০৬. ভীষ্মার্জ্জুনের প্রথম দিন যুদ্ধজন্মেজয় জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।শুনি কি কহিল তবে অম্বিকা-তনয়।।মুনি বলে জন্মেজয় শুন সাবধানে।এতেক শুনিয়া অন্ধহৃষ্ট হৈল মনে।।সঞ্জয়েরে জিজ্ঞাসিলা করিয়া মিনতি।কি প্রসঙ্গ হৈল তবে কহ মহামতি।।মহাবীর গঙ্গাপুত্র সমরে দুর্জ্জয়।সংগ্রামেতে পরাজিল পাণ্ডুর-তনয়।।গৃহে আসি কি যুক্তি করিল যুধিষ্ঠির।কিবা যুক্তি কৈল তবে দুর্য্যোধন বীর।।কহত সঞ্জয় তুমি হও বিচক্ষণ।অতঃপর কি করিল ইন্দ্রের নন্দন।।কি কর্ম্ম করিল মোর পুত্র দুর্য্যোধনে।কিরূপে হইল যুদ্ধ অর্জ্জুনের সনে।।মহাবলবান বীর বীর্য্যবন্ত সবে।কোন কোন বীরে যুঝে কৌরব পাণ্ডবে।।সঞ্জয় বলেন, রাজা শুন একমনে।কৃষ্ণের বচনে ভয় খণ্ডিল অর্জ্জুনে।।যোগমার্গ কথা শুনি চিত্ত হৈল স্থির।গাণ্ডীব তুলিয়া হাতে নিল মহাবীর।।আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।ইন্দ্রের যুদ্ধেতে যেন পর্ব্বত বিদার।।এককালে হৈল যেন শত বজ্রাঘাত।মহাশব্দে মোহিত হইল কুরুনাথ।।শঙ্খ ও দুন্দুভি আদি বাজে বাদ্যগণ।বাদ্যের শবদে কম্প হৈল ত্রিভুবন।।রথ রথী পদাতি যতেক বীরগণে।যুঝিবারে পার্থ আজ্ঞা দিল সর্ব্বজনে।।পার্থের আদেশ পেয়ে যত বীরগণে।যার সেই লয়ে প্রবেশিল রণে।।তবে ভীষ্ম মহাবীর গঙ্গার নন্দন।হাতেতে তুলিয়া নিল দিব্য শরাসন।।ভৃগুপতি গুরু ইতি চরণ বন্দিয়া।ধনুতে টঙ্কার দিল আকর্ণ পূরিয়া।।প্রলয়ের মেঘ যেন করয়ে গর্জ্জন।শতবজ্র শব্দ জিনি হইল নিঃস্বন।।তবে পার্থ পিতামহে করে নিরীক্ষণ।মহারূপ তেজঃপুঞ্জ গঙ্গার-নন্দন।।রজত কাঞ্চন জিনি অঙ্গের বরণ।এ বৃদ্ধ বয়সে যেন সাক্ষাৎ মদন।।করি-কর জিনি ভুজ রাতুল অধর।পূর্ণ বিধুবর জিনি বদন সুন্দর।।বিচিত্র ধনুক হাতে যেন শত্রুধনু।শিরীষ কুসুম জিনি সুকুমার তনু।।দেখিয়া মোহিত পার্থ ভাবয়ে অন্তরে।কিমতে মারিব অস্ত্র হেন কলেবরে।।সঞ্জয় বলেন, রাজা কর অবধান।দোঁহা দেখি দোঁহাকার বিদরয়ে প্রাণ।।আছুক যুঝিতে কার্য্য দেখিয়া মোহিত।দেখিয়া হইল ক্লিষ্ট উভয়ের চিত।।দোঁহাকার মায়া হরি নিল নারায়ণে।নির্ম্মোহ হইয়া দোঁহে প্রবর্ত্তিল রণে।।তবে পার্থ ডাকি বলে গঙ্গার নন্দনে।কুরুবংশে শ্রেষ্ঠ তুমি জানে সর্ব্বজনে।।আগে তুমি অস্ত্র মোরে করহ প্রহার।পশ্চাতে করিব আমি অস্ত্র-অবতার।।তবে ভীষ্ম কহিলেন অনেক প্রকারে।আগে পার্থ অস্ত্র তুমি মারহ আমারে।।না মারিল বাণ পার্থ করি অনুভব।কৃষ্ণের মায়ায় ভীষ্ম পাসরিল সব।।আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।দশ বাণ পার্থ পরে করিল প্রহার।।দশ গোটা কাল ফণী জিনি দশ শর।মহাশব্দ করি আইসে পার্থের উপর।।দিব্য অস্ত্র দিয়া কাটে ইন্দ্রের নন্দন।তবে ভীষ্ম মহাবীর এড়ে দিব্যবাণ।।ভীষ্মার্জ্জুনে সংগ্রাম বাজিল দোঁহে যবে।কুরু পাণ্ডুগণ যুদ্ধে প্রবর্ত্তিল তবে।।রথী রথী মহাযুদ্ধ পদাতি পদাতি।আশোয়ারে আশোয়ারে মত্ত মত্ত হাতী।।মল্লে মল্লে মহাযুদ্ধ ধানুকী ধানুকী।খড়্গী খড়্গী মহারণ তবকি তবকি।।অন্য অন্য দুই দলে বাজিল সংগ্রাম।পূর্ব্বে যেন যুদ্ধ হৈল রাবণ শ্রীরাম।।নানাবিধ অস্ত্রবৃষ্টি করে দুই দলে।প্রলয়ের কালে যেন সমুদ্র উথলে।।মুষল মুদগর শেল ভূষণ্ডী তোমর।ক্ষুদ্রপট্ট নারাচ প্রভৃতি মহাশর।।শিলীমুখ সূচীমুখ পরিঘ ভৈরব।ভূষণ্ডী তোমর আদি ফেলিলেক সব।।ব্রহ্মঅস্ত্র রুদ্রঅস্ত্র যেবা যত জানে।নিরন্তর দুইদলে করে বরিষণে।।দুর্য্যোধন সহ যুদ্ধ করে বীর ভীম।দুই জনে গদাযুদ্ধ হইল অসীম।।কৃতবর্ম্মা সহ যুঝে সাত্যকি দুর্জ্জয়।দোঁহে মহাবীর্য্যবন্ত সংগ্রামে নির্ভয়।।কৃতবর্ম্মা এক বাণ সন্ধান পূরিল।গুণ সহ সাত্যকির ধনুক কাটিল।।ধনু কাটা গেল বীর ক্রোধ হৈল মনে।দিব্য অস্ত্র এড়ে বীর পূরিয়া সন্ধানে।।মহাতেজে এড়ে শক্তি বীরের উপরে।সেই ঘায়ে মোহ গেল কৃতবর্ম্মা বীরে।।রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ ফিরায় সারথি।সিংহনাদ করিল সাত্যকি মহামতি।।মূর্চ্ছা ভাঙ্গি পুনরপি উঠে মহাশূর।শিবেরে জিনিতে যেন সাজিল ত্রিপুর।।সারথিরে বহু বীর করিল তর্জ্জন।পুনরপি সাত্যকির সনে কৈল রণ।।বৃহন্নল বীর যুঝে অভিমন্যু সনে।দোঁহে মহাবীর্য্যবন্ত সংগ্রামে নিপুণে।।আর আর বীর করে অস্ত্র অবতার।প্রলয়ের কালে যেন পৃথিবী-সংহার।।মহাবীর অভিমন্যু সুভদ্রা-নন্দন।বৃহন্নল বীরের কাটিল ধনুর্গুণ।।আর ধনু বৃহন্নল নিল ততক্ষণে।সেই ধনু অভিমন্যু কাটে দুই বাণে।।যত ধনু লয় বৃহন্নল মহাবল।বাণে কাটি পাড়ে অভিমন্যু ভূমিতল।।পুনঃ পুনঃ বৃহন্নল যত ধনু লয়।পুনঃ পুনঃ কাটি পাড়ে সুভদ্রা-তনয়।।শক্তিশেল হতে বীর ভীষণ দর্শন।অভিমন্যু উপরে এড়িল ততক্ষণ।।ঘোর শব্দে শক্তিগোটা আইল আকাশে।প্রভাত কালেতে যেন অরুণ প্রকাশে।।লাফ দিয়া এড়াইল সুভদ্রা-নন্দন।তেজোহীন শক্তি তথা পাড়ে ততক্ষণ।।তবে বৃহন্নল বীর শক্তি নিলা হাথে।মহাতেজে ফেলি মারে অভিমন্যু মাথে।।সেই ঘাতে মোহ গেল সুভদ্রা-নন্দন।মোহ ভাঙ্গি উঠে যেন মধ্যাহ্ন তপন।।আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।প্রলয়ের কালে যেন সমুদ্র সঞ্চার।।দশ বাণ এড়ে যেন যমের দোসর।বাণাঘাতে বৃহন্নল হইল ফাঁফর।।তবে ছয় বাণ এড়ে সুভদ্রা-নন্দন।বৃহন্নল বীরের কাটিল ধনুর্গুণ।।চারি বাণে চারি অশ্ব কৈল খণ্ড খণ্ড।দুই বাণে কাটি পাড়ে সারথির মুণ্ড।।সিংহনাদ করি বলে সুভদ্রা-নন্দন।আজি তোরে পাঠাইব যমের সদন।।বৃহৎক্ষেত্র তার ভাই সমরে প্রখর।গর্জ্জিয়া উঠিল যেন যমের সোসর।।মহাক্রুদ্ধ হৈয়া বীর হাতে নিল ধনু।লঙ্কা দহিবারে যেন সাজিলেক হনু।।অভিমন্যু বেড়িলেক হাতে লৈয়া শর।ডাক দিয়া বলে তবে সুভদ্রা-কোঙর।।আমার সমরে তোরে যম কোল দিল।এত বলি দিব্য অস্ত্র চাপে বসাইল।।হাসি অভিমন্যু বলে শুন রে বর্ব্বর।মোর হাতে যাবি আজি যমের নগর।।এত বলি দিব্য অস্ত্র এড়ে ততক্ষণ।সারথি তুরঙ্গ তার করিল নিধন।।অর্দ্ধচন্দ্র বাণে তার শিরচ্ছেদ কৈল।রথ হৈতে বৃহৎক্ষেত্র ভূমিতে পড়িল।।ভ্রাতার নিধন দেখি বৃহন্নল বীর।যুঝিবারে আইল রণে হইয়া অস্থির।।অভিমন্যু সহ তবে কর মহারণ।দোঁহে দোঁহা প্রতি কৈল বাণ বরিষণ।।প্রলয়ের কালে যেন ধারা বরিষণ।অন্য অন্য জনে জনে হৈল মহারণ।।মহাবীর দুঃশাসন সমরে প্রচণ্ড।নকুলের ধনু কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।।ধনু কাটা গেল বীর পাইল বড় লাজ।লাঙ্গুলে চাপিলে যেন গর্জ্জে কাল সাপ।।আর ধনু হাতে নিল সমরে প্রখর।দুঃশাসনের ধ্বজচ্ছত্র কাটিল সত্বর।।চারি বাণে চারি অশ্ব করিল নিধন।দুই বাণে সারথিরে কৈল খান খান।।বিরথ হৈল বীর সংগ্রাম ভিতরে।গদা লৈয়া যুদ্ধ করে দুর্য্যোধন বীরে।।এইরূপ গদাযুদ্ধ হৈল দুই জনে।সহদেব যুদ্ধ করে দুঃশাসন সনে।।মহাবীর সহদেব মাদ্রীর নন্দন।শরজালে অন্ধকার করিল গগন।।বাণে বাণে দুঃশাসন করয়ে প্রহার।দুই বীরের শরজালে কৈল অন্ধকার।।ক্রোধে দুঃশাসন বীর পূরিল সন্ধান।সহদেব উপরে মারিল দশ বাণ।।সারথি উপরে মারে দুই অশ্বে চারি।চারি অস্ত্র সহদেব উপরে প্রহারি।।বাণে বাণ সহদেব কৈল খণ্ড খণ্ড।দুই বাণে কাটিলেক সারথির মুণ্ড।।চারি অশ্ব কাটিয়া করিল সিংহনাদ।পাণ্ডবের দলে হৈল জয় জয় বাদ।।তবে দুঃশাসন বীর রণে প্রাণ ধরি।সহদেবের রথ চূর্ণ কৈল গদা মারি।।সারথি তুরঙ্গ রথ চূর্ণ হৈয়া গেল।হাতে গদা করি বীর ভূমেতে পড়িল।।দোঁহে বীর্য্যবন্ত দোঁহে সংগ্রামে নিপুণ।দোঁহাকার গদাযুদ্ধ না যায় লিখন।।মদ্রপতি সঙ্গে যুঝে রাজা যুধিষ্ঠির।দোঁহে মহাবীর্য্যবন্ত দোঁহে মহাবীর।।মহাবীর মদ্ররাজ সংগ্রামে প্রচণ্ড।ধর্ম্মের হাতের ধনু কৈল খণ্ড খণ্ড।।ধনু কাটে গেল লজ্জা পাইল যুধিষ্ঠির।পুনঃ আন ধনু নিল সংগ্রামে সুধীর।।গুণ চড়াইয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।নবমেঘে যেন ঘন জলের সঞ্চার।।ডাক দিয়া তবে ধর্ম্মরাজ ত কহিল।না হই বিমুখ আমি শুনহ মাতুল।।নিজ পরাক্রমে যুদ্ধ কর মোর সনে।এত বলি দিব্য অস্ত্র পূরিল সন্ধানে।।এক শত বাণ মারে শল্যের উপর।বাণাঘাতে শল্য রাজা হইল ফাঁফর।।বাণে বাণ কাটিয়া করিল নিবারণ।অষ্ট বাণ ধর্ম্মেরে মারিল ততক্ষণ।।অষ্ট কলসর্প জিনি অষ্টগোটা শর।মহাশব্দ করি আইসে ধর্ম্মের উপর।।দিব্য অস্ত্র দিয়া কাটে ধর্ম্মের নন্দন।বাণ ব্যর্থ গেল বীর ক্রোধ হৈল মন।।অগ্নিবাণ এড়ে তবে শল্য নরপতি।বরুণ বাণেতে নিবারিল ধর্ম্মমতি।।এড়িল বরুণ বাণ ধর্ম্মের নন্দন।অগ্নিবাণে নিবারিল শল্য ততক্ষণ।।এইরূপে দুই নৃপে হৈল মহারণ।দোঁহাকার যুদ্ধকথা না যায় লিখন।।দোঁহে মহাবীর্য্যবন্ত সংগ্রামে প্রখর।দোঁহাকার ঘোরনাদে বিস্ময় অন্তর।।শিলীমুখ সূচীমুখ বাণ কর্ণিকার।বজ্রমুখ শঙ্কু কঙ্ক নারাচ অপার।।পরিষ তোমর আদি খুরুপ প্রচণ্ড।ভৈরব সৌবীর আদি অস্ত্র যমদণ্ড।।ব্রহ্মঅস্ত্র রুদ্রঅস্ত্র যেবা যত জানে।দোঁহার উপরে দোঁহে করে বরিষণে।।কেহ পরাজয় নহে দোঁহে মহাধীর।এইরূপে যুদ্ধ কৈল রাজা যুধিষ্ঠির।।দ্রোণসহ যুদ্ধ করে ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।দোঁহে মহাবীর্য্যবন্ত দোঁহে মহাধীর।।আচার্য্যের সঙ্গে যুদ্ধ বড়ই দুষ্কর।প্রাণ উপেক্ষিয়া যুঝে দ্রুপদ-কোঙর।।নানা অস্ত্রে দিব্য শিক্ষা দ্রোণ মহামতি।ধৃষ্টদ্যুন্ন ধনু কাটি পাড়ে শীঘ্রগতি।।আর ধনু লয় বীর নিমিষ ভিতরে।গুণ তুলি ধনুকেতে দিলেক সত্বরে।।ডাক দিয়া দ্রোণে তবে বলয়ে বচন।পূর্ব্বাপর সত্য মোর জানহ কারণ।।মহামুনিরাজ মোরে আশীর্ব্বাদ কৈল।এবে তব সেই কাল নিকটে আসিল।।অবশ্য আমার হাতে তোমার নিধন।দৈবর নির্ব্বন্ধ এই না হয় খণ্ডন।।এত শুনি বলয়ে আচার্য্য মহাশয়।না করিস্ গর্ব্ব তুই দ্রুপদ-তনয়।।আমার হস্তেতে তোর নাহিক নিস্তার।সবংশে আমার হাতে হইবি সংহার।।এত বলি আচার্য্য পূরিয়া মারে বাণ।শত শত অস্ত্র মারে পূরিয়া সন্ধান।।মহাবল ধৃষ্টদ্যুন্ন সংগ্রামে প্রচণ্ড।বাণে বাণ কাটিয়া করিল খণ্ড খণ্ড।।আচার্য্যের বাণ কাটি করিল সন্ধান।আকাশে উঠিল বাণ নাহি পরিমাণ।।শরে আবরিল দ্রোণে দ্রুপদ-নন্দন।অন্ধকার হৈল সৈন্য না দেখে তপন।।হাসিয়া লইল অস্ত্র দ্রোণ মহাশয়।বাণে বাণে কাটিয়া সকল কৈল ক্ষয়।।নিমিষেতে সব অস্ত্র কৈল নিবারণ।অন্ধকার দূর হৈল আকাশ অরুণ।।মহাবীর দ্রোণাচার্য্য সিংহের প্রতাপ।এক অস্ত্রে জন্মাইল সহস্রেক সাপ।।মহাঘোর অহিগণ উঠিল আকাশে।নবঘন বনে যেন তড়িৎ প্রকাশে।।মহাবীর ধৃষ্টদ্যুন্ন সংগ্রামে নিপুণ।এড়িল গরুড়-অস্ত্র পন্নগ-নাশন।।শত শত শিখিগণ উঠিল আকাশে।যতেক ভুজঙ্গগণে ধরিয়া গরাসে।।ভুজঙ্গ গিলিয়া গিলিবারে আইসে দ্রোণে।অগ্নিবাণ দ্রোণ তবে এড়ে ততক্ষণে।।পর্ব্বত প্রমাণ অগ্নি উঠিল অম্বরে।পুড়িয়া পক্ষীর পাখা পড়িল সত্বরে।।ঘোরশব্দে কালানল আইসে অম্বরে।বরুণাস্ত্রে নিবারিল দ্রুপদ-কুমারে।।এইরূপ দুইজনে হইল সংগ্রাম।পূর্ব্বে যুদ্ধ হৈল যেন রাবণ-শ্রীরাম।।বালি সুগ্রীবের যেন হইল সমর।বলির সহিত যেন অদিতি-কোঙর।।তবে দ্রোণ মহাবীর সংগ্রামে প্রচণ্ড।ধৃষ্টদ্যুন্ন-ধনু কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।।দুই বাণে কাটিয়া পাড়িল রথধ্বজ।চারি বাণে কাটিল সত্বরে চারি গজ।।তৃণবৎ কাটি রথ কৈল খণ্ড খণ্ড।দুই বাণে কাটে তবে সারথির মুণ্ড।।হাতে গদা করি বীর পড়িল ভূতলে।জয় জয় শব্দ হৈল আচার্য্যের দলে।।গদা হাতে করি ধায় দ্রুপদ-তনয়।চূর্ণবৎ করিল দ্রোণের রথ হয়।।গদার প্রহারে রথ চূর্ণ হয়ে গেল।লাফ দিয়া দ্রোণ বীর ভূতলে পড়িল।।শীঘ্রগতি আর রথ যোগায় সারথি।পুনরপি যুদ্ধ হৈল দুই মহামতি।।অপরেতে বাণবৃষ্টি করে জনে জন।দোঁহাকার বাণ দোঁহে করে নিবারণ।।মহাবীর সোমদত্ত সংগ্রামে সুধীর।অষ্ট বাণে বিন্ধে শঙ্খবীরের শরীর।।দুই বাণে ধনু কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।চারি বাণে সারথিরে বিন্ধিল প্রচণ্ড।।বাণে বাণ শঙ্খবীর কৈল নিবারণ।অষ্ট বাণে সোমদত্তে বিন্ধে ততক্ষণ।।শত শত বাণ দোঁহে বিন্ধে একেবারে।দোঁহার বাণেতে দোঁহে হইল জর্জ্জরে।।শরীর জর্জ্জর হৈল রক্ত পড়ে ধারে।সারথি বাহুড়ি রথ নিল কত দূরে।।বাহিক সহিত যুদ্ধ কেকয় বীরের।দুইজনে দোঁহে বিন্ধে দোঁহার শরীর।।মহাবল দুইজন সংগ্রামে নিপুণ।দোঁহাকার শরজালে ঢাকিল অরুণ।।নানাবিধ অস্ত্র দোঁহে করে অবতার।দোঁহাকার অস্ত্র দোঁহে করয়ে সংহার।।তবে ধৃষ্টকেতু বীর পূরিয়া সন্ধান।একেবারে বাহিকেরে মারে নয় বাণ।।কবচ কাটিয়া বাণ শরীর ভেদিল।মূর্চ্ছা হয়ে মহাবীর রথেতে পড়িল।।রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ ফিরায় সারথি।সিংহনাদ করে ধৃষ্টকেতু মহামতি।।মূর্চ্ছা ভাঙ্গি মহাবীর উঠে ততক্ষণ।সারথিরে বহুবিধ করিল তর্জ্জন।।শীঘ্র করি লহ রথ বলে সারথিরে।আজি যুদ্ধে সংহারিব ধৃষ্টকেতু বীরে।।আজ্ঞামাত্র রথ তবে চালায় সারথি।মুখামুখি পুনঃ যুদ্ধ হৈল মহারথী।।কেহ পরাভব নহে সব দুইজন।নানাবিধ অস্ত্র দোঁহে করে বরিষণ।।ঘটোঃকচ সহ যুঝে অলম্বুষ রাক্ষস।দোঁহে দোঁহাকার বাণে রুধিল আকাশ।।দোঁহে দোঁহা মায়াবী অনেক মায়া জানে।মায়েতে আচ্ছন্ন করি যুঝে দুই জনে।।দোঁহাকার সিংহনাদ বিপক্ষ-বিদার।নানাবিধ অস্ত্র দোঁহে করে অবতার।।কেহ পরাজয় নহে সম দুই বীর।দোঁহে মহাবীর্য্যবন্ত দোঁহে মহাধীর।।অশ্বত্থামা সঙ্গে যুদ্ধ শিখণ্ডী প্রখর।নানাবিধ দিব্য অস্ত্র করে অবতার।।মহাবীর অশ্বত্থামা দ্রোনের কুমার।মহাঘোর রণ করে বলে মার মার।।শিখণ্ডী উপরে তবে করে শরজাল।গগনে বরিষে যেন কোটি কালানল।।দশদিক অন্ধকারে পূরিল আকাশ।অশ্বত্থামা নিকটে শিখণ্ডী পাইল ত্রাস।।শিখণ্ডীর বিপাক দেখিয়া সত্রাজিত।অশ্বত্থামা নিকটে হইল উপনীত।।মহাবীর সত্রাজিত সমরে প্রচণ্ড।যত অস্ত্র দ্রৌণির করিল খণ্ড খণ্ড।।অন্ধকার দূর হৈল প্রকাশে অরুণ।মহাবীর সত্রাজিত সংগ্রামে নিপুণ।।তাহার বিক্রম দেখি দ্রোনের কুমার।ক্রুদ্ধ হয়ে নানা অস্ত্র করে অবতার।।মুষল মুদগর আদি বজ্র অস্ত্রগণ।সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল বীরগণ।।সত্রাজিত শিখণ্ডী পাইল পরাভব।জয় জয় শব্দ কৈল সকল কৌরব।।বিরাট সহিত যুঝে রাজা ভগদত্ত।দোঁহে মহাবলবন্ত দোঁহে মহাসত্ত্ব।।অন্য অন্য বীর করে বাণ করিষণ।দোঁহাকার অস্ত্র দোঁহে করে নিবারণ।।ভগদত্ত দুই বাণ সন্ধান করিল।বিরাটের ধ্বজছত্র কাটিয়া পাড়িল।।ধ্বজ কাটা গেল বীর ক্রোধ হৈল মনে।শক্তি ফেলি ভগদত্তে বিন্ধে ততক্ষণে।।শক্তির প্রহারে মোহ পায় মহাবীর।মোহ ভাঙ্গি উঠে পুনঃ সংগ্রামে সুধীর।।অষ্ট বাণে বিরাটেরে বিন্ধিল সত্বর।বাণে বাণ কাটি পাড়ে বিরাট-ঈশ্বর।।মোহ গেল বিরাট শোণিত পড়ে ধারে।মোহ ভাঙ্গি বিরাট যে উঠিল সত্বরে।।পুনরপি দুই নৃপে হৈল মহারণ।দোঁহাকার বাণবৃষ্টি না যায় গণন।।কৃপাচায্য সনে যুঝে কেকয় নৃপতি।বাণে বাণ নিবারয়ে দুই মহামতি।।জয়দ্রথ দ্রুপদে হইল মহারণ।গগন ছাইয়া কৈল বাণ বরিষণ।।বিকর্ণ সহিত যুদ্ধ সোমদত্ত করে।নানাবিধ অস্ত্র দোঁহে প্রহারে দোঁহারে।।সুশর্ম্মা সহিত যুদ্ধ করে চেকিতান।দোঁহে মহাবীর দোঁহে মহাবীর্য্যবান।।দোঁহাকার অস্ত্রে দোঁহে বিন্ধে শীঘ্রগতি।বাণে বাণ নিবারয়ে দুই মহামতি।।সহদেব সুত যুঝে সুদক্ষিণ সনে।দোঁহাকারে অস্ত্র দোঁহে মারে বরিষণে।।আয়ুধন সনে যুদ্ধ করে সম বীর।দোঁহাকার অস্ত্র দোঁহে মারে বরিষণে।।আয়ুধন সনে যুদ্ধ করে সম বীর।দোঁহাকার বাণে বিন্ধে দোঁহার শরীর।।দোঁহে মহা বীর্য্যবন্ত দোঁহে মহাবীর।কেহ পরাভব নহে দোঁহে মহাধীর।।অন্য অন্য এইরূপে যুঝে বীরগণ।বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল গগন।।দগড় দুন্দুভি বাদ্য বাজে অগণন।লক্ষ লক্ষ শঙ্খ বাজে না যায় লিখন।।দুই দলে সৈন্য যুঝে পড়ে বীরগণ।মহাঘোর শব্দ হৈল পূরিল গগন।।ধ্বজ ছত্র পতাকায় পৃথিবী ছাইল।ধূলি অন্ধকারে ঘোর ভুবন পূরিল।।কোটি কোটি অশ্ববর লক্ষ লক্ষ হাতী।ভাসিয়া বেড়ায় সব স্থল নাহি তথি।।সারি সারি মুণ্ড হাসে দেখিতে সুন্দর।লক্ষ লক্ষ ছত্র পড়ে পৃথিবী উপর।।ধ্বজ ছত্র পতাকায় ধরণী শোভন।বসন্ত সময়ে যেন শোভয়ে কানন।।এইরূপে যুদ্ধ হৈল দ্বিতীয় প্রহর।ক্রুদ্ধ হৈল মহাবীর গঙ্গার কুমার।।আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।ইন্দ্রের বজ্রেতে যেন পর্ব্বত বিদার।।শত শত বাণ বীর একবাণে এড়ে।শত শত মুণ্ড কাটি পাড়ে একেবারে।।কাটিল অনেক অশ্ব রথী রথধ্বজ।লক্ষ লক্ষ আশোয়ার লক্ষ লক্ষ গজ।।বিস্মিত যতেক যোদ্ধা ভীষ্মের বিক্রমে।সহিতে না পারি ভঙ্গ দিলেক সংগ্রামে।।ভঙ্গ দিল পাণ্ডবের যত সৈন্যগণ।দেখি যুধিষ্ঠির রাজা ভয়াকুল মন।।আশ্বাসিয়া সর্ব্বসৈন্য বীর ধনঞ্জয়।ডাক দিয়া বলে শুন কৃষ্ণ মহাশয়।।শীঘ্রগতি লহ রথ কুরুসৈন্য মাঝে।আজিকার সংগ্রামে মারিব কুরুরাজে।।সব কুরুগণ আজি করিব নিধন।না পারিবে রাখিবারে গঙ্গার নন্দন।।আজ্ঞামাত্র রথ চালাইয়া নারায়ণ।নানা অস্ত্রবৃষ্টি করে কুপিয়া অর্জ্জুন।।একেবারে মারে বীর লক্ষ লক্ষ শর।নিমিষেকে শরজালে ছাইল অম্বর।।দশদিক অন্ধকার না দেখি অরুণ।আকাশ ছাইয়া কৈল বাণ বরিষণ।।সহস্র সহস্র বাণ এড়ে একেবারে।সহস্র সহস্র মহারথীরে সংহারে।।লক্ষ লক্ষ মহারথী করিল সংহার।অসংখ্য পদাতি কোটী কোটী আশোয়ার।।লক্ষ লক্ষ মত্ত হস্তী দীর্ঘ দন্ত যার।একেশ্বর ধনঞ্জয় করিল সংহার।।অর্জ্জুনের বিক্রমে ত্রাসিত কুরুদল।সহিতে না পারি সর্ব্বজন ভঙ্গ দিল।।পলায় সকল সৈন্য পিছু নাহি চায়।আশ্বাসয়ে সর্ব্বসৈন্য গঙ্গার তনয়।।কৃতবর্ম্মা দুঃশাসন শল্য পরপতি।বিবিংশতি চেকিতান কেশরী প্রভৃতি।।কৃপ সোমদত্ত আর গুরুর নন্দন।দশ মহারথী গেল ভীষ্মের রক্ষণ।।চক্ররক্ষা কৈল তবে ভীষ্মের শরীর।বিক্রমে বিশাল সবে সংগ্রামে সুধীর।।নানা অস্ত্রবৃষ্টি করে সৈন্যের উপর।ক্রোধ করি আগু হৈল সুভদ্রা-কুমার।।আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।নানাবিধ দিব্য অস্ত্র করে অবতার।।খুরুপা ভৈরববাণ এড়িল প্রচণ্ড।ভীষ্মের হাতের ধনু কৈল খণ্ড খণ্ড।।ধ্বজচ্ছত্র হানিয়া সংগ্রামে মহাধীর।ষষ্টি বাণ মারি বিন্ধে ভীষ্মের শরীর।।দশ বাণ মারে কৃতবর্ম্মার শরীরে।পঞ্চ বাণে বিন্ধিলেক শল্য-কলেবরে।।ছয় বাণে দুঃশাসনের সারথি সহিতে।ধ্বজচ্ছত্র অশ্ব তার পাড়িল ভূমিতে।।দুই বাণে কৃতবর্ম্মার কাটে ধনুর্গুণ।শীঘ্রহস্ত অভিমন্যু সংগ্রামে নিপুণ।।দ্বিতীয় অর্জ্জুন সম বীর-অবতার।শিশুর সমরে কুরুকুলে চমৎকার।।আকাশে প্রশংসা করে যত দেবগণ।লজ্জা পায় রণে তবে গঙ্গার নন্দন।।ক্রোধ হৈয়া পুনঃ ধনু লইল সত্বরে।দশ বাণ মারিলেক সুভদ্রা-কুমারে।।চারি বাণে ধ্বজচ্ছত্র কাটিল ত্বরিতে।সারথির মাথা কাটি পাড়িল ভূমিতে।।না কম্পিল অভিমন্যু সংগ্রামে সুধীর।নকুলের রথে চড়ি রণে হৈল স্থির।।তবে কৃতবর্ম্মা আর কৃপ বিবিংশতি।চেকিতান দুঃশাসন কেশরী প্রভৃতি।।ছয় মহারথী মেলি করে অস্ত্রবৃষ্টি।প্রলয়ের কালে যেন মজাইতে সৃষ্টি।।ক্রোধ করি পার্থ তবে প্রবেশিলে রণে।মহাভয়ঙ্কর যুদ্ধ হৈল ভীষ্মার্জ্জুনে।।দুর্য্যোধন দুঃশাসন সহ সহোদর।ভূরিশ্রবা উল্কা আদি মদ্রের কুমার।।গগন ছাইয়া সবে বরিষয়ে শর।মৎস্যবংশ বীরগণে করিল জর্জ্জর।।উত্তর কুমার তবে বরিষয়ে শর।দশ বাণে বিন্ধিল শল্যের কলেবর।।চারি বাণে চারি অশ্ব বিন্ধে ততক্ষণ।দুই বাণে সারথিরে করিলা নিধন।।বিরথ হইল শল্য লজ্জা পাইল রণে।সর্ব্বলৌহময় গদা লৈল ততক্ষণে।।ফেলিয়া মারিল গদা উত্তর উপর।গদাঘাতে পলাইল বিরাট-কুমার।।ভ্রাতৃভঙ্গ দেখি শঙ্খ দুঃখ পরিহরি।শল্যের অগ্রেতে এল হাতে গদা করি।।শল্যরে দেখিয়া বলে শুন রে বর্ব্বর।এক গদাঘাতে তুমি যাবে যমঘর।।এত বলি গদা বীর মারিল সত্বর।লাফ দিয়া এড়াইল মদ্রের কুমার।।ক্রোধ করি শঙ্খে গদা করিল প্রহার।বজ্রেতে হইল যেন পর্ব্বত বিদার।।সেই ঘায়ে শঙ্খবীর হরিল গেয়ান।ভীমসেন ধেয়ে বীরে কৈল পরিত্রাণ।।মৎস্যবীরগণ তবে রণে ভঙ্গ দিল।আশ্বাস করিয়া ভীম বলিতে লাগিল।।স্থির হৈয়া যুঝ সবে ভঙ্গ দেহ কেনে।আজি যুদ্ধে মারিব পাপিষ্ঠ কুরুগণে।।এত বলি বৃকোদর প্রবেশিল রণে।শল্যের উপরে করে বাণ বরিষণে।।নানাবিধ অস্ত্র মারে ভীম মহাবীর।শরেতে জর্জ্জর হৈল শল্যের শরীর।।শল্যের সাহায্য হেতু বিড়ালাক্ষ বীর।নানা অস্ত্র মারি বিন্ধে ভীমের শরীর।।দুর্য্যোধন-সহোদর সমরে প্রচণ্ড।রথধ্বজ ভীমের করিল খণ্ড খণ্ড।।খুরুপা ভৈরববাণ এড়িল ত্বরিত।বাণাঘাতে বিড়ালাক্ষ হইল মূর্চ্ছিত।।রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ ফিরায় সারথি।রথী লৈয়া সারথি পলায় শীঘ্রগতি।।তবে দুর্য্যোধন রাজা ক্রোধিত অন্তর।রণে আইল সহ ঊনশত সহোদর।।নানা অস্ত্রবৃষ্টি করে ভীমের উপর।আষাঢ় শ্রাবণে যেন বর্ষে জলধর।।অস্ত্রে অস্ত্র নিবারয়ে বায়ুর নন্দন।পবনে উড়ায় যেন মেঘ বরিষণ।।ভীমের প্রতাপে স্থির নহে কুরুগণ।ভঙ্গ দিয়া লৈল গিয়া ভীষ্মের শরণ।।আশ্বাস করিয়া ভীষ্ম সর্ব্বসৈন্যগণে।নানা অস্ত্র লৈয়া তবে প্রবেশিল রণে।।শুল্ক বন দহে যেন কালাগ্নি অনল।তাদৃশ সৈন্যের মধ্যে ভীষ্ম মহাবল।।রথ রথী সৈন্য বাজী পড়িল অনেক।লিখনে না যায় সৈন্য পড়িল যতেক।।সন্ধ্যার সময়ে সৈন্য অনেক পড়িল।ভীষ্মার্জ্জুনে দেখাদেখি পুনঃ যুদ্ধ হৈল।।অস্ত্র গেল দিনমণি রাত্রি প্রবেশিল।যার যেই নিজ স্থানে দুই দলে গেল।।দুই দলে পড়িল অনেক সৈন্যগণ।গজ বাজি রথধ্বজ না যায় লিখন।।ভয়ঙ্কর হৈল ভূমি দেখি লাগে ভয়।শ্মশান সদৃশ হৈল বৈসে প্রেতচয়।।অসংখ্য কবন্ধ উঠে হাতে ধনুঃশর।শৃগাল কুক্কুরগণ করে কোলাহল।।মুনি বলে জন্মেজয় কর অবধান।প্রথম দিনের যুদ্ধ হৈল সমাধান।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হয় দিব্যজ্ঞান।।কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।অবহেলে শুন যেন সকল সংসার।।০৭. শিখণ্ডীর পূর্ব্বজন্ম বৃত্তান্তজিজ্ঞাসিল জন্মেজয় করিয়া বিনয়।কি কহিলা শুনি তবে অম্বিকা-তনয়।।তবে পুনঃ সঞ্জয়েরে জিজ্ঞাসে রাজন।কি করিল কহ শুনি পুত্র দুর্য্যোধন।।সঞ্জয় বলিল, রাজা শুন একমনে।শিবিরে আসিয়া যুক্তি কৈল দুর্য্যোধনে।।দুর্য্যোধন দুঃশাসন গান্ধার নন্দন।তিন জনে মিলি গেলা ভীষ্মের সদন।।পুনরপি ভীষ্মেরে বলয়ে দুর্য্যোধন।অবধান নিবেদিয়ে গঙ্গার নন্দন।।পূর্ব্বেতে আমার অগ্রে কৈলে অঙ্গীকার।পাণ্ডবে জিনিয়া মোরে দিবে রাজ্যভার।।স্নেহেতে না মার তুমি পাণ্ডুর কুমার।তব বাক্য ব্যর্থ হৈল কি বলিব আর।।আগে যদি করিতাম কর্ণে সেনাপতি।দৃষ্টিমাত্রে পাণ্ডবে মারিত মহামতি।।এইরূপ দুর্য্যোধন কহিল বচন।শুনিয়া হইল ক্রোধ গঙ্গার-নন্দন।।দুর্য্যোধনে চাহি তবে বলিল বচন।স্থিরহও দুর্য্যোধন না কর শোচন।।যে প্রতিজ্ঞা কৈনু আমি তোমার গোচরে।কালি পাণ্ডু পুত্রেরে পাঠাব যমঘরে।।সোমক পাঞ্চাল আদি যত বীরচয়।কালি প্রাতে মোর হাতে যাবে যমালয়।।এক যুক্তি কহি আমি শুন দুর্য্যোধন।প্রকারেতে শিখণ্ডীর করিতে নিধন।।অমঙ্গল দুরাচার সেই ত অধম।তাহা দেখি সিন্ধ নয় আমার বিক্রম।।পূর্ব্বেতে প্রতিজ্ঞা মোর জানে সর্ব্বজন।অমঙ্গল দেখি অতি তেয়াগিনু রণ।।দৈবের নির্ব্বন্ধ আছে জানে সর্ব্বজন।শিখণ্ডীর হাতে আমি হইব নিধন।।পূর্ব্বজন্মে ভজি নাই আমি দুরাচারে।আমারে ভজিব হেন আছিল বিচারে।।বিভা না করিব আমি প্রতিজ্ঞা আমার।তেকারণে আইল পাপিনী দুরাচার।।তার হেতু গুরু সনে হৈল মহারণ।প্রকারে শিখণ্ডী তুমি করহ নিধন।।এত শুনি দুর্য্যোধন বিস্ময় হৃদয়ে।পুনঃ জিজ্ঞাসিল করযোড়ে পিতামহে।।কহ শুনি পিতামহ পূর্ব্বের কাহিনী।পূর্ব্বেতে শিখণ্ডী ছিল কাহার নন্দিনী।।শিখণ্ডী তোমার বৈরী ছিল কি কারণ।কি কারণে গরু সনে কৈলে তুমি রণ।।ভীষ্ম বলে রহস্য শুনহ দুর্য্যোধন।বিচিত্রবীর্য্যের পূর্ব্বে বিবাহ কারণ।।দ্বিজগণ মুখে আমি শুনিনু কাহিনী।পরমা সুন্দরী আছে কাশীর নন্দিনী।।একাধিক কন্যকা আছয়ে তিন জন।শুনি কাশীপুরে আমি করিনু গমন।।স্বয়ম্বর আরম্ভিয়া ছিল কাশীশ্বর।স্বয়ম্বর হৈতে কন্যা করিনু সত্বর।।তিন কন্যা রথেতে তুলিনু সব্য হাতে।অনেক হইল যুদ্ধ শাল্বের সহিতে।।সংগ্রামেতে শাল্বেরে করিনু পরাজয়।কন্যাগণে লৈয়া আইনু আপন আলয়।।অম্বী অম্বা অম্বালিকা আদি তিনজন।বিবাহ আরম্ভ হেতু জানি শুভক্ষণ।।রত্নবেদী মধ্যে বসাইনু তিনজন।হেনকালে অম্বী তবে বলিল বচন।।ইচ্ছা-বরী হৈয়া আমি বরিনু শাল্বেরে।জানিয়া আমার বিভা দেহ অনুসারে।।এতেক শুনিয়া ত্যাগ করিনু তাহারে।দুই কন্যা বিভা আমি দিনু অনুজেরে।।অম্বা অম্বালিকা দুই কাশীর নন্দিনী।পরমা সুন্দরী রূপে ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী।।জ্যেষ্ঠ কন্যা অম্বী যবে করিনু বর্জ্জন।সত্বর চলিল কন্যা শাল্বের সদন।।অনেক প্রকারে তবে কহিল শাল্বেরে।ইচ্ছাসুখে তোমারে করিব স্বয়ম্বরে।।অবিচার করি দুষ্ট গঙ্গার-নন্দন।স্বয়ম্বর হৈতে মোরে করিল হরণ।।এই বিবরণ কহি সভার ভিতরে।তেকারণে ত্যাগ দুষ্ট করিল আমারে।।তোমা ভিন্ন রাজা মোর অন্যে নাহি মন।জানিয়া আমারে রাজা করহ গ্রহণ।।এত শুনি শাল্ব চিত্তে কৈল নিরূপণ।বিচার করিয়া তারে না কৈল গ্রহণ।।পুনরপি কন্যা তবে আইল মোর ঘরে।কহিল আমারে কন্যা অনেক প্রকারে।।সর্ব্ব ধর্ম্ম জ্ঞাত তুমি গঙ্গার কুমার।হাতে ধরি তুলি নিলে রথের উপর।।পূর্ব্বাপার আছে হেন শাস্ত্রের বচন।স্বয়ম্বরা কন্যা যেই করয়ে গ্রহণ।।সেই তার পতি হয় বেদের বিচার।অন্যপরে তাহার নাহিক অধিকার।।জানিয়া শুনিয়া বিভা না কৈলে আমারে।নারীহত্যা ভার দিব তোমার উপরে।।আমিও কহিনু তারে শুনহ পাপিনি।পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর জানহ কাহিনী।।পিতার বিবাহ হেতু কৈনু অঙ্গীকার।বিভা না করিব সত্য বচন আমার।।তাহা শুনি কন্যা তবে করয়ে রোদন।অরণ্যের মধ্যে প্রবেশিল ততক্ষণ।।একাকী অরণ্য মধ্যে করয়ে রোদন।হেনকালে নারদের সঙ্গে দরশন।।ব্যাকুল হইয়া তবে কহে মহামুনি।কি কারণে কান্দ কন্যা কহত কাহিনী।।এত শুনি কহে কন্যা যুড়ি দুই কর।অবধান নিবেদন শুন মুনিবর।।অবিহিত কৈল দুষ্ট গঙ্গার নন্দন।স্বয়ম্বরে ধরি মোরে না কৈল গ্রহণ।।শরীর ত্যজিব আমি করি অনাহার।মোর প্রতি কেন তার এত অবিচার।।এত শুনি হৃদয়ে ভাবিল তপোধন।কন্যারে চাহিয়া কহে মধুর বচন।।না ত্যজহ প্রাণ কহি করিয়া প্রকার।শীঘ্রগতি যাহ যথা ভৃগুর কুমার।।তাঁর প্রিয় শিষ্য হয়গঙ্গার নন্দন।বহুবিধ মতে তাঁরে করিবে স্তবন।।প্রসন্ন করিয়া তবে সাধিবে ভীষ্মেরে।তাঁহার বচন ভীষ্ম খণ্ডাইতে নারে।।গুরু আজ্ঞা ভীষ্ম নাহি করিবে হেলন।স্বধর্ম্ম রাখিয়া তোমা করিবে গ্রহণ।।এত বলি অন্তর্দ্ধান হৈল তপোধন।শীঘ্রগতি গেল কন্যা ভার্গব সদন।।অনেক প্রকারে স্তব করিল মুনিরে।তুষ্ট হৈয়া বর তারে যাচে ভৃগুবরে।।তোমার স্তবেতে কন্যা তুষ্ট হৈনু আমি।যেই বর ইচ্ছা কন্যা মাগি লহ তুমি।।এত শুনি কহে কন্যা যুড়ি দুই কর।আমার বাঞ্ছিত দেব শুনহ উত্তর।।তব প্রিয় শিষ্য হয় গঙ্গার নন্দন।স্বয়ম্বরে হরি মোরে না কৈল গ্রহণ।।এত শুনি কন্যাসহ ভৃগুর নন্দন।শীঘ্রগতি আইলা চলি আমার সদন।।গুরু দেখি আমি প্রণমিনু করযোড়ে।পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তবে পূজিনু বিস্তরে।।তবে ভৃগুবর মোরে বলিল বচন।এই কন্যা কেন তুমি না কর গ্রহণ।।স্বয়ম্বর হৈতে কন্যা করিয়া গ্রহণ।হরিয়া আনিলে ত্যাগ কর কি কারণ।।নারীবধ পাপ ভীষ্ম লাগে পরিণামে।এইরূপ বহু মোরে কৈল গুরু রামে।।হৃদয়ে চিন্তিয়া তাঁরে দিলাম উত্তর।পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর জান গুরুবর।।জনকের বিভা হেতু কৈনু অঙ্গীকার।বিবাহ না করি আমি, না লই রাজ্যভার।।ক্ষত্রিয় প্রতিজ্ঞা কভু না করিলে নয়।ধর্ম্মাধর্ম্ম সব নাথ গোচর তোমায়।।জানিয়া কারণ হেন কহ মতিমান্।তুমি হেন বল দেব কি কহিব আন।।এত শুনি পুনরপি বলে ভৃগুবর।নাহিক ইহাতে দোষ গুন গুরুতর।।আমার বচন শুন না কর খণ্ডন।সর্ব্ব ধর্ম্ম জানি ইহায় করহ গ্রহণ।।আমি কহিলাম দেব নহে কদাচন।এত শুনি ক্রোধ কৈল ভৃগুর নন্দন।।গুরু বাক্য নাহি নিলি তুই দুরাচার।এই দোষে তোরে আমি করিব সংহার।।ইচ্ছামৃত্যু এইমাত্র ধর অহঙ্কার।আমার ক্রোধেতে কারে নাহিক নিস্তার।।যুদ্ধ দেহ মোর সঙ্গে শুন দুষ্টমতি।এত শুনি বাহির হইনু শীঘ্রগতি।।নানা অস্ত্র লয়ে দোঁহে প্রবেশিনু রণে।ক্ষান্ত নহে দোঁহে হৈল বাণ বরিষণে।।যত অস্ত্র মারে গুরু কৈনু খণ্ড খণ্ড।ক্রোধেতে এড়িল তবে বাণ যমদণ্ড।।আকাশে উঠিল অস্ত্র দেখি ভয়ঙ্কর।বিষম দুর্জ্জয় বাণ আইসে তৎপর।।বশিষ্ঠের দত্ত বাণ মোর তুণে ছিল।সেই বাণাঘাতে বাণ দুইখান হৈল।।অস্ত্র ব্যর্থ গেল ক্রোধ হৈল ভৃগুবর।ক্রোধেতে কম্পিত অঙ্গ কাঁপে থর থর।।শক্তি ফেলি মারিলেক আমার উপর।দিব্য অস্ত্র দিয়া কাটি ফেলিনু সত্বর।।উন্মত্ত কুঠার লয়ে আইসে মারিবারে।উপনীত হৈল গিয়া মোর বরাবরে।।বশিষ্ঠের শিক্ষা অস্ত্র নাম ব্রহ্মশির।তাহাতে জর্জ্জর কৈনু ভৃগুর শরীর।।আর জন্মে ভীষ্মে আমি করিব নিধন।এত বলি কন্যা কৈল অরণ্যে গমন।।চিন্তা করি কাষ্ঠ দিয়া জ্বালিল অনল।শাপ দিল মোর তরে হাতে করি জল।।আমার বচন কভু না যায় খণ্ডন।দ্রুপদের গৃহে আসি লইল জনম।।সেই কন্যা দেখহ শিখণ্ডী দুরাচার।প্রকারে তাহারে তুমি করহ সংহার।।তাহারে মারিলে জয় হইবে তোমার।নাহিক সংশয় শুন বচন আমার।।দুর্য্যোধন বলে এই কোন্ চিত্রকথা।কালি যুদ্ধে মারিব শিখণ্ডী মহারথা।।দুঃশাসন মহাবীর মোর সহোদর।শিখণ্ডীরে মারিতে তাহার হৈল ভার।।মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হেলে ভবতরি।।মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদদ্বন্দ্ব।কাশীরাম দাস কহে পয়ার প্রবন্ধ।।০৮. দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধসঞ্জয় বলেন, শুন অন্ধ নরপতি।রজনী প্রভাতে আজ্ঞা দিল কুরুপতি।।রাজার বচনে সবে সাজে শীঘ্রগতি।রথী মহারথী সাজে মহাযোধপতি।।বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল গগন।ডিমি ডিমি শব্দে বাজে বাদ্য অগণন।।শঙ্খ ভেরী দুন্দুভি বাজয়ে করতাল।কতেক লিখিব যত ফুকারে কাহাল।।মহরী ঝাঝরি নানা বাদ্য সব বাজে।বাদ্যের শবদে কম্প হৈল সব রাজ্যে।।ভূমিকম্পে উঠে ঘন পৃথিবী কম্পন।তবে ভীষ্ম মহাবীর গঙ্গার নন্দন।।সমুদ্র সদৃশ ব্যূহ করিল রচন।ব্যূহ-মুখে নিয়োজিল মহাযোদ্ধাগণ।।বামশৃঙ্গে কৃতবর্ম্মা রাজা দুর্য্যোধনে।এইরূপে সবে রহে ব্যূহের রক্ষণে।।দুঃশাসনে আদি ঊনশত সহোদর।ভূরিশ্রবা সোমদত্ত প্রতীপকুমার।।দক্ষিণ শৃঙ্গেতে দ্রোণ কৃপ মহামতি।ত্রিগর্ত্ত সুশর্ম্মা আদি প্রাগজ্যোতিষপতি।।মধ্যশৃঙ্গে রহিলেন যত বীরগণ।পশ্চাতে রহিলা তবে মদ্রের নন্দন।।ব্যূহের অগ্রেতে হৈল ভীষ্ম মহামতি।দশসহস্র চক্ররক্ষ সঙ্গে মহারথী।।দশসহস্র নারায়ণী-সেনা বলবান।রাখিল পশ্চিম শৃঙ্গে রথীর প্রধান।।কোটি কোটী হস্তী পত্তি অশ্ব অগণন।সাজিল যতেক সেনা না যায় লিখন।।এইরূপে ব্যুহ কৈল ভীষ্ম মহামতি।ব্যূহ-কথা শুনিলেন ধর্ম্ম নরপতি।।অর্জ্জুনে ডাকিয়া আজ্ঞা দিল ততক্ষণ।ব্যূহ করি সাজিলেন গঙ্গার নন্দন।।ইহার বিধান ভাই কর শীঘ্রতর।সাবধান হৈয়া আজি করিবে সমর।।শিখণ্ডীরে রাখ রণে বহু যত্ন করি।মহারথিগণ তবে করিয়া প্রহরী।।সাবধান হৈয়া কর ব্যূহের রচন।স্থানে স্থানে বুঝিয়া রাখহ যোদ্ধাগণ।।আজ্ঞামাত্র ধনঞ্জয় মহাবিচক্ষণ।রচিল বিচিত্র ব্যূহ না যায় বর্ণন।।সূচীমুখ-ব্যূহ কৈল বড়ই দুষ্কর।ব্যূহমুখে নিয়োজিল মহাধনুর্দ্ধর।।মহাশৃঙ্গে রাখিল সাত্যকি মহামতি।ভীমসেন সহদেব নকুল প্রভৃতি।।মধ্যশৃঙ্গে যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের কুমার।দশসহস্র রথী সঙ্গে মহাবলধর।।দক্ষিণ শৃঙ্গেতে রহে মহা মহারথী।ধৃষ্টদ্যুন্ন বিরাটাদি কেকয় প্রভৃতি।।দেখাদেখি বোলাবুলি বাজিল সমর।ব্যূহের অগ্রেতে পার্থ ইন্দ্রের কুমার।।মহাবীর ধনঞ্জয় সংগ্রামে প্রচণ্ড।একেবারে কাটি পাড়ে শত শত মুণ্ড।।ইন্দ্রদত্ত শিক্ষা যত দিব্য অস্ত্র জানে।জলধর সম পার্থ করে বরিষণে।।সহস্র সহস্র বাণ একেবারে এড়ে।সহস্র সহস্র বীর পড়ে একেবারে।।ধ্বজচ্ছত্র পতাকায় ঢাকিল মেদিনী।ক্ষণেকে রক্তের নদী বহাল ফাল্গুনি।।পার্থের বিক্রমে ত্রাস পাইল কুরুগণ।সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল সর্ব্বজন।।সৈন্যভঙ্গ দেখি তবে গঙ্গার কুমার।ক্রোধ করি আগু হৈল করিতে সমর।।ভীষ্মার্জ্জুন দুইজনে হৈল মহারণ।দোঁহার বিক্রমেতে কম্পিত বীরগণ।।মহাবীর বৃকোদর সংগ্রামে প্রখর।বিন্ধিয়া কৌরব-সৈন্য কৈল জর জর।।সহস্র সহস্র বীর কৈল খণ্ড খণ্ড।ক্ষুদ্র মৃগে মারে যেন কেশরী প্রচণ্ড।।ভীমের বিক্রমেতে কম্পিত কুরুগণ।ক্রোধ করি আগু হৈল ত্রিগর্ত্ত রাজন।।ভীমের উপরে করে বাণ বরিষণ।প্রলয়ের কালে যেন বর্ষে ঘোর ঘন।।শেল শূল শক্তি জাঠা মুষল মুদগর।নিরন্তর বৃষ্টি করে ভীমের উপর।।অস্ত্রে অস্ত্রে কাটি তবে পবন-কুমার।ত্রিগর্ত্ত উপরে করে অস্ত্র অবতার।।চারি বাণে চারি অশ্ব কৈল খণ্ড খণ্ড।দুই বাণে সারথিরে মারিল প্রচণ্ড।।চারি অশ্ব মারিয়া করিল সিংহনাদ।কৌরবের দলে হৈল বহুত প্রমাদ।।বিরথ হইল বীর সংগ্রাম ভিতর।হাতে গদা করিয়া নামিল ভূমি পর।।গদা আস্ফালিয়া যায় ভীমে মারিবারে।ক্রোধ হৈল ভীম তব সংগ্রাম ভিতরে।।দুই বাণে কাটি তাহা কৈল খণ্ড খণ্ড।ভল্ল-অস্ত্রে ত্রিগর্ত্তের বিন্ধিল প্রচণ্ড।।কবচ কাটিয়া অস্ত্র ভেদিল শরীরে।অস্ত্রাঘাতে অঙ্গে তার রক্ত পড়ে ধারে।।ত্রিগর্ত্তের বিপাক দেখিয়া শল্য বীর।আগু হৈয়া রক্ষা কৈল ত্রিগর্ত্ত-শরীর।।শীঘ্রগতি রথ লৈয়া যোগায় সারথি।রথে করি লৈল তবে ত্রিগর্ত্ত নৃপতি।।শল্য ভীমে দোঁহে তবে হৈল মহারণ।দেখাদেখি দোঁহে কৈল বাণ বরিষণ।।নারাচ ভৈরব আদি মুষল মুদগর।নানা অস্ত্র ফেলে দোঁহে দোঁহার উপর।।তবেত খুরুপা বাণ পূরিল সন্ধান।ভীমের হাতের ধনু কৈল খান খান।।আর ধনু লয় বীর নিমেষ ভিতরে।সেই ধনু কাটে বীর মারি দুই শরে।।পুনঃ পুনঃ বৃকোদর যত ধনু লয়।বাণে হানি শল্যবীর ভূমিতে ফেলায়।।ধনু কাটা গেল বীর হৈল ক্রোধ মন।শক্তি এক তুলি নিল ভীষণ দর্শন।।মহাতেজে মারে শক্তি পবন-কুমার।ইন্দ্রের বজ্রেতে যেন পর্ব্বত বিদার।।নানা অস্ত্র মারে বীর নিবারিতে নারে।কবচ ভেদিয়া শক্তি ভেদিল শরীরে।।মেহি গেল শল্য বীর রক্ত পড়ে ধারে।হাহাকার শব্দ হৈল যত কুরুবীরে।।রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ ফিরায় সারথি।সিংহনাদ কৈল বীর ভীম মহামতি।।অবসর পেয়ে ধনু লৈল বৃকোদর।ধনুকেতে গুণ তুলি দিলেক সত্বর।।গুণ দিয়া ধনু বীর টঙ্কারে নির্ঘাত।এককালে হৈল যেন শত বজ্রাঘাত।।মহাশব্দে মোহ হৈল যত কুরুগণ।রুষিল শল্যের ভাই সংগ্রামে দুর্জ্জন।।আগু হয়ে ভীমসেনে বলেন বচন।মোর হাতে যাবি আজি যমের সদন।।এত বলি দিব্য অস্ত্র যুড়িল ধনুকে।ঝলকে ঝলকে অগ্নি উঠে অস্ত্রমুখে।।মহাশব্দে আইসে বাণ গগন-মণ্ডলে।শরতের কালে হেন হংসপংক্তি চলে।।ভীম এড়িলেন বাণ খুরুপা প্রচণ্ড।অর্দ্ধপথে অস্ত্র কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।।তবে তারে ডাকি বলে পবন-কুমার।এই সে অস্ত্রেতে তোর এত অহঙ্কার।।এই অর্দ্ধচন্দ্র অস্ত্র অব্যর্থ সন্ধান।পূর্ব্বে মোরে দ্রোণাচার্য্য গুরু দিল দান।।সুরাসুর বিজয়ী দুষ্কর এই শর।এই অস্ত্রে পাঠাইব যমের নগর।।এত বলি আকর্ণ পূরিয়া শরাসন।এড়িলেক অস্ত্র যেন মধ্যাহ্ন তপন।।ঘোর শব্দ কির অস্ত্র আইসে আকাশে।অস্ত্র দেখি দেবগণ পলায় তরাসে।।নানা শক্তি করে নিবারিতে নাহি পারে।পড়িল শল্যের ভাই দারুণ প্রহারে।।সংগ্রামে পড়িল বীর পূর্ব্বশির হয়ে।কাঞ্চন পর্ব্বত যেন পড়িল খসিয়ে।।হাহাকার শব্দ হৈল যত কুরুদলে।হাতে অস্ত্র বৃকোদর নাচে কুতূহলে।।ভীমের বিক্রম সহে নাহি হেন বীর।ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি যেন প্রলয়-শরীর।।ধৃষ্টদ্যুন্ন দ্রোণে তবে হৈল মহারণ।নানা অস্ত্র দুইজনে করে বরিষণ।।মহাবীর দ্রোণাচার্য্য বিক্রমে বিশাল।দশ বাণ ধৃষ্টদ্যুন্নে প্রহার করিল।।দশগোটা কালসর্প জিনি দশ শর।মহাশব্দে আইল ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর।।অর্দ্ধচন্দ্র বাণেতে কাটিল ততক্ষণে।আকাশে প্রশংসা করে যত দেবগণে।।বাণ ব্যর্থ গেল বীর ক্রোধ হৈল মন।ভল্লবাণ পুনরপি এড়ে ততক্ষণ।।আকাশে উঠিল বাণ প্রলয় প্রচণ্ড।দুই বাণে ধৃষ্টদ্যুন্ন কৈল খণ্ড খণ্ড।।তবে ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর পূরিল সন্ধান।দ্রোণাচার্য্য উপরে মারিল দশ বাণ।।আকাশে উঠিল বাণ উলূকা সমান।বাণে বাণে হানি দ্রোণ কৈল সমাধান।।তবে গুরু মহাক্রোধ হইল অন্তরে।একবারে অগণিত যুড়িল তোমরে।।দশদিক অন্ধকার পূরিল আকাশ।পবন রুধিল সৈন্যে না চলে বাতাস।।ধৃষ্টদ্যুন্নে আরোপিল লক্ষ লক্ষ বাণ।অর্জ্জুন ধাইয়া গিয়া রক্ষা কৈল প্রাণ।।গুরু শিষ্যে পুনঃ তবে হৈল মহারণ।দোঁহার যুদ্ধের কথা না যায় লিখন।।পাঞ্চাল নন্দন তবে সুদক্ষিণ নাম।সর্ব্বগুণে বিশারদ মহা অনুপাম।।দ্রোনের উপরে করে বাণ বরিষণ।বরষা-কালেতে যেন বর্ষে ঘোর ঘন।।বাণে বাণে কাটি দ্রোণ কৈল খণ্ড খণ্ড।শক্তি ফেলি সুদক্ষিণে মারিল প্রচণ্ড।।নানা শক্তি করে বীর নারে নিবারিতে।বুকেতে বাজিল অস্ত্র পড়িল ভূমিতে।।রথ হৈতে সুদক্ষিণ পড়ে ভূমিতলে।হাহাকার শব্দ হৈল পাণ্ডবের দলে।।যতেক পাঞ্চালগণ হৈল ক্রোধমন।দ্রোণের উপরে করে বাণ বরিষণ।।শেল শূল শক্তি জাঠা মুষল মুদগর।ভৈরব নারাচ আদি নানা অস্ত্রবর।।নিরন্তর বৃষ্টি করে দ্রোনের উপর।বরিষার কালে যেন বর্ষে জলধর।।নানা অস্ত্রে শিক্ষিত আচার্য্য মতিমান।অস্ত্রে অস্ত্র কাটিয়া করিল খান খান।।চোখ চোখ বাণ এড়ে বড় বড় বীর।পাঞ্চাল বংশেতে নাহি অক্ষত শরীর।।অশ্বত্থামা নকুলের যুদ্ধ অনুপাম।পূর্ব্বে যুদ্ধ হৈল যেন রাবণ শ্রীরাম।।মহাবীর অশ্বত্থামা সমরে প্রচণ্ড।নকুলের রথধ্বজ কৈল খণ্ড খণ্ড।।ধ্বজ কাটা গেল বীর বড় পাইল লাজ।শক্তি ফেলি মারিলেক হৃদয়ের মাঝ।।লাফ দিয়া এড়াইল দ্রোনের নন্দন।নকুল উপরে করে বাণ বরিষণ।।বাণে বাণ নকুল করিল নিবারণ।বায়ুতে উড়ায় যেন জলধরগণ।।ক্রোধ হৈল নকুলের সংগ্রামে প্রখর।ষষ্টি বাণ মারি বিন্ধে দ্রোনের কোঙর।।চারি বাণে চারি অস্ত্র কৈল খণ্ড খণ্ড।দুই বাণে কাটিলেক সারথির মুণ্ড।।বিরথ হইল বীর সমর ভিতর।হাতে গদা করি তবে ধাইল সত্বর।।মারিল গদার বাড়ি নকুলের রথে।চারি অশ্ব সারিথি করিল চূর্ণ তাতে।।সারথি তুরঙ্গ রথ চূর্ণ হয়ে গেল।সাত্যকি আসিয়া তবে পরিত্রাণ কৈল।।অশ্বত্থামা সাত্যকিতে যুদ্ধ অনুপাম।পূর্ব্বে দেবাসুরে যেন হইল সংগ্রাম।।শত শত বাণ দোঁহে একেবারে এড়ে।অন্ধকার হইয়া দোঁহার গায়ে পড়ে।।নারাচ ভূষণ্ডী আর পরিঘ তোমর।নানা অস্ত্র ফেলে দোঁহে দোঁহার উপর।।কেহ পরাভব নহে সম দুই জন।দোঁহাকার অস্ত্র দোঁহে করি নিবারণ।।নকুলের সনে যুঝে বিকর্ণ কুমার।দোঁহাকার দোঁহে অস্ত্র করে অবতার।।শিখণ্ডী সহিত যুঝে বীর দুঃশাসন।অন্যে অন্যে দোঁহে করে বাণ বরিষণ।।সংগ্রামেতে প্রচণ্ড শিখণ্ডী মহাবীর।ষষ্টি বাণে বিন্ধে দুঃশাসনের শরীর।।দুই বাণে সারথিরে বিন্ধে ততক্ষণ।চারি বাণে চারি অশ্ব করিল নিধন।।অষ্ট বাণে ধ্বজচ্ছত্র কৈল খণ্ড খণ্ড।দুই বাণে দুঃশাসনে কৈল লণ্ডভণ্ড।।গদা হাতে করি বীর পড়ে ভূমিতলে।সিংহনাদ করিল শিখণ্ডী মহাবলে।।হাতে ধনু করি বীর ধায় আগুসারি।মৃগ মারিবারে যেন আইসে কেশরী।।চারি অশ্ব মারিল মারিয়া গদাবাড়ি।কেশে ধরি শিখণ্ডীরে ভূমিতলে পাড়ি।।ধরাধরি বাহুযুদ্ধ কৈল দুই জন।সহদেব শিখণ্ডীরে কৈল পরিত্রাণ।।মহাবীর সহদেব বিক্রমে বিশাল।দুঃশাসন উপরে করিল শরজাল।।দুঃশাসনে রথ আনি যোগায় সারথি।লাফ দিয়া রথেতে উঠিল মহামতি।।সহদেব দুঃশাসনে হৈল মহারণ।নানা অস্ত্র দুই জনে কৈল বরিষণ।।মহাবীর সহদেব পেয়ে অবসর।শক্তি ফেলি হানে দুঃশাসনের উপর।।সেই ঘায়ে দুঃশাসন হৈল অচেতন।রথ লয়ে সারথি বাহুড়ে ততক্ষণ।।তবে ত শকুনি বীর ক্রোধ হৈল মনে।নানা অস্ত্র মারি বিন্ধে মাদ্রীর নন্দনে।।শকুনিরে দেখি বীর কহয়ে কাহিনী।শুন রে পাপিষ্ঠ দুষ্ট অধম শকুনি।।পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর জান ভালমতে।সেই কাল হৈল এই কহিনু তোমাতে।।পাশাকালে যতেক করিলে অপমান।তাহার উচিত ফল পাবে মোর স্থান।।সবংশেতে যমঘর যাবি মোর হাতে।বিধাতার শক্তি ইহা নারিবি রাখিতে।।এত বলি আকর্ণ পূরিয়া মারে বাণ।রথধ্বজ শকুনির কৈল খান খান।।সারথিরে দুই বাণ করিল প্রহার।বজ্রেতে পর্ব্বত যেন হইল বিদার।।চারি বাণে চারি অশ্ব কৈল অষ্টখান।শকুনির হৃদয়ে মারিল দশ বাণ।।সর্ব্বাঙ্গে রুধির পড়ে নাহি ভুরূভঙ্গ।পুষ্পিত কিংশুক যেন শকুনির অঙ্গ।।তবে ত শকুনি বরি রণে প্রাণ ধরি।সারথিরে আগু হৈতে কহে ক্রোধ করি।।শকুনিরে শক্তি ফেলি মারে ততক্ষণ।সেই ঘায়ে শকুনি হইল অচেতন।।রথ লয়ে সারথি বাহুড়ে ততক্ষণ।শকুনি লইয়া গেল যথা দুর্য্যোধন।।শকুনির ভঙ্গ দেখি শকুনির দল।পাছে নাহি চাহে কেহ পলায় সকল।।পলাইয়া লয় সৈন্য ভীষ্মের শরণ।আশ্বাসিল সর্ব্ব সৈন্যে গঙ্গার-নন্দন।।দুই দলে সৈন্যের হইল হানাহানি।লিখনে না যায় যত পড়িল বাহিনী।।দুই দলে পড়িল অনেক রথিগণ।ধ্বজচ্ছত্র গজ বাজী পত্তি অগণন।।কনক রচিত ধ্বজে পৃথিবী পূরিল।অশোক-কানন যেন বসন্তে ফুটিল।।ভাদ্রমাসে পাকা তাল পড়ে যেন ঝড়ে।সারি সারি অশ্ব হস্তী এককালে পড়ে।।শত শত মুণ্ড পড়ে শুনি দড়বড়ি।কবচ কুণ্ডল পড়ে অস্ত্রগণ বেড়ি।।নানা অলঙ্কারেতে ছাইল রণপুরী।পড়িল অনেক সৈন্য লিখিতে না পারি।।মহাবীর গঙ্গাসুত সমরে প্রচণ্ড।পাণ্ডবের সৈন্য কাটি করে খণ্ড খণ্ড।।কাহার কাটিল হাত ধনুক সহিতে।মস্তক কাটিয়া কার পাড়িল ভূমিতে।।মধ্যে মধ্যে কাহারে করিল খণ্ড খণ্ড।কাহার কাটিয়া পাড়ে ছত্র ধ্বজদণ্ড।।কাহার কাটিল নাক কাহার শ্রবণ।মধ্যে মধ্যে চিরিয়া ফেলিল কত জন।।এইরূপে যুদ্ধ হৈল তৃতীয় প্রহর।অনেক করিল যুদ্ধ গঙ্গার কোঙর।।শতসহস্র রথী তবে করিল সংহার।গজ বাজি পদাতিক মারিল অপার।।ভীষ্মের বিক্রমে আনন্দিত দুর্য্যোধন।চিত্তেতে করিল আজি পাণ্ডব নিধন।।ভীষ্মের বিক্রমেতে ত্রাসিত পাণ্ডুগণ।সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল সর্ব্বজন।।নানা শক্তি করে পার্থ নিবারিতে নারে।স্থির নহে সৈন্যগণ পলায় সত্বরে।।বহু রত্ন করি স্থির কৈল সৈন্যগণ।আশ্বাসিয়া সৈন্যগণে প্রবেশিল রণ।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাহার শকতি তাহা করয়ে বর্ণন।।মস্তকে বন্দিয়া চন্দ্রচূড় পদদ্বন্দ্ব।কাশীরাম দাস কহে পাঁচালি-প্রবন্ধ।।০৯. অর্জ্জুনের মূর্চ্ছাবীর ধনঞ্জয়, সংগ্রামে দুর্জ্জয়,গাণ্ডীর ধনুক হাতে।মস্তকে শোভিত, কনক রচিত,পূর্ব্বে দিল সুরনাথে।।ত্রিভুবন-পতি, গোবিন্দ সারথি,ধবল চারি তুরঙ্গ।কপিধ্বজ নাম, রথ অনুপাম,জলদ-বরণ অঙ্গ।।একই বরণ, রাজীব লোচন,ধনঞ্জয় নারায়ণ।তনু অনুপাম, দোঁহে ঘনশ্যাম,দেখিতে বড় শোভন।।পার্থ বীরবরে, বলিল কৃষ্ণেরে,শীঘ্রগতি রথ বাহ।গঙ্গার তনয়, সংগ্রামে দুর্জ্জয়,তাঁহার অগ্রেতে লহ।।আজি মহারণে, গঙ্গার-নন্দনে,পাঠাইব যমালয়।এত শুনি বাণী, দেব চক্রপাণি,চালাইলা রথ হয়।।পার্থেরে দেখিয়া, রথ চালাইয়া,আগু হৈল গঙ্গাসুত।দোঁহার সংগ্রাম, বড় অনুপাম,এড়ে অস্ত্র যূথ যূথ।।ঘোর শব্দ করি, পড়ে দোঁহাপরি,সৈন্যে হৈল অন্ধকার।ভৃগুদত্ত বাণ, রণে অনুপাম,এড়ে গঙ্গার কুমার।।হৈয়া জ্যোতির্ম্ময়, দেখি লাগে ভয়,আইসে পার্থের পর।এড়িলেন বাণ, পার্থ মতিমান,বাণ কাটিল সত্বর।।বাণ ব্যর্থ গেল, মনে ক্রোধ হৈল,পুনরপি এড়ে বাণ।অষ্টবক্র নাম, বাণ অনুপাম.এড়ে পুরিয়া সন্ধান।।আলো করি আইসে, যেন তারা খসে,মহাভয়ঙ্কর শর।পার্থ লৈয়া বাণ, কৈল খান খান,প্রশংসে সব অমর।।তবে পার্থ বীর, নির্ভয়-শরীর,শতসংখ্যা বাণ এড়ে।আকাশ আবরি, অন্ধকার করি,ভীষ্মের গায়েতে পড়ে।।সংগ্রামে প্রচণ্ড, তেজেতে মার্ত্তণ্ড,দুর্জ্জয় গঙ্গার সুত।এড়ি দিব্য বাণ, কৈল খান খান,পার্থ মানিল অদ্ভুত।।হৈয়া ক্রোধমন, গঙ্গার নন্দন,পূরিল দিব্য সন্ধান।বশিষ্ঠ-শিক্ষিত, জগত-পূজিত,ব্রহ্মশির নাম বাণ।।এড়ে ক্রোধভরে, উঠিল অম্বরে,আশুনি সমান বাণ।নানা শক্তি করে, নিবারিতে নারে,এস্ত হৈলা ভগবান।।বাজিল সত্বরে, পার্থের শরীরে,নিবারিতে না পারিল।সেই অস্ত্রঘায় পার্থ মোহ যায়,গোবিন্দ এস্ত হইল।।তবে নারায়ণ, পুরুষ প্রধান,অঙ্গে হাত বুলাইল।স্পর্শে পদ্মহাত, খণ্ডে অস্ত্রঘাত,পার্থ সম্বিত পাইল।।তবে ধনঞ্জয়, ক্রোধে অতিশয়,পার্থ সম্বিত পাইল।তবে ধনঞ্জয়, ক্রোধে অতিশয়,লক্ষ লক্ষ এড়ে বাণ।বাণে বাণ হানি, বীর কুরুমণি,সব কৈল খান খান।।ক্রোধে পুনরপি, মন্ত্র অভিষেকি,লক্ষ লক্ষ বাণ এড়ে।নারাচ তোমর, মুষল মুদগর,পরিঘাদি শেল পড়ে।।করে অস্ত্র বৃষ্টি, মজাইতে সৃষ্টি,যেন বর্ষে ঘোর ঘন।শরতে ছাইল, অন্ধকার হৈল,না দেখি কৃষ্ণ অর্জ্জুন।।হাহাকার বোলে, পাণ্ডবের দলে,ভয়ে রণে ভঙ্গ দিল।পাণ্ডুসৈন্যগণে, গঙ্গার নন্দনে,প্রায় লণ্ডভণ্ড কৈল।।বীর ধনঞ্জয়, সংগ্রামে দুর্জ্জয়,কাটিল ভীষ্মের বাণ।সূর্য্য অস্ত্র গেল, রাত্রি প্রবেশিল,দিবা হৈল অবসান।।হেনই সময়, গঙ্গার তনয়,আজ্ঞা দিল যোধগণে।শুন সর্ব্বজন, সম্বরহ রণ,দিন হৈল অবসানে।।ভীষ্মের বচনে, কুরু-পাণ্ডুগণে,ত্যাগ কৈল সবে রণ।যে যার সদন, গেন সর্ব্বজন,কুরু পাণ্ডু বীরগণ।।সন্ধ্যার সময়, কুরু-পাণ্ডুচয়,পড়িল সংগ্রাম-স্থানে।সৈন্য অগণন, হস্তী অশ্বগণ,পড়িল বহুত রণে।।বেড়ে প্রেতচয়, দেখি লাগে ভয়,ভয়ঙ্কর রণস্থল।কুক্কুর শৃগাল, করে কোলাহল,কবন্ধ উঠে বহুদল।।ভারত-চরিত্র, পরম পবিত্র,শুনিলে পাপ বিনাশে।কাশীরাম কয়, নাহিক সংশয়,যে কহিলা মুনি ব্যাসে।।১০. তৃতীয় দিনের যুদ্ধমুনি বলে, অবধান কারহ রাজন।এতেক শুনিয়া কথা অম্বিকা-নন্দন।।হরিষে পূরিল তনু সানন্দ হৃদয়।জিজ্ঞাসিল সঞ্জয়েরে করিয়া বিনয়।।তবে কি করিলা কহ ধর্ম্মের তনয়।বিস্তার করিয়া মোরে শুনাহ সঞ্জয়।।সঞ্জয় বলেন রাজা কর অবগতি।সংগ্রামেতে পরাভব পাইল পাণ্ডুপতি।।শিবিরে আইল রাজা হৈয়া দুঃখমন।সভা করি সভাতে বসিল সর্ব্বজন।।ভীমসেন ধনঞ্জয় মাদ্রীর নন্দন।আর সবে বসিলেন মহাযোধগণ।।ঘটোৎকচ বিরাট দ্রুপদ নরপতি।ধৃষ্টদ্যুন্ন সাত্যকি আদি যদুবংশপতি।।সভা করি নিভৃতে বসিল সর্ব্বজন।গোবিন্দে চাহিয়া বলে ধর্ম্মের নন্দন।।অবধান শুন দেব যাদব-ঈশ্বর।অকারণে ভীষ্ম সহ বাড়াইলা সমর।।মহারাজা দুর্য্যোধন অনেক সহায়।জিনিবারে কার শক্তি আছয়ে তাহায়।।আপন উপায় কিছু না চিন্তি অন্তরে।পিপীলিকার পাখা যেন মরিবার তরে।।ভুবনবিজয়ী বীর গঙ্গার নন্দন।বাণেতে জর্জ্জর সব কৈল সৈন্যগণ।।ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি মহারথী যত যত।বাণেতে জর্জ্জর সব কৈল সৈন্যগণ।।ধৃষ্টদ্যুম্ন আদি মহারথী যত যত।বাণেতে সবারে ভীষ্ম করিল ব্যথিত।।মহারথী পদাতিক যত সৈন্যগণ।কথঞ্চিত প্রাণ লয়ে আছে সর্ব্বজন।।ভীষ্ম সেনাপতি আর দুর্জ্জয় কৌরব।কাহার শকতি তারে করে পরাভব।।আপন উপায় আমি চিত্তে না গণিনু।আগু পাছু না গণিয়া যুদ্ধে প্রবেশিনু।।আজ্ঞা কর জগন্নাথ করি পরিহার।যুদ্ধে কার্য্য নাহি যাব অরণ্য ভিতর।।হৃদয়ে ভাবিয়া তবে কহে যদুবীর।কেন এত ভাব তুমি রাজা যুধিষ্ঠির।।তুমি হেন মহারাজা নৃপতি-প্রধান।তুমি হেন বল রাজা কি বলিব আন।।ক্ষত্রধর্ম্ম শাস্ত্রমত জান সর্ব্বনীত।জানিয়া শুনিয়া কেন রণে হও ভীত।।পূর্ব্বাপর আছে কহে শাস্ত্রের বিধান।গুরু লঘু সংগ্রামেতে একই সমান।।মাতুল শ্বশুর পিতা ভাই বন্ধুজন।জ্যেষ্ঠতাত পিতামহ আদি গুরুগণ।।শিক্ষা দীক্ষা দ্বিজ মুনি গুরু যত জন।যে হউক সংগ্রামেতে করিব নিধন।।ইহাতে অধর্ম্ম নাহি বেদের বচন।জানিয়া শুনিয়া কেন হও ভীত মন।।স্বরূপ কহিল ভীষ্ম গঙ্গার কোঙর।সংগ্রামে দুর্জ্জয় বীর যমের সোসর।।কাহার শকতি তারে করিতে নিধন।তার মৃত্যু পূর্ব্বে আমি করেছি চিন্তন।।উপায়ে মারিব ভীষ্মে নয়নে দেখিবে।প্রকারেতে দ্রোণাচার্য্য নিধন হইবে।।প্রকারেতে সবারে পাঠাব যমালয়।আমার বচন রাজা কভু অন্য নয়।।আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে ক্ষিতি জলে ভাসে।তথাপি বচন মোর না হয় বিনাশে।।চন্দ্র-সূর্য্য-পাত হয় দৃষ্টি নাহি চলে।তথাপি বচন মোর নহিবে বিফলে।।এত বলি প্রবোধিল ধর্ম্মের নন্দনে।ধৃষ্টদ্যুন্ন প্রতিজ্ঞা করিল ততক্ষণে।।কালিকে সংগ্রামে মোর দেখিবে প্রতাপ।মত্ত হস্তী প্রহারয়ে হেন ক্ষুদ্র সাপ।।দ্রোণাচার্য্যে বাণে কালি করিব নিধন।আমার প্রতিজ্ঞা কভু না হয় খণ্ডন।।তবে ভীম ধনঞ্জয় আদি বীরগণে।প্রতিজ্ঞা করিল সবে কৌরব-নিধনে।।সঞ্জয় বলেন, শুন অম্বিকা-নন্দন।রজনী প্রভাত কালে কুরু-পাণ্ডুগণ।।দুই দলে সাজে নানা বাদ্যগণ বাজে।বাদ্যের শবদে কম্প হৈল সর্ব্বরাজে।।ডগর ডিণ্ডিমি বাজে কাংস্য করতাল।অসংখ্যা দুন্দুভি বাজে বাহুক রসাল।।ভেরী ঝাঝরী আদি বাজে বাদ্যগণ।দুই দলে বাদ্য বাজে না যায় লিখন।।রথী মহারথী গজ পদাতি প্রচণ্ড।আসোয়ার হাতে গদা খড়্গ যমদণ্ড।।লক্ষ লক্ষ মহারথী সঙ্গে আশোয়ার।ব্যূহের অগ্রেতে ভীষ্ম গঙ্গার কুমার।।বাম শৃঙ্গে কৃতবর্ম্মা বীর সোমদত্ত।দক্ষিণ শৃঙ্গেতে ভগদত্ত মহাসত্ত্ব।।দ্রোণ অশ্বত্থামা আর প্রতীপ-নন্দন।ভূরিশ্রবা সুশর্ম্মাদি যত রাজগণ।।ভীষ্মের রক্ষক পাশে সংগ্রামে নির্ভয়।মধ্যে দুর্য্যোধন রাজা গান্ধারী তনয়।।ঊনশত সহোদর সঙ্গে পরিবার।মহাবীর্য্যবন্ত রণে যম-অবতার।।ব্যূহ করি সাজিলেন কুরু-নরপতি।শুনি অর্জ্জুনেরে আজ্ঞা দিল পাণ্ডুপতি।।শীঘ্রগতি ব্যূহ করি সাজহ সত্বর।কুরুবীরগণেরে পাঠাও যমঘর।।আজ্ঞামাত্র ধনঞ্জয় মহাবিচক্ষণ।রচিল বিচিত্র ব্যূহ না হয় বর্ণন।।যথাযথ স্থানেতে রহিল বীরগণ।বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল গগন।।দুই দলে দিব্য অস্ত্র করে বরিষণ।প্রলয়ের কালে যেন বর্ষে ঘোর ঘন।।মহাবীর ধনঞ্জয় সংগ্রামে প্রচণ্ড।হাতেতে গাণ্ডীব ধনু যেন যমদণ্ড।।দিব্যমূর্ত্তি অঙ্গ শ্যাম রাজীবলোচন।বিচিত্র কবচ অঙ্গে অরুণ বরণ।।পূর্ণবিধু-মুখচন্দ্র সুকোমল তনু।বিচিত্র কুণ্ডল কর্ণে যেন শোভে ভানু।।ততোধিক রূপ কৃষ্ণ দেবকীনন্দন।কপিধ্বজ রথখান বিচিত্র শোভন।।ব্যুহের অগ্রেতে হৈলা বীর ধনঞ্জয়।প্রভাতে সূর্য্যের যেন হইল উদয়।।দেখিয়া মোহিত হৈল কুরু-সৈন্যগণ।আছুক যুদ্ধের কার্য্য হৈল অচেতন।।দ্রোণের অগ্রেতে হৈল ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।বিচিত্র কবচ অঙ্গে সংগ্রামে সুধীর।।ধৃষ্টদ্যুন্নে দেখি বীর সংগ্রামে প্রচণ্ড।হাতেতে লইল যেন কাল যমদণ্ড।।আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।মহাশব্দ হৈল যেন পর্ব্বত বিদার।।এক কালে লক্ষ লক্ষ শঙ্খের নিঃস্বন।দুই দলে প্রবেশিল করিবারে রণ।।অন্য অন্য সৈন্যেতে হইল হানাহানি।দুই দলে রনে পড়ে অনেক বাহিনী।।অনেক পড়িল রথী রথ আশোয়ার।কোটী কোটী মত্তগজ পদাতি অপার।।ধ্বজচ্ছত্র পতাকায় মেদিনী পূরিল।অশোক কিংশুক যেন বসন্তে ফুটিল।।কনক-কুণ্ডল মণি-মুকুট অপার।কেয়ূর কনক দিব্য মণি-রত্ন হার।।কোটী কোটী বীর দুইদলে দিল হানা।খরস্রোতে বহে নদী রুদিরের ফেণা।।নর-গজ-মুণ্ড ভাসে রকত-উপর।অসংখ্য কর্দ্দমে লুঠে হাতে ধনুঃশর।।তবে দ্রোণ মহাবীর হাতে ধনুঃশর।হানয়ে পাঞ্চাল সৈন্য সংগ্রাম ভিতর।।শুষ্ক বন দহে যেন কালাগ্নি অনলে।ভঙ্গ দিল সৈন্য দেখি দ্রোণ মহাবলে।।ক্রোধ হৈল ধৃষ্টদ্যুন্ন সংগ্রাম ভিতরে।নানা অস্ত্র বৃষ্টি করে দ্রোনের উপরে।।শেল শূল শক্তি জাঠা মুষল মুদগর।ভৈরব পরিঘ আদি অসংখ্য তোমর।।অস্ত্রে অস্ত্র কাটি দ্রোণ কৈল নিবারণ।বায়ুতে উড়ায় যেন মেঘ বরিষণ।।বাণ কাটি দ্রোণ বীর পূরিল সন্ধান।বাণেতে কাটিয়া রথ কৈল খান খান।।কবচ ভেদিয়া বাণ অঙ্গে প্রবেশিল।বজ্রেতে পর্ব্বত যেন ইন্দ্রে বিদারিল।।সর্ব্বাঙ্গে রুধির বহে হৈল অচেতন।রথ লৈয়া সারথি পলায় ততক্ষণ।।দ্রোণের বিক্রমে স্থির নহে কোনজন।ভঙ্গ দিল পাঞ্চালের যত সৈন্যগণ।।হাহাকার শব্দ হৈল পাণ্ডবের দলে।প্রলয় সময়ে যেন সমুদ্র উথলে।।আশ্বাসিয়া সর্ব্বসৈন্যে বীর বৃকোদর।দ্রোণশিষ্য প্রবেশিল করিতে সমর।।দিব্য দিব্য বাণ বীর করে বরিষণ।ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি বীর পবন-নন্দন।।নলবন ভাঙ্গে যেন মত্ত করিবর।কেশরী বিহরে যেন গজেন্দ্র উপর।।একেশ্বর দ্রোণ সৈন্য কৈল লণ্ডভণ্ড।ক্ষুদ্র মৃগী মারে যেন কেশরী প্রচণ্ড।।শত শত গজ বাজি পদাতি অপার।সংহারিল বৃকোদর পবন কুমার।।ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ভীম পবন নন্দন।ভীমে দেখি ভঙ্গ দিল সর্ব্বসৈন্যগণ।।ভঙ্গ দিল দ্রোণ শল্য কেহ নাহি রয়।ক্রোধ করি আইল অশ্বত্থামা মহাশয়।।ডাক দিয়া বৃকোদরে বলিল বচন।ক্ষণেক রহিয়া যুদ্ধ করহ এখন।।ক্ষুদ্র জীব মারি তোর এত অহঙ্কার।আমার হস্তেতে আজি হইব সংহার।।এত বলি অশ্বত্থামা পূরিল সন্ধান।বাণে বাণ কাটিয়া করিল খান খান।।পুনর্ব্বার অশ্বত্থামা পূরিল সন্ধান।ভীমের উপরে মারিলেক দশ বাণ।।দশ গোটা বাণ আসে কাল-সহচর।মহাশব্দ করি আসে ভীমের উপর।।হাসি বৃকোদর বীর পূরিল সন্ধান।বাণে বাণ হানিয়া করিল দুইখান।।বাণ ব্যর্থ গেল বীর হৈল ক্রোধ মন।পুনরপি দিব্য অস্ত্র করে বরিষণ।।একেবারে ছাড়ে বীর সহস্র তোমর।অস্ত্রমুখে বৃষ্টি হয় মুষল মুদগর।।অস্ত্র দেখি পাণ্ডুসৈন্য বিস্ময় হইল।হাহাকার করি সবে প্রমাদ গণিল।।আকাশে আইসে যেন প্রলয়-তপন।বজ্রের নিঃস্বন শুনি অস্ত্রের গর্জ্জন।।মহাবীর বৃকোদর সমরে প্রচণ্ড।ভল্ল বাণে অস্ত্র কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।।আকাশেতে প্রশংসা করয়ে দেবগণ।সাধু বৃকোদর বীর পবন নন্দন।।তবে ভীম মহাবীর পূরিল সন্ধান।অশ্বত্থামা উপরে মারিল দশ বাণ।।চারি বাণে ধ্বজচ্ছত্র কাটিয়া পাড়িল।দুই বাণে সারথিরে যমঘর নিল।।বিরথ হইয়া বীর ক্রোধিত অন্তরে।গদা ঘুরাইয়া বীর যায় মারিবারে।।চারি অশ্ব মারিল মারিয়া গদাবাড়ি।সারথিরে গদাঘাতে ভূমিতলে পাড়ি।।সারথি তুরঙ্গ রথ চূর্ণ হৈয়া গেল।গদা হাতে করি বীর ভূমিতে নামিল।।অশ্বত্থামা-ভীম দোঁহে হৈল মহারণ।দোঁহাকার গদাযুদ্ধ না হয় গণন।।কতক্ষণে দুইজনে গদা প্রহারিল।মাথে হানি দুই বীর ভূমিতে পড়িল।।শীঘ্রগতি আনি রথ যোগায় সারথি।রথে করি নিল অশ্বত্থামা মহারথী।।সর্ব্বাঙ্গে রুধির বহে পবন নন্দন।তথাপি অক্ষম বীর নহে কদাচন।।ভয়ঙ্কর গদা হাতে দুর্জ্জয় শরীর।মস্তক ভাঙ্গিয়া কারো বুক কৈল চির।।গদার প্রহারে মারে লক্ষ লক্ষ বীর।ভীমের বিক্রমে ভঙ্গ দিল কুরুবীর।।ক্রোধ হৈল দ্রৌণিবীর সমর ভিতরে।শত শত বাণ মারে ভীমের উপরে।।গদা ফিরাইয়া অস্ত্র কৈল নিবারণ।বায়ুতে ভাঙ্গিল যেন মেঘ বরিষণ।।শীঘ্রগতি রথ আনি যোগায় সারথি।লাফ দিয়া উঠে তাহে ভীম মহারথী।।জয়বাদ্য বাজাইল পাণ্ডবের দলে।নানা অস্ত্রবৃষ্টি তবে করে কুতূহলে।।ভীমের বিক্রমে কুরুগণ নহে স্থির।ক্রোধ হৈয়া আগু হৈল ভূরিশ্রবা বীর।।ভূরিশ্রবা দেখি সহদেব লৈল বাণ।বৃহন্নল ধেয়ে তার কৈল পরিত্রাণ।।বৃহন্নল সহদেবে হৈল মহারণ।দোঁহে দোঁহাপরি কৈল বাণ বরিষণ।।ক্রোধ হয়ে সহদেব সমর ভিতরে।অষ্টবাণে বিন্ধে বৃহন্নল-কলেবরে।।চারি বাণে ধ্বজচ্ছত্র কাটিয়া পাড়িল।দুই বাণে সারথিরে পরাণে মারিল।।গদা হাতে করি বীর ভূমেতে পড়িল।বেগে ধেয়ে সহদেবে মারিতে আইল।।খুরুপা বাণ সহদেব এড়িল প্রচণ্ড।বৃহন্নল বীরেরে করিল খণ্ড খণ্ড।।মহাবীর বৃহন্নল পড়িল সমরে।তার ভাই বৃহদ্রথ আইল ক্রোধভরে।।ডাক দিয়া সহদেবে বলয়ে বচন।তোমার শোণিতে ভায়ের করিব তর্পণ।।এত বলি আকর্ণ পূরিয়া এড়ে বাণ।অষ্টক তোমর মারে পূরিয়া সন্ধান।।শূন্যেতে উঠিল অস্ত্র প্রলয় প্রচণ্ড।রথধ্বজ কাটিয়া করিল খণ্ড খণ্ড।।চারি অশ্ব মারিল মারিয়া চারি বাণ।দুই বাণে সারথিরে কৈল চারিখান।।অর্দ্ধচন্দ্র বাণে তার শিরশ্চেদ কৈল।রথ হৈতে বৃহদ্রথ ভূমেতে শোভিল।।একস্থানে দুইজন সমরে পড়িল।সুমেরুর শৃঙ্গ যেন ভূমেতে পড়িল।।হাহাকার শব্দ হৈল কৌরবের দলে।হাতে বস্ত্র সহদেব নাচে কুতূহলে।।সহদেবের বিক্রমে ত্রাসিত কুরুগণ।ক্রোধ হৈল ভীষ্মবীর গঙ্গার নন্দন।।মহাবীর গঙ্গাপুত্র সমরে প্রচণ্ড।পাণ্ডবের সৈন্যগণে কৈল খণ্ড খণ্ড।।দিব্য অস্ত্র মারে বীর পূরিয়া সন্ধান।একবারে এড়ে বীর শত শত বাণ।।শত শত মহারথী পড়য়ে সমরে।শরজালে অন্ধকার করিল অম্বরে।।দ্বিতীয় প্রহর যুদ্ধ না হয় বর্ণন।দুই জনে যুদ্ধ করে নহে নিবারণ।।রথী রথী মহাযুদ্ধ পদাতি পদাতি।আশোয়ারে আশোয়ারে মত্তে মত্তহাতী।।দুই দলে কোলাহল কৌরব-পাণ্ডব।প্রলয়ের কালে যেন উথলে অর্ণব।।এইরূপ দুই দলে হৈল হানাহানি।লিখিতে না পারি যত পড়িল বাহিনী।।বীরের মস্তকেতে ছাইল রণস্থলী।পড়িল অনেক সৈন্য আথালি পাথালি।।রথ-ধ্বজ-পতাকায় ছাইল মেদিনী।মুকুট কুণ্ডল হার নানা রত্ন মণি।।মহাবল ভীষ্মবীর গঙ্গার কোঙর।পাণ্ডবের বহু সৈন্য করিল সংহার।।ভীষ্মের বিক্রম সহে নহি হেন বীর।ভঙ্গ দিল সৈন্যগণ রণে নহে স্থির।।কৃষ্ণেরে চাহিয়া পার্থ বলয়ে বচন।শীঘ্রগতি লহ রথ যাদব-নন্দন।।কালাগ্নি সমান শিক্ষা ভীষ্ম মহাবল।তাঁহার সংগ্রামে ভাঙ্গে পাণ্ডবের দল।।শীঘ্রগতি লহ রথ ভীষ্মের সম্মুখে।আজি যুদ্ধে তাঁহারে পাঠাব যমলোক।।এত শুনি শীঘ্র রথ লয় নারায়ণ।পার্থে দেখি আগে হৈল গঙ্গার নন্দন।।ভীম্মার্জ্জুনে সমাগম হৈল দুই জন।দোঁহাকার অস্ত্রবৃষ্টি না হয় বর্ণন।।শিলীমুখ সূচীমুখ পরিঘ তোমর।অর্দ্ধচন্দ্র ভল্ল আদি মুষল মুদগর।।অজমুখ রুদ্রঅস্ত্র যেবা যত জানে।দোঁহার উপরে দোঁহে বর্ষে অনুক্ষণে।।তবে ভীষ্ম মহাবীর পূরিল সন্ধান।অর্জ্জুনের উপরে এড়িল রুদ্রবাণ।।পঞ্চরুদ্র নাম বাণ মহাভয়ঙ্কর।ঘোর শব্দে আইসে বাণ অর্জ্জুন-উপর।।হাসিয়া অর্জ্জুন বীর পূরিল সন্ধান।ব্রহ্মঅস্ত্র এড়ি অস্ত্র কৈল খান খান।।তবে পার্থ ইন্দ্রদত্ত ভল্ল দিব্য শর।আকর্ণ পূরিয়া এড়ে ভীষ্মের উপর।।মহাশব্দে আইসে অস্ত্র গগন-মণ্ডলে।প্রলয়ের কালে যেন সমুদ্র উথলে।।শীঘ্রহস্তে মহাবীর গঙ্গার নন্দন।ব্রহ্মঅস্ত্রে অস্ত্র কাটি কৈল নিবারণ।।অস্ত্র ব্যর্থ গেল পার্থ লজ্জা পাইল মনে।সহস্র তোমর ক্রোধে মারে ততক্ষণে।।নিমিষেকে হৈল গগনেতে অন্ধকার।শরে আবরিল ভীষ্মে না দেখি যে আর।।আকাশেতে প্রশংসা করয়ে দেবগণ।ধন্য কুন্তী গর্ভে ধরে দুর্জ্জয় অর্জ্জুন।।তবে ভীষ্ম দিব্য অস্ত্র এড়ে ততক্ষণ।শরে শর কাটিয়া করিল নিবারণ।।দিব্য অস্ত্র পুনরপি করিল সন্ধান।অর্জ্জুনের শরীরে বিন্ধিল দশ বাণ।।একশত বাণ মারে কৃষ্ণের শরীরে।পঞ্চ বাণ মারে তার ধ্বজের উপরে।।চারি বাণে চারি অশ্ব বিন্ধে ততক্ষণ।দুই বাণে হাতের কাটিল শরাসন।।ধনঞ্জয় অষ্ট গোটা তোমর এড়িল।সেই ঘায়ে গঙ্গাপুত্র অচেতন হৈল।।কবচ ভেদিয়া অস্ত্র ফুটিল শরীরে।মূর্চ্ছা হৈল ভীষ্ম বীর রক্ত পড়ে ধারে।।শীঘ্রহস্তে ধনঞ্জয় পাইল অবসর।নানা অস্ত্র এড়ে কুরুসৈন্যের উপর।।শেল শূল শক্তি জাঠা মুষল মুদগর।ভল্ল ভূষণ্ডি গদা পরিঘ তোমর।।অজমুখ শঙ্খ কঙ্কু বাণ কর্ণিকার।রুদ্রমুখ ক্ষুদ্রমুখ নারাচ অপার।।শেল সূচীমুখ আদি নানা অস্ত্রগণে।জলবৃষ্টি সম এড়ে ইন্দ্রের নন্দনে।।অক্ষয় যুগল তূণ পূর্ণ বাণময়।কিছু ক্ষয় নহে যত বিন্ধে তত হয়।।মারিল যতেক সৈন্য না হয় লিখন।অশ্ব হস্তী পদাতিক না যায় গণন।।পড়িল যতেক সৈন্য সমর ভিতরে।অশ্ব হস্তী পদাতিক ভাসে রক্তোপরে।।সন্ধ্যাকালে দুই দলে হৈল মহারণ।দুই দলে বহু সৈন্য হইল নিধন।।কাটা গেল পদ কারো কারো হাত শির।মধ্যে মধ্যে কোন বীর হৈল দুই চির।।ভয়ঙ্কর দেখি রণভূমি লাগে ভয়।অসংখ্য কবন্ধ উঠে হাতে ধনু লয়।।শ্মশান সদৃশ হৈল নাচে প্রেতগণ।শকুনি গৃধিনীগণে ছাইল গগন।।শতধারে মহানদী বহে রক্তজল।শৃগাল কুক্কুরগণ করে কোলাহল।।অস্ত গেল দিবাকর প্রবেশিল রাতি।দুই দল চলি গেলা যে যার বসতি।।মুনি বল জন্মেজয় কর অবধান।তৃতীয় দিবস যুদ্ধ হৈল সমাধান।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হয় দিব্য জ্ঞান।।মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদদ্বন্দ্ব।কাশীরাম দেব কহে পয়ার প্রবন্ধ।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon