ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্নভিক্ষা

প্রতিদিনের মত শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম ও অন্যান্য গোপীবালকগণ মাঠে ধেনু চড়াতে গেল। বেলা প্রায় দুপ্রহর হল।শ্রীদাম শ্রীকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বলল,” এখানের তোমরা কিছূক্ষণ অপেক্ষা কর আমার গাভীবৎসগণ ফিরায়ে আনছি”।শ্রীদামাদিচঞ্চল ধেনুগণের সাথে ভ্রমন করতে করতে ক্ষুধায় ব্যাকুল হলেন। ধেনু ফিরিয়ে এনে ক্লান্ত শরীরে শিশুগণবলতে লাগল,” আমরা খুবই ক্ষুধার্থ। ক্ষুধার জ্বালায় প্রাণ যায়। আমাদেরকে কিছু খাবার দাও। এত ক্ষুধার সময় মা নেই।গোঠে ধেনু চড়ার সময় মা যা খাদ্যদ্রব্য দিয়েছিল ধেনু চড়াতে চড়াতে ক্ষুধার জ্বালায় তা মন ভুলে খেয়ে ফেলেছি। এমনসময় জননী কাছে নেই। মুখ চেয়ে তুমি আমাদের খেতে দাও। সেজন্যে আমার তোমার সংগে যাই। প্রাণহারালে প্রাণফিরে পাই। এ সময় যদি তুমি আমাদের না খাওয়াবে, তবে বল ভাই কে আমাদের খেতে দিবে। দাদা তুমি আমাদেরসকলের মাতা হও। আমাদের মলিন মুখ দেখে তুমি খেতে দাও।” এ কথাগুলি যখন শিশুগণ রামকে সুধায় তখন রামবলার পূর্বেই কৃষ্ণ কহে,” শোন ভাই শ্রীদাম, মধুবনে যজ্ঞ করছে বহু মুনি। তার নিকটেই আঙ্গিরস-গোত্রীয় ব্রাহ্মণগণসবেমাত্র নারায়ণের পূজা শেষ করে যজ্ঞ করছে। শ্রীদাম ও সুবল তোমরা দুজন সেখানে যাও এবং আমার নাম করেযজ্ঞশালায় গিয়ে অন্ন মেগে আন। অবশ্যই উনার অন্ন দিবেন”। তখন শ্রীদাম সুবল ও অন্য দুইজন শিশু মধুবণে যজ্ঞ স্থলেমুনিদের সম্মুখে উপস্থিত হল। শ্রীদাম-সুবল বলল,” ওগো দ্বিজগণ। রাম-কৃষ্ণ পাঠালেন যজ্ঞশালায়।” শ্রীদামকে দেখেমুনিগণ বলল,” কে তোমরা, কোথা থেকে এসেছে, কিসের জন্য এসেছো? তখন শ্রীদাম হাত জোর করে বললেন,” নিবেদনকরি মুনিবর। আমরা ব্রজেতে থাকি গোপের কুমার। অদূরেদে রাম-কৃষ্ণ ধেনু চড়ান। ক্ষুধায় কাতর হয়েছেন দুইজন।তোমাদের কাছে অন্ন চেয়ে আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। অন্নভিক্ষা করার জন্য এসেছি মোরা। বিলম্ব না করে আমাদেরকেঅন্ন দাও। অন্ন দিয়ে সকলের ক্ষুধার দূর কর। মনোমত হয় যদি তবে অন্ন দাও। আর যদি না দিবে তো বলি গে কৃষ্ণরে আগে”।সব শুনে মুনিগণ ক্রোদ্ধ হল। তারা বললেন,” গোয়ালার ছেলে তোরা। তোরা কি জানিবি নীতি। যজ্ঞ করি আমরা দেবতার জন্য।গোয়ালার ছেলেদের অন্ন আগে দিব কি করে। যজ্ঞ শেষ হলে দেয়া যেত যেহেতু যজ্ঞ শেষ হয়নি,তাই অন্ন দেয়া যাবে না।বলতে বলতে মহাক্রোদ্ধ হলেন মুনিগণ। ক্রোধমনে বলতে লাগলেন,” কোথাকার কোন রাম-কৃষ্ণ কেবা তারে চিনে। এখানে এসেছে বেটা অন্ন মাগিবারে। দূর হয়ে যা। যষ্টি মারলে এক ঘা যমালয়ে যাবি। হায় বিধি এ কথা শুনে হাসি পায় দেবতা-ব্রাহ্মণের আগে গোয়ালা খায়। ওহে কোথায় ন্যায়বাগীশ, শিরোমণি। এস বিদ্যাভূষণ শুন চূড়ামণি গোয়ালার জ্বালায় দেশেতে থাকাভার। এদের উচিৎ দন্ড দেয়া দরকার। গোপের নন্দন রাম-কৃষ্ণ দুটি ভাই। সদাই তারা রাখালের বেশে বনেতে বেড়ায়।কৃষ্ণ নিন্দা শুনে শ্রীদামাদি শিশুগণ কানে হাত দিয়ে রোদন করতে লাগল। “ কেন গো ঠাকুর ক্রোধে তোমরা কৃষ্ণ নিন্দা করছ।যজ্ঞকারী হয়ে তোমরা যিনি যজ্ঞেশ্বর তাকেই নিন্দা করছ। তোমরা ব্রাহ্মণ হয়ে কেন এত কৃষ্ণ নিন্দা করছ। আমার সব সহ্যকরতে পারি। কিন্তু প্রভু কৃষ্ণ নিন্দা সহ্য করতে পারি না”। শ্রীদামের কথা শুনে রক্তচক্ষুসম দ্বিজগণ ক্রোধে কম্পিত হল। তবে রে গোয়ালা বলে লাঠি দিয়ে প্রহার করতে উদ্যত হল। অবস্থা দেখে শ্রীদামাদি শিশুগণ ভয়ে পালায়ন করে উর্ধ্বশাসেকৃষ্ণ সমীপে উপস্থিত হল। দেখে কৃষ্ণ সুধান তাদেরকে,” কেন সবে ব্যস্ত হয়ে এত বেগে এলে। আর কেনই বা ঘণ ঘণ নিশ্বাস”।শুনিয়া পুটপাণি হয়ে শ্রীদাম কহে,” নিবেদন করি শুন কৃষ্ণ গুনমণি। অন্ন আনিবার জন্য আমাদেরকে পাঠালে। আমার চারজন সেথায় অন্ন আনার জন্য গেলা। দ্বিজগণকে বললাম, কানাই-বলাই দুজন তোমাদের কাছে অন্ন মাগেছে। এ কথা শুনে সবাই জ্বলে গেল। দ্বিজগণ লাঠি নিয়ে আমাদেরকে মারতে এলো। ভয় পেয়ে দ্রুত পালিয়ে চলে এলাম। তাই আমাদের এত ঘণ ঘণ শ্বাস।” পূর্বেই আমরা ক্ষুধার্থ ছিলাম। তবুও স্থানের নাম বলিনি”। তুমি পাঠালে কিন্তু তারা আমাদেরকে অন্ন দিল না। এখন কি হবে কৃষ্ণ”। শুনে কৃষ্ণ পুনরায় বলে,” শুন শ্রীদাম, তোমরা আবার মধুবনে যাও। অন্ন মাগিলে এবার অবশ্যই তোমরা অন্ন পাবে”। কৃষ্ণবাক্য শুনে শিশুগণ বলে,” অধমদের কাছে আর ভিক্ষা চেতে যাব না। ভিক্ষা না পেলেও সাধুর কাছে ভিক্ষা চাব। শোন ভাই, আমরা আর কেহ খাব না। তথায় আর যেতে পারব না। ধর্মে ধর্মে প্রান বেঁচেছে। আর সেখানে যাব না। দেখলাম মুনিগণ মহাক্রোধী হয়। এবার গেলে নিশ্চয় প্রাণ যাবে”। শুনে কৃষ্ণ বলে,” তোমরা মুনিদের কাছে কেন অন্ন মাগতে গেলে। পাকশালে যাও তথায় মুনি পত্নীগণ আছেন।চাহিলে অবশ্যই অন্নাদি ব্যঞ্জন পাবে”। শুনি শিশুগণ বলে,” আমার যেতে পারব না। না হয় অন্যত্র অন্ন-ব্যঞ্জন মাগ”। পূর্বে শ্রীদামাদি চারজন গিয়েছিল। দুইজন শিশু গেল না। কিন্তু শ্রীদামাদি তো কৃষ্ণের বাক্য ফেলতে পারে না। সুবলকে সাথে নিয়ে মধুবনে উপনীত হল। যেখানে রন্ধন করে মুনিপত্নীগণ সেখানে গেল দুইজন। বর্হিদ্বারে দুইজন দাড়িয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল পুরীতে কেমন করে প্রবেশ করা যায়। ইহা ভেবে দুজনে দ্বারে দাড়িয়ে আছে।
কৃষ্ণের সমান শ্রীদামের রুপ-শোভা।
পীতাম্বর সম অঙ্গে পীতাম্বর আভা।।
তেমনি নয়ন হয় তেমতি বয়ান।
হস্ত পদ আদি করি সকলি সমান।।
শ্রীকৃষ্ণ সমান হয় শ্রীদামের বর্ণ।
কেবল নাহিক হৃদে ভৃগুপদ-চিহ্ন।।
আর ধ্বজবজ্রাঙ্কুশ নাহিক চরণে।
এই ভেদ শ্রীদাম শ্রীগোবিন্দের সনে।।
সুবল সুবর্ণ হয় সুবর্ণ হইতে।
অতীব সুন্দর নীল অম্বর কটিতে।।
দু’জনার গোপবেশ বেণুবেত্র করে।
অপূর্ব্ব হয়েছে শোভা দুই কলেবরে।।
হেরিয়া সে রুপ-শোভা এই অনুমানি।
কাদম্বিনী-কোলে যেন স্থিরা সৌদামিনী।।
তখন মুনিপত্নীগণ রন্ধনশালায় রন্ধন কাজে ব্যস্ত। কোন জন ব্যঞ্জন রন্ধন করছেন। কেহ বা অন্যজনকে সাহায্য করছে। কেহ বা অন্যজনকে বলছে উত্তপ্ত তৈলে সম্বরা দিবার জন্য। তখন সে রমনী চলিল সত্বর সম্বরা আনতে। রন্ধনশালা হতে প্রধান মন্দিরে যাওয়ার সময় মুনিপত্নী নজর পড়ে দ্বারপানে। ভূবনমোহন রুপ দেখিল সে নয়নে। তাদের দুজনের সেরুপ দেখে তার চোখের পলক পড়ে না। স্থির দাড়িয়ে রইল। যে দ্রব্য আনার জন্য বলা হয়েছিল দুজনকে দেখে সে রমনী তা ভুলে গেল। সে দিকে রাঁধুনীর পাত্রের তেল যায় পুড়ে। তাড়াতাড়ি সম্বর আনার জন্য চিৎকার চেচামেচি করতে লাগল। সাড়া পেয়ে সে নারী সকলকে ডেকে বলছে “ ওরে তোরা দেখে যা দ্বারে কারা দাঁড়িয়ে আছে। হেন অপরুপ রুপ আগে কখন দেখিনি। যেতে না পারি আমি ভুলে গেছে আঁখি”।এ কথা রাঁধুনীকে ডেকে বলল। রাঁধুনী রন্ধন না করে তাড়াতাড়ি বাহিরে এসে দেখে দ্বারে দাড়ায়ে আছে দুজন। তাদের রুপ দেখে ভুলে গেল মন। রাম-কৃষ্ণ-রূপ-কথা পূর্বে তারা শুনেছে। শ্রীদাম-সুবলকে দেখে মনে ভাবছে হয়তো তারা হবে। রাম-কৃষ্ণ দেখেনি মুনিপত্নীগণ। গোপিকাগণ মাঝে মাঝে দুধি দুগ্ধ বেচিবার তরে মধুবনে যেত। কদাচিৎ মূল্য দিতে দেরী হলে তারা নন্দের কুমারকে না দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত। তা শুনে মুনিপত্নীগণ বলত,” বলত নন্দের পুত্র তোমাদের কে হয়? তখন গোপিনীগণ বলত,” নন্দগোপ হয় গোকূলের অধিকারী। তার দুপুত্র রাম-কৃষ্ণ। রূপে-গুণে অপরূপ। ভূবনমোহন রূপ দুজনার। আমরা কোথায়ও এমন রূপ দেখেনি।দাও তাড়াতাড়ি মূল্য দাও। অনেকক্ষণ হয় নন্দকুমারদ্বয়কে দেখতে পারছিনা। মূল্য নিয়ে গোপিনীগণ চলে গেল। এভাবে মুনিপত্নীগণ রাম-কৃষ্ণের কথা শুনেছিল। শ্রীদাম-সুবল ভুবনমোহন রূপ। গোপিকাগণের কথামত মুনিপত্নীগণ এ কথা বিশ্বাস করল যে এরা বুঝি রাম-কৃষ্ণ দু’ভা। তা নাহলে এমন রূপ কোন জনের আছে। মুনিপত্নীগণ শ্রীদাম-সুবলকে বলছে,” এসো এসো দ্বারে কেন দাড়িয়ে আছ? শ্রীদাম-সুবল মুনিপত্নীগনের সাথে রন্ধনশালে গিয়ে তাদের প্রণাম করল। শ্রীদাম-সুবলকে আর্শিবাদ করে দ্বিজনারীগণ বলল,” কহ বাছাধন তোমরা কারা? তোমাদের এরূপ দেখে আমাদের নয়ন জুড়িয়ে গেছে। সত্য করে তোমাদের পরিচয় দাও।” শ্রীদাম কহে,” শোন মা,আমরা ব্রজের রাখাল। গোপের নন্দন। শ্রীদামের কথা শুনে, অন্য এক নারী কহে,” তোমাদের বাস যদি ব্রজপুরী হয় তবে তো সেখানে রাম-কৃষ্ণ দুজনার বাস। তাদের রূপের কথা আমার শুনেছি। তাদের মত এমন রূপ নাকি জগতে নাহি। তোমাদের রূপও অপরূপ তবেকি তোমরাই রাম-কৃষ্ণ হবে। শুনে শ্রীদাম কহে,” শুন গো মা আমরা দুজন রাম-কৃষ্ণ-দাস। আমার দুজন শ্রীদাম-সুবল। মুনিপত্নীগণমনে মনে ভাবে রাম-কৃষ্ণ-দাস যদি এরা হয় আর এদের রূপেই আমাদের আঁখি ভুলে গেল। আর রাম-কৃষ্ণ-রূপ দর্শন করলে না জানি আমাদের অবস্থা কেমন হবে। এ সকল কথা বিবেচনা করে মুনিপত্নীগণ পুনঃ কহিল,” কোন  ছলচাতুরী না করে কহ বাছাধন, কিসের জন্য এখানে এসেছিলে আর দ্বারেই বা কেন দাড়ায়ে ছিলে। শ্রীদাম কহিল,” মাগো অদূরেই সখাসহ রাম-কৃষ্ণ ধেনু চড়াতে এসেছে। ক্ষুধার্থ হয় দুজন। তোমাদের যজ্ঞ শুনি আমাদের পাঠাল অন্ন লয়ে যেতে। পূর্বে আমরা এসেছিলাম যজ্ঞের স্থলে। কিন্তু মুনিগণ আমাদেরকে অন্ন না দিয়ে প্রহার করতে উদ্যত হল।  আমরা পালিয়ে  জীবন রক্ষা করেছি এবং রাম-কৃষ্ণ-সম্মুখে তা বর্ননা করেছি। সমস্ত শুনে কৃষ্ণ পুনরায় বলল,” যেখানে মুনিপত্নীগণ আছে সেখানে তোমরা যাও এবং আমার নাম করে অন্ন মেগে আন। তাই রন্ধনশালায় প্রবেশ না করে প্রবেশ দ্বারে দাড়িয়ে আছি, যদি মন চায় আমাদিগকে অন্ন দাও।  তখন মুনিপত্নীগণ বলল,” হে শ্রীদাম! রাম-কৃষ্ণ কি আমাদের অন্ন গ্রহণ করিবে? এমন ভাগ্য কি আমাদের হবে? যদি রাম-কৃষ্ণ কৃপা করে আমাদের অন্ন গ্রহণে করেন তবে আমরাই সকলে মিলে অন্ন নিয়ে যাই।” শ্রীদাম বলে,” মাগো ক্ষুধায় আকুল রাম-কৃষ্ণ দুজনে। তোমাদের অন্ন নেয়ার জন্য হরি আমাদের পাঠালেন। আমার কি তোমাদের সাথে ছল করতে পারি। মুনিপত্নীগণ বল্লে,” যাও বাছাধন! রাম-কৃষ্ণকে সংবাদ দাও আমার অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে আসছি। আমরা সকলে তোমাদের পশ্চাতে আসছি। শ্রীদাম বিদায় নিল। স্বর্ণথালাতে অন্ন-ব্যঞ্জন সুন্দর করে সাজাল। রন্ধনশালা শূন্য পড়ে রইল। রাম-কৃষ্ণে অন্ন দিতে ধেয়ে চলল। এর মধ্যে একজন প্রাচীনা( প্রৌঢ়োত্তর বৃদ্ধ)  নব্যাগণকে ( অল্পবয়স্ক যুবা) জিজ্ঞাসা করল,”  তোমরা অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? শুনে একজন কহে প্রাচীনাকে,” রাম-কৃষ্ণ দুভাই গোঠে (মাঠে) গরু চড়াতে এসেছে। ক্ষুধায় কাতর হয়ে অন্ন মাগছে। তাই অন্ন লয়ে যাচ্ছি দুভাইকে অন্ন খাওয়াব আর দু নয়নে তাদের রূপ উপভোগ করব।”  শুনে প্রাচীনা বলে,” কোথাকার রাম-কৃষ্ণ , কাহার নন্দন। গোঠে গিয়ে যদি তাদের অন্ন খাওয়াবে তবে কুলে কলঙ্ক হবে। তোমরা অন্ন নিয়ে যেওনা।” কেহ প্রাচীনার কথা শুনল না। অন্ন-ব্যঞ্জন লয়ে মুনপত্নীগণ দ্রুতগতিতে রাম-কৃষ্ণ দর্শনে চলল। নদী যেমন  সমুদ্রে ধাবিত হয়। ঠিক তেমনী বিপ্রপত্নীগণ তথায় যায়। প্রাচীনা নারী ক্রুদ্ধমতি হয়ে যজ্ঞস্থলে গিয়ে বলে,” তোমরা যজ্ঞ কর উল্লাসে।  এদিকে ঘরের হল সর্বনাশ। না জানি কোথাকার কোন রাম-কৃষ্ণকে অন্ন-ব্যঞ্জন দিতে গেল সবে।”  শুনে সব মুনিগণ চিন্তিত হল এবং তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য একজন দ্বিজকে বলা হলে তিনি পথ রোধ করে সকল মুনিপত্নীগণকে বলল,” তোমরা কোথায় যাবে? মুনিপত্নীগণ বলে,” রাম-কৃষ্ণ-দরশনে  যাব।” ‍তখন দ্বিজ বলে,” তোমাদের যাওয়া হবে না।” কিন্তু দ্বিজ তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে পারলনা। তখন দ্বিজ নিজ পত্নীকে উদ্দেশ্য করে বলল,” কৃষ্ণ দরশনে যেতে হবে না। বাড়ী চল।” ব্রাহ্মণী বলে,” রাম-কৃষ্ণ দরশনে যাব। বারন করিও না। কৃষ্ণ দরশন বিনে প্রাণ রবে না।” দ্বিজ ব্রাহ্মণীকে  টানাটানি করে গৃহে নিয়ে দ্বার বন্ধ করে রাখে এবং যজ্ঞস্থলে গিয়ে বলে,” সকলেই কৃষ্ণ-দরশনে গমন করল। শুধু আমার পত্নীকে টানাটানি করে ফিরিয়ে এনেছি।” সব বৃত্তান্ত শুনে মুনিগণ নীরব রইল  এবং পত্নীগণ ফিরলে কোন একটা উপায় করা যাবে বলে যজ্ঞে হবি( হোমের ঘৃত) দেয়। যে রমনীকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল সে রমণী রাম-কৃষ্ণ চিন্তায় দেহ রাখল। অন্য রমণীদের যেতে বিলম্ব হল। কৃষ্ণ চিন্তায় মগ্ন হয়ে বৈকন্ঠ ধাম প্রাপ্ত হল। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ। অন্যদিকে মুনিপত্নীগণ মনে মনে ভাবে অন্ন-ব্যঞ্জন রাম-কৃষ্ণকে দিব। তাদের দুজনকে একত্রে দেখতে পাব। ভব ভয় অনায়াসে দূর হবে। আমাদের এত কি আরাধনা আছে ভাগ্যে এমন হবে। পরমেশ্বর ভগবান অন্তর্য্যামী। তিনি সব জানেন। রাম-কৃষ্ণ তরুতলে গোপবেশে বেণুশৃঙ্গ করে দাড়ায়ে আছে। সে রূপ যে দেখে তাকে আর জন্ম নিতে হয় ন। ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় রাম-কৃষ্ণ দাঁড়ায়ে আছে। মুনিপত্নীগণ অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে যাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে রাম-কৃষ্ণ দুজনকে একসাথে দেখব। তাদের মনের বাসনা পুরণ হবে। শ্যামবর্ণ, পীতবাস, বনমালা গলে দাড়ায়ে দুভাই। শিখীপুচ্ছ ধাতুমায় শোভিছে প্রবালে/অশোক পাদপ নবপল্লবে শোভিত। যমুনার তীরে উপনীত হয়ে কৃষ্ণ দরশনে তাদের দুঃখ দূর হল। অপলক চোখে কৃষ্ণের রূপ দেখতে লাগল। অন্ন-ব্যঞ্জন পাত্র নামিয়ে রাম-কৃষ্ণ পদে প্রণাম করে বলতে লাগল,” শোন হে শ্রীহরি! জানিনা তোমার লীলা। মোরা হই নারী। বেদশাস্ত্রে আমাদের অধিকার নেই। কেমন জানিব মোরা তোমার মহিমা। নিজ গুনে আমাদেরকে ক্ষমা কর প্রভু।” মুনিপত্নীগনের বচন শুনে কৃষ্ণ তুষ্ট হলেন এবং তিনি বললেন,” ক্ষুধায় পেট জ্বলে। আগে আমাদিগকে খেতে দাও। তোমাদের স্তবে আমি তুষ্ট হয়েছি। তোমারা আমাকে পাবে এবং তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে।” এ কথা বলে মুনিপত্নীগণকে সান্তনা দিল। পরে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদামাদি সকলকে ডেকে পলাশ গাছের পাতা আনার জন্য। সকলে আজ তারা বনে অন্ন-ব্যঞ্জন ভোজন করবে। শ্রীদাম পলাশের দল আনল। রাম-কৃষ্ণসহ সকল রাখাল বালক বেড়িতে বসল। তখন কৃষ্ণ বললেন,” দাও আমাদেরকে আছে যত তোমাদের অন্ন-ব্যঞ্জন।” শ্রীদাম মুনিপত্নীগণকে ডেকে বলে,” আগে অন্ন-ব্যাঞ্জন দাও রাম-কৃষ্ণকে। তারপর আমাদের সকলকে দাও।” তারপর মুনিপত্নীগণ রাম-কৃষ্ণকে আগে অন্ন-ব্যঞ্জন দিল। তারপর সকল রাখাল বালককে অন্ন-ব্যঞ্জন দিল। মুনিপত্নীগণ নিকটেই দাড়িয়ে রইল। মনের হরষে রাম-কৃষ্ণ অন্ন-ব্যঞ্জন খান। চারিদিকে শিশুগণ ভোজন করেন আর রাম-কৃষ্ণকে দর্শন করেন। যে দ্রব্য খেতে মিষ্টি সে দ্রব্য না খেতে পেরে উঠে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মুখে তুলে দেয়। কৃষ্ণ তা আহার করেন মনের সুখে। সকলেই ভোজন করল। যমুনার জলে গিয়ে আচমন করল। ভোজনের পর মুনিপত্নীগণ কৃষ্ণের প্রসাদ ভোজন করল। আচমন না করে শিরে হাত দিল। তুষ্ট হয়ে সকলকে বলে জগন্নাথ,” আজ তোমরা সকলেই নিজ নিজ বাসে(বাড়ীতে) চলে যাও। মহারাসে এসো, তোমাদের মনসকাম পূর্ণ হবে।” শুনে মুনিপত্নীগণ বলে,” আমরা আর গৃহেতে ফিরে যাব না। তোমার চরণে আমাদের প্রাণ মন সপলাম। আমাদের গৃহের আর দরকার নেই। তোমার চরণে সর্বদা রব। নিরবধি তোমার চরণ দর্শন করব। তুমি যদি অনুগ্রহ করে কৃপা করলে তবে আর আমাদের প্রতি কেন নিগ্রহ করবে কৃপানিধি। আমরা কি করে গৃহে ফিরে যাব? আমারা যখন অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে আসি তখন ঋষিগণ আমাদিগকে নিষেধ করেছিল। তাদের কথা না শুনে এখানে এসেছি। আমাদিগকে দ্বিজগণ আর গৃহে নিবে না। আর গৃহেরই বা কিসের প্রয়োজন। তোমার এখান থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে যাব আর মুনিগণ আমাদিগকে লাঞ্ছিত করবে। গৃহে গেলে মুনীগণ যদি আমাদিগকে তাড়িয়ে দেয় তবে লজ্জায় আমার সকলে জীবন ত্যজিব। বলুন প্রভু তবে গৃহে ফিরে আমরা কি করব? আপনার পদতলে আমাদের মন প্রাণ সঁপেছি। জীবনে এমন পাদপদ্ম দেখব কখনও ভরসা করিনি। মরণে এমন চরণ পাব তাই মনের এত আশা।” তাহা শুনে কৃষ্ণ কহে,” আমার কথা শুনে তোমরা গৃহে ফিরে যাও। কেন তোমরা আমাকে মিনতি করছ। তোমাদিগকে আমি পূর্বেই কৃপা করেছি। কৃপা আর করব তোমরা সকলে মহারাসে এসো। এখন তোমরা সকলে নিজ বাসে চলে যাও। আমার নিকটে থাকলে সাধন হবে না। যে ভক্ত গৃহে বসে আমাকে কামনা করে সে আমাকে পায়। কাছে যেমন শ্রবন, দর্শন, ধ্যান ও ভাবানুকীর্ত্তন হয় না হয় দূরে। যে ভক্ত হৃদয়ে আমাকে ভাবে দেখতে পায় তার থেকে না হয় ভক্ত যে থাকে সাক্ষাতে। তোমরা মনে করছ তাদের কাছে না বলে এসেছ তাই গৃহে ফিরে গেলে তারা তোমাদের মন্দ বলবে। আমার বরে বিপ্রগণ তোমাদের কিছু্ই বলবে না। গৃহে গেলে তোমাদেরকে সমাদর করবে। শ্রীঘ্রই তোমরা গৃহে ফিরে যাও।” কৃষ্ণ পদে প্রণাম করে অশ্রুসজল চোখে বিদায় নিল সকলে। গৃহে উপনীত হলো। দ্বিজ কাউকে কিছুই বলে না। যজ্ঞেতে পূর্ণাহুতি দিয়ে সকল মুনিগণ ভোজন করল। ভোজন শেষে আচমন করে নিজ নিজ পত্নীকে সুধায় দ্বিজগণ,” অন্ন নিয়ে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?” শুনে নারীগণ দুই হাত জোর করে কহে,” নিবেদন করি সকলে প্রতি। রাম-কৃষ্ণ ধেনু চড়াতে এসেছেন। চঞ্ছল ধেনুর সাথে ভ্রমন করতে করতে ক্ষুধায় কাতর হন দুজন। অন্ন মাগার জন্য শ্রীদাম-সুবল এসেছিল। শুনে আমাদের মন হরষিত হল। তাই অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে তথায় তাড়াতাড়ি গেলাম। পথে আমাদের বারণ করলে আমরা সে বারণ শুনিনি। গিয়ে দেখি নীপমূলে দুভাই দাড়িয়ে আছে একত্রে। দুজনের রূপ দেখে আমাদের প্রাণ জুড়াল। অন্ন-ব্যঞ্জন চরণে রেখে প্রণিপাত করি। আমাদের কৃপা করে অন্ন খেলেন দীননাথ। তারপর তাঁর প্রসাদ আমরা সকলে ভোজন করলাম। প্রণাম করে গৃহে ফিরে আসলাম। যার জন্য তোমারা সকলেই যজ্ঞ করছ  সে ‍যজ্ঞের যজ্ঞেশ্বর স্বং কৃষ্ণ ভেবে দেখ মনে।” তখন ধ্যানস্থ হয়ে যজ্ঞকারীগণ দেখেন যে গোলোকবিহারী কৃষ্ণ পূর্ণ সনাতন। আপনাকে ধিক্কার দিয়ে মুনিগণ কহে,” শুন শুন তোমরা ,আমাদের কাছে তারা এসেছিল। প্রহার করতেই তারা পালিয়ে গেল। যাঁর উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞ করি। আপন ইচ্ছায় অন্ন মাগেন শ্রীহরি। অহংকার করি তাদের অন্ন দেয়নি। কেমনে পাব সবে ভাবার্ণবে( সংসারসমুদ্র) পার। অতি খরতর সে ভববারি। এ হরিপদ-তরীই একমাত্র ভববন্ধন থেকে মুক্তি দিতে পারে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণ হচ্ছেন তরণী আর সে তরণীর কান্ডারী হচ্ছেন স্বং ভগবান। ‍ভক্ত যে ভবপার হয় তাকে ভক্তি করে। যজ্ঞ করে যজ্ঞেশ্বর চিনতে না পারলাম কেহ। তবে আমাদেরকে কে আর পার করবে। এতকাল বেদপাঠ তপস্যা করেছি। করেছি বেদপাঠ তপস্যা তবে চিনতে আমরা পারিনি কৃষ্ণকে। বেদপাঠ, তপস্যা আর যাগ-যজ্ঞ করে কি হবে। চিনতে পারিনি কৃষ্ণকে কিন্তু চিনিল নারীগণ। ধন্য তোমাদের ভাগ্য ।ধন্য তোমাদের জীবন। ধন্য হে তোমরা সকলী ব্রাহ্মণী। নিজ হাতে তোমরা খাওয়ালে প্রভু চিন্তামণিকে। মন্ত্র বিনা আমার যে কৃষ্ণকে খাওয়াতে পারি না। আর তোমরা কি-না নিজেদের হাতে খাওয়ালে কৃষ্ণকে। তোমাদের সকলের জীবন সার্থক হয়েছে। তোমরা অনায়াসে সকলে এ ভব-সমুদ্র পার হতে পারবে। অবজ্ঞা করি আমাদের যাগ-যজ্ঞকে(ধিক্কার দেয়া)। পেয়েও হেলায় হারালাম শ্রীহরিকে। আমাদের শরীর একবার স্পর্শ কর। তোমাদেরকে স্পর্শ করে আমরা উদ্ধার হব।” তারপর নারীগণকে স্পর্শ করল। পুনরায় শ্রীহরি উদ্দেশ্যে যাগ আরম্ভ করল। তখন পরীক্ষিৎ শুকদেবকে প্রশ্ন করেন,” নারীগণের মুখ থেকে মুনিগণ সমস্ত কিছু শুনিল। কিন্ত কৃষ্ণের পাশেতে কেন তারা গেলন না? গৃহে বসে কেন যাগ-যজ্ঞ আরম্ভ করল? শুকদেব বলেন সে কথা- যখন দেবকীর গর্ভে কীর্ত্তিমন্ত পুত্র হল। তখন বসুদেব তার ‍পুত্রকে কংসের কাছে সর্পিল। কুমারকে হত্যা না করে তাকে ফিরিয়ে দিল। কিন্তু দেবঋষির মন্ত্রণায় কংসরাজ কীর্ত্তিমন্তকে হত্যা করল। নারদের মন্ত্রণায় এভাবে একে একে ছয়টি পুত্রকে কংস হত্যা করল। পাপমতি কংসাসুর দ্বিজগণকে দুঃখ দিতে মন্ত্রণা করল যত অমাত্য সংগে। মন্ত্রীদের মন্ত্রণা মতে দ্বিজগণকে দূগর্তি দিতে আরম্ভ করল। কংসের ভয়ে সকল দ্বিজগণ বনে আশ্রয় নিল। নির্জনে থেকে সবে অতি সংগোপনে। কংস ভয়ে কেহ বাহিরে আসে না। তাই গৃহে বসে দ্বিজগণ গদাধরের স্তব করে। সে জন্যে দ্বিজগণ বনে যেতে সাহস পাননি।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র