৪২. চন্দ্রবংশের বিবরণ জন্মেজয় বলে, কহ মুনি মহামতি। চন্দ্রবংশে ভরতের হইল উৎপত্তি।। চন্দ্র হৈতে বংশ হৈল কিরূপ প্রকারে। সে সকল কথা মুনি শুনাও আমারে।। মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন। কহিব সকল কথা করহ শ্রবণ।। ভাল কথা জিজ্ঞাসিলে ভারত আখ্যান। চন্দ্র বংশ চরিত্র করহ অবধান।। মরীচি ব্রহ্মার পুত্র বিদিত সংসার। কশ্যপ নামেতে পুত্র হইল তাঁহার।। তাঁহার নন্দন হৈল সূর্য্য মহাশয়। বৈবস্বত নামে হৈল তাঁহার তনয়।। তাঁহার নন্দিনী ইলা বিখ্যাত জগতে। ইলা গর্ভে পুরূরবা বুধের বীর্য্যেতে।। চন্দ্রের নন্দন বুধ বিখ্যাত সংসার। পুরূরবা মহারাজ তাঁহার কুমার।। অষ্টাদশ দ্বীপে তিনি হৈলা নরপতি। চিরদিন ক্রীড়া করে ঊর্ব্বশী সংহতি।। নৃপতি হইল আয়ু তাঁহার তনয়। তাঁর পুত্র হইল নহুষ মহাশয়।। স্বর্গে ইন্দ্র হৈল রাজা আপনার গুণে। সর্প কলেবর ধরেন দ্বিজ-বচনে।। যযাতি নৃপতি হৈল তাঁহার কুমার। যযাতির গুণ যত কহিতে অপার।। শুক্রশাপে জরাগ্রস্ত তাঁহার শরীর। পুত্রে জরা দিয়া রাজ্য করিল সুধীর।। ৪৩. শুক্রস্থানে কচের বিদ্যাশিক্ষা জন্মেজয় বলে, কহ ইহার কারণ। শুক্রস্থানে কোন্ দোষ করিলা রাজন।। কি কারণে শাপ দিল ভৃগুর কুমার। সে সব চরিত্র কহ করিয়া বিস্তার।। মুনি বলে, অবধান কর নরবর। দেবাসুরে মহাযুদ্ধ হয় নিরন্তর।। নিজ নিজ হিত দোঁহে বাঞ্ছা করি মন। দুই জনে পুরোহিত কৈল নিয়োজন।। বৃহস্পতি পুরোহিত করেন বাসব। দৈত্যবংশে পুরোহিত হইল ভার্গব।। যুদ্ধে যত দৈত্যবধ করে যত দেবে। সকল জীয়ান শুক্র মন্ত্রের প্রভাবে।। সঞ্জীবনী মন্ত্রে ভৃগু-পুত্রের অভ্যাস। যত মরে তত জীয়ে, নাহিক বিনাশ।। যুদ্ধে যত দেবগণ হইত নিধন। নারিতেন বাঁচাইতে অঙ্গিরা নন্দন।। শুক্রের প্রতাপে দেবগণ করয়ে বিচার। কচ নামে ছিল বৃহস্পতির নন্দন। তাহারে বলিল তবে সব দেবগণ।। সঞ্জীবনী-মন্ত্র জানে ভৃগুর নন্দন। উপায় করিয়া কর সে মন্ত্র গ্রহণ।। বৃষপর্ব্ব-পুরে হয় শুক্রের বসতি। তোমা বিনা যাইতে না পারে কোন কৃতী।। শিষ্য হৈয়া শুক্র-স্থানে কর অধ্যয়ণ। দেবযানী তাঁর কন্যা করিবে সেবন।। এত যদি বলিল সকল দেবগণ। বৃষপর্ব্ব-পুরে কচ করিল গমন।। শুক্রের চরণে কচ করি লমস্কার। প্রত্যক্ষেতে পরিচয় দিল আপনার।। অঙ্গিরার পৌত্র আমি, জীবের নন্দন। পড়িবারে আইলাম তোমার সদন।। এত শুনি শুক্র তাঁরে দিলেন আশ্বাস। পড়াব সকল শাস্ত্র যেই অভিলাষ।। শুক্রের আশ্বাসে কচ আনন্দিত-মন। ব্রহ্মচর্য্য পালি বিদ্যা করেন পঠন।। বিবিধ প্রকারে কচ শুক্রে সেবা করে। ততোধিক সেবে কচ তাঁহার কন্যারে।। কর-যোড়ে থাকে কচ দেবযানী-আগে। অবিলম্বে আনে কচ কন্যা যাহা মাগে।। নৃত্য-গীত বাদ্যে সদা তোষে তাঁর মন। আজ্ঞাবর্ত্তী হৈয়া পাশে থাকে অনুক্ষণ।। হেনমতে পঞ্চশত বৎসর যে গেল। গাভী রাখিবারে শুক্র কচে নিয়োজিল।। গোধন-রক্ষণে কচ নিত্য যার বনে। দৈত্যগণ তাঁহারে দেখিল এক দিনে।। জানিল কচেরে দেব-গুরুর নন্দন। মায়া করি আসিয়াছে মন্ত্রের কারণ।। তবে সব দৈত্যগণ কচেরে ধরিয়া। তীক্ষ্ণ খড়্গে খণ্ড খণ্ড করিল কাটিয়া।। অস্থি-মাংস যতেক শার্দ্দূলে খাওয়াইল। কচে মারি দৈত্যগণ নিজ ঘরে গেল।। সন্ধ্যাকালে গাভীগাণ প্রবেশে নগরে। কচ নাহি, গাভীগণ প্রবেশিল ঘরে।। কচ নাহি, দেবযানী হইল চিন্তিত। কান্দিয়া পিতার ঠাঁই জানায় ত্বরিত।। গোধন ফিরিল গৃহে, কচ না আইল। সিংহ ব্যাঘ্র কিম্বা দৈত্যে তাঁহারে মারিল।। কচের বিহনে আমি ত্যজিব জীবন। এত বলি দেবযানী করেন ক্রন্দন।। শুক্র বলে, দেবযানী না কর ক্রন্দন। মন্ত্রবলে কচে আমি জীয়াব এখন।। এস কচ বলি শুক্র তিন ডাক দিল। মন্ত্রের প্রভাবে কচ আসি উত্তরিল।। কচে দেখি দেবযানী আনন্দিত-মন। জিজ্ঞাসিলা কোথায় আছিলা এতক্ষণ।। কচ বলে, দৈত্যগণ আমারে মারিল। প্রসন্ন হইয়া গুরু পুনঃ জিয়াইল।। এত শুনি দেবযানী পিতাকে কহিল। গোধন-রক্ষণ হেতু নিষেধ করিল।। ভারতের কথা হয় শ্রবণে অমৃত। পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীদাস-বিরচিত।। ৪৪. কচ ও দেবযানীর পরস্পর অভিশাপ প্রদান তবে কতদিনে কচে বলে দেবযানী। দেব আরাধিব, কিছু পুষ্প দেহ আনি।। আজ্ঞা পেয়ে গেল কচ পুষ্প আনিবারে। পুনরপি দেখি তারে ধরিল অসুরে।। তিলেক-প্রমাণ কৈল খড়্গেতে কাটিয়া। ঘৃতে ভাজে অস্থি মাংস একত্র করিয়া।। তবে সব দৈত্যগণ করিল বিচার। অন্যজনে খেলে তার নাহিক নিস্তার।। পুনঃ জিয়াইবে শুক্র মন্ত্রের প্রভাবে। কচ প্রাণ পাবে আর তার প্রাণ যাবে।। এতেক বিচার করি যত দৈত্যগণ। করাইল সুরাসহ শুক্রেরে ভোজন।। পুনরপি দেবযানী বাপে জিজ্ঞাসিল। পুষ্প আনিবারে কচ কাননেতে গেল।। এতক্ষণ হৈল পিতা, কচ না আইল। হেন বুঝি, দৈত্যগণ পুনশ্চ মারিল।। নিশ্চয় মরিব পিতা কচে না দেখিয়া। পুনরপি তারে পিতা দেহ জিয়াইয়া।। শুক্র বলে, দেবযানী না কর বিলাপ। মৃত-জন-হেতু কেন কর পরিতাপ।। ব্রহ্মা ইন্দ্র চন্দ্র সূর্য্য মরিলে না জীয়ে। কচ হেতু কেন মর ক্রন্দন করিয়ে।। দেবযানী বলে, পিতা যাহা কহ তুমি। নিশ্চয় মরিব, কচে না দেখিলে আমি।। কচের যতেক গুণ কহিতে না পারি। কচের সৌজন্য পিতা পাসরিতে নারি।। আজি হৈতে এই মোর সত্য অঙ্গীকার। শরীর ত্যজিব আমি করি অনাহার।। এত বলি দেবযানী করিছে ক্রন্দন। প্রবোধিয়া শুক্র বলে মধুর বচন।। কন্যা-প্রবোধিয়া শুক্র ভাবিল অন্তরে। ধ্যানে দেখে কচ আছে আপন উদরে।। শুক্র বলে, কচ তুমি কহ বিবরণ। আমার উদরে আইলা কিসের কারণ।। কচ বল আমারে মারিল দৈত্যগণ। করাইল সুরাসহ তোমায় ভক্ষণ।। জ্ঞান নাহি টুটে মম তব অধ্যয়নে। কেমনে বাহির হৈব ভাবিতেছি মনে।। এত শুনি শুক্র তবে বলে আরবার। তোমারে বাহির কৈলে আমার সংহার।। বাহির না করিলে ব্রাহ্মণ-বধ হয়। মরণ হইতে বড় বিপ্র-বধে ভয়।। ব্রহ্মা-আদি দেবগণ আছে যত জন। ব্রহ্মবধ-পাপে নয় কাহারো মোচন।। এত ভাবি কচে শুক্র বলিল বচন। নিশ্চয় দেখি যে পুত্র আমার মরণ।। সঞ্জীবনী-মন্ত্রী আমি দিতেছে তোমারে। বাহির হইয়া তুমি জীয়াইবা মোরে।। এত বলি মন্ত্র দিল ভৃগুর নন্দন। গর্ভে থাকি কচ করে মন্ত্র উচ্চারণ।। তবে দৈত্যগুরু নিজ করে খড়্গ লৈয়া। বাহির করিল কচে উদর চিরিয়া।। হইল বাহির কচ, শুক্র ত্যজে প্রাণ। পুনরপি জীয়াইল মন্ত্র করি ধ্যান।। তবে মহাক্রুদ্ধ হৈল ভৃগুর নন্দন। সুরা প্রতি শাপ দিল মুনি ততক্ষণ।। ব্রাহ্মণ হইয়া যেই করে সুরাপান। থাকুক পানের কাজ লহে যদি ঘ্রাণ।। অধার্ম্মিক ব্রহ্মঘাতী বলিবা সে জনে। ব্রহ্মাতেজ নষ্ট তার হৈবে সেইক্ষণে।। ইহলোকে অপূজিত হৈবে সেই জনে। মরিলে নরক মধ্যে হইবে গমন।। তবে শুক্র ডাকি বলে দৈত্যগণ প্রতি। মম শিষ্যে মারিলে এ কেমন প্রকৃতি।। আজি হৈতে কচে তোমা কেহ না হিংসিবে। এই বাক্য হেলা কৈলে বড় দুঃখ পাবে।। কচেরে বলিল শুক্র আশ্বাস করিয়া। যথা ইচ্ছা ভ্রম সুখে নির্ভয় হইয়া।। শুক্রের বচনে কচ নির্ভয় হইল। নানা বিদ্যা ব্রহ্মচর্য্য অধ্যয়ন কৈল।। অধ্যয়ন শেষে বৃহস্পতির তনয়। দেবযানী স্থানে গেল মাগিতে বিদায়।। আজ্ঞা কর দেবযানী যাই নিজ দেশ। চিত্তে অনুগ্রহ মোরে রাখিও বিশেষ।। এত শুনি দেবযানী বিষণ্ণ-বদন। কচেরে ডাকিয়া তবে বলেন বচন।। দেখহ আমার কচ যৌবন-সময়। তোমারে দেখি যে যোগ্য, কম পরিণয়।। শুনিয়া বিস্ময়ে কহে জীবের কুমার। হেন অনুচিত বাক্য না বলিও আর।। গুরুর তনয়া তুমি আমার ভগিনী। এমত কুৎসিত কেন বল দেবযানী।। দেবযানী বলে তুমি না কর খণ্ডন। তোমারে করিতে বিভা হইয়াছে মন।। মরেছিলে তুমি, জীয়াইনু বার বার। মোর বাক্য নাহি রাখ, কেমন বিচার।। পূর্ব্বের সৌহৃদ্য রাখ জীবের নন্দন। এত শুনি কচ হৈল বিষণ্ণ-বদন।। কচ বলে, দেবযানী এ নহে উচিত। তোমায় আমায় হেন না হয় বিহিত।। যেই শুক্র হইতে তোমার জন্ম হয়। সেই শুক্র হইতে আমার জ্ঞানোদয়।। সহোদরা তুমি হও সহজে আমার। কি মতে এমত বল বাক্য কদাচার।। আজ্ঞা কর যাই আমি আপন আলয়। শুনি দেবযানী কোপ করে অতিশয়।। নারী হৈয়া বারে বারে করিনু বিনয়। না রাখ আমার বাক্য তুমি দুরাশয়।। যত বিদ্যা তোরে পড়াইল মোর বাপে। সকল নিষ্ফল তোর হবে মোর শাপে।। কচ বলে, দেবযানী করিলা কি কর্ম্ম। বিনা দোষে শাপ দিলা, নহে এই ধর্ম্ম।। গর্ব্বিতা হইয়া কথা বল অনুচিত। সে কারণে দিব শাপ ইহার বিহিত।। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ শুক্র, তুমি কন্যা তাঁর। মোর শাপে ক্ষত্রভর্ত্তা হইবে তোমার।। মোরে শাপ দিলা তুমি, না যাবে খণ্ডন। বিফল হইবে যে করিলাম পঠন।। আমি যত পড়াইব আর শিষ্যগণে। সে সবারে ফলদায়ী হৈবে অধ্যাপনে।। এত বলি গেল কচ ইন্দ্রের নগর। কচে দেখি আনন্দিত সকল অমর।। কহিল সকল কচ যত বিবরণ। নিঃশঙ্ক হইয়া যুদ্ধ করে দেবগণ।। দেব-দৈত্য-যুদ্ধ-কথা না যায় লিখন। এতেক শুনিলা দেবযানীর কথন।। কচ-দেবযানী-কথা মহা-পুণ্যময়। কাশী ভণে, সাধু শুনে হইয়া তন্ময়।। মহাভারতের কথা ব্যাসের রচিত। পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীরাম বিরচিত।। ৪৫. বৃষপর্ব্ব-কন্যা শর্ম্মিষ্ঠার দাসীত্বের বিবরণ জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল যুড়ি দুই কর। অনন্তর কি হইল কহ মুনিবর।। মুনি বলে, অবধান কর নৃপমণি। কচের বিরহে দুঃখে রহে দেবযানী।। তবে কত দিনে পরে বৃষপর্ব্ব-পুরে। কন্যাগণ মিলি গেল স্নান করিবারে।। শর্ম্মিষ্ঠা নামেতে বৃষপর্ব্বার কুমারী। স্নানেতে চলিল দাসীগণ সঙ্গে করি।। শুক্রকন্যা দেবযানী চলিল সংহতি। একত্রে চলিল সবে স্নানেতে যুবতী।। চৈত্ররথ-নামে বলে আছে সরোবর। জলক্রীড়া করে সবে তাহার ভিতর।। নিজ নিজ বস্ত্র সব রাখি তার কূলে। উন্মত্তা হইয়া সবে ক্রীড়া করে জলে।। হেনকাল খরতর বহিল পবন। একত্র করিল যত সবার বসন।। জলক্রীড়া করিয়া উঠিল কন্যাগণ। চিনিয়া পরিল সবে আপন বসন।। শর্ম্মিষ্ঠা দৈত্যের কন্যা উঠি শীঘ্রগতি। শুক্রজার বস্ত্র পরে হইয়া বিস্মৃতি।। দেবযানী বলে তোর এত অহঙ্কার। শূদ্রা হৈয়া বস্ত্র তুই পরিস আমার।। দেবযানী-বাক্য শুনি শর্ম্মিষ্ঠা কুপিল। দেবযানী প্রতি চাহি ক্রোধেতে বলিল।। তোমায় আমায় দেখ অনেক অন্তর। মোর অন্ন খাইয়া রক্ষা কর কলেবর।। মোর বাপে তোর বাপ সদা স্তুতি করে। মোরে হেন বাক্য বল কেন্ অহঙ্কারে।। অল্প হেন করি তোরে করি যে গণনা। মোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব কর না চিন আপনা।। বলিতে বলিতে ক্রোধ অধিক বাড়িল। বলে ধরি কূপে দেবযানীরে ফেলিল।। তাহারে ফেলিয়া কূপে গেল নিজাগার। মরিল কি বাঁচিল সে, না দেখিল আর।। দৈবের নির্ব্বন্ধ কেবা খণ্ডিবারে পারে। সেই বনে গেল রাজা মৃগ মারিবারে।। মৃগয়াতে পটু বড় নহুষ-নন্দন। সসৈন্যে যযাতি রাজা গেল সেই বন।। তৃষ্ণায় পীড়িত হৈল যযাতি রাজন। জল অন্বেষণে ভ্রমে সব সৈন্যগণ।। ভ্রমিতে ভ্রমিতে দেখে কূপের ভিতর। পড়িয়াছে কন্যা এক পরম-সুন্দর।। আস্তে-ব্যস্তে লোক গিয়া জানায় রাজারে। শুনিয়া নৃপতি তবে এল তথাকারে।। অতি পুরাতন কূপ আচ্ছন্ন তৃণেতে। পড়িয়াছে চন্দ্রের সমান কন্যা তাতে।। রাজা বলে, কন্যা কহ নিজ বিবরণ। কূপে পড়িয়াছ তুমি কিসের কারণ।। দ্বিতীয় চন্দ্রের প্রায় ত্রৈলোক্য-মোহিনী। কি নাম ধরহ তুমি, কাহার নন্দিনী।। রাজার বচন শুনি বলে দেবযানী। দেবযানী নাম মোর শুক্রের নন্দিনী।। আমার বৃত্তান্ত রাজা কহিব পশ্চাতে। আগে নরপতি মোরে তোল কূপ হৈতে।। কুলীন পণ্ডিত তুমি দেখি মহাজন। মহাতেজোবন্ত দেখি রাজার লক্ষণ।। করে ধরি তোল মোরে না কর বিচার। বিষম প্রমাদ হৈতে করহ উদ্ধার।। এত শুনি নৃপতি বলিল আরবার। তোমার বচন চিত্তে না লয় আমার।। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ শুক্র, তুমি কন্যা তাঁর। দ্বিতীয় দেখি যে তব যৌবন-সঞ্চার।। সে কারণে তোমারে ছুঁইতে না যুয়ায়। কন্যা বলে দোষ রাজা নাহিক তাহায়।। অন্ধকূপে পড়িয়াছি, মোর প্রাণ যায়। ত্বরিতে উদ্ধার কর, প্রাণ রাখ তায়।। এত শুনি নরপতি কন্যার বচনে। কন্যার দক্ষিণ হস্ত ধরি ততক্ষণে।। সাবধানে নরপতি উপরে তুলিল। কন্যা উদ্ধারিয়া রাজা নিজ দেশে গেল।। হেনকালে ঘূর্ণিকা নামেতে সহচরী। সম্মুখে দেখিল তারে শুক্রের কুমারী।। কান্দিয়া কহিল যত দুঃখ আপনার। পিতারে জানাহ গিয়া মোর সমাচার।। পুনঃ নগরেতে নাহি করিব গমন। কোন্ লাজে লোক মাঝে দেখাব বদন।। চলি যাহ ঘূর্ণিকা গো, কহ পিতৃস্থান। তাঁহাকে কহিও আমি ত্যজিব পরাণ।। ত্বরিতে জানাও গিয়া শুক্রে মহামতি। এত শুনি ঘূর্ণিকা চলিল শীঘ্রগতি।। শুক্র-স্থানে ঘূর্ণিকা বলিছে সবিনয়। দেবযানীর বৃত্তান্ত শুন মহাশয়।। শর্ম্মিষ্ঠা সহিত গেল স্নান করিবারে। বলেতে শর্ম্মিষ্ঠা কূপে ফেলাইল তাঁরে।। এত শুনি শুক্র হৈল বিরস-বদন। দেবযানী দেখিবারে করিল গমন।। দেখে শুক্র, দেবযানী বনের ভিতরে। হেঁট মুখে বসি আছে, চক্ষে জল ঝরে।। বস্ত্র দিয়া দৈত্য-গুরু, মুছায় বদন। জিজ্ঞাসিল বার্ত্তা কিবা কহ বিবরণ।। কোন কালে তুমি সে করিয়াছিলে পাপ। তাহার কারণে তুমি পেলে এত তাপ।। পাপ নাহি জানি গো যাবত মম জ্ঞান। কহি যত বিবরণ, কর অবধান।। বৃষপর্ব্ব-কন্যা মোরে বলেতে ধরিয়া। ঘরে গেল আমারে সে কূপে ফেলাইয়া।। শূদ্রী হৈয়া মোর বস্ত্র করিল পিন্ধন। কতেক কহিব যে করিল পিন্ধন। কতেক কহিব যে কহিল কুবচন।। মোর বাপে স্তুতি শুক্র করে অনুব্রতে। কুটুম্ব সহিত খাও মোর ধন হৈতে।। পুনঃ পুনঃ কহিলেক যাহা আসে মুখে। তার বাক্য বজ্র হেন বাজিয়াছে বুকে।। শুক্র বলে, দেবযানী ত্যজ মনস্তাপ। ক্রোধে লোক ভ্রষ্ট হয়, ক্রোধে হয় পাপ।। অক্রোধের সম পুণ্য নাহিক সংসারে। সর্ব্বধর্ম্মে ধার্ম্মিক যে ক্রোধকে সম্বরে।। শতেক বৎসর তপ করে যেই জন। অক্রোধ-সহিত সম নহে কদাচন।। দেবযানী বলে, পিতা আমি সব জানি। লাঞ্ছিত করিলা মোরে দৈত্যের নন্দিনী।। দর্প দংশনে যেন বিষে অঙ্গ দগ্ধয়। কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণে যেমন অগ্নি হয়।। ততোধিক পিতা মম দহে কলেবর। না হয় নিবৃত্ত সদা দহিছে অন্তর।। কন্যার বচন শুনি ভৃগুর নন্দন। বৃষপর্ব্ব-দৈত্য-স্থানে করিল গমন।। বৃষপর্ব্বে চাহি শুক্র বলিল বিশেষ। অন্যত্র যাইব ত্যজি তোমার এ দেশ।। পাপী দুরাচার যেই হিংসা করে লোকে। পুণ্যবান্ জন তার নিকটে না থাকে।। জানিয়া শুনিয়া পাপ করে যেই জন। অনুরূপ দুঃখ পায়, না যায় খণ্ডন।। তারে না ফলিলে তার পুত্র-পৌত্রে ফলে। ব্যর্থ নাহি হয়, কভু বিধি বেদে বলে।। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ বৃহস্পতির নন্দন। পুনঃ পুনঃ তুই তারে করিলি নিধন।। মম কন্যা দেবযানী, তোর কন্যা তারে। নিক্ষেপিল বধিবারে কূপের মাঝারে।। নারীবধ ব্রহ্মবধ কৈলে বারে-বার। সহজে অসুর তুই, দুষ্ট দুরাচার।। থাকিলে পাপীর কাছে নিত্য পাপ বাড়ে। সে কারণে সাধুজন পাপিসঙ্গ ছাড়ে।। এত বলি ভৃঙ্গ-সুত চলিল সত্বর। বাধা দিয়া পায়ে ধরি কহে দৈত্যেশ্বর।। অধম পাপিষ্ঠ আমি বড় দুরাচার। আপনার গুণে প্রভু কর প্রতিকার।। জাতি ধন রাজ্য প্রাণ কুটুম্বাদি করি। এ সব আমার দ্রব্যে তুমি অধিকারী।। নিশ্চয় গোসাঞি যদি ছাড়ি যাবে মোরে। গোষ্ঠীর সহিত আমি পশিব সাগরে।। শুক্র বলে, তুমি গিয়া প্রবেশ সাগরে। শরীর ত্যজহ কিম্বা যাও দেশান্তরে।। প্রাণের সদৃশ হয় আমার কুমারী। তাহার অপ্রিয় আমি করিবারে নারি।। প্রবোধ করিতে যদি পার দেবযানী। তবে ক্ষান্ত হই আমি, শুন দৈত্যমণি।। এত শুনি দৈত্যরাজ বিনয় করিয়া। কহে দেবযানীর অগ্রেতে দাঁড়াইয়া।। হইল কুকর্ম্ম মোর ক্ষম অপরাধ। সদয় হইয়া মোরে দেহ ত প্রসাদ।। দেবযানী বলে, রাজা বুঝহ অন্তরে। তবে সে প্রসন্ন আমি হইব তোমারে।। শর্ম্মিষ্ঠা তোমার কন্যা বড়ই দুর্ভাষী। সহচরী সহ মোর করি দেহ দাসী।। এত শুনি দৈত্যরাজ হৈল অঙ্গীকার। এখনি আনিয়া অগ্রে দিব গো তোমার।। এত বলি ধাত্রী পাঠাইল অন্তঃপুরে। শর্ম্মিষ্ঠারে বার্ত্তা ধাত্রী কহিল সত্বরে।। ক্রোধ করি যায় শুক্র নগর ত্যজিয়া। সে কারণে রাজা মোরে দিল পাঠাইয়া।। না মানে প্রবোধ কারো ভৃগুর নন্দন। কেবল তাঁহার ক্রোধ তোমার কারণ।। অতএব শীঘ্র তুমি যাহ তথাকারে। তোমাকে লইতে রাজা পাঠাইল মোরে।। কন্যা বলে, যাহে হৈবে জ্ঞাতির কুশল। প্রবোধিয়া শুক্রাচার্য্যে করিব নিশ্চল।। এত বলি যার কন্যা ধাত্রীর সংহতি। যথায় আছেন পিতা দৈত্য-অধিপতি।। সহস্রেক দাসী সঙ্গে চড়ি চতুর্দ্দোলে। পিতার সম্মুখে গিয়া দাণ্ডাইল তলে।। বৃষপর্ব্ব বলে, কন্যা দৈবের লিখনে। দেবযানী কাছে তুমি থাক দাসীপণে।। শর্ম্মিষ্ঠা বলেন, পিতা যে আজ্ঞা তোমার। হইলাম দাসী আমি কর্ম্মে আপনার।। এত শুনি উত্তর করিল দেবযানী। কিমতে হইবা দাসী তুমি ঠাকুরাণী।। তোর বাপে মোর বাপ সদা স্তুতি করে। তোর অন্নেতে যে বাড়িয়াছি কলেবরে।। হেন জন তুমি দাসী হেইবে কেমনে। শুনিয়া উত্তর কন্যা দিল ততক্ষণে।। জ্ঞাতির কুশল আর পিতার বচন। দুই ধর্ম্ম রাখিতে করিনু দাসীপণ।। ইহাতে আমার লজ্জা তিলেক নহিবে। তথাচ রাজার কন্যা সবাই বলিবে।। পরে শুক্র দেবযানী গেল নিজ ঘর। সঙ্গেতে শর্ম্মিষ্ঠা গেল সহ পরিচর।। আদিপর্ব্বে হয় দেবযানীর আখ্যান। কাশীদাস বলে সব অমৃত-সমান।। ৪৬. দেবযানীর বিবাহ হেনমতে নানা রঙ্গে বঞ্চে দেবযানী। দাসীভাবে সেবে তারে দৈত্যের নন্দিনী।। কতদিনে দেবযানী শর্ম্মিষ্ঠা লইয়া। সহস্রেক দাসীগণ সংহতি করিয়া।। চৈত্ররথ-নামে বন অতি মনোহর। নানা রঙ্গে ক্রীড়া করে তাহার ভিতর।। কেহ নাচে, কেহ গায়, কেহ দেয় তালি। নানা বাদ্যারম্ভে, কেহ দেয় হুলাহুলি।। কিশলয়-শয্যায় শয়ানা দেবযানী। পদসেবা করে তাঁর দৈত্যের নন্দিনী।। হেনকালে সেই বনে দৈবের লিখন। যযাতি নৃপতি এল মৃগয়া কারণ।। কন্যাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল নৃপমণি। কি নাম ধরহ তুমি কাহার নন্দিনী।। এত শুনি দেবযানী করিল উত্তর। দৈত্যগুরু শুক্র নামে খ্যাত চরাচর।। তাঁহার তনয়া আমি, নাম দেবযানী। শর্ম্মিষ্ঠা আমার সখী দৈত্যেশ-নন্দিনী।। তুমি কিবা নাম ধর, কাহার নন্দন। এথাকারে এলে তুমি কোন্ প্রয়োজন।। শুনিয়া কন্যার বাক্য বলেন নৃপতি। নহুষ-নন্দন আমি নামেতে যযাতি।। ব্রহ্মচর্য্য-শীল আমি বিখ্যাত সংসারে। মৃগয়া কারণে আইলাম এথাকারে।। দেবযানী বলে, আমি ভালমতে জানি। তোমার বংশের কথা অদ্ভুত কাহিনী।। পরম সুন্দর তুমি, বলে মহাতেজা। ব্রহ্মচর্য্য-বিজ্ঞ তুমি ধর্ম্মশীল রাজা।। পূর্ব্বে কূপ হৈতে তুমি তুলিলা আমারে। পুরুষ হইয়া তুমি ধরিয়াছ করে।। এক্ষণে আমারে বিভা কর নরপতি। সহস্রেক দাসী পাবে শর্ম্মিষ্ঠা-সংহতি।। তোমার বংশেতে কেহ বিভা নাহি করে। হাত ধরি লৈয়া যায় কন্যা নিজ ঘরে।। এক্ষণে আমার হস্ত ধরি লহ তুমি। স্বেচ্ছায় তোমারে রাজা বরিলাম আমি।। রাজা বলে, জানি শুক্র তপঃকল্পতরু। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ আর দৈত্যগণ-গুরু।। তাঁহার নন্দিনী তুমি বন্দিতা আমার। সে কারণে যোগ্য আমি না হই তোমার।। তোমা বিভা করিবারে বড় ভয় মন। শুক্র-ক্রোধে হবে মোর সংশয়-জীবন।। সর্পের বিষের তেজে একজন মরে। ব্রাহ্মণের ক্রোধ-বিষ স্বংশে-জীবন।। সর্পের বিষের তেজে একজন মরে। ব্রাহ্মণের ক্রোধ-বিষ সবংশে সংহারে।। দেবযানী বলে, রাজা কি তোমার ভয়। অযাচকে যাচি দিলে কিবা তার হয়।। রাজা বলে, শুক্র যদি দেন অনুমতি। তবে বিভা করিবারে পারি গুণবতি।। এত শুনি দেবযানী রাজার উত্তর। ভাবিয়া চিন্তিয়া গেল পিতার গোচর।। পিতারে কহিল কন্যা যত বিবরণ। যযাতি নৃপতি এল মৃগয়া কারণ।। মহা-ধর্ম্মশীল রাজা নহুষ-তনয়। তাঁরে সম্প্রদান কর মোরে মহাশয়।। শুনিয়া কন্যার বাক্য বলে শুক্রাচার্য্য। যযাতিকে দিব তোমা, এ নহে আশ্চর্য্য।। এত বলি দৈত্যগুরু চলে শীঘ্রগতি। দেবযানী সহ গেল যথা নরপতি।। শুক্রে দেখি নরপতি প্রণতি করিল। কৃতাঞ্জলি হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।। শুক্র বলে, শুনহ যযাতি নৃপমণি। এই দেবযানী হয় আমার নন্দিনী।। স্বেচ্ছামত ইহারে বিবাহ কর তুমি। করে ধরি সম্প্রদান করিতেছি আমি।। রাজা বলে, ধর্ম্মাধর্ম্ম জানহ আপনি। ক্ষত্রিয়ের যোগ্য নহে ব্রাহ্মণ-নন্দিনী।। শুক্র বলে, আছে দোষ বলে দেববাণী। ব্রাহ্মণ-তনয়া তিন বর্ণের জননী।। শুক্র কন, বিভা কর আজ্ঞায় আমার। মম তপোবলে দোষ খণ্ডিবে তোমার।। এই বাক্য আমার শুনহ নৃপমণি। শর্ম্মিষ্ঠা দেখহ এই দৈত্যের-নন্দিনী।। মম কন্যা দেবযানীর সেবিকা এ হয়। কদাচ না করো কভু অবৈধ প্রণয়।। এত বলি সম্প্রদান কৈল দেবযানী। শুক্রে প্রণমিয়া দেশে গেল নৃপমণি।। শর্ম্মিষ্ঠার সহ দুই সহস্র যুবতী। অশোক বনেতে রাজা দিলেন বসতি।। যথাযোগ্য ভক্ষ্য ভোজ্য বসন ভূষণ। প্রত্যক্ষে সবার রাজা কৈল নিয়োজন।। দেবযানী হইল প্রধান পাটেশ্বরী। হেনমতে ক্রীড়া করে দিবস-শর্ব্বরী।। ধরিল প্রথম গর্ভ শুক্রের নন্দিনী। দশ মাসে প্রসব হইল দেবযানী।। দ্বিতীয়ার চন্দ্র সম হইল নন্দন। নন্দনের যদু নাম রাখিল রাজন।। কতদিন পরে দেখ দৈবের যে গতি। দৈত্যকন্যা শর্ম্মিষ্ঠা হইল ঋতুমতী।। ঋতুস্নান করি কন্যা চিন্তিতা মানসে। স্বামীহীনা হইলাম নিজ কর্ম্মদোষে।। বৃথা জন্ম গেল মোর, এ নব যৌবনে। পুত্রহীনা হইলাম বঞ্চি দাসীপণে।। হরি হরি বিধি মোরে হইলা নিষ্ঠুর। কোন্ কর্ম্ম লভিলাম জন্মি মর্ত্ত্যপুর।। ভাগ্যবতী দেবযানী যৌবন-সময়। লভিল আপন পতি পাইল তনয়।। এতেক বিষাদ করি ভাবে মনে মনে। পুত্রবর মাগি লব যযাতি রাজনে।। দেবযানী সখী মোর হয় ত ঈশ্বরী। তাঁহার ঈশ্বর হৈল মোর অধিকারী।। যদি পাই একান্তে নৃপতি দরশন। ঋতুদান মাগি লব, এই লয় মন।। যযাতি যে সত্যব্রত বিখ্যাত সংসারে। যে কিছু যে চাহে, তাহা অন্যথা না করে।। এতেক চিন্তিতে দেখ দৈবের লিখন। আইল নৃপতি তথা বিহার-কারণ।। নানা বৃক্ষ ফল ফুলে শোভে রম্য বন। একাকী ভ্রময়ে তথা যযাতি রাজন।। হেনকালে শর্ম্মিষ্ঠা রাজারে একা দেখি। সন্নিকটে গিয়া প্রণমিল শশীমুখী।। কৃতাঞ্জলী হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইল। সবিনয়ে দৈত্য-বালা কহিতে লাগিল।। উপেন্দ্র মহেন্দ্র চন্দ্র জলেন্দ্রর প্রায়। সর্ব্বগুণে নৃপতি তোমারে গণি তায়।। আমারে নৃপতি তুমি জান ভালমতে। শুনহ প্রার্থনা এক করি যে তোমাতে।। কামভাবে তোমারে না করি নিবেদন। ঋতুরক্ষা কর মোর ধর্ম্মের কারণ।। রাজা বলে, ইহা না কহিও কদাচন। শুক্রের বচন তব নাহি কি স্মরণ।। দেবযানী-বিবাহে বলিল বারে বারে। প্রণয়ে আবদ্ধ না করিহ শর্ম্মিষ্ঠারে।। শুক্রের বচন কেবা খণ্ডাইতে পারে। কি শক্তি আমার পরশিব যে তোমারে।। কন্যা বলে, রাজা তুমি পরম পণ্ডিত। তোমারে বুঝাব আমি, না হয় উচিত।। বিবাহের কালে সর্ব্ব-ধন-অপহারে। কৌতুকেতে আর নারী সহিত বিহারে।। প্রাণের সংশয়ে যদি মিথ্যা কেহ কহে। এই পঞ্চ স্থানে মিথ্যা পাপহেতু নহে।। দেবযানী তোমারে বরিল যেই ক্ষণে। আমার বরণ রাজা হৈল সেই দিনে।। একে সখী দেবযানী দ্বিতীয়ে ঈশ্বরী। তাঁর ভর্ত্তা তুমি মম হৈলা অধিকারী।। রাজা বলে, নহে এই ধর্ম্মের বিচার। মিথ্যা বাক্য কভু নাহি শোভে যে রাজার।। লোকে মিথ্যা পাপ কৈলে দণ্ড করে রাজা। রাজা মিথ্যাবাদী হৈলে লোকে নাহি পূজা।। কন্যা বলে, রাজা নহে অধর্ম্ম আচার। ভার্য্যা পুত্র দাসেতে স্বামীর অধিকার।। ঈশ্বরী-ঈশ্বর তুমি আমার ঈশ্বর। তে কারণে তোমাতে মাগিনু পুত্রবর।। কন্যার বচন শুনি সত্য ধর্ম্ম নীতি। হৃদয়ে ভাবিয়া তবে কহে নরপতি।। রাজা বলে, পূর্ব্বে করিয়াছি অঙ্গীকার। যেই যাহা মাগে দিব প্রতিজ্ঞা আমার।। সে কারণে তোমার পূরাব অভিলাষ। এত বলি গেল রাজা শর্ম্মিষ্ঠার পাশ।। ঋতুদান শর্ম্মিষ্ঠারে দিলা নরপতি। কেহ না জানিল, গেল আপন বসতি।। রাজার ঔরসে গর্ভ শর্ম্মিষ্ঠা ধরিল। দশ মাস দশ দিনে পুত্র প্রসবিল।। পরম সুন্দর হৈল রাজার নন্দন। হস্ত পদে চক্র শোভে কমল-লোচন।। শর্ম্মিষ্ঠার পুত্র হৈল, লোকে কৈল শব্দ। বার্ত্তা পেয়ে দেবযানী হৈল মহাস্তব্ধ।। আশ্চর্য্য শুনি যে, পুত্র হইল কিমতে। শর্ম্মিষ্ঠার গৃহে তবে চলিল ত্বরিতে।। দেবযানী বলে, সখি! করিলে কি কর্ম্ম। কামে মত্ত হৈয়া নষ্ট কৈলে সতীধর্ম্ম।। শর্ম্মিষ্ঠা বলেন, সখি! দৈবের লিখন। মোর ঋতুকালে আসে ঋষি একজন।। কামভাবে তাহাঁরে না করিনু কামনা। পুত্রদান দিয়া মোরে গেল সেই জনা।। দেবযানী বলে, সখী কহ সত্য কথা। কি নাম ঋষির হয় বাস তার কোথা।। শর্ম্মিষ্ঠা বলেন, ঋষি পরম-সুন্দর। মহাতেজ ধরে ঋষি যেন দিবাকর।। তাঁরে জিজ্ঞাসিতে শক্তি হইবে কাহার। সে কারণে নাম-গোত্র না জানি তাঁহার।। দেবযানী বলে, সখি তুমি পুণ্যবতী। ঋষিবরে হৈল পুত্র, চন্দ্র-সম-দ্যুতি।। এত বলি দেবযানী গেল অন্তঃপুরে। হেনমতে তার কত দিবস-অন্তরে।। দেবযানী প্রসবিল দ্বিতীয় কুমার। তুর্ব্বসু বলিয়া নাম রাখিল তাহার।। দেবযানী প্রসবিল এই দুই নন্দন। যদু আর তুর্ব্বসু বিখ্যাত ত্রিভুবন।। শর্ম্মিষ্ঠার গর্ভে জন্মে রাজার ঔরসে। তিন পুত্র হৈল নাম শুন সবিশেষে।। জ্যেষ্ঠ দ্রুহ্যু, অনু আর দ্বিতীয় কুমার। কনিষ্ঠ হইল পুরু সর্ব্ব-গুণাধার।। রাজার কুমার সব বাড়ে দিনে দিনে। ঋষি হৈতে পুত্র হয়, দেবযানী জানে।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon