মহাভারত:আদিপর্ব-৫২-৫৬

৫২. অষ্টবসুর জন্ম-বিবরণ
হস্তিনা-নগরে রাজা শান্তনু হইল।
ক্রমে তাঁর গুণরাশি পৃথিবী পূরিল।।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক রাজা মহা-ধনুর্দ্ধর।
মগৃয়া করিয়া ভ্রমে বনের ভিতর।।
জাহ্নবীর দুই তটে ভ্রমে রাজা একা।
পাইল দৈবাৎ তথা জাহ্নবীর দেখা।।
পদ্মের কেশর-বর্ণ সুসিক্ত বসনা।
রূপেতে নিন্দিত যত বিদ্যাধরাঙ্গনা।।
আশ্চর্য্য কন্যার রূপ শান্তনু দেখিয়া।
জিজ্ঞাসিল নরপতি নিকটেতে গিয়া।।
কে তুমি দেবের কন্যা অপ্সরী কিন্নরী।
কিম্বা নাগকন্যা হও কিম্বা বিদ্যাধরী।।
অনুপম রূপরাশি, বর্ণিতে না পারি।
তোমাতে মজিল মন, হও মোর নারী।।
কন্যা বলে, ভার্য্যা রাজা হইব তোমার।
একটী নিয়ম তবে আছে যে আমার।।
আমার নিয়ম যদি করিবে পালন।
তবে পরপতি আমি করিব বরণ।।
আপন ইচ্ছায় আমি করিব যে কাজ।
আমারে নিষেধ না করিবে মহারাজ।।
যে যদি বলিবে মোরে কোন কুবচন।
সে দিন হইতে নাহি পাবে দরশন।।
ত্যাগ করি তোমারে যাইব নিজ স্থান।
স্বীকার করিল রাজা তাঁর বিদ্যমান।।
যা কিছু তোমার ইচ্ছা কর নিজ সুখে।
কখন নিষেধ-বাক্য না আনিব মুখে।।
রাজার বচনে গঙ্গা স্বীকার করিল।
গঙ্গারে লইয়া রাজা হস্তিনা আইল।।
দিব্য রত্ন ভূষণ বসন আনি দিল।
যতনে ভার্য্যার মন তুষিতে লাগিল।।
অনুগত হইয়া থাকেন নরপতি।
মনোসুকে কেলি করে গঙ্গার সংহতি।।
মুনি-শাপে বসুগণ জন্ম নিল আসি।
জন্মিল গঙ্গার পুত্র লয়ে গঙ্গা গেল গঙ্গাজলে।
জলেতে ডুবিয়া মর পুত্র প্রতি বলে।।
দেখিয়া শান্তনু হৈল বিরস বদন।
ভয়েতে গঙ্গারে কিছু না বলে বচন।।
তবে কত দিনে আর এক পুত্র হৈল।
সেই মত করি গঙ্গা জলে ডুবাইল।।
পূর্ব্ব সর্ত ভয়ে রাজা কিছু নাহি বলে।
নিরন্তর দহে তনু পুত্র শোকানলে।।
এক দুই তিন চারি পাঁচ ছয় সাত।
একে একে গঙ্গাদেবী করিল নিপাত।।
পুত্রশোকে শান্তনুর দহে কলেবর।
কত দিনে হৈল জন্ম অষ্টম কুমার।।
পুত্র লৈয়া গঙ্গাদেবী যায় নিজ জলে।
ক্রুদ্ধ হৈয়া নরপতি গঙ্গা প্রতি বলে।।
কেমন মায়াবী তুমি এলে কোথা হৈতে।
তব সম নিন্দিতা না দেখি পৃথিবীতে।।
আপনার গর্ভে যেই জন্মিল কুমার।
কেমনে এমন পুত্রে করিলা সংহার।।
পাষাণ শরীর তব বড়ই নির্দ্দয়।
এত বলি কোলে নিল আপন তনয়।।
গঙ্গা বলে, পুত্র বাঞ্ছা কৈলে নরপতি।
পূর্ব্বের নিয়ম পূর্ণ হৈল মহামতি।।
তোমায় আমায় আর নাহি দরশন।
এ পুত্র পালিহ রাজা করিয়া যতন।।
এবে পরিচয় মম দিব নরপতি।
আমি হই জাহ্নবী ত্রিলোকে মোর গতি।।
আমার উদরে যত হৈল পুত্রগণ।
বশিষ্পের শাপে এই বসু অষ্টজন।।
মুনি-শাপে বসুগণ হইয়া কাতর।
আমারে মিনতি করি মাগিলেন বর।।
গর্ভেতে ধরিব বলি করি অঙ্গীকার।
সে কারণে হইলাম বণিতা তোমার।।
রাজা বলে, কহ শুনি পূর্ব্ব-বিবরণ।
বসুগণে বশিষ্ঠ শাপিল কি কারণ।।
গঙ্গা বলে, সেই কথা শুন নরপতি।
বরুণের পুত্র সে বশিষ্ঠ মহামতি।।
হিমালয়-পর্ব্বতে মুনির তপোবন।
নানা-ফল-ফুলেতে শোভিত তরুগণ।।
দক্ষকন্যা সুরভি সে কশ্যপ-গৃহিণী।
কামদুঘা ধেনু হৈল তাহার নন্দিনী।।
সেই ধনু প্রাপ্ত হৈল বরুণ-নন্দন।
বৎসের সহিত থাকে মুনির সদন।।
দৈবে একদিন তথা বসু অষ্টজন।
ভার্য্যার সহিত তথা করিল গমন।।
আপন আপন ভার্য্যা সহ অষ্টজনে।
ক্রীড়া করি ভ্রমে সবে মুনির কাননে।।
দিব্যবসু-ভার্য্যা কামদুঘা গবী দেখি।
একদৃষ্টে চাহে কন্যা অনিমিখ-আঁখি।।
সুন্দর দেখিয়া গবী কহিল স্বামীরে।
কাহার সুন্দর গবী দেখ বনে চরে।।
দিব্যবসু বলে এই বশিষ্ঠের গবী।
কশ্যপের অংশে জন্ম জননী সুরভি।।
ইহার যতেক গুণ কহনে না যায়।
এক পল দুগ্ধ যদি নরলোকে পায়।।
পান কৈলে জীয়ে দশ সহস্র বৎসর।
সুচির যৌবন থাকে, শরীর নির্জ্জর।।
স্বামীর বচন শুনি বলিল সুন্দরী।
এ গবীর দুগ্ধ যদি হয় হিতকারী।।
নরলোকে সখী এক আছয়ে আমার।
উশীনর-কন্যা জিতবতী নাম তার।।
তাহার কারণে তুমি গবী দেহ মোরে।
যদ্যপি থাকয়ে স্নেহ তোমার আমারে।।
বিনয় করিয়া কন্যা বলে বারে বারে।
স্ত্রীবশ হইয়া বসু ধরিল গবীরে।।
ভার্য্যা-বোলে গবী ধরে, পাছে না গণিল।
কামদুঘা ধেনু লয়ে নিজ গৃহে গেল।।
কতক্ষণে মুনিবর আইল আশ্রমে।
গবী না দেখিয়া মুনি তপোবন ভ্রমে।।
না পাইল গবী মুনি, ভ্রমিল বিস্তর।
গবীর বিহনে হৈল ব্যথিত অন্তর।।
ধ্যান করি দেখে তবে বরুণ-নন্দন।
জানিল হরিল গবী বসু অষ্টজন।।
ক্রোধেতে বশিষ্ঠ শাপ দিল ততক্ষণে।
মনুষ্য হইয়া জন্ম লহ অষ্টজনে।।
বশিষ্ঠ দিলেন শাপ, শুনি বসুগণে।
করযোড়ে স্তুতি করে মুনি বিদ্যমানে।।
মুনি বলে মোর বাক্য না হয় খণ্ডন।
বৎসরেক গর্ভবাসে রবে সাতজন।।
বৎসরে বৎসরে ক্রমে হইবে মুকতি।
সবে না হইবে তাহে একই সুকৃতি।।
তোমা সবা মধ্যে গবী নিল যেই জনে।
নরলোকে রহি মুক্ত হবে বহুদিনে।।
মুনিশাপে বসুগণ হইয়া কাতর।
স্তুতি করি আমারে মাগিল এই বর।।
জন্মমাত্র আমা সবে ডুবাইবে জলে।
অঙ্গীকার করিলাম তা সবার বোলে।।
সে কারণে ভার্য্যা আমি হৈলাম তোমার।
এই তো কুমার রাজা বসু-অবতার।।
মায়ের বিহনে পুত্র দুঃখিত হইবে।
সে কারণে আমার সহিত পুত্র যাবে।।
পালিয়া সুতে পুনঃ যৌবন সঞ্চারে।
তোমারে আনিয়া দিব কত দিনান্তরে।।
এত বলি সুত লৈয়া হৈল অন্তর্ধান।
কান্দিতে কান্দিতে রাজা গেল নিজস্থান।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৫৩. দেবব্রতের যৌবরাজ্য প্রাপ্তি
গঙ্গার শোকেতে রাজা হইল কাতর।
নিরন্তর ভার্য্যা-গুণ ভাবে নৃপবর।।
গঙ্গার ভাবনা বিনা অন্য নাহি মনে।
বিবাহ না করে রাজা নবীন যৌবনে।।
হেনমতে বহুদিন আছে নরপতি।
নানা দান যজ্ঞ রাজা করে নিতি নিতি।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় ধর্ম্মেতে তৎপর।
দেবাসুর-নর-পূজ্য যেন পুরন্দর।।
তেজে দিনকর সম, শান্তে যেন ইন্দু।
ক্ষমায় পৃথিবী রাজা গুণে পূর্ণ-সিন্ধু।।
গতিতে পবন রাজা, দুষ্টগণে যম।
রূপে গুণে ধর্ম্মে ধর্ম্মে কেহ নাহি সম।।
দুঃখী অন্ধ অথর্ব্বের হৈল পিতামাতা।
ধর্ম্মেতে তৎপর রাজা কল্পতুর-দাতা।।
রাজার পালনে প্রজা দুঃখ নাহি জানে।
ধন্য ধন্য বলি খ্যত হইল ভুবনে।।
বৎসর শতেক ষষ্টি গেল হেমতে।
এক দিন গেলে রাজা কল্পতরু-দাতা।।
রাজার পালনে প্রজা দুঃখ নাহি জানে।
ধন্য ধন্য বলি খ্যাত হইল ভুবনে।।
বৎসর শতেক ষষ্টি গেল হেনমতে।
এক দিন গেল রাজা মৃগয়া করিতে।।
একা রথে ভ্রমে রাজা ভাগীরথী-তীরে।
হেরে রাজা তরঙ্গ না বহে গঙ্গা-নীরে।।
স্থির রহে জাহ্নবী বারি যে সুগভীর।
আচম্বিতে দেখে রাজা দূরে এক বীর।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া রাজা ভাবে মনে মনে।
তদন্ত জানিতে তবে গেল ততক্ষণে।।
নিকটে আসিয়া নৃপ দেখে সেই বীর।
কামদেব জিনি রূপ সুন্দর শরীর।।
হাতে ধনুঃশর বসি আছে মহাবল।
শরজালে বান্ধিয়াছে জাহ্নবীর জল।।
দেখিয়া শান্তনু হৈল বিরস বদন।
নৃপে হেরি বীর জলে প্রবেশে তখন।।
জলে প্রবেশিল তাহা শান্তনু দেখিয়া।
বসিল তথায় রাজা চিন্তিত হইয়া।।
শান্তনু দেখিয়া গঙ্গা হইল সদয়।
বাহির হইল আগে করিয়া তনয়।।
পূর্ব্ব রূপ ত্যজি গঙ্গা অন্য রূপ হৈয়্যা।
নৃপতির তরে তবে বলে ডাক দিয়া।।
কি কারণে চিন্তা তুমি করহ রাজন।
হের দেখ লহ রাজা আপন নন্দন।।
আমা হৈতে পাইলা যে অষ্টম কুমার।
দেবব্রত নাম ধরে তনয় তোমার।।
এ পুত্রের গুণ রাজা না যায় কথনে।
অস্ত্র শস্ত্র শিক্ষা কৈল বশিষ্ঠের স্থানে।।
দেবগুরু, দৈত্যগুরু সম শাস্ত্রে জ্ঞান।
অস্ত্রবিদ্যা জানে ভৃগুরামের সমান।।
সংসারে যতেক বিদ্যা নীতি-শাস্ত্র ধর্ম্ম।
এ পুত্রের অগোচর নহে কোন কর্ম্ম।।
তোমারে দিলাম পুত্র, লহ মহারাজ।
অভিষেক করিয়া করহ যুবরাজ।।
এত বলি গেল গঙ্গা অন্তর্ধান গতি।
পুত্র পেয়ে আনন্দিত হৈল নরপতি।।
পুত্র লৈয়া গেল রাজা আপন নগরে।
আনন্দিত পুরজন দেখি পুত্রবরে।।
রাজার সহিত যত মন্ত্রীর সমাজ।
শুভক্ষণ করিয়া করিল যুবরাজ।।
পুত্র পেয়ে সব দুঃখ পাসরিল রাজা।
আনন্দিত হইল রাজ্যের যত প্রজা।।
পুত্রে অধিকার দিয়া শান্তনু ভূপতি।
মৃগয়া করিয়া ভ্রমে অচিন্তিত-মতি।।
স্বচ্ছন্দে মৃগয়া করি ভ্রমে নরবীর।
একদিন গেল রাজা যমুনার তীর।।
কালিন্দীর তীরে মৃগ করে অন্বেষণ।
সুগন্ধ সহিত তথা বহিল পবন।।
গন্ধে আমোদিত রাজা চারিভিতে চায়।
কিসের সুগন্ধ আসে, না জানিল রায়।।
গন্ধ-অনুসারে তবে যায় নরপতি।
আচম্বিতে নৌকামাঝে দেখিল যুবতী।।
পরম সুন্দরী কন্যা জিনি বিদ্যাধরী।
কিরণে উজ্জ্বল করে যমুনার বারি।।
যুগল-খঞ্জন সম কন্যার নয়ন।
বিকচ-কমল প্রায় তাহার বদন।।
বচনে জিনিল মত্ত কোকিলের ভাষা।
কুসুমে কবরী-ভার সুচারু সুকেশা।।
কন্যা দেখি নৃপতিরে পীড়িল মদন।
আগু হৈয়া কন্যা প্রতি জিজ্ঞাসে রাজন।।
কোন জাতি হও তুমি, কোথা তব ধাম।
কাহার নন্দিনী তুমি কি তোমার নাম।।
কন্যা বলে, আমি দাস-রাজার দুহিতা।
ধর্ম্মার্থে বাহি যে নৌকা, আজ্ঞা দিল পিতা।।
কন্যার বচনে রাজা গেল শীঘ্রগতি।
যথায় কন্যার পিতা দাসের বসতি।।
রাজা দেখি মৎস্যজীবী উঠিল ত্বরিতে।
রত্ন-সিংহাসন লৈয়া দিলেক বসিতে।।
করযোড় দাস-রাজা নৃপ প্রতি কয়।
কি হেতু আইলা, আজ্ঞা কর মহাশয়।।
রাজা বলে, আইলাম তোমার এ স্থান।
তোমার যে কন্যা আছে, মোরে কর দান।।
দাস বলে মোর যদি বংশে ভাগ্য থাকে।
তবে মোর কন্যা দান করিব তোমাকে।।
যদি থাকে কন্যার কপালে সুলিখন।
যথাযোগ্য বর পায় ধর্ম্ম-নিবন্ধন।।
তুমি কুরু বংশধর বিখ্যাত সংসারে।
একমাত্র নিবেদন আছয়ে তোমারে।।
সত্য কর, ধর্ম্মপত্নী করিবে কন্যায়।
তবে কন্যা সম্প্রদান করিব তোমায়।।
আমার কন্যার যেই হইবে কুমার।
সেই জনে দিবে তুমি রাজ্য-অধিকার।।
রাজা বলে হেন কর্ম্ম করিতে না পারি।
দেবব্রত পুত্র মোর রাজ্য-অধিকারী।।
এমন বিবাহে মোর নাহি প্রয়োজন।
উঠিয়া নৃপতি দেশে করিল গমন।।
যেইক্ষণ হৈতে কন্যা দেখিল রাজন।
অনুক্ষণ চিন্তে রাজা নহে বিস্মরণ।।
নিরন্তর নরনাথ রহে অধোমুখে।
কন্যার ভাবনা ভাবি রহে মনোদুঃখে।।
পিতারে চিন্তিত দেখি দুঃখিত তনয়।
জিজ্ঞাসিল চিন্তা কেন কর মহাশয়।।
পৃথিবীতে কোন্ কর্ম্ম তোমার অসাধ্য।
যক্ষ-রক্ষ সুরাসুর সবে তব বাধ্য।।
আজ্ঞা কর এখনি সাধিয়া দিব কাজ।
কি কারণে অনুক্ষণ চিন্ত মহারাজ।।
পুত্রের বচন শুনি কহে নরপতি।
যে কারণে চিন্তা মোর শুনহ সুমতি।।
কুরুকুল মহাবংশ বিখ্যাত সংসার।
হেন বংশধর তুমি একই কুমার।।
জীবন যৌবন পুত্র চিরকাল নয়।
কদাচিৎ তোমার বিপদ যদি হয়।।
তবে ত কৌরব বংশ হইবে বিনাশ।
এই হেতু চিত্তে তাপ না করি প্রকাশ।।
যাবত আছহ তুমি বংশেতে নন্দন।
সহস্র কুমারে আর কোন্ প্রয়োজন।।
সংসারে যতেক ধর্ম্ম কহে পদ্মযোনি।
বংশ-রক্ষা-ধর্ম্ম ষোল-কলায় যে গণি।।
বংশহীন-লোকে ধর্ম্ম ফল নাহি ফলে।
বিবাহ না করি তুমি থাকিলে কুশলে।।
রূপে গুণে যোগ্য তুমি যে রাজকুমার।
তোমা বদ্যিমানে বিবাহে কি কাজ আমার।।
তথাপি পূর্ব্বাপর কহেন মুনিগণ।
এক পুত্র পুত্র নহে বংশের কারণ।।
এই হেতু চিন্তা মোর হয় নিরবধি।
উপায় না দেখি পুত্র ইহার ঔষধি।।
পিতার এতেক বাক্য করিয়া শ্রবণ।
দেবব্রত গেল যথা বিজ্ঞ মন্ত্রিগণ।।
কহিল পিতার কথা যত মন্ত্রিগণে।
শুনিয়া সকল মন্ত্রী বলিল তখনে।।
মৃগয়া করিতে রাজা গিয়াছিল বন।
পদ্মগন্ধা কন্যা সনে হৈল দরশন।।
তার হেতু তার বাপে বলিল বচন।
নাহি দিল কন্যা সেই তোমার কারণ।।
মন্ত্রিগণ স্থানে শুনি এতেক বচন।
রথে চড়ি তথাকারে করিল গমন।।
ততক্ষণে দেবব্রত দেখিয়া ধীবর।
রাজার বিধানে পূজা কৈল বহুতর।।
দেবব্রত বলে, রাজা তুমি ভাগ্যবান।
আমার জনকে তুমি কন্যা দেহ দান।।
এত শুনি যোড়হাতে বলিল ধীবর।
মোর নিবেদন এক অবধান কর।।
দাস বলে মোর কন্যা বিখ্যাত ভুবনে।
তাহার মহিমা বলে যত মুনিগণে।।
এত শুনি রাজা জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল।
ধীবর সে কন্যারত্ন কেমনে পাইল।।
সহজে কৈবর্ত্ত-জাতি নীচ-মধ্যে গণি।
তার ঘরে হেন কন্যা কি কারণে মুনি।।
মুনিবর বলে রাজা কর অবধান।
সে কন্যার গুণ-কর্ম্ম শুনহ বিধান।।
মৎস্যের উদরে জন্ম ব্যাসের জননী।
দয়া করিলেন তারে পরাশর-মুনি।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে শুনি ভববারি হবে পার।।
৫৪. মৎস্যগন্ধার উৎপত্তি ও ব্যাসদেবের জন্ম
দ্বাপর-যুগেতে রাজা নামে পরিচর।
সত্যশীল ধর্ম্মবন্ত তপেতে তৎপর।।
সকল ত্যজিয়া রাজা ধর্ম্মে দিল মন।
কঠিন তপস্যা বনে করে অনুক্ষণ।।
শিরে জটা, বৃক্ষের বল্কল পরিধান।
কভু ফল-মূল খায়, কভু অম্বুপান।।
কখন গলিত পত্র, কভু বাতাহার।
বৎসরেক নৃপতি করিল অনাহার।।
গ্রীষ্মকালে চতুর্দ্দিকে জ্বালি হুতাশন।
ঊর্দ্ধপদে তার মধ্যে রহে নৃপধন।।
হেনমতে তপ করে সহস্র বৎসর।
তাঁর তপ দেখিয়া ত্রাসিত পুরন্দর।।
ঐরাবতে চড়িয়া চলিল দেবরাজ।
যথা তপ করে রাজা অরণ্যের মাঝ।।
ডাক দিয়া বলে ইন্দ্র শুন নৃপবর।
দেখিয়া তোমার তপ সবে পাইল ডর।।
নিবর্ত্ত কঠোর তপ, না কর রাজন।
এত বলি দিল ইন্দ্র দিব্য আভরণ।।
বৈজয়ন্তী মালা দিল নৃপতির গলে।
ছত্রদণ্ড দিল আর শ্রবণ-কুণ্ডলে।।
চেদি নামে রাজ্যে করি অভিষেক তাঁরে।
রাজা করি দেবরাজ গেল নিজপুরে।।
চেদি রাজ্যে নৃপতি হইল পরিচয়।
নানাবিধ যজ্ঞ দান করে নিরন্তর।।
অযোনিসম্ভবা কন্যা পর্ব্বতে পাইল।
পরমা সুন্দরী দেখি বিবাহ করিল।।
নানাক্রীড়া করে রাজা ভার্য্যার সহিত।
কত দিনে ঋতুকাল হৈল উপনীত।।
ঋতুস্নান করিল রাজ্যের পাপেশ্বরী।
পবিত্র হইল তবে স্নান দান করি।।
সেই দিন পিতৃলোক কহিল রাজায়।
মৃগমাংসে শ্রাদ্ধ আজি কর মহাশয়।।
পিতৃগণ-আজ্ঞা পেয়ে রাজা পরিচয়।
মৃগয়া করিতে গেল অরণ্য ভিতর।।
মহাবনে প্রবেশিল মৃগ-অন্বেষণে।
ঋতুমতী ভার্য্যা তাঁর সদা পড়ে মনে।।
মৃগয়া করয়ে রাজা নাহি তাহে মন।
অনুক্ষণ ভার্য্যা মনে হয় ত স্মরণ।।
সেই হেতু তাঁর বীর্য্য হইল স্খলিত।
দেখিয়া নৃপতি চিত্তে হইল চিন্তি।।
হাতেতে সঞ্চান পক্ষী আছিল রাজার।
পত্রে করি বীর্য্য দিল স্থানেতে তাহার।।
এই বীর্য্য লৈয়া দিবা পাটেশ্বরী স্থানে।
এত বলি নরপতি পাঠায় সঞ্চানে।।
চলিল সঞ্চান পক্ষী রাজার আজ্ঞাতে।
আর এক সঞ্চান দেখিল শূন্যপথে।।
ভক্ষ দ্রব্য বলিয়া তাহাতে ছোঁ মারিল।
অন্তরীক্ষে যুগল সঞ্চানে যুদ্ধ হৈল।।
পক্ষী স্থান হৈতে রেতঃ পড়ে সেইকালে।
অন্তরীক্ষ হৈতে পড়ে যমুনার জলে।।
দীর্ঘিকা নামেতে ছিল স্বর্গ-বিদ্যাধরী।
মুনিশাপে ছিল জলে হইয়া শফরী।।
সেই বীর্য্য শফরী যে করিল ভক্ষণ।
খণ্ডন না যায় কভু দৈবের ঘটন।।
সেই হৈতে দশ মাসে ধীবরের জালে।
পড়িল প্রবীণ মৎস্য তুলিলেক কূলে।।
কূলেতে তুলিতে মৎস্য প্রসব হইল।
মুনিশাপে মুক্ত হৈয়া নিজ দেশে গেল।।
গর্ভে তার ছিল সুতা আর এক সুত।
দেখিয়া ধীবরগণ মানিল অদ্ভুত।।
যুগল-সন্তান তবে নিল কোলে করি।
যথা রাজা পরিচয় চেদি-অধিকারী।।
অপূর্ব্ব দেখিয়া রাজা হইল বিস্ময়।
কৈবর্ত্তে তনয়া দিয়া লইল তনয়।।
অপুত্রক রাজা পুত্রে করিল পালন।
মৎস্যরাজ বলি নাম করিল ঘোষণ।।
কন্যা লয়ে ধীবর আইল নিজঘরে।
বহু যত্ন করি তারে পালিল ধীবরে।।
রূপেতে তাহার সম নাহি ধরাপরে।
দোষ মাত্র মৎস্যগন্ধ তার কলেবরে।।
দুর্গন্ধেতে কেহ তার নিকটে না যায়।
দেখিয়া ধীবর-রাজা চিন্তিল উপায়।।
যমুনার জলে পথ গহন-কাননে।
সেই পথ নিত্য পার হয় মুনিগণে।।
কন্যারে বলিল, তুমি থাক এইখানে।
ধর্ম্ম-অর্থে পার কর যত মুনিগণে।।
পিতৃ-আজ্ঞা পেয়ে কন্যা থাকিল তথায়।
নিরন্তর মুনিগণে পার করে নায়।।
মহামুনি পরাশর শক্তির-কুমার।
তীর্থযাত্রা করিয়া ভ্রমেণ ধরাপর।।
আচম্বিতে পরাশর আইল সেই পথে।
কৈবর্ত্ত-কুমারী কন্যা দেখিল নৌকাতে।।
আনন্দিত অঙ্গ তার, প্রথম যৌবন।
মত্ত কোকিলের স্বর জিনিয়া বচন।।
তাহার লাবণ্য দেখি মোহ গেলা মুনি।
জিজ্ঞাসিল, কন্যা তুমি কাহার নন্দিনী।।
কন্যা বলে, আমি দাস-রাজার কুমারী।
পিতা মাতা নাম দিল মৎস্যগন্ধা করি।।
মুনি বলে, কন্যা তুমি জগত-মোহিনী।
পিতা মাতা নাম দিল মৎস্যগন্ধা করি।।
মুনি বলে, কন্যা তুমি জগত-মোহিনী।
আমারে ভজহ আমি পরাশর মুনি।।
এত শুনি কন্যা বলে, যুড়ি দুই কর।
কন্যা জাতি প্রভু আমি, নাহি স্বতন্তর।।
সহজে কৈবর্ত্ত-কন্যা, হই নীচজাতি।
অঙ্গেতে দুর্গন্ধ মোর, দেখ মহামতি।।
দুর্গন্ধেতে নিকটে না আসে কোন জনে।
আমারে পরশ মুনি করিবা কেমনে।।
তাহাতে কুমারী আমি, বিবাহ না হয়।
কিমতে ভজিব, আজ্ঞা কর মহাশয়।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন পরাশর।
আমি বর দিব কন্যা নাহি তোর ডর।।
মৎস্যের দুর্গন্ধ আছে তোর কলেবরে।
পদ্মগন্ধ হইবেক আমার এ বরে।।
অনূঢ়া আছহ তুমি প্রথম যৌবনে।
সদা এইরূপে থাক আমার বচনে।।
বলিলা, তোমার জন্ম কৈবর্ত্তের ঘরে।
মহারাজ বিবাহ করিবে মোর বরে।।
এতেক বচন যদি সে মুনি বলিল।
পূর্ব্ব গন্ধ ত্যজি কন্যা পদ্মগন্ধা হৈল।।
অত্যন্ত সুন্দরী হৈর মুনিরাজ-বরে।
আপনা নেহারে কন্যা হরিষ অন্তরে।।
পুনরপি বলে কন্যা যুড়ি দুই কর।
খণ্ডিতে কাহার শক্তি তোমার উত্তর।।
যমুনার দুই তটে আছে লোকজন।
যমুনার জলে আছে নৌকা অগণন।।
ইহার উপায় প্রভু চিন্তহ আপনি।
লোকেতে প্রচার যেন না হয় কাহিনী।।
শক্ত্রি-পুত্র পরাশর মহা-তপোধন।
আজ্ঞাতে কুজ্ঝাটি মুনি করিল সৃজন।।
যমুনার মধ্যে দ্বীপ হইল তখন।
তথায় কন্যায় মুনি করে আলিঙ্গন।।
সেইকালে গর্ভ হৈল কন্যার উদরে।
ব্যাসদেব জন্মিলেন বিখ্যাত সংসারে।।
দ্বীপে জন্ম হেতু তাঁর নাম দ্বৈপায়ন।
চারি ভাল কৈল বেদ, ব্যাস সে কারণ।।
জন্মমাত্র জননীরে বলেন বচন।
আজ্ঞা কর মাতা, আমি যাব তপোবন।।
যখন তোমার কিছু হবে প্রয়োজন।
আসিব তোমার ঠাঁই করিলে স্মরণ।।
জননীর আজ্ঞা পেয়ে ব্যাস তপোধন।
তপস্যা-কারণে বনে করিল গমন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
৫৫. সত্যবতীর বিবাহ
জন্মেজয় বলে, তবে কহ মুনিবর।
পিতামহে কোন্ বাক্য বলিল ধীবর।।
মুনি বলে, দাসরাজ বিবিধ বিধানে।
বিনয় পূর্ব্বক বলে শান্তনু-নন্দনে।।
পূর্ব্বেতে তোমার পিতা এসেছিলা এথা।
কন্যার কারণে কহিলেন এই কথা।।
এক্ষণে আপনি তুমি কহ মহাশয়।
মোর কর্ম্মদোষে ইহা ঘটনা না হয়।।
রূপেতে তোমার পিতা কামদেবে জিনে।
কুরুকুল মহাবংশ বিখ্যাত ভুবনে।।
হেন বংশে দিব কন্যা, ভাগ্য নাহি করি।
তবে এক কথা আছে এই হেতু ডরি।।
দেবব্রত বলে কহ আছে কোন্ কথা।
মম বশ হৈলে তাহা করিব সর্ব্বথা।।
দাস বলে, যুবরাজ কর অবধান।
যে কারণে নৃপে নাহি করি কন্যা দান।।
কন্যা দান করিলে শান্তনু নরবরে।
বৈরানল প্রজ্জ্বলিত হইবে যে পরে।।
তোমা হেন পুত্র যাঁর রাজ্যের ভাজন।
তাঁর কি উচিত পুনঃ পত্নীর গ্রহণ।।
তোমার মহিমা যত বিখ্যাত সংসারে।
তোমার ক্রোধেতে ইন্দ্র-আদি দেব ডরে।।
এতেক শুনিয়া বলে গঙ্গার নন্দন।
অনুমানে বুঝিলাম তোমার বচন।।
যতেক কহিলা তুমি নহে অপ্রমাণ।
নাহিক কন্যার দুঃখ আমা বিদ্যমান।।
সে কারণে সত্য আমি করি দাস-রাজ।
অবধানে শুন যত ক্ষত্রিয়-সমাজ।।
পিতার বিবাহ হেতু করি অঙ্গীকার।
আজি হৈতে রাজ্যে মম নাহি অধিকার।।
তোমার কন্যার গর্ভে যে হবে কুমার।
হস্তিনা-নগরে তার হবে রাজ্যভার।।
দাসরাজ বলে তব অব্যর্থ বচন।
আর এক মহাশয় আছে নিবেদন।।
তুমি সত্য করিলে, তা করিবে পালন।
পাছে দ্বন্দ্ব করিবে তোমার পুত্রগণ।।
সে কারণে ভয়ান্বিত আমার অন্তর।
এত শুনি দেবব্রত করিল উত্তর।।
আমি ত্যাগ করিলাম যদি রাজ্যভার।
পুত্র হেতু ভয় কেন হইল তোমার।।
তোমার অগ্রেতে আমি করি অঙ্গীকার।
বিবাহ-না করিব যে প্রতিজ্ঞা আমার।।
দেবব্রত এইমত বচন কহিল।
দেবতা গন্ধর্ব্ব নহে বিস্মিত হইল।।
ধন্য ধন্য শব্দে সবে চারিভিতে ডাকে।
হেন কর্ম্ম কেহ নাহি করে নরলোকে।।
যত বিদ্যাধরী আর অপ্সরী অপ্সর।
ঝাঁকে ঝাঁকে পুষ্পবৃষ্টি করে নিরন্তর।।
স্বর্গ হৈতে ডাক দিয়া বলে দেবগণ।
ভয়ঙ্কর কর্ম্ম কৈলা শান্তনু-নন্দন।।
দেবাসুর-নরে এই কর্ম্ম অনুপাম।
ভয়ঙ্কর কর্ম্ম কৈলা, ভীষ্ম তব নাম।।
সত্য করি কন্যা লয়ে দিবা জনকেরে।
আজি হৈতে সত্যবতী নাম কন্যা ধরে ।।
ভীষ্মেরে প্রতিজ্ঞা শুনি কৈবর্ত্তের পতি।
ভীষ্মে আনি নিবেদিল কন্যা সত্যবতী।।
সত্যবতী দেখি ভীষ্ম বলে যোড়-হাতে।
নিজ গৃহে চল মাতা, চড় আসি রথে।।
কন্যা লয়ে যায় ভীষ্ম রথ-আরোহণে।
হস্তিনা-নগরে প্রবেশিল কতক্ষণে।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য যত জন ছিল।
অপূর্ব্ব শুনিয়া সবে দেখিতে আসিল।।
ধন্য ধন্য বলিয়া ডাকয়ে সর্ব্বজনে।
ভীষ্ম ভীষ্ম বলি রব হইল ভুবনে।।
কন্যা লৈয়া দিল তবে পিতার গোচর।
দেখিয়া শান্তনু হৈল বিস্ময় অন্তর।।
তুষ্ট হয়ে বর তবে দিলেন নন্দনে।
ইচ্ছামৃত্যু হবে তুমি আমার বচনে।।
ভীষ্ম-জন্ম-কর্ম্ম আর গঙ্গার চরিত্র।
অপূর্ব্ব ভারত-কথা ত্রৈলোক্য-পবিত্র।।
এ সব রহস্য কথা যেই নর শুনে।
শরীর নির্ম্মল হয় জ্ঞান ততক্ষণে।।
ব্যাসের রচিত চিত্র অপূর্ব্ব ভারত।
কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর মত।।
৫৬. বিচিত্রবীর্য্যের মৃত্যু ও ধৃতরাষ্ট্রাদির উৎপত্তি
সত্যবতী লভি রাজা আনন্দিত মনে।
অনুক্ষণ ক্রীড়া করে সত্যবতী সনে।।
তবে কত দিনে রাজ্ঞী হৈল গর্ভবতী।
দশ মাসে প্রসব হইল সত্যবতী।।
পরম সুন্দর পুত্র, মুখ কোকনদ।
সুন্দর দেখিয়া নাম রাখে চিত্রাঙ্গদ।।
তার কত দিনেতে দ্বিতীয় পুত্র হৈল।
বিচিত্রবীর্য্য বলিয়া তবে নাম থুইল।।
সত্যবতী-গর্ভে হৈল যুগল-কুমার।
পরম সুন্দর যেন কাম-অবতার।।
কত দিন অন্তরে শান্তনু নৃপবর।
ত্যজিলেন অক্লেশে ভৌতিক কলেবর।।
রাজার মরণে দুঃখী হৈল সর্ব্বজন।
ভীষ্ম সত্যবতী হৈল শোকাকুল মন।।
অনাথ হৈল পুত্র দোঁহা পিতৃ বিহনে।
আপনি দোঁহারে ভীষ্ম পালেন যতনে।।
চিত্রাঙ্গদ উপরে ধরিল ছত্রদণ্ড।
আপনি পালেন ভীষ্ম মহারাজ্য-খণ্ড।।
কত দিনে চিত্রাঙ্গদা হইল যুবক।
মহা-ধনুর্দ্ধর হৈল প্রতাপে পাবক।।
আপন সদৃশ কেহ না দেখে নয়নে।
এক রথে চড়ি বীর সবাকারে জিনে।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ দৈত্য নর নাগে।
হেন জন নাহি, যুঝে চিত্রাঙ্গদ-আগে।।
হেনমতে এক রথে জিনিল সকল।
এক রথে ভ্রমে বীর পৃথিবী-মণ্ডল।।
চিত্ররথ নামে এক গন্ধবর্ব-ঈশ্বর।
কুরুক্ষেত্রে তাহারে ভেটিল নরবর।।
সরস্বতী-নদী-তীরে হইল সমর।
বর্ষত্রয়-ব্যাপী যুদ্ধ হৈল ঘোরতর।।
মায়াবী গন্ধর্ব্ব শেষে নিজ মায়াবলে।
চিত্রাঙ্গদে মারি গেল গগন-মণ্ডলে।।
চিত্রাঙ্গদ-বধ বার্ত্তা রটিল নগরে।
ধরিল বিচিত্রবীর্য্য রাজছত্র শিরে।।
তাঁর বিভা হেতু ভীষ্ম চিন্তে নিরন্তর।
শুনে কাশীরাজ করে কন্যা-স্বয়ন্বর।।
একেবারে তিন কন্যা করে স্বয়ম্বর।
এ কথা হইল সব রাজার গোচর।।
স্বয়ম্বর শুনি ভীষ্ম চলিল ত্বরিত।
একা রথে কাশীধামে হৈল উপনীত।।
দেখিল অনেক রাজা আছে সয়ম্বরে।
রাজ-রাজেশ্বর যত পৃথিবী-উপরে।।
হেনকালে বলে ভীষ্ম সভার ভিতর।
আমার বচন শুন কাশীর ঈশ্বর।।
আমার অনুজ আছে শান্তনু-নন্দন।
তার হেতু তব কন্যা করিনু বরণ।।
এত বলি তিন কন্যা রথে চড়াইল।
পুনরপি রাজগণে ডাকিয়া বলিল।।
স্বয়ম্বর হৈতে কন্যা বলে যাই লৈয়া।
যার শক্তি থাকে যুদ্ধ করহ আসিয়া।।
ভীষ্মের বচন শুনি যত রাজগণ।
নানা অস্ত্র লয়ে সবেধায় ততক্ষণ।।
মাতঙ্গে তুরঙ্গে কেহ, কেহ চড়ি রথে।
শতপুর করিয়া বেড়িল চারিভিতে।।
শেল শূল জাঠা শক্তি মুষল মুদগর।
নানাবিধ অস্ত্র ফেলে ভীষ্মের উপর।।
মুহূর্ত্তেকে হৈল সব অন্ধকার-ময়।
না দেখি যে ভীষ্ম বীর আছয়ে কোথায়।।
ক্ষিপ্রহস্ত ভীষ্ম বীর গঙ্গার কোঙর।
বশিষ্ঠ-মুনির শিক্ষা, যমের দোসর।।
শরজালে আপনারে করে আচ্ছাদন।
শরে শরে সব অস্ত্র করিল ছেদন।।
কাটিয়া সকল অস্ত্র গঙ্গার কুমার।
নিজ অস্ত্রে রাজগণে করিল প্রহার।।
কাটিল কাহার মুণ্ড কুণ্ডল সহিত।
শ্রবণ কাটিল কারো, দেখি বিপরীত।।
শরীর ত্যজিল কেহ ভূমিতলে পড়ি।
রত্ন-অলঙ্কার সব যায় গড়াগড়ি।।
বাম-হস্ত সহিত ধনুক ফেলে কাটি।
বুকেতে বাজিল কারো, করে ছটফটি।।
পড়িল সকল সৈন্য পৃথিবী আচ্ছাদি।
করিল গঙ্গার পুত্র ক্ষণে রক্তনদী।।
বিমুখ হইল, কেহ না রহে সম্মুখে।
ধন্য ধন্য ভীষ্ম বলি রাজগণ ডাকে।।
ভঙ্গ দিয়া পলাইল যত রাজগণ।
চলিল আপন দেশে শান্তনু-নন্দন।।
কন্যা লৈয়া যায় ভীষ্ম, শাল্বরাজা দেখে।
তিষ্ঠ তিষ্ঠ বলি ভীষ্মে পুনঃপুনঃ ডাকে।।
হস্তিনী কারণে যেন ক্রোধে হস্তিবর।
ধাইয়া আইল তেন শাল্ব নৃপবর।।
ক্রোধেতে আকর্ণ পূরি মহা-ধনুর্দ্ধর।
দিব্য অস্ত্র প্রহারিল ভীষ্মের উপর।।
নেউটিয়া ভীষ্ম বীর নিল শরাসন।
শাল্ব ভীষ্ম দুই জনে হৈল মহারণ।।
দুই সিংহে যুঝে যেন পর্ব্বত উপর।
দুই বৃষ যুঝে যেন গোষ্ঠের ভিতর।।
ক্রোধেতে নির্ধূম-অগ্নি যেন ভীষ্ম বীর।
দুই বাণে কাটে তর সারথির শির।।
চারি অশ্ব কাটিয়া কাটিল রথধ্বজ।
ধনুক কাটিল তার গঙ্গার অঙ্গজ।।
অশ্ব রথ সারথি ধনুক গেল কাট।
পলাইয়া যায় শাল্ব ভূমে বহি বাট।।
কাতর দেখিয়া তারে দিল প্রাণদান।
না মারিল অস্ত্র আর গঙ্গার সন্তান।।
সংগ্রামে জিনিয়া তবে চলে মতিমান।
কন্যা লৈয়া নিজ দেশে করিল পয়ান।।
আনন্দিত সব লোক হস্তিনা-পুরের।
বিবাহ উদ্যোগ কৈল বিচিত্রবীর্য্যের।।
পুরোহিত আনিয়া করিল শুভক্ষণ।
আইল যতেক দ্বিজ বিবাহ কারণ।।
বরের নিকটে তিনি কন্যা বসাইল।
অম্বা নামে জ্যেষ্ঠা কন্যা তখন কহিল।।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি শান্তনু-নন্দন।
তোমারে করি যে আমি এক নিবেদন।।
সভামধ্যে দেখিয়া সকল রাজগণে।
শাল্বেরে বরিতে আমি করিয়াছি মনে।।
পিতার সম্মতি আছে দিবেন শাল্বেরে।
আমার বিবাহ দেহ আনিয়া তাহারে।।
ব্রাহ্মাণ-সভাতে কন্যা এতেক কহিল।
বিচার করিয়া ভীষ্ম তাহারে ত্যজিল।।
পুনর্ব্বার গেল কন্যা শাল্ব রাজস্থান।
শাল্বরাজ বলে তোরে না করি গ্রহণ।।
কান্দিয়া ভীষ্মের স্থানে পুনঃ সে আইল।
তুমি বলে নিলে তেঁই শাল্ব তেয়াগিল।।
তবে ভীষ্ম বলে তুমি বড় দুরাচার।
পুনঃ না লইব তোরে ধর্ম্মের বিচার।।
এত শুনি হৈল কন্যা পরম দুঃখিত।
সেইকালে অগ্নিকুণ্ড করিল ত্বরিত।।
অগ্নি প্রদক্ষিণ করি করিল প্রবেশ।
ভীষ্মের বধের হেতু কামনা বিশেষ।।
অম্বিকা ও অম্বালিকা যুগল সুন্দরী।
রূপেতে দোঁহার নিন্দে স্বর্গবিদ্যাধরী।।
বিচিত্রবীর্য্যেরে দুই কন্যা বিভা দিল।
শচী তিলোত্তমা যেন দেবেন্দ্র পাইল।।
সহজে বিচিত্রবীর্য্য নবীন বয়েস।
যুগল কন্যার সহ শৃঙ্গার বিশেষ।।
অল্পকালে যক্ষ্মাকাশ তাহার ঘটিল।
অনেক উপায় ভীষ্ম তাহার করিল।।
বহু যত্ন করি রক্ষা নারিল করিতে।
মরিল বিচিত্রবীর্য্য পুত্র না জন্মিতে।।
শোকেতে আকুল হৈল যত বধূগণ।
বধূসহ সত্যবতী করেন ক্রন্দন।।
অগ্নিহোত্র মধ্যেতে করিল প্রেতকর্ম্ম।
যেন পুর্ব্বাপর আছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।।
তবে সত্যবতী আনি গঙ্গার নন্দনে।
কহিতে লাগিল তাঁরে করিয়া ক্রন্দনে।।
কুরুকুল মহাবংশ পৃথিবী-ঈশ্বর।
এ বংশ ধরিতে পুত্র তুমি একেশ্বর।।
রাজা হৈয়া রাজ্য রাখ পাল প্রজাগণ।
পুত্র জন্মাইয়া কর বংশের রক্ষণ।।
কুরুকুল অস্ত যায় করহ তারণ।
তোমা বিনা রক্ষা-হেতু নহে অন্যজন।।
নরক হইতে উদ্ধারহ পিতৃগণে।
সর্ব্বশাস্ত্রে ধর্ম্ম বাপু জানহ আপনে।।
অপুত্রক তব ভাই হইল নিধন।
অপুএক আছে তব ভ্রাতৃ-বধূগণ।।
অবিরোধ-ধর্ম্ম বাপু আছে পূর্ব্বাপর।
পুত্র জন্মাইয়া কর বংশের উদ্ধার।।
এতেক শুনিয়া তবে শান্তনু-নন্দন।
বেদের সদৃশ মাতা তোমার বচন।।
আমার প্রতিজ্ঞা মাতা জানহ আপনে।
অঙ্গীকার করিলাম তোমার কারণে।।
ত্রিভুবনে কেহ যদি দেয় অধিকার।
তথাপি না লব রাজ্য, সত্য অঙ্গীকার।।
যাবৎ শরীরে মোর আছয়ে পরাণ।
না ছুঁইব রামা, সত্য নহে মোর আন।।
দিনকর ত্যজে তেজ, চন্দ্র শীত ত্যজে।
ধর্ম্ম সত্য ত্যজে, পরাক্রম দেবরাজে।।
ত্যজিবারে পারয়ে এ সব কদাচন।
তবু সত্য নাহি ত্যজে গঙ্গার নন্দন।।
সত্যবতী বলে, পুত্র আমি সব জানি।
তোমার মহিমা গুণ কহে সুর মুনি।।
আমার বিবাহে যে করিলা অঙ্গীকার।
সকল জানি যে আমি প্রতিজ্ঞা তোমার।।
তথাপি বিপদে ত্রাণ কর কোনমতে।
আপনি উপায় কর কুল-ধর্ম্ম-হিতে।।
বিপদে দেবতা পুছে বৃহস্পতি-স্থানে।
দৈত্যগণ যুক্তি পুছে ভৃগুর নন্দনে।।
তোমা বিনা আমি জিজ্ঞাসিব কার কাছে।
যেমত জানহ কর, যাহে বংশ বাঁচে।।
বেদ-বিধি-ধর্ম্ম পুত্র তোমাতে গোচর।
অবিরোধে ধর্ম্ম পুত্র বংশ রক্ষা কর।।
এত বলি সত্যবতী করেন ক্রন্দন।
নিবর্ত্তিয়া পুনঃ বলে গঙ্গার নন্দন।।
ক্ষত্র হৈয়া যেই জন প্রতিজ্ঞা না পালে।
অপযশ ঘোষে তার এ মহীমণ্ডলে।।
কুরুবংশ-রক্ষা হেতু করিব বিধান।
পূর্ব্বাপর আছে কহি কর অবধান।।
জমদগ্নি-সুত রাম পিতার কারণে।
দশ-শত-ভুজ-ধর মারিল অর্জ্জুনে।।
প্রতিজ্ঞা করিয়া ক্ষত্র করিল সংহার।
নিঃক্ষত্রা করিল ক্ষিতি তিন-সপ্ত-বার।।
ক্ষত্র আর না রহিল পৃথিবী-ভিতরে।
ক্ষত্র-নারী-গণ প্রবেশিল বিপ্র-ঘরে।।
বেদেতে পারগ যেই পবিত্র ব্রাহ্মণ।
তাহার ঔরসে বংশ করিল রক্ষণ।।
বেদবিধি দ্বিজগণ ধর্ম্মেতে বুঝিয়া।
বৃদ্ধি কৈল ক্ষত্রকুল পুত্রদান দিয়া।।
ক্ষত্রক্ষেত্রে জন্ম হৈল ব্রাহ্মণ-ঔরসে।
যার ক্ষেত্র তার পুত্র সবে হেন ভাষে।।
বিপ্র হৈতে ক্ষত্র জন্ম আছে পূর্ব্বাপর।
অদূষিত কর্ম্ম এই ধর্ম্মের উত্তর।।
আর পূর্ব্বকথা মাতা কহি যে তোমারে।
উতথ্য নামেতে ঋষি বিখ্যাত সংসারে।।
তাঁহার কনিষ্ঠ দেব-গুরু বৃহস্পতি।
মমতা নামেতে কন্যা উতথ্য যুবতী।।
কামেতে পীড়িত হৈয়া ধরে বৃহস্পতি।
মমতা ডাকিয়া বলে বৃহস্পতি প্রতি।।
ক্ষমা কর এই নহে রমণ সময়।
মম গর্ভে আছে তব ভ্রাতার তনয়।।
অক্ষয় তোমার বীর্য্য হইবে সন্তুতি।
দুই পুত্র ধরিবারে নাহিক শকতি।।
নিবৃত্ত নিবৃত্ত তুমি নহে সুবিচার।
পরম পণ্ডিত আছে গর্ভেতে আমার।।
গর্ভেতে ষড়ঙ্গ বেদ করে অধ্যয়ন।
নিবর্ত্তহ বৃহস্পতি বুঝিয়া কারণ।।
কামেতে পীড়িত গুরু না করি বিচার।
নিষেধ না শুনি তারে করিল শৃঙ্গার।।
উতথ্য-নন্দন যেই গর্ভেতে আছিল।
বৃহস্পতি প্রতি সেই ডাকিয়া বলিল।।
অনুচিত কর্ম্ম তাত কর কি বিধান।
তব বীর্য্য রহিবারে নাহি তথা স্থান।।
সর্ঙ্কীর্ণ এ স্থল আমি আছি পূর্ব্ব হৈতে।
মোর পীড়া হইবেক তোমার বীর্য্যেতে।।
না শুনিল বৃহস্পতি তাহার বচন।
কামেতে হইয়া মত্ত করিল রমণ।।
এতেক দেখিয়া তবে উতথ্য-কুমার।
যুগল চরণে রুদ্ধ কৈল রেতদ্বার।।
পড়িল জীবের বীর্য্য না পাইয়া স্থল।
দেখি ক্রোধে হৈল গুরু জ্বলন্ত অনল।।
মম বীর্য্য ঠেলিয়া ফেলিলি ভূমিতলে।
দিনু শাপ হও অন্ধ নয়ন যুগলে।।
অন্ধ হইয়া জন্ম হইল উতথ্য-নন্দন।
সৌভরি বংশেতে তেঁহ কৈল অধ্যয়ন।।
গোধর্ম্ম পঠন কৈল গরুর আচার।
ধর্ম্মাধর্ম্ম নাহি মানে, না করে বিচার।।
তার কর্ম্ম দেখিয়া যতেক ঋষিগণ।
ধিক্কার করিয়া সবে বলিল বচন।।
নিকটে বসতি যোগ্য নহে দুরাচার।
ধর্ম্মাধর্ম্ম কোন জ্ঞান নাহিক ইহার।।
এত বলি মুনিগণ উতথ্য-নন্দনে।
সবে হতাদর করে কেহ নাহি মানে।।
পত্নীর বিরাগ-পাত্র ক্রমে দ্বিজবর।
প্রদ্বেষী নাম্নী পত্নী না করে সমাদর।।
সেবা ভক্তি নাহিকরে নাহি শুনে কথা।
অনাদর-করে সদা মর্ম্মে দেয় ব্যথা।।
তাহা দেখি দীর্ঘতমা জিজ্ঞাসে কারণ।
কিসের লাগিয়া মোরে কর অযতন।।
প্রদ্বেষী কহিল, দেখ বিচারিয়া মনে।
স্বামী যে ভার্য্যার ভর্ত্তা ভরণ পোষণে।।
জন্মান্ধ হইয়া তুমি জগতে জন্মিলে।
ভরণ-পোষণ মম কিছু না করিলে।।
পত্নীর বচনে ক্রুদ্ধ হয়ে দ্বিজবর।
প্রদ্বেষী সম্ভাষি তবে কহে অতঃপর।।
দিতেছি বিপুল অর্থ করহ গ্রহণ।
পুনশ্চ না কহ হেন পরুষ বচন।।
আর এই শাপ আমি অর্পিলাম তোরে।
ক্ষত্রকুলে জন্ম হবে অর্থলিপ্সা তরে।।
এত কহি দীর্ঘতমা বলেন বচন।
অদ্যাবধি এই বিধি করিনু স্থাপন।।
নারীজাতি জীবিত থাকিবে যতদিন।
ততদিন হয়ে রবে পতির অধীন।।
পতিবাক্যে অবহেলা কভু না করিবে।
প্রাণপণে পতি-প্রিয় কার্য্য আচরিবে।
জীবিত থাকিতে পতি অথবা মরণে।।
অপর পুরুষে নারী যদি ভাবে মনে।।
নিরয়-গামিনী হবে কহিলাম সার।
পতি ভিন্ন গতি আর নাহি অবলার।।
সংসারের সুখভোগে কিছুমাত্র আর।
পতিহীনা নারীর না রবে অধিকার।।
এত যদি কহে দীর্ঘতমা দ্বিজবর।
ক্রোধেতে আকুল হয় পত্নীর অন্তর।।
পুত্রগণে কহে, লয়ে এই পাতকীরে।
সত্বরে ভাসায়ে দেহ জাহ্নবীর নীরে।।
মাতার বচনে লোভলুব্ধ পুত্রগণ।
গঙ্গাতে ফেলিল বাপে করিয়া বন্ধন।।
ভেলার বন্ধনে ভাসি গেল বহুদূর।
দৈবাৎ দেখিল তারে বলী মহাশূর।।
ধরিয়া আনিল ভেলা, দেখিল ব্রাহ্মণ।
জিজ্ঞাসিল তাহারে যতেক বিবরণ।।
কহিল সকল কথা উতথ্য-নন্দন।
বলী বলে, আমি তোমা করিনু বরণ।।
মোর বংশ বৃদ্ধি কর নিজ তপোবলে।
স্বীকার করিল দ্বিজ দৈত্যপতি-স্থলে।।
গৃহে আনি দ্বিজবরে করিল অর্চ্চন।
সুদেষ্ণা-রাণীকে ডাকি বলিল বচন।।
এই দ্বিজে ভজি কর, বংশের উৎপত্তি।
দ্বিজ হৈতে হইবেক, আছে হেন নীতি।।
অন্ধ দেখি সুদেষ্ণা করিল অনাদর।
শূদ্রী দাসী পাঠাইল যথা দ্বিজবর।।
দ্বিজের ঔরসে তার হৈল পুত্রগণ।
চারিবেদ ষট্শাস্ত্র করে অধ্যয়ন।।
হেনকালে বলী গেল দ্বিজের ভবন।
জিজ্ঞাসিল এই সব আমার নন্দন।।
দ্বিজ বলে, এরা নহে কুমার তোমার।
শূদ্রী-গর্ভে জন্ম হৈল আমার কুমার।।
অন্ধ দেখি আমারে তোমার পাটেশ্বরী।
না আইল মোর স্থানে অনাদর করি।।
এত শুনি বলী গেল নিজ অন্তঃপুরে।
কহিল সকল কথা সুদেষ্ণা-রাণীরে।।
তবে ত চলিল রাণী স্বামীর আদেশে।
তিন পুত্র জন্মাইল দ্বিজের ঔরসে।।
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ এ তিন পুত্র নাম।
পৃথিবীর মধ্যে রাজা হৈল অনুপাম।।
অঙ্গদেশে বসাইল, জ্যেষ্ঠ পুত্র অঙ্গ।
কলিঙ্গ কলিঙ্গ দেশে, বঙ্গদেশে বঙ্গ।।
হেনমতে দ্বিজ হৈতে ক্ষত্রিয়-উৎপত্তি।
পূর্ব্বাপর আছে এই কহি বেদনীতি।।
তোমার বিচারে যেই আইসে জননী।
পাত্র মিত্র ডাকি জিজ্ঞাসহ এখনি।।
মন্ত্রী পুরোহিত লৈয়া করহ বিচার।
ভারত-বংশের হেতু কর প্রতিকার।।
সত্যবতী বলে, পুত্র তুমি ব্রহ্মচারী।
তোমার বচন আমি বেদতুল্য ধরি।।
মোর পূর্ব্ব-বিবরণ কহি যে তোমাতে।
যখন ছিলাম আমি পিতার গৃহেতে।।
ধর্ম্ম-পিতা বাহে নৌকা যমুনার জলে।
একদিন কৌতুকে গেলাম সেই স্থলে।।
দৈবে সেই দিনে মহামুনি পরাশর।
মহাতেজা জ্যোতির্ম্ময়, দেখে লাগে ডর।।
কহিবার যোগ্য পুত্র নহেত তোমারে।
সে মুনির কর্ম্ম পুত্র অদ্ভুত সংসারে।।
মৎস্যের দুর্গন্ধ মোর শরীরে আছিল।
আজ্ঞামাত্র দেহেতে পদ্মগন্ধ হইল।।
কুজ্ঝটী সৃজিয়া মুনি কৈল অন্ধকার।
মহাভয়ে বশীভূতা হইলাম তাঁর।।
তাঁহার ঔরসে মোর হইল নন্দন।
দ্বীপমধ্যে পুত্র মোর হৈল ততক্ষণ।।
জন্মমাত্র তার কর্ম্ম লোকে অনুপাম।
দ্বীপে জন্ম হেতু তাঁর দ্বৈপায়ন নাম।।
বেদ চতুর্ভাগ কৈল ব্যাস সে কারণে।
কৃষ্ণ নাম বলি কৃষ্ণ অঙ্গের বরণে।।
জন্মমাত্র যায় পুত্র তপের কারণ।
আমারে বলিয়া গেল এই ত বচন।।
ত্বরিতে আসিব মাতা করিলে স্মরণ।
কন্যাকালে পুত্র মোর ব্যাস তপোধন।।
তোমার সম্মতি হৈলে করি যে স্মরণ।
তুমি আমি কহি তারে বংশের কারণ।।
করযোড় করি বলে শান্তনু-নন্দন।
তবে চিন্তা কর মাতা কিসের কারণ।।
ধর্ম্ম অর্থ কাম ইথে, নাহিক বিচার।
কুল-শ্রেয়ঃ কর্ম্ম এই সম্মতি আমার।।
তোমার কুমার মাতা ব্যাস তপোধন।
শীঘ্রগতি কর মাতা তাঁহারে স্মরণ।।
দেবগণ মধ্যে হেথা ব্যাস তপোধন।
ভীষ্মের বচনে দেবী করিলা স্মরণ।।
নানাশাস্ত্র ধর্ম্ম কহিছেন দেবস্থানে।
উৎকণ্ঠা জন্মিল তাঁর মাতার স্মরণে।।
সেইক্ষণে আসি তথা হৈল উপস্থিত।
দেখি ভীষ্ম পূজা তাঁরে কৈল বিধিমত।।
বহুদিনে সত্যবতী দেখিলা নন্দন।
আলিঙ্গন দিয়া পুত্রে করেন ক্রন্দন।।
নয়নেতে নীর ঝরে, ক্ষীর বহে স্তনে।
স্তন্যদুগ্ধে স্নান করাইল তপোধনে।।
মায়ের রোদন দেখি বিস্ময়-বদন।
কমণ্ডলু-জল মুখে করিল সেচন।।
নিবারিয়া ক্রন্দন বলেন ব্যাস-মুনি।
কেন ডাকিয়াছ, আজ্ঞা করহ জননী।।
করিব তোমার প্রিয়, আজ্ঞা দেহ মোরে।
কি কর্ম্ম অসাধ্য তব সংসার-ভিতরে।।
সত্যবতী কহে, পুত্র কহিতে অশেষ।
আমার দুঃখের আর নাহি পরিশেষ।।
শিশু পুত্র রাখি স্বামী গেল স্বর্গবাস।
গন্ধর্ব্বেতে জ্যেষ্ঠপুত্র করিল বিনাশ।।
কনিষ্ঠ বালকে ভীষ্ম পালন করিল।
কাশীরাজ দুই কন্যা বিবাহ যে দিল।।
পুত্র না হইতে তার হইল নিধন।
বিধবা-যুগল বধূ, নবীন যৌবন।।
কুরুকুল অস্ত যায়, নাহি রাজ্য-স্বামী।
এ শোক-সাগরে পুত্র পড়িয়াছি আমি।।
উপায় না দেখি তোমা করিনু স্মরণ।
এ দায়ে আমার বংশ করহ রক্ষণ।।
পিতামাতা হৈতে হয় সন্তান সন্ততি।
একের অভাবে হয় সব অসঙ্গতি।।
তুমি পুত্র যেমন, তেমন দেবব্রত।
ইহার উপায় কর দোঁহার সম্মত।।
আমার বিবাহে ভীষ্ম করিল স্বীকার।
বংশ না করিব, নাহি লব অধিকার।।
সে কারণে তোমা বিনা না দেখি উপায়।
আপনি উদ্ধার কর, কুল অস্ত যায়।।
ব্যাস বলে, জননী করিনু অঙ্গীকার।
পালন করিব আজ্ঞা সে হয় তোমার।।
সত্যবতী বলে, তব আছে ভ্রাতৃ-বধূ।
পরম পবিত্র রূপে যেন পূর্ণ বিধু।।
করুণা প্রকাশি দেহ পুত্র দান তার।
ইহা বিনা উপায় না দেখি আমি আর।।
ব্যাস বলে, মাতা তুমি ধর্ম্মেতে তৎপরা।
ধর্ম্মেতে বিহিত এই আছে পরম্পরা।।
তোমার বচন আমি করিব পালন।
রাজ্য-হিতে তব কুল করিব রক্ষণ।।
আর এক নিবেদন শুনহ জননী।
পবিত্র হইতে বধূ বলহ আপনি।।
পবিত্র হইলে বর লভিবে আমার।
দেবতুল্য পরাক্রম হইবে কুমার।।
সত্যবতী বলে, পুত্র বিলম্ব না সয়।
অরাজকে রাজ্য নষ্ট, প্রজা দুষ্ট হয়।।
মায়ের বচনে বলে ব্যাস তপোধন।
মোর ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি হবে দরশন।।
সেই মূর্ত্তি দেখি বধূ সহিবারে পারে।
সুপুত্র হইবে তবে তাহার উদরে।।
সময়ে আসিব বলি গেল মুনি ব্যাস।
সত্যবতী গেল তবে অম্বিকার পাশ।।
মধুর-বচনে তারে বলে সত্যবতী।
আমার বচন বধূ কর অবগতি।।
মজিল ভরত-বংশ নাহিক উপায়।
বংশরক্ষা হেতু বধু কহি যে তোমায়।।
যে উপায় বলে মোরে গঙ্গার কুমার।
সেই ত উপায় আছে নিকটে তোমার।।
আমার বচন তুমি কর অঙ্গীকার।
পুত্র জন্মাইয়া কর বংশের উদ্ধার।।
অর্দ্ধরাত্রে আসিবেন তোমার ভাসুর।
ভজিবে তাহারে তুমি ভয় করি দূর।।
আপনে থাকিয়া তবে দেবী সত্যবতী।
বিবিধ কুসুমে তার শয্যা দিল পাতি।।
পুনঃ পুনঃ কহি দেবী গেল নিজ স্থান।
অর্দ্ধরাত্রে ব্যাসদেব করিল প্রয়াণ।।
কৃষ্ণবর্ণ অঙ্গ, সুপিঙ্গল জটাভার।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি, যেন ভৈরব আকার।।
দেখি মহাভয়ে রাণী মুদিল নয়ন।
তবে ব্যাসমুনি হৈল বিরস-বদন।।
রজনী বঞ্চিয়া মুনি কৈল স্নান-দান।
প্রাতঃকালে সত্যবতী গেল তাঁর স্থান।।
সত্যবতী বলে, পুত্র কহ বিবরণ।
ব্যাস বলে, পালিলাম তোমার বচন।।
মহাবলবন্ত মাতা হইবে কুমার।
অযুত হস্তীর বল হইবে তাহার।।
কেবল হইবে অন্ধ জননীর দোষে।
শত পুত্র হইবে যে তাহার ঔরসে।।
সত্যবতী বলে, পুত্র নহিল করণ।
কুরুকুলে অন্ধ রাজা না হবে শোভন।।
আর এক পুত্র কর বংশের কারণ।
অঙ্গীকার করি গেল ব্যাস তপোধন।।
তবে দশমাস পরে ধৃতরাষ্ট্র হৈল।
যুগল নয়ন অন্ধ, মুনি যাহা কৈল।।
পরে যবে অম্বালিকা কৈল ঋতুস্নান।
পুনঃ ব্যাসে সত্যবতী করিল আহ্বান।।
পূর্ব্বভয়ে অম্বালিকা না মুদিল আঁখি।
শরীর পাণ্ডুর বর্ণ হৈল মুনি দেখি।।
তবে ব্যাস মনামুনি মায়েরে কহিল।
আমারে দেখিয়া বধূ পাণ্ডুবর্ণ হৈল।।
সে কারণে হবে পুত্র পাণ্ডুর বরণ।
এত বলি গেল চলি ব্যাস তপোধন।।
সত্যবতী বলে, পুত্র কর অবধান।
আর এক পুত্র দেহ গন্ধর্ব্ব সমান।।
মায়ের বচনে ব্যাস স্বীকার করিল।
অন্তর্ধান করি মুনি নিজ স্থানে গেল।।
বৎসরেক বয়স হইল পাণ্ডুর-বীর।
অপূর্ব্ব গঠন রূপ পাণ্ডুর শরীর।।
পুনরপি এল ব্যাস মাতার স্মরণে।
ভয়ে অম্বালিকা নাহি গেল তাঁর স্থানে।।
সেবিকা আছিল তাঁর পরমা সুন্দরী।
পাঠাইল মুনি-স্থানে সুবেশাদি করি।।
নবীন যৌবন তাঁর, হয় শূদ্র-জাতি।
মুনির চরণে বহু করিল ভকতি।।
সন্তুষ্ট হইয়া মুনি বলিল তাহারে।
ধর্ম্মবন্ত পুত্র হবে তেমার উদরে।।
পরম পণ্ডিত হবে নরেতে প্রধান।
বর দিয়া গেল ব্যাস আপনার স্থান।।
মুনি-বরে গর্ভ তার হইল উৎপত্তি।
আপনি জন্মিল আসি ধর্ম্ম মহামতি।।
মহাভারতের কথা শ্রবণে অমৃত।
কাশীদাস কহে, সাধু পিয়ে অবিরত।।
 

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র