গোবর্ধন গিরিপূজা

ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে গোপ-গোপীগণ পূর্ব্বাপর হতে যথা নিয়মে ইন্দ্রপূজা করে আসছে। সে তিথি আসন্ন বিধায় পূজার আয়োজন করতে ব্যস্ত তারা। দ্বাদশীর পূর্বদিনে সকল গোপ-গোপীকাগণ নন্দালয়ে উপিস্থিত হয়ে পূজার বিষয়ে পরামর্শ করে। গোপ-গোপীগণকে এভাবে ব্যস্ত দেখে কৃষ্ণ সকলকে পিতা নন্দ আর যত গোপ-গোপীগণকে সুধান,” কেন এবং কিসের কারণে এত ব্যস্ততা? কার উদ্দেশ্যে কিসের জন্য যজ্ঞ কর? কি ফল তাতে আশা কর? জ্ঞানযোগে কর্ম করলে সুসিদ্ধ হয় আর অজ্ঞানে কর্ম করলে কর্ম সিদ্ধ হয় না। আমাকে তোমরা বল কার উৎসবের জন্য এত ধূম বৃন্দাবনে। তখন নন্দ কহে,"শুন কৃষ্ণ কমললোচন। শুন বলরাম। পূর্ব্ব হতেই বৃন্দাবনে বর্ষাকালে ইন্দ্রপূজার নিয়ম আছে। তাই সকলে ইন্দ্রপূজার আয়োজন করছে।" স্বয়ং ইন্দ্র হচ্ছেন জলবর্ষী মেঘ। তিনি নিরন্তর জল বর্ষণ করেন। তখন কৃষ্ণ প্রশ্ন করেন,"ইন্দ্রযজ্ঞ করলে কি হবে? গোপগণ কহে,"শুন কৃষ্ণ, দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশে মেঘগণ জল বর্ষণ করে। তাই মোরা যতন করে ইন্দ্রপূজা করি। দেবরাজ ইন্দ্র তুষ্ট হলে বরিষণ করেন। ফলে তৃণ লতা আদি শস্যাদি জন্মে। তাই পূর্ব্ব হতে আমার ইন্দ্রযজ্ঞ করে আসছি।” শুনে কৃষ্ণ কন“ ইন্দ্রের কি সাধ্য আছে জল বর্ষণ করার। তোমরা শুনেছ তো একজন ভগবান আছেন। জগতের সকল কার্য তার ইচ্ছায় হয়। তার আজ্ঞানুসারে সকলে কর্ম করে। তাঁর আদেশ কেহ লংঘন করতে পারে না। কালেতে জীব জন্মায় কালেই মৃত্যু হয়। সুখ-দুঃখ, শুভ-অশুভ কালচক্রেই ফিরে আসে। তাঁর আজ্ঞা পালনের জন্যই উঠেন দিবাকর। তাঁর বাক্য পালনের জন্য উঠে শশধর। ভগবান যাকে যেমন নির্দেশ দিয়েছেন সেমতে সকলেই কার্য করছে। তার কোন লংঘন হয় না। দেখি, ইন্দ্র অন্য সময় জল বর্ষণ করুন। প্রভুর আজ্ঞায় এ সময় জল বর্ষিত হবে। তবে তোমরা সকলে কেন ইন্দ্রের অর্চ্চনা করবে? যাঁর আদেশে ব্রহ্মা করেন জগৎ সংসার সৃষ্টি। যাঁর আদেশে শিব করেন সংহার। যাঁর আদেশে বিষ্ণু করেন পালন। কার সাধ্য আছে তাঁর আদেশ লংঘন করার। আর যাগ-যজ্ঞ করার কাজ হচ্ছে ব্রাহ্মণদের। তোমরা কেন যজ্ঞ করবে? ভগবান চারি জাতি বা বর্ণাশ্রম সৃষ্টি করল। সৃষ্টি করে চারকর্ম চার জাতিকে অর্পণ করল। যাগ-যজ্ঞ হোম পূজা করবে ব্রাহ্মণ। সসাগরা শাসন করবে ক্ষত্রিয়। কৃষি, গো-রক্ষ ও ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈশ্যদের কর্ম। আমরা সকলে গোধন রক্ষা করি। সে কর্ম করার ফলে ধেনুবৎস কূল সুখে থাকে। তাই সে কর্ম অবশ্য আমাদের করতে হয়।” শুনে সব গোপগণ কহে,“ তাহলে গোবর্দ্ধন পূজা কি করে আমরা করব? আর কি কর্ম করিলেই বা ধেনুকুল সুখেতে থাকবে? অবশ্য সে কর্ম কৃষ্ণকে করতে হব।” সব শুনে কৃষ্ণ কহে,“আমি যা বলি তোমরা তা মন দিয়ে শুন। গোবর্ধন গিরি হন কুলের দেবতা। তিনি আমাদিগকে উপকার করেন এবং রক্ষা করেন। এমন উপকার করে দেবকে পূজা না করে দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা করলে কি ফল পাবে? গিরির উপর তৃণ জন্মে গো-বৎস কূল সেখানে বিচরণ করে। গোবর্ধনের জন্য আমার বৃন্দাবনে বাস। ধেনুগণ তৃণ লোভের সদা ইচ্ছা করে। তোমরা সকলে শুন এ গোবর্ধন সাক্ষাৎ দেবতা। ইন্দ্রপূজা করলে তিনি দর্শন দেন না। কিন্তু গিরি-গোবর্ধন প্রত্যক্ষ দেবতা। তোমরা যা ভক্ষণ করতে তাই ভক্তিভাবে দেবতাকে দিবে। দেবের উদ্দেশ্যে পূজা তোমরা নিশ্চয় দেখেছ।” তা শুনে আনন্দিত সকল গোপগণ। কিন্তু তারা এতকাল এ বিষয়টি জানত না। নন্দঘোষ বলে,” শুন আমার কথা। কৃষ্ণ যা বলল তা তোমরা কখনও অবহেলা করিও না। কৃষ্ণ যা বলেন তা কখনও মিথ্যা হয় না।” তা শুনে সকল গোপগণ বলে,” কেন আমারা  কৃষ্ণের কথা লঙ্ঘন করব। বয়সতে ছোট নীলমনি। কিন্তু যা বলে তাই ঘটে। গোবর্ধন পূজা অবশ্যই আমরা করব।” সভা শেষে গোপগণ যার যার ঘরে চলে গেলেন। পরদিন প্রাতে নন্দের বাড়ী সকলে আসল। তখন কৃষ্ণকে সকল গোপগণ বলল,” কিভাবে আমরা গিরি-গোবর্ধন পূজা করব? ইন্দ্রপূজা করার জন্য আমরা যতদ্রব্য সংগ্রহ করেছি তা সকল আমাদের কাছে আছে । আরও যদি অধিক দ্রব্য লাগে তা তুমি আমাদিগকে বল।” শুনে কৃষ্ণ কন,” চর্ব, চূষ্য, লেহ্য ও পেয় যত দ্রব্য আছে সব রন্ধন কর। পায়স, পিষ্টক (পিঠা), শাক, সূপ ( ঝোল) ও তরকারী রন্ধন কর। ক্ষীর সর নবনীত যে যত বেশী দিবে তাই গিরি গোবর্ধন ভোজন করবে। গোপগণ সুন্দর পোষাক ও পোপনারীগণ অলংকার সাজে সজ্জিত হয়ে গোবর্ধনের কাছে যেতে হবে।” কৃষ্ণের কথা শুনে সকল গোপ-গোপীকাগণ নিজ নিজ ঘরে গেল এবং রন্ধন কার্য শেষ করল। ইন্দ্রপূজা করবে বলে ব্রাহ্মণ এলো। তখন গোপগণ ব্রহ্মণকে বললেন,” চলুন শ্রীঘ্রই কৃষ্ণের নিকট। কৃষ্ণের কথা আমাদের শিরোধার্য। কৃষ্ণ যা বলবে সেমতে কাজ হবে।” গোপ-গোপনীগণসহ ব্রাহ্মণ কৃষ্ণের নিকট গেল। ব্রাহ্মণকে দেখে কৃষ্ণ করপুটে প্রণাম করে মধুর বচনে বলেন,” বৃন্দাবনে আর এখন থেকে ইন্দ্রপূজা হবে না। গিরি-গোবর্ধন আমাদের দেবতা। তাকে আমরা পূজা করব। তাকে পূজা করলে আমাদের সকল কার্য সিদ্ধ হবে। পূর্ব হতে যে ইন্দ্রপূজা হয়ে আসছে, পূরন্দর কি কখন সে পূজা দ্রব্য খেয়েছেন। এখন থেকে আমরা গিরি-গোবর্ধন পূজা করব সবার সাক্ষাতে গিরিবর তা আহার করবে।” তখন ব্রাহ্মণ মনে মনে ভাবে গিরি-গোবর্ধন যদি সবই খাবে তবে তো সে আর কিছু পাবে না। এ কথা চিন্তা করে কৃষ্ণের উপর তার রাগ হলো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো অন্তর্যামী। তিনি সব জানলেন। কৃষ্ণ বললেন,” রাগ করিও না তুমিও কিছু পাবে। তখন ক্রোধ সংবরণ করে ব্রাহ্মণ মনে মনে বলে যা পায় তাই হবে আমার লাভ। কৃষ্ণ যে ভাবে যা রন্ধন করতে বলল গোপনীগণ সেমতে সব রন্ধন করল। প্রায় দুপ্রহর হলো। কৃষ্ণ সকল গোপীগণকে ডেকে বলে,”পূজার সব আয়োজন নিয়ে তাড়াতাড়ি চল গিরি-গোবর্ধনে।” গোপগণ কৃষ্ণের বাক্য শুনে পূজার সামগ্রী নিয়ে তাড়াতাড়ি গিরি-গোবর্ধনের নিকট চলল। অন্যান্য সকল লোক বিভিন্ন উপাচার নিয়ে চলল। যুবক-যুবতী, নন্দব্রজকুমারিকা ও প্রাচীনাসহ সকলই চলল। ফল-মূল, ক্ষীর, সর, মাখন, পায়স, পিষ্টক, অন্ন-ব্যঞ্জন, শাক, সূপ ইত্যাদি লয়ে গোপ-গোপীকাগণ চলল। বৃন্দাবনের যত বাদ্যকার তাদের সাথে সাথে চলল। কেহ বাজায় জগঝম্প, কেহ বাজায় মৃদঙ্গ, কেহ বাজায় কাড়া, ঝাউ ঝাউ বাজে কৃষ্ণ কাড়া, টং টং টং বাজে অসংখ্য টিকাড়া, ভেরী ধ্বনি হয়, শত শত ঢোল বাজে একত্রে, শত শত তূরী বাজে একত্রে, বাজে ঝাঁঝরী মোহরী, বীণা আর বাঁশী বাজে কত সুরে, মন্দিরাদির সাথে সাথে বাজে করতাল, জয়ঢাক এর সাথে বাজে জয়ঢোল, পিনাক মুচঙ্গ আর বাজছে মাদোল, উপভোগ্য সুরে বাজছে সারঙ্গ সেতার, বাজছে সপ্তস্বরা ও তানপুরা, খমক রবাব বাজছে আর বাজছে ডম্ফ। বাদ্যের শব্দ চারিদিকে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে। গোবর্ধন গিরির আশে পাশে যত গ্রাম ছিল তারা সকলই এবং মনে হচ্ছে যেন বৃন্দাবনবাসী এক জায়গায় মিলিত হয়েছে। ব্রাহ্মণকে পূজা করার জন্য বললে ব্রাহ্মণ পূর্বেই জানে গিরি-গোবর্ধন সমস্ত দ্রব্য আহার করবে। তাই তার মনে রাগ হয়েছে। তখন গোপগণ প্রতি চেয়ে কহে,” শুন সকলেতে, পর্ব্বত-পূজার কোন মন্ত্র আমি জানি না। গো-বর্ধন পূজা করতে যে তোমাদিগকে পরামর্শ দিল তাকে বল গিয়ে মন্ত্র পাঠ করতে।” ব্রাহ্মণের মুখে এ কথা শুনে গোপগণ কৃষ্ণকে গিয়ে বলল,” বলুন কৃষ্ণ, কে বলবে পূজার মন্ত্র।” শুনে কৃষ্ণ কহে,” পূজার মন্ত্র কিছু নেই। সকলে গলেতে বসন দিয়ে মনে ভক্তি রেখে সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোর করে সকলে বলবে,” আমাদের এ দ্রব্য তুমি গ্রহণ করো গিরিবর। ইহা বলে সাতবার গিরিবর প্রদক্ষিণ করবে।” পুনরায় গিরি ধরে বলবে,“তুমি সাক্ষাৎ দেবতা তা আমরা পূর্বে জানিনি। তা জেনে আমরা সকলে তোমার পূজা করছি। তা বলে গিরিবরকে নমস্কার করবে। দেখবে তা হলে গিরিবর আহার করবে।” কৃষ্ণের মুখ থেকে গোপগণ যা শুনেছিল সে মতে কাজ করল তারা। গোপগণের নিকট রইল কৃষ্ণ। অন্যরূপে আবির্ভিূত হলেন তিনি গোবর্ধনে। মাধব মধুর কন্ঠে বলে সকলকে,“তোমরা সকলে নয়ন বন্ধ করে থাক। পরে দেখতে পাবে তোমাদের সব দ্রব্য গিরিবর ভোজন করেছে।” শুনে সকল গোপগণ চোখ বন্ধ করে রাখল। মাধব সকল ভোজ্য-দ্রব্য মুখে পুড়ে দিল। সকল দ্রব্য খেয়ে গোপগণকে দেখতে বলে যে, দেখ কোন আর দ্রব্য নেই। তা দেখে পোপগণ হাত করজোর করে স্তব করে বলে,“তোমার নিকটে আমরা এ বর মাগছি তোমার তৃণ দিয়ে আমাদের গাভীগণকে তুমি পালন করবে।” পুনরায় জগন্নাথ সকলকে বলেন,” দক্ষিণাস্বরূপ তোমরা দ্বিজকে কিছু ধন দান কর। কৃষ্ণের কথায় গোপগণ আগের চেয়ে দ্বিজকে অনেক বেশী ধন দান করল। ব্রাহ্মণ ভাবে ধন বেশী পেয়েছি কিন্তু ভোজ্য-দ্রব্য কিছু পায়নি। তারপর সকলে যার যার গৃহে গমন করল। কেহ কেহ বলতে লাগল,“ভাই শুন সমাচার, নন্দের বেটা মনুষ্য নয়; মাত্র দশ বছরে কিভাবে জানল কৃষ্ণ এ বিবরণ।” তারপর নিজেদের মধ্যে এ কথা আলোচনা করতে করতে এবং কৃষ্ণের  প্রশংসা করতে করতে গোপ-গোপীগণ যার যার গৃহে প্রবেশ করল।
যেদিন গোপগণ ইন্দ্রপূজা করবে সেদিন দেবরাজ ই্ন্দ্র তার মন্ত্রীগণকে ডেকে বলেন,” আজ গোপগণ আমার পূজা করবে।” মন্ত্রীগণ বলেন,” কোথায় যজ্ঞ হবে।” বাসব বলেন,” যজ্ঞ হবে বৃন্দাবনে।” তখন ইন্দ্রের কথা শুনে সকলে বলে,” আপনার সাথে যজ্ঞ দেখতে যাব।” এ কথা ইন্দ্র যখন সকলকে বলল ঠিক সেবার ইন্দ্রপূজা হলো না। প্রদোষ হলে ইন্দ্র ভাবে বৃন্দাবনে তো তার পূজা হলো না। তার পূজা না করে গোবর্ধন গিরি পূজা করেছে। দেবরাজ ইন্দ্র ক্রোদ্ধ হয়ে বলে,“বৃন্দাবনে কে আমার পূজা লোপ করেছে? তখন নারদ মুনি জানান,“আপনার পূজা লোপ করেছে নন্দের নন্দন।” দেবরাজ ইন্দ্র অপমানে ক্রোদ্ধান্বিত হয়ে বলল,“কৃষ্ণের কথা শুনে গিরির পূজা করল। আজ আমি বৃন্দাবনবাসীকে বিনাশ করব। দেখি কে রক্ষা করে গোকুল নগর।” দূতগণকে বলে প্রলয়ের মেঘগণকে ডেকে আনতে। আদেশ পেয়ে মেঘঘণ ইন্দ্রের সন্নিকটে আসল। মেঘগণকে ইন্দ্র কহে,“বৃন্দাবনবাসী গোপগণ অহঙ্কার করে আমার পূজা না করে গিরি পূজা করেছে। সেখানে তোমরা জল বর্ষণ কর যাতে বৃন্দাবন রসাতলে যায়। গোপের নন্দন বেটা কৃষ্ণ গিরি পূজা করার জন্য মন্ত্রণা দিয়েছে। তার সদন আগে বিনাশিবে। তারপর একে একে সংহার করবে গোপ সকলকে। বৃন্দাবনের সকল তৃণ আদি বিনাশ করবে। বিনাশ করবে লতা-বৃক্ষ সকল। বিনাশ করবে বৃন্দাবনের গোধন। কোন ঘরদোর যেন না থাকে। তোমরা সকলে আগে যাও আমি যাব পিছে। করীশুন্ড মত যেন জল পড়ে। শিলাবৃষ্টি ঝড় হবে যেন গোকূলে কোন স্থল না থাকে। কেহ যেন না বাঁচে। প্রলয়ের মত অবিরত জল বর্ষণ করবে। তোমরা চল আমি যাব পশ্চাতে। মারতে তাদের বজ্রাঘাতে।” এ কথা বলে মেঘকে অনুমতি দিল। অনুমতি পেয়ে ক্রোধভরে গর্জন করে উঠল মেঘগণ। মেঘগণ যার যার আকৃতি ধারণ করে অবিরাম বর্ষণ করতে লাগল। শিলা বৃষ্টির স্তুপিকৃত হল। প্রলয় যেন সৃষ্টিকে ধ্বংস করছে। মেঘেতে আচ্ছন্ন হলো মহা অন্ধকার। চাল ভেদ করে বৃষ্টি পড়ছে। বাসব ঘন ঘন বজ্রাঘাত করছে। ঘন মেঘের সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এসব দেখে ব্রজবাসী ভয়ে কম্পিত। শিলার আঘাতে ধেনুগণ স্থির থাকতে পারছে না। লেজ তুলে গাভীকূল হাম্বা হাম্বা রব করছে। গোপ-গোপীগণ মৃত্যু ভয়ে “কি হলো কি হলো” বলে হাহাকার করতে লাগল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলে,”এমন বৃষ্টি তারা কখনও দেখেনি।” চারিদিকে ব্রজবাসী করে হাহাকার। আর বলে,”এ সংকট হতে কে উদ্ধার করবে।” বলতে বলতে জলমগ্ন হলো সমস্ত পুরী। বালককে কোলে লয়ে ক্রন্দন করে যত গোপনারী। প্রলয় আসন্ন দেখে যশোমতী নীলমণিকে কোলে লয়। সব কিছু মনে মনে জানলেন দেব নারায়ণ। ক্রুদ্ধ হয়ে দেবরাজ বারি বর্ষণ করছে। অহঙ্কার বশতঃ বৃন্দাবন রসাতলে দিবে। গোবর্ধন ধারণ করে আমি রক্ষা করব সকলকে।” এ মত নারায়ণ মনে মনে ভাবে। ব্রজবাসী সবে ভাবে “এখন উপায় কী হবে। আগেতে দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা করতাম। এখন তা না মেনে গোবর্ধন পূজা করছি। দেবরাজ ইন্দ্র ক্রোদ্ধ হয়েছেন। তার জন্যেই এ ঘোরতর সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কৃষ্ণের কথায় আমরা সকলে এ কাজ করেছি। এখন কি উপায়। চল আমরা সকলে মিলে কৃষ্ণের কাছে যাই। এ বিপদ হতে নিশ্চয় সে আমাদিগকে উদ্ধার করবে।” গোপগণ এ বিবেচনায় শ্রীকৃষ্ণের নিকট গেল। কাতর হয়ে সকলে বলে,” আমাদেরকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার কর। তুমি হচ্ছ ব্রজবাসীর প্রাণ। কিসে আমরা উদ্ধার পাব। ইন্দ্রপূজা না করে গিরি-গোবর্ধন পূজা করেছি। তাই দেবরাজ ইন্দ্র আমাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে অবিরাম বাবি বর্ষণ করছেন। তোমার কথায় আমরা গিরি-গোবর্ধন পূজা করেছি। এখন আমাদের জীবন কিভাবে বাঁচবে। তুমি যা বলবে আমার তা করব। তোমার কথা আমরা কখন হেলা করতে পারি না। তুমিই আমাদের একমাত্র উদ্ধারকর্তা। বিপদ সাগরের কর্ণধার তুমি। তুমি ব্যতিত আমাদিগকে কে উদ্ধার করবে। যখন তুমি কালিন্দীর জলে ডুবেছিলে সেদিন আমরা বৃন্দাবনবাসীগণ দ্বিতীয় প্রহর নিশি হলে নিদ্রা যাই। হঠাৎ বনের মধ্যে আগুন লাগিল তুমি আমাদিগকে রক্ষা করলে। শিশুগণকে বিষ-পানেতে রক্ষা করলে। সকল ঘটনাই আমাদের সাক্ষাতে ঘটল। বার বার তুমি আমাদিগকে রক্ষা করেছ। এবারও আমাদেরকে তুমি রক্ষা কর। গোপগণের সকল কথা শুনে কৃষ্ণ বললেন,“তোমরা শুন আমার ভারতী (বাণী, কথা), সকলে মিলে ভক্তিভরে যার পূজা করেছ, তার কাছে যাও। বিপদে নিশ্চয় গোবর্ধন তোমাদিগকে রক্ষা করবে।” কৃষ্ণের কথা শ্রবণ করা মাত্রই গোপনারীগণ বৃন্দাবনে গাভী আদি যত ছিল তা লয়ে কৃষ্ণের সাথে গিয়ে গোবর্ধন গিরিতে উপস্থিত হলো। গিরি প্রতি কন গদাধর,” তোমার পূজা করতে যেয়ে গোপগণ বিপদে পড়েছে। সে জন্যে সকলে তোমার কাছে এসেছে। তাদের সকলকে তুমি স্থান দাও। ইন্দ্রের ভয় হতে গোপগণকে পরিত্রাণ কর।” তখন উচ্চস্বরে কৃষ্ণ বললেন,” গোবর্ধন তোমাদের কষ্ট নিবারণ করবেন। তোমাদের কোন ভয় নেই।” এ বলে শ্রহরি বামকরে (বাম আঙ্গুল) ধরলেন গিরি গোবর্ধন। যেমন বালক অনায়াসে ছাতা ধরে। ধরলেন হরি পর্বত সেমতে। তারপর কৃষ্ণ বলেন,”দেখ ব্রজবাসীগণ গিরি গোবর্ধন তোমাদের সকলকে ঠাই দিয়েছেন। তোমরা সকলে গর্তের ভিতর এসো।” কৃষ্ণের বাণী শুনে ব্রজবাসীগণ গাভী বৎস লয়ে দ্রুত গর্তের মধ্যে প্রবেশ করল। মেঘগণ সবকিছু দেখল। ইন্দ্রের নিকট গিয়ে বলল ব্রজাবাসীগণ পর্বতের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে গিরি গোবর্ধন ভাঙ্গার জন্য বলল। আদেশ পেয়ে মেঘগণ গোবর্ধনের উপর সঘনে বারি বর্ষণ করে। প্রচন্ড শিলা বৃষ্টি হয়। ইন্দ্র তাতে ঘন ঘণ ব্রজাঘাত করে। এভাবে সাত দিন অবিরাম বৃষ্টি বর্ষিত হলো। কিন্তু তারপরও মেঘগণ কিছু করতে পারল না। ইন্দ্র ছয় দিন অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণ করল। আর এ ছয়দিন কৃষ্ণ গিরি গোবর্ধন ছাতার মত করে ধরে রাখলেন। তখন যশোমতী মাতা ব্যস্ত হয়ে শ্রীদামাদিসহ গোপসখাগণকে বলল,” ওরে, আজ ছয়দিন যাবত গোপাল আমার গিরি পর্বত ধরে আছে। তোরা সকলে আয়। পাঁচুনী দিয়ে ঠেকা।” যশোমাতার কথা শুনে নন্দ আদি গোপগণ একত্র হয়ে গিরি ধরে কিন্তু বামনগণ নাগাল পায় না। যষ্টি খোঁটা দিয়ে তারা গিরি পবর্তকে ঠেকা দিল। নন্দ কৃষ্ণের দিকে চেয়ে বলে “ তুমি ছয়দিন ধরে গিরি পর্বতকে ধরে আছ। ছেড়ে দাও আমরা সকলে মিলে ধরি।” নন্দ বাক্য শুনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঈষৎ হাসল। তখন শ্রীকৃষ্ণ “ধর” বলে গিরি পর্বত কিছুটা নামিয়ে ছেড়ে দিল। যেই ভার পড়ল গোপগণের উপর “মরি মরি” করে সকলে হাহাকার করে উঠল। সকলে বলতে লাগল,” ওরে কৃষ্ণ ধর ধর শ্রীঘ্র ধর। গোবর্ধন গিরি যে এত ভারি আগে জানিনি। ধর কৃষ্ণ যদি পড়ে যায় গোবর্ধন তা হলে শ্রীঘ্রই সকলে জীবন হারাবে।” গোপগণ গিরি পর্বতের ভার সহ্য করতে পারছেনা। তা দেখে গিরিধারী পুনরায় পূর্বের মত করে গিরি পর্বত ধরে রাখে। তখন পরস্পরে বলে,” নন্দন কুমার কোন মানুষ নয়। মায়া করে যশোদামায়ে ঘরে জন্ম নিল। সকলে চিন্তা করে দেখ সে ছাড়া আর কে পারে গিরি ধরতে। নিজে বিষ পান করে শিশুগণকে বাঁচাল। কালীয় সর্প দমন করল। বনেতে আগুল লাগল। মোরা চোখ বন্ধ করলাম। না জানি কেমন করে আগুন নিয়ে গেল। আর দেখ অঘাসুর বাকাসুর তৃণাবর্ত্তকে বধ করল কৃষ্ণ গুণিনিধি। এ সকল কাজ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। নিশ্চয় সাক্ষাৎ দেবতা এ নন্দের তনয়।” সমস্ত কিছূ শুনে নন্দ সকলকে বলে,” গর্গমুনি নামকরণ অনুষ্ঠানে আমাকে ডেকে বলেছিলেন,” তোমার “কৃষ্ণের” সমান কেহ হবে না এ ভবে। নারায়ণ সম হবে তার গুণ। তা বুঝলাম এ কারণে কৃষ্ণ গিরি পর্বত ধরে আছে।” নন্দের এ কথা শুনে সকলের মন হরষিত হলে। সাত দিন হলো। তখনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কারো কিছু হলো না। শচীপতির নিকট গিয়ে বলল মেঘগণ কাতরে বলল,“বৃষ্টি বর্ষণ করার অনুমতি দিলেন। ব্রজধামে সাত দিন অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। কিন্তু নন্দ তনয় শ্রীকৃষ্ণ গিরি ধরে ব্রজবাসীকে রক্ষা করল। আমরা  কিছু করতে পারলাম না।” তখন বাসব মেঘগণকে বলল,”তোমরা ক্ষান্ত হও।” বাসব মনে মনে ভাবতে লাগল বাম হাতে নন্দের তনয় গিরি পর্বত ধরে রাখল। জানতে পারছিনা কে এ নন্দের নন্দন।” দেবরাজ ইন্দ্র তখন ভীত হয়ে গোলকেতে গেল। গোলকভুবনে শ্রীহরি নেই। বাসব মনে মনে বিচার করল গোলক ত্যাগ করে শ্রীহরি ব্রজেতে গেছেন। এ সব কিছু দেবরাজ ইন্দ্র আগে জানতে পারেনি। দেবরাজ ইন্দ্র ভাবছে এখন তিনি কি করবেন। শ্রীহরি তার প্রতি নিশ্চয় ক্রোধান্বিত হয়েছেন। তারপরও তিনি চিন্তা করলেন তিনি যাবেন শ্রীহরি সাথে দেখা করতে। গোলকভুবনের সুরভী গাভী নিয়ে গোকূলে রওনা দিলেন। বৃষ্টি থেমে গেলে ব্রজবাসীগণ গাভীবৎস নিয়ে কৃষ্ণের সাথে বৃন্দাবনে ফিরে গেল। গিরি গোবর্ধন পর্বতকে প্রণাম করে পুরন্দর বললেন,” প্রভু ক্ষমা কর এ দাসেরে। তমোগুনে আচ্ছন্ন হয়ে অপরাধ করেছি।” এভাবে নানা বাক্যে পুরন্দর শ্রীহরির স্তব করলেন। স্তবে তুষ্ট হয়ে গদাধর বললেন,” কেন তুমি আমার এত স্তব করছে। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন আছি। তোমাকে জানাব বলে গিরি ধরেছি। আর তাই রক্ষা করেছি গোকূল নগরী। কিন্তু ব্রজপুরে তোমার পূজা বারণ করেছি। জানিবে কেবল ইহা আমার ইচ্ছা। যাও তোমার নিজ সদনে।” শুনে ইন্দ্র পুনরায় প্রণাম করে কহে,” গোলোকে গিয়েছিলাম। দেখলাম তুমি পৃথিবীতে। সুরভী গাভীর দুগ্ধ দিয়ে তোমার অভিষেক করব। আমার প্রতি সুপ্রসন্ন হও প্রভু। দ্বাদশী তিথিতে সুরপতি গোবিন্দের অভিষেক করলেন। সুরভী গাভীকে বৃন্দাবনে রক্ষা কর তুমি। তুমি বিনা সুরভী গাভীকে কেহ রাখতে পারবে না।” ব্রজের গোপগণকে তোমার সাথে রাখলে আর পেলে আনন্দ। সে জন্যে তোমার নাম হলো গোবিন্দ। তারপর দেবরাজ ইন্দ্র গোবিন্দকে প্রণাম করে স্বর্গপুরী গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ সুরভিসহ বৃন্দাবনে গোপগণের সাথে মহাআনন্দে বাস করতে লাগল।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র