মহাভারত:বনপর্ব-০৬১-০৬৫

৬১. দধীচি মুনির অস্থিদান
পুনঃ জিজ্ঞাসেন তবে রাজা যুধিষ্ঠির।
কিরূপে শুষিল মুনি সাগর গভীর।।
লোমশ বলেন, পূর্ব্বে দৈত্য বৃত্রাসুর।
পরাক্রমে জিনিয়া বেড়ায় তিন পুর।।
কালকেয় আদি যত দৈত্য ও দানব।
বৃত্রাসুর সহিত থাকয়ে দুষ্ট সব।।
দৈত্যভয়ে দেবগণ রহিতে নারিল।
ইন্দ্রে আগে করিয়া ব্রহ্মারে নিবেদিল।।
ব্রহ্মা কন, যেই হেতু এলে দেবগণ।
পূর্ব্বে চিন্তিয়াছি আমি তাহার কারণ।।
লৌহ দারু মেরু যত অস্ত্র আছে সার।
কোন মতে নহে বৃত্রাসুরের সংহার।।
দধীচি মুনির স্থানে করহ গমন।
সবে মিলি বর মাগ, শুন দেবগণ।।
প্রসন্ন হৈলে মুনি চাহিবে বরদান।
নিজ অস্থি দিয়া লোকে কর পরিত্রাণ।।
শরীর ত্যজিবে মুনি লোকের কারণ।
তাঁর অস্থি লয়ে কর বজ্রের সৃজন।।
বজ্র অস্ত্রে ইন্দ্র তারে করিবে প্রহার।
বজ্রাঘাতে বৃত্রাসুর হইবে সংহার।।
এত শুনি দেবগণ করিল গমন।
সরস্বতী নদীতীরে আইল তখন।।
মহাতেজোময় মূর্ত্তি দেখি দধীচির।
চন্দ্র সূর্য্য অগ্নি জিনি জ্বলন্ত শরীর।।
মুনিরে বেড়িয়া ইন্দ্র আদি দেবগণ।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিল অগণন।।
দেবতাসমূহ সব দিক্পালগণে।
দেখিয়া দধীচি মুনি ভাবে মনে মনে।।
জানিয়া সকল তত্ত্ব কহে মুনিবর।
বুঝিনু যে হেতু এলে সকল অমর।।
সবাকার হেতু আমি ত্যজিব শরীর।
অস্থি মাংসময় তনু সহজে অচির।।
হয় হৌক, ইহাতে লোকের উপকার।
উপকার হীন ব্যর্থ রহে তনু ছার।।
পূর্ব্বভাগ্যে দেবকার্য্যে লাগিল শরীর।
এত বলি তনু ত্যাগ হৈল দধীচির।।
হেন উপকার কোথা নাহি করে কেহ।
পরোপকারের জন্য ত্যজে নিজ দেহ।।
দধীচি মুনির গুণ বর্ণন না যায়।
হেন উপকার বল কে করে কোথায়।।
যুধিষ্ঠির কন, প্রভু বল অতঃপর।
অস্থি নিয়া কি কর্ম্ম করিলা পুরন্দর।।
৬২. দধীচির অস্থিতে বজ্র নির্ম্মাণ
ও ইন্দ্র কর্ত্তৃক বজ্রাঘাতে বৃত্রাসুর বধ
লোমশ বলেন, রাজা কর অবধান।
বৃত্রাসুরে যেইরূপে বধে মরুত্বান।।
অস্থি লয়ে দেবগণ করিল গমন।
দেবশিল্পী স্থানে দিল করিতে গমন।।
সে উগ্র প্রকারে বজ্র করিয়া নিম্মাণ।
শীঘ্রগতি আনি দিল ইন্দ্র বিদ্যামান।।
বজ্র নিয়া সাজি থাকে দেব পুরন্দর।
হেনকালে এল বৃত্রাসুর দৈত্যেশ্বর।।
প্রবল দানব দৈত্য সংহতি করিয়া।
সুমেরু শিখর যেন পর্ব্বত বেড়িয়া।।
মার মার শব্দ করি মহা কলরব।
প্রলয় সময়ে যেন উথলে অর্ণব।।
পর্ব্বত আয়ুধ কেহ ধরে দৈত্যগণ।
নানা অস্ত্র চতুর্ভিতে করে বরিষণ।।
গজেন্দ্র চড়িয়া ইন্দ্র বজ্র লয়ে হাতে।
দেবগণ সহ যায় বৃত্রেরে মারিতে।।
ইন্দ্রে দেখি ঘোরনাদে গর্জ্জে দৈত্যেশ্বর।
ভয়ঙ্কর শব্দে কাঁপে যত চরাচর।।
আকাশ পাতাল যুড়ি মুখ মেলি ধায়।
দেখিয়া অমরপতি ভয়েতে পলায়।।
দেবগণ সহ ইন্দ্র যায় রড়ারড়ি।
পাছু পাছু দৈত্যগণ ধায় তাড়াতাড়ি।।
কোথায় পাইব রক্ষা, করি অনুমান।
বিষ্ণুর সদনে গিয়া রাখে নিজ প্রাণ।।
ভয়ার্ত্ত দেখিয়া আশ্বাসিয়া নারায়ণ।
উপায় চিন্তেন দৈত্য নিধন কারণ।।
দিলেন আপন তেজ হরি পুরন্দরে।
বিষ্ণুতেজ পেয়ে পুনঃ চলিল সমরে।।
অন্য দেবগণে তেজ হরি পুরন্দরে।
বিষ্ণুতেজ পেয়ে পুনঃ চলিল সমরে।।
অন্য দেবগণে তেজ হরি পুরন্দরে।
বিষ্ণুতেজ পেয়ে পুনঃ চলিল সমরে।।
অন্য দেবগণে তেজ দিল ঋষিগণ।
পুনঃ দেবাসুরে হয় ঘোরতর রণ।।
অনেক হইল যুদ্ধ লিখনে না যায়।
বৃত্রাসুরে বজ্র প্রহারিল দেবরায়।।
বজ্রের ভীষণ শব্দ, দৈত্যের গর্জ্জন।
ত্রৈলোক্যের লোক যত হৈল অচেতন।।
বজ্রাঘাতে অসুরের মুণ্ড হৈল চুর্ণ।
আর যত ছিল, সবে পলাইল তূর্ণ।।
যতেক দানব দৈত্য কালকেয়গণ।
সমুদ্র ভিতরে প্রবেশিল সর্ব্ব জন।।
৬৩. অগস্ত্য মুনির সমুদ্র পান এবং
দেবগণের যুদ্ধে অসুরদিগের নিধন
লোমশ বলেন, শুন ধর্ম্মের নন্দন।
সমুদ্রে আশ্রয় নিল কালকেয়গণ।।
সমস্ত দিবস থাকে জলের ভিতর।
রাত্রিতে উঠিয়া খায় যত মুনিবর।।
বশিষ্ঠ আশ্রমে খাইল সপ্তশত ঋষি।
তিনশত খায় চ্যবনাশ্রমেতে বসি।।
ভরদ্বাজ আশ্রমেতে বিংশ মুনি ছিল।
রজনীর মধ্যে গিয়া সকলি খাইল।।
হেনমতে খায় তারা যত মুনিগণ।
অনাহারী বাতাহরী মহাতপোধন।।
আর যত দ্বিজগণ গেল পলাইয়া।
পর্ব্বত গহ্বরে রহে কোটরে বসিয়া।।
ভাঙ্গিল মুনির মেলা, কেহ নাহি আর।
যাগ যজ্ঞহীন হৈল সকল সংসার।।
উপায় না দেখি আর ব্যাকুল হইয়া।
নারায়ণ স্থানে সবে জানাইল গিয়া।।
সৃষ্টিকর্ত্তা হর্ত্তা তুমি, তুমি শ্রীনিবাস।
তুমি উদ্ধারিবা মোরা করিয়াছি আশ।।
বৃত্রাসুর মৈল, কিন্তু কালকেয়গণ।
লক্ষিতে না পারি, তারা আইসে কখন।।
করিল দ্বিজের নাশ, না দেখি নিস্তার।
আমরা উপায় বহু করিনু তাহার।।
না পারিয়া তব পদে করি নিবেদন।
তোমা বিনা সৃষ্টি রাখে, নাহি হেন জন।।
এত শুনি রোষভরে কহে পীতাম্বর।
ইহার উপায় আর নাহি পুরন্দর।।
বরুণ আশ্রিত হয়ে আছে দুষ্টগণ।
সিন্ধু শুখাইতে সবে করহ যতন।।
পাইয়া বিষ্ণুর আজ্ঞা তবে দেবগণ।
ব্রহ্মার সহিত গেল অগস্ত্য সদন।।
কর যুড়ি দেবগণ তাঁর স্তুতি করে।
সঙ্কটেতে তুমি রক্ষা কর বারে বরে।।
নহুষের ভয়ে পূর্ব্বে করিলা নিস্তার।
বিন্ধ্যাভয়ে বসুধার খণ্ডিলে আঁধার।।
রাক্ষস বধিয়া বিনাশিলা লোকভয়।
এবার করহ রক্ষা হইয়া সদয়।।
মুনি বলে, কোন কার্য্য করিব সবার।
যাহা বল করি তাহা, এই অঙ্গীকার।।
দেব বলে, অসুর করি সিন্ধু আশ্রয়।
মুনি ঋষি খাইয়া পুনঃ সাগরে লুকায়।।
হেরিতে না পায় কেহ, বধিবে কেমনে।
না বধিলে অসুর, কেহ না জীয়ে প্রাণে।।
ইহার উপায় তুমি চিন্তহ মহামুনি।
নিবেদি তোমায় সবে ঋষিশ্রেষ্ঠ গণি।।
শুনি কহে মুনি, চিন্তা নাহি দেবগণ।
জলধির জল আমি করিব শোষণ।।
এত বলি চলিল অগস্ত্য মুনিবর।
সঙ্গেতে চলিল সব অমর কিন্নর।।
অগস্ত্য সমুদ্র পীবে অদ্ভুত কথন।
দেখিতে চলিল যত ত্রৈলোক্যের জন।।
সমুদ্র নিকটে গিয়া বলে তপোধন।
তোমারে শুষিব আমি লোকের কারণ।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব নাগ দেখিবে কৌতুকে।
নিমিষে সমুদ্র পান করিব চুমুকে।।
তবেত অগস্ত্য মুনি একই গণ্ডূষে।
ক্ষণমাত্রে সিন্ধুজল পান করি শোষে।।
কোথায় লহরী গেল, শব্দ হুড়াহুড়ি।
জলজন্তু ছটফটি শুষ্কস্থলে পড়ি।।
বিস্ময় মানিল তবে ত্রৈলোক্যের জন।
অগস্ত্য মুনিরে তবে করিল স্তবন।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যত অপ্সরা অপ্সরী।
মুনির সম্মুখে তারা দেখায় মাধুরী।।
করিল কুসুম বৃষ্টি মুনির উপরে।
সাধু সাধু বলি শব্দ হল দিগন্তরে।।
জলহীন সিন্ধু দেখি যত দেবগণ।
যে যাহার অস্ত্র লয়ে ধাইল তখন।।
যতেক অসুরগণে বেড়িয়া মারিল।
কত দৈত্য ক্ষিতি বিদারিয়া প্রবেশিল।।
দৈত্য হত নিরখিয়া ক্ষান্ত দেবগণ।
পুনরপি অগস্ত্যেরে করিল স্তবন।।
তোমার প্রসাদে রক্ষা পাইল সংসার।
লোকের কণ্টক দৈত্য হইল সংহার।।
সমুদ্রের জল যে শুষিলা মুনিবর।
পুনরপি সেই জলে পর রত্নাকর।।
মুনি বলে, তোমরা উপায় কর সবে।
জলপান করিলাম আর কোথা পাবে।।
এত শুনি দেবগণ বিষণ্ণ বদন।
শীঘ্রগতি গেল সবে ব্রহ্মার সদন।।
দৈত্যনাশ হেতু সিন্ধু শুষিল বারুণি।
কিরূপে পূরিবে সিন্ধু, কহ পদ্মযোনি।।
ব্রহ্মা বলে, নিজালয়ে যাহ সর্ব্ব জন।
উপায় নাহিক সিন্ধু, পূরিতে এখন।।
শুষ্ক সিন্ধু রহিবেক দীর্ঘকাল ভবে।
জ্ঞাতি হেতু ভগীরথ গঙ্গাকে আনিবে।।
ভগীরথ হতে পূর্ণ হবে জলনিধি।
শুষ্ক রহিবেক সিন্ধু তাবৎ অবধি।।
ব্রহ্মার বচনে সবে গেল নিজালয়।
এই শুন পূর্ব্বকথা ধর্ম্মের তনয়।।
৬৪. সগর বংশোপাখ্যান এবং
কপিলের শাপে সগর সন্তান ভস্ম হওন
এত শুনি জিজ্ঞাসিল ধর্ম্মের নন্দন।
কহ শুনি মুনি সিন্ধু পূরণ কথন।।
কে বা ভগীরথ, জ্ঞাতি কারণ কি হয়।
বিস্তারিয়া মুনিরাজ কহ মহাশয়।।
লোমশ বলেন, শুন ধার্ম্মিক রাজন।
সগর নামেতে রাজা বাহুর নন্দন।।
তালজঙ্ঘ হৈহয়াদি রাজা বশ করি।
পৃথিবী পালন করে দুষ্টজনে মারি।।
পুত্র বাঞ্ছা করি রাজা হইল চিন্তিত।
তপস্যা করিতে গেল ভার্য্যার সহিত।।
শৈব্যা আর বৈদর্ভী যুগল ভার্য্যা তাঁর।
কৈলাস পর্ব্বতে তপ করে বহুবার।।
তাঁর তপে আর্বিভূত হয়ে মহেশ্বর।
বলিলেন সগরেরে, মাগি লহ বর।।
বংশ হেতু এই বর মাগিল রাজন।
দেহ ষাটি সহস্র তনয় ত্রিলোচন।।
হর বলিলেন, বর মাগিলে রাজন।
হইবে তোমার ষাটি সহস্র নন্দন।।
সময়ে সবাই এককালে হবে ক্ষয়।
বংশ রক্ষা করিবেক একই তনয়।।
শৈব্যার উদরে যেই এক পুত্র হবে।
তাহাতে ইক্ষ্বাকু বংশ উন্নতি পাইবে।।
এত বলি অন্তর্দ্ধান হইলেন হর।
সগর চলিয়া গেল আপনার ঘর।।
মিথ্যা না হয় কভু শঙ্করের বরদান।
কতদিনে দোঁহাকার হৈল গর্ভাধান।।
সময়ে প্রসব কৈল রাণী দুই জন।
শৈব্যা প্রসবিল এক সুন্দর নন্দন।।
বৈদর্ভীর গর্ভে এক অলাবু জন্মিল।
দেখিয়া নৃপতি ফেলাইতে আজ্ঞা দিল।।
হেনকালে ঘোরনাদে হৈল শূন্যবাণী।
কি কারণে বংশ ত্যাগ কর নৃপিমণি।।
যত বীচি আছে এই অলাবু ভিতর।
ঘৃতপূর্ণ হাঁড়ি মধ্যে রাখ নৃপবর।।
ইহাতে পাইবে ষাটি সহস্র নন্দন।
এই শুনি নরপতি রাখে সেইক্ষণ।।
ঘৃত হাঁড়ি প্রতি এক ধাত্রী নিয়োজিল।
ষাইট সহস্র পুত্র তাহাতে জন্মিল।।
তেজে বীর্য্যে রূপে সবে সগর সমান।
মদগর্ব্বে সবাকারে করে অল্প জ্ঞান।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ নাগ নরগণ।
সবার করিল পীড়া সগর নন্দন।।
দেবগণ জানাইল ব্রহ্মার গোচরে।
সৃষ্টিনাশ কৈল প্রভু সগর-কুমারে।।
ব্রহ্মা বলিলেন, না চিন্তিহ দেবগণে।
কর্ম্মদোষে সকলে মরিবে অল্পদিনে।।
এত শুনি চলি গেল যতেক অমর।
কত দিনে যজ্ঞদীক্ষা লইল সগর।।
অশ্বমেধ আরম্ভিল বাহুর নন্দন।
অশ্ব রক্ষিবারে নিয়োজিল পুত্রগণ।।
সসৈন্যে তাহারা ষাটি সহস্র নন্দন।
ঘোড়া রক্ষিবারে গেল পর্ব্বত কানন।।
জলহীন সিন্ধুমধ্যে করয়ে ভ্রমণ।
ঘোড়ার রক্ষণে তবে থাকে সর্ব্বজন।।
দেবরাজ ভাবে, বুঝি মম রাজ্য যায়।
শত যজ্ঞ সাঙ্গ হৈলে কি হবে উপায়।।
যজ্ঞ বিঘ্ন না করিলে রাজা ইন্দ্র হয়।
মন্ত্রণা করিল ইন্দ্র চরি করি হয়।।
স্বপদ রাখিতে ইন্দ্র করিল চাতুরী।
আপনি আসিয়া শেষে অশ্ব করে চুরি।।
চুরি করি নিয়া ঘোড়া রাখে পাতালেতে।
যেখানে কপিল মুনি ছিলেন যোগেতে।।
যেখানে রাখিয়া ঘোড়া শত্রু পলাইল।
প্রাতঃকালে সেনাগণ জাগিয়া উঠিল।।
সিন্ধুমধ্যে ঘোড়া নাহি দেখি আচম্বিতে।
কেহ না জানিল ঘোড়া গেল কোন্ ভিতে।।
সমকে সমুদ্রে ঘোড়া করে অম্বেষণ।
নদ নদী গিরি গুহা নগর কানন।।
কোথা না দেখিয়া অশ্ব চিন্তিত হইয়া।
সগরের স্থানে সবে জানাইল গিয়া।।
শুনি রাজা দৈববশে করিল উত্তর।
ঘোড়া না আনিয়া কেন আইলি রে ঘর।।
খুঁজিয়া না পাও যদি পৃথিবী ভিতর।
তবে সিন্ধুমধ্যে ঘোড়া হইল অন্তর।।
যত্ন করি সেই স্থল খুঁজ গিয়া সবে।
ঘোড়া না আনিয়া গৃহে ফিরি না আসিবে।।
পিতৃ আজ্ঞা পাইয়া চলিল সর্ব্বজন।
কোদালি ধরিয়া পৃথ্বী করিল খনন।।
জলহীন জন্তুগণ মৃত্তিকাতে ছিল।
কোদালির প্রহারেতে অনেকে মরিল।।
স্কন্ধ শির হস্ত কার কাটা গেল পাদ।
প্রহারে সকল জন্তু করে ঘোর নাদ।।
পর্ব্বত প্রমাণ যত জন্তুগণ মৈল।
পুঞ্জ করি অস্থি সব স্থানে স্থানে থুইল।।
এইমত বারিনিধি খনিতে খনিতে।
অশ্ব অন্বেষণে গেল পৃথ্বী পূর্ব্বভিতে।।
তথায় খনিয়া ক্ষিতি বিদার করিল।
পাতালপুরেতে গিয়া সবে প্রবেশিল।।
তথা গিয়া দেখিল কপিল মহামুনি।
দীপ্তিমান তেজ যেন জ্বলন্ত আগুণি।।
তাঁহার আশ্রমেতে দেখিয়া হয়বর।
হৃষ্ট হয়ে ঘোড়া গিয়া ধরিল সত্বর।।
অহঙ্কারে মুনিবরে করে অনাদর।
দেখিয়া কপিল মুনি কুপিল অন্তর।।
বাহিরায় দুই চক্ষু হইতে অনল।
ভস্মরাশি করিলেক কুমার সকল।।
নারদের মুখে বার্ত্তা পাইল সগর।
শোকাকুল হয় রাজা বিরস অন্তর।।
স্তব্ধ হয়ে শোকাকুল চিন্তে নরপতি।
শিববাক্যে স্মরি শেষে স্থির করে মতি।।
অংশুমান পৌত্র অসমঞ্জের নন্দন।
তাহারে ডাকিয়া রাজা বলেন বচন।।
কপিলের ক্রোধে ভস্ম হৈল পুত্রগণে।
যজ্ঞ নষ্ট হইবেক অশ্বের বিহনে।।
পূর্ব্বে ত্যাগ করিয়াছি তোমার পিতায়।
তোমা বিনা অন্য নাহি যজ্ঞের উপায়।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসিল, কহ মুনিবর।
কি হেতু অত্যাজ্য পুত্রে ত্যজিল সগর।।
মুনি বলে, অসমঞ্জ শৈব্যাগর্ভে জন্ম।
যৌবন সময়ে বড় করিল কুকর্ম্ম।।
দুগ্ধমুখ শিশুগণ ধরি হস্তে গলে।
উপরে তুলিয়া ভূমে আছাড়িয়া ফেলে।।
একত্র হইয়া তবে যত প্রজাগণ।
সগর রাজার প্রতি কৈল নিবেদন।।
তাতরূপে আমা সবে করহ পালন।
দুষ্ট দৈত্য পরচক্রে করহ তারণ।।
অসমঞ্জ ভয় হৈতে কর রাজা পার।
প্রজাদুঃখ শুনি দুঃখ হইল রাজার।।
ক্রুদ্ধ হয়ে আজ্ঞা দিল যত মন্ত্রীগণে।
অসমঞ্জে বাহির করহ এইক্ষণে।।
এইমতে নিজপুত্রে ত্যজিল সগর।
পৌত্রে যে কহিল রাজা, শুন নরবর।।
তোমা বিনা কুলত্রাণ কেহ নাহি আর।
যজ্ঞবিঘ্ন নরক হইতে কর পার।।
পিতামহ বচন শুনিয়া অংশুমান।
যথায় কপিল মুনি, গেল তাঁর স্থান।।
প্রণাম করিয়া বহু করিল স্তবন।
তুষ্ট হয়ে বলে, ইষ্ট মাগহ রাজন।।
এত শুনি অংশুমান বলে যোড়করে।
কৃপা যদি কর প্রভু, দেহ অশ্ববরে।।
দ্বিতীয়ে মাগিল পিতৃগণের সদগতি।
বাঞ্ছাপূর্ণ হৌক বলি বলে মহামতি।।
সত্যশীল ক্ষমাশীল ধর্ম্মে তব জ্ঞান।
তব পিতা হইতে সগর পুত্রবান।।
মম ক্রোধে দগ্ধ যত সগর কুমার।
তব পৌত্র করিবেক সবার উদ্ধার।।
শিবে তুষ্ট করিয়ে আনিবে সুরধুনী।
যজ্ঞ সাঙ্গ কর অশ্ব লইয়া এখনি।।
মুনিলে প্রণাম করি লয়ে অশ্ববর।
অংশুমান দিল পিতামহের গোচর।।
আলিঙ্গন দিয়া বহু করিল সম্মান।
অশ্বমেধ যজ্ঞ তবে কৈল সমাধান।।
পৌত্রে রাজ্য দিয়া শেষে গেল তপোবন।
অংশুমান শাসিলেক সকল ভুবন।।
হইল দিলীপ নামে তাঁহার নন্দন।
দেখি আনন্দিত বড় হইল বাহির।।
দিলীপ পাইল নিজ পিতৃ-সিংহাসন।
শুনিল কপিল কোপে দগ্ধ পিতৃগণ।।
গঙ্গাহেতু তপষ্যা করিল বহুকাল।
তথাপি আনিতে গঙ্গা নারিল ভূপাল।।
তাঁহার নন্দন মহারথ ভগীরথ।
যাঁর যশঃ কর্পূরে পূরিল ত্রিজগৎ।।
কপিলের কোপানলে দগ্ধ পিতৃগণ।
লোক মুখে শুনি কথা চিন্তিত রাজন।।
মন্ত্রীরে করিয়া রাজা রাজ্য সমর্পণ।
গঙ্গার উদ্দেশে গেল দিলীপ নন্দন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৬৫. ভগীরথের ভূতলে গঙ্গা আনয়ন
ও সগরবংশ উদ্ধার
হিমালয় গিয়া মহাতপ আরম্ভিল।
কঠোর তপেতে সব তপস্বী তাপিল।।
ফলাহার পত্রাহার কৈল বাতাহার।
অনাহারে কৈল তনু অস্থিচর্ম্ম সার।।
দেবমানে তপ কৈল সহস্র বৎসর।
তপে তুস্টা গঙ্গা দিতে আইলেন বর।।
গঙ্গা বলিলেন, রাজা তপ কেন কর।
প্রীত হইলাম আমি, মাগ ইষ্টবর।।
জাহ্নবীর বাক্য শুনি হয়ে হৃষ্টমন।
করযোড় করি মাগে দিলীপ নন্দন।।
কপিলের কোপানলে পুড়ে পিতৃগণ।
তা সবার মুক্তি হেতু করি আরাধন।।
যাবৎ তোমার জলে না হয় সেচন।
তাবৎ সদগতি নাহি পাবে পিতৃগণ।।
তোমার চরণে করি এই নিবেদন।
উদ্ধার কর গো মাতা মম পিতৃগণ।।
যদি কৃপা করিলা গো, মাগি তব পায়।
আপনি তথায় গিয়া উদ্ধার সবায়।।
গঙ্গা বলে, তব প্রীতে যাইব তথায়।
মম বেগ সহে হেন করহ উপায়।।
ঊর্দ্ধ হৈতে মহাবেগে নামিব যখন।
মম বেগ সহে, হেন নাহি অন্য জন।।
বিনা নীলকণ্ঠ কারো শক্তি নাহি লোকে।
তপস্যায় বশ করি আনহ ত্র্যম্বকে।।
এত শুনি ভগীরথ করিল গমন।
কৈলাশ শিখরে শিবে করেন ভজন।।
তপস্যায় তুষ্ট হইলেন দিগম্বর।
গঙ্গা ধরিবারে ভগীরথ মাগে বর।।
নিজ ইষ্ট জানি তুষ্ট হয়ে মহেশ্বর।
প্রীতিতে বলেন, চল যাব নৃপবর।।
হিমালয় পর্ব্বতে কহেন উমাপতি।
আনহ, কোথায় আছে তব হৈমবতী।।
ভববাক্যে ভগীরথ গঙ্গা চিন্তা করে।
ব্রহ্মলোকে গঙ্গা তাহা জানিল অন্তরে।।
আকাশ হইতে গঙ্গা দেখি শৃলপাণি।
পড়িলেন হরশিরে করি ঘোর ধ্বনি।।
মকর কুম্ভীর মীন পূর্ণ মহাজলে।
মুক্তামালা শোভে যেন চন্দ্রচূড় গলে।।
শিব শির হৈতে গঙ্গা হৈলেন ত্রিধারা।
এক ধারা আসিয়া পড়িল বসুন্ধরা।।
স্বর্গেতে যে ধারা, তার মন্দাকিনী খ্যাতি।
মর্ত্ত্যে অলকানন্দা পাতালে ভোগবতী।।
ভগীরথ প্রতি বলিলেন ভাগীরথী।
তোমার কারণে আমি আইলাম ক্ষিতি।।
পিতৃগণ তোমার আছয়ে কোন্ দিগে।
কোন্ পথে যাইব, চলহ মম আগে।।
আজ্ঞামাত্র আগে চলে দিলীপ নন্দন।
কল কল শব্দে গঙ্গা চলিল তখন।।
হিমালয় পর্ব্বতে হইলা উপনীত।
পথ না পাইয়া গঙ্গা হলেন ভাবিত।।
চিন্তিয়া কহেন দেবী দিলীপ নন্দনে।
গিরিবর পথ রুধিয়াছে নির্গমনে।।
শুনি ভগীরথ সুরধুনীর বচন।
বিনয়েতে কহে, মাতা পথ নির্দ্ধারণ।।
গঙ্গা বলেন, কর রাজা ঐরাবতে ধ্যান।
বিদারিয়া গিরি পথ করুক নির্ম্মাণ।।
মম বাক্যে ঐরাবতে করিলেন স্তুতি।
স্তবেতে হইয়া তুষ্ট আসে গজপতি।।
রাজা বলে, মহাশয় নিস্তার এ দায়।
গিরি বিদারিয়া পথ দেহ গঙ্গা মায়।।
শুনি করী দুষ্টমতি বলিল রাজারে।
পথ করি দিতে পারি যদি ভজে মোরে।।
কর্ণে হাত দিয়া রাজা আইল সত্বর।
ছলেতে জানায় সব পশুর উত্তর।।
গঙ্গা বলে, ভগীরথ কহিবে করীরে।
সহে যদি মম বেগ, ভজিব তাহারে।।
দেখিবে দুর্গতি তার, কিবা দশা ঘটে।
শীঘ্রগতি আন তারে ছলিয়া কপটে।।
মাতঙ্গ নিকটে গিয়া বলে ভগীরথ।
শুনি করী শীঘ্রগতি করি দিল পথ।।
গিরি খণ্ড করি দন্তে টানিয়া ফেলিল।
মহাবেগে মহামায়া গমন করিল।।
সম্মুখে পড়িয়া হস্তী ভাসিয়া চলিল।
আছাড়ে বিছাড়ে তার প্রাণমাত্র ছিল।।
স্তব করে, গজবর, ত্রাহি ত্রাহি ডাকে।
বলে মাগো পশু আমি, কি চিনি তোমাকে।।
দয়াময়ী দয়া করি রাখিল জীবন।
প্রাণ লয়ে ঐরাবত পলায় তখন।।
বেগেতে চলিল গঙ্গা আনন্দিত মনে।
উপনীতা হৈল জহ্নুমুনির আশ্রমে।।
দেখিয়া গঙ্গারে মুনি করিলেন পান।
গঙ্গারে না দেখি রাজা হৈল হতজ্ঞান।।
মুনিবরে স্তব করে কাতর অন্তরে।
তুষ্ট হয়ে মুনিবর গঙ্গা দিল পরে।।
কল কল শব্দে হয় গঙ্গার প্রয়াণ।
কত শত লোক তরে নাহি পরিমাণ।।
তাহা দেখি হর্ষান্বিত নৃপ গুণবান।
বেগেতে আইল গঙ্গা কপিলের স্থান।।
যথায় আছিল ভস্ম সগর সন্তান।
পরশে পরম জল বৈকুণ্ঠে প্রয়াণ।।
চতুর্ভূজ হয়ে স্বর্ণরথে আরোহিল।
ঊর্দ্ধবাহু করি সবে আশীর্ব্বাদ কৈল।।
পিতৃগণে মুক্ত দেখি আনন্দ অপার।
প্রণাম করিয়া নাচে দিলীপ কুমার।।
ভগীরথ হইতে সমুদ্রে হৈল জল।
যাহা জিজ্ঞাসিলে রাজা কহিনু সকল।।
শুনিলে পৃথিবীপাল সগরোপাখ্যান।
ভগীরথ তুল্য আর নাহি পুণ্যবান।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীদাস বিরচিল সগর আখ্যান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র