ব্রহ্মা কি তার মেয়ে সরস্বতীকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন?

ব্রহ্মার সৃষ্টিকার্যের সময় স্বীয় শরীর ভেদ করে যে নারী সৃষ্টি হয়েছিল যাকে আমরা শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী বা সরস্বতী নামে অভিহিত করি কিন্তু সে নারী সম্পর্কে মানুষের মনে যে প্রশ্নসমূহ আজও ঘুরপাক খাচ্ছে- তা হলো ব্রহ্মা কি সত্যিই সরস্বতীকে বিয়ে করেছিলেন? ইউটিউবে যে যার মত ভিডিও তৈরী করে আপলোড করছে। কোনটি সত্য কোনটি অসত্য তা নির্ধারণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন পুরাণে ব্রহ্মার সৃষ্টি বিষয়ে উল্লেখ আছে (মৎস্য পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং শ্রীমদ্ভাগবত)। আমি ঐ সকল পুরাণের প্রযোজ্য অংশটুকু পড়েছি। পুরাণ ও শ্রীমদ্ভাগবতে বিষয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মৎস্যপুরাণে আছে-
ব্রহ্মা তপস্যা বলে তার পবিত্র শরীর হতে যে অর্ধেক নারী সৃষ্টি করেছিলে তিনি ছিলেন অপরূপ সুন্দরী (A paragon of beauty)। সেই নারীই শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী নামে অভিহিত। আর অর্ধেক ছিল পুরুষ। ব্রহ্মা এ নারীকে তার আত্নজা বলেই কল্পনা করেছিলেন। এ নারী রূপে তিনি মুগ্ধ হয়ে শুধু বললেন “কি রূপ! কি অপূর্ব রূপ!” ব্রহ্মা তাকে দেখে কামাতুর হয়েছিলন। কিন্তু তার মানস পুত্রেরা তাকে ভগিনী বলে মম্বোধন করলেন। নারী রূপ বার বার দর্শনে তিনি পুত্রদের নিকট লজ্জিত হচ্ছিলেন। তাই সেই নারীকে দেখার জন্য ব্রহ্মার তার দক্ষিণদিকে এক মুখ সৃষ্টি করলেন, পশ্চিমদিকে এক মুখ সৃষ্টি করলেন, তারপর কামাতুরতায় তার আরও দুটি মুখ সৃষ্টি হলো। ঊর্ধ্বদিকে তার পঞ্চম মুখটি সৃষি হলো। তারপর ব্রহ্মা তার পুত্রদের প্রজা সৃষ্টি কার্যে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য বললেন এবং তারা সৃষ্টি কার্যে মনোনিবেশ করার জন্য প্রস্থান করলেন। ব্রহ্মা শতরূপার পাণি গ্রহণ করলেন। মহাভাগবত পুরাণে আছে-
সৃষ্টির পূর্বে জগৎ সংসার বলে কিছু ছিল না। কোন ব্রহ্মান্ড ছিল না। ছিল শুধু সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। যিনি অংশ রহিত, সেই সূক্ষ্ণা প্রকৃতিই একা ছিলেন। সেই প্রকৃতির যখন সৃষ্টির অভিলাষ হলো, তখন সেই আকারশূন্যা প্রকৃতি হঠাৎ করে একটি রূপ পরিগ্রহণ করল। সেই প্রকৃতি চতুর্বাহুযুক্ত, রক্তিমনয়না, আলুলায়িত কেশ, পরিপূর্ণ যৌবনা, সে সিংহপৃষ্ঠে উপবেশন ছিল। সেই পরমাসূক্ষ্ণা প্রকৃতি মূর্তি ধারণ করে সত্ত্ব, তম ও রজ: গুন দ্বারা এক পুরুষ সৃষ্টি করল। কিন্তু সে পুরুষের কোন চৈতণ্য ছিল না। তখন তিনি নিজ শক্তির সহিত সৃষ্টির ইচ্ছা সে পুরুষকে প্রদান করলেন। তখন সেই পুরুষের মধ্যে শক্তির সঞ্চার হলো। সেই আদি পুরুষ লব্ধশক্তির দ্বারা সত্ত্ব, তম ও রজ গুণ দ্বারা একাই তিন পুরুষ হলেন। বিষ্ণু হলেন সত্ত্বগুণে, ব্রহ্মা হলেন রজোগুণে এবং শিব হলেন তমোগুণে। কিন্তু তারা সৃষ্টি কার্য করতে পারলেন না দেখে সেই পরমা প্রকৃতি ত্রয়ীপুরুষকে জীবাত্মা এবং পরমাত্মমারূপে দুই প্রকার করলেন। সাথে সাথে পরমাপ্রকৃতি নিজেও মায়া, পরমা ও বিদ্যা এ তিন প্রকার হলেন। মায়াশক্তির কাজ জীবকে মোহিত করা অর্থাৎ জীবসকলকে সংসারে প্রেরণ করা, পরমাশক্তি হয়ে সেই সংসার নির্বাহ করা এবং বিদ্যাশক্তির দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান আহরণ করে সংসার সাগর হতে পরিত্রান পাওয়া।
তারপর পরমাপ্রকৃতি ত্রয়ীপুরুষগণকে বললেন “ আমি জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছায় তোমাদের তিন জনকে সৃষ্টি করেছি; তোমরা আমার ইচ্ছানুসারে তোমাদের কার্য সম্পাদন কর।” তিনি ব্রহ্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “হে বৎস ব্রহ্মন! তুমি সংযত হয়ে বিশ্ব চরাচর সৃষ্টি কর, পুত্র বিষ্ণু! তোমার বাহুবীর্য আছে, তুমি এ বিশ্ব সংসার পালন কর, মহাদেব! তুমি তমোগুণে সৃষ্টি, তাই পরিশেষে তুমি এ বিশ্ব সংসার ধ্বংস করবে। আমার সৃষ্টি কার্যে তোমরা সাহায্য কর। পরে সাবিত্রী হয়ে আমি তোমাদের বনিতাভাবে বিহার করব। এ কথা বলে পরমাপ্রকৃতি অন্তর্নিহিত হলেন। ত্রয়ীপুরুষ তপস্যায় রত হলেন। তারা বহু বৎসর তপস্যা করলেন। পরমাপ্রকৃতি ত্রয়ীপুরুষদের পরীক্ষা করার জন্য নিজে এক ভয়ানক বিরাট মূর্তি তৈরী করলেন। প্রথমে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা ভয়ানক মূর্তি দেখে ভীত হয়ে বিমুখ হলে পরমাপ্রকৃতির ইচ্ছায় এক মুখ সৃষ্টি হলো, ভয়ে আবার বিমুখ হলে ব্রহ্মার আরেক মুখ সৃষ্টি হলো। ব্রহ্মার চারটি মুখ সৃষ্টি হলো। এভাবে ব্রহ্মা চতু্র্মুখী হলেন।
এভাবে বিষ্ণুকেও পরীক্ষা করলেন। তিনিও বিরাট মূর্তি দেখে ভীত হলেন। তারপর মহেশ্বরের নিকট গমন করলেন। ভয়ানক মূর্তি দেখে মহেশ্বরের ভয় হলো না। তিনি ধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞাত হলেন তিনিই তাদের সৃষ্টিকারী পরমাপ্রকৃতি, যিনি পরীক্ষা করতে এসেছেন। মহেশ্বর আরও গভীরভাবে ধ্যান মগ্ন হলেন।
পরমা প্রকৃতি মহাদেবের তপস্যায় সন্তষ্ট হয়ে সংকল্প করলেন যে, দূর্গা ও গঙ্গা এ দুই রূপ ধারণ করে পূর্ণারূপেই মহাদেবের পত্নী হবেন; আর তার অংশ দ্বারা সাবিত্রী হয়ে ব্রহ্মার এবং লক্ষ্ণী ও সরস্বতী হয়ে বিষ্ণুর পত্নী হবেন। তারপর পরমা প্রকৃতি অন্তর্ধান হলেন। তারপর ব্রহ্মা পরমাপ্রকৃতির নির্দেশানুসারে সৃষ্টি কাজে ব্রত হলেন। প্রথমে ব্রহ্মা তার শরীর থেকে দশজন মানস পুত্র সৃষ্টি করলেন। তারপর ব্রহ্মা তার বামাংশ হতে এক অপরূপ নারী সৃষ্টি করলেন, সেই নারীই শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী বা সরস্বতী নামে অভিহিত। দক্ষিণাংশ হতে এক পুরুষ সৃষ্টি করলেন যিনি স্বায়ম্ভুব মনু নামে খ্যাত। তিনি শতরূপাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। এরাই হলেন আমাদের আদি পিতামাতা এবং তাদের থেকেই প্রজাসৃষ্টির কার্য শুরু হয়।শ্রীমদ্ভাগবত আছে (উপেন্দ্র চন্দ্র মিত্র)-
প্রথমে ব্রহ্মা তার শরীর থেকে দশজন মানস পুত্র সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মা কামনা মনে বিশ্ব রচনাকালে কামনারত অবস্থায় সরস্বতী নামে এক অপরূপ নারীর সৃষ্টি করেন। সে নারীর রূপ দেখে ব্রহ্মা বিমোহিত হন। তার মধ্যে কামনা ভাব উদয় হয়। তাতে ব্রহ্মা অস্থির হয়ে পড়েন। তাকে হরণ করার জন্য মন স্থির করেন। তার আকাঙ্খা ছিল অধম্য। ভূবন ভীত হলো-----------। দৈববলে ব্রহ্মার দেহ দুভাগ হলো। প্রথমে দক্ষিণ অংশে মনু নামে এক পুরুষের সৃষ্টি হয়, যিনি জগতে স্বয়ম্ভুব মনু নামে খ্যাত। পরে দ্বিতীয় অংশে এক নারীর সৃষ্টি হয়, সেই নারীর নামই শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী বা সরস্বতী। পরে শতরূপা ও মনু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তারাই প্রজাসকল সৃষ্টি কাজ আরম্ভ করেন।শ্রীমদ্ভাগবত আছে (শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন)-
মহাভাগবত পুরাণে সৃষ্টি তত্ত্ব যেভাবে বলা আছে, বিষ্ণুপুরাণে ও শ্রীমদ্ভাগবতেও সেরুপভাবেই বর্ণনা আছে। সেহেতু বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়নি।শ্রীমদ্ভাগবত আছে (শ্রীগুনদাচরন সেন)-
ব্রহ্মা প্রথমে তার মন থেকে সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামে চারজন মুনি সৃষ্টি করে বললেন “ হে বৎসগণ! তোমরা প্রজাসৃষ্টি কার্যে প্রবৃত্ত হও।” কিন্তু তারা নিজেদেরকে প্রজাসৃষ্টির কাজে নিয়োজিত না করে পরমাত্মায় সন্ধানে রত হলেন। তখন অগ্রজ নীললোহিত নামে এক কুমারের সৃষ্টি হলো কিন্তু সেও প্রজাসৃষ্টি না করে তপস্যার জন্য বনে গমন করেন। তারপর ব্রহ্মা তার শরীর হতে দশজন মানস পুত্র সৃষ্টি করেন। কিন্তু ব্রহ্মার দশজন পুত্রও আশানুরূপ প্রজা সৃষ্টি করতে পারল না। অবশেষে ব্রহ্মা দৈববলে তার দেহ এক নতুন মূর্তিতে পরিণত করলেন। দেখতে দেখতে সে মূর্তি দুভাগে বিভক্ত হয়ে একভাগ নারী ও অন্যভাগ পুরুষ অংশ বিভক্ত হলো। নারীর নাম শতরূপা ও পুরুষের নাম মনু। তারা দুজনে ব্রহ্মাকে প্রণমা করে বললেন “হে পিতা! কোন কার্যের জন্য আমরা আপনার সেবা করব? ব্রহ্মা বললেন “তোমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রজাসকল সৃষ্টি কর। তাতে আমার ও শ্রীভগবানের তুষ্টি বিধান হবে।”শ্রীমদ্ভাগবত আছে (শ্রী তারাকান্ত ভট্টাচার্য)-
ভগবান ব্রহ্মা সৃষ্টি কার্যে ব্যাপৃত থাকলেও প্রজাসৃষ্টি বর্দ্ধিত হচ্ছে না। ব্রহ্মা দৈবের প্রতি দৃষ্টি রেখেসৃষ্টির জন্য মনোনিবেশ করলেন। ব্রহ্মা তার দেহ দ্বিধা বিভক্ত করলেন। এক অংশে পুরুষ ও অন্য অংশে নারী সৃষ্টি হলো। পুরুষ স্বয়ং স্বয়ম্ভুব মনু এবং নারী শতরূপা। মনু শতরূপকে ভার্যা হিসেবে গ্রহণ করে তারা প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন।
ব্রহ্মা ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন, প্রজা সৃষ্টি করেছেন এবং সাথে সাথে তিনিপ্রকৃতিকেও সৃষ্টি করেছেন। অপরূপ সৌন্দর্য এ প্রকৃতি। যা দেখে ব্রহ্মা অভিভূত হয়েছেন। আর বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকেছেন। এই প্রকৃতিই হল শতরূপা বা সরস্বতী। যিনি ইচ্ছেমত শত সহস্র রূপ ধারণ করতে পারে। ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহংকার- এ নিয়ে আমাদের এ জড় জগৎ। যাকে আমরা অপরাপ্রকৃতি বলে থাকি। এই প্রকৃতি হলো শুদ্ধ জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। আর ভগবান ব্রহ্মা এই প্রকৃতির মায়াময় রূপ দেখে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন। অর্থাৎ সরস্বতী অর্থাৎ শতরূপা কে নিয়ন্ত্রণ করে তার অধীনে আনতে চেয়ে ছিলেন। সৃষ্টি কার্যে বিমোহিত হয়ে ব্রহ্মার মনে অহংকারের জন্ম হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন আমি সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতি আমার অধীনে থাকবে। তিনি প্রকৃতি সৃষ্টি করলেও প্রকৃতির স্বাধীন সত্ত্বা রয়েছে। প্রকৃতি সৃষ্টি করে ভগবান ব্রহ্মা অস্থির হয়ে পড়েন। কারণ প্রকৃতি কারো বশ্যতা স্বীকার করে না। নিজের ইচ্ছায় রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। তাই তিনি স্বনিয়ন্ত্রিত। তিনি স্বাধীন। তিনি ব্রহ্মার নিয়ন্ত্রণে থাকতে চান না। প্রকৃতিকে সার্বক্ষনিক নজরধারী করার জন্য ব্রহ্মা পাঁচটি মাথা সৃষ্টি হয়। ভগবান শিব ব্রহ্মার মানসিক অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই তার পঞ্চম মাথাটি কর্তিত করে তাকে উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করান যে প্রকৃতি কারো নিয়ন্ত্রণে থাকার নয়।
ব্রহ্মা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করে নিজের অধীনে আনার চেষ্ট করেছিলেন। দেবাদিদেব মহাদেব পরম বৈষ্ণব। তিনি প্রকৃতির অধীন নন। সর্বক্ষণ ধ্যান মগ্ন থাকেন। তিনিও পূজার যোগ্য। আর বিষ্ণু প্রকৃতিকে যথাযথ সম্মান করে আমারদেরকে পরম মমতায় লালন পালন করছেন তাই তিনি পূজার যোগ্য। কিন্তু ব্রহ্মা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করতে চেয়ে ছিলেন বলেই আমাদের পূজা পাওয়ার যোগ্যতা হারিছেন।
তাই আমরা বলতে পারি ব্রহ্মা কখনও তার সৃষ্টিকে (সরস্বতীকে) বিয়ে করতে চাননি শুধু নিয়ন্ত্রন করতে চেয়েছিলেন। এটিকে আমরা বিয়ে বল চালিয়ে দিয়ে সনাতন ধর্মকে কলুষিত করছি। এ বিষয়ে তার থেকেও অধিক যদি কেহ জানেন তবে সনাতন ধর্মের মানুষকে সত্যটি জানান। সনাতন যাবতীয় ধর্মের গ্রন্থ মনোযোগসহকারে পড়ুন এবং বেশী বেশী করে ফেইসবুক বা ইউটিউবে আপলোড করুন। কারণ ইতোমধ্যেই সনাতন ধর্ম সম্পর্কে নাস্তিকদের নেতিবাচক প্রভাব শুরু হয়ে গিয়েছে। হরে কৃষ্ণ।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র