কালীয় নাগের পূর্বজন্ম কথন

পরীক্ষিত শোকদেব পদতলে বসে বলছেন”, হে মুনিবর! কালীয় নাগ এমন কি পূণ্য করল যার ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম চিহ্ন তার মাথায় থাকিল। সে কথা বলুন মুনিবর। শোন পরীক্ষিত রাজন কালীয় নাগের এ জন্মে কোন পূণ্য নেই। যা ছিল তা পূর্বজন্মে। সেই পূর্বজন্মের কথা শোন। উশী নগরে বিষদর্ব্বি নামে একজন কৃষ্ণভক্ত রাজা ছিলেন। ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবদের তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু দৈবের ঘটনা তো বলা যায় না। এমনই একটি দৈব ঘটনা ঘটল। রাজার ছিল একটি পূষ্প উদ্যান। সে উদ্যান থেকে মালীগণ পূষ্প তুলত। সেই উদ্যানের কোন স্থানে একজন ব্যধিগ্রস্থ ব্রহ্মাণ বৈষ্ণব বাস করত। তার হাত পা সবকিছূ পচে গিয়ে খসে পড়ছে। রক্ত, পোচ পড়ছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কৃমি বাস করছে। এমন দূর্গন্ধ যে তার কাছে কেহ যেদে পারে না। একদিন দূত এসে রাজাকে বলল” মহারাজ, পুষ্পের উদ্যানে একজন ব্যাধিগ্রস্থ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব তার হাত পা পচে গেছে। শরীর থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে। তার কাছে যাওয় যায় না। উদ্যান থেকে আপনার জন্য পূষ্প সংগ্রহ করতে সমস্যা হচ্ছে। তখন রাজা বললেন” ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবকে বল অন্য কোন স্থানে যেতে আর তিনি যদি যেতে নার পারেন তা হলো তোমার কোন স্থানে তাকে রেখে এস। রাজার আদেশ পেয়ে দূতগণ নাকে হাত দিয়ে ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের নিকট গিয়ে বলল” শোন ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব , রাজার আদেশ হয়েছে তোমাকে অন্যত্র যেতে হবে। ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব বলল” আমি কিভাবে যাব। আমার তো যাওয়া শক্তি নেই। আমার হাত পা পচন ধরেছে আমি কিভাবে যাব। তখন দূতগণ মনে মনে ভাবল রাজার আদেশ আছে যেতে না পারলে অন্য কোন স্থানে রেখে আসতে। তাই দূতগণ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবকে মাঠের একটি বৃক্ষমূলে রেখে এল। বৈষ্ণবেরে বাহিরে রেখে আসার সাথে সাথে রাজাকে শূলব্যাধি আক্রান্ত করে। রাজা মনে মনে ভাবে বৈষ্ণব অপমানে শূলব্যাধি হয়নি হয়েছে দৈবের কারণে। বৈধ্য ডেকে রাজার অনেক চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু কোন কিছুতেই রাজার অসুখ ভাল হলো না। রাজা দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। বেদনাকাতর হয়ে পড়ছেন। অবশেষে একজন রোজা (বৈদ্য) এসে বলল” মহারাজ, আপনার এ অসুখ কোন ঔষধে সারবে না। আপনাকে ঔষধের মধ্যে রাজহংসের মাংস চাই। তাহলে কেবল আপনি ভাল হবেন। রাজা তখন বলে” রাজহংস কোথায় পাই।“ বৈদ্য তখন বলে” মহারাজ ব্রহ্মার সরোবরে রাজহংস আছে। হংস বা হংসী যে কোনটি হলেই চলবে। তা হলেই আপনি নিশ্চিত সুস্থ্য হবেন।“ রাজা বিষদর্ব্বি তখন দূতগণকে ডেকে সমস্ত ঘটনা বলল এবং যে কোন প্রকারে হোক রাজহংস বা হংসী যে এনে দেবে তাকে তিনি যথোপযুক্ত পুরষ্কার দিবেন। বৈদ্যরা বলল” অবশ্যই আমারা রাজহংস রাজার জন্য আনব।“ এ বলে বৈদ্যরা ব্রহ্মা সরোবরে উপস্থিত হলো। ব্রহ্মা সরোবর যোড়শ যোজন দীর্ঘ ( ৬৪ কোশ লম্বা) এবং দ্বাদশ যোজন প্রস্থ ( ৪৮ কোশ প্রস্থ)। সাদা, নীল, পীত ও রক্ত বর্ণ কমল ব্রহ্মা সরোবরের ফুটে আছে। মাঝখানে রাজহংস ও রাজহংসী আছে। ব্যাধগণ তাদের দেখে খুবই খুশি হলো। ব্যাধগণ রাজহংসদের ধরার জন্য আমিষ দ্রব্য মিশিয়ে ফাঁদ পেতে এ ভাবে পাঁচ দিব বসে রইল। কিন্তু কোন হংস বা হংসী ফাঁদে ধরা ধিল না। ব্যাদগণ হতাশ হয়ে নিকটস্থ লোকজনের নিকট হতে জানতে পারল। এ দুই হংস-হংসী পদ্মের মৃনাল অথবা কোন বৈষ্ণব কোন দ্রব্য দিলে তারা আহার করে। তখন ব্যাধগণ তাদের বস্ত্র ত্যাগ করে ফাঁদ তুলে বৈষ্ণবের বেশ ধারণ করে সরোবরের তীরে দাড়ায়ে খাদ্যদ্রব্য লয়ে সঘনে হংসী-হংসীকে ডাকরে আরম্ভ করল। ডাক শুনে হংস তীরের দিকে যেতে লাগলে হংসী বলে” কোথায় যাও প্রাননাথ।“ হংস বলে ঐ দেখ বৈষ্ণব ডাকছে।“ হংসী তখন বলে” যেও না প্রাননাথ এরা বৈষ্ণব নয় মনে হয়এরা মায়াধারী ব্যাধ।“ পাঁচ দিন পূর্বে তারা এখানে ফাঁদ পেতে ছিল। এখন কপট করে বৈষ্ণবের বেশ ধারণ করেছে। খাবার নাম করে আমাদের ধরবে।“ তখন হংস বলল”, কপট হলেও বৈষ্ণবের বেশ। কাছে না গেলে অপমান হবে। যদি শ্রীকৃষ্ণে চরণ না পাই। যদি কৃষ্ণ চরণ সেবা হতে যদি বঞ্ঝিত হই। তবুও আমি তার কাছে যাব।“ এ বলে হংস যেখানে কিরাতকুল(ব্যাধ) উচ্চস্বরে ডাকিতেছে সেখানে গেল। ব্যাধগণ হাত পেতে খাদ্যদ্রব্য দেয় যেন তারা কত সুখে তাদের খাওয়াতে চাচ্ছে। মনের সুখে হংস আহার করলে লাগল। সহসাই ব্যাধ বাম হাতে হংসের গলায় ধরিল এবং মারতে উদ্যত হলো। তখন হংস বলল”, কেন তোমরা আমাকে মারছ।“ ব্যাধ বলল”, উশি নগরের রাজার শূলব্যাধী হয়েছে বৈদ্য এসে বলল রাজহংস রক্তমাংশে ঔষধ করে খাওয়ালে তবেই রাজা ভাল হবেন।“ তাই তোমাকে ধরে মেরে রাজার কাছে নিয়ে যাব। অনেক ধন পাব।“ তখন রাজহংস বলে”, এখানে কেন আমাকে প্রহার করে প্রান সংহার করবে। আমাকে রাজার নিকট লয়ে যাও। তিনি আমাকে যা করার করবেন। হংসের বচন শুনে ব্যাধগণ তাকে নৃপতির নিকট লয়ে গেল। বহু ধনরত্ন দিযে ব্যাধকে বিদায় করে নৃপতি রাজহংসকে বধ করতে বলেন। তখন রাজহংস বলেন”. কিসের জন্য মহারাজ আপনি আমাকে বধ করবেনন।“ মহারাজ বলেন”, তোমার রক্তমাংশ দ্ধারা ঔষধ করে খেলে আমার শূলব্যাধী ভাল হয়ে যাবে।“ রাজহংস বলে”, এর জন্য আপনি আমাকে হত্যা করবেন। আপনি ঔষধ খেলে ভাল হবেন না। আমি যা বলি তা আপনি শুনুন।“ তখন বিষদর্ব্বি রাজা বলেন”, কি দ্রব্য আমাকে আহার করতে হবে।“ হংস বলে “,আপনাকে কোন দ্রব্য আহার করতে হবে না।“ কেবল মাত্র ব্রাহ্মণ চরণোদক পান করলেই আপনি মুক্ত হবেন।“ রাজা ব্রাহ্মণের চরণোদক আনার জন্য দুতগণকে প্রেরণ করলেন। কিন্তু কোথাও ব্রাহ্মণের চনণোদক পেলেন না। দূতগণ ফিরে এসে বলল”, মহারজা কোথাও ব্রাহ্মণের চরণোদক পাওয় গেল না। তবে উদ্যানে বৃক্ষমূলে একজন ব্যাধিগ্রস্থ ব্ষ্ণৈব আছেন।“ সহসাই রাজহংস বলল” হোক বৈষ্ণব তার চরণোদকই নিয়ে আস।“ একজন দূত দ্রুত সেই ব্যাধিগ্রস্থ বৈষ্ণবে কাছে উপনীত হয়ে বলল” মহারাজ পাঠিয়েছেন। তিনি ব্যাধিগ্রস্থ আপনার পাদোদক দিতে বলেছেন। তাড়াতাড়ি আপনার পাদোদক দিন।“ বৈষ্ণব বলিল” আমি পাদোদক কোথায় পাব। আমার তো পায়ে কোন আংগুল নেই।“ তখন দূত তার হাতে থাকা পাত্রটিতেই তার চরণ ডুবিয়ে দিল। তাতে রক্ত, মাংশ, পূয় কীট পড়িল। সেই পাত্র থেকে রাজহংস আগে রক্ত, মাংম, পূয় ও কটি সমেত জল পান করল। পরে রাজাতে তা পান করার জন্য বলল। রাজা দেখেন পাত্রস্থিত জলে রক্ত, মাংশ,পূয় ও কীট ভাসছে। তা দেখে রাজার মনে ঘৃনার উদ্রেক হলো। তিনি তখন বললেন” , আমি অন্দরে রানী সহ তা পান করব।“ এ বলে রাজা অন্দরে প্রবেশ করে রানীকে বললেন”, রাজহংস এনেছি ঔষধ করে খেতে সে বলে বৈষ্ণবে পাদোদক খেলে আমি মুক্ত হবো। কিন্তু সেই চরনমৃতে রক্ত, মাংশ, পূয় ও কটি ভাসে। কেমনে তা আমি পান করব। মনে ঘৃনের উদয় হয়। এখন তুমি বল রানী আমি কি করব।“ রানী বলেন’, আপনার যা মনে হয় তা করুন।“ রাজা তা না খেয়ে সেই বিপ্রপাদোদক শীরে ধারণ করা মাত্রই রাজার শূলব্যাধি চলে গেল এবং দিব্যজ্ঞান উদয় হলো। তখন কেন্দে কেন্দে রাজা রানীকে বলেন” করি যে অতি মন্দ। বুঝিলাম প্রবঞ্ছনা করেন গোবিন্দ।। রক্ত চরণামৃত আনেছি ভোজন করার জন্য কিন্তু মস্তুকে ধারণ করার ফলে শূলব্যাধ চলে গেল। ভক্তিভরে যদি চরণামৃত খেতাম তাও হয়তে হরির কৃপায় ভাল হতাম। এখন বুঝলাম সেই রক্ত পূয় নয় তা মায়া। আর এ রাজহংস সামান্য নয়। পরাম বৈষ্ণব।“ ইহা বলে রাজা রাজহংসের সম্মুখে আসল। রাজহংস ধ্যানেতে সবকিছু জানল। রাজাকে বলল”, ঘৃনায় চরণাদোক না খেয়ে তা আপনি মস্তকে ধারণ করেছেন। তাই আপনাকে আমি শাপ দিব। মহাখল সাপ হয়ে জন্ম হবে আপনার। বৈষ্ণবের চরণোদক শীর ধারণ করেছেন তাই শ্রীহরিপাদপদ্ম-চিহ্ন মস্তকে ধারণ করিবে।“ এ কথা বলে রাজহংস উড়ে গেল। রোম মুক্ত হয়ে রাজা কিছুদিন বেঁচে ছিল। সেই বিষদর্ব্বি রাজ প্রাণ ত্যাগ করলে কালীয় নামেতে সর্পকূলে তার জন্ম হলো। রাজহংস বাক্য রক্ষা করার জন্য শ্রীহরি কালীয় নাগের মাথায় পাদপদ্ম-চিহ্ন রাখিলেন। ভক্তিভরে যে এ কাহিনী শুনে তার কোন সর্পভয়ব্যাধি হয় না।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র