বসুদেব মহামায়াকে সংগে নিয়ে পূর্ববৎ কারাগারে প্রবেশ করলেন। কারারক্ষিগণ শিশুর ধ্বনি শ্রবণ করে দেবকীর অষ্টম গর্ভের জন্মের কথা ভোজরাজ কংসকে অবহিত করালেন। কংসও এ জন্মের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল। কারারক্ষিদের কাছ থেকে দেবকীর সন্তান জন্মের কথা শ্রবণ করার পর শয্যা হতে গাত্রোত্থান করে কারাগারে প্রবেশ করলেন। দেবকী তার সন্তানকে রক্ষা করার জন্য ভ্রাতাকে অতি কাতরভাবে বললেন,” হে কল্যাণ! হে ধার্মিক! দেখ এটি বালক নয়, বালিকা। এ কন্যা তোমার পুত্রবধূ হবে।” এ কথা বলে দেবকী কংসকে লোভ দেখাল। ”এটি কন্যা, ইহাকে বধ করতে পারেন না।” বলপূর্বক কন্যা সন্তানটিকে ছিনিয়ে নিতে গেলে দেবকী বলল,” এ কন্যা সন্তান। এ বালিকা অসমর্থ ও অবধ্যা। ইহাতে তোমার মৃত্যুভয় নেই হে ভ্রাত! আপনি দৈব সংবাদ শ্রবণ করে আমার অনেক পুত্র বিনাশ করেছেন। এ একটি মাত্র কন্যা আমাকে প্রদান করুন। আমি পুত্রভাগ্যহীনা।” দেবকী কন্যা সন্তানটি বুকে আকড়িয়ে ধরে অতিশয় কাতর হয়ে রোদন করছে আর কন্যা সন্তানটির প্রাণ ভিক্ষা প্রার্থনা করছে। কিন্তু এতে কংসের পাষাণ হৃদয়ে বিন্দুমাত্র দয়ার উদয় হলো না। সে দেবকীর কোল থেকে কন্যা সন্তানটি বলপূর্বক কেড়ে নিল। সদ্যজাত শিশুটিকে নির্দয়হীনভাবে শিলার উপর নিক্ষেপ করল। কিন্তু সে কন্যা কংসের হাত হতে ফসকে গিয়ে আকাশে দৈববাণী করল। তিনি বিষ্ণুর অনুজা সশস্ত্র অষ্টমহাভূজারুপে দৃশ্য হলেন। তিনি দিব্য বসন-ভূষণ ও মাল্যালঙ্কারে ভূষিতা ও অষ্ট ভূজে শূল, ধনু, খড়গ, বাশ, চর্ম্ম,শঙ্খ, চক্র ও গদা ধারণ করেছিলেন। মহামায়া বললেন,” হে মূঢ়! আমাকে হত্যা করলে কি হবে। তোমার হন্তারক অন্যস্থানে জন্ম গ্রহণ করেছে। তুমি আর বৃথা বালকদিগকে হত্যা করিও না।” কংস দৈববাণী স্মরণ করে চিন্তা করতে লাগল কিভাবে এ বাণী মিথ্যা হলো। এ ঘটনা তাকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি কারাগার হতে বসুদেব ও দেবকীকে মুক্ত করে দিলেন। তিনি তার ভগিনীকে বললেন,” হে ভগিনী! হে ভগ্নিপতি! আমি পাপিষ্ঠ। আমি তোমাদের পুত্রগণকে হত্যা করেছি। ব্রহ্মহত্যার জন্য আমি কোন লোকে যাব জানিনা। কিন্তু মানুষই কেবল মিথ্যা কথা বলে না, দেবতারও মিথ্যা কথা বলে। তাদের কথা বিশ্বাস করে আমি তোমাদের পুত্রগণকে হত্যা করেছি। তোমরা তোমাদের পুত্রদের জন্য শোক করিও না। তারা তাদের কর্মফল ভোগ করেছে। এ সংসারে কোন প্রাণীই একত্রে থাকতে পারে না। কারণ তারা দৈবাধীন। হাড়ি-কলসীর ঢাকনা উৎপন্ন হয় এবং ভেঙ্গে যায়, কিন্তু আত্ম সেরুপ নয়। যেমন ঘট-শরাবাদি উৎপন্ন ও বিনষ্ট হলে পৃথিবীর কোন বিপর্যয় হয় না- সেরুপ দেহের বিনাশ হলেও আত্মার কোন বিনাশ হয় না। যারা দেহাত্মবুদ্ধি সম্পন্ন তারা প্রতিদেহেই আত্মাকে ভিন্ন বলে মনে করে। ফলে পুত্রাদির জন্ম-মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে। আর এর নামই সংসার। আত্মজ্ঞান ব্যতীত এ সংসার নিবৃত্ত হয় না। আত্মজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত পুন: পুন: জন্ম-মৃত্যু চলতে থাকে। দেহাত্মাভিমানী জীব মনে করে যে হত্যা করা বা হত হওয়া মানেই আত্মহনন, এ জন্যই দেহাভিমানী অজ্ঞ জীব বাধ্য ও বাধক প্রাপ্ত হয়। তোমরা সাধুজন এবং বন্ধুবাৎসল্য। আমি দূরাত্মা। আমাকে তোমরা ক্ষমা কর বলে অশ্রুনয়নে দেবকী ও বসুদের চরণ স্পর্শ করল।” কংস মহামায়ার কথায় বিশ্বস্ত হয়ে দেবকী-বসুদেবের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার করল এবং তাদের পায়ের শিকল খুলে দিল। দেবকী ভ্রাতার প্রতি যে ক্রোধান্বিত হয়েছিল সে ক্রোধও পরিত্যাগ করল। তারপর বসুদেব হাস্যবদনে বলল,” হে মহারাজ! আপনি যা বলছেন তা ঐ প্রকার দেহীদিগের অহংবুদ্ধি অজ্ঞানজাত হতে জন্মে, সে অহংবুদ্ধি হতে কে পর, কে আপন বলে ভেদদর্শন হয়। সে ভেদদর্শনকারী দেহীগণ শোক, হর্ষ, লোভ, মোহ, ভয়, দ্বেষ এবং মদে পরিপূর্ণ থাকেন, সুতরাং নিমিত্তীভূত রাজা ব্যাঘ্র-রোগাদির দ্বারা মনুষ্য-গবাদিকে যিনি বিনষ্ট করেন, সে ঈশ্বরকে দেখতে পান না। তারপর কংস দেবকী ও বসুদেবের অনুমতি নিয়ে নিজ প্রাসাদের প্রবেশ করল। পরদিন প্রভাতে কংস তার মন্ত্রিগণের সহিত যোগমায়ার বাক্য সবিস্তারে বর্ণনা করল। “যদি মহামায়া দৈত্যগণেকে দেবগণের জাতক্রোধ, অল্পজ্ঞ ও দেবশক্র মনে করেন তাহলে তো পুর, গ্রাম বা ব্রজপুরে যত শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে তারা দশ দিনের বা কম হোক সে সব শিশুকে বিনাশ করা উচিৎ। হে মহারাজ! দেবতারা সমরভীরু, আপনি বাণ বর্ষণ করতে থাকলে তারা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়নপর হয়। সে সব দেবতা হতে কিসের ভয়? বিষ্ণু গুপ্তস্থানে বাস করেন, শিব ইলাবৃতবর্ষমধ্যে পুরুষের প্রবেশযোগ্য কুমারবনে বাস করেন, ইন্দ্র অল্প বীর্য্যসম্পন্ন আর ব্রহ্মা তপস্যাপরায়ণ তার কোন বিক্রম নেই। সুতরাং তাদেরকে ভয় পাওয়ার কি হেতু? দেবতারা আমাদের জাতশক্র হলেও ইহাদেরকে উপেক্ষা করা যায় না, তাদের মূলোৎপাটন করার জন্য আমাদেরকে নিযুক্ত করুন। শরীরের কোন রোগকে উপেক্ষা করলে তাকে সারিয়ে তুলা যায় না, ইন্দ্রিয়গণকে উপেক্ষা করলে তাহাদিগকে বশীভূত করা দু:সাধ্য, তেমনি শক্রকে উপেক্ষা করলে সে সহায়াদি-সম্পন্ন হয়ে অজেয় হয়, তাকে চালিত করা যায় না। স্বয়ং বিষ্ণু হচ্ছেন দেবতাদের মূল। যেখানে সনাতন ধর্ম সেখানেই তিনি থাকেন। গো, বিপ্র, বেদ, তপস্যা, শম, দম, শ্রদ্ধা, দয়া তিতিক্ষা ও যজ্ঞ সবকিছূ বিষ্ণুর শরীরে অবস্থান করে। হে মহারাজ! বিষ্ণুই সকল দেবতার অধ্যক্ষ। সকলের অন্তর্যামি, অসুর বিদ্বেষী। তিনিই ঈশ্বর ও ব্রহ্মার সহিত সমস্ত দেবতার মূল। সেই বিষ্ণুকে বধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে- ঋষিদের হিংসা করা।” দৈত্যগণ কংসকে এ কথাগুলো বলল। দুমর্তি কংস তার দুর্মতি মন্ত্রিগণের সতি সলাপরামর্শ করে ঋষিগণ হিংসা করা নিজের হিতকর মনে করেছিল। কারণ কংস কালপাশ দ্বারা আবৃত
Sign up here with your email
ConversionConversion EmoticonEmoticon