শ্রীমদ্ভগবতগীতার সপ্তম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

অর্জুন জিজ্ঞাসা কররেন- হে পুরুষোত্তম! ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি? অধিভূত ও অধিদৈবই বা কাকে বলে? অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্পষ্ট করে বল। হে মধুসূদন! এই দেহে অধিযজ্ঞ কে এবং এই দেহের মধ্যে তিনি কিরুপে অবস্থিত? মৃত্যুকালে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কিভাবে তোমাকে জানাতে পারেন?
পরমেশ্বর ভগবান বললেন- যিনি পরম অক্ষর (জগতের মূল কারণ) তিনিই ব্রহ্ম, সেই ব্রহ্মের অংশস্বরূপ যে জীব এ দেহ অধিকার করে থাকে তাকে বলা হয় অধ্যাত্ম; যার দ্বারা প্রাণিগণের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি হয় এবং যা দেবোদ্দেশে বিহিত হয়ে থাকে, সেই দ্রব্য ত্যাগরূপ যজ্ঞাদির নাম কর্ম। হে দেহধারীশ্রেষ্ঠ! নশ্বর জড়া প্রকৃতি অধিভূত। যিনি সবভূতের ইন্দ্রিয় প্রবর্তক, সর্ব দেবতার অধীশ্বর এবং হিরণ্যগর্ভ নামে বিখ্যাত তিনিই অধিদৈব আর আর দেহীদের দেহান্তর্গত অন্তর্যামী রুপে আমিই অধিযজ্ঞ। মুত্যুর সময়ে যিনি আমাকে স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করেন, তিনি আমার ভাব প্রাপ্ত হন অর্থাৎ ব্রহ্মভূত হন করেন। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
হে কৌন্তেয় আর জানিও যে, অন্তিকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি সদা সেই ভাবে অনুরুক্ত থাকায় সেই সেই ভাবই প্রাপ্ত হন। অতএব হে অর্জুন! সর্বদা আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বীয় ক্ষাত্র ধর্ম পালনহেতু যুদ্ধ কর, আমাতে তোমার মন ও বুদ্ধি অর্পণ করলে নি:সন্দেহে তুমি আমাকেই লাভ করবে। হে পার্থ ! অভ্যাস যোগে যুক্ত হয়ে অনন্যগামী চিত্তে যিনি অনুক্ষণ শাস্ত্র ও আচার্যের উপাদেশানুসারে জ্যেতির্ময় পরম পুরুষের চিন্তা করেন, তিনি অবশ্যই তাঁকেই প্রাপ্ত হন। সর্বজ্ঞ,সনাতন, নিয়ন্তা, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, সকলের বিধাতা, জড় বুদ্ধির অতীত, অচিন্ত্য ও পুরুষরুপে পরমেশ্বর ভগবানের ধ্যান করা উচত। তিনি যূর্যের মতো জ্যোতির্ময় এবং এই জড়া প্রকৃতির অতীত। যিনি মৃত্যুর সময় অচঞ্চল চিত্তে, ভক্তি সহকারে পূর্ণ যোগশক্তির বলে ভ্রুযুগলের মধ্যে প্রাণবায়ুকে স্থাপন করে পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করেন, তিনি অবশ্যই সেই দিব্য পরম পুরুষকে প্রাপ্ত হন। বেদবিৎ পন্ডিতেরা যাঁকে 'অক্ষর' বলে অভিহিত করেন, বিষয়ে আসক্তিশূন্য সন্ন্যাসীরা যাতে প্রবেশ করেন, ব্রহ্মচারীরা যাঁকে লাভ করার ইচ্ছায় ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁর কথা আমি সেংক্ষেপে তোমাকে বলব। সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত করে এবং মনকে হৃদয় কমলে নিরুদ্ধ করে ভ্রুযুগলের মধ্যে নিজের প্রাণ স্থাপনকরত: যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হয়ে একাক্ষর ব্রহ্মনাম ওঁ উচ্চারণ করতে করতে কলেবর পরিত্যাগপূর্বক প্রয়াণ করেন, তিনি পরমগতি (মোক্ষ লাভ) লাভ করে থাকেন। হে পার্থ! যিনি একাগ্র মনে কেবল আমাকেই নিরন্তর স্মরণ করেন আমি সেই সদা স্মরণশীল ভক্তিযোগীর নিকট সুলভ হই। পরম সিদ্ধি লাভ করে মহাত্মাগণ আমাকে প্রাপ্ত হন এবং দু:খালয় নশ্বর সংসারে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন না। হে অর্জুন !এ পৃথিবী হতে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সকল লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ তাদের পুন: পুন: উৎপত্তি ও বিনাশ হয় কিন্ত কৌন্তেয় আমাকে লাভ করলে আর পুনর্জন্ম হয় না।
মনুষ্য মানের সহস্র চর্তুযুগে ব্রহ্মার একদিন হয় এবং সহস্র চতুর্যুগে তাঁর এক রাত্রি হয়। এভাবেই যাঁরা জানেন, তাঁরা দিবা-রাত্রির তত্ত্ববেত্তা। ব্রহ্মার দিন সমাগত হলে অব্যক্ত হতে সকল ব্যক্ত চরাচরের উৎপত্তি হয় এবং ব্রহ্মার রাত্রি সমাগমে সেই অব্যক্তেই চরাচর পুনরায় বিলীন হয়ে যায়। হে পার্থ! সেই ভূতসমূহ (প্রাণিসমূহ) পুন; পুন: উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মার রাত্রির সমাগমে লয় হয় এবং পুনরায় দিনের আগমনে স্বীয় কর্মের অধীন হয়ে পুনরায় জন্ম গ্রহণ করে। কিন্তু আর একটি অব্যক্ত প্রকৃতি রয়েছে যা অব্যক্তের অতীত, ইন্দ্রিয়গণের অগোচর ও নিত্য। সমস্ত ভূত বিনষ্ট হলেও তা বিনষ্ট হয় না। সেই অক্ষর অব্যক্ত সত্তাস্বরূপকে শ্রুতি স্মৃতি (বেদ) জীবের পরম গতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেই সত্তারূপ ভাব প্রাপ্ত হলে জীবের আর পুনর্জন্ম হয় না; ইহাই আমার পরম ধাম।
হে পার্থ ! সেই পরমেশ্বর ভগবানকে অনন্যা ভক্তির দ্বারাই কেবল লাভ করা যায়। সমস্ত ভূতই তার অভ্যন্তরে অবস্থান করছে এবং তিনি এ বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। যোগীগণ যে কালে প্রয়াণ করলে অর্থাৎ দেহত্যাগ করলে আর ফিরে আসেন না অর্থাৎ পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না এবং যে কালে প্রয়াণ করলে আবার ফিরে আসতে হয় অর্থাৎ পুনর্জন্ম লাভ করেন, সেই কালের কথা তোমাকে বলব।অগ্নি, জ্যোতি, শুভদিন, শুক্লপক্ষ সম্পন্ন ছয় মাস ব্যাপী উত্তরায়ণ কালে দেহত্যাগ করলে মনুষ্যগণ ব্রহ্ম লাভ করেন। ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ ছয় মাস ব্যাপী দক্ষিণায়ন কালে দেহত্যাগ করলে যোগী চন্দ্রলোক লাভ করে সুখভোগ করার পর পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন করেন।
অক্ষর ব্রহ্মযোগ নামক শ্রীমদ্ভগবতগীতার অষ্টম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত সংক্রান্ত বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র