্ষুধা তৃষ্ণা অনাহারে, মহাকষ্টে নৃপবরে,শেষমাত্র ছিল প্রাণ তাঁর।শুন ধর্ম্ম মহাশয়, সকল দৈবেতে হয়,সর্ব্ব কর্ম্ম ইচ্ছা বিধাতার।।চিত্তানন্দ নামে বনে, রাজা গেল সেইস্থানে,তথাকারে সুরভি আশ্রম।অপূর্ব্ব বিচিত্র শোভা, সুরাসুর মনোলোভা,তথা যেতে সভয় শমন।।নানা পশু নানা পক্ষ, এক স্থানে লক্ষ লক্ষ,ভক্ষ্য ভোজ্য রঙ্গে এক স্থল।বিচিত্র তড়াগ বাপী, পুষ্করিণী কতরূপী,তাহে শোভে কনক কমল।।অপূর্ব্ব কাননশোভা, নানা পুষ্প মনোলোভা,ঋড়ঋতু শোভিত তথায়।কেহ কারে নাহি ডরে, সুখে সবে ঘর করে,নিঃশঙ্কে রহিল তথা রায়।।রাজা পুণ্যবান অতি, জানিয়া গোমাতা সতী,তথায় হইল উপনীত।কাশীরাম সাদ গায়, বিফলে জনম যায়,ভজ হরি, ভবে নাহি ভীত।।১৯. সুরভি আশ্রমে শ্রীবৎস রাজারঅবস্থিতি ও সদাগর কর্ত্তৃক নিগ্রহসুরভি জিজ্ঞাসা করে, তুমি কোন জন।রাজা বলে, শুন মাতা মোর নিবেদন।।অবনীতে মহীপতি ছিলাম মা আমি।শ্রীবৎস আমার নাম প্রাগদেশস্বামী।।আনন্দেতে করিতাম প্রজার পালন।কত দিনে শুন মাতা দৈবের ঘটন।।একদিন শনি সঙ্গে জলধি তনয়া।মম স্থানে আসে দোঁহে বিরোধ করিয়া।।বিচার করিনু আমি ধর্ম্মশাস্ত্র ধরি।বিপরীত বুঝি শনি হৈল মম অরি।।রাজ্য ধন সব শনি করিল বিনাশ।অবশেষে চিন্তা সহ আসি বনবাস।।বনবাসে মহাক্লেশে বঞ্চি দুই জনে।চিন্তাকে হারানু মাতা নির্জ্জন কাননে।।সুরভি এতেক শুনি কহে নৃপ প্রতি।ভয় নাই, থাক রাজা আমার বসতি।।যত দিন গ্রহ মন্দ আছয়ে তোমার।তত দিন মোর তেথা থাক গুণাধার।।এখানে শনি ভয় নাহিক রাজন।হেথা থাকি কর রাজা কালের হরণ।।পুনঃ বসুমতী পতি হবে নৃপবর।চিন্তা সতী পাবে কত দিবস অন্তর।।এ বন ছাড়িয়া নাহি যাইবে কোথায়।দুই ধার দুগ্ধি আমি ভুঞ্জাব তোমায়।।এ বন ছাড়িয়া যদি যাও নররায়।অবশ্য পড়িবে তুমি শনির মায়ায়।।রাজা বলে, মাতা হয় যে আজ্ঞা তোমার।রহিলাম যত দিন দুঃখ নহে পার।।এরূপে শ্রীবৎস রায় রহিল তথায়।শুনহ অপূর্ব্ব কথা ধর্ম্মের তনয়।।মনোরথ নন্দিনীর যত দুগ্ধ খায়।দুধারের দুগ্ধেতে ধরণী ভিজে যায়।।সেই দুগ্ধে মৃত্তিকা ভিজায়ে কাদা করি।দুই হাতে মহারাজ দুই পাট ধরি।।চিন্তাদেবী শ্রীবৎস নৃপতি নাম স্মরি।তাল ও বেতাল সিদ্ধ মনেতে বিচারি।।যুগ্মপাট যুক্ত করি গঠয়ে রাজন।এরূপে কতেক পাট করয়ে রচন।।ঈশ্বরের ধ্যান করি কালের হরণ।সহস্র সহস্র পাট করিল গঠন।।স্থানে স্থানে স্তূপাকার শত শত করি।এমতে শ্রীবৎস বঞ্চে দিবস শর্ব্বরী।।কত দিনান্তরে শুন ধর্ম্ম মহাশয়।পুনর্ব্বার পড়ে রাজা শনির মায়ায়।।সেই মহাজন যায় বাহিয়া তরণী।কূলেতে থাকিয়া দেখে শ্রীবৎস আপনি।।মহাজন প্রতি রাজা বলিল ডাকিয়া।শুন শুন সদাগর কূলেতে আসিয়া।।নৃপতির উচ্চবর শুনি মহাজন।শীঘ্র করি কূলে তরী লইল তখন।।পাইয়া সাধুর আজ্ঞা নৌকার নফর।শ্রীবৎসের কাছে তরী আনিল সত্বর।।মৃদুভাষে রাজা কহে বিনয় বচন।শুন মহাজন তুমি মোর বিবরণ।।বড় বংশে জন্মিলাম পূর্ব্ব ভাগ্যবলে।কিন্তু সব হৈল নষ্ট নিজ কর্ম্মফলে।।কারে কি বলিব আমি, কি বলিতে পারি।ঈশ্বরের ইচ্ছা যাহা, খণ্ডাইতে নারি।।তুমি যদি দয়া করে এক কর্ম্ম কর।তবে ত তরিব আমি বিপদ সাগর।।কতগুলি স্বর্ণপাট করিয়াছি আমি।তুলে যদি লয়ে যাও নৌকা পরে তুমি।।যে দেশে বাণিজ্যে তুমি করিছ প্রয়াণ।সেই দেশে তব সঙ্গে করিব প্রস্থান।।স্বর্ণপাট বেচি যদি পাই কিছু ধন।তবে ত বিপদে তরি, এই নিবেদন।।রাজার বিনয় বাক্য শুনি মহাজন।কিঙ্করের আজ্ঞা করে , লয়ে এস ধন।।রাজাকে কহিল সাধু, শুন মহাশয়।আইস আমার সঙ্গে, নাহি কিছু ভয়।।হৃষ্ট হয়ে নরপতি উঠে নৌকা পরে।স্বর্ণপাট বয়ে আনে যতেক কিঙ্করে।।তুষ্ট হয়ে সদাগর বাহিল তরণী।কি কব শনির মায়া শুন নৃপমণি।।কপট পাষণ্ড বড় সেই সদাগর।এই দুষ্ট, তবে চিন্তিল নিজ অন্তর।।মিলাইল যদি ধন দৈবেতে আমাকে।ঘুচাই মনের ব্যথা বধিয়া ইহাকে।।এতেক ভাবিয়া মনে দুষ্ট দুরাচার।রাজাকে ধরিয়া ফেলে সাগর মাঝার।।যখন ধরিয়া দুষ্ট করিল বন্ধন।ত্রাহি ত্রাহি বলি রাজা করিছে স্মরণ।।কোথা তাল বেতাল বান্ধব দুই জন।এ মহাবিপদে কর আমারে তারণ।।কোথা গেলে চিন্তাদেবী আমারে ছাড়িয়া।আমার দুর্গতি প্রিয়ে দেখ না আসিয়া।।সেই নৌকা পরে ছিল চিন্তা পতিব্রতা।কান্দিয়া উঠিল রাণী শুনি প্রভু কথা।।যখন ধরিয়া নৃপে ফেলিল সমুদ্রে।হইল বেতাল তাল রাজচক্ষে নিদ্রে।।তাল রক্ষা কৈল চক্ষু বেতাল হৈল ভেলা।ভাসিয়া নৃপতি যায় যেন রাশি তূলা।।সেইক্ষণে চিন্তাদেবী বালিশ যোগায়।বালিশে আলিস রাখি নৃপ ভাসি যায়।।শুনহ আশ্চর্য্য কথা ধর্ম্মের তনয়।বহুকাল জলে ভাসি সৌতিপুরে যায়।।সৌতিপুরে রম্ভাবতী মালিনীর স্থানে।আসিয়া লাগিল শুষ্ক পুষ্পের উদ্যানে।।বহুকাল শুষ্ক ছিল যত পুষ্পবন।রাজ আগমনে পুষ্প ফুটিল তখন।।রাজ-দরশনে পুনঃ জীব সঞ্চরিল।পূর্ব্বমত সব পুষ্প বিকশিত হৈল।।অশোক কিংশুক নাগ ফুটিল বকুল।গন্ধরাজ চাঁপা ফুটে জারুল পারুল।।শেফালি সেঁওতী আদি নানাজাতি ফুল।ফুটিল যতেক পুষ্প, নাহি সমতুল।।পুষ্পগন্ধে অলিকুল ধায় মধু আশে।কোকিল কোকিলা গান করিছে হরিষে।।ষড়ঋতু আসি তথা হৈল উপনীত।শর ধনু সহ কাম তথায় উদিত।।পূর্ব্বমত বনশোভা হইল বিস্তর।কর্ম্মান্তর হইতে মালিনী আইল ঘর।।আশ্চর্য্য দেখিয়া বড় ভাবিছে মালিনী।ইহার কারণ কিবা, কিছুই না জানি।।বন দেখি হৃষ্ট অতি মালীর মহিষী।কুসুম কাননে শীঘ্র প্রবেশিল আসি।।একে একে নিরখিয়া চতুর্দ্দিকে চায়।হেনকালে শ্রীবৎসকে দেখিল তথায়।।কন্দর্প আকার এক পুরুষ সুন্দর।মালিনী দেখিয়া কহে করি যোড়কর।।কোথা হৈতে এলে তুমি, কোন মহাজন।সত্য করি কহ বাছা, মোর নিবেদন।।মালিনী বিনয় শুনি তবে নৃপমণি।কহিতে লাগিল রাজা আপন কাহিনী।।বাণিজ্যে আইনু আমি করিতে ব্যাপার।ডিঙ্গা ডুবি হয়ে দুঃখ হইল আমার।।ভাগ্য হেতু প্রাণ পাই, তেঁই আসি কূল।আমার ভাবনা মিথ্যা,ভবিতব্য মূল।।শুনিয়া মালিনী কহে, শুন মহাশয়।থাকহ আমার ঘরে নাহি কিছু ভয়।।শুভগ্রহ হৈল তব, দুঃখ অবসান।নহে কেন নৌকা ডুবে পাইলে পরাণ।।আর কেহ নাহি বাপু, বঞ্চি একাকিনী।মোর গৃহে ভাগিনেয় ভাবে থাক তুমি।।এমতে রহিল তথা শ্রীবৎস ভূপতি।শুনহ অপূর্ব্ব কথা ধর্ম্ম মহামতি।।সুধার সমান মহাভারতের কথা।শ্রবণে পঠনে ঘুচে, পাপ তাপ ব্যথা।।২০. শ্রীবৎস রাজর মালিনী আলয়ে অবস্থিতিমালিনীর বাণী শুনি, আনন্দিত নৃপমণি,তুষ্ট হয়ে গেল তার বাসে।আয়োজন আনি দিল, নৃপতি রন্ধন কৈল,বঞ্চে রায় কৌতুক বিমেষে।।এইরূপে নৃপবর, রহিল মালিনী ঘর,আছে রায়, কেহ নাহি জানে।শুন ধর্ম্ম মহাশয়, শুভকাল যবে হয়,শুভ তার হয় দিনে দিনে।।অপূর্ব্ব বিধির কর্ম্ম, কেবা তার বুঝে মর্ম্ম,সৃজন পালন পুনঃ পাত।একবার হয় অংশ, আরবার করে ধ্বংস,কর্ম্মযোগে করে যাতায়াত।।পুনঃ জন্মে পুনঃ মরে, এইরূপে ঘুরে ফিরে,তথাচ না বুঝে মূঢ় জন।লোভ করে, অপহরে, কুকর্ম্ম যতেক করে,সাধুকর্ম্ম নহে একক্ষণ।।আশ্চর্য্য শুনহ রাজা, সেই দেশে মহাতেজা,বাহুদেব নামে নৃপবর।ভদ্রা নামে তাঁর কন্যা, রূপে গুণে মহীধন্যা,সৌজন্যেতে দ্রৌপদী সোসর।।রূপ গুণ বর্ণিবারে, কার শক্তি কেবা পরে,তিলোত্তমা জিনি রূপবতী।ক্ষমায় পৃথিবী সম, গুণে সরস্বতী সম.তপে যেন অগ্নি স্বাহা সতী।।জন্মাবধি কর্ম্ম তার, শুন মুন গুণাধার,হরগৌরী করে আরাধন।কঠোর তপস্যা যত, বিস্তারিয়া কব কত,আরধয়ে করি প্রাণপণ।।স্তবে তুষ্টা হৈমবতী, ডাকি বলে ভদ্রাবতী,বর মাগ চিত্তে যাহা লয়।শুনিয়া রাজার সুতা, হইল আনন্দযুতা,প্রণমিয়া করযোড়ে কয়।।শুন মাতা ব্রহ্মময়ি, গতি নাই তোমা বই,তরাইতে হবে এ দাসীরে।বর যদি দিবে তুমি, শ্রীবৎস নৃপতি স্বামী,এই বর দেহ মা আমারে।।তুষ্টা হয়ে হরপ্রিয়া, কহিলেন আশ্বাসিয়া,তব ভাগ্যে হবে নৃপবর।তত্বকথা কহি শুন, আসিয়াছে সেই জন,রম্ভাবতী মালিনীর ঘর।।তারে বরমাল্য দিয়া, সুখে ঘর কর নিয়া,বর দিনু বাঞ্ছামত তব।বর পেয়ে নৃপসুতা, হইয়া আনন্দযুতা,দেবী পূজে করিয়া উৎসব।।শ্রীবৎস চিন্তার কথা, আরণ্যপর্ব্বতে গাথা,শুনিলে অধর্ম্ম হয় নাশ।কমলাকান্তের সুত, সুজনের মনঃপূত,বিরচিল কাশীরাম দাস।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon