উদ্ধবের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশঃ

যাদবগণসহ শ্রীকৃষ্ণের প্রভাস তীর্থে যাওয়ার প্রস্তুতি দেখে উদ্ধব ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পদে মস্তক স্পর্শ করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন,” হে যোগেশ্বর! নিশ্চয় আপনি যদুকুল নাশ করে এ মর্ত্যলোক ত্যাগ করে নিজ ধামে যাবেন। যেহেতু আপনি সমর্থ হয়েও বিপ্রশাপের কোন বিধান করছেন না। হে নাথ! হে কেশব! আমি আপনার চরণ ব্যতীত ক্ষণকাল এ ধরাধামে থাকতে ইচ্ছা করছি না। আমাকেও আপনি আপনার ধামে নিয়ে যান। আপনি যাদবকুল নাশ করে নিজ ধামে চলে যাবেন। কিন্তু আমার কি উপায় হবে। হে কৃষ্ণ! আপনার লীলা কীর্তন মানবের কর্ণ কুঠরে প্রবেশ করলে আর কোন স্পৃহা থাকে না। আপনি আমাদের প্রিয় আত্ম। শয়ন, আসন, গমন, উপবেশন, স্নান, ক্রীড়া ও ভোজনকালে আপনাকে আমার দর্শন করতে পারব না, এটা আমাদের জন্য খুবই অসহ্যকার মনে হবে। আমার আপনার উচ্ছিস্টভোজী দাস। আমরা কি প্রকারে আপনার মায়া জয় করতে সমর্থ হবো?। আত্মজ্ঞানী, ঊর্দ্ধরেতা, বসনহীন সন্যাসীরা শান্ত ও অচঞ্ঝলচিত্তে আপনার ধামে প্রবেশ করেন। আমরা এ জগতে অভাজন, শুধু সংসারে ভ্রমণ করছি, কিভাবে আমরা ভব-সংসার পারাপার হবে। আপনি দয়ার আধার। আমাদেরকে উদ্ধার করুন।” কাতর হয়ে সজলনয়নে উদ্ধব বলে,” হে প্রভু! দয়াময়! আপনি বলুন অনিত্য এ সংসার থেকে কিভাবে উদ্ধার পাব। এ সংসারে কেউ কারো নয়। একমাত্র আপনার চরণ বন্দনাই সার। মানব কুলে জন্ম নিয়ে আপনার ভজনা করিনি।
উদ্ধবের বাক্য শ্রবণ করে জনার্দন বললেন,” হে মহাভাগ! তুমি যা বললে তা আমিও স্থির করেছি। ব্রহ্মা, শিব ও অন্য লোকপালগণ আমার ধামে বাস করতে ইচ্ছাপোষণ করে। ব্রহ্মার প্রার্থনা চরিতার্থ করার মানসে আমি অংশ (বলদেব)সহ ধরাতলে অবতীর্ণ হয়েছি এবং সে সকল দেবকার্য আমি অশেষরূপে সম্পন্ন করেছি। বিপ্রশাপে যদুবংশ পরস্পরের সাথে কলহ করে ধ্বংস হবে এবং সপ্তম দিবসে দ্বারকানগরী সমুদ্রে বিলীন হবে। আমি যখন এ ধরণীমন্ডল ত্যাগ করব তখন কলি রাজা হবে। ধরণীর কোন মঙ্গল হবে না। শুন উদ্ধব, আমার পরিত্যক্ত এ ধরাধামে তুমি একস্থানে বাস করিও না। কলিযুগে মানুষ হবে কলুষে মলিন। তখন ধর্ম-কর্ম লোপ পাবে। মানব পূন্যহীন হবে। তুমি স্বজন-বন্ধুবান্ধবের প্রতি সব স্নেহ পরিত্যাগ করে আমাতে চিত্ত অর্পণ করে সর্বত্র সমদৃষ্টি হয়ে পৃথিবী বিচরণ কর। এ পৃথিবীতে সকল বস্তু নশ্বর। কিছুই চিরস্থায়ী নয়। জড় জগতে মন, বাক্য, চক্ষু এবং শ্রবণাদি দ্বারা যা কিছু গ্রহণ করা যায় সে সকল কার্য মায়াময়। তাই তাকে মায়া বলে ও নশ্বর বলে জানবে। বিক্ষিপ্তচিত্ত মানবের নানাবিধ বিষয়ে ভ্রম হয়। সে গুন ও দোষ বিচার করতে পারে না। কোন কাজ উৎকৃষ্ট কোন কাজ নিকৃষ্ট তা তার কাছে ভ্রম অনুভূত হয়। দোষ-গুণ সম্পন্ন ব্যক্তি কর্ম-অকর্ম-বিকর্ম বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়। যোগযুক্ত চিত্তে তুমি আত্মা দর্শন কর, আত্মজ্ঞানী হয়ে আত্মাকে অনুভব কর, দেহভোক্তা আত্মার নিয়ন্তা যে আমি তা নিয়ম্যরূপে দর্শন কর। মুক্তপুরুষেরা আত্মার যথার্থতা উপলদ্ধি করে কর্ম করেন ফলে পুনরায় আর তাদেরকে আর জন্মগ্রহণ করতে হয়না।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাক্য শ্রবণ করে উদ্ধব বললেন,” হে যোগেশ! আমাকে তুমি মুক্তির জন্য সন্ন্যাসের পথ অবলম্বন করার জন্য উপদেশ দিলে। কিন্তু আমি জানি দেহাত্মবুদ্ধি মানবের পক্ষে বিষয় বাসন পরিত্যাগ করা দুষ্কর। কিভাবে অভাগার সন্ন্যাস হবে আমাকে বল। আমি অতি মূঢ়। সংসারে স্ত্রী-পুত্রাদির স্নেহে মায়া-ডোরে আবদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি। ‘আমি ও আমার’ অহমবুদ্ধিতে নিমজ্জিত হয়ে উদ্ধারের পথ খুঁজে পাচ্ছি না। হে প্রভু! হে ভগবান! এ দাসকে উপদেশ দাও কিভাবে সাধন হবে। হে ঈশ! তুমি জগতের আত্মা। নিত্য তুমি প্রকটিত হ্চ্ছ। তুমি ছাড়া কে আমাকে আত্মতত্ত্বোপদেশ প্রদান করবে। এমনি কি ব্রাহ্মাদি দেবতারও তোমার মায়ায় মুগ্ধ। আমি ভীত, সন্তপ্ত। তুমি অনন্তবীর্যশালী, তুমি সর্বজ্ঞ, নরসখা নারায়ণ। আমি তোমার শরণাগত। যাতে আমার মঙ্গল হয় সে শিক্ষা আমাকে দাও। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন,” ইহলোকে আত্মজ্ঞানী যোগীগণ বিষয় বাসনা হতে আত্মাকে সমুদ্ধৃত করে থাকেন। এ জগত সংসারে আত্মাই পরম গুরু। জ্ঞানযোগী ও ভক্তিযোগী পরমপুরুষ আমাকে দেখতে পান। আমার পূর্বসৃষ্ট বহুরূপ আছে তারমধ্যে পুরুষ শরীর (মানব শরীর) আমার সবচেয়ে প্রিয়। পুরুষ শরীরধারী (মানব শরীর) যারা তারাই আমাকে ইন্দ্রিয় গোচর অন্বেষণ করে। এ সম্বন্ধে প্রাচীন ইতিহাস স্মরণ করে যদু ও অবধূতের উপাখ্যান উদারহরণস্বরূপ বলে থাকেন। তাদের কথা স্মারণ করলে মনের বিষাদ দূর হয়। আমি যদু ও অবধূতের এক প্রাচীন কাহিনী তোমাকে বলছি।
একদা যদু (যাযাতির জ্যেষ্ঠ পুত্র) অকুতোভয় পৃথিবী ভ্রমণকারী এক তরুণ সুপন্ডিত অবধূত ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন,” হে বিপ্রে! তুমি কার নন্দন। অকর্তা হয়ে তুমি পৃথিবী পরিভ্রমণ করছ। মায়ামোহ কিরূপে ত্যাগ করলে। সর্বলোকবিচক্ষণা বুদ্ধি কিভাবে পেলে? আপনি জ্ঞানী কিন্তু বালকের ন্যায় ইহলোকে বিচরণ করছেন। মানবগণ আয়ু, যশ: ও ঐশ্বর্য লাভের আশায় ধর্ম, অর্থ, কাম পরিত্যাগ করে। কিন্তু আপনি কার্য করতে সমর্থ, আপনি কবি (বেদজ্ঞ পন্ডিত), আপনি কর্মদক্ষ, আপনি সুন্দর ও পরিমিতভাষী হয়ে জড় জগতে অবস্থান করেও উন্মত্ত পিশাচের ন্যায় কর্ম করছেন না। কোনকিছু ইচ্ছাও করছেন না। কাম ও লোভের আগুনে মানবগণ দাহ্য হয়। গঙ্গাজলে যে হস্তী বাস করে তার কি অনলে কোন ভয় আছে। আপনি সে সকলের কাছে থেকেও উতপ্ত হচ্ছেন না। বিষয়-বাসনাশূন্য, স্ত্রী-পুত্রাদিরহিত হয়েও আপনার আত্মাতে এত আনন্দের কারণ কি? এ বুদ্ধিই বা কোথা হতে এলো? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বলেলেন সেই মহাভাগ ব্রাহ্মণ যদুর বাক্য শ্রবণ করে বলতে লাগলেন,” হে রাজন! এ পৃথিবীতে আমার অনেক গুরু আছেন যাদের কাছে থেকে আমি বুদ্ধি লাভ করেছি। তারা হলেন- পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল, অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য, কপোত, অজগর, সমুদ্র, পতঙ্গ, মধুকর, হস্তী, ভ্রমর, হরিণ, মৎস্য, পিঙ্গলা, কুররী, বালক, কুমারী, শরনির্মাতা লৌহকার,সর্প, ঊর্ণনাভ। এ চব্বিশ জনকে আমি গুরু হিসেবে গ্রহণ করে তাদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছি। তাদের মধ্যে যাদের কাছে যা শিক্ষা করেছি তা আপনার কাছে নিবেদন করছি:
পৃথিবী: পৃথিবী নানা অত্যাচার সহ্য করেও অবিচলিত থাকে; ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় যেমন ধীর ব্যক্তিকে বিচলিত করতে পারে না তদ্রূপ পৃথিবীর নিকট হতে আমি এ অচল ব্রতরূপ শিক্ষা গ্রহণ করেছি।
পর্বত ও বৃক্ষ: পৃথিবীর অংশ পর্বত ও বৃক্ষ। সাধু ব্যক্তি যেমন পরের উপকার করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে, নির্জনে বাস করে; পর্বত ও বৃক্ষ যেমন সর্বদা পরের উপকার করে; মানুষ আপন প্রয়োজনের পর্বত ও বৃক্ষকে কাটিয়া নিলেও তারা কিছুই বলে না; তাদের কাছ থেকে আমি পরাত্মতা শিক্ষা করেছি অর্থাৎ পরার্থে জীবনধারণ করিবে।
বায়ু: যোগী ইন্দ্রিয় প্রিয় বিষয় ত্যাগ করে প্রাণবৃত্তিতেই তুষ্ট থাকবে, জ্ঞান নাশ হয়, মন ও বুদ্ধি চঞ্চল হয় এমন আহার করিবে না। বায়ু যেমন গন্ধের সহিত যুক্ত হয়েও তাতে লিপ্ত হয় না তদ্রুপ আত্মদর্শী যোগী ব্যক্তি দেহধর্মে লিপ্ত হয়েও তাতে যুক্ত হয় না। তার কাছ থেকে শিখলাম বিষয়ে প্রবিষ্ট হয়েও বাক্য ও বুদ্ধি অবিকৃত রেখে সর্বদা অনাসক্ত থাকবে।  আকাশ: যোগী ব্যক্তি দেহান্তর্গত হলেও আত্মা দেহাদির অসঙ্গ ও তিনি অব্যবচ্ছেদ্য ইহা মনে করবেন। আকাশ যখন ঘটের ভিতর থাকে তখন সে কত ক্ষুদ্র, কিন্তু তখনও সে অনন্ত বহিরাকাশের সাথে যুক্ত; আকাশ বায়ু দ্বারা তাড়িত হয় না, মেঘ, বিদ্যুৎ ইত্যাদি দ্বারা স্পৃষ্ট হয় না। তার কাছ থেকে শিখলাম আত্মাকে দেহের সহিত অসঙ্গ, গুণাদি দ্বারা অস্পৃষ্ট এবং স্থাবর জঙ্গমে অবিচ্ছেদ্যভাবে পরিব্যাপ্ত জেনে ব্রহ্মস্বরূপে ভাবনা করবে।
জল: জলের নিকট হতে শিখলাম, জল যেমন স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ-মধুর ও তীর্থস্থানরূপ তেমনি যোগীব্যক্তি তার তুল্য হয়ে দর্শন, স্পর্শন ও কীর্তন দ্বারা জগৎ পবিত্র করবেন।
অগ্নি: মুক্তাত্মা ব্যক্তি তেজস্বী ও তপস্যায় প্রদীপ্ত, প্রশান্ত ও দারপরিগ্রহ হয়ে অগ্নির ন্যায় সর্বভূক হয়েও পাপেযুক্ত হন না। মুনিব্যক্তি অগ্নির মত কখন প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্ন থেকে; শ্রেয়োঅভিলাষীগণ উপাসিত হয়ে ভূত আদি ভবিষ্যৎ যত অমঙ্গল দহন করে দাতা যা দিবেন তাই ভোজন করবেন। অগ্নি যেমন কাষ্ঠাদি দাহ্য পদার্থে নিজ স্বরূপে প্রবেশ করে তেমনি প্রভু পরমেশ্বর নিজ মায়া দ্বারা এ জগৎ সৃষ্টি করে তাতে প্রবিষ্ট হয়েছেন। জন্ম আর মৃত্যুর বিকার এ দেহের আত্মার নয়।
চন্দ্র: চন্দ্রের নিকট হতে শিখেছি অব্যক্ত গতি কালের কারণ চন্দ্রের নয়, কালের কারণে চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। শিখার যেমন নাশ হয় তাতে অগ্নির কোন ক্ষতি নেই, জন্ম-মৃত্যু-জরা দেহের ধর্ম, দেহের নাশ হয় কিন্তু আত্মার নয়।
সূর্য: সূর্যের নিকট হতে শিখেছি-সূর্য তার কিরণ দ্বারা জলকে আকর্ষণ করে কিন্তু যথাকালে প্রাণিগণের জীবনধারনের জন্য তা আবার পৃথিবীকে পুনরায় প্রদান করে, তেমনি যোগীব্যক্তি ইন্দ্রিয় বিষয় গ্রহণ করে যথাসময়ে তা অর্থিগণকে প্রদান করেন, তাতে তিনি আসক্ত হন না। সুর্য এক হলেও ভ্ন্নি জলপাত্ররূপ উপাধি ভেদে ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়, তদ্রুপ স্ব স্ব রূপে আত্মা স্বরূপত অভিন্ন হলেও স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির নিকট আত্মাকে ভিন্ন ভিন্ন মনে হয়।
কপোত-কপোতী: কপোতের নিকট হতে শিখেছি কারো সহিত অতিশয় প্রীতি বা অত্যাধিক আসক্তি করিবে না, যদি কেহ করে তবে সে দীনচিত্ত কপোতের ন্যায় সন্তাপ ভোগ করবেন। কোন এক অরণ্যে কপোত-কপোতী বৃক্ষে নীড় তৈরী করে বাস করছিল।কপোত-কপোতী একে অন্যের প্রতি ভালবাসার কোন কমতি ছিল না। মুক্তভাবে তারা আকাশে ঘুড়ে বেড়াত। অঙ্গে অঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকত। এমন ভাব যেন মৃত্যু হলেও দুজনে একসাথে মৃত্যুবরণ করবে। এক আত্মায় পরিণত হয়েছিল তারা। এমনই মায়া তাদের মধ্যে বাসা বেধেছিল ছিল যে কেউ কাউকে না দেখে ক্ষণিকের জন্যও থাকতে পারত না।কপোতী যা যা পাওযার জন্য বায়না ধরত কপোত তা কষ্ট করে হলেও পূরণ কর। তাদের ভালবাসার ফলশ্রুতিই কপোতী যথাসময়ে অন্ড সকল প্রসব করল। সেই সকল অন্ড হতে পক্ষী শাবক প্রসবিত হল। তারপর পুত্রবৎসল কপোতদম্পতি শাবকগণের প্রতিপালনের চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন। তাদের পুষ্ঠিবিধানের জন্য সর্বদা তারা ব্যস্ত থাকত।বিষ্ণু মায়ায় বিমোহিত দীনবুদ্ধি ও স্নেহানুঅন্ধ হৃদয় কপোত-কপোতী তাদের শাবকদের প্রতিপালন করতে লাগল। শাবকগণের কূজন, স্পর্শ, ডানা ঝাপটা তাদের মনকে উদ্বেলিত করত।একদিন খাদ্যের সন্ধানে কপোত-কপোতী দূরবর্তী স্থানে গমন করল। তৎসময়ে এক ব্যাধ নীড়ের সামনে জাল ফেলে শাবকগণকে জালবদ্ধ করল। ইতোমধ্যে কপোত-কপোতী দম্পতি আহারসহ তথায় উপস্থিত হয়ে দেখে শাককগণ জালবদ্ধ হয়েছে। জালবব্ধ দেখে কপোতী রোদন করতে লাগল আর শাবকগণ খাদ্যের জন্য রোদন করতে লাগল। ঈশ্বর মায়ায় মুগ্ধা স্নেহাপ্রবনা শাবক দর্শনে নষ্টস্মৃতি হয়ে সেও জালে আবদ্ধ হলো। তখন কপোত আত্মশরীর হতেও অধিক প্রিয়তর সন্তানগণ ও আত্মসদৃশ ভার্য্যাকে জালে বদ্ধ দেখে বিলাপ করতে লাগল। কপোত বলতে লাগল- ”আমি অতি অকৃতপূন্য ও দূর্বুদ্ধি, আমার দূগর্তি দেখ। গৃহাস্থাশ্রমে তৃপ্ত ও কৃতার্থ না হতে হতেই ধর্মার্থসাধন গৃহাশ্রম বিনষ্ট হলো। পতিদেবতা, অনুরূপা ও অনুকুলা আমার ভার্য্যা আমাকে শূন্য গৃহে পরিত্যাগ করে সাধু পুত্রদের সহিত কোথায় গমন করছে? স্ত্রীপুত্র শূন্য গৃহে আমি কেমন করে বাস করব।” কপোত রোদন করতে করতে জালবদ্ধ স্ত্রীপুত্রকে মৃত্যু আসন্ন দেখে মোহে আচ্ছন্ন হয়ে নিজেও জালে আবদ্ধ হলো। তারপর ব্যাধ কপোত-কপোতী ও শাবকসহ জালে আবদ্ধ করে সু্খে গৃহে গমন করল। যে ব্যক্তি এরূপ কুটুম্বপালনে কুটুম্ব-পোষণপর হয়, সেও কপোত-কপোতীর মত সন্তাপ ভোগ করে। মানব জন্ম মুক্তির দ্বার স্বরূপ। মনুষ্যজন্ম প্রাপ্ত হয়েও যারা গৃহাসক্ত হয়ে জীবন যাপন করে শাস্ত্রে তাদেরকে ‘আরূঢ়চ্যুত’ বলে।
অজগর: শরীরযাত্রা নির্বাহ করার জন্য যা প্রয়োজন উদাসীনের ন্যায় যোগী ব্যক্তি তাই গ্রহণ করে; যদি খাদ্য মিষ্ট, তিক্ত, সরস বা বিরস, অধিক বা স্বল্প হয় তাই অজগরের ন্যায় গ্রহণ করে। অজগর যা পায় তাই ভক্ষণ করে। আবার খাদ্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত শিকার ধরে না। তেমনি যোগী ব্যক্তি নিরাহার ও নিচেষ্ট হয়ে থাকবে যদি ইচ্ছাক্রমে আহার না আসে তবে অজগরের ন্যায় ধৈর্যধারণ করে থাকবে। ইন্দ্রিয়বল, মনোবল ও শরীরবল প্রাপ্ত হয়ে অকর্মকারী শরীর লয়ে নিদ্রাশূন্য ও স্বার্থভাবনা পূর্বক অজগরের ন্যায় শয়ন করে থাকবে এবং ইন্দ্রিয় সৌষ্ঠব পেয়েও কোন চেষ্টা করবে না। অর্থাৎ অজগরবৃত্তি ধারণকারী যোগী অপ্রাপ্তি প্রারদ্ধ কর্মের ভোগ তু্চ্ছ জ্ঞান করে আপনা থেকে প্রাপ্ত আহারে সন্তুষ্ট থাকবেন।
সমুদ্র: মুনি বা যোগী ব্যক্তির বাহিরে প্রসন্নভাব, অন্তরে গম্ভীরভাব, দুর্বিগ্রাহ্য, দুরতিক্রমণীয়, অনন্তপার, অক্ষাভ্যরূপে নিশ্চলোদক সমুদ্রের ন্যায় ভাব ধারণ করবেন। বর্ষায় যেমন নদী স্ফীত হয়, গ্রীষ্মে তেমনি ক্ষীণ হয়। তেমনি নারায়ণ পরায়ণ মুনির কাছে শীতগ্রীষ্ম, সুখ-দু:খ, জয়-পরাজয় সবই সমান। সম্পদের আগমনে বা বিয়োগে তিনি হৃষ্ট বা ক্ষুব্দ হন না। সমুদ্রের নিকট হতে আমি এ শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে, মুনি বা যোগী সমুদ্রের মত নিশ্চল, ধীর-স্থির ও প্রশান্ত স্বভাবের হবেন, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিতে নিশ্চল থাকেবেন।
পতঙ্গ: পতঙ্গ যেমন আগুনের উজ্জ্বল শিখা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভক্ষণ করার জন্য আগুনে ঝাপ দেয় তেমনি অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি রমণীগুণে মুগ্ধ হয়ে নরকে পতিত হয়। মূর্খ ব্যক্তিরা মায়া রচিত স্ত্রী, হিরণ্যাভরণ ও বস্ত্রাদি বিষয়ে উপভোগ বুদ্ধিতে প্রলোভিত হয়ে বুদ্ধি লোপ পেয়ে পতঙ্গের ন্যায় বিনষ্ট হয়। পতঙ্গে কাছ থেকে আমি এ শিক্ষাই পেয়েছি যে, জড় জাগতি বিষয়ে আকৃষ্ট হলে পতন অনিবার্য।
মধুকর: যে পরিমান অন্ন ভোজন করলে যোগীর দেহ রক্ষা হয় সে পরিমানের অন্ন সংগ্রহ করা উচিৎ। মধুকর যেমন বহু পুষ্প হতে মধু সংগ্রহ করে নিজের উদর পূর্ণ করে, এক পুষ্প হতে সমগ্র মধু আহরণ করে না, যোগীও তেমনি এক গৃহস্থের নিকট হতে মাধুকরী সংগ্রহ না করে অনেক গৃহস্থের নিকট হতে অল্প অল্প করে ভোজনের নিমিত্ত মাধুকরী সংগ্রহ করবেন। মধুকরের নিকট হতে আমি এ শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে, যোগী ব্যক্তিগণ আগামীর জন্য কোন সঞ্চয় করবেন না।
ভ্রমর: ভ্রমরের নিকট হতে আমি দুটো শিক্ষা গ্রহণ করেছি। প্রথম শিক্ষা- ভ্রমর যেমন পুষ্পের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে ফুল হতে সার-মধু আহরণ করে, তেমনি যোগী বা সাধু ব্যক্তি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শাস্ত্র হতে তার সার বা জ্ঞান আহরণ করবেন। ভ্রমরের নিকট হতে দ্বিতীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে- মুনি বা যোগী ব্যক্তি আজ বা আগামীর জন্য মক্ষিকার মত অন্নাদি সঞ্চয় করবেন না। যদি করেন তবে মুনি ব্যক্তি আহারীয় দ্রব্যের সহিত বিনষ্ট হবেন।
মধুসংগ্রাহক গুরু: লোভী ব্যক্তি অতিদু:খ কষ্ট সহ্য করে নিজে উপভোগ না করে ধন সঞ্চয় করে কিন্তু তার সঞ্চিত ধন অন্য লোকে ভোগ করে। নিজে ভোগ করতে পারে না বা অন্যকে দানও করে না। যেমন মক্ষিকারা ( মৌমাছি) মধু সংগ্রহ করে নিজে ভোগ করতে পারে না; পরে লোকে তা নিয়ে যায়। এ থেকে আমি শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে- গৃহস্থ অন্ন-ব্যঞ্জনাদি রন্ধন করে কিন্তু যতি ব্যক্তি এলে তাতে তাকে আগে ভোজন করাতে হয়।
হস্তী: সামান্য মাংসময়ী যুবতীর কথা দূরে থাক, দারুময়ী বা কাষ্ঠময়ী নারীকেও স্পর্শ করা সন্ন্যাসীর পক্ষে অনুচিৎ। স্পর্শ করলে গর্তের মধ্যে রাখা হস্তীনিকে পেতে যেমন গর্তে পড়ে হস্তী ধরা পড়ে তেমনি নারীর রূপ সন্ন্যাসীকে মায়ায় আচ্ছন্ন করে ভ্রষ্ট করে। তাই প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কখনও নিজের মৃত্যুর জন্য কোন স্ত্রীতে আসক্ত হবেন না। যদি আসক্ত হয় তবে গজের মতই অবস্থ হবে। এ শিক্ষা তিনি গজের কাছ থেকে পেয়েছি।
হরিণ: বনচর যতি ব্যক্তি ভগবদ্ভগীত ব্যতীত কখনও পার্থিব বিষয় সম্পর্কিত গানাদি শ্রবণ করবেন না। ব্যাধের গীতে হরিণ মুগ্ধ হয়ে তাতে ব্যাধের কাছে ধরা দিয়ে জীবন হারায়। মৃগীপুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ স্ত্রীগণের গ্রাম্য নৃত্য-গীতবাদ্য প্রীতপূর্বক শ্রবণ ও দর্শন করে তাদের বশীভূত হয়েছিল। তেমনি মুনি বা যোগী ব্যক্তির তেমন দশা হয়। হরিণের কাছ থেকে আমি এ শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে, মুনি বা যোগী ব্যক্তির জড় জাগতিক বিষয় তৃষ্ণা নিবৃত্তি করতে হবে।
মৎস্য: বড়শির লোভনীয় টোপে আকৃষ্ট হয়ে মাছ যেমন বড়শিতে ধরা পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তেমনি অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ চিত্ত চাঞ্চল্য হেতু জিহ্বার লোভে বশীভূত হয়ে মৃতুগ্রাসে পতিত হয়। নিরাহার যোগীগণ রসনা ব্যতীত সকল ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পারেন যেহেতু নিরাহার যোগীর রসনাই প্রবৃত্তি হতে থাকে, রসনা জয় না করে কোন যোগী জিতেন্দ্রিয় হতে পারে না, রসনাকে জয় করতে পারলে সকল ইন্দ্রিয়িই পরাজিত হয়। মৎস্যের কাছে থেকে শিক্ষা পেয়েছি যে-ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মোক্ষ লাভ করা যাবে না।
কুরর পক্ষী: মাংস নিয়ে কুরর পক্ষীদের মধ্যে মরামারি হয়। দুর্বল কুরর পক্ষীকে সহজেই বধ করে মাংসখন্ড ছিনিয়ে নিতে বলবান কুরর পক্ষী চেষ্টা করে। কিন্তু কুরর পক্ষী যদি মাংসখন্ডটি ফেলে দেয় তবে বলশালী কুরর পক্ষী আর দিকে ধেয়ে যায় না। কুরর পক্ষীর নিকট হতে আমি শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে-আসক্তি বা লোভ ত্যাগ করলে অনায়াসে সুখ লাভ হয়।
পিঙ্গলা উপখ্যান: পুরাকালে বিদেহ নগরে পিঙ্গলা নামে এক দুশ্চরিত্রা (বেশ্যা) মহিলা বাস করত। সে দেখতে খুব সুন্দরী ছিল। একদিন সে নিজেকে উত্তম বেশভূষাসহ সজ্জিত করে সন্ধ্যাকালে বর্হিদ্বারে বিত্তশালী কোন পুরুষের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু কোন পুরুষ তার বাটিতে প্রবেশ করছে না। সে তখন ভাবতে লাগল নিশ্চয় অন্য কোন বিত্তবান পুরুষ তার গৃহে আসবে। পিঙ্গলার উদ্দেশ্যে ছিল পুরুষ সঙ্গের বিনিময়ে অর্থ লাভ করা। অপেক্ষা করতে করতে পিঙ্গলা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল কিন্তু কোন বিত্তবান কোন ব্যক্তি তার গৃহে প্রবেশ করল না। রাত্রি প্রায় শেষ হতে চলল। সে দুশ্চিন্তায় পতিত হলো। ধনাশায় শুষ্কবদনা দীনচিত্তা সে পিঙ্গলার সুখাবহ চিন্তা হেতু হৃদয়ে বৈরাগ্যের উদয় হলো। বৈরাগ্য মানুষের আশা-বন্ধনকে ছেদন করে যেমন অসি অন্য বন্ধনকে ছেদন করে। বৈরাগ্য না জন্মিলে মায়পাশ ছেদন করা যায় না। তখন পিঙ্গলা বলতে লাগল- হায়! আমি অতি মূঢ়, অতি বিবেক শূন্য, আমার কি মোহ, আমি অজিতেন্দ্রিয়, আমি মূর্খের ন্যায় অতি তুচ্ছ কান্তের নিকট হতে কাম্য বিষয় পাওয়ার জন্য অধীর হয়েছি। যিনি আমার সমীপে বর্তমান, রতিদাতা, বিত্তপ্রদ, সে নিত্য রমণ এ কান্তকে পরিত্যাগ করে অজ্ঞের ন্যায় অকামদ, দু:খ, ভয়, শোক এবং পীড়াদায়ক ও অতি তুচ্ছ পুরুষকে ভজনা করছি। এতদিন আমি নিন্দিত কর্ম করে আত্মাকে কষ্ট দিয়েছি; নিজে বিক্রয় করে অর্থলোভ বশীভূত হয়ে অন্য পুরুষের নিকট হতে রতি ও বিত্তপ্রাপ্তির আশা করেছিলাম। অস্থিচর্ম দ্বারা গঠিত নবদ্বার বিশিষ্ট এ দেহঘর মুল-মূত্র দ্বারা পরিপূর্ণ। আর আমি এ দেহকে আনন্দে ভোগ করছি। আমি আত্মপ্রদ অচ্যুত হতে অন্যের নিকটে কামভোগ ইচ্ছা করেছি; সেজন্যে এ বিদেহ নগরে আমি অতি মূঢ়। পতিতপাবন শ্রীহরি যে আমাকে উদ্ধার করবে তাকে ত্যাগ করে অন্যকে কামনা করছি। আমি পাপ করেছি। আমার মনে যে বৈরাগ্যের উদয় হয়েছে নিশ্চয় তা তার কৃপায় হয়েছে। আমি অতি নীচ কি সাধ্য আমার আমাতে বৈরাগ্য সৃষ্টি করার। আর সংসার সাগরে কেন মজিব। ঈশ্বরের শরণ নিয়ে তার কাছে সব সপে দিব। এ সংসার অনিত্য। মায়ার দ্বারা আক্রান্ত। সর্বদাই শ্রীহরি চরণ স্মারণ করিব। তাতেই মুক্তি পাব। কুচিন্তা, কুপ্রভা মনকে ভীষণ আচ্ছন্ন করেছে। কালসর্প অজগর আমাকে গ্রাস করেছে। পার্থিব সুখে আর রমণ করব না। হরি বিনা উদ্ধার কে আমাকে করিবে। পিঙ্গলা এভাবে স্থিরনিশ্চয় করে এবং কান্ততৃষ্ণাজনিত দুরাশা পরিত্যাগ করে ও উপশম প্রাপ্ত হয়ে শয্যা গ্রহণ করল। কারণ আশাই পরম দু:খের কারণ আর নৈরাশ্যই পরশ সুখ। পিঙ্গলা কান্ত বিষয়ক আশা পরিত্যাগ করেই সুখে নিদ্রিত হয়েছিল।
বালক: অজ্ঞ বালকের কোন মান বা অপমান বোধ কিছুই নেই। গৃহ বা সংসার নিয়েও কোন চিন্তাও করে না। আমি অজ্ঞান বা অবুঝ বালকের মত নিত্য ক্রীড়া করি। আত্মক্রীড়া ও আত্মরতি হয়ে বালকের ন্যায় আমি বিচরণ করি। বালক যেমন অবুঝ বোধশক্তিহীন, বালকের কাছ থেকে আমি এ শিক্ষাই গ্রহণ করেছি।
কুমারী: এক কুমারী পিতামাতার অনুপস্থিতে তার বিবাহ উপলক্ষে কিছু লোক তার বাড়ীতে আসে। কুমারী শশব্যস্ত হয়ে তাদের খাবারের আয়োজনের নিমিত্ত ঢেঁকিতে ধান ভানতে লাগল। কিন্তু কুমারীর হাতের কঙ্কনের ধ্বনী কুমারীকে লজ্জিত করিল। তারপর এক এক করে কুমারী কঙ্কন খুলে রাখল। কুমারীর হাতে রহিল শুধু একটি কঙ্কন। ফলে কোন ধ্বনি সৃষ্টি হলো না। কুমারী হতে আমি এ শিক্ষা পেয়েছি যে, দুই জনের বা বহুজনের একত্রে বাস শুধু দু:খের কারণ। তাই সাধু ব্যক্তি বহু জনে সঙ্গ ত্যাগ করে নির্জনে একাকী বাস করবেন।
শরনির্মাতা লৌহকার: শরের নির্মাণকারী লৌহ সোজা করার সময় অন্য কোন দিকে মন সংযোগ করে না এমনকি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রাজ-মহারাজারা গমন করলেও তাতে তার মন মজে না। তেমনি বৈরাগ্য অভ্যাস করে মনে মনে তম: রজ: গুণকে ত্যাগ করে সত্ত্বগুণকে আঁকড়িয়ে ধরে ভগবানে মন সমাহিত করতে হয়। অন্তরে বাহিরে কিছু না ভেবে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে ধ্যানস্থ থাকতে হবে। শরনির্মাতা লৌহকারের নিকট হতে আমি এ শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে- মনে বৈরাগ্য সৃষ্টি করে একাগ্রচিত্তে এক বস্ততেই মনসংযোগ করতে হবে।
সর্প: সর্প একাকী বিচরণ করে। ইহার কোন নির্দিষ্ট নিবাসস্থান নেই। মানুষের ঘরে বা অন্য কর্তৃক তৈরীকৃত গর্তে পরম সুখে বাস করে। তার যে বিষ আছে, তার গতি দ্বারা তা বুঝা যায় না। তেমনি অসহায় ও মিতভাষী মুনিও সেভাবে বসবাস করবেন। সর্পের কাছ আমি এ শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে, অনিকেতনতাই সুখ, গৃহপরিবারই দু:খের কারণ। কারণ মানুষের গৃহে বাস করে সর্প পরম সুখ প্রাপ্ত হয়।
ঊর্ণনাভ (মাকড়সা): ঊর্ণনাভ বা মাকড়সা নিজ হৃদয় হতে মুখের দ্বারা সূক্ষ্ণ সূত্র বিস্তার করে জাল তৈরী করে নিজ মনের আনন্দে বিচরণ করে, আবার নিজেই তা গ্রাস করে, পরমেশ্বর ভগবান তেমনি এ বিশ্ব সৃজন করে, ইহার স্থিতি বিধান করে, অবশেষে আপনি নিজেই তা প্রলয় করেন। ঊর্ণনাভের কাছে থেকে আমি এ শিক্ষা লাভ করলাম
কীট: মুনি বা যোগী ব্যক্তি স্নেহ দ্বারাই হোক বা দ্বেষ বশতই হোক আর ভয় কারণেই হোক যেখানে যেখানে সর্বতোভাবে বুদ্ধির সাথে একাগ্ররূপে মন ধারণ করেন, তার সে সে রূপ প্রাপ্তি হয়। কোন কোন দূর্বল কীট সবল কীট কর্তৃক ধৃত হয়ে তার গর্তে প্রবেশ করে ভয়ে ধ্যান করতে করতে নিজ দেহ পরিত্যাগ না করেই ঐ কীটের রূপ প্রাপ্ত হয়। এ কীটের কাছ থেকে শিখিলাম তন্ময় বা বাহ্যজ্ঞান হয়ে ধ্যান করলে ভগবৎসারূপ্য লাভ হয়।
বৈরাগ্য ও বিবেকের কারণে আমার এ দেহ আমার গুরু: এ দেহ অনিত্য, বিনাশশীল। তাই দেহের স্বরূপ নির্ণয় করে অসঙ্গরূপে বিচরণ করছি। এ দেহ কত কষ্ট সহ্য করে স্ত্রীপুত্রাদির জন্য,পরিবারের জন্য। অর্থ সঞ্চয় করে কিন্তু অন্তিমকালে বৃক্ষের ন্যায় দেহান্তরে বীজ সৃষ্টি করে নিজেকে বিনাশ করে। জিহ্বা, তৃষ্ণা, শি শ্ন, ত্বক, উদর, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, চক্ষু কর্মশক্তি- ইহারা প্রত্যেকে এক এক দিক হতে নিজের দিকে এ দেহকে টানছে, বহুপত্নী যেমন গৃহস্বামীকে টানে, সেরূপ টানছে। বহু জন্মের পর অনিত্য এ দেহ কিন্তু সকল অর্থের সাধক এ মনুষ্যদেহ লাভ করে ধীর ব্যক্তি এরূপ যত্ন করবে যেন মৃত্যুর পর নিকৃষ্ট যোনীতে পতিত হতে না হয় ও সর্বতোভাবে মুক্তি লাভ হয়। এ সকল শিক্ষা লাভ করে আমি বৈরাগ্য প্রভাবে মুক্তসঙ্গ ও নিরহঙ্কার হয়ে এ পৃথিবী পরিভ্রমণ করছি। একজন গুরুর নিকট হতে প্রচুর ও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যায় না, কারণ ব্রহ্ম এক অদ্বিতীয় হলেও ভিন্ন ভিন্ন ঋষিরা তাঁকে নানাভাবে নির্ণয় করেছেন। ভগবান বললেন- গভীর-বুদ্ধিদীপ্ত ব্রাহ্মণ এরূপ বলে যদুরাজ কর্তৃক অর্চিত ও বন্দিত হয়ে যেখান হতে এসেছিলেন সেখানে গমন করলেন। হে উদ্বব! আমাদের পূর্বপুরুষগণের আদিপুরুষ যদু অবধূতের সকল কথা শ্রবণ করে সর্বপ্রকার আসক্তি ত্যাগ করে সমচিত্ত হয়েছিলেন।
First

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র