সতীদাহ প্রথা

সতীদাহ প্রথা কোন ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে কি?

সৃষ্টির পর থেকেই বিশ্বব্রহ্মান্ডে প্রতিনিয়তই পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে । কিছু পরিবর্তন আমাদের অঘোচরে হচ্ছে কিছু পরিবর্তন আমাদের ঘোচরে হচ্ছে। আজ যে ধর্ম সংসারে শ্রেষ্ঠ বলে জায়গা করে নিয়েছে, কাল আবার আর কোনও মহাপুরুষের আবির্ভাবে নবধর্মের প্রতিভাত হচ্ছে। আজ যে সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, সমাজে পালনীয় কাল তা আবার সামাজিক কারণেই পরিবর্তিত হচ্ছে। তেমনি দেশ ভেদেও এ পরিবর্তন অহরহ ঘটছে। সরীসৃপ জাতীয় জীবকূল রুচিকর খাদ্য হিসেবে যে দেশে পরিগণিত, তা আবার অন্য দেশে অখাদ্যকর। যে দেশে মদ সামাজিকভাবে স্বীকৃত তা আবার অন্য দেশে নিষিদ্ধ। 

অবিরামভাবে পরিবর্তনশীলতার স্রোতে দেশের তথা ভিন দেশেও তথাকথিত ভাল-মন্দ পরিবর্তিত হচ্ছে। তার কোন পরিমান আমাদের জানা নেই। কিন্তু হচ্ছে। কত আইন-কানুন সৃষ্টি হচ্ছে। আর তা সবই হচ্ছে মানুষের জন্য। আবার সামাজিক প্রয়োজনে তা বিলুপ্ত করে নতুন করে হচ্ছে। আবার শত শত, হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন প্রথা সমাজে যখন মানুষের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনছিল তখন তা নতুন করে সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তেমনই একটি প্রথা হাজার হাজার বছর পূর্বে সনাতন সমাজে প্রচলিত ছিল। দীর্ঘ দিন ধরে এ প্রথা সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে এ প্রথা চলছিল। সে প্রথাটি হচ্ছে সতীদাহ প্রথা বা সহমরণ প্রথা যা তখনকার সময়ে অন্যতম ছিল। 

বেদে কি সতীদাহ প্রথার উল্লেখ আছে?
এ প্রশ্ন আমাদের অনেকের মধ্যে ঘুরপাক খায়। কিন্তু এর সঠিক উত্তরটি আমাদের অনেকেরই জানা নেই। তবে পশ্চিমা গবেষকদের মধ্যে এ বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও ভারতীয় বেদ ভাষ্যকারদের মতে বেদে সতীদাহের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ বৈদিক যোগে সতীদাহ (একে অনেকে সতী, সতীদাহ, সহমরণ, অনুমরণ, সহগমণ ও অনুগম নামে অভিহিত করেন।) বৈদিক যোগে সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল কি-না এ বিষয়ে মতভেদ থাকলেও  পৌরাণিক যোগে যে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল তার ভুরি ভুরি উদাহরণ পুরাণ ও উপপুরাণে আছে। মনুস্মৃতি ব্যতীত প্রায় সকল স্মৃতিশাস্ত্রেই সহমরণের উল্লেখ আছে। সংহিতাতেও সহমরণের উল্লেখ আছে। তবে বেদে সতীদাহের পরিবর্তে স্ত্রীকে পুন: বিবাহ করার বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। বেদের এ শ্লোকটিতে কি বলা হয়েছে-

ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নী রাঞ্জনেন সর্পিষা সম্পৃশন্তাম্।
অনশ্রয়ো অনমীবাঃ সুশেবা আরোহন্তু জনয়ো যোনিমগ্রে।। ঋকবেদ ১০।১৮।৭।
অর্থঃ এই সকল নারী বৈধব্য দু:খ অনুভব না করে, মনোমত পতি লাভ করে অঞ্জন ও ঘৃতের সহিত গৃহে প্রবেশ করুন। এ সকল বধু অশ্রুপাত না করে, রোগের কাতর না হয়ে উত্তম উত্তম রত্ন ধারণ করে সর্বাগ্রে গৃহে আগমন করুন।
উদীষ্ব নায্যভি জীবলোকমিগতাসুমেতমুপ শেষ এহি।
হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূব।। (অথর্ব বেদ ১৮।৩।২)/ঋগবেদ ১০।১৮।৮।)
অর্থঃ হে নারী! সংসারের দিকে ফিরে চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যার নিকট শয়ন করতে যাচ্ছ, সে গতাসু অর্থাৎ মৃত হয়েছে। চলে এস। যিনি তোমার পাণিগ্রহণ করে গর্ভাধান করেছিলেন, সেই পতির পত্নী হয়ে যাহা কিছু কর্তব্য ছিল, সকলই তোমার করা হয়েছে।
ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।। (অথর্ব বেদ ১৮।৩।১)
ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্ব্য মর্ন্ত্য প্রেতম্।
অর্থঃ হে মনুষ্যা! এই স্ত্রী পুনর্বিবাহের আকাঙ্খা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিয়াছে। সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।

রামায়ণে ও মহাভারতে সহমরণ নিয়ে বহু ঘটনার উল্লেখ থাকলেও রামায়ণে সহমরণের বেশীর ভাগ ঘটনা সম্পন্ন হয়নি পক্ষান্তরে মহাভারতে সহমরণের আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সহমরণের বিষয়ে কয়েকটি স্মৃতিশাস্ত্রের অবতারণা করা হলোঃ

“স্বামীর মরণান্তে যে নারী ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করেন, তিনি মৃত্যুর পর ব্রহ্মচারীর ন্যায় স্বর্গ লাভ করেন। সেই নারী, মানবদেহে যে সার্দ্ধ ত্রিকোটি সংখ্যক রোম আছে, তাবৎ পরিমিত কাল স্বর্গ ভোগ করিতে থাকেন। ব্যালগ্রাহী যেমন গর্ত হইতে সর্পকে বলপূর্বক টানিয়া আনে তেমনি সহমৃতা নারী মৃত পতিকে নরক হইতে উদ্ধার করিয়া তাহার সহিত স্বর্গ সুখ ভোগ করেন।”-পরাশর সংহিত ৪ অঃ ২৭-২৯ শ্লোক।

“পতির মৃত্যু হইলে ব্রহ্মচর্য্য কিংবা ভর্ত্তার সহগমন বা অনুগমন স্ত্রীলোকের ধর্ম”- বিষ্ণু সংহিতা।

“পতিব্রতা স্ত্রী মৃত পতির সহিত অগ্নি প্রবেশ করিবে অথবা আজীবন ব্রহ্মচর্য্য করিব।”- ব্যাসসংহিতা

“স্বামীর মৃত্যু হইলে যে স্ত্রী স্বামীর চিতারোহণ করে, সে স্ত্রী সদাচার সম্পন্না হইবে এবং স্বর্গে দেবগণ কর্তৃক পূজিত হইবে। সাপুড়িয়া যেরূপ গর্ত হইতে বলদ্বারা সর্পেকে উদ্ধার করে, সেইরূপ সহমৃতা পত্নী স্বামী যদি নরকেও থাকেন, তাঁহাকে নিজ পূণ্যবলে উদ্ধার করিয়া তাঁহার সহিত স্বর্গলোক সহর্ষে কালযাপন করেন।।”-দক্ষ সংহিতা, ৪র্থ অঃ ১৯-২০ শ্লোক।

সতীদাহ প্রথা বিলোপের প্রাথমিক সূচনাঃ
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রয়াণের পর বঙ্গদেশে সতীদাহ প্রথা প্রকটরূপ ধারণ করে। অবশ্য মহাপ্রভুর পূর্বে ও তার সময়েও সতীদাহ প্রথা ছিল। ইংরেজ শাসন সূত্রপাত হওয়ার সাথে সাথে তারা সতীদাহ প্রথাকে কুনজরে দেখতে শুরু করে কিন্তু কোন প্রশাসনি কার্যক্রম নিতে সমর্থ হচ্ছিলেন না কারণ হিন্দুদের ধর্মের প্রতি হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছিলেন না। ১৭৯০ খ্রীস্টাব্দে গভর্ণর মার্কুইস কর্ণওয়ালিশ সর্বপ্রথম সতীদাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং তার রাজকর্মচারিদের নির্দেশ দেন যেখানে যেখানে সতীদাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে সেখানে তারা তাদের অমত প্রকাশ করবেন কিন্তু কোন বিরুদ্ধোচারন করবেন না। মূলত: এটিই ইংরেজ সরকারের প্রথম প্রশাসনিক আদেশ।
তারপর ১৮৯১ খ্রীস্টাব্দে মার্কুইস ওয়েলেস্লী ভারতে গভর্ণর হয়ে আসেন। তিনিও সতীদাহ প্রথাকে সরাসরি হত্যা বলে অভিহিত করে নিজামত আদালতের বিচারপতিদের মতামত অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। ফলে সতীদাহ আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ১৮১৩ খ্রীস্টাব্দে লর্ড মিন্টো ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে এক ফরমান জারী করেন। এ ফরমানে বলা হয়- রমণী স্বেচ্ছায় চিতায় আরোহন করছেন কি-না, কোন মাদকদব্য ব্যবহারে তাকে সম্মত করানো হয়েছে কি-না, রমণীর বয়ষ ১৬ বছর কি-না, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার অভিপ্রায় বুঝে ঐ সংকল্প হতে তাকে বিচ্যুত করতে সুযোগ প্রদান করবেন। সতীদাহ বিলোপে এটি হচ্ছে দ্বিতীয় উদ্যোগ।
মার্কুইস হেসটিংস সহমরণকে সধারণ নর হত্যা পর্যায়ভুক্ত করে শাস্তির বিধানের নির্দেশ দেন এবং পুলিশ ও ম্যাজিস্টেটগণকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেন। সতীদাহ প্রথা বন্ধে এটি হচ্ছে ইংরেজ সরকারের তৃতীয় পদক্ষেপ। সম্পূর্ণ বন্ধ না হলেও সামান্য পরিমানে হ্রাস পেয়েছিল। তারপর লর্ড আমহার্ষ্ট ভারতের গভর্ণর হয়ে আসেন। পূর্বসূরীদের পদক্ষেপ বিবেচনা করে তিনি এক আদেশ জারী করেন যে,সহমরণেচ্ছু বিধবার সন্তানাদি সাবালক না হওয়া পর্যন্ত ভরণ-পোষণের ভার নিতে স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত বিধবার সহমরণ নিষেধ করে দেন। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে রহিত করতে পারেননি।
১৮২৮ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতে গভর্ণর হয়ে আসেন। তিনি তার পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া নথিপত্র পর্যালোচনা করে বুঝতে পারেন যে সিপাহী বিদ্রোহের আশঙ্কায় তারা তা আইন দ্বারা রহিত করতে সাহস পাননি। তথন তিনি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার প্রধান প্রধান ৪৯ জন সৈনিকের মতামত নেন। এতে তিনি আশ্বস্থ হন যে, সতীদাহ প্রথা রহিত করলে সিপাহী বিদ্রোহের কোন আশংকা নেই। তিনি মনে আশা বাাঁধেন। এ সময়ে নিজাম আদালতের ৫ জন বিচারপতি সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। এ নির্দেশনা লর্ড বেন্টিঙ্ককে সহীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য অনেক সাহায্য করে। এ সময়ে রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ শিক্ষিত বাঙ্গালীগণ সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেন। রাজা রামমোহন রায় মানুষকে বুঝাচ্ছেন যে, ধর্মশাস্ত্রে সকল কাম্য কর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাম্য কর্ম নিন্দনীয়। সহমরণও কার্ম-কর্ম। ধর্ম শাস্ত্র বিরুদ্ধ। অবশ্য তখন কিছু রক্ষণশীল হিন্দু রাজা রামমোহন রায়ের রিরোধীতা শুরু করেন কিন্তু তখন জল অনেক দূর গড়িয়েছে। লর্ড বেন্টিঙ্ক মনে সাহস পেয়েছেন। অত:পর ১৮২৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর তারিখে কলিকাতা গেজেটে সতীদাহ প্রথা রহিত বিষয়ক এক আইন প্রকাশিত হয়। যার ফলে সহমরণ নিষিদ্ধ ও বেআইনী বলে গণ্য হয়। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা একটি সামাজিক রীতির কারণে কত বোনকে, কত মাকে, কত প্রৌঢ়াকে, কত বৃদ্ধাকে অগুনে ঝাপিয়ে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় ধর্মের জন্য মানুষ নয় মানুষের জন্য ধর্ম। সেই ধর্ম যখন মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ ঢেকে আনে তখনই সংস্কারের প্রয়োজন হয়। সতীদাহ প্রথা আইন দ্বারা রহিত হয়েছে। আমাদের সনাতন ধর্মে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার পরিপন্থী কিছু ধর্মীয় অনুশাসন প্রচলিত আছে। সেগুলিও সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তেমন সমাজ সংস্কার কোথায়?

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র