বহু বছর পূর্বে শুনকের পুত্র শৌনক ব্রহ্মবিদ্যা জানার জন্য শাস্ত্রবিধি অনুসারে হাতে সমিধ (যজ্ঞের কাঠ) নিয়ে শ্রদ্ধাপূর্বক মহর্ষি অঙ্গিরার কাছে এসে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন-
শৌনকো হ বৈ মহাশালোহঙ্গিরসং বিধিবদুপসন্নঃ
পপ্রচ্ছ কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীতি। মুন্ডকোপনিষৎ ১।১।৩।
অর্থঃ গৃহস্থ শ্রেষ্ঠ শৌনক যথাশাস্ত্র মহর্ষি অঙ্গিরার কাছ গিয়ে বললেন হে ভগবান! কোন্ বস্তুটি বা এমন কোন উপাদান বা
পপ্রচ্ছ কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীতি। মুন্ডকোপনিষৎ ১।১।৩।
অর্থঃ গৃহস্থ শ্রেষ্ঠ শৌনক যথাশাস্ত্র মহর্ষি অঙ্গিরার কাছ গিয়ে বললেন হে ভগবান! কোন্ বস্তুটি বা এমন কোন উপাদান বা
বিদ্যা আছে যা সম্পর্কে অবহিত হলে এই সমস্তই কিছু জানা যায়? সে পরমতত্ত্ব কি? করুনা করে আমাকে সে শিক্ষা দিন। তখন গুরুদেব অঙ্গিরা বললেন-
দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে ইতি হ স্ম
যদ ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ। মুন্ডকোপনিষৎ ১।১।৪।
অর্থঃ “দুটি বিদ্যা জানবার আছে” এ কথাটিই বেদার্থভিজ্ঞেরা বলে থাকেন। উক্ত বিদ্যাদ্বয় পরা বিদ্যা ও অপরা বিদ্যা নামে প্রসিদ্ধ।
মুন্ডকোপনিষৎ বলছে-
তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহর্থববেদঃ
শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিত।
অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।।।১।১।৫।।
অর্থঃতন্মধ্যে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ এ গুলি হচ্ছে অপরা বিদ্যা। যে বিদ্যা দ্বারা সেই অক্ষর অর্থাৎ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত বা জ্ঞাত হওয়া যায় সেটি হচ্ছে পরা বিদ্যা। মুন্ডকোপনিষৎ বলছে-
যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্যমগোত্রমবর্ণম্
অচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপাদম্।
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং
তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ।।৬।।
অর্থঃ সে অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, নিষ্কারণ, অরূপ ও চক্ষকর্ণাদি শূন্যকে, সেই হস্তপাদহীন, অবিনাশী, বিবিধাকার, সর্বব্যাপী, ও সুসূক্ষ্মকে, সেই অব্যয়কে অর্থাৎ ভূতবর্গের কারণ ব্রহ্মকে (যে বিদ্যা সহায়ে) বিবেকীরা সর্বতোভাবে দর্শন করে (তাই পরাবিদ্যা)।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন-
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ |
অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||
অর্থঃ ভূমি, জল ,বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার- এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত। এটাকেই নিকৃষ্টা প্রকৃতি বা অপরা প্রকৃতি বা জড়া প্রকৃতি বা অপরা শক্তি বা অপরা বিদ্যা বলো হয়। অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ |
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ || ৫ ||
অর্থঃহে মাহবাহো! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃত রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরুপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নি:সৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে। ভগবানের এ শক্তি উৎকৃষ্টা বলে একে উৎকৃষ্টা শক্তি বা পরা প্রকৃতি বা পরা শক্তি বা পরা বিদ্যাও বলা হয়।
চেতন জীবাত্মক ক্ষেত্রজ্ঞ পরা প্রকৃতিই শ্রেষ্ঠ ও শুদ্ধ। চেতন বা পরা প্রকৃতিই অচেতন বা অপরা প্রকৃতিকে ধারণ করে আছে। পরা প্রকৃতি বা চেতন প্রকৃতিকে জানতে পারলে জীব বন্ধন দশা হতে মুক্ত হয়। পরা ও অপরা প্রকৃতি উভয়ই হতে জড় ও চেতন সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহংকার এ আটটি হচ্ছে অপরা প্রকৃতি বা মায়ারূপ প্রকৃতি। অপরা প্রকৃতি জড়ত্ব, পরাধীনত্ব, সংসার বন্ধনকারিত্ব দোষ জন্য নিকৃষ্ট ও ক্ষেত্রস্বরূপ। এ সম্পর্কে চিন্তা করলে জীব মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আমাদের চারপাশে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য যা কিছু আছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার যে ক্ষমতা অর্জন করা হলো অপরাবিদ্যা।
এ নয়টি প্রকৃতিই হচ্ছে সমগ্র জগতের সৃষ্টির মূল উপাদান। ভূমি, জল ,বায়ু, অগ্নি, আকাশ এ পাঁচটি হচ্ছে পঞ্চমহাভূত। যার পরিমাণ আমাদের এ “স্থূলদেহ”। তাছাড়া আমাদের আর একটি দেহ রয়েছে যেটি পঞ্চপ্রাণ, দশ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি দ্বারা গঠিত। একে “সূক্ষ্মশরীর” বলা হয়। আর অহংকারের প্রসূতি অবিদ্যাকেই আর্যঋষিরা এই বিশ্ব প্রপঞ্চের “কারণশরীর” বলে অভিহিত করেন। ইহাই মূলত: সৃষ্টিতত্ত্ব।
মন্ডুকোপনিষৎ বলে-
যথোর্ণনাভিঃ সজতে গৃহ্ণতে চ
যথা পৃথিব্যামোষধয়ঃ সম্ভবন্তি।
যথা সতঃ পুরুষাং কেশলোমানি
তথাহক্ষরাৎ সম্ভবতীহ বিশ্বম্।।১।১।৭।।
অর্থঃ মাকড়সা যেরূপ সূতা উপৎপাদন করে ও আত্মসাৎ করে, পৃথিবীতে যদ্রুপ(তদনিতিরিক্ত) ঔষধিসমূহ জাত হয়, সজীব পুরূষ শরীর হতে যদ্রূপ(বিজাতীয়) কেশ ও লোমসমূহ নির্গত হয়, তদ্রূপ অক্ষর হতে এ সংসারমন্ডলে নিখিল বস্তু উৎপন্ন হয়।
পণ্ডিতেরা বললেন, সমজাতীয় কারণ হতে সমজাতীয় ফলের উৎপত্তি সম্ভব। যেমন- জড় মাটি হতে জড় নানান বস্তু উৎপন্ন হয়। কিন্তু ব্ৰহ্ম চৈতন্যময় আর পৃথিবী জড় জগৎ। চেতন হতে তাহলে কিভাবে জড় হলো?
মুণ্ডক উপনিষদ-
যেমন মানুষের দেহে কেশ-লোমাদি হয়, ঠিক তেমনি অক্ষর হতেও বিশ্ববস্তু ‘এ’ সংসারমন্ডলে নিখিল বস্তু উৎপন্ন হয় বা জন্মগ্রহণ করে। ‘এ’ বলতে নিজের আত্মায়, চৈতন্যে। ইহাই ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ চেতন হতে অচেতনের উৎপত্তি।
উপাদান-কারণ ছাড়া ব্রহ্ম কিভাবে সৃষ্টি কার্য সম্পন্ন করলেন? মুণ্ডক উপনিষদ বলছে-
মাকড়সা যেমন নিজদেহ হতে নিসৃত লালা দিয়ে জাল তৈরি করে, কোনও উপাদানের প্রয়োজন হয় না। ওই সুতা মাকড়সা আবার নিজ দেহের ভিতর ধারণ করতে পারে। শাস্ত্র বলে, একই বস্তু উপাদান-কারণ ও নিমিত্ত-কারণ হতে পারে না। ঘটের উপাদান-কারণ মাটি ও নিমিত্ত-কারণ কুম্ভকার। ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে কীভাবে সৃষ্টি করলেন? মুণ্ডক-উপনিষদ দৃষ্টান্ত দিয়ে উত্তর দিচ্ছেন, যেমন একমাত্র পৃথিবীই ওষধি (যে গাছ এক বার ফল দিয়ে মরে যায়) গাছেদের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ - ব্রহ্মও ঠিক তেমন।
মানুষ জন্মের পর হতেই বিবিধ ক্রীয়া অবিচ্ছিন্নভাবে দর্শন করে আসছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ অহরহ ঘটে যাচ্ছে। বিশ্বব্রহ্মান্ড যথা এ সৌরজগৎ অবিরত কর্ম করে যাচ্ছে। সবই গতিশীল। কোন কিছুই থেমে নেয়। অবিরত বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে সমুদ্রে জলরাশি প্রবাহিত হচ্ছে, প্রকৃতি অবিরত কর্মচঞ্চল। প্রশ্ন হচ্ছে কে এ কর্মপ্রবাহ গুলিকে অতি সূক্ষ্ণভাবে অতি সুচারুভাবে পরিচালিত করছে? আমরা যদি অতি সহজভাবে এ চিন্তা করি যে এ ক্রীয়াগুলির পিছনে যে বা যারা জড়িত মূলত: তাদেরকেই আমরা শক্তি বলি থাকি। যেমন-তাপ,আলোক এর সঞ্চারন বিদ্যুৎশক্তি, বায়ুর সঞ্চরণ গতিশক্তি, মেধা-বুদ্ধি-ধৃতি’র সঞ্চারন স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞানশক্তি ইত্যাদি। এ মহাবিশ্বের সকল বস্তুরই অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। সে শক্তির প্রভাবেই বিশ্ব চরাচর অত্যন্ত সংযতভাবে ও সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কার ইচ্ছায় বিশ্বব্রহ্মান্ড পরিচালিত হচ্ছে?
শৌনকের মনে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে মহাবিশ্বের সমগ্র কিছু একসাথে জানার যে বিদ্যা বা জ্ঞান সেটিই তাকে জানতে হবে। তাকে জানা হলে মূল তত্ত্বকেই জানা যাবে। সোনাকে জানলে যেমন সোনার তৈরী সকল জিনিস সম্পর্কে জানা যায়, মাটির ডেলাকে জানলে যেমন মাটির তৈরী সকল বস্তুকে জানা যায়। পৃথক পৃথকভাবে সকল বস্তুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোন প্রয়োজন নেই। আকারের ভিন্নতা থাকলেও উপাদন কিন্তু এক। তাই উপাদনকে জানতে পারলে সকল বস্তুকে জানা যায়। কারণ মূল হচ্ছে সোনা ও মাটি। সোনা ও মাটি ছাড়া ঐ সকল বস্তুর কোন পৃথক সত্তাও নেই নামও নেই। সুতরাং সোনা বা মাটিই হচ্ছে মূল। সোনা বা মাটিই সত্য। আর অন্য সব মিথ্যা।
রজ্জুতে সাপ, রজ্জু-সত্তা ছাড়া সাপের পৃথক সত্তা নেই। তাই রজ্জুকে জানলেই সে রজ্জুতে যা কিছু আছে তা জানা সহজ হয়ে যায়। রজ্জুকে কেহ সাপ, কেহ লাঠি বলে দেখে। বিভিন্নভাবে দর্শিত হলেও রজ্জু ছাড়া তাদের পৃথক কোন সত্তা নেই।
যখনই উপাদানকে জানা যায় তখনই তার কাজগুলি সব জানা হয়ে যায়। একমাত্র কারণই আছে, কাজগুলি সবই তাতে আরোপিত। এগুলির পৃথক সত্তা থাকলে, তাদের কারণ থেকে আলাদা করে দেখলে তবেই তাদের অস্তিত্ব থাকত। মাটির খেলনা থেকে মাটি সরিয়ে নিলে খেলনা যেমন খেলনা থাকে না তেমনি অলঙ্কার থেকে সোনাকে বাদ দিলে কিছুই থাকে না। কোনো একটি বস্তুর উপাদান থেকে তার পৃথক সত্তা যখন কল্পনা করা যায় না, তখন তাকে বলি মিথ্যা। সুতরাং এ জগতে যা কিছু বিকার বস্তু দেখছি, তার সবই মিথ্যা; একমাত্র যা উপাদান অর্থাৎ আদি কারণ, তা-ই সত্য। সেই কারণটি হলো “ব্রহ্ম”। অতএব ব্রহ্মকে যখন জানা হলো, তখন সবই জানা হয়ে গেল।
জড় জাগতিক জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাথে যুক্ত করতে পারলে তবেই পরম জ্ঞান লাভ হয়। জড় জাগতিক জ্ঞান আমাদের সাময়িক শান্তি বা আনন্দ দেয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞান অন্তর্জগত ও বহির্জগত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।
শ্রুতি বা উপনিষদ ব্রহ্মকে জগতের যোনি, ভূতগণের যোনি, পঞ্চভূতের কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। তাতে ব্রহ্মই যে বিশ্বের উপাদান কারণ, তা জানা যায়। নিমিত্ত-কারণও ব্রহ্মই। মুণ্ডক উপনিষদ পরা-বিদ্যার সাহায্যে যে অক্ষর-পুরুষকে জানতে হবে, তার স্বরূপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, এই বিশ্ব-সংসার অক্ষর-পুরুষ হতেই উৎপন্ন হয়েছে।
শৌনক মুনির জিজ্ঞাসু বিষয় ছিল “কাকে জানলে সবকিছু জানা হয়ে যায়?" সংক্ষেপে বলা যায় নিজের আত্মা ও দেহের সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সবকিছুই জানা হয়। তার অর্থ ব্রহ্মকে জানা যায়।
ব্রহ্মজ্ঞরা বলেন, পরা ও অপরা এই দুটি বিদ্যাই জানা দরকার। পরমেশ্বরকে জানার বিদ্যা হচ্ছে পরা-বিদ্যা আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়কে জানার বিদ্যা অপরা-বিদ্যা। অপরা-বিদ্যা করায়াত্ত করা মানে সব কিছু আয়ত্ত করা নয়।
শাস্ত্র বলছেন, অপরা-বিদ্যা তথা বেদ-উপনিষদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করাই যথেষ্ট নয় যদি না পরা-বিদ্যা তথা আত্মজ্ঞান লাভ করা না যায়। আমাদের চারপাশে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য যা কিছু আছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার যে ক্ষমতা অর্জন করা হলো অপরাবিদ্যা অর্থাৎ একজন ব্যক্তি এই অপরাবিদ্যা অর্জন করে তার জীবনকে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ আরামদায়ক এবং সুরক্ষিত করে তুলতে পারে। তবে তা সাময়িক শান্তি বা আনন্দ দেয় । তাই জীবনের লক্ষ্য অপরা-বিদ্যা অর্জন করা নয়, বরং তার উপর ভর করে পরা-বিদ্যা অর্জন করা। অপরা-বিদ্যা ও পরা-বিদ্যার সমন্বয় ঘটিয়ে জীবনকে আধ্যাত্মিকভাবে গড়ে তুলতে পারা যায়।
আমাদের বেদান্তে শাস্ত্রের ৪টি স্তম্ভ ছিল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। সেই প্রাচীন যুগে ছাত্ররা গুরুগৃহে গিয়ে ব্রহ্মচর্য শিক্ষা করতো। অর্থাৎ এখানেই তাদেরকে অপরাবিদ্যা ও পরাবিদ্যা সম্পর্কে যথাযথভাবে শিখানো হতো। সেই অর্জিত বিদ্যার কারণেই তারা জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারতো। বিচ্যুত হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। তারপর বিবাহ করে সংসার জীবনে প্রবেশ করতো। এক সময় সংসার জীবন শেষ করে “কেবা পিতা কেবা মাতা কেবা সূত-জায়া। বুঝিতে না পারে জীব প্রমত্ত থাকিয়া।” তারপর সংসারের মায়ার বন্ধন ছিন্ন করার জন্য অনতিদূরে একাকী জীবন যাপন শুরু করতে হয়। যখন মায়ার বন্ধন ছিন্ন হয় তখন সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। আমার মনে হয় এটি একটি সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় বিধান ব্যবস্থা মানুষকে ব্রহ্মকে জানার পথকে সুগম করে দেয়। কিন্তু দু:খের বিষয় ৪টি স্তম্ভ আজও শাস্ত্রে আছে কিন্তু নেই চর্চা। বর্তমানে যেটি হচ্ছে সেটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে হচ্ছে। অর্থাৎ যে যেভাবে পারে শেষ জীবনে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করছে। কেহ ইসকনের মাধ্যমে করছে, কেহ গুরুর মাধ্যমে করছে আবার কেহ বা নিজে নেজেই নিজেকে সন্ন্যাস বলে বেশ ধারণ করছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় গুরুগৃহে গিয়ে ব্রহ্মচর্য বিদ্যা অর্জন করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাহলে কিভাবে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের ব্রহ্মচর্য শিক্ষা দেব? কোথায় পাব ব্রহ্মজ্ঞান সম্পন্ন সদগুরু। যিনি আমাদের ছেলে-মেয়েদের ব্রহ্মজ্ঞান দান করবেন। পাঠক চোখ বন্ধ করে ক্ষণিকের জন্য চিন্তা করুন আমরা Survive করতে পারবো? ডারউইন বলতেন "Survival of the fittest" যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার।
তাই বাসুদেব কৃষ্ণের কাছে একটি প্রার্থনাই আমাদের করা উচিৎ “ হে গোবিন্দ! হে বাসুদেব! তুমি সনাতন ধর্মের রক্ষক। তুমি সনাতন ধর্মকে রক্ষা কর। তুমি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা কর।”
দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে ইতি হ স্ম
যদ ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ। মুন্ডকোপনিষৎ ১।১।৪।
অর্থঃ “দুটি বিদ্যা জানবার আছে” এ কথাটিই বেদার্থভিজ্ঞেরা বলে থাকেন। উক্ত বিদ্যাদ্বয় পরা বিদ্যা ও অপরা বিদ্যা নামে প্রসিদ্ধ।
মুন্ডকোপনিষৎ বলছে-
তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহর্থববেদঃ
শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিত।
অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।।।১।১।৫।।
অর্থঃতন্মধ্যে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ এ গুলি হচ্ছে অপরা বিদ্যা। যে বিদ্যা দ্বারা সেই অক্ষর অর্থাৎ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত বা জ্ঞাত হওয়া যায় সেটি হচ্ছে পরা বিদ্যা। মুন্ডকোপনিষৎ বলছে-
যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্যমগোত্রমবর্ণম্
অচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপাদম্।
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং
তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ।।৬।।
অর্থঃ সে অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, নিষ্কারণ, অরূপ ও চক্ষকর্ণাদি শূন্যকে, সেই হস্তপাদহীন, অবিনাশী, বিবিধাকার, সর্বব্যাপী, ও সুসূক্ষ্মকে, সেই অব্যয়কে অর্থাৎ ভূতবর্গের কারণ ব্রহ্মকে (যে বিদ্যা সহায়ে) বিবেকীরা সর্বতোভাবে দর্শন করে (তাই পরাবিদ্যা)।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন-
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ |
অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||
অর্থঃ ভূমি, জল ,বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার- এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত। এটাকেই নিকৃষ্টা প্রকৃতি বা অপরা প্রকৃতি বা জড়া প্রকৃতি বা অপরা শক্তি বা অপরা বিদ্যা বলো হয়। অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ |
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ || ৫ ||
অর্থঃহে মাহবাহো! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃত রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরুপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নি:সৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে। ভগবানের এ শক্তি উৎকৃষ্টা বলে একে উৎকৃষ্টা শক্তি বা পরা প্রকৃতি বা পরা শক্তি বা পরা বিদ্যাও বলা হয়।
চেতন জীবাত্মক ক্ষেত্রজ্ঞ পরা প্রকৃতিই শ্রেষ্ঠ ও শুদ্ধ। চেতন বা পরা প্রকৃতিই অচেতন বা অপরা প্রকৃতিকে ধারণ করে আছে। পরা প্রকৃতি বা চেতন প্রকৃতিকে জানতে পারলে জীব বন্ধন দশা হতে মুক্ত হয়। পরা ও অপরা প্রকৃতি উভয়ই হতে জড় ও চেতন সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহংকার এ আটটি হচ্ছে অপরা প্রকৃতি বা মায়ারূপ প্রকৃতি। অপরা প্রকৃতি জড়ত্ব, পরাধীনত্ব, সংসার বন্ধনকারিত্ব দোষ জন্য নিকৃষ্ট ও ক্ষেত্রস্বরূপ। এ সম্পর্কে চিন্তা করলে জীব মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আমাদের চারপাশে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য যা কিছু আছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার যে ক্ষমতা অর্জন করা হলো অপরাবিদ্যা।
এ নয়টি প্রকৃতিই হচ্ছে সমগ্র জগতের সৃষ্টির মূল উপাদান। ভূমি, জল ,বায়ু, অগ্নি, আকাশ এ পাঁচটি হচ্ছে পঞ্চমহাভূত। যার পরিমাণ আমাদের এ “স্থূলদেহ”। তাছাড়া আমাদের আর একটি দেহ রয়েছে যেটি পঞ্চপ্রাণ, দশ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি দ্বারা গঠিত। একে “সূক্ষ্মশরীর” বলা হয়। আর অহংকারের প্রসূতি অবিদ্যাকেই আর্যঋষিরা এই বিশ্ব প্রপঞ্চের “কারণশরীর” বলে অভিহিত করেন। ইহাই মূলত: সৃষ্টিতত্ত্ব।
মন্ডুকোপনিষৎ বলে-
যথোর্ণনাভিঃ সজতে গৃহ্ণতে চ
যথা পৃথিব্যামোষধয়ঃ সম্ভবন্তি।
যথা সতঃ পুরুষাং কেশলোমানি
তথাহক্ষরাৎ সম্ভবতীহ বিশ্বম্।।১।১।৭।।
অর্থঃ মাকড়সা যেরূপ সূতা উপৎপাদন করে ও আত্মসাৎ করে, পৃথিবীতে যদ্রুপ(তদনিতিরিক্ত) ঔষধিসমূহ জাত হয়, সজীব পুরূষ শরীর হতে যদ্রূপ(বিজাতীয়) কেশ ও লোমসমূহ নির্গত হয়, তদ্রূপ অক্ষর হতে এ সংসারমন্ডলে নিখিল বস্তু উৎপন্ন হয়।
পণ্ডিতেরা বললেন, সমজাতীয় কারণ হতে সমজাতীয় ফলের উৎপত্তি সম্ভব। যেমন- জড় মাটি হতে জড় নানান বস্তু উৎপন্ন হয়। কিন্তু ব্ৰহ্ম চৈতন্যময় আর পৃথিবী জড় জগৎ। চেতন হতে তাহলে কিভাবে জড় হলো?
মুণ্ডক উপনিষদ-
যেমন মানুষের দেহে কেশ-লোমাদি হয়, ঠিক তেমনি অক্ষর হতেও বিশ্ববস্তু ‘এ’ সংসারমন্ডলে নিখিল বস্তু উৎপন্ন হয় বা জন্মগ্রহণ করে। ‘এ’ বলতে নিজের আত্মায়, চৈতন্যে। ইহাই ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ চেতন হতে অচেতনের উৎপত্তি।
উপাদান-কারণ ছাড়া ব্রহ্ম কিভাবে সৃষ্টি কার্য সম্পন্ন করলেন? মুণ্ডক উপনিষদ বলছে-
মাকড়সা যেমন নিজদেহ হতে নিসৃত লালা দিয়ে জাল তৈরি করে, কোনও উপাদানের প্রয়োজন হয় না। ওই সুতা মাকড়সা আবার নিজ দেহের ভিতর ধারণ করতে পারে। শাস্ত্র বলে, একই বস্তু উপাদান-কারণ ও নিমিত্ত-কারণ হতে পারে না। ঘটের উপাদান-কারণ মাটি ও নিমিত্ত-কারণ কুম্ভকার। ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে কীভাবে সৃষ্টি করলেন? মুণ্ডক-উপনিষদ দৃষ্টান্ত দিয়ে উত্তর দিচ্ছেন, যেমন একমাত্র পৃথিবীই ওষধি (যে গাছ এক বার ফল দিয়ে মরে যায়) গাছেদের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ - ব্রহ্মও ঠিক তেমন।
মানুষ জন্মের পর হতেই বিবিধ ক্রীয়া অবিচ্ছিন্নভাবে দর্শন করে আসছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ অহরহ ঘটে যাচ্ছে। বিশ্বব্রহ্মান্ড যথা এ সৌরজগৎ অবিরত কর্ম করে যাচ্ছে। সবই গতিশীল। কোন কিছুই থেমে নেয়। অবিরত বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে সমুদ্রে জলরাশি প্রবাহিত হচ্ছে, প্রকৃতি অবিরত কর্মচঞ্চল। প্রশ্ন হচ্ছে কে এ কর্মপ্রবাহ গুলিকে অতি সূক্ষ্ণভাবে অতি সুচারুভাবে পরিচালিত করছে? আমরা যদি অতি সহজভাবে এ চিন্তা করি যে এ ক্রীয়াগুলির পিছনে যে বা যারা জড়িত মূলত: তাদেরকেই আমরা শক্তি বলি থাকি। যেমন-তাপ,আলোক এর সঞ্চারন বিদ্যুৎশক্তি, বায়ুর সঞ্চরণ গতিশক্তি, মেধা-বুদ্ধি-ধৃতি’র সঞ্চারন স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞানশক্তি ইত্যাদি। এ মহাবিশ্বের সকল বস্তুরই অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। সে শক্তির প্রভাবেই বিশ্ব চরাচর অত্যন্ত সংযতভাবে ও সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কার ইচ্ছায় বিশ্বব্রহ্মান্ড পরিচালিত হচ্ছে?
শৌনকের মনে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে মহাবিশ্বের সমগ্র কিছু একসাথে জানার যে বিদ্যা বা জ্ঞান সেটিই তাকে জানতে হবে। তাকে জানা হলে মূল তত্ত্বকেই জানা যাবে। সোনাকে জানলে যেমন সোনার তৈরী সকল জিনিস সম্পর্কে জানা যায়, মাটির ডেলাকে জানলে যেমন মাটির তৈরী সকল বস্তুকে জানা যায়। পৃথক পৃথকভাবে সকল বস্তুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোন প্রয়োজন নেই। আকারের ভিন্নতা থাকলেও উপাদন কিন্তু এক। তাই উপাদনকে জানতে পারলে সকল বস্তুকে জানা যায়। কারণ মূল হচ্ছে সোনা ও মাটি। সোনা ও মাটি ছাড়া ঐ সকল বস্তুর কোন পৃথক সত্তাও নেই নামও নেই। সুতরাং সোনা বা মাটিই হচ্ছে মূল। সোনা বা মাটিই সত্য। আর অন্য সব মিথ্যা।
রজ্জুতে সাপ, রজ্জু-সত্তা ছাড়া সাপের পৃথক সত্তা নেই। তাই রজ্জুকে জানলেই সে রজ্জুতে যা কিছু আছে তা জানা সহজ হয়ে যায়। রজ্জুকে কেহ সাপ, কেহ লাঠি বলে দেখে। বিভিন্নভাবে দর্শিত হলেও রজ্জু ছাড়া তাদের পৃথক কোন সত্তা নেই।
যখনই উপাদানকে জানা যায় তখনই তার কাজগুলি সব জানা হয়ে যায়। একমাত্র কারণই আছে, কাজগুলি সবই তাতে আরোপিত। এগুলির পৃথক সত্তা থাকলে, তাদের কারণ থেকে আলাদা করে দেখলে তবেই তাদের অস্তিত্ব থাকত। মাটির খেলনা থেকে মাটি সরিয়ে নিলে খেলনা যেমন খেলনা থাকে না তেমনি অলঙ্কার থেকে সোনাকে বাদ দিলে কিছুই থাকে না। কোনো একটি বস্তুর উপাদান থেকে তার পৃথক সত্তা যখন কল্পনা করা যায় না, তখন তাকে বলি মিথ্যা। সুতরাং এ জগতে যা কিছু বিকার বস্তু দেখছি, তার সবই মিথ্যা; একমাত্র যা উপাদান অর্থাৎ আদি কারণ, তা-ই সত্য। সেই কারণটি হলো “ব্রহ্ম”। অতএব ব্রহ্মকে যখন জানা হলো, তখন সবই জানা হয়ে গেল।
জড় জাগতিক জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাথে যুক্ত করতে পারলে তবেই পরম জ্ঞান লাভ হয়। জড় জাগতিক জ্ঞান আমাদের সাময়িক শান্তি বা আনন্দ দেয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞান অন্তর্জগত ও বহির্জগত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।
শ্রুতি বা উপনিষদ ব্রহ্মকে জগতের যোনি, ভূতগণের যোনি, পঞ্চভূতের কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। তাতে ব্রহ্মই যে বিশ্বের উপাদান কারণ, তা জানা যায়। নিমিত্ত-কারণও ব্রহ্মই। মুণ্ডক উপনিষদ পরা-বিদ্যার সাহায্যে যে অক্ষর-পুরুষকে জানতে হবে, তার স্বরূপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, এই বিশ্ব-সংসার অক্ষর-পুরুষ হতেই উৎপন্ন হয়েছে।
শৌনক মুনির জিজ্ঞাসু বিষয় ছিল “কাকে জানলে সবকিছু জানা হয়ে যায়?" সংক্ষেপে বলা যায় নিজের আত্মা ও দেহের সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সবকিছুই জানা হয়। তার অর্থ ব্রহ্মকে জানা যায়।
ব্রহ্মজ্ঞরা বলেন, পরা ও অপরা এই দুটি বিদ্যাই জানা দরকার। পরমেশ্বরকে জানার বিদ্যা হচ্ছে পরা-বিদ্যা আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়কে জানার বিদ্যা অপরা-বিদ্যা। অপরা-বিদ্যা করায়াত্ত করা মানে সব কিছু আয়ত্ত করা নয়।
শাস্ত্র বলছেন, অপরা-বিদ্যা তথা বেদ-উপনিষদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করাই যথেষ্ট নয় যদি না পরা-বিদ্যা তথা আত্মজ্ঞান লাভ করা না যায়। আমাদের চারপাশে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য যা কিছু আছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার যে ক্ষমতা অর্জন করা হলো অপরাবিদ্যা অর্থাৎ একজন ব্যক্তি এই অপরাবিদ্যা অর্জন করে তার জীবনকে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ আরামদায়ক এবং সুরক্ষিত করে তুলতে পারে। তবে তা সাময়িক শান্তি বা আনন্দ দেয় । তাই জীবনের লক্ষ্য অপরা-বিদ্যা অর্জন করা নয়, বরং তার উপর ভর করে পরা-বিদ্যা অর্জন করা। অপরা-বিদ্যা ও পরা-বিদ্যার সমন্বয় ঘটিয়ে জীবনকে আধ্যাত্মিকভাবে গড়ে তুলতে পারা যায়।
আমাদের বেদান্তে শাস্ত্রের ৪টি স্তম্ভ ছিল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। সেই প্রাচীন যুগে ছাত্ররা গুরুগৃহে গিয়ে ব্রহ্মচর্য শিক্ষা করতো। অর্থাৎ এখানেই তাদেরকে অপরাবিদ্যা ও পরাবিদ্যা সম্পর্কে যথাযথভাবে শিখানো হতো। সেই অর্জিত বিদ্যার কারণেই তারা জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারতো। বিচ্যুত হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। তারপর বিবাহ করে সংসার জীবনে প্রবেশ করতো। এক সময় সংসার জীবন শেষ করে “কেবা পিতা কেবা মাতা কেবা সূত-জায়া। বুঝিতে না পারে জীব প্রমত্ত থাকিয়া।” তারপর সংসারের মায়ার বন্ধন ছিন্ন করার জন্য অনতিদূরে একাকী জীবন যাপন শুরু করতে হয়। যখন মায়ার বন্ধন ছিন্ন হয় তখন সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। আমার মনে হয় এটি একটি সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় বিধান ব্যবস্থা মানুষকে ব্রহ্মকে জানার পথকে সুগম করে দেয়। কিন্তু দু:খের বিষয় ৪টি স্তম্ভ আজও শাস্ত্রে আছে কিন্তু নেই চর্চা। বর্তমানে যেটি হচ্ছে সেটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে হচ্ছে। অর্থাৎ যে যেভাবে পারে শেষ জীবনে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করছে। কেহ ইসকনের মাধ্যমে করছে, কেহ গুরুর মাধ্যমে করছে আবার কেহ বা নিজে নেজেই নিজেকে সন্ন্যাস বলে বেশ ধারণ করছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় গুরুগৃহে গিয়ে ব্রহ্মচর্য বিদ্যা অর্জন করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাহলে কিভাবে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের ব্রহ্মচর্য শিক্ষা দেব? কোথায় পাব ব্রহ্মজ্ঞান সম্পন্ন সদগুরু। যিনি আমাদের ছেলে-মেয়েদের ব্রহ্মজ্ঞান দান করবেন। পাঠক চোখ বন্ধ করে ক্ষণিকের জন্য চিন্তা করুন আমরা Survive করতে পারবো? ডারউইন বলতেন "Survival of the fittest" যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার।
তাই বাসুদেব কৃষ্ণের কাছে একটি প্রার্থনাই আমাদের করা উচিৎ “ হে গোবিন্দ! হে বাসুদেব! তুমি সনাতন ধর্মের রক্ষক। তুমি সনাতন ধর্মকে রক্ষা কর। তুমি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা কর।”
ConversionConversion EmoticonEmoticon