মহাভারত:উদ্যোগপর্ব-০০১-০০৫
১. দুর্য্যোধনের প্রতি ভীষ্মাদির হিতোপদেশজিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ তপোধন।সত্য হতে মুক্ত যদি হৈল পঞ্চজন।।আপন বিভাগ রাজ্য লাভের কারণ।কহকিবা করিলেন পিতামহগণ।।ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্য্যোধনে বুঝবারে।কোন্ দূত পাঠালেন হস্তিনানগরে।।উত্তর গোগ্রহ যুদ্ধ কৌরব প্রধান।পাইলেন অর্জ্জুনের স্থানে অপমান।।শিবিরে আসিয়া কিবা করিল বিচার।কহ শুনি মুনিবর করিয়া বিস্তার।।মুনি বলে শুনহ নৃপতি জন্মেজয়।যুদ্ধে পরাভূত হয়ে কৌরব তনয়।।লণ্ড ভণ্ড হয়ে রাজা আইল শিবিরে।মহামনস্তাপ হেতু দুঃখিত অন্তরে।।শিবা হাতে সিংহ যেন পেয়ে অপমান।দোর্দ্দূলের হাতে যেন কুঞ্জরপ্রধান।।একাপার্থ করিলেন সবাকারে জয়।ব্যকুল কৌরব অতি পেয়ে লজ্জা ভয়।।কর্ণ বলিলেন রাজা ত্যজ চিন্তা মনে।উপায়ে মারিব পঞ্চ পাণ্ডুপুত্রগণে।।বাসব উপায়ে বৃত্রাসুরেরে মারিল।উপায় করিয়া শিব ত্রিপুরে বধিল।।বিনা উপায়েতে সিদ্ধ না হয় রাজন।উপায় সৃজিয়া মার পাণ্ডুপুত্রগণ।।বিরাট নগরে দূত দেহ পাঠাইয়া।পাণ্ডবে হেথায় আন কপট করিয়া।।মুখ্য মুখ্য সেনাপতি যত বীরগণে।সঙ্গেতে করিয়া তুমি রাখ এইখানে।।বিরাট দ্রুপদ আর ভাই পঞ্চজন।ভোজন কারণে রাজা কর নিমন্ত্রণ।।সূপকারগণে সবে সঙ্কেত করহ।অন্নপান সনে বিষ সবাকারে দেহ।।বিষপানে হীনবল হবে সর্ব্বজন।যতেক প্রহরী বেড়ি করিবে নিধন।।পূর্ব্বাপর আছে হেন শাস্ত্রের বিহিত।বলে ছলে শত্রুকে মারিবে সুনিশ্চিত।।ছল করি ফল মধ্যে রহি পুরষ্কার।নমুচি দানবে পাঠাইল যম ঘর।।সে কারণে এই যুক্তি কহিনু তোমারে।মারহ পাণ্ডুর পুত্র বুদ্ধি অনুসারে।।নতুবা সকল সৈন্যে সাজ নরপতি।বিরাট নগরে চল যাইব সম্প্রতি।।বিরাটের পুর সব চৌদিকে বেড়িয়া।অগ্নি দিয়া পাণ্ডবেরে মার পোড়াইয়া।।ইমত বিধান করহ নরবর।উলম্ব উচিত নহে করহ সত্বর।।বলিলেন রাজা ইহা নাহি লয় মনে।তার শক্তি মারিবে পাণ্ডব পঞ্চজনে।।এতেক উপায় আমি করিলাম পূর্ব্ব।কপট পাশাতে তার হরিলাম সর্ব্ব।।পরে দিই বনবাস দ্বাদস বৎসর।বৎসরেক অজ্ঞাত বসতি তার পর।।সভামাঝে পাণ্ডব করিল যেই পণ।তাহাতে হৈল মুক্ত দৈব নিবন্ধন।।আমার উপায় যত হইল বিফল।এখন সহায় তার হৈল মহাবল।।যে হোক সে হোক যুদ্ধ করিলাম পণ।বিনা যুদ্ধ রাজ্য নাহি দিব কদাচন।।আমারে জিনিয়া পাণ্ডুপুত্র রাজ্য লয়।আমি বা পাণ্ডবে জিনি মম রাজ্য হয়।।প্রতিজ্ঞা আমার এই না হইবে আন।ইহার উপায় সখা করহ বিধান।।না মারিব যে পর্য্যন্ত পাণ্ডু-পুত্রগণ।রাজ্যে রাজ্যে অনুচর করহ প্রেরণ।।নিবসেন যত রাজা মম অধিকারে।যুদ্ধ হেতু বরিয়া আনহ সবাকারে।।সবা মধ্যে প্রধান সুমন্ত্র নরপতি।কলিঙ্গ কামদ ভোজ বাহিলক প্রভৃতি।।সুশর্ম্মা নৃপতি আদি যত রাজগণ।যুদ্ধ হেতু সবাকারে করহ বরণ।।একাদশ অক্ষৌহিণী করহ সাজন।হইবে অবশ্য যুদ্ধ না হয় খণ্ডন।।অস্ত্র শস্ত্র বহুবিধ করহ সঞ্চয়।মিত্রামিত্র বলাবল করহ নির্ণয়।।রাজার বচন শুনি রাধার নন্দন।সাধু সাধু বলিয়া প্রশংসে সেইক্ষণ।।উত্তম বলিয়া যুক্তি নিল মম মনে।তুমি হে ক্ষন্ত্রিয়শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি বলে গুণে।।দেবগণ মধ্যে যেন দেব শচীপতি।প্রজাপতি মধ্যে যেন দক্ষ মহামতি।।তারাগণ মধ্যে যেন শীতল কিরণ।তাদৃশ ক্ষন্ত্রিয় মধ্যে তোমারে গণন।।ক্ষত্রধর্ম্ম শাস্ত্র যত আছে পূর্ব্বাপর।ক্ষন্ত্রিয় হইয়া যুদ্ধে না করিবে ডর।।সে কারণে ক্ষত্রধর্ম্ম করাহ উদয়।যুদ্ধ হেতু বরহ যতেক রাজচয়।।হয় বা না হয় যুদ্ধ বিধির লিখন।সৈন্য সমাবেশ কর না ছাড় বিক্রম।।এত বলি আজ্ঞা দিল ডাকি অনুচরে।লিখিলেন লিখন সমস্ত নৃপবরে।।অনন্তরে কহিলেন গঙ্গার তনয়।যে যুক্তি করিলা মম হৃদয়ে না লয়।।ভাই ভাই বিচ্ছেদ হইতে না যুয়ায়।হিত উপদেশ রাজা কহিব তোমায়।।মান বৃদ্ধি নাই ইথে না হইবে যশ।হারিলে জিনিলে তুল্য না হবে পৌরষ।।অতএব যুদ্ধে রাজা নাহি প্রয়োজন।পাণ্ডব সহিত সবে করহ মিলন।।পাণ্ডবেরা নাহি তব করে অত্যাচার।আপনি ইচ্ছায় ভাগ যে দিবে তাহার।।তাহা পেয়ে সুখী হবে ভাই পঞ্চজন।এক্ষণে এমত বুদ্ধি না কর রাজন।।পাশায় জিনিয়া তুমি নিলে সর্ব্ব ধন।তবু তারা তোমা প্রতি নহে ক্রোধমন।।যে সত্য করিল তারা সবার সাক্ষাতে।ধর্ম্ম অনুসারে মুক্ত হইল তাহাতে।।পূর্ব্বে ছিল তাহাদের যেই অধিকার।তাহা ছাড়ি দিতে হয় উচিত তোমার।।তাহাতে প্রবোধ যদি নহে কদাচন।তবে যেই মনে লয় করিও তখন।।পূর্ব্বে অঙ্গীকার তুমি করিলে আপনে।সত্য হতে মুক্ত যদি হয় কদাচনে।।পুনঃ আসি রাজ্য তবে লইবে পাণ্ডব।সেইকালে সাক্ষাতে আছিনু মোরা সব।।এক্ষণে যাহাতে তুষ্ট কুন্তীপুত্র সব।তাহা দিয়া রাজা তুমি প্রবোধ পাণ্ডব।।তাহা দিয়া প্রবোধহ পাণ্ডু পুত্রগণে।ভাই ভাই বিরোধ না হয় প্রয়োজনে।।ভীষ্মের এতেক বাক্য শুনি দুর্য্যোধন।ক্ষণেক থাকিয়া তবে বলিলা বচন।।শত্রুকে ভজিব আমি মনে নাহি লয়।যে হোক সে হোক যুদ্ধ করিব নিশ্চয়।।ক্ষত্রমধ্যে অযোগ্যতা গণি এই কর্ম্ম।শত্রুকে যে রাজ্য ত্যজে, ধিক্ তার জন্ম।।বলিলেন ভীষ্ম তবে যাহা ইচ্ছা কর।শুনিলে উপদেশ যুদ্ধানলে মর।।অনন্তরে দ্রোণ কৃপ বাহলীক রাজন।অষ্টকেতু ধৃতরাষ্ট্র গুরুর নন্দন।।বিদ্যুর প্রভৃতি আর যত মন্ত্রিগণ।একে একে দুর্য্যোধনে কহিল বচন।।ভীষ্ম যে কহিলা তাহা কর মহারাজ।ভাই ভাই বিরোধে না হয় ভদ্র কাজ।।হলক্ষয় হইবেক লোকে অপমান।তাহাতে পৌরুষ কিছু না হয় বিধান।।আপন পৈতৃক ভাগ যে হয় উচিত।তাহা দেহ পাণ্ডবেরে শাস্ত্রীয় বিহিত।।যে সত্য করিল তাহা সভায় গোচর।তাহাতে হইর মুক্ত পঞ্চ সহোদর।।পূর্ব্বে যেই অধিকার ছিল তা সবার।যাই ইন্দ্রপ্রস্থ তুমি দেহ পুনর্ব্বার।।করিলে অপমান না করিল মনে।অন্য কেহ হৈলে না সহিত কদাচনে।।বাসুর নরমধ্যে খ্যাত পঞ্চজন।মূর্ত্তেকে জিনিবারে পারে ত্রিভুবন।।উত্তর গোগ্রহে যুদ্ধ দেখিলে আপনে।একেশ্বর ধনঞ্জয় সবাকারে জিনে।।বিরাটের গাভীগণ মুক্ত করি দিল।ধায় অর্জ্জুন বীর কারে না মারিল।।আমায় আক্রোশ যদি থাকিত তাহার।তার কেন সংগ্রামে করিল পরিহার।।অন্তর দেখ রাজা গন্ধর্ব্ব প্রধান।আমায় ধরিয়া নিয়া করিল প্রয়াণ।।মুখ্য মুখ্য যতেক ছিলেন সেনাপতি।ছাড়াইতে না হইল কাহার শকতি।।তোমারে আক্রোশ যদি পাণ্ডবের ছিল।তবে কেন পার্থ তোমা মুক্ত করি দিল।।যদি বল উত্তর গো গ্রহে ধনঞ্জয়।পরকার্য্যে অপমান করিল আমায়।।দ্রৌপদীর বাক্য পার্থ নারে খণ্ডিবারে।এই হেতু গাভী মুক্ত করিল প্রকারে।।ভাই ভাই যুদ্ধে কিছু নাহি অপমান।জয় পরাজয় মানি একই সমান।।কহিলে পরম শত্রু মোর পঞ্চজন।তাহারে ভজিলে হয় কুযশ ঘোষণ।।তুমি শত্রুভাব কর তাহারা না করে।জ্ঞাতি মধ্যে যে জন অধিক বল ধরে।।সে হয় প্রধান রাজা কহিনু নিশ্চয়।পূর্ব্বের কাহিনী শুন কহি যে তোমায়।।ত্রেতাযুগে ছিল রাজা লঙ্কার ঈশ্বর।বাহুবলে জিনিল সকল চরাচর।।ক্ষন্ত্রবংশে চূড়ামণি শ্রীরাম লক্ষণ।তাঁহাদের সহ দ্বন্দ্বে হইল নিধন।।মুখ্য মুখ্য যতেক আছিল সেনাগণ।শক্তি না হইল কার করিতে মোচন।।অহিংসা পরমধর্ম্ম শাস্ত্রেতে বাখানে।হিংসা সম পাপ নাহি বলে জ্ঞানিজনে।।অগ্র হৈতে হিংসাবুদ্ধি যেই জন করে।পঞ্চ মহাপাপ আসি বেড়য়ে তাহারে।।জগতে অকীর্ত্তি ঘোষে লোকে নাহি মানে।কহিব পূর্ব্বের কথা শুন সাবধানে।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।০২. ইন্দ্রের জন্ম, তৎকর্ত্তৃক গুরুপত্নীহরণ ও গৌতমের শাপদক্ষকন্যা অদিতি যে কশ্যপ গৃহিনী।পুত্রবাঞ্ছা করিয়া ভজিল শূলপাণি।।প্রত্যক্ষ হইয়া বর যাচেন শঙ্কর।মাগিল অদিতি বর করি যোড়কর।।মম গর্ভে হবে যেই সন্তান উৎপত্তি।ত্রিভুবন মধ্যে যেন হয় মহামতি।।নাগ নর সুর আদি প্রজাপতিগণ।সবে পূজা করিবেন তাহার চরণ।।স্বস্তি বলি বর তারে দেন শূলপাণি।স্বামীরে কহিল তবে দক্ষের নন্দিনী।।আমারে দিলেন বর দেব পঞ্চানন।ত্রিভুবনে রাজা হবে তোমার নন্দন।।কশ্যপ বলিলা শিববাক্য মিথ্যা নয়।মহাবলবন্ত হবে তোমার তনয়।।ত্রিভুবন মধ্যে সেই হইবেক রাজা।এ তিন ভুবনে লোক করিবেক পূজা।।স্বামীর নিকটে কন্যা পাইল সম্মান।কতদিনে অদিতি করিল ঋতুস্নান।।স্বামী সহ বতি কেলি কুতূহলে করে।বিষ্ণু অংশে পুত্র আসি জন্মিল উদরে।।পরম সুন্দর পুত্র ভূমিষ্ঠ হইল।ইন্দ্র বলি নাম তার মুনিবর দিল।।দ্বাদশ আদিত্য তবে জন্মিল বিশেষে।যাহার উদয়ে দিন আপনি প্রকাশে।।কত দিনান্তরে তবে দক্ষের নন্দিনী।ঋতুস্নান করিয়া স্বামীরে বলে বাণী।।রতি করিলেন মুনি দক্ষের কন্যায়।গর্ভেতে পবন আসি জন্মিল তাহায়।।কহিলেন ভার্য্যারে কশ্যপ তপোধন।ত্রিভুবন ব্যাপিবেক তব এ নন্দন।।ছোট বড় জীব জন্তু আছয়ে যতেক।সর্ব্বভূতে হইবেক নন্দন প্রত্যেক।।ইহা সম বলবন্ত কেহ না হইবে।সকল সংসার এই ব্যাপিত করিবে।।শুনি আনন্দিত হৈল দক্ষের নন্দিনী।স্বর্গলোকে চলিলা কশ্যপ মহামুনি।।কত দিনে নারদ আইল সুরপুরে।সঙ্কেতে ডাকিয়া মুনি বলিল ইন্দ্রেরে।।তোমায় মায়ের গর্ভে হবে যেই জন।জন্মমাত্রে করিবেক জগৎ ব্যাপন।।ইহা বলি যথাস্থানে যান তপোধন।বিস্ময় মানিয়া ইন্দ্র ভাবিল তখন।।এইক্ষণে না করিলে সংহার ইহারে।জন্মিলে অনেক মন্দ করিবে আমারে।।এতেক বিচার চিত্তে বাসব করিল।সূক্ষারূপে জননীর গর্ভে প্রবেশিল।।যেইকালে নিদ্রাগত দক্ষের নন্দিনী।সেই গর্ভ কাটিয়া করিল সাতখানি।।কাটিলেন পুনঃ একখানি সাতবার।তাহাতে হইল উনপঞ্চাশ প্রকার।।চিত্তেতে সানন্দ ইন্দ্র হইল নির্ভয়।কতদিনে প্রসবিল সকল তনয়।।ক্রমে উনপঞ্চাশ জন্মিল প্রভঞ্জন।দেখিয়া হইল ইন্দ্র সবিস্ময় মন।।অহিংসকে হিংসিয়া পাইলা বড় তাপ।জন্মিল পবনদেব অতুল প্রতাপ।।তবে কতদিনে ইন্দ্র কশ্যপ নন্দন।গৌতমের স্থানেতে করিল অধ্যয়ন।।চারিবেদ ষটশাস্ত্র অধ্যয়ন কৈল।তথাপিও কিছু তার জ্ঞান না জন্মিল।।পরমা সুন্দরী দেখি গুরুর রমণী।তারে হরিবারে ইচ্ছা করে সুরমণি।।একদিন যান মুনি স্নান করিবার।দেখে ইন্দ্র গুরুপত্না একা আছে ঘরে।।মদনে পীড়িত হয়ে অদিতি নন্দন।মায়া কার গুরুরূপী হইল তখন।।গুরুরূপে গুরুপত্নী হরিল দেবেন্দ্র।ক্ষণকাল পরে ঘরে আইল মুনন্দ্র।।স্বামীরে কহিল পরে বিনয় বচন।স্নান করিবারে গেলে করিয়া রমণ।।কিরূপে করিয়া স্নান এলে মুহূর্ত্তেকে।ইহার বৃত্তান্ত প্রভু বলিবা আমাকে।।এত শুনি মুনিবর ভাবি মনে মন।করিল অধর্ম্ম বুঝি কশ্যপ নন্দন।।গুরুপত্নী হরে এত করে অহঙ্কার।অতএব করিব ইহার প্রতিকার।।নিস্ফল করিলি যত শাস্ত্র অধ্যয়ন।তোর সম অজ্ঞান না দেখি কোনজন।।কপট করিয়া গুরুপত্নীরে হরিলি।পাইবি উচিত ফল যে কর্ম্ম করিলি।।হউক সহস্রযোনি শক্রের শরীরে।অলঙ্ঘ্য গৌতম বাক্য কে অন্যথা করে।।হইল সহস্রযোনি শক্রের শরীরে।স্বদেহ দর্শনে ইন্দ্র বিষণ্ন অন্তরে।।কোন্ লাজে দেবমাঝে দেখাব বদন।তপস্যা করিয়া আত্মা করিব নিধন।।সকল শরীরে আচ্ছাদিলেক বসন।চিন্তিত হইয়া যান কশ্যপ নন্দন।।ক্ষীরোদের কূলে গিয়া কশ্যপকুমার।করিল সহস্র বর্ষ তপ অনাহার।।সুরপুর নষ্ট হেথা হয় ইন্দ্র বিনে।পাপিষ্ঠ রাক্ষস নাশ করে রাত্রি দিনে।।দুরন্ত অসুর সব দেশেত ব্যাপিল।দান যজ্ঞ তপ জপ সকলি নাশিল।।জানিয়া কশ্যপ মুনি সচিন্তিত মনে।এ সকল তত্ত্ব পরে জানিলেন ধ্যানে।।ব্রহ্মাকে করেন স্তুতি বিবিধ প্রকারে।তোমার নির্ম্মিত সৃষ্টি অসুরে সংহারে।।কুকর্ম্ম করিল ইন্দ্র আমার নন্দন।কামবশে গুরুপত্নী করিয়া হরণ।।গৌতম দারুণ শাপ দিলেক তাহারে।হইল সহস্র ভগ তাহার শরীরে।।ক্রোধ করি দেবরাজ মজে অপমানে।ক্ষীরোদের কূলে তপ করে একাসনে।।ইন্দ্র বিনা অসুরেতে জগৎ ব্যাপিল।তব বিরচিত সৃষ্টি সব নষ্ট হৈল।।অতএব বাসবেরে করহ উদ্ধার।নিস্তার করহ প্রভু শাপান্ত তাহার।।এইরূপ কশ্যপ কহিল বহুতর।শুনিয়া সদয় হইলেন সৃষ্টিধর।।গৌতমেরে আনিয়া কনেহ বহুতর।মম বাক্য রক্ষা তুমি কর মুনিবর।।পাইল উচিত শাস্তি ক্ষমা দেহ মনে।কৃপায় শাপান্ত কর অদিতি নন্দনে।।গৌতম বলিল মুনি কর অবধান।কহিলাম যে কথা সে না হইবে আন।।তোমার কারণে বর দিলাম তাহারে।সহস্রেক চক্ষু যেন দেবরাজ ধরে।।শুনিয়া কশ্যপ মুনি আনন্দিত মন।যথাস্থানে গেলা করি দেব সম্ভাষণ।।সত্যলোকে গেলেন গৌতম তপোধন।কশ্যপ আইল যথা আপন নন্দন।।অব্যর্থ মুনির বাক্য না হয় খণ্ডণ।ভগচিহ্ন অঙ্গে লুপ্ত হইল তখন।।সহস্রেক চক্ষু হৈল ইন্দ্রের শরীরে।আপনাকে দেখি ইন্দ্র হরিষ অন্তরে।।কশ্যপ বলিল পুত্র কর অবধান।অনুচিত কর্ম্ম না করিও, সাবধান।।কাম ক্রোধ লোভ মোহ নিতান্ত বর্জ্জিহ।কদাচিত কোনজনে হিংসা না করিহ।।জ্ঞাতি বন্ধু আদি করি যত পরিবার।কদাচিত হিংসা নাহি করিবে কাহার।।এত বলি ইন্দ্রকে প্রেরিল যথাস্থান।এই শুন কহিলাম পূর্ব্ব উপাখ্যান।।ভীষ্ম যাহা কহিলেন না হয় অন্যথা।সম্প্রতি পাণ্ডবগণে আন রাজা হেথা।।সমুচিত রাজ্য দেহ ছাড়িয়া তাহারে।সমভাবে বাস কর সম ব্যবহারে।।ভাই ভাই বিরোধ নাহিক প্রয়োজন।কুলক্ষয় হবে আর কুযশ ঘোষণ।।এইমত দ্রোণ কৃপ বিদ্যুর সহিত।বিধিমতে দুর্য্যোধনে বুঝাইল নীত।।কার বাক্য না শুনিল কুরুকুলপতি।অদৃষ্ট মানিয়া গেল যে যার বসতি।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।০৩. রাজ্যলাভার্থ পাণ্ডবগণের পরামর্শ ও ধৌম্য-দ্বিজকে হস্তিনায় প্রেরণও ধৌম্য-দ্বিজকে হস্তিনায় প্রেরণবৈশম্পায়ন বলেন, শুন জন্মেজয়।বিরাট-নগরে পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।অজ্ঞাতে হইয়া মুক্ত মনে আনন্দিত।সুহৃদ বান্ধব সহ হইল মিলিত।।অভিমন্যু-বিবাহ-উৎসব দিনান্তরে।রজনী বঞ্চিয়া সুখে মহাসমাদরে।প্রাতঃকালে বসিলেন বিরাট-সভায়।।শত সূর্য্য, শত চন্দ্র, যেন শোভা পায়।।দিব্য সিংহাসনে বসিলেন যুধিষ্ঠির।বামেতে নকুল ভীম পার্থ মহাবীর।।দক্ষিনেতে সহদেব দুরুপদ রাজন।ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর আদি আর যত জন।।সম্মূখে বসিয়া কৃষ্ণ কমললোচন।প্রসঙ্গ করিল তবে দ্রুপদ রাজন।।যেই সত্য করেছিল পাণ্ডুর তনয়।ধর্ম্ম-অনুবলে তাহা হইল উদয়।।আপন পৈতৃক ভাগ যে হয় উচিত।লইতে উপায় তার করহ বিহিত।।মোর চিত্তে লয়, দুষ্ট পাপিষ্ঠ কৌরব।সম্প্রীতে কভু না ছাড়িবে রাজ্য বৈভব।।উত্তর গোগৃহে যত পায় অপমান।একেশ্বর ধনঞ্জয় করে সমাধান।।সেই অপমানে রাজা কৌরবের পতি।না করিবে প্রীতি, হেন লয় মম মতি।।তথাপি আছয়ে হেন শাস্ত্রের বিধান।দূত পাঠাইয়া দেহ ধৃতরাষ্ট্র-স্থান।।প্রিয়ম্বদ দূত যেই নীতিশাস্ত্র জানে।বিধিমতে বুঝাইবে অম্বিকা-নন্দনে।।ভীষ্ম দ্রোণে বুঝাইবে রাজা দুর্য্যোধনে।তবে যদি রাজ্য নাহি দেয় কদাচনে।।তবে যা বিধান হয়, করিব উচিত।আমা সবা মিলি শাস্তি দিব সমুচিত।।এতেক বলিল যদি দ্রুপদ ভূপতি।ভাল ভাল বলি সায় দিলেন নৃপতি।।ভাল ভাল, বলি ইহা লয় মম মন।সম্প্রীতে হইলে দ্বন্দ্বে কোন্ প্রয়োজন।।প্রিয়ম্বদ দূত যাক হস্তিনা-নগরে।জ্যেষ্ঠতাত আদি করি বুঝাবে সবারে।।দুর্য্যোধনে বুঝাউক, রাগার নন্দনে।তবে যদি সম্প্রীতি না করে কদাচনে।।তবে যা বিধান হয় করিব উচিত।এত শুনি ধৃষ্টদ্যুন্ন কহে সুবিহিত।।অকারণে দূত পাঠাইবে তথাকারে।সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য কৌরব পামরে।।মহা খল পাপাচার দুষ্ট দুর্য্যোধন।ততোধিক কর্ণ সেই রাধার নন্দন।।কপটে যতেক কষ্ট দিল দুষ্টগণ।বিনা যুদ্ধে শান্ত নাহি হবে কদাচন।।মুহূর্ত্তেক ক্ষমা করা উচিত না হয়।ইন্দ্রপ্রস্থে চল যাই লয়ে সৈন্যচয়।।লইবে আপন রাজ্য বলে মহারাজ।না নিলে বাড়িবে দর্প, নাহি দিলে লাজ।।সে কারণে মাগিবার নাহি প্রয়োজন।আপন ইচ্ছায় লহ আপন শাসন।।তবে যদি দ্বন্দ্ব করে কৌরব-কুমার।আমা সবা মিলি তারে করিব-সংহার।।সবংশে করিব ক্ষয় দুষ্ট কুরুগণে।এই যুক্তি নরপতি লয় মম মনে।।ভীমসেন বলে, ভাল কৈলে নরপতি।আপনি যেমত বিজ্ঞ কহিলে তেমতি।।সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য কুরু পাপাশয়।মুহূর্ত্তেক তারে ক্ষমা যুক্তিযুক্ত নয়।।যত দুঃখ দিল দুষ্ট পাপী দুর্য্যোধন।সে সব স্মরণে মম হেন লয় মন।।রজনীর মধ্যে সব হস্তিনা বেড়িয়ে।সকল কৌরবগণে মারহ পোড়ায়ে।।তবে সে আমার খণ্ডে হৃদয়ের তাপ।এরূপে নিঃশ্বাস ছাড়ে যেন কালসাপ।।ক্রোধেতে কম্পিত অঙ্গ অরুণ লোচন।রাজারে চাহিয়া বলে করিয়া গর্জ্জন।।তোমার কারণে এত দুঃখ সবাকার।তোমার কারণে জীয়ে কৌরব-কুমার।।কি বুঝি সম্প্রীতি বল করি তার সনে।বিনা দ্বন্দ্বে বাধ্য নহে রাজা দুর্য্যোধনে।।আজ্ঞা কর, নরপতি বিলম্ব না সয়।সসৈন্যে সাজিয়া আজি চল হস্তিনায়।।সবংশে মারিব আজি রাজা দুর্য্যোধনে।এই যুক্তি নরপতি লয় মম মনে।।অর্জ্জুন বলেন, ভাল কৈলে মহাশয়।আজ্ঞা কর কুরুগণে করি পরাজয়।।ক্ষমিবার যোগ্য নহে, কি হেতু ক্ষমিব।রজনীর মধ্যে আজি কৌরবে মারিব।।পার্থ- বাক্যে মাদ্রী-সুত জানায় সম্মতি।হাসিয়া কহেন তবে দেব জগৎপতি।।সে কহিল ভীমসেন আর ধনঞ্জয়।সেই মত করিবারে সমুচিত নয়।।তথাপি আছয়ে হেন শাস্ত্রের বিধান।সম্প্রীতে রিপুর সঙ্গে করিবে সন্ধান।।সম্প্রীতে না দিলে, বল করিবে পশ্চাতে।পূর্ব্বাপর হেন রাজা আছয়ে শাস্ত্রেতে।।প্রিয়ম্বদ দূত হবে, সর্ব্বশাস্ত্র জানে।পাঠাইয়া দেহ আগে হস্তিনা ভবনে।।দুর্য্যোধন আদি করি যত সভাজনে।ধর্ম্মনীতি বুঝাউক শাস্ত্রের বিধানে।।তবে যদি রাজ্য নাহি দেয় দুর্য্যোধন।মনে যাহা লয়, তাহা করিও তখন।।হেন চিত্তে লয় মম, রাজা দুর্য্যোধন।মনে যাহা লয়, তাহা করিও তখন।।হেন চিত্তে লয় মম, রাজা দুর্য্যোধন।সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য, করিবেক রণ।।ভূপতি বলেন, ভাল কথা নারায়ণ।দূত পাঠাইয়া দেহ হস্তিনা ভবন।।ধর্ম্মনীতি বুঝাইবে অম্বিকা-নন্দনে।তবু রাজ্য ছাড়িবে না, লয় মম মনে।।পশ্চাতে করিব তবে যেই মনে লয়।শুনিয়া উত্তর করিছেন ধনঞ্জয়।।বিরাট দ্রুপদ আদি সুহৃদ সুজন।রাজারে চাহিয়া তবে বলিল বচন।।সম্প্রীতে না দিলে রাজ্য কুরু কুলাঙ্গার।মোরা সবে মিলি তারে করিব সংহার।।এই মত যুক্তি করে যত রাজগণ।তবে ধৌম্যে বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।হস্তিনা-নগরে দেব যাহ শীঘ্রগতি।প্রীতিবাক্যে বুঝাইয়ে কুরুগণ প্রতি।।ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদি অম্বিকা-কুমারে।প্রীতিবাক্যে সমাচার দিবে সবাকারে।।গান্ধারী প্রভৃতি আর জননী কুন্তীরে।সমভাবে নমস্কার জানাবে সবারে।।জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রে কহিবে বচন।তোমার প্রসাদে জীয়ে ভাই পঞ্চ জন।।সম্প্রীতে বিনয় ভাবে অগ্রেতে কহিবে।না শুনিলে উপযুক্ত বচন বলিবে।।দম্ভ করি কহিবে, না কর তাহে ভয়।পাণ্ডবের হাতে তোর হবে কুলক্ষয়।।কপটে যতেক দুঃখ দিলে সবাকারে।সেই তাপ-হুতাশনে দহে কলেবরে।।তাহার উচিত শাস্তি অবিলম্বে দিবে।স্বংশেতে দুর্য্যোধনে অবশ্য মারিবে।।এরূপে ধৌম্যেরে কহি ভাই পঞ্চ জন।পাঠাইয়া দিল তাঁরে হস্তিনা ভবন।।তবে কৃষ্ণ প্রদ্যুন্নাদি যত পদুগণ।যুধিষ্ঠিরে সম্বোধিয়া করে নিবেদন।।আজ্ঞা কর দ্বারাবতী করি আগুসার।আসিব সংবাদ পেলে হেথা পুনর্ব্বার।।যুধিষ্ঠির বলে, শুন কহি নারায়ণ।সম্প্রীতে না দিবে রাজ্য দুষ্ট দুর্য্যোধন।।অবশ্য হইবে রণ, না হবে খণ্ডন।কৌরব সহায় মহা মহা বীরগণ।।তুমি অনুবলমাত্র কেবল আমার।তোমা বিনা গতি আর নাহি মো সবার।।তোমা বিনা আমরা যে ভাই পঞ্চ জন।যেমন সলিল-হীন মীনের জীবন।।চন্দ্র বিনা রাত্রি যেন শোভা নাহি পায়।তেন তোমা বিনা পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।আপনি আমারে কৃষ্ণ হও অনুকূল।তবে সে জিনিতে পারি কৌরবে সমূল।।এত শুনি হাসি হাসি বলে নারায়ণ।যে আজ্ঞা করিবে, তাহা করিব পালন।।মহারণ হব আমি র্পার্থের সারথি।স্বংশে করিব ক্ষয় কুরু-বংশপতি।।পার্থের বিক্রম রাজ্য খ্যাত ত্রিভুবনে।একেশ্বর জিনিবেক যত কুরুগণে।।ইন্দ্র আদি দেবগণ স্থির নহে রণে।কি করিবে শত ভাই কৌরব আপনে।।এত বলি আলিঙ্গন করি সেইক্ষণে।সবান্ধবে যান কৃষ্ণ দ্বারকা ভবনে।।উদ্যোগপর্ব্বের কথা অপূর্ব্ব আখ্যান।ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত পুরাণ।।পড়ে যেবা, শুনে যেবা, কহে যেই জন।সর্ব্ব দুঃখ খণ্ডে তার আপদ মোচন।।সেই কথা কহি আমি রচিয়া পয়ার।অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।কাশীরাম দাস কহে, পয়ার প্রবন্ধে।পিয়ে সাধুজন নিঙরিয়া ভাষা ছন্দে।।০৪. কুরুসভাতে ধৌম্যের প্রবেশ ও কুরুদের প্রতি কথনও কুরুদের প্রতি কথনমুনি বলিলেন শুন তবে জন্মেজয়।কুরুসভা মধ্যে গেলা ধৌম্য মহাশয়।।সভায় বসিয়া আছে কৌরবের পতি।সুহৃদ অমাত্য বন্ধুগণের সংহতি।।শত ভাই কুরুবংশ রাধাপুত্র আর।ভীষ্ম দ্রোণ আর গুরুর কুমার।।ধৃতরাষ্ট্র বিদুর অমাত্য যত জন।সভা করি বসিয়াছে কৌরব নন্দন।।হেনকালে কহে গিয়া ধৌম্য তপোধন।অবধান কর রাজা অম্বিকানন্দন।।পাণ্ডুপুত্র পঞ্চভাই পাঠান আমারে।আপন বিভাগ মত রাজ্য লইবারে।।কহিলেন বিনয় করিয়া ধর্ম্মরায়।সে সকল কথা রাজা কহিতে তোমায়।।জ্যেষ্ঠতাতে কহিবা আমার নিবেদন।তোমার প্রসাদে জীয়ে ভাই পঞ্চজন।।তুমি যে করিবা আজ্ঞা না করিব আন।তব অনুবর্ত্তি পঞ্চ পাণ্ডুর সন্তান।।যত দুঃখ সহিলাম তোমার কারণ।তব বশ হইয়া হারাই রাজ্যধন।।যে নির্ণয় পূর্ব্বে হৈল তোমার সাক্ষাতে।তাহাতে হইনু মুক্ত দুঃখ সঙ্কটেতে।।মহাদুঃখ পাইলাম অরণ্যে বিশেষ।জটাবল্ক পরিধান তপস্বীর বেশ।।তৎপরে অজ্ঞাতবাস করি লুকাইয়া।পরসেবা করি পর আজ্ঞাযর্ত্তি হৈয়া।।রাজপুত্র হইয়া ক্লীবের ব্যবহার।হীনসেবা করিলাম হীন দুরাচার।।পাইলাম এত দুঃখ নাহি করি মনে।সব দুঃখ পাসরিনু তোমার কারণে ।।আপন পৈতৃক ভাগ উচিত যে হয়।দিয়া প্রীত কর রাজা আমা সবাকায়।।ভাই ভাই বিরোধতে নাহি প্রয়োজন।এই মত কহিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।ভীম কহিলেন দর্প করিয়া অপার।অন্ধেরে কহিবে অগ্রে মম নমস্কার।।ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর পৃষতকুমারে।আমার বিনয় জানাইবে সবাকারে।।কহিবা নিষ্ঠুর বাক্য রাজ্য দুর্য্যোধনে।যত দুঃখ দিল তাহা সর্ব্বলোক জানে।।ক্ষমিলাম সে সকল চাহিয়া অন্ধেরে ।উচিত বিভাগ যেন দেয় পাণ্ডবেরে।।না দিলে আমার হাতে হবে বংশক্ষয়।এইরূপ কহিলেন ভীম মহাশয়।।অর্জ্জুন কহিলেন করিয়া মিনতি।কহিবা অন্ধের পদে আমার প্রণতি।।যত দুঃখ দিল দুষ্ট তাহা নাহি মনে।তোমার কারণে ক্ষমিলাম দুর্য্যোধনে।।যত অপমান কৈল দেখিলে সাক্ষাতে।দ্রৌপদীর কেশে ধরি আনিল সভাতে।।কপট পাশায় যত সর্ব্বস্ব লইল।দ্বাদশ বৎসর বনবাসে পাঠাইল।।সহিলাম সই সেব তোমার কারণে।আমার বিভাগ ছাড়ি দেহ এইক্ষণে।।সম্প্রীতে না দিলে দুঃখ পাইবে অপার।এইরূপে বলিলেন ইন্দ্রের কুমার।।সহদেব নকুল কহিল বহুতর।ধৃষ্টদ্যুন্ন দ্রুপদাদি যত নরবর।।পাণ্ডবের সমুচিত বিভাগ যে হয়।সন্তোষহ তাহা দিয়া পাণ্ডুর তনয়।।এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র করিল উত্তর।যে কহিলা অসদৃশ নহে মুনিবর।।পাইল অনেক দুঃখ পাণ্ডুপুত্রগণে।মম হেতু ক্ষমিলেক পাপ দুর্য্যোধনে।।কর্ণ দুঃশাসনে নিন্দা করিল অপার।মম হেতু ক্ষমিলেক পাণ্ডুর কুমার।।এখন যে কহি তাহা শুন সভ্যজন।প্রিয়ম্বদ দূত যাক পাণ্ডবের স্থান।।প্রিয়বাক্য কহিয়া আনিয়া হস্তিনায়।সমুচিত ভাগ দিয়া তোষ তা সবায়।।নানা বস্ত্র অলঙ্কার ধন বহুতর।পুরষ্কার দিয়া তোষ পঞ্চ সহোদর।।সেই ইন্দ্রপ্রস্ত পুনঃ দেহ অধিকার।যত রত্ন ছিল তার যতেক ভাণ্ডার।।যেই সত্য করিলেক তাহে হৈল পার।সমচিত ভাগ দেহ উচিত তাহার।।বলেতে অশক্ত নহে ভাই পঞ্চজন।মুহূর্ত্তেকে জিনিবারে পারে ত্রিভুবন।।অতএব দ্বন্দ্ব কিছু নাহি প্রয়োজন।অর্দ্ধ রাজ্য দিয়া তোষ পাণ্ডু পুত্রগণ।।ভীষ্ম বলিলেন ভাল নিল মম মনে।উপযুক্ত যুক্তি বটে কর এইক্ষণে।।বিরোধ হইলে রাজা হবে কোন্ কাজ।সমুচিত ভাগ তারে দেহ মহারাজ।।না দিলে নিশ্চয় রাজা হবে কুলক্ষয়।অতএব সাবধানে শুন মহাশয়।।প্রিয়ম্বদ দূত রাজা দেহ পাঠাইয়া।পাণ্ডবেরে হেথা আন বিনয় করিয়া।।তবে সে তোমার হিত হইবে রাজন।আমারে এতেক কহ কোন প্রয়োজন।।কৌরবের পতি তুমি কৌরবের গতি।তোমা বিনা কুরুকুলে নাহি অব্যাহতি।।তুমি যে কহিবে তাহা কে করিবে আন।যেই চিত্তে লয় তাহা করহ বিধান।।ভীষ্মের এতেক বাক্য শুনি সভ্যগণ।সাধু সাধু বলি প্রশংসিল জনে জন।।দ্রোণ কৃপ বিদুরাদি বাহলিক নৃপতি।পাণ্ডবে আনিতে সবে দিল অনুমতি।।পুনঃ পুনঃ নানামতে কহিল অন্ধেরে।সম্প্রীতে আনহ রাজা পঞ্চ সহোদরে।।সমুচিত ভাগ তারে দেহ রাজধানী।এই কর্ম্ম তব প্রিয় শুন নৃপমণি।।এইরূপে কহিল সক সভাজন।মনে মনে ক্রোধে জ্বলে রাজা দুর্য্যোধন।।পাণ্ডবের প্রশংসা কর্ণেতে লাগে শাল।ক্রোধভরে হেঁটমাথা কুরু মহীপাল।।তবে দুর্য্যোধনে কহে অন্ধ নরপতি।আমার বচন সুত কর অবগতি।।সবার সম্মান রাখ শুন মম বাণী।পাণ্ডবেরে সমুচিত দেহ রাজধানী।।ভাই ভাই সংপ্রীতে করহ রাজাসুখ।কলহেতে কার্য্য নাহি জন্মে মহাদুঃখ।।লোকেতে কুযশ ঘোষে অপকীর্ত্তি হয়।পূর্ব্বের কাহিনী শুন কহি যে তোমায়।।মন দিয়া শুন বৃক রাজার আখ্যান।ঘুচিবে মনধন্ধ লভিবে দিব্য জ্ঞান।।মহাভারতের কথা সুধা সঞ্জীবনী।কাশীরাম কহে, ভব পারের তরনী।।০৫. বৃক রাজার উপাখ্যানসূর্য্যবংশে বৃক নামে ছিল নরপতি।মহাধর্ম্মশীল রাজা জগতে সুখ্যাতি।।সুমতি কুমতি তার যুগল বনিতা।কোশলনন্দিনী দোঁহে মাতা পতিব্রতা।।যুবাকাল গেল তবু পুত্র না হইল।পুত্রবাঞ্ছা করি দোঁহে স্বামীরে কহিল।।কত দিনান্তরে বিভাণ্ডক তপোধন।অয্যোধ্যায় করিলেন শুভ আগমন।।ভার্য্যা সহ নরপতি ছিল অন্তঃপুরে।তথা গিয়া উত্তরিল কে নিবারিবে তাঁরে।।জিতেন্দ্রিয় তেজোময় দেখি তপোধন।ভার্য্যা সহ নরপতি করিল বন্দন।।রাণী সহ করযুড়ি মনি অগ্রে স্থিত।বিভাণ্ডক জিজ্ঞাসেন কিবা, চাহ হিত।।মহাধর্ম্মশীল তুমি নৃপতিপ্রধান।তোমা সম সংসারেতে নাহি ভাগ্যবান।।রূপে কামদেব জিনি শীলতায় ইন্দু।তেজে দিনকর তুমি গুণে গুণসিন্ধু।।কীর্ত্তবীর্য্য প্রতাপে সামর্থ্যে হনুমান।কীর্ত্তিতে গণি যে পৃথু রাজার সমান।।সেনাপতি মধ্যে গণি যেন ষড়ানন।সর্ব্বজ্ঞ শ্রেণীতে যেন জীবের নন্দন।।কেন দেখি চিন্তামগ্ন উদ্বিগ্ন তোমারে।ইহার বৃত্তান্ত রাজা কহিবে আমারে।।রাজা বলিলেন মুনি বলিলা প্রমাণ।যে হেতু চিন্তিত আমি বলি সে বিধান।।যুবাকাল গেল মম পুত্র না হইল।এই হেতু মনস্তাপ মনেতে রহিল।।সকল হইতে সেই জন অতি দীন।সর্ব্ব সুখ বিহীন যে হয় পুত্রহীন।।জলহীন নদী যেন নহে সুশোভন।পদ্মহীন সর ফলহীন তরুগণ।।চন্দ্র বিনা রাত্রি যেন সর্ব্ব অন্ধকার।শাস্ত্রবিদ্যাহীন যেন ব্রাহ্মণ-কুমার।।ধর্ম্মহীন জন যেন ধনহীন গৃহী।জীবহীন জন্তু যেন দন্তহীন অহি।।পুত্রহীন জনের জীবন অকারণ।এই হেতু চিন্তা মম শুন তপোধন।।এত শুনি হৃদয়ে ভাবিল মুনিবর।রাজারে চাহিয়া পুনঃ করিল উত্তর।।পুন্ত্রেষ্টি করহ রাজা করিয়া যতন।মহাবলবন্ত হবে তোমার নন্দন।।পরাজিবে সকল পৃথিবী বাহুবলে।হইবে তনয় তব যজ্ঞ পুণ্যফলে।।এত বলি অন্তর্হিত হন তপোধন।করিল পুত্রেষ্টি রাজা করি আয়োজন।।সুমতির গর্ভে হয় যুগল নন্দন।পরম সুন্দর রূপে নৃপতি লক্ষণ।।কুমতির গর্ভে হৈল একমাত্র পুত্র।দিনকর সম তেজ তেজপুঞ্জ গাত্র।।দিনে বাড়ে সবে রাজার নন্দন।পুত্র দেখি নরপতি আনন্দিত মন।।সুমতির গর্ভে হৈল দুই গুণধাম।পাইলেন তালজঙ্ঘ হৈহয় যে নাম।।রূপে গুণে অনুপম কুমতিনন্দন।বাহু নাম রাখিলেন বাছিয়া রাজন।।কত দিনে বৃদ্ধকালে বৃক নরপতি।তিন পুত্রে ডাকিয়া আনিল শীঘ্রগতি।।তিন পুত্রে রাজ্যধন ভাগ করি দিল।ভার্য্যা সহ নরপতি অরণ্যে চলিল।।তপঃযোগ সাধিয়া পাইল দিব্যগতি।রাজ্যতে হইল রাজা বাহু নরপতি।।রাজার পালনে প্রজা দুঃখ নাহি জানে।একচ্ছত্র নরপতি এ মর্ত্ত্য ভুবনে।।মহাধর্ম্মশীল রাজা বৃকের নন্দন।নিরন্তর যজ্ঞে রত অন্য নাহি মন।।অযোনিসম্ভবা কন্যা নামে সত্যবতী।বিবাহ করিল শুনি আকাশ ভারতী।।এক ভার্য্যা বিনা তার অন্যে নাহি মতি।পুরুরবা রাজা যেন বুধের সন্ততি।।কতদিনে ঋতুযোগে রাণী গর্ভবতী।গণিয়া গণকগণ কহিল ভারতী।।ইহার গর্ভেতে যেই হইবে নন্দন।ত্রিভুবনে রাজা হবে সেই বিচক্ষণ।।অস্ত্রে শস্ত্রে বিজ্ঞবর মহাধনুর্দ্ধর।করিবেন শত অশ্বমেধ নরবর।।শুনি আনন্দিত রাজা হইল অন্তরে।বহু পুরস্কার দিল ব্রাহ্মণগণেরে।।তবে কত দিনান্তে নারদ তপোধন।হৈহয় রাজার পুরে করিল গমন।।নারদে দেখিয়া রাজা অভ্যর্থনা করি।বসাইল দিব্য রত্ন সিহাসনোপরি।।পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া রাজা পূজন করিল।মুনিবরে বিনয়পূর্ব্বক জিজ্ঞাসিল।।সর্ব্বশোস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি কুলপুরোহিত।বশিষ্ঠ মুখেতে তব শুনিয়াছি নাত।।জ্ঞাতি মধ্যে যেই ধনে জনে বলবান।ক্ষত্রিয়েতে সেই শত্রু গণি যে প্রধান।।বলে ছলে শত্রুকে না ক্ষমি কদাচন।হেন নাতি শাস্ত্রেতে লেখেন মুনিগণ।।কহ মুনি আমা প্রতি ইহার বিধান।নারদ বলেন রাজা কহিলে প্রমাণ।।বলে ছলে শক্রকে না ক্ষমিবে কখন।নিজবশে আনি পরে করিবে নিধন।।কহিলা প্রমাণ রাজা না হয় অন্যথা।শত্রুকে করিবে নষ্ট পাবে যথা তথা।।গর্ভে যদি জন্মে শক্র দৈববাণী কয়।তাহারে বধিবে প্রাণে শাস্ত্রের নির্ণয়।।পূর্ব্বে শুনিয়াছি আমি বিরিঞ্চির স্থান।কহিব তোমারে নৃপ কর অবধান।।বাহুর ঔরসে যেই হইবে নন্দন।বাহুবলে পরাজিবে সমস্ত ভুবন।।শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করিবে নিশ্চয়।তোমা আদি জ্ঞাতিগণে করিবেক ক্ষয়।।উপায়েতে গর্ভ যদি পার নাশিবারে।তবে তব শ্রেয়ঃ হয় জানাই তোমারে।।এত বলি নারদ হইল অন্তর্দ্ধান।শুনিয়া নৃপতি হইল সচিন্তিত প্রাণ।।অনুক্ষণ চিন্তিয়া আকুল নরবর।একদিন বসিলেন সভার ভিতর।।পঞ্চ পাত্রে লয়ে যুক্তি করেন রাজন।বাহুর ঔরসে যেই হইবে নন্দন।।আমা আদি করিয়া যতেক জ্ঞাতিচয়।বাহুবলে করিবেক সবাকারে ক্ষয়।।উহার উপায় কিছু কর মন্ত্রিগণ।কিরূপে রাণীর গর্ভ করিব নিধন।।উহাতে সমর্থ না হইব কদাচন।যদি না করিব যুদ্ধ হারাব জীবন।।মন্ত্রিগণ বলিলেন শুন নৃপমণি।নিমন্ত্রিয়া আন হেথা ভূপতি রমণী।।বধি খাওবার ছলে উপায় কারণে।বিষপান করাইয়া মারহ পরাণে।।ইহ ভিন্ন উপায় না দেখিতেছি আর।এইমত করি রাজা শিশুকে সংহার।।ভূপতি বলেন মন্ত্রী কহিলে শোভন।শীঘ্র ভক্ষ্য ভোজ্য দ্রব্য আয়োজন।।বন্ধন করিতে বল সূপকারগণে।অঙ্কেতে করিবা যেন কেহ নাহি শুনে।।রবিবারগণ সহ বরিয়া রাজারে।এত দিয়া নিমন্ত্রিয়া আন হেথাকারে।।জার আদেশ মত যত মন্ত্রিগণ।বাহুরাজে আনিলেন করি নিমন্ত্রণ।।বিষ দিয়া উপহারে ভোজনের কালে।বাহুর ভার্য্যারে খাওয়াল তবে ছলে।।তথাপিহ গর্ভপাত নহিল তাহার।পরিবার সহ রাজা কৈল আগুসার।।সে সব বৃত্তান্ত রাণী কহিল রাজারে।বিষ খাওয়াইল মোরে মারিবার তরে।।অহিংসক মোরে হিংসা করে দুরাচার।শুনিয়া নৃপতি মনে হইল ধিক্কার।।হিংসক কপট জ্ঞাতি মধ্যে যেই জন।তাহার নিকটে নাহি জ্ঞাতি সুশোভন।।অহিংসকে হিংসয়ে যে পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।তাহার সংসর্গে নাহি রহি কদাচন।।পাপী সঙ্গে রহে যদি, পাপে ধায় মন।পুণ্যাত্মার সঙ্গ হয় মোক্ষের কারণ।।অপত্য নহিল, হৈল বিধির ঘটন।তাহে দুষ্ট জ্ঞাতিগণ করিল হিংসন।।এইরূপে সদা রাজা করে অনুভব।দ্বিতীয় বৎসর গর্ভ নহিল প্রসব।।অনুদিন হৈহয় অনুজ তালজঙ্ঘ।রিপুভাব করিলেন নৃপতির সঙ্গ।।কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন সহ মৈত্রভাব করি।সংগ্রামে জিনিয়া তার রাজ্য নিল হরি।।যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাহু নরপতি।অরণ্যে প্রবেশ করে ভার্য্যার সংহতি।।দেখিল আশ্রম বন অতি সুশোভন।ফল ফুলে সুশোভিত যত বৃক্ষগণ।।দিব্য সরোবর আছে বনের মাঝারে।তাহে জলচরগণ সদা কেলি করে।।পুণ্য সরোবর সেই বিন্দুসর নাম।প্রফুল্ল সরোবর সেই বিন্দুসর নাম।।প্রফুল্ল উৎপল কত অতি অনুপাম।।ভার্য্যা সহ তথা রাজা করিল গমন।সরোবর দেখি রাজা আনন্দিত মন।।তথায় আশ্রম করি রচিল কুটীর।চিন্তায় আকুল রাজা, চিত্ত নহে স্থির।।অনুক্ষণ চিন্তাকুল বাহু-নরবর।বৃদ্ধকালে ব্যাধিযুক্ত হৈল কলেবর।।কালপ্রাপ্তে নৃপতির হইল নিধন।ব্যাকুলা হইয়া রাণী করয়ে রোদন।।অনেক রোদন করে বনে একেশ্বরী।নিবৃত্ত হইল তবে মনে যুক্তি করি।।চিতা করি কাষ্ঠ দিয়া জ্বালি বৈশ্বানর।তদুপরি রাখে সতী পতিকলেবর।।চিতা আরোহিতে চিতা প্রদক্ষিণ করে।হেনকালে ঔর্ব্ব মুনি আসে তথাকারে।।গর্ভবতী নারী চিতা আরোহণ করে।দেখিয়া বিস্ময় মুনি মানিল অন্তরে।।নিকটেতে গিয়া শীঘ্র করে নিবারণ।রাণীরে চাহিয়া তবে বলে তপোধন।।চিতা আরোহণ নাহি কর কদাচিত।অবধান কর মাতা শাস্ত্রের বিহিত।।দিব্য চক্ষে আমি সব পাই যে দেখিতে।রাজচক্রবর্ত্তী আছে তোমার গর্ভেতে।।বাহুবলে জিনিবেক যত রিপুগণে।একচ্ছত্র রাজা হবে এ মর্ত্ত্য ভুবনে।।রাজরাজেশ্বর হবে মহাতেজোময়।শত অশ্বমেদ-যজ্ঞ করিবে নিশ্চয়।।ব্রাহ্মণে দিবেক সদা অপ্রমিত দান।না হইল, না হইবে, তাহার তুলন।।গর্ভবতী নারী যদি সহমৃতা হয়।পঞ্চ মহাপাপ আসি তাহারে বেড়ায়।।কদাচিৎ স্বামীসঙ্গে না হয় মিলন।ঘোর নরকেতে তার হয়ত গমন।।যত পুণ্যকর্ম্ম তার সব নষ্ট হয়।কদাচিৎ পুণ্যফল নাহিক সে পায়।।রজঃস্বলা কিম্বা শিশু পুত্রেরে রাখিয়া।পতি সঙ্গে যেই জন মরয়ে পুড়িয়া।।পঞ্চ পাতকের ভাগী হয় সেই নারী।ব্যর্থ হয় যত পুণ্য ধর্ম্মকর্ম্ম তারি।।অগ্নিহোত্রে মৃত-তনু করিয়া দাহন।নারীরে লইয়া গেল আপন সদন।।প্রেতকর্ম্ম করিল যে শাস্ত্রের বিধানে।আদ্য শ্রাদ্ধ শান্তি দান ত্রয়োদশ দিনে।।এইরূপে রহে রাণী মুনির সদন।সেবাতে সন্তুষ্ট হন মহা তপোধ।।অন্যথা না হয় কভু বিধির লিখন।মহারাণী প্রসবিল অপূর্ব্ব নন্দন।।গরল সহিত পুত্র হৈল যে কারণ।সগর বলিয়া নাম রাখে সে কারণ।।দিনে দিনে বাড়ে শিশু সুন্দর লক্ষণ।শুক্লপক্ষে চন্দ্রকলা বাড়য়ে যেমন।।দরিদ্র পাইল যে হারানিধি ধন।সে মত পাইল রাণী অপত্য-রতন।।মধু ক্ষীর দুগ্ধ চিনি করি আনয়ন।যত্ন করি যেই শিশু করেন পালন।।নানা অস্ত্র-শস্ত্র করাইলে অধ্যয়ন।অল্প দিনে হৈল সর্ব্বশাস্ত্রে বিচক্ষণ।।নবীন বয়স শিশু মহাবলধর।একদিন তীর্থস্থানে গেল মুনিবর।।একান্তে মায়েরে শিশু জিজ্ঞাসিল বাণী।কোন্ বংশে জন্ম মম, কহ গো জননী।।কাহার তনয় আমি কহিবে নিশ্চয়।এই মুনিবর বুঝি মম পিতা হয়।।শিশুকালে পিতৃহীন হয় যেই জন।দুঃখী হতে দুঃখী সেই, জন্ম অকারণ।।জলহীন নদী যথা নহে সুশোভন।ফলহীন নদী যথা অতি কুলক্ষণ।।চন্দ্র বিনা রাত্রি যথা সব অন্ধকার।গায়ত্রী বিহনে যথা ব্রাহ্মণ-কুমার।।ধনহীন গৃহী যথা ধর্ম্মহীন নর।বেদহীন বিপ্র যথা পদ্মহীন সর।।পিতৃহীন পুত্র তথা শোভা নাহি পায়।সে কারণে কহ মাতা, জিজ্ঞাসি তোমায়।।এত শুনি কহে রাণী করিয়া রোদন।বড় ভাগ্যবশে তোমা পাইনু নন্দন।।মহা রাজবংশে পুত্র জনম তোমার।তুমি সূর্য্যবংশে রাজা বাহুর কুমার।।তালজঙ্ঘ হৈহয় পাপিষ্ঠ জ্ঞাতিগণ।কপটে তোমার বাপে করিল নিধন।।যেই কালে তোমা আমি ধরিনু উদরে।বিষ খাওয়াইল মোরে তোমা মারিবারে।।দৈববলে রক্ষা হৈল তোমার জীবন।আমা সহ এই বনে আসিল রাজন।।হিংসকের হিংসা হেরি চিন্তি নরবর।ব্যাধিযুক্ত নরপতি ত্যজে কলেবর।।সহমৃতা হতে মম চিন্তা উপজিল।ঔর্ব্ব মুনি আসি মোরে বারণ করিল।।মুনির আশ্রমে আমি আছি সে কারণ।এতেক বলিয়া রাণী করেন রোদন।।শুনিয়া সগর ক্রোধে অরুণ লোচন।মাতার ক্রন্দন পুত্র করে নিবারণ।।প্রণমিয়া জননীরে লইয়া বিদায়।নানাবিধ অস্ত্র শস্ত্র সঙ্গে করি লয়।।মুনিরে প্রণাম করি বিদায় হইয়া।সৃহৃদ বান্ধবগণে সহায় করিয়া।।যতেক পিতার শত্রু পূবর্ব হৈতে ছিল।অস্ত্রেতে কাটিয়া সব খণ্ড খণ্ড কৈল।।একেশ্বর বিনাশিল যত রিপুগণ।প্রাণভয়ে কেহ নিল বশিষ্ঠে শরণ।।কাতর দেখিয়া তারে দিল প্রাণদান।কোন জন মুনিস্থানে রাখিল পরাণ।।তখন বশিষ্ঠ মুনি তারে নিবারিল।অযোধ্যায় লয়ে সিংহাসনে বসাইল।।একচ্ছত্র রাজা হৈল ধরণীমণ্ডলে।যত ক্ষত্রগণে শাসে নিজ বাহুবলে।।পুত্র ষাটি সহস্র যে তাহার ঔরসে।অদ্যাবধি যার কীর্ত্তি সংসারেতে ঘোষে।।পুত্রগণ সবে হৈল মহা দুরাচার।কপিলের শাপে তারা হইল সংহার।।অহিংসকে হিংসে যেই, পায় এই গতি।জগতে অকীর্ত্তি হয়, অশেষ দুর্গতি।।সে কারণে শুন পুত্র না হও বিমন।পাণ্ডবের সহ দ্বন্দ্বে কিবা প্রয়োজন।।সমুচিত ভাগ দিতে উচিত যে হয়।তাহা দিয়া প্রীত কর পাণ্ডুর তনয়।।ভাই ভাই বিরোধেতে নাহি প্রয়োজন।অনুমতি দেহ আনাইতে পঞ্চ জন।।সেই ইন্দ্রপ্রস্থে পুনঃ দেহ অধিকার।তাহার সহিত দ্বন্দ্বে কি কাজ তোমার।।দুর্য্যোধন বলে, ইহা নহেত বিচার।আমার পরম শত্রু পাণ্ডর কুমার।।বিনা যুদ্ধে ছাড়িয়া না দিব রাজ্যধন।ক্ষত্র-ধর্ম্ম শাস্ত্র মত আছে নিরূপণ।।ক্ষত্র হয়ে শত্রুকে না করিবে বিশ্বাস।শত্রুর মহিমা কেহ না করে প্রকাশ।।যে হৌক, সে হৌক, তাত ক্রোধ কর তুমি।বিনা যুদ্ধে পাণ্ডবে না দিব রাজা ভূমি।।এত বলি সভা হৈতে চলিল উঠিয়া।কর্ণ দুঃশাসন আর দুষ্ট মন্ত্রী লৈয়া।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত পুরাণ।।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, নাহিক সংশয়।পয়ার প্রবন্ধে কাশীরাম দাস কয়।।
ConversionConversion EmoticonEmoticon