মহাভারত:শান্তিপর্ব:০০১-০০৫

০১. যুধিষ্ঠিরের প্রতি ব্যাসের উপদেশ
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয়, কহ তপোধন।
অতঃপর কি করিলা পিতামহগণ।।
কিরূপে বৈভব ভোগ কৈল পঞ্চজন।
কিবা ধর্ম্ম উপার্জ্জিল পালি প্রজাগণ।।
শরশয্যাগত ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
কি হেতু উত্তরায়ণে ত্যজেন জীবন।।
কিবা যোগধর্ম্ম কহিলেন যুধিষ্ঠিরে।
বিস্তার করিয়া মুনি বলহ আমারে।।
মুনি বলে, অবধান করহ রাজন।
হস্তিনা নগর মাঝে ধর্ম্মের নন্দন।।
মহাধর্ম্মশীল রাজা প্রতাপে তপন।
শীলতায় চন্দ্র যেন, তেজে বৈশ্রবণ।।
সর্ব্বত্র সমান ভাব গুণে গুণধাম।
প্রজার পালনে যেন পূর্ব্বে ছিল রাম।।
নানা বাদ্য বাজে সদা শুনিতে কৌতুক।
হস্তিনা নগরবাসী সবাকার সুখ।।
জ্ঞাতি বন্ধুজন সবে সতত আনন্দ।
মহারাজ বিদ্যাশীল সকলি স্বচ্ছন্দ।।
রাজার প্রসাদে রাজ্যে সর্ব্বলোকে সুখী।
মৌন হয়ে মহারাজ রহে অধোমুখী।।
নাহি রুচে অন্নজল কান্দিয়া ব্যাকুল।
পাত্র মিত্র ভ্রাতা আদি ভাবিয়া আকুল।।
নৃপতির শোকে শোকাতুর সর্ব্বজন।
একদিন ভীম পার্থ মাদ্রীর নন্দন।।
পাত্র মিত্র বন্ধু আর ধৌম্য তপোধন।
নানামতে নৃপে করে প্রবোধ অর্পণ।।
অনেক প্রকারে সবে বুঝায় রাজারে।
যোগমার্গ কথা কহি অনেক প্রকারে।।
না শুনেন কারো বাক্য রাজা যুধিষ্ঠির।
ভীষ্ম পিতামহ-শোকে আপনি অস্থির।।
জলহীন হয় যেন কমলের বন।
বৃহস্পতি বিনা যেন সহস্রলোচন।।
সূর্য্যের অভাবে যেন কমলের দল।
ভীষ্ম দ্রোণ বিনে তেন নৃপতি সকল।।
নিরবধি এই চিতে চিন্তেন রাজন।
চাহেন আপন দেহ করিতে নিধন।।
অনাহারে বিষাদিত ক্ষীণ কলেবর।
জানিয়া রাজার কষ্ট ব্যাস মুনিবর।।
অতি শীঘ্র আসিলেন বাজার সদন।
উচিত বিধানে পূজা করেন রাজান।।
পাদ্য অর্ঘ্য দেন, বসিবারে সিংহাসন।
সুবাসিত জলে করি পাদ প্রক্ষালন।।
সুস্থ হয়ে আসনেতে বসি মহামুনি।
রাজারে বিমনা দেখি জিজ্ঞাসে কাহিনী।।
কি হেতু চিন্তিত রাজা জিজ্ঞাসি তোমারে।
কোন্ সুখে হীন তুমি এই চরাচরে।।
ইন্দ্রের সমান তব চারি সহোদর।
সর্ব্বগুণান্বিত, রণে মহাধনুর্দ্ধর।।
বাহুবলে শত্রুগণে করিয়া সংহার।
হস্তিনাতে অভিষেক করিল তোমার।।
সবে অনুগত তব ভ্রাতা-বন্ধুগণ।
কিঙ্কর সদৃশ সবে করয়ে সেবন।।
সংসারের হর্ত্তা কর্ত্তা দেব জগৎপতি।
আজ্ঞাকারী তব, সদা খ্যাত বসুমতী।।
তেজে যশে বলে ধর্ম্মে প্রজা পালনেতে।
তোমার সদৃশ রাজা নাহি পৃথিবীতে।।
ইহা শুনি প্রণমিয়া কহেন ভূপতি।
আমার দুঃখের কথা শুন মহামতি।।
জগতে না জন্মে পাপী সদৃশ আমার।
রাজ্যলোভে জ্ঞাতি বন্ধু করেছি সংহার।।
কল্পতরু পিতামহ ভীষ্ম কুরুনাথ।
রাজ্যভোগ হেতু তাঁরে করেছি নিপাত।।
দ্রোণ গুরু আদি যত সুহৃদ সুজন।
সংহার করিনু আমি, রাজ্যের কারণ।।
এ তনু রাখিয়া আর কিবা প্রয়োজন।
মহাপাপ করিলাম ভোগের কারণ।।
এই হেতু অনাহারে আপনার কায়।
করিব নিপাত আমি, আছি এ আশায়।।
মুনি বলে, অবধান কর জন্মেজয়।
এত শুনি হাসি বলে ব্যাস মহাশয়।।
ধর্ম্মশাস্ত্রজ্ঞাতা তুমি ধর্ম্মের নন্দন।
জ্ঞানবান হয়ে, হেন কহ কি কারণ।।
অনন্ত প্রকার জ্ঞান বেদের বচন।
তাহা পাসরিলে কেন না বুঝি কারণ।।
অনন্ত প্রকার জ্ঞান বেদের বচন।
তাহা পাসরিলে কেন না বুঝি কারণ।।
জ্ঞান হতে লভে ধর্ম্ম, জ্ঞানে পাপ খণ্ডে।
জ্ঞানের প্রতাপে সবে তরে যমদণ্ডে।।
অনন্ত লোচন জ্ঞান শুন মহাজন।
তোমাতে সে দিব্যজ্ঞান আছে হে রাজন।।
কহিলে যে মহাপাপ কৈলে উপার্জ্জন।
জ্ঞাতিবধ মহাপাপ কহে সর্ব্বজন।।
তার হেতু কহি রাজা শুন দিয়া মন।
ধার্ম্মিক জনের পাপ নহে কদাচন।।
তুলারাশি সম পাপ শুনহ রাজন।
ধর্ম্মের প্রতাপে ভস্ম হয় সেইক্ষণ।।
সংসারের হর্ত্তা কর্ত্তা দেব দামোদর।
যাঁর নাম লৈলে পাপহীন হয় নর।।
যাঁর নাম কীর্ত্তন শ্রবণ দরশনে।
অশেষ পাপীর পাপ খণ্ডে সেইক্ষণে।।
সদাকালে সঙ্গে রাজা সেই নারায়ণ।
কেন যুদ্ধে পাপ-ভয় চিন্তহ রাজন।।
কি হেতু আপন প্রাণ চাহ ছাড়িবারে।
আত্মহত্যা সম পাপ নাহিক সংসারে।।
ব্রহ্মবধ নারীবধ গোহত্যা কারণ।
ইহাতে নিষ্কৃতি আছে বেদের বচন।।
আত্মহত্যা পাপে রাজা নাহিক নিষ্কৃতি।
আগম পুরাণ যত বেদের ভারতী।।
জানিয়া শুনিয়া হেন চিন্তহ রাজন।
যদি বা আছয়ে রাজা ভ্রান্ত তব মন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, পরলোকে তরি।।
০২. ব্যাস কর্ত্তৃক মার্কণ্ডেয় উপাখ্যান কথন
এরূপ কহিয়া পুনঃ কহে ব্যাসমুনি।
ধৈর্য্য হও নরপতি ইতিহাস শুনি।।
যথায় সংযোগ হয় রিপুজ্ঞান কর।
মরিয়া সকলে তারা গেল স্বর্গপুর।।
জন্মিলে অবশ্য রাজা আছয়ে মরণ।
অহঙ্কারে অবশ্য ত আছয়ে পতন।।
অহঙ্কার করি সবে অল্পায়ু হইল।
অধর্ম্ম করিয়া তারা আপনি মরিল।।
তার সাক্ষী দেখ তুমি আপন সমীপে।
ধর্ম্মে পরমায়ু বাড়ে আর বাড়ে জপে।।
এই বসি আছেন মার্কণ্ড মুনিবর।
ইহার পরমায়ু ছিল দ্বাদশ বৎসর।।
অল্পকালে সর্ব্বশাস্ত্র পড়িল মার্কণ্ডে।
সরস্বতী বশ কৈল আপনার তুণ্ডে।।
বিচারি জ্যোতিষ শাস্ত্র আপনি গণিল।
দ্বাদশ বৎসর আয়ু গণিয়া পাইল।।
তবে মনে ভাবিয়া মার্কণ্ড তপোধন।
ত্যজিয়া ত গৃহবাস তপে দিল মন।।
তাঁর সম তপস্যা না করে কোন জন।
মৃত্যু খণ্ডাইল সেই তপের কারণ।।
তবে রাজা যুধিষ্ঠির পুছিল ব্যাসেরে।
মৃত্যু খণ্ডাইল মুনি কিমত প্রকারে।।
ব্যাস কহে, শুন রাজা কহি যে তোমারে।
যেই মতে মৃত্যু খণ্ডে সংসার ভিতরে।।
তপ করে মার্কণ্ডেয় নাহি জানে আর।
হেনমতে গেল বর্ষ সহস্র হাজার।।
সমাধি লাগিল সেই মুনির শরীরে।
উই ঢিপি জন্মি তবে বেড়িল তাহারে।।
তাহার উপরে বৃক্ষ বড়ই হইল।
মৃগ পশু ব্যাঘ্র আদি তথায় বঞ্চিল।।
নানা জাতি পক্ষী থাকে বৃক্ষের উপর।
বটবৃক্ষ হয় সেই বহুত বিস্তার।।
পুরাতন লোক কেহ বলিতে না পারে।
কত কাল বটবৃক্ষ বনের ভিতরে।।
এই মত আছে মুনি মাটীর ভিতর।
তপ ব্রতে গেল ষাটি হাজার বৎসর।।
তার পর বহু মুনি সনে পদ্মাসন।
সেই পথে মুনি সনে করিয়া গমন।।
হাসিতে লাগিল ব্রহ্মা সেই স্থান দেখি।
মনেতে হইলা ব্রহ্মা অতিবড় সুখী।।
তবে মুনিগণ সব পুছিল ব্রহ্মারে।
কি লাগি হাসিলে তুমি কহত সবারে।।
ব্রহ্মা বলে, হাসিলাম যাহার কারণ।
সেই কথা কহি শুন তাহে দেহ মন।।
মৃত্তিকার ভিতরে মার্কণ্ড মুনি তায়।
দ্বাদশ বৎসর আয়ু ষাটি হাজার যায়।।
শিষ্যগণে বলে ব্রহ্মা শুনহ এখনে।
দেখিব মার্কণ্ড মুনি আছেন কেমনে।।
তবে ব্রহ্মা কমণ্ডলু জল ঢালি দিল।
মাটী ফাটি দুই দিকে তখন পড়িল।।
মহাশব্দে দুই বৃক্ষ মাটিতে পড়িল।
মাটিতলে মুনি আছে দেখিতে পাইল।।
মহাতেজোবন্ত মুনি সূর্য্য সম সর।
দেখিয়া ত ব্রহ্মদেব করিলা উত্তর।।
অতঃপর উঠ তুমি কার্য্য নাহি তপে।
তোমার সাক্ষাতে যম আদি প্রাণ কাঁপে।।
মুনি বলে, কবে মোর হইবে মরণ।
তাহা কহ মোর আগে শুনি বিবরণ।।
ব্রহ্মা বলে, ব্রহ্মাণ্ডে যবে অগ্নি ইচ্ছা হবে।
কহিনু তোমারে তুমি তখনি মরিবে।।
যাহ সদ্য বিচারিয়া করহ পুরাণ।
এত বলি ব্রহ্মা গেল আপনার স্থান।।
তবে মুনি উঠিলা করিতে গঙ্গাস্নান।
কমণ্ডলু হাতে করি করিলা পয়াণ।।
গঙ্গা আদি করিয়া যতেক তীর্থজল।
সকল শুকাল, মুনি হইলা বিকল।।
সর্ব্ব নদীগণ দেখে সব বালিময়।
দীঘি পুষ্করিণী সব জল নাহি তায়।।
সপ্ত সাগর মুনি করিলা ভ্রমণ।
ব্রহ্মার মায়াতে জল না পায় তখন।।
তবে মুনি ভাবিতে ভাবিতে পথ যায়।
হাড়িপাড়া নামে তথা এক গ্রাম পায়।।
এক হ্রদ আছে তথা বিপর্য্যর জল।
তাহাতে বিস্তর আছে শূকরের পাল।।
বৃষ্টিময় জল তাহে শূকরে বেষ্টিত।
তাহা দেখি মহামুনি হৈলা আনন্দিত।।
অপ্ নারায়ণ বলি মুনি নামে জলে।
উপনীত হৈল গিয়া শূকরের পালে।।
মাথা তুলি দেখেন শূকর গেল দূর।
কর্দ্দম সদৃশ জল বিকশিত ফুল।।
নীলোৎপল পদ্মগণ সুধাময় নীর।
শূকর নাহিক দেখি হংসময় তীর।।
স্নান দান কৈলা মুনি আনন্দিত হৈয়া।
জল লইলেন কমণ্ডলুতে পূরিয়া।।
বিপ্র-পাদোদক লাগি মহামুনি ফিলে।
বিপ্র-নাহি পায় মুনি সকল সংসারে।।
সপ্তদ্বীপ পৃথ্বী মুনি করিলা ভ্রমণ।
তথাপিহ না পাইল একটী ব্রাহ্মণ।।
পাদোদক বিনা মুনি জল খাইতে নারে।
ব্রাহ্মণ চাহিয়া মুনি ফিরে দ্বারে দ্বারে।।
এইমতে উপনীত হৈল হাড়িপাড়া।
হাতে কমণ্ডলু মুনি তথা হৈল খাড়া।।
দেখিল হাড়িনী এক, দুই পুত্র হয়।
বড় দুগ্ধ হেতু কান্দে ছোট পুত্রে দেয়।।
বড় পুত্র দুগ্ধ চাহে খাইতে না পায়।
ছোট পুত্রে দুগ্ধ দিয়া খাটেতে শোয়ায়।।
তবেত সে হাড়িনী ধুইল দুই স্তন।
বড় পুত্রে কোলে করি লইল তখন।।
তবে সে হাড়িনী তারে দুগ্ধ খাওয়াইল।
তাহা দেখি মুনিবর তখন পুছিল।।
স্তন কেনে ধুইলে তুমি কহত আমারে।
এই দুই পুত্র কার সহ সারোদ্ধারে।।
হাড়িনী কহিল, গোসাঞি করি নিবেদন।
যুবাকালে স্বামী ছিল একই ব্রাহ্মণ।।
তার তেজে পুত্র এই প্রথম হইল।
শেষ পুত্র এই মোর হাড়ি জন্মাইল।।
উচ্ছিষ্ট দুগ্ধ পুত্রে নাহি যায়।
তেকারণে স্তন ধুইনু শুন মহাশয়।।
মুনি বলে, তবে আমি যাইব কোথায়।
কমণ্ডলু জল দিল সেই শিশু পায়।।
হাড়িনী কহিল, গোসাঞি কি করিলে তুমি।
পাদোদক নিলে তুমি কি কহিব আমি।।
তুমি মহা তেজোময় দেখি সূর্য্যসম।
হাড়িজাতি কর্ম্ম মোর পরম অধম।।
মুনি বলে, চিন্তা নাহি শুনি মোর কথা।
বিপ্রপুত্র হয় এই না করিহ চিন্তা।।
এইমত পাদোদক মুনি পাইয়া যায়।
আপনি আসিয়া ব্রহ্মা কহিলা তাহায়।।
অমর হইলা তুমি শুনি মহামুনি।
নাহিক মরণ তব কহিলাম আমি।।
তপোবলে মার্কণ্ডেয় হইল অমর।
ধর্ম্ম বড় কেহ নহে শুন মুনিবর।।
মার্কণ্ডেয় উপাখ্যান যেই জন শুনে।
আয়ুবৃদ্ধি হয় তার বিধির লিখনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
০৩. লোমশ মুনির উপাখ্যান
তবে জন্মেজয় বলে, শুন তপোধন।
তদন্তরে কি হইল কহত এখন।।
ব্যাস বলে, শুন এবে ধর্ম্মের নন্দন।
মৃত্যু হইতে তরিবারে নহে কোন জন।।
আর কথা কহি শুন রাজা যুধিষ্ঠির।
আমার বচনে তুমি চিত্ত কর স্থির।।
পূর্ব্বে দেব যে কালে আমরা নির্ম্মাইল।
বিশ্বকর্মা যত খাটে মনে না লইল।।
প্রতিদিন গড়ে বিশাই প্রতিদিন ভাঙ্গে।
যত তত গড়ে বিশাই করি নানা রঙ্গে।।
ইন্দ্র-মনে নাহি লয় সদা মন্দ বলে।
সহিতে না পারি বিশাই গেল বিষ্ণু স্থলে।।
গোবিন্দের আগে বিশাই কহিল তখন।
সহিতে না পারে বিশাই ইন্দ্রের বচন।।
তবে হরি কহিলেন বিশাইর তরে।
করিব তোমার কার্য্য যাহ তুমি ঘরে।।
আর দিন গেলা হরি দেবের সভাতে।
হরি দেখি সর্ব্ব দেব বন্দে যোড়হাথে।।
ইন্দ্র বলে, বৈস প্রভু আসন উপরে।
কৃষ্ণ বলে, যাইব লোমশ দেখিবারে।।
ইন্দ্র বলে, চল আমি যাব তব সাথে।
দেখিব লোমশ মুনি আছয়ে কিমতে।।
তবে ইন্দ্র গোবিন্দের সঙ্গেতে চলিলা।
মুনির নিকটে তবে দুই জন গেলা।।
মুনিরে প্রণাম কৈল ইন্দ্র আর হরি।
সর্ব্ব অঙ্গে মুনির আছয়ে লোম ভরি।।
তাহার মধ্যেতে আছে একখানি টাক।
দেখিয়া ইন্দ্রের মনে হইল বিপাক।।
মুনিরে পুছেন ইন্দ্র করি নমস্কার।
টাকখানি দেখি কেন বুকের মাঝার।।
মুনি বলে,শুন ইন্দ্র ইহা না কহিব।
তোমাকে কহিয়া ইহা অনর্থ করিব।।
ইন্দ্র বলে, ইহা মোরে কহ মুনিবর।
অবশ্য করিবে তুমি ইহার উত্তর।।
তবে মুনি কহিলেন শুন দেবরাজ।
যে কারণে টাক মোর হৈল বুকমাঝ।।
এক ইন্দ্র মৈলে মোর এক লোমপাত।
এই মত টাক পড়ে শুন দেবনাথ।।
লোম যত আছে মোর তত ইন্দ্র হবে।
তবে সে আমার লোম সকল খসিবে।।
তবে সে আমার শুন হইবে মরণ।
তবে ইন্দ্র বলে শুন আমার বচন।।
তবে কেন তালপত্র-তলে থাক তুমি।
মুনি বলে, কতকাল জীব আর আমি।।
ইহা শুনি দেবরাজে মহাভয় হৈল।
আমা হেন কত ইন্দ্র লুপ্ত হৈয়া গেল।।
তবে তথা হৈতে হরি করিলা গমন।
সুরনাথ মুনিবরে বন্দিলা চরণ।।
অমরাবতীতে গেল ইন্দ্র দেবরাজ।
ইন্দ্র বলে, বিশাই পুরীতে নাহি কাজ।।
এইমত কহিল লোমশ-উপাখ্যান।
যাহার শ্রবণ হৈতে জন্ম দিব্য জ্ঞান।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
০৪. সংসারে জন্ম-মৃত্যু বিষয়ে নরক-রাজার উপাখ্যান
তবে জন্মেজয় কহে, শুন মুনিবর।
তদন্তরে কি হইল কহ অতঃপর।।
মুনি বলে, শুন তবে রাজা জন্মেজয়।
তদন্তরে যে হইল শুনহ নিশ্চয়।।
সংসার প্রসঙ্গ এই বনে যে আছয়।
কহিব অপূর্ব্ব কথা শুন মহাশয়।।
ব্রাহ্মণে কহেন কথা নরকেতে শুনে।
হইবে নরকক্ষয় বেদের বচনে।।
দেহ ধরি জন্ম হয় সংসার ভিতরে।
জরা মৃত্যু আদি লোক সবারে সংহারে।।
সাগর পর্য্যন্ত আছে যত যত জন।
বিধির নির্ণয় তার অবশ্য মরণ।।
প্রথম বয়সে কেহ মরে যুবাকালে।
উত্তম কালেতে কারে মৃত্যুতে সংহারে।।
আসন ভূষণ দেখ উত্তম ভোজন।
রূপবান কুলবান অতি মরোরম।।
সম্পত্তি বিপত্তি সব দেহ সঙ্গে যায়।
কালে সব সংহারিবে কহিনু নিশ্চয়।।
বেশবন্ত মরয়ে, মরয়ে ছদ্মলোক।
বলবন্ত মরয়ে দুর্জ্জনে দিয়া শোক।।
বৈদ্যেতে চিকিৎসা করে সে বা মরে কেনে।
নানান ঔষধি জানে, বৈদ্যশাস্ত্র জানে।।
নারী সব মরয়ে, মরয়ে নপুংসক।
মহা মহা গজ মরে, মরয়ে মশক।।
যোগী সিদ্ধ মরয়ে, মরয়ে বিদ্যাধর।
সিদ্ধ সে মরয়ে জ্বরে শুদ্ধ কলেবর।।
চন্দ্র সূর্য্য ধ্বংস হবে কিরণ যাহার।
আপনি মরিবে ধাতা ব্রহ্মাণ্ড-ঈশ্বর।।
রূপবন্ত আরোগ্য যে সৌভাগ্য সম্পদ।
মরিবে সকল লোকে সম্পদ বিপদ।।
বাঞ্ছয়ে অনেক পুত্র কেনে কার আশ।
বহুপুত্রবন্ত হই করে অভিলাষ।।
ভবিতব্য যেই থাকে ভুঞ্জিবে অবশ্য।
তোমাকে কহিনু এই সংসার রহস্য।।
যেমত যাহার মন তেন তার মতি।
যেমত করিবে কর্ম্ম হবে সেই গতি।।
জন্মিলে মরণ আছে শুনহ রাজন।
পূর্ব্বেতে করিলে যাহা পাইবে এখন।।
যেই জন পূর্ব্বজন্মে পরহিংসা করে।
রহিতে না পারে সেই জন্মমাত্র মরে।।
যন্ত্রণা-কারণ তার হয় গর্ভবাস।
ভূমিষ্ঠ হইলে মাত্র তাহার বিনাশ।।
যত জন্মে পুনঃ পুনঃ ততবার মরে।
নানা দুঃখ পায় সেই হেনমত করে।।
পুণ্যবন্ত লোক যত জন্ময়ে সংসারে।
নানা যজ্ঞ নানা দান সেইজন করে।।
ভারতে জন্মিয়া সেই করে নানা সুখ।
অল্পকালে দেহ ছাড়ে শুনহ কৌতুক।।
বিকা জ্যেষ্ঠ কিবা শ্রেষ্ঠ মরে সর্ব্বজন।
কোনজন চিরজীবী নহে অনুক্ষণ।।
কেহ শাস্ত্র দৃষ্টি করি করয়ে বিচার।
এবিধ কৌতুক দেখ সংসার মাঝার।।
সংসারেতে পুণ্যবন্ত হয় যেই জন।
তার মৃত্যু নষ্ট নয় শুনহ কারণ।।
সেই জন জন্মিয়া কখন নাহি মরে।
কখন সংসারে থাকে কভু স্বর্গপুরে।।
যথা ইচ্ছা তথা থাকে সাধু যেইজন।
জানাইল সাধুজন এই সে কারণ।।
পৃথিবীতে সেই নাহি থাকে বহুদিন।
অল্পকালে মরে সেই না হয় প্রবীণ।।
যার যেইমত ইচ্ছা সেইমত করে।
বলিল যে সাধুজন মরিয়া না মরে।।
স্বর্গে গেলে সাধুজন রহে সেই স্থান।
পৃথিবীতে আসি করে দান যজ্ঞ ধ্যান।।
তপ জপ হয় সদা দান যজ্ঞ হয়।
সেই সে জানিহ সাধু কহিনু নিশ্চয়।।
পাপিজন-তত্ত্ব কহি শুনহ বচন।
তার বুদ্ধি ভাল নাহি হয় কদাচন।।
নষ্টযুক্তি বিনা তার সুষ্ঠুবুদ্ধি নহে।
ধর্ম্মকার্য্য তার গায়ে অগ্নিসম দহে।।
সুজেনের নিন্দা করে ধর্ম্মান্বিত দেখি।
না করে গুরুকে মান্য এই সে নারকী।।
অর্থ উপার্জ্জন করে পেয়ে বহু দুখ।
সেই সে জানিবে পাপী ধর্ম্মেতে বিমুখ।।
মরিলে হারায় সেই আপনার দেহ।
পৃথিবীতে নানা জন্ম হয় আসি সেহ।।
স্থাবর জঙ্গম আদি যত বৃক্ষ আছে।
বিশ লক্ষ বর্ষ সেই জন্ম হয় গাছে।।
তদন্তরে ফিরে সেই জলের ভিতর।
নবলক্ষ বর্ষ সেই হয় জলচর।।
তদন্তরে পক্ষী দশ লক্ষেক বৎসরে।
পক্ষীযোনি হয় সেই পক্ষীর উদরে।।
তারপর একাদশ লক্ষের ভ্রমণ।
নানামত ক্রিমি হৈয়া জন্মে সেইজন।।
এইমত ভ্রমে সেই মাটীর ভিতরে।
তদন্তরে জন্ম হয় পশুর উদরে।।
পৃথিবীর মধ্যে দেখ যত পশু হয়।
ত্রিশ লক্ষ বর্ষ সেই পশুযোনি পায়।।
তার পরে জন্ম হয় মনুষ্যের ঘরে।
চারি লক্ষ জন্ম জন্মে মনুষ্য-উদরে।।
যত যত জাতি আছে ক্রমে জন্ম হয়।
নিজ কর্ম্মার্জ্জিত সেইমত ফল পায়।।
সেই জন্ম পেয়ে যদি ভাল কর্ম্ম করে।
তবে সেই পাপে মুক্ত হয় পুনর্ব্বারে।।
ধর্ম্ম নাহি চিন্তি যেই পাপ করে ঘরে।
তাহার নিস্তার নাই কহিনু তোমারে।।
কহিল চৌরাশী লক্ষ যোনির ভ্রমণ।
এই তত্ত্ব জানে যেই সাধু সেই জন।।
তেনমত সুখ-দুঃখ জানিহ রাজন।
ধর্ম্মপথ-বিজ্ঞ যেই সাধু সেই জন।।
ঔষধি না মানে যেই নিন্দয়ে শাস্ত্রেতে।
আপনাকে স্বয়ং বলি জানে সর্ব্বমতে।।
দুইখানি কাষ্ঠ যেন ভাসাইল জলে।
তেনমত জন্ম হয় এই মহীতলে।।
সকল সংসার মিথ্যা শুন নৃপবর।
অনাথের নাথ কৃষ্ণ চিন্ত গদাধর।।
নারীগণ পতিসেবা করে অনুক্ষণ।
পতি হল হৈলে সবে করয়ে রোদন।।
কাল সংহারিবে সর্ব্ব প্রাণী নাহি দেখে।
কোথা হৈতে কোথা যায় কেহ নাহি লেখে।।
কার পুত্র কার ভ্রাতা কেবা কার পতি।
কেবা কার ভাই হয় কেবা কার মিতি।।
পথের সংযোগ যেন একত্তর হয়।
একযোগে হৈয়া সবে পথে যেন রয়।।
তার পরে যায় যার যথা প্রয়োজন।
আপন আপন কার্য্যে করয়ে গমন।।
সেইমত যায় সবে কেবা কারে রাখে।
বিধির ঘটন যেন একত্তর থাকে।।
সেমত তো মরে রাজা যত বন্ধুজন।
নিজ নিজ স্থানে সবে করিল গমন।।
আপনার কর্ম্ম-ফলে সব জীব ফিরে।
অধর্ম্ম হইলে তোরে ধর্ম্মেতে সংহারে।।
ধর্ম্ম বড় কেহ নহে শুনহ রাজন।
ধর্ম্মবন্ত লোকের কখন নহে মরণ।।
পুরাতন ছাড়িয়া নূতন বস্ত্র পরে।
সেইমত সাধুজন মরিয়া না মরে।।
বাদিয়ার বাজি যেন সংসারের হাট।
আপনি বসিয়া হরি দেখে সব নাট।।
শিশুগণ যেমত ধূলায় খেলে ঘর।
ঘর বাড়ী করি যেন খেলে নিরন্তর।।
সর্ব্ব শিশুগণ যেন একত্র হইয়া।
ধূলি ঘর করি যেন ফিরে বেড়াইয়া।।
সেই খেলা খেলে যেন সর্ব্বজীবগণ।
কেহ নাহি জানে পাছে হইবে মরণ।।
মৃত্যুরূপ আছে এক তাহা নাহি জানে।
শিশুরূপে সর্ব্বজনে ফিরে সর্ব্বস্থানে।।
ধন জন যত দেখ সব সাধারণ।
হরির চরণ বিনে সব অকারণ।।
কপালে আছয়ে ধন দেখিতে না পায়।
যাহা লিখে দেন বিধি সেইমত হয়।।
কপালে লিখয়ে বিধি বসিয়া ত ঘরে।
তাহার অক্ষর কাটে কে আছে সংসারে।।
কপালে সংহার করে বিধি যাহা লিখে।
কোথা থাকে কোথা যায় কেহ নাহি দেখে।।
কুম্ভকার চক্র যেন পাক দিয়া ফিরে।
তেনমত জন্ম-মৃত্যু পাক দিয়া ঘুরে।।
ধর্ম্ম কর্ম্ম নিরন্তর করিবে সদাই।
না ছাড়িবে ধর্ম্মপথ মহাক্লেশ পাই।।
হেন তত্ত্বকথা যদি কহিল ব্রাহ্মণে।
শুনিয়া নরকরাজা শান্ত ততক্ষণে।।
০৫. ধ্রুব উপাখ্যান
শোক ত্যজ ধৈর্য্য কর ধর্ম্ম নরপতি।
নানা সুখ ভোগ কর ভুঞ্জ বসুমতী।।
আর কিছু কহি রাজা মন দিয়া শুন।
করিয়া ত শান্ত মন শুনহ রাজন।।
উত্তানপাদ নামে রাজা পূর্ব্বেতে আছিল।
সুভগা দুর্ভগা তার দুই নারী ছিল।।
উত্তমাদি সাত পুত্র রাজার গোচরে।
সাত পুত্র লৈয়া সিংহাসনের উপরে।।
পুত্র মহারাণী বসি আছে হৃষ্টমনে।
হাস্য ও কৌতুক রাণী করে রাজা সনে।।
নানা রঙ্গ কৌতুকেতে রাজা রাণী থাকে।
সাত পুত্র বসিয়া রাজার কোলে দেখে।।
দেখিয়া ত ধ্রুব তবে চলিল সত্বর।
উঠে গিয়া ধ্রুব সিংহাসনের উপর।।
সিংহাসনে উঠিয়া যাইতে পিতৃকোলে।
হেনকালে রাণী সেই শিশুপ্রতি বলে।।
দুর্ভগার পুত্র তুমি, তোর মাতা দাসী।
কোন্ তেজে ইচ্ছা কর নৃপকোলে বসি।।
আর কভু দেখিলে কপালে দিব ঝাঁটা।
এত মনে সাধ কর দুর্ভগার বেটা।।
সিংহাসনে বসিবারে মনে কর সাধ।
আরাধনা কর তবে গোবিন্দের পাদ।।
এই দেহ ত্যজি যবে মোর পুত্র হবে।
তবে সিংহাসনোপরে বসিতে পাইবে।।
এত শুনি কান্দে ধ্রুব ধূলায় ধূসর।
কান্দিতে কান্দিতে গেল মায়ের গোচর।।
ধ্রুব বলে, মাতা মোরে সতাই মারিল।
সিংহাসন হৈতে মোরে ভূমিতে ফেলিল।।
আর বলে তোর মাতা কৃষ্ণ নাহি ভজে।
রত্ন-সিংহাসনে তুমি বৈস কোন লাজে।।
যত দিনে কৃষ্ণ ভজি শরীর ত্যজিবে।
পুনর্ব্বার তুমি মোর গর্ভেতে জন্মিবে।।
তবে সিংহাসনে তুমি বৈস মোর কোলে।
এই মত সতাই আমারে মন্দ বলে।।
শুনিয়া বচন রাণী বলিল ধ্রুবেরে।
কৃষ্ণ নাহি ভজি আমি জন্ম-জন্মান্তরে।।
দুর্ভগার পুত্র তুমি শুনহ বচন।
ভাল বৈল কর তুমি কৃষ্ণের ভজন।।
কৃষ্ণ ভজ পুত্র তুমি কৃষ্ণ সর্ব্বোপর।
ভালই বলিল সতাই তোমারে উত্তর।।
ভজন করহ পুত্র শ্রীকৃষ্ণ চরণ।
কৃষ্ণ বিনে উচ্চ পদ দিবে কোন্ জন।।
কত বড় উচ্চ তব পিতৃ-সিংহাসন।
ত্রৈলোক্য উপর ভজ শ্রীকৃষ্ণ-চরণ।।
শুনিয়া মায়ের পদে কৈল নমস্কার।
শ্রীকৃষ্ণে ভজিতে যায় দুর্ভগা-কুমার।।
পঞ্চবৎসরের শিশু তখনি চলিল।
কৃষ্ণ ভজিবার হেতু দেশ ছাড়ি গেল।।
পথেতে যাইতে নারদ সহ দরশন।
মুনি বলে, কোথা যাহ উত্তান-নন্দন।।
দণ্ডবৎ করি বলে ধ্রুব মহামতি।
কৃষ্ণের উদ্দেশে যাই কৃষ্ণ মোর গতি।।
নারদ বলিল, তুমি দুগ্ধমুখ শিশু।
সাধন-ভজন তুমি নাহি জান কিছু।।
গুরু নাহি কর তুমি শুনহ বচন।
কি মতে পাইবে হরি কঠিন ভজন।।
ধ্রুব বলে, যে হয় সে হয় এই কথা।
গোবিন্দ-উদ্দেশে যাই কহিনু সর্ব্বথা।।
কার্য্য সিন্ধ হয় কিম্বা দেহ হয় পাত।
যদি নাহি দরশন দেন জগন্নাথ।।
নিষ্ঠা দেখি মুনি মন্ত্র দিলেন ধ্রুবেরে।
অষ্টাদশ উপাসনা করাইলেন তারে।।
তবে ধ্রুব চলি গেল দণ্ডবত করি।
যমুনার কূলে গিয়া স্নান দান করি।।
ত্রিভঙ্গ হইয়া ধ্রুব এক পদে ভর।
তপস্যা করয়ে ধ্রুব চিন্তে গদাধর।।
অনাহারে তপ করে বনের ভিতরে।
বাতাহার করি তপ দ্বাদশ বৎসরে।।
তার তপ দেখি ভয় হৈল দেবগণ।
সর্ব্ব দেবগণ গেলা ধ্রুব-সন্নিধান।।
কোন দেব বলে, ধ্রুব আইল তোর বাপ।
কোন দেব বলে, অই আইল কালসাপ।।
কোন দেব পরিত্রাহি ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।
কোন দেব বিকট মূরতি যেন ধরে।।
কোন দেব সিংহ হৈয়া আইসে মারিতে।
কোন দেব ব্যাঘ্রমূর্ত্তি ধরে আচম্বিতে।।
কোন দেব রাক্ষস-মূরতি তবে ধরে।
কোন দেব ধরে মূর্ত্তি দেখি ভয়ঙ্করে।।
হুহুঙ্কার করে সবে একত্র হইয়া।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ধরে ধ্রুব কাছে গিয়া।।
কোনরূপে ধ্যানভঙ্গ করিতে না পারে।
ত্রিভঙ্গ হইয়া ধ্রুব কৃষ্ণধ্যান করে।।
সর্ব্বদেব পলাইল স্থির হইতে নারে।
বস্ত্র ডুবাইয়া থুইল যমুনার তীরে।।
ডরে পলাইয়া গেল সর্ব্ব দেবগণ।
মহাভয় হৈল ইন্দ্র দেবের তখন।।
ইন্দ্র বলে, বুঝি ধ্রুব নিবে মোর পদ।
তেকারণে এতদিনে পাড়িল প্রমাদ।।
সর্ব্বদেবগণ বলে, হইল জঞ্জাল।
নাহি জানি দেন হরি কার অধিকার।।
এইমত দেবগণ হৈল চমৎকার।
তারপরে শুন কথা বলি কিছু আর।।
রহিতে নারিলা হরি দিলা দরশন।
গরুড়ে চড়িয়া হরি আইলা তখন।।
ডাকিয়া বলিল তবে শুনহ বচন।
কিবা চাহ বল মোরে কিবা তব মন।।
তবে ধ্রুব চক্ষু মেলি বলিল বচন।
তোমা বিনে আর মোর অন্যে নাহি মন।।
তোমার চরণ বিনে অন্য নাহি চাই।
তোমার চরণে প্রভু দেহ মোরে ঠাঁই।।
কৃষ্ণ বলেন, জানি তোমা, করিলে সেবন।
মোর বাক্যে পাবে তুমি পিতৃ-সিংহাসন।।
যাহা লাগি আইলে হেথা তাহা তুমি পাবে।
বাঞ্ছাকল্পতরু নাম সকলে ঘুষিবে।।
রাজ্যভোগ করি ছত্রিশহাজার বৎসর।
তবে তুমি মাতা সহ যাবে স্বর্গপুর।।
সর্ব্বদেব উপরেতে স্থান দিব আমি।
ধ্রুবলোক বলি বলিবেক সর্ব্বভূমি।।
সর্ব্বলোক উপরে হইবে ধ্রুবস্থান।
বিশ্বকর্ম্মা দিব্য পুরী করিল নির্ম্মাণ।।
অপূর্ব্ব হইলা পুরী জিনিয়া অমরা।
অর্দ্ধচন্দ্র বেদী যেন দীপ্ত করে তারা।।
বর দিয়া গেলা তবে দেব নারায়ণ।
চলি গেল ধ্রুব তবে আপন ভবন।।
দেশে গেলে মাতা পিতা কোলেতে করিল।
সতাই আসিয়া তার মুখে চুম্ব দিল।।
মোর দোষ ক্ষমা কর শুন মোর বাপ।
পাপিনী তোমারে আমি দিনু এত তাপ।।
ধ্রুব বলে, মাতা তুমি বল অকারণ।
তোমার প্রসাদে পাইনু হরির চরণ।।
এইমত সৎমায়ে কহিল বিস্তর।
নিজ মাতা বন্দে ধ্রুব করি যোড় কর।।
তবে রাজ্যে ধ্রুব হইলেন দণ্ডধর।
সিংহাসনে বসিয়া আপনি নৃপবর।।
ছত্রিশসহস্র বর্ষ রাজ্যে কৈল সুখে।
তবে মাতা সহিত চলিল ধ্রুবলোকে।।
আপনার পারিষদ বন্ধুগণ লৈয়া।
উচ্চপদে ধ্রুব তবে রহিলেন গিয়া।।
এই ত কহিনু রাজা ধ্রুবের আখ্যান।
ত্রিভুবনে নাহি পদ ধ্রুবের সমান।।
ধ্রুবের চরিত্র কথা শুনে যেই জন।
পাপে মুক্ত হয়সেই দুঃখ বিমোচন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র