ধ্রুবের জন্মবৃত্তান্ত

মহারাজ উত্তানপাদের দুই পত্নী ছিলেন। একজনের নাম সুনীতি ও অন্য জনের নাম সুরুচি। ছোট স্ত্রীর প্রতি মহারাজের আসক্তি ছিল বেশী। কালক্রমে সুনীতির গর্ভে ধ্রুবের জন্ম এবং সুরুচির গর্ভে উত্তমের জন্ম হল। মহারাজ সুরুচির প্রতি একান্ত আসক্তির কারণে উত্তম তার অতিশয় প্রীতিভাজন হয়েছিল। প্রিয়তমা সুরুচির সন্তষ্ট্যির জন্য মহারাজ সর্বদা উত্তমাকে ক্রোড়ে রেখে আদর করতেন। একদিন মহরাজ উত্তানপদ সিংহাসনে বসে ছিলেন। তার ক্রোড়ে উত্তম ছিল। তিনি উত্তমকে আদর করতে ছিলেন। এমন সময় ধ্রুব সেখানে এসে পিতার ক্রোড়ে উঠতে চাইলেন। ইহাতে মহারাজের কৃপার উদয় হল কিন্তু  সুরুচির অবলোকনের কারণে ধ্রুবকে ক্রোড়ে তুলে সমাদর করতে পারলেন না। কিন্তু কুমুলমতি ধ্রুব পিতার ক্রোড়ে উঠার জন্য আকুবাকু করতে লাগল। তখন পাষাণহৃদয়া সুরুচি গর্বিত বাক্যে কুমুলমতি ধ্রুবেক বলতে লাগল,” আরে বালক! তুমি তো আমার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করনি। তুমি অন্যস্ত্রীর গর্ভজাত হয়ে কেন অসম্ভব প্রত্যাশা করছ? আমার সন্তান যে মহারাজের ক্রোড় আশ্রয় করে আছে, উহা কি তোমার উপযুক্ত স্থান? তুমি অজ্ঞান বলেই এরু দূরাশা করছ। তুমি রাজার পুত্র বটে কিন্তু আমার গর্ভে তোমার জন্ম হয়নি। রাজ্য, সিংহাসন, ও অপূর্ব অট্টালিকা প্রভৃতি যা কিছু আছে সকলিই আমার পুত্রের অধিকার আছে। তবে কেন বৃথা এখনও দন্ডায়মান আছ? আমার পুত্রের ন্যায় দূর্লভ আশার বশবর্তী হওয়া তোমার উচিৎ নয়। সুনীতির গর্ভে তোমার জন্ম এ কথা কি তুমি ভুলে গেছ? ধ্রুব সুনীতির এরুপ রুদ্র বাক্য পর পর শ্রবণ করে খুবই কোপাবিষ্ট ও দু:খিত হয়ে পিতার নিকট হতে প্রস্থান করে রোদন করতে করতে মায়ের কাছে গেল। ধ্রুবকে এমন ক্রোধান্বিত ও কাতর দেখে ক্রোড়ে তুলে নিয়ে বললেন,” বৎস! তোমাকে কিসের জন্য এমন ক্রোধান্বিত ও কাতর দেখাছে? কে তোমার সাথে এমন অনাদর করেছে। তোমার অপরাধ করলে যে মহারাজকে অবজ্ঞা করা হয় ইহা কি তার মনে একবারও উদয় হল না।”

সুনীতি তাকে বিভিন্ন উপায়ে সান্তনা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ধ্রুব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিষন্নবদনে কিছুক্ষণ রোদন করলেন। অত:পর তার বিমাতা মহারাজের সম্মুখে তাকে কটুবাক্য প্রয়োগ করেছিল তা আদ্যোপান্ত মায়ের নিকট বর্ণনা করল। সুনীতি পুত্রের এরুপ বিষাদভাব ও বিমাতার এমন দুর্বাক্য শ্রবণ করে নিজেকে অশ্রুসংবরন হতে বিরত রাখতে পারলেন না। তিনি অশ্রুপূর্ণলোচনে ও গদগদ বচনে ধ্রুবকে বলতে লাগলেন,” হে বৎস্য! তোমার বিমাতা সুরুচি তোমাকে যে সকল কটূবাক্য প্রয়োগ করেছে তা মিথ্যা নয়। পূণ্যবানদিগকে কখন এমন বাক্য-যন্ত্রনা সহ্য করতে হয় না। তুমি ইহার জন্য আর পরিতাপ করো না। পূর্ব জন্মে যে রুপ কর্ম করেছ এখন তার কর্মফল ভোগ করতেই হবে। পূর্ব জন্মের পাপ অথবা পূণ্য-ফলের অতিক্রম করবার কারো ক্ষমতা নেই। যার জন্মান্তরে পূণ্যরাশি সঞ্চিত থাকে সে ব্যক্তিই সিংহাসন, শ্বেতছত্র ও উৎকৃষ্ট হস্তী অশ্বের অধিকারী হতে পারে। তাই এরুপ চিন্তা করে তুমি উদ্বেগ শূন্য হও। সুরুচি পূর্বজন্মে বিস্তর পূণ্য সঞ্চয় করেছে বলেই মহারাজ তার প্রতি অনুরুক্ত হয়েছেন। তার গর্ভের উত্তমের মত পূন্যবান সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। আমি অতিশয় হতভাগিনী। পূর্বজন্মে আমি না জানি কত পাপ করেছি। আমার মত ভাগ্যহীনা কি মহারাজের পত্নী হতে পারে? তুমি অতিশয় মন্দ ভাগ্য বলেই আমার মত অভাগিনী গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছ। যাহোক তুমি আর শোক করো না। সকলেই জন্মান্তরীণ পাপপূণ্যের ফলভোগ করতে হয়। এরুপ বিবেচনা করেই বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সকল অবস্থায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন।যদি তুমি সুরুচির দুর্ব্যবহারে কাতর হয়ে থাক তাহা হলে সুশীল ধর্মপরায়ণ ও সর্বভূতের হিতচিকীষু হয়ে সর্বফলপ্রদ পূণ্য সঞ্চয় করতে যত্নবান হও। অবগত হও যে, সলিলরাশি যেমন নিম্ন স্থানকে আশ্রয় করে তদ্রুপ সম্পদ সমুদয় আপনা হতে নম্র প্রকৃতি সৎপাত্রকে আশ্রয় করে থাকে। ধ্রুব বলল,” মাতা! আপনার উপদেশ আমি যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না। আমার বিমাতার আচরণ আমকে কষ্ট দিয়েছে। আমি সমুদয় জগতের পূজনীয় সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্থান লাভ করতে যত্নবান হব। আমার ভ্রাতা সিংহাসন লাভ করুক তাতে আমার কিছূ আপত্তি নেই। আমার পিতা যে পদ লাভ করতে সমর্থ হয়নি আমি স্বীয় কর্মবলে সে দুর্লভ পদ লাভ করব তাকে কোন সন্দেহ নেই।” এ কথা বলে মাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করল। অত্রি ও মরীচি প্রভৃতি সপ্ত মহর্ষি তপোবলে পূর্বেই এ ব্যাপারে অবহিত হয়েছিলেন এবং ধ্রুবকে কৃপা করার জন্য তারাও বনে প্রবেশ করলেন। মহর্ষিগণ কুশাসনের উপর কৃষ্ণাজিন আস্তরন করে উপবিষ্ট রয়েছেন দেখে ধ্রুব তাদের নিকট গেলেন এবং ভক্তিভাবে বিনীত হয়ে বললেন,” মহাশয়গণ! আমি উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব। আমার জননীর নাম সুনীতি। আমার মনে বৈরাগ্যভাব উদয় হওয়ায় আমি বনবাসী হয়ে আপনাদের আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

মহর্ষিগণ ধ্রুবের মুখে সমস্ত বিবরণ শ্রবণ করে বললেন,” রাজকুমার! তুমি পঞ্চবর্ষীয় বালক। এ সময়ে তোমার বৈরাগ্য উদয় হওয়ার কোন কারণ দেখছি না। তাছাড়া তোমার পিতা এখনও জীবিত আছেন। তোমার কোন বিষয়েই ভাবনা করতে হয় না। তুমি প্রিয়জন বিয়োগে কাতর বা  কোন পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছে তা তো তোমাকে দেখে হৃদয়ঙ্গম করা যাচ্ছে না। তাহলে তোমার হৃদয়ে বৈরাগ্যের কারণ কি? তখন ধ্রুব তার বিমাতার দুর্ব্যবহার ও মাতা সুনীতির উপদেশ মহর্ষিগণের নিকট বর্ণনা করল। সম্পূর্ণ বিবরণ শ্রবণ করে মহির্ষিগণের হৃদয় বিষাদ হলো। তারা পরস্পরকে বলতে লাগলেন ক্ষত্রিয় জাতির কি ভয়ানক তেজ। মাত্র ৫ বছরের এক বালকও বিমাতার দুর্বাক্য সহ্য করতে পারেনি। তারা পরস্পরের নিকট এ রকম বাক্য শেষ করে ধ্রুবকে বলল,” হে ক্ষত্রিয় বালক! তুমি যে কারণে নির্বেদ(বৈরাগ্য) গ্রস্থ হয়ে অরণ্যে প্রবেশ করেছ তা আমাদের কাছে নির্ভয়ে, নিসঙ্কুচে বল। আমরা তোমাকে সাহায্য করব। ধ্রুব মহর্ষিগণ কৃর্তক এভাবে আশ্বস্থ হয়ে বলতে লাগল,” হে মহাশয়গণ! আমার ঐশ্বর্য বা রাজ্য লাভ করবার কোন অভিলাষ নেই। সর্বলোকের পরম দূর্লভ স্থান লাভ করবার বাসনায় আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা আমার প্রতি সদয় হন এবং নির্দেশ দিন যাতে আমি ঐ পরমপদ লাভ করতে পারি। তখন মরীচি বলল,” হে রাজকুমার! ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা না করলে কেহ পরম স্থান লাভ করতে সমর্থ হয় না। অতএব তুমি সে সনাতন বিষ্ণুর আরাধনা করতে অনুরক্ত হও। মহাত্মা মরীচি এরুপ বললে মহর্ষি অত্রিও বলল,” হে রাজপুত্র! যে ব্যক্তি ভগবান নারায়ণকে ভক্তির দ্বারা প্রীত করতে পারেন তিনিই অক্ষয় লোক লাভ করতে সমর্থ হন তাতে কোন সন্দেহ নেই। মহর্ষি অঙ্গিরাও বললেন,” হে বৎস! ভগবান বিষ্ণু সর্বলোক পরিব্যপ্ত করে অবস্থান করেন। অতএব যদি তোমার শ্রেষ্ট লোক লাভ করবার অভিলাষ থাকে তাহলে তারই আরাধনা করতে প্রবৃত্ত হও। পুলস্ত্য বলল,” বৎস! ভগবান নারায়ন পরম ধাম ও পরব্রহ্ম স্বরুপ। তাঁর আরাধনা করলে দুর্লভমোক্ষ লাভ করা। ক্রতু বলল,” হে বৎস! ভগবান নারায়ন যজ্ঞপুরুষ বলে অভিহিত হন এবং যোগিগণ যার পরব্রহ্ম বলে নির্দেশ করে থাকে তাঁর আরাধনা করলে কি না লভ্য হতে পারে? পুলহ বলল,” দেবরাজ ইন্দ্র যার আরাধন করে ইন্দ্রত্ব লাভ করেছে, তুমি তাঁরই আরাধনা করতে আসক্ত হও। বশিষ্ঠ বলল,” হে বৎস! যে ব্যক্তি সনাতন বিষ্ণুর আরাধনা করেন তাঁর দুর্লভ কিছুই নেই। তিনি অনায়াসে সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্থান লাভ করতে পারেন।

মহর্ষিগণের কাছ হতে এরুপ উপদেশ শ্রবণ করার পর ধ্রুব বললেন,” হে মহাশয়গণ! অনুগ্রহ করে আপনারা আমার আরাধ্য দেবকে পাওয়ার নির্দেশ করে দিলেন কিন্তু কিভাবে আরাধনা করলে আমি তার সাক্ষাত পাব তার উপদেশ আমাকে দিন। তখন মহর্ষিগণ তাকে বলল,” হে বৎস! মনুষ্যগণ যে ভাবে ভগবান নারায়ণের আরাধনা করে তা তোমাকে বলছি। তুমি শ্রবণ কর। সনাতন বিষ্ণুর আরাধনা করতে হলে প্রথমে তাঁহাতেই চিত্ত সমর্পণ করে তাঁর ধ্যান করতে করতে এ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়- হে ভগবান! তুমি পরম পুরুষ, ব্রহ্ম, বিষ্ণু, মহেশ্বরের নিয়ন্তা, ত্রিগুণাত্বিকা শক্তির মূলকারণ, শুদ্ধ, জ্ঞান-স্বরুপ ও বাসুদেব। আমি তোমারে বার বার নমস্কার করি ।” তোমার পিতামহ স্বায়ম্ভুব মনু এ মন্ত্র জপ করে সনাতন বিষ্ণুর প্রীতি লাভ পূর্বক পরম সিদ্ধি লাভ করে গিয়েছেন। অতএব তুমিও সে মন্ত্র জপ কর। অনায়াসে তাঁর প্রীতি লাভ করতে সমর্থ হবে।

মহাত্মা ধ্রুব মহর্ষিগণের এরুপ উপদেশাবলী শ্রবণ করে যমুনানিকটবর্তী মধুবনে প্রবেশ করলেন(মধু নামক এক দৈত্য এ বনে বাস করত। এ জন্য বনের নাম হলো মধুবন। মহাবল পরাক্রান্ত শত্রুঘ্ন মধুদাবনের পুত্র লবণকে হত্যা করে মথুরাপুরী স্থাপন করেন)। এ স্থান দেবদেব সনাতন বিষ্ণুর অবির্ভাব-নিবন্ধন সর্বপাপ-বিনাশন পবিত্র মহাতীর্থ বলে প্রসিদ্ধ হয়েছে। মহাত্মা ধ্রু সপ্তর্ষিমুনিগণের উপদেশমতে একাগ্রচিত্তে তপস্যা করতে লাগল। ধ্যান করতে করতে তার বোধ হতে লাগল স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু তার হৃদয়ে বিরাজিত রয়েছেন। তিনি অনন্যমনে নারায়ণের ধ্যান করতে লাগলেন। নারায়ণ প্রীত হয়ে বিশ্বরুপ ধারণ করে তার হৃদয়-মন্দিরে প্রকাশিত হলেন। তখন বসুন্ধরা আর তার ভার সহ্য করতে পারলেন না। তখন মহাত্মা ধ্রুব বামপদে ভর দিয়ে দন্ডায়মান হলে ধরণীর অর্ধাংশ ও দক্ষিণ পদে ভর দিয়ে দন্ডায়মান হলে অন্য অর্ধাংশ অবনত হতে লাগল। তখন ধ্রুব অঙ্গুলির উপর ভর দিয়ে দন্ডায়মান হলেন কিন্তু ধরণীও তাও সহ্য করতে পারল না। পর্বতাদি, সমুদ্র নদ-নদী প্রভৃতি সংক্ষুদ্ধ হতে লাগল। পৃথিবীর এরুপ অবস্থা দর্শণ করে দেবগণ শংকিত হলেন। যাম নামক  দেবতারা, কুষ্মান্ড নামক দেবতরা এবং উপদেবতাগণ দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে পরামর্শক্রমে ধ্রুবের সমাধিভঙ্গের বিভিন্ন চেষ্টা করতে লাগলেন।

ধ্রুব-জননী সুনীতি পূর্বাপর সকল সময়েই মহাত্মা ধ্রুবের সমভিব্যারে ছিলেন। পুত্রের এরুপ কঠোর তপস্যা দর্শণ করে বলতে লাগলেন,”হে পুত্র! তুমি দেহনাশক নিদারূণ তপস্যা হতে নিবৃত্ত হও। আমি তোমাকে অনেক দু:খে লাভ করেছি। আমার মত অনাথ ও হত-ভাগিনী আর নেই। তুমি ৫ বছরের বালক। তুমি এ নির্বন্ধ হতে নিবৃত্ত হও। তোমার এরুপ কঠোর তপস্যার সময় এটা নয়। বালক অবস্থায় ক্রীড়া, তারপর অধ্যায়ন, অধ্যায়নের বিষয়-ভোগ এবং তারপর তপস্যা করাই মানবগণের অবশ্য কর্তব্য। আর যদি তুমি আমার বাক্য শ্রবণ করে এ কঠোর তপস্যা হতে বিরত না হও তাহলে নি:সন্দেহে আমি তোমার সম্মুখে প্রাণত্যাগ করব।” কিন্তু একাগ্রচিত্তে ধ্যানরত ধ্রুব মাতাকে দেখেও দেখতে পেলেন না। তারপর বিকৃতায় একদল রাক্ষস বিবিধ অস্ত্র দ্ধারা ধ্রুবকে আক্রমন করল। তা দেখে মাতা ভীত হয়ে ধ্রুবকে এ স্থান ত্যাগ করতে বলল। মাতা ভীত হয়ে তৎক্ষণাৎ এ স্থান ত্যাগ করল। রাক্ষসেরা মহাত্মা ধ্রুবের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করতে লাগল। তাকে ছেদন ক , তাকে ভক্ষণ কর, ইত্যাদি ‍বিকৃত স্বরে উচ্চারণ করতে লাগল। সিংহ এবং বাঘের রুপ ধারণ করে ভয় দেখাতে লাগল। ভয়ংকর চিৎকার করে তাকে ভয় দেখাতে লাগল। এরুপ অনেক ভয়ভীতি প্রদর্শণ করেও তপস্যারত মহাত্মা ধ্রুবের ইন্দ্রিয়গোচর হলো না। তিনি কেবল অনন্যচিত্তে সনাতন বিষ্ণুর বিশ্বরুপ দর্শন করতে লাগলেন। কোন ভয়-ভীতই যখন ধ্রুবকে তার তপস্যা থেকে টলাতে পারল না, তখন মায়া পরাভূত হয়ে আপনা হতে অন্তর্হিত হলো।

তারপর মহাত্মা ধ্রুবের তপস্যায় দেবতাগণ ভীত হয়ে ভগবান বিষ্ণুর নিকট গমনে করে স্তব করে বলতে লাগলেন,” ভগবান! আমরা উত্তানপাদের পুত্র মহাত্ম ধ্রুবের তপস্যায় সন্তপ্ত হয়ে আপনার শরনাপন্ন হয়েছি। চন্দ্র যেমন দিন দিন কলা দ্বারা পরিপূর্ণ হয় তেমনি মহাত্মা ধ্রুবও সেরুপ তপোবলে ক্রমশ ঊর্ধ্বপথে উত্থিত হচ্ছেন। আপনি তাকে এ কঠোর তপস্যা হতে নিবৃত্ত করুন।” সনাতন বিষ্ণু বললেন,” তোমরা ভীত হওনা। ধ্রুব ইন্দ্রত্ব, সূর্যত্ব অথবা কুবেরেত্ব লাভের আশায় তপস্যা করছে না। তার যে আভিলাষ আমি তা পূর্ণ করব। তোমরা ভয়হীন হয়ে নিজ নিজ স্থানে প্রস্থান কর।” তখন ভগবান বিষ্ণু ধ্রুবের তপস্যায় প্রীত হয়ে চতুর্ভুজরুপে তার নিকট আর্বিভূত হয়ে বললেন,” বৎস! বিষয়ভোগে নিরপেক্ষ হয়ে সমাহিতচিত্তে তপস্যা করতে দেখে আমি যার পর নেই প্রীত হয়েছি। তুমি অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।” তখন ধ্রুব মহাত্মা ভগবানের প্রীতিময় বাক্য শ্রবণ করা মাত্রই নয়ন উন্মেচন করে দেখলেন তার হৃদয়ে যে শঙ্খ-চক্র-গদাধারী কিরীটবান ভগবান নারায়ণ বিরাজিত ছিল তিনিই তার সম্মুখে আর্বিভূত হয়েছেন। তার এরুপ দর্শন করে ধ্রুবের অন্ত:করণ আহ্লাদে পরিপূর্ণ হলো। তিনি অত্যন্ত রোমাঞ্চিতকলেবরে ও ভয়ে জড়ীভূত হয়ে নিতান্ত উৎসুক প্রদর্শন করে বললেন,” হে ভগবান! আমি নিতান্ত বালক। আমি জানি না কিভাবে তোমার স্তব করতে হয়। কিন্তু তোমার স্তব করবার জন্য আমার মন অস্থির হয়েছে। তুমি যদি আমার তপস্যায় প্রীত হয়ে থাক তবে এ বর দাও আমি&nbsp; যেন তোমার স্তবস্তুতি করতে পারি। ব্রহ্মআদি দেবতারও তোমার তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হতে পারে না, আমি বালক হয়ে কিভাবে তোমার স্তুতিবাদ করব? আমার মন ভক্তিরসে পরিপূর্ণ হয়েছে। কোন ভাবে স্থির থাকতে পারছি না। তুমি জ্ঞানশক্তি প্রদান করে আমার চিত্তকে পরিতৃপ্ত কর।”</div>

মহাত্মা ধ্রুবের এরক আকুতিতে ভগবান প্রীত হয়ে শঙ্খের প্রান্তভাগ দ্বারা তাকে স্পর্শ করলেন। স্শর্শ করা মাত্রই তার চিত্ত প্রসন্ন হলো এবং দিব্যজ্ঞান লাভ করলেন। তখন তিনি প্রণত হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে দেবদেব ভগবান নারায়ণের স্তব করতে লাগলেন-” হে ভগবান! ভুমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ এ পঞ্চভূত, গন্ধ, রস, রুপ, স্পর্শ, ও শব্দ এ পঞ্চতম্মাত্র এবং মন, মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার ও আদিপ্রকৃতি এ সমুদয় চতুবিশংতি তত্ত্ব তোমা হতে পৃথক ভূত নহে। তুমি ভুত ভবিষ্যৎ ও বর্তমন স্বরুপ। তোমা হতেই বিরাট্ অর্থাৎ ব্রহ্মান্ড, স্বরাট্ অর্থাৎ ব্রহ্মা সম্রাট্ অর্থাৎ মনু এবং উহাদিগের অধিষ্ঠাতা পুরুষের উদ্ভব হয়। তুমি পৃথিবীর অর্ধ: ঊর্ধ্ব ও সর্বস্থানে বিদ্যমান রয়েছ। তুমি বিশ্ব ও সর্বভূতের সৃষ্টিকর্তা এবং কারণস্বরুপ। অতএব ব্রহ্মান্ডের অন্তর্গত সমুদয় পদার্থই তোমার অন্তর্গত বলে দির্দেশ করা যায়। তোমা হতেই যজ্ঞ, যজ্ঞানল, হবনীয় বস্তু, যজ্ঞপশু, ঋগ্বেদে, যজুবেদ, সামবেদ উৎপন্ন। তোমার মুখ হতে ব্রহ্মণ, বাহু হতে ক্ষত্রিয়, উরু হতে বৈশ্য ও চরণ হতে শূদ্র জাতরি উদ্ভব হয়েছে। তোমার চক্ষু হতে সূর্য, কর্ণ হতে বায়ু ও দিক সমুদয়, মন হতে চন্দ্র, মুখ হতে অগ্নি, নাভি হহে আকাশ, মস্তক হতে স্বর্গ ও পদদ্বয় হতে পৃথিবীর উদ্ভব হয়েছে। তুমি নিখিল জহতের বীজস্বরুপ। যেমন ক্ষুদ্র বীজ মধ্যে প্রকান্ড বটবৃক্ষ অলক্ষিতভাবে অবস্থান করে, তদ্রুপ প্রলয়কালে সমুদয় ব্রহ্মান্ড তোমাতেই প্রবিষ্ট হয়, আবার ঐ ক্ষুদ্রবীজ অংকুরিত হলে যেমন ক্রমে ক্রমে উহা হতে বৃহদাকার বটবৃক্ষ উৎপন্ন হয়, তদ্রুপ সৃষ্টির প্রাক্কালে ব্রহ্মান্ড তোমা হতেই আর্বিভূত হয়ে ক্রমশ বর্দ্ধিত হয়ে থাকে। কদলী যেমন ত্বকও পত্রদ্বারা জড়ীভূত হয়, তুমিও তদ্রুপ এ ব্রহ্মান্ডের চতুর্দিক বেষ্টন করে রয়েছ। তোমার শক্তি দুই প্রকার। নির্গণ ও সগুণ। নির্গুণ শক্তি তোমার স্বরুপ ও সগুণ শক্তি তোমা হতে পৃথক বলে অভিহিত হয়ে থাকে। তুমি সৎ, চিৎ ও আনন্দ স্বরুপ। তোমার নির্গুণ শক্তি এক মাত্র হয়েও সৎস্বরূপে সন্ধিনী, চিৎস্বরূপে সন্বিৎ ও আনন্দ স্বরূপে হ্লাদিনী নাম ধারণ পূর্বক তোমাতে অবস্থান করছে। তুমি নির্গুণ। তোমার সগুণ শক্তি কখন আহ্লাদকরী ও কখন বা তাপকরী হয় বলে তোমারে আশ্রয় করতে সমর্থ হয় না। তোমাতে প্রাণিগণের ন্যায় সত্ত্বাদিগুণধিকার বিদ্যমান নয়। তুমি স্থূলভূত, সূক্ষ্ম, মহাভূত, অদ্বিতীয় ও চারাচর-স্বরূপ। তুমি প্রকৃতি, পুরুষ, বিরাট, স্বরাট, সম্র্রাট ও অক্ষয়। গোগিগণ নিরন্তর তোমারই ধ্যান করে থাকেন। তুমি সর্বভূতের আত্মা ও সর্বরূপধারী।তোমা হতেই সমুদয় পদার্থ উদ্ভূত। তুমি সর্বদা সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থান করে সমুদয় নিরীক্ষণ করছ। কোন প্রাণির কোন মনোরথ তোমার অগোচর নেই। আমি বার বার নমস্কার করছি, অতএব তুমি আমারও মনোরথ পূর্ণ কর। মহাত্মা ধ্রুব ভক্তিযুক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে ভগবান নারায়ণের স্তুবস্তুতি করলে নারায়ণ তাকে সম্বোধন কলে বলল,” বৎস! তুমি যখন আমাকে দর্শন করেছ, তখন তোমার তপস্যার ফল লাভ হয়েছে। আমার দর্শন লাভ কখন বিফল হয় না। যে ব্যক্তি আমার সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে, সে সমুদয় পাদার্থ লাভ করতে সমর্থ হয়। অতএব, তুমি আমার নিকট তোমার অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।” ভগবান নারায়ন এরুপ বললে ধ্রুব তাকে সেম্বোধন করে বলল,” হে ভগবান! তুমি সর্বভূতের ঈশ্বর ও সর্বান্তরযামী। তোমার অগোচর কিছুই নেই। যদিও আমার মনোবাসনা তুমি জান তবুও তোমার আজ্ঞামতে আমার অভিপ্রায় তোমার নিকট ব্যক্ত করছি। আমার দূর্বার মন যে পদার্থ লাভ করতে বাসনা হয়েছে তা অত্যন্ত দুর্লভ। কিন্তু তুমি প্রসন্ন হলে কোন্ ব্যক্তি কিনা লাভ করতে পারে। তোমার প্রসাদে দেবরাজ ইন্দ্র ত্রিলোকের আধিপত্য লাভ করে বিপুল ঐশ্বর্য ভোগ করছে। আমার বিমাতা আমার সামনে তিরষ্কার করে বলেছিল ওরে নির্বোধ বালক! তুমি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ না করে বৃথা কেন এ রাজসিংহাসনের আশা করছ? তোমার ইহাতে বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। বিমাতার হেন নিষ্ঠুর দুর্বাক্য শ্রবণ করে আমার হৃদয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয়েছে। তাই আমি জগতের আধার-স্বরুপ সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্থান লাভ করতে বাসনা করেছি, অতএব তুমি প্রসন্ন হয়ে আমার অভিলাষ পূর্ণ কর।

মহাত্ম ধ্রুব কাতর হয়ে এভাবে প্রার্থনা করলে সর্বভূত নিয়ন্তা নারায়ণ তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন,” বৎস! তুমি যে বর প্রার্থনা করেছ তা অবশ্যই লাভ হবে। তুমি তপোবলে কেবল এ জন্মে আমাকে তুষ্ট করনি। পূর্বজন্মেও আমি তোমার প্রতি প্রীত হয়েছিলাম। পূর্বজন্মে তুমি একজন ধর্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ ছিলে। আমার প্রতি একান্ত ভক্তি পরায়ণ হয়ে তুমি সর্বদা পিতা-মাতার শুশ্রুষা করতে। তোমার সাথে এক রাজপুত্রের মিত্রতা হয়। তুমি তার বিপুল বিভব ও মনোহর মূর্তি দর্শন করে মনে মনে রাজপুত্র হওয়ার বাসনা করেছিলে। এ জন্যে এ জন্মে মহারাজ উত্তানপাদের পুত্ররুপে জন্ম গ্রহণ করেছ। এ কুলে জন্মগ্রহণ করা অল্প সুকৃতি নহে। অন্য কোন ব্যক্তি বরপ্রাপ্ত না হলে স্বয়ম্ভুব মনুর বংশে জন্মগ্রহণ করতে সমর্থ হয় না। পূবজন্মেও তুমি তপস্যা করে আমারে প্রীত করেছ। মুনুষ্য একান্ত মনে আমার আরাধনা করলে নি:সন্দেহে মুক্তি লাভ করতে পারে। যে ব্যক্তি আমার প্রতি মন সমর্পণ করে তার স্বর্গাদি পদ তুচ্ছজ্ঞান হয়। তোমার সর্বোৎকৃষ্ট পরম পদ লাভের বাসনা আমি পূর্ণ করব। আমার প্রসাদে তুমি ত্রিলোকাতীত উচ্চতর স্থানে নক্ষত্র ও গ্রহগণের আশ্রয় হয়ে থাকবে। সুর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি এ সকল গ্রহগণ তোমার নীচে অবস্থান করবে। সপ্তর্ষি ও দেবগণের উপরিভাগে তোমার লোক নিরূপিত হলো। দেবগণের মধ্যে কেহ চারি যোগ এবং কেহ বা মন্বন্তর পর্যন্ত ঐ লোকে অবস্থান করতে পারবে। কিন্তু তুমি কল্পকাল পর্যন্ত তুমি ঐ স্থানে অবস্থান করতে পারবে। তোমার জননী যেহেতু স্নেহাতুর হয়ে তোমার নিকট অবস্থান করেন সেহেতু আমি তাকেও এ বর প্রদান করছি তিনি তারকা হয়ে নিরন্তর আকাশে অবস্থান করবেন। আর যে সকল মানুষ সকল-সন্ধ্যা তোমার নাম কীর্তন করবে তারাও পূণ্যলোক লাভ করতে সমর্থ হতে তাতে সন্দেহ নেই। ভগবান নারায়ণের নিকট হতে বরপ্রাপ্ত হয়ে তার প্রসাদে মহাত্মা ধ্রুব এখন সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্থান বাস করছেন। যাকে আমরা ধ্রুবলোক বলি বা ধ্রুবতারা বলি। তার মাতা সুনীতি পূণ্যের ফলে আকাশে তারকা হয়ে আছেন। যিনি ধ্রুবচরিত নিত্য পাঠ করেন তিনি সমুদয় পাপ হতে মুক্ত হয়ে স্বর্গ লাভ করেন (সূত্র: বিষ্ণুপুরান)


Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র