০৬. দ্রৌপদীর শোকে পাণ্ডবদের বিলাপ
যুধিষ্ঠির নৃপমণি, কোলে লৈয়া যাজ্ঞাসেনী,
কান্দিছেন সকরুণ ভাষে।
শোক দুঃখে অচেতন, আর ভাই চারিজন,
অশ্রুমুখে বৈসে চারিপাশে।।
দ্রৌপদীর মুখ চেয়ে, কান্দিছেন বিলাপিয়ে,
কোথা গেলে দ্রুপদনন্দিনী।
অজ্ঞাতে তোমার তরে, বধিনু কীচক বীরে,
তুমি পাণ্ডবের ধন মানি।।
যেকালে দ্রুপদরাজে, পণ কৈল সভামাঝে,
রাধাচক্র বিন্ধিতে যে পারে।
অযোনিসম্ভবা কন্যা, ত্রিভুবনে সেই ধন্যা,
সম্প্রদান করিবে তাহারে।।
প্রতিজ্ঞা বচন শনি, এক লক্ষ নৃপমণি,
হুড়াহুড়ি বিন্ধিবার তরে।
দুর্জ্জয় ধনুক ধরে, গুণ দিতে নাহি পারে,
তবু বাঞ্ছা পাইতে তোমারে।।
রক্ত উঠে কার মুখে, কার হস্ত ঘাড় বাঁকে,
না পারিয়া ক্ষমা দিল সবে।
চারিবর্ণে যে বিন্ধিবে, তারে রাজকন্যা দিবে,
দ্রুপদ কহিল ডাকি তবে।।
তোমা জিনি পঞ্চ ভাই, গেলাম জননী ঠাঁই,
ভিক্ষা বলি মায়ে বলা গেল।
না দেখিয়া না শুনিয়া, জননী হরিষ হৈয়া,
বাটি খাও পঞ্চজনে কৈল।।
আজ্ঞা দিল মুনিগণে, বিভা কৈনু পঞ্চজনে,
লক্ষীরূপা সুন্দরী পাঞ্চালী।
দ্বাদশ বৎসর বনে, তুষিলে ব্রাহ্মণগণে,
পর্ব্বতে পড়িলে অঙ্গ ঢালি।।
মর্ত্ত্যে করিলাম পাপ, তেঁই এত পাইতাপ,
কেন তুমি পড়িলে পর্ব্বতে।
কেমনে যাইব পথে, কান্দেন ভূপতি চিতে,
নাহি কেহ প্রবোধ করিতে।।
কান্দি ভীম ধনঞ্জয়, যমজ সোদরদ্বয়,
শোকাকুল করে হাকাকার।
বিস্তর বিলাপ করি, বলে পুনঃ হরি হরি,
অগ্রে হৈল মরণ তোমার।।
আমাদের সঙ্গ ছাড়ি; পর্ব্বতে রহিলা পড়ি,
তোমা এড়ি যাইব কিমতে।
এতেক ভাবিয়া সবে, কিছু শান্ত হৈয়া তবে,
প্রিয়বাক্য কহে ধর্ম্মসুতে।।
এই হেতু দেশে পূর্ব্বে, রহিতে বলিতে সর্ব্বে,
দৃঢ় করি না ছাড়িলে সঙ্গ।
তোমা হেন নারী বিনে, শূন্যদেখি রাত্রিদিনে,
বিধাতা করিল সুখ ভঙ্গ।।
ভারতের পুণ্যকথা, শ্রবণে বিনাশে ব্যথা,
হয় দিব্যজ্ঞানের প্রকাশ।
কমলাকান্তের সুত, সুজনের মনঃপুত,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।
০৭. যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীমের প্রশ্ন
মুনি বলে শুনহ নৃপতি জন্মেজয়।
তবে কতক্ষণে পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।
দ্রৌপদীরে বেড়িয়া বৈসেন পঞ্চজন।
ধর্ম্মরাজ বলিলেন গদগদ বচন।।
তোমার বিচ্ছেদ প্রাণে সহিতে না পারি।
হায় প্রিয়ে মোরে ছাড়ি গেলে কোন পুরী।।
পড়িয়া রহিলে কেন পর্ব্বত উপরে।
তোমার শয়নে মম পরাণ বিদরে।।
উত্তর না দেহ কেন স্বামী পঞ্চজনে।
সঙ্গ ছাড়ি কেমনে রহিলে মহাবনে।।
কপট পাশায় আমি করিলাম পণ।
তব অপমান কৈল দুষ্ট দুঃশাসন।।
তোমার কারণে ভীম প্রতিজ্ঞা করিল।
দুঃশাসনের বক্ষ চিরি রক্তপান কৈল।।
ঊরু ভাঙ্গি মারিল নৃপতি দুর্য্যোধন।
নিঃক্ষত্রা হইল ক্ষিতি তোমার কারণ।।
তোমা হেতু জয়দ্রথ পায় অপমান।
গোবিন্দের প্রিয় তুমি পাণ্ডবের প্রাণ।।
তোমার বিহনে দিনে দেখি অন্ধকার।
এত শুনি কান্দে রাজা চক্ষে জলধার।।
বৃকোদর বলিলেন ধর্ম্ম নৃপমণি।
কোনপাপে পর্ব্বতে পড়িল যাজ্ঞসেনী।।
পতিব্রতা হৈয়া স্বর্গে নাহি গেলে কেনে।
এত শুনি শ্রীধর্ম্ম বলেন ভীমসেনে।।
দ্রৌপদীর পাপ শুন কহি যে তোমারে।
আমা হৈতে বড় স্নেহ ছিল পার্থ বীরে।।
এই পাপে দ্রৌপদী রহিল এই ঠাঁই।
জানাই বৃত্তান্ত শুন বৃকোদর ভাই।।
জ্ঞাতিবধ পাপে সদা জ্বলিছে আগুনি।
ঘৃতাহুতি তাহাতে হৈল যাজ্ঞসেনী।।
মহাভারতের কথা সুধা হৈতে সুধা।
কর্ণপথে পান কৈলে খণ্ডে মনক্ষুধা।।
কাশীরাম দাস প্রভু নীল শৈলা রূঢ়।
দক্ষিণে অনুজানুজ সম্মুখে গরুড়।।
০৮. পাণ্ডবগণের বদরিকাশ্রমে গমন
ও সহদেবের মৃত্যু ও যুধিষ্ঠিরের শোক
বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
দ্রৌপদীরে তেয়াগিয়া পাণ্ডুর তনয়।।
শোক মোহ কাম ক্রোধ লোভ আদিছাড়ি।
পঞ্চ ভাই গঙ্গাতীরে যান স্বর্গপুরী।।
যাইতে উত্তরমুখে পাণ্ডুর নন্দন।
তাম্রচূড় গিরি করিলেন আরোহণ।।
পর্ব্বত দেখিয়া সুখী পাণ্ডুর তনয়।
শঙ্খনাদে পূরিল সর্ব্বত্র জয় জয়।।
আকাশ পরশে চূড়া অতি ভয়ঙ্কর।
সপ্ত অশ্ব রথে যায় দেবতা ভাঙ্কর।।
কালচক্র ফিরে সদা আপনার কাছে।
বৃক্ষ লতা নাহি তথা ভাস্করের তেজে।।
পাপিষ্ঠ পরাণী যদি তথা গতি করে।
আরোহণ মাত্রে সেইক্ষণে পুড়ে মরে।।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন ভাই পঞ্চজন।
কালাগ্নি রুদ্রের পুরী ভয়ঙ্কর বন।।
অতিশয় প্রচণ্ড প্রতাপ তেজ তাঁর।
নিকটে যাইতে শক্তি নাহিক কাহার।।
আছেন ঈশ্বর তথা দশমূর্ত্তি ধরি।
দ্বারে থাকি পঞ্চ ভাই নমস্কার করি।।
স্তব করি বর পেয়ে করিল গমন।
ক্রৌঞ্চ নামে পর্ব্বতে করিল আরোহণ।।
ক্রৌঞ্চের নির্ম্মাণ পুরী অতিশয় শোভা।
ইন্দ্রের খাণ্ডব জিনি কনকের প্রভা।।
স্বর্গ হৈতে নামে তাতে গঙ্গা সরস্বতী।
হংস চক্রবাক জলে চরে হৃষ্টমতি।।
সুবর্ণের পাখা পক্ষী আছে বহুতর।
জল স্থল আবাস উদ্যান মনোহর।।
নির্ম্মল উজ্জ্বল জল স্ফটিক আকার।
তীরে তপ করে মুনি জ্ঞান অনুসার।।
দেখিয়া হরিষ বড় পাণ্ডু পুত্রগণ।
স্বর্ণের মণ্ডপ তথা দেখি বিচক্ষণ।।
অতি অপরূপ পুরী প্রাসাদ মন্দির।
অন্ধকারে আলো করে জিনিয়া মিহির।।
পুষ্করাক্ষ নামে শিব মণ্ডপ ভিতর।
তাঁর পূজা করে দেব দানব ঈশ্বর।।
কিন্নরের রাজপুরী অতি অনুপম।
স্থাপিয়াছে দেব দেব মহাদেব নাম।।
বীণা বংশী বাজে কেহ গায় শিবগীত।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যক্ষ সবে আনন্দিত।।
চারিপাশে স্তুতি করে নাচয়ে নর্ত্তনী।
অন্য জাতি নারী নাহি সকল ব্রাহ্মণী।।
কেহ গন্ধ চুয়া দেয় পুষ্প পারিজাত।
বিল্বপত্রে গালবাদ্যে পূজে বিশ্বনাথ।।
স্তবপাঠ করে কেহ শিবের সাক্ষাতে।
একপদে স্তব কেহ করে যোড়হাতে।।
সেবিলে সকল পাপ হয় তার ক্ষয়।
অনেক তপস্বী ঋষি করয়ে আশ্রয়।।
নিরবধি সবে সেবে শিবের চরণ।
অন্তরীক্ষে আছে কেহ যোগপরায়ণ।।
দেখি পঞ্চভাই করিলেন স্নানদান।
লোভ মোহ ছাড়িয়া পাইল দিব্যজ্ঞান।।
স্নান করি পাণ্ডব হইল কুতূহলী।
পিতৃলোকে উদ্দেশিয়া দেন জলাঞ্জলি।।
প্রবেশ করেন সবে মণ্ডপ ভিতরে।
বিবিমতে পঞ্চভাই পূজিল শঙ্করে।।
করযোড়ে প্রভু রুদ্রে মাগিলেন বর।
পুনঃ জন্ম নাহি হয় মর্ত্ত্যের ভিতর।।
এত বলি প্রণমিয়া যান তথা হৈতে।
দেবপুষ্প পড়ে আসি ভূপতির মাথে।।
দেখিয়া তপস্বিগণ প্রফুল্ল অন্তরে।
আদর করিল বড় রাজা যুধিষ্ঠিরে।।
এই তীর্থে থাক রাজা মোসবার সঙ্গে।
কোথাকারে কোন্ হেতু যাবে কোন্ ভাগে।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির বলেন হাসিয়া।
নিষ্কণ্টক নিজ রাজ্য, সকলি ত্যজিয়া।।
সঙ্কল্প করেছি আমি মর্ত্ত্যের ভিতর।
স্বর্গপুরে যাইব দেখিব দামোদর।।
আশীর্ব্বাদ কর মোরে সব মুনিগণ।
স্বর্গে গিয়া দেখি যেন দেব নারায়ণ।।
এত শুনি বলে তারে ক্রৌঞ্চ মুনিবর।
তব তুল্য রাজা নাহি অবনী ভিতর।।
সমস্ত ত্যজিয়া যাহ স্বর্গের বসতি।
দেখিয়া গোবিন্দ পদ পাবে দিব্যগতি।।
তাঁরে নমস্কার করি ধর্ম্মের নন্দন।
উত্তরমুন্ডেতে যাত্রা করেন তখন।।
বদরিকা শ্রমে দেখি জাহ্নবীর কূলে।
বদরিক বৃক্ষ তথা শোভে ফল ফুলে।।
অমৃত জিনিয়া স্বাদু পিক নাদে ডালে।
জরা মৃত্যু ভয় নাহি তথায় থাকিলে।।
দুর্ব্বাসার বরে বৃক্ষে অক্ষয় অব্যয়।
নানা বর্ণে নানা স্থল দিব্য দেবালয়।।
করয়ে তপস্যা তীরে কত শত মুনি।
তরঙ্গ নির্ম্মল বহে গঙ্গা মন্দাকিনী।।
দুর্ব্বাসা গৌতম ভরদ্বাজ পরাশর।
অশ্বথামা আঙ্গিরস আর সোমেশ্বর।।
ঋষিগণ বলে তবে রাজাকে দেখিয়া।
হেথায় থাকহ রাজা আমা সবা লৈয়া।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব এথা আছে শত শত।
পঞ্চভাই থাক সুখে সবার সহিত।।
অশ্বথামা আসিয়া মিলিল পঞ্চজনে।
পূর্ব্ব শোক স্মরিয়া কান্দয়ে দুঃখমনে।।
অশ্বথামা বলে থাক বদরিকাশ্রমে।
পাপ মুক্ত হৈয়া, হরি পাবে পরিণামে।।
এতেক শুনিয়া বলিলেন যুধিষ্ঠির।
না করিব স্থিতি মোরা থাকিতে শরীর।।
সঙ্কল্প করিনু আমি কৃষ্ণের সাক্ষাতে।
যাইব অমরপুরে সুমেরু পর্ব্বতে।।
সঙ্কল্প লঙ্ঘিলে হয় ব্রহ্মবধ ভয়।
অতএব কহি শুন তপস্বী তনয়।।
যে হোক সে হোক, থাকে যায় বা জীবন।
যাইব বৈকুণ্ঠপুরী যথা নারায়ণ।।
অশ্বথামা বলে, কোথা দ্রুপদ নন্দিনী।
যুধিষ্ঠির কন, পথে ত্যজিল পরাণী।।
শুনি হাহাকার করি কান্দে দ্রোণসুত।
হাহা কৃষ্ণা সুবদনী রূপ গুণযুত।।
তবে গুরুপুত্রে বন্দিলেন সর্ব্বজন।
উত্তর মুখেতে যান পাণ্ডুর নন্দন।।
কতদূরে গঙ্গাতীরে দেখে নৃপবর।
পর্ব্বত রৈবত নামে অতি মনোহর।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য দুর্ল্লভ বিচিত্র উপবন।
অরোহেণ সে পর্ব্বতে ভাই পঞ্চজন।।
রেবা নামে পুণ্য নদী পর্ব্বত উপর।
অতি সুনির্ম্মল জল শোভে মনোহর।।
তীরে রেবানাথ বিষ্ণুমূর্ত্তি চতুর্ভুজ।
প্রণমেন যুধিষ্ঠির সহিত অনুজ।।
মণি মরকত পুরী অতি শোভা করে।
চৌরশী যোজন তার উপরে বিস্তারে।।
বৃক্ষে অন্ধকার নাহি জানি দিবারাতি।
তিন লক্ষ কিরাত কুৎসিত মূর্ত্তি অতি।।
নানাবর্ণে অস্ত্র ধরে প্রচণ্ড কিরণ।
মণি রত্নে বিভূষিত লোহিত বরণ।।
পিন্ধন গাছের ছাল তাম্রবর্ণ কেশ।
কর্ণে রামকড়ি সাজে ভয়ঙ্কর বেশ।।
কেহ মালসাট মারে কেহ দেয় লম্ফ।
কেহ অন্তরীক্ষে কেহ জলে দেয় ঝম্ফ।।
বাণ বৃষ্টি করিয়া করিল অন্ধকার।
ভাবেন না দেখি পথ পাণ্ডুর কুমার।।
মহাহিমে কাঁপে তনু পায়ে বাজে শীলা।
বিষণ্ণ হইয়া তবে ভাবিতে লাগিলা।।
তিন লক্ষ কিরাত করিল বানবৃষ্টি।
প্রলয়কালেতে যেন সংহারিতে সৃষ্টি।।
সাত্যবাদী পাণ্ডুপুত্র গোবিন্দ সহায়।
একগুটি বাণ তার না লাগিল গায়।।
দেখিয়া কিরাতগণ অদ্ভুত মানিল।
এড়িয়া ধনুক বাণ নমস্কার কৈল।।
জিজ্ঞাসিল তোমা সবে কোন মহাজ্ন।
কিবা নাম কোথা ধাম কোথায় গমন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন পরিচয়।
চন্দ্রবংশে জন্ম মম পাণ্ডুর তনয়।।
দ্বাপর হইল শেষ কলি আগমন।
স্বর্গপুরে যাই মোরা তথির কারণ।।
রাজার বচনে বলে কিরাত প্রধান।
এই দেশে রাজা হও তুমি পুণ্যবান।।
স্বর্গসুখ পাবে তুমি এস্থানে রাজন।
নিরন্তর তোমারে সেবিবে দেবগণ।।
তা সবারে মৃদুভাষ বিদায় করিয়া।
স্বর্গপথে পান রাজা গোবিন্দ স্মরিয়া।।
যাইতে পর্ব্বত মধ্যে দেখেন রাজন।
করয়ে শিবের সেবা কিরাত ব্রাহ্মণ।।
অপূর্ব্ব দেখিয়া ভাবিলেন মনে মন।
বর মাগি লইল শঙ্করে পঞ্চজন।।
মহাশীতে হিমে ভেদি যান কতদূর।
সহদেব বীর পড়ি অঙ্গ হৈল চুর।।
অন্তকাল জানিয়া চিন্তিল নারায়ণ।
অবাক হইয়া পড়ি ছাড়িল জীবন।।
যুধিষ্ঠিরে শুনাইল বৃকোদর ধীর।
পর্ব্বতে ত্যজিল প্রাণ সহদেব বীর।।
পড়িল কনিষ্ঠ ভাই শুনহ রাজন।
দেখি শোকে কান্দিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
কোথাকারে গেল ভাই পরাণ আমার।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের গুরু বুদ্ধির আধার।।
আমাদিকে ছাড়ি ভাই গেলে কোথাকারে।
বিপদে পড়িলে বুদ্ধি জিজ্ঞাসিব কারে।।
পরম পণ্ডিত ভাই মন্ত্রী চূড়ামণি।
যার বুদ্ধে রাজ্য পাই কুরুগণে জিনি।।
এত বলি পড়িলেন আছাড় খাইয়া।
হায় সহদেব বলি ভূমে লোটাইয়া।।
ভারত সমরে জয় কৈলা কুরুগণে।
শকুনিরে সংহারিলা সবা বিদ্যমানে।।
দিগ্বিজয় করিয়া করিলে মহাক্রতু।
মোরে এড়ি পর্ব্বতে পড়িলা কোন হেতু।।
বিষম সঙ্কটে বনে পাইয়াছ ত্রাণ।
পর্ব্বতে পড়িয়া ভাই হারাইলে প্রাণ।।
জননী কুন্তীর তুমি বড় প্রিয়তর।
হেন ভাই পর্ব্বতে রহিলা একেশ্বর।।
ধবল পর্ব্বতে কৃষ্ণা কৃষ্ণ বিষ্ণুলোকে।
কে জানিবে মম দুঃখ কহিব কাহাকে।।
দশদিক অন্ধকার দেখেন নয়নে।
স্থিরচিত্ত নৃপতির হৈল কতক্ষণে।।
ভীম জিজ্ঞাসেন রাজা কহিবে আমাতে।
কোন পাপে সহদেব পড়িল পর্ব্বতে।।
যুধিষ্ঠির বলেন যে শুন সাবধান।
সহদেব জ্ঞাত ভূত ভাবি বর্ত্তমান।।
পাশাতে আমারে আহবানিল দুর্য্যোধন।
বিদ্যমান ছিল ভাই মাদ্রীর নন্দন।।
হারিব জিনিব সেই ভাল তাহা জানে।
জানিয়া আমারে না করিল নিবারণে।।
বারণাবতেতে যবে দিল পাঠাইয়া।
আমাদিগে কপটে মারিতে পোড়াইয়া।।
জানিয়া না বলিলেক কুলের বিনাশ।
অধর্ম্ম হইল তেঁই পাপের প্রকাশ।।
এই পাপে যাইতে নারিল স্বর্গপুরে।
শুন বৃকোদর ভাই জানাই তোমারে।।
এত বলি যান রাজা করিয়া ক্রন্দন।
ভীমার্জ্জুন নকুল পশ্চাতে তিনজন।।
পথমধ্যে সরোবর দেখি বিদ্যমান।
যুধিষ্ঠির তাতে করিলেন স্নানদান।।
দেব ঋষি পিতৃলোকে করিয়া তর্পন ।
শুচি হৈয়া করিলেন স্বর্গ আরোহণ।।
সহদেব দ্রৌপদী চলিল স্বর্গপুরে।
ভেটিল গোবিন্দে আতি সানন্দ অন্তরে।।
জ্ঞাতি গোত্রগণ সঙ্গে হইল মিলন।
যুধিষ্ঠির পথ চাহি আছে সর্ব্বজন।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
বিরচিল পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস।।
০৯. চন্দ্রকালী পর্ব্বতে নকুলের ও
নন্দিঘোষ পর্ব্বতে অর্জ্জুনের দেহত্যাগ
মুনি বলে কহি শুন নৃপ জন্মেজয়।
চলিল উত্তরমুখে পাণ্ডুর তনয়।।
যাইতে উত্তরমুখে দেখেন রাজন।
সরোবর তীরে লিঙ্গ অতি সুশোভন।।
গঙ্গার সদৃশ দেখি সুনির্ম্মল জল।
কোকনদ প্রফুল্ল সহস্র শতদল।।
সরোবর আছে শত যোজন বিস্তার।
জল দেখি নৃপতির আনন্দ অপার।।
মৃগ পক্ষী হংস চক্র বিহরে বিস্তর।
ভ্রমর ঝঙ্কারে বনে জলে জলচর।।
অপরূপ দেবের দুর্ল্লভ সেই স্থান।
বসন্তে পবন মত্ত কোকিলের গান।।
পদ্মে আচ্ছাদিত সব নাহি দেখি নীর।
নিত্য স্নান হয় যাতে সদা ইন্দ্রাণীর।।
সেই সরোবরে স্নান করি চারিজন।
শোক দুঃখ ছাড়ি কিছু স্থির হৈল মন।।
তাহার পশ্চিমে গিরি চন্দ্রকালী নাম।
স্ফটিক নির্ম্মল দীপ্ত চন্দ্রের সমান।।
ভূবনের সার সে পর্ব্বত সুশোভন।
তাহাতে পাণ্ডব করিল আরোহণ।।
হিমে অঙ্গ জ্বর জ্বর গিয়া হিমালয়।
তাহে উঠি পাণ্ডব করেন জয় জয়।।
ধীরে ধীরে যান হিমে পদ নাহি চলে।
ঋষি মুনি তপস্বী দেখেন গঙ্গাকূলে।।
ষোড়শ সহস্র লিঙ্গ দেখি পঞ্চানন।
ভক্তিভাবে প্রণাম করেন চারিজন।।
বিচিত্র মণ্ডপ নানা দেবের আবাস।
ঋষি মুনি জপ তপ করে চারি পাশ।।
নৃসিংহের মূর্ত্তি দেখি পর্ব্বত উপরে।
দেবকন্যাগণ তাতে নিত্য পূজা করে।।
চারি ভাই প্রণাম করেন তাঁর পায়।
নৃসিংহ উদ্ধার কর ঘন বলে রায়।।
হিরণ্যকশিপু মারি রাখিলা প্রহলাদ।
স্বর্গপথে পাণ্ডবে রাখিবা অপ্রমাদ।।
অভয় নৃসিংহ নাম যে করে স্মরণ।
জলে স্থলে ভয় তার নাহি কদাচন।।
এত বলি বর মাগি নৃসিংহের ঠাঁই।
বিষাদ সন্তাপ তাপে যান চারি ভাই।।
কতদূরে দেখিলেন গিরি মনোহর।
নানা ধাতু বিরচিত প্রবাল পাথর।।
পশ্চাৎ করিয়া গিরি চলেন উত্তরে।
হিমেতে মন্থর পদ চলিতে না পারে।।
নকুলের অঙ্গে পড়ে শোণিত বহিয়া।
পর্ব্বতে পড়িল বীর আছাড় খাইয়া।।
গোবিন্দ চিন্তিয়া চিত্তে ত্যজিল পরাণ।
স্বর্গপুরে প্রবেশিল কৃষ্ণ বিদ্যমান।।
ধর্ম্মেরে কহিল তবে ভীম মহামতি।
পড়িল নকুল বীর শুন নরপতি।।
পাছে দেখি ধর্ম্মরাজ ভাবিলেন চিতে।
ছয় জন মধ্যে তিন রহিল পর্ব্বতে।।
তিনলোকে দুর্জ্জয় নকুল মহাবীর।
যাহার সংগ্রামে দেবাসুর নহে স্থির।।
হেন ভাই পড়ে মম পর্ব্বত উপরে।
কোন সুখে কি বলিয়া যাব স্বর্গপুরে।।
তাপের উপরে তাপ শোকে মহাশোক।
কাহারে কহিব দুঃখ হরি পরলোক।।
যামদিক যেই ভাই জিনিল সকলে।
যজ্ঞ করিবার কালে ধন আনি দিলে।।
স্বর্গ নাহি গেলা ভাই পড়িলে পর্ব্বতে।
তোমার বিচ্ছিদে প্রাণ ধরিব কিমতে।।
কান্দি জিজ্ঞাসেন ভীম নৃপতির স্থানে।
কোন পাপে নকুল পড়িল এইখানে।।
যুধিষ্ঠির কন শুন ভাই, বৃকোদর।
কুরুক্ষেত্রে হয় যবে ভারত সমর।।
কর্ণের সমর হৈল আমার সহিতে।
সেই কালে নকুল আছিল মম ভিতে।।
কর্ণের সংগ্রামে যবে মম বল টুটে।
সহায় না হৈল সেই বিষয় সঙ্কটে।।
যুদ্ধ না করিল ভাই আমার রক্ষণে।
এই পাপে পর্ব্বতে পড়িল পরিণামে।।
ইহা বলি যুধিষ্ঠির কান্দিতে কান্দিতে।
চলেন উত্তরমুখে ভাবিতে ভাবিতে।।
কতদূরে মহাহিমে যান তিন জন।
নন্দীঘোষ গিরি করিলেন আরোহণ।।
পদ্মরাগে বিরাজিত গিরি মনোহর।
নানা জাতি নর নারী পরম সুন্দর।।
মণি বিভূষিত যত দেবের বসতি।
সে বনেতে অক্ষয় অব্যয় হয় গতি।।
তিন ভাই করি তথা গোবিন্দ পূজন।
যোড়হাতে করিলেন কৃষ্ণের স্তবন।।
ভক্তিভাবে স্তুতি করে হয়ে কৃতাঞ্জলি।
জলপান করে যান হয়ে কুতূহলী।।
ভয়ঙ্কর নন্দীঘোষ পর্ব্বত বিশাল।
হিমাগমে মহাশীত বহে সর্ব্বকাল।।
পশু পক্ষী গাছ লতা নাহি সেই দেশে।
হিমের প্রতাপে নাশ হয়েছে বিশেষে।।
হিম ভেদি অর্জ্জুনের হরিল যে জ্ঞান।
গোবিন্দ ভাবিয়া চিত্তে ত্যজিলেন প্রাণ।।
দেবাসুরে দুর্জ্জয় সে পার্থ মহাবীর।
পতনে পর্ব্বতে কম্প পৃথিবী অস্থির।।
উল্কাপাত ঘোর বহে প্রলয়ের ঝড়।
ভল্লুবাদি বরাহ গণ্ডার আদি ঘোড়।।
ভীমসেন বলে শুন ধর্ম্মের নন্দন।
পর্ব্বতে পড়িয়া পার্থ ত্যজিল জীবন।।
যার পরাক্রমে যক্ষ নর নহে স্থির।
হেন ভাই পড়ে শুন রাজা যুধিষ্ঠির।।
প্রাণ দিল নন্দীঘোষ পর্ব্বত উপরে।
এত বলি বৃকোদর কান্দে হাহাকারে।।
চমৎকার চিত্ত হৈয়া চান ধর্ম্মরাজ।
না চলে চরণ চক্ষে নাহি দেখে কাজ।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে বিরচিল কাশীদাস।।
১০. যুধিষ্ঠিরের বিলা
ভীমের বচন শুনি, শোকে ধর্ম্ম নৃপমণি,
কান্দিছেন বিলাপ করিয়া।
হাহাকার ঘন মুখে, চাপড় মারিয়া বুকে,
পর্ব্বতে পড়েন লোটাইয়া।।
হায় পার্থ মহাবল, পাণ্ডবের বুদ্ধি বল,
পর্ব্বতে পড়িলা কি কারণে।
স্বর্গপুরে আরোহণ, না হইল বিচক্ষণ,
প্রাণ দিব তোমার বিহনে।।
ত্রিভুবন কৈলে জয়, মহাবীর ধনঞ্জয়,
নররূপে বিষ্ণু অবতার।
অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী, কৌরববাহিনী জিনি
মোরে দিলা রাজ্য অধিকার।।
রাজসূয় যজ্ঞকালে, জিনি নিজ বাহুবলে,
করিলা উত্তর দিক জয়।
শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞা নিয়া, সুরাসুর পুরী গিয়া,
নিমন্ত্রিয়া আনিলা সবায়।।
স্বর্গে যত দেবগণ, হইয়া সাদর মন,
দিল অস্ত্র মন্ত্রের সহিত।
তাহাতে সর্ব্বত্র জয়, করিলে শত্রুর ক্ষয়,
তব তুল্য নাহি পৃথিবীতে।
প্রবেশি কাননে, দেব পঞ্চাননে,
তুষিলা বাহুযুদ্ধেতে।
মারিলা অজস্র, কিরাত সহস্র,
একা তুমি কাননেতে।।
অমর সোসর, জিনিলে শঙ্কর,
ম্লেচ্ছ কিরাতের দেশ।
হৈয়া হৃষ্টচিত্ত, অস্ত্র পাশুপত,
দিলা প্রভু ব্যোমকেশ।।
কালকেয় আদি, যত সুরবাদী,
হেলায় করিলা নাশ।
যত দেবচয়, করিলা অভয়,
পূরাইয়া অভিলাষ।।
তাহে দেব অস্ত্র, পাইলা সমস্ত,
তোমার অজেয় নাই।
আর ধনুঃশর, দিলা বৈশ্বানর,
খাণ্ডব দহিলে ভাই।।
জিনি দেবগণ, দৈত্য অগণন,
অগ্নিরে সন্তোষ কৈলে।
ছাড়ি যাও তুমি, কিসে জীব আমি,
প্রাণ দিব শোকানলে।।
প্রাণাধিক বীর, ত্যজিলে শরীর,
নন্দীঘোষ গিরিবরে।
আমি পুনর্ব্বার, না দেখিব আর,
পড়িনু শোকসাগরে।।
ভারত সমরে, কর্ণ মহাবীরে,
বিনাশিলে ভীষ্ম দ্রোণে।
যাহার সহায়, যার ভরসায়,
প্রবল কৌরবগণে।।
তুমি মম প্রাণ, বীরের প্রধান,
সব শূণ্য তোমা বিনে।
মহাবীর তুমি, ঘন ডাকি আমি,
উত্তর না দেহ কেনে।।
নিদ্রা যাহ সুখে, আমি মরি শোকে,
উঠিয়া উত্তর দেহ।
কুরুগণে জিনি, লহ রাজধানী,
তাহার যুকতি কহ।।
রাজা ভূমে পড়ি, যান গড়াগড়ি,
না বান্ধেন কেশপাশ।
ভারত সঙ্গীত, শ্রবণে অমৃত,
বিরচিল কাশীদাস।।
ConversionConversion EmoticonEmoticon