তারপর দেবর্ষি নারদ যোগেশ্বরের অনির্বচনীয় যোগমায়া জানিবার ইচ্ছায় অন্য এক পত্নীর গৃহে প্রবেশ করলেন। সেগৃহেও তিনি দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ প্রিয় ভার্য্যাকে লয়ে উদ্ধবের সহিত অক্ষক্রীড়া করছে। দেবর্ষি নারদকে দর্শন করামাত্রই শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যুত্থান ও আসনাদি দ্ধারা পূজা করলেন। যেন প্রথম তার সহিত সাক্ষাত হলো এমন ভাব নিয়ে বললেন,“ দেবর্ষি নারদ, আপনি কখন আগমন করেছেন? আপনার অভিপ্রায় আমাকে বলুন। আপনারা পূর্ণ আর আমরা অপূর্ণ। অতএব আমরা আপনার কি অভিষ্ট পূরণ করিব? আপনি বসুন। আপনার আদেশ দ্ধারা আমার জন্ম সফল করুন।” শ্রীকৃষ্ণের এরূপ বাক্য শ্রবণ করে দেবর্ষি নারদ বিস্মিত হলেন এবং তথা হতে উঠে কিছু না বলে অন্য গৃহে প্রবেশ করলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শিশু সন্তানগণকে লালন পালন করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে অন্য গৃহে প্রবেশ করে দেখলেন গোবিন্দ স্নান করার জন্য তৈরী হচ্ছেন। এরূপভাবে কোন গৃহে বা পঞ্চ মহাযজ্ঞ দ্ধারা আহ্বনীয়াদি অগ্নিতে হোম করছেন; কোন গৃহে দ্বিজগণকে ভোজন করিয়ে নিজে ভোজন করছেন; অন্য গৃহে বাগযত হয়ে পরব্রহ্মকে ধ্যান করত: সন্ধ্যাপোসনা করছেন; একস্থানে অসি চর্ম লয়ে অসিপথে বিচরণ করছেন; আর এক স্থানে অশ্বপৃষ্ঠে ও গজে চড়ে ভ্রমণ করছেন; কোথায় বা পর্য্যঙ্কে শায়িত- বন্ধীগণ স্তব করছেন; কোন স্থানে গিয়ে দেখলেন উদ্ধবাদি মন্ত্রিগণসহ কোন গভীর বিষেয়ে মন্ত্রণা করছেন; কোন গৃহেনারদ দেখলেন- শ্রীকৃষ্ণ দ্বিজগণকে অলঙ্কৃত গোদান করছেন; কোথাও বা ইতিহাস ও পুরাণাদি মঙ্গলকথা শ্রবন করছেন; কোন গৃহে প্রিয়ার সহিত হাস্যালাপ করছেন; কোন গৃহে ধর্ম, অর্থ ও কাম-সেবায় রত আছেন; একস্থানে দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতি পর পুরুষ পরমাত্মার ধ্যান করছেন; কোথায় বা কামনা-পূরণ, ভোগপ্রদান ও পূজা দ্ধারা গুরুগণের সেবা করছেন; কোন গৃহে শ্রীকৃষ্ণ কারো সাথে কলহ করছে বা কারো সাথে সন্ধি করছে; আর এক গৃহে দেখলেন বলদেবের সহিত একসাথে বসে সাদুগণের মঙ্গল চিন্তা করছেন; কোন গৃহে দেখলেন পুত্র-কন্যাগণের বিবাহ দিবার জন্য এবং যৌতুকাদি প্রদানের জন্য যত্নশীল রয়েছেন; যোগেশ্বর বাসুদেবের পুত্রবধুর আনয়ন বা দুহিতাকে শ্বশুরালয়ে প্রেরণ উৎসব অবলোকন করে বিস্ময়াপন্ন হয়, সে বিষয়ে কল্পনা করছেন; বহুদক্ষিণাবিশিষ্ট যজ্ঞের অনুষ্ঠানে কোন গৃহে শ্রীকৃষ্ণ স্বগণবিশিষ্ট দেবতাগণের অর্চনা করছেন, কোথাও বা কূপ, আরাম ও দেবমন্দিরাদির প্রতিষ্ঠা দ্বারা প্রচুর পূর্ত্তকর্মের অনুষ্ঠান করছেন; নারদ আরও দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ যদুশ্রেষ্ঠগণে বেষ্টিত হয়ে কোথাও বা সিন্ধুদেশীয় অশ্বে আরোহণ করে মৃগয়া করতে করতে যজ্ঞের পশুসকল বধ করছেন; ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বজ্ঞ হলেও নিজের অন্ত;পুরের গূঢ় রহস্য জানার অভিপ্রায়ে স্ত্রীবেশ ধারণ করে সে যোগেশ্বরকে ইতস্তত বিচরণ করছেন; তারপর মানব লীলা করার জন্য অবতীর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এরূপ অচিন্ত্য শক্তির অনির্বচনীয় বিকাশ দর্শনে বিস্মিত দেবর্ষি নারদ ঈষৎ হাসলেন এবং সর্বান্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণকে বললেন,“ হে যোগেশ্বর! যোগেন্দ্রগণ এবং মায়াশক্তিসম্পন্ন লোকপালগণও আপনার দর্শন লাভ করতে পারে না, কেবল আপনার ভবদীয় চরণকমল সেবা দ্ধারাই অবগত হয়ে আপনার অনন্ত যোগমায়ার প্রভাব অদ্য জানতে পারলাম। হে দেব! আমাকে আজ্ঞা দিন। আপনার ভূবনপাবনী লীলাকথা গান করতে করতে ভবদীয় যশোরাশি পরিব্যাপ্ত নানা লোকে আমি বিরচণ করি।” ভগবান বললেন,“ হে ব্রাহ্মণ! আমি ধর্মের বক্তা, অনুষ্ঠাতা ও অনুমোদিতা, জগতে সেই সকল ধর্মের অনুষ্ঠান প্রণালী যাতে লোককে শিক্ষা দিতে পারি, সেই অভিপ্রায়ে আমি আপনার সহিত এরূপ সম্মান প্রদর্শন করেছি। হে পুত্র! এ জন্য আপনি মোহপ্রাপ্ত হবেন না।”
এভাবেই দেবর্ষি নারদ একমাত্র শ্রীকৃষ্ণকেই সকল গৃহে গৃহস্থগণের পরম পবিত্র উৎকৃষ্ট ধর্মসমূহের সকল আচরণ করতে দর্শন করলেন। দেবর্ষি নারদ অনন্তবীর্ষ শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য যোগমায়ার প্রভাব বার বার দর্শন করে কৌতুহলান্বিত ও বিস্মিত হলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে দেবর্ষি নারদকে এরূপে ধর্ম, অর্থ ও কাম বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে পূজা করলেন এবং তিনি মনে মনে একান্ত প্রসন্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে করতে প্রস্থান করলেন।
বিশ্বব্রহ্মান্ডের মঙ্গল কামনায় প্রয়োজন অনুসারে যিনি নানা মূর্তি ধারণ করে আবির্ভূত হয়ে থাকেন, সেই ভগবান নারায়ণ মনুষ্যবিগ্রহ রূপে অবর্তীণ হযে, এই প্রকারে রূপলাবণ্যবতী ষোড়শ সহস্র পত্নীর সলজ্জ প্রেমপূর্ণ হাস্য ও অবলোকনে অনুরাগে নিরন্তর সেবিত হয়ে যযোপযুক্ত বিহার করছেন। বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের একমাত্র হেতু ভগবান শ্রীহরি যে সমস্ত অসাধারণ লীলা কর্ম করেছেন, মানব যদি কেবল সেই সকল লীলা শ্রবণ, কীর্তন এবং অনুমোদন মাত্র করেন, তা হলেই তার আর সৌভাগ্যের সীমা থাকে না। মোক্ষদাতা ভগবান শ্রীহরিতে তার ভক্তি জন্মে, সন্দেহ নেই।
Sign up here with your email
ConversionConversion EmoticonEmoticon